আমাদের দেশে সাময়িক পত্রিকার দুটো বড় ধারা আছে—১. প্রথিতযশা পণ্ডিতবর্গের দুয়েকটা প্রবন্ধ আর সৃজনশীল সম্পাদকের আবেগী বন্ধুকৃত্যকে সম্বল করে বহমান সংকলনধর্মী লিটলম্যাগীয় ধারা; ২. বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকগণের পদোন্নতির সোপানরূপে, প্রধানত আমজনতার চক্ষুর অন্তরালে,
…….
যোগাযোগ; সংখ্যা ৮, ফেব্রুয়ারি ২০০৭; সম্পাদক: ফাহমিদুল হক, আ-আল মামুন; মূল্য: ১০০ টাকা; প্রচ্ছদ: শাহীনুর রহমান, দিয়াগো ভেলাসকেজের 'লাস মেনিনাস' পেইন্টিং অবলম্বনে।
……..
প্রকাশিত জার্নালীয় ধারা। এ-দুই বড় ধারার মাঝে আরেকটি ধারা ধীরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে বয়ে যাচ্ছে এ-দুয়েরই ধনাত্মক সারবত্তাকে আত্মস্থ করে। যোগাযোগ সে-ধারারই একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। যদিও সম্পাদক পত্রিকাটির পরিচয় দেওয়ার সময় বলে থাকেন 'অ্যাকাডেমিক পত্রিকা'১, যদিও পত্রিকাটির প্রতিটি লেখার মাথার ওপরে জার্নালীয় কায়দায় উল্লিখিত থাকে পত্রিকার নাম, সংখ্যা, প্রকাশের সাল (প্রবন্ধের পৃষ্ঠা নম্বরও দেওয়া থাকলে
—————————————————————–
যে-বৈশিষ্ট্যটি যোগাযোগকে স্বাতন্ত্র্য-ঋদ্ধ করেছে, তা হল এর উদ্দেশ্যের একমুখিনতা। বাংলাদেশের অধিকাংশ সাময়িক পত্রিকায় এর অভাব থাকার কারণে সামগ্রিকভাবে পত্রিকার কোনো চারিত্র দাঁড়ায় না।
—————————————————————-
জার্নালীয় ষোলকলা পূর্ণ হত), যদিও অ্যাকাডেমিক ও নন-অ্যাকাডেমিক লেখার জন্য পত্রিকাটিতে বরাদ্দ থাকে প্রায় ফিফ্টি-ফিফ্টি অংশ; তবুও পত্রিকাটির চারিত্র ওপরের ২ নম্বরি ধারায় পড়ে না। এখানেই যোগাযোগ-এর প্রতি আমার আন্তরিক পক্ষপাত। রাজনৈতিক ও দার্শনিক অবস্থানের সুস্পষ্টতার বিচারে এ-পত্রিকা এককথায় একমেবাদ্বিতীয়ম্। শুরুতেই তাই এর সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আমার সাধুবাদ।
দুই
যোগাযোগ এ-সংখ্যার ১৮টি লেখার মধ্যে ১১টি অনূদিত, ২টি গ্রন্থালোচনাই মূলত অনূদিত গ্রন্থ-বিষয়ক, প্রধান প্রবন্ধটিও একটি অনূদিত প্রবন্ধ। সঙ্গতভাবেই, এ-আলোচনায় অনূদিত লেখাগুলোর দিকেই আমাদের মনোযোগ বেশি থাকবে।
শুরুতেই দুটো পয়েন্ট দিয়ে রাখি। আলোচনায় এগুলোকে আমরা অনেকটা অনুসিদ্ধান্তের মতো ব্যবহার করব—
ক. বিশ্বস্ততা বনাম সফলতা: প্রতিটি ভাষার একটি নিজস্ব ভঙ্গি থাকে, অলংকার-প্রয়োগের স্বাতন্ত্র্য থাকে। মূলভাষার এ-দুই বৈশিষ্ট্যের সার্থক রূপান্তর ঘটানো গেলে অনুবাদ সফল হয়; না গেলে, ক্ষেত্রবিশেষে মূলের প্রতি বিশ্বস্ততা রক্ষা করা গেলেও, অনুবাদ অসুন্দর হয়। এ-বিষয়ে অতি-পরিচিত একটি লোকনিরুক্তি—'অনুবাদ বিশ্বস্ত হলে সুন্দরী হয় না; সুন্দরী হলে বিশ্বস্ত হয় না।'
খ. কুলীন রীতি বনাম ব্রাত্য রীতি: ভাষারীতি বিষয়ক বিতর্কটি প্রাচীন ও সনাতন। নানান প্রেক্ষাপটে এটি বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও ঘুরেফিরে এসেছে। সৃজনশীল রচনার ক্ষেত্রে অনুবাদকেরা যতটা স্বাধীনতা নিতে পারেন, তাত্ত্বিক রচনার ক্ষেত্রে ততটা পারেন না। ফলে, সৃজনশীল রচনায় আটপৌরে ভাষারীতির ব্যবহার হয়ে থাকলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাত্ত্বিক রচনায় অনুবাদকেরা সাধুরীতির কাছাকাছি একধরনের কুলীন ভাষারীতির আশ্রয় নেন। ফলে রচনা আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। তার ওপর, বিষয়বস্তুর ব্যাপারে অনুবাদকের স্পষ্ট ধারণা না থাকলে অনুবাদ হয়ে পড়ে ভীষণ গোলমেলে ও দুর্বোধ্য।
রিপ্রেজেন্টেশন বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সংস্কৃতি-তাত্ত্বিক স্টুয়ার্ট হলের প্রবন্ধ 'দ্য ওয়ার্ক অব রিপ্রেজেন্টেশন'-এর বঙ্গানুবাদ করেছেন ফাহমিদুল হক। বিদ্যায়তনের অধুনাতন প্রসঙ্গে লেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ-প্রবন্ধ বাংলায় পড়তে পারাটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। অনুবাদকের দায়বদ্ধতা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই, অনুবাদটিকে এখন উল্লিখিত পয়েন্টদুটোর সঙ্গে মিলিয়ে পড়ব।
তাত্ত্বিক প্রবন্ধ অনুবাদের প্রধান সমস্যা হল পরিভাষা। ফাহমিদুল হক তাই শুরুতেই পরিভাষাগুলোর একটা তালিকা দিয়ে বলেছেন, প্রবন্ধ পড়ার সময় তালিকাটিকে 'অভিধানের মতো ব্যবহার করা যাবে।' তালিকাটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক—
'যুক্তিসিদ্ধ-নয়' একেবারেই 'অভিধানের মতো' করে বানানো পরিভাষা। 'arbitrary'-র জন্য বাংলা পারিভাষিক শব্দ হিসাবে অনায়াসে ব্যবহার করা যেত 'আরোপিত'; 'intentional'-এর বাংলায় 'স্বেচ্ছাকৃত'-র চাইতে বেশি পরিচিত ও সহজ শব্দ 'ইচ্ছাকৃত'; 'ঐক্ষিক' শব্দের চাইতে অনেক সহজ ও সুন্দর 'দৃশ্যগত'। 'substitution'-এর পরিভাষা 'প্রতিকল্প' একেবারেই ভুল; এটা ব্যবহার করা যায় 'substitute'-এর বাংলা হিসাবে। আর, এর চাইতে সহজ হয় 'substitute'-এর বাংলায় 'বিকল্প' ও 'substitution'-এর বাংলায় 'বিকল্পন' ব্যবহার করা হলে। 'encoding' ও 'decoding'-এর বাংলায় যথাক্রমে 'সংহিতায়ন' ও 'বিসংহিতায়ন' সাধারণ্যে কিছুটা অপরিচিত হলেও, আমার মনে হয়, শব্দদুটো পরিভাষা হিসাবে চমৎকার। 'constructionist'-এর বাংলা 'নির্মাণমূলক'-এর চাইতে 'নির্মাণবাদী' উপযুক্ততর।
স্টুয়ার্ট হলের ব্যবহৃত 'অ্যাক্টিভিটি' শব্দটি ফাহমিদুল হক উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে অননূদিত রেখে দিয়েছেন (পৃ. ৮), অথচ এ-অর্থে পাঠ্যবইয়ে 'অনুশীলনী' বা 'অনুশীলন' শব্দের ব্যবহার অনেক পুরনো ও যথোপযুক্ত। 'relational'-এর বাংলা তিনি যে-অর্থে লিখেছেন 'সম্পর্কিত', সে-অর্থে 'আপেক্ষিক' শব্দটা অবিকল্পভাবে বাংলায় বহুকাল ধরে চলছে। 'নির্মাণমূলক তত্ত্বানুসারীরা বলেন, অর্থ হলো সম্পর্কিত' (পৃ. ২০)—বাক্যটিকে এভাবে লিখা যেত: 'নির্মাণবাদীদের মতে অর্থ আপেক্ষিক'। 'ভাষায় সঞ্চিত শব্দ' না লিখে তিনি লিখেছেন 'ভাষায় সংরক্ষিত শব্দ' (পৃ. ১৭)।
' "ডিসকোর্স জ্ঞানের উদ্দিষ্ট (object) উৎপন্ন করে" এবং ডিসকোর্সের বাইরে অর্থপূর্ণ কিছুই নেই—এই ধারণা—প্রথমাবস্থায় মনে হতে পারে উত্তেজনাকর অবস্থান, যাকিনা সাধারণ-জ্ঞান-ভাবনার বিরোধী।' (পৃ. ৩৪) এখানে অনুবাদক খেয়াল করেন নি যে, বাংলায় কোনো কিছু 'উৎপন্ন করে' না, 'উৎপাদন করে'; আর 'উৎপন্ন হয়'। 'উত্তেজনাকর অবস্থান' দেখে পাঠক যদি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তা হলে এর দায় কিন্তু অনুবাদককেই নিতে হবে। 'যাকিনা'র বদলে 'যা কিনা' লেখা সঙ্গত। 'সাধারণ-জ্ঞান-ভাবনা', নাকি 'সাধারণ জ্ঞান-ভাবনা'? মানে, ভাবনা সাধারণ, নাকি 'সাধারণ জ্ঞান'-এর? সহজেই বোঝা যাচ্ছে, 'সাধারণ' শব্দটা 'জ্ঞান-ভাবনা'র বিশেষণ। সে-ক্ষেত্রে লিখা উচিত 'সাধারণ জ্ঞান-ভাবনা'।
ইংরেজিতে 'narrow down' বলতে যা বোঝায়, তার বাংলা করতে গিয়ে ফাহমিদুল হক কোথাও 'কমিয়ে আনা', কোথাও 'নামিয়ে আনা' ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত সেটাকে পাঠকের কাছে 'নামিয়ে আনতে' পারেন নি। উদাহরণ: 'ভাষা নিয়মতাড়িত। কিন্তু এটি একটা বদ্ধ পদ্ধতি নয় যাকে এর আনুষ্ঠানিক উপাদানে কমিয়ে আনা যাবে।' (পৃ. ২৬) পর পর লিখিত 'এটি' এবং 'একটা'-তে একই নির্দেশকের দুই রূপ 'টি' ও 'টা'-এর ব্যবহারও লক্ষণীয়।
আচ্ছা, বাংলায় কি কোনো ছবিকে কোনো নামে 'ডাকা হয়'? অনুবাদক লিখেছেন, 'পরে ছবিটিকে ডাকা হতো লাস মেনিনাস—'সম্মানিত পরিচারিকা' '! (পৃ. ৪৩)
ইংরেজি ভাষায় বস্তুবাচক বিশেষ্য প্রায়ই বাক্যের কর্তা হয়ে থাকে। বাংলায় সেটা সাধারণত হয় না ('সাধারণত' বলছি এ-কারণেই যে, বাংলায় কর্মকর্তৃবাচ্যের কর্তার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। যেমন: 'বইটা পড়ে গেল।'); কিন্তু অনুবাদে হয়! প্রবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদটি শুরু হয়েছে এভাবে: 'মনে রাখতে হবে, এই প্রবন্ধ বলতে চাচ্ছে না যে ডিসকার্সিভ এ্য[অ্যা]প্রোচ সেমিওটিকস [সেমিওটিক] এ্যপ্রোচের সবকিছুকে উল্টে দিয়েছে। তাত্ত্বিক অগ্রগতি এরকম রৈখিক দিকনির্দেশনা ধরে চলে না।' (পৃ. ৪৯) এমন অনুবাদ 'বলতে চাচ্ছে', অনুবাদক এখানে 'রৈখিক দিকনির্দেশনা ধরে' এগিয়েছেন!
বিশ্বস্ত অনুবাদের বিড়ম্বনা এমনই। উদাহরণ বাড়িয়ে পাঠকের বিড়ম্বনা বাড়াতে চাই না। আশা করি, 'ক' পয়েন্টটাকে স্পষ্ট করতে এ-কয়টা উদাহরণই যথেষ্ট।
প্রবন্ধের গোড়ায় রিপ্রেজেন্টেশনের পরিচয়ে বলা হয়েছে: 'রেপ্রিজেন্টেশন হলো এমন একটা প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য অংশ যার মাধ্যমে একটা সংস্কৃতিতে এর সদস্যদের মধ্যে অর্থ উৎপন্ন ও বিনিময় হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে ভাষা, চিহ্ন ও ইমেজের ব্যবহারসূত্রে বিভিন্ন বিষয়ের অর্থ নির্দেশ বা উপস্থাপন করা হয়।' (পৃ. ৯; নিম্নরেখ আমার) সামান্য ভাষাগত ত্রুটি (নিম্নরেখ অংশে বাক্যের একই কর্তার জন্য পর পর ব্যবহৃত দুটো শব্দের পদ ভিন্ন হয়ে গেছে। লেখা উচিত ছিল 'অর্থের উৎপাদন ও বিনিময় হয়ে থাকে' অথবা 'অর্থ উৎপন্ন ও বিনিমিত হয়ে থাকে') সত্ত্বেও বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না এবং ভাষাও খুব একটা টাল খাচ্ছে না। কিন্তু পরের বাক্যটি এমন: 'এরকম সরল-সিধা ও সোজাসাপ্টা প্রক্রিয়া থেকে রেপ্রিজেন্টেশন আসলে যোজন দূরে তৎপর থাকে, অচিরেই, এই লেখায় আপনি তা ধরে ফেলতে সক্ষম হবেন।' আশা করি, পাঠক 'অচিরেই' ধরে ফেলতে 'সক্ষম হবেন' 'খ'-পয়েন্টের মাজেজা!
অর্থ (meaning) সম্পর্কে তাত্ত্বিক কিছু লিখতে গেলে 'অর্থ' শব্দটাই যে অনর্থ ঘটায়, এর উদাহরণ পাচ্ছি এ-বাক্যে: 'এই প্রেক্ষাপটে রেপ্রিজেন্টেশন শব্দটি সত্যিকার অর্থে কী মানে বহন করে?' (পৃ. ৯) 'অর্থ' শব্দটা অনর্থকভাবে প্রথমে একবার ব্যবহার করে ফেলায় অনুবাদককে বিপাকে পড়তে হয়েছে। ফলও পাওয়া গেছে হাতেনাতে—পরে সমার্থক 'মানে' শব্দ ব্যবহার করায় বাক্যের জোরটা যেখানে পড়ার কথা ('মানে'র ওপর) সেখানে পড়ে নি; গিয়ে পড়েছে ঐ অনর্থক 'অর্থ'টার ওপর। বাক্যটাকে এভাবে লিখলে বিপত্তি এড়ানো যেত: 'এই প্রেক্ষাপটে রেপ্রিজেন্টেশন শব্দটি আদতে কী অর্থ বহন করে?'
এসব অনুবাদ-সম্পর্কিত দুর্বলতা ছাড়াও প্রবন্ধটিতে আছে সাধারণভাবে বাংলা ভাষাপ্রয়োগের দুর্বলতাও।
'কথামালাগুলো' (পৃ. ৮) শব্দটিতে 'মালা' ও 'গুলো'র একই অর্থ, দুইবার বহুবাচক করে ভুল করা হয়েছে। 'বর্ণমালাসমূহ' শব্দটি যে-অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে, সে-অর্থে তা দুইবার বহুবচন করার দোষে দুষ্ট। ' 'বৃক্ষ' ধারণাটি ব-ঋ-ক্-ষ-অ বর্ণমালাসমূহ দ্বারা উপস্থাপিত যা একটি নির্দিষ্ট ক্রমে সাজানো' (পৃ. ১৪)—এখানে 'বর্ণসমূহ' বা 'বর্ণগুলো' লিখা সমীচীন। 'বর্ণমালাসমূহ' শব্দটি শুদ্ধ হতে পারে কেবল একাধিক ভাষার বর্ণমালার (alphabet) কথা বলা হলে। আরও লক্ষণীয়, 'বৃক্ষ' শব্দে 'ষ'-এর পরে কিন্তু আর কোনো বর্ণ নেই; অনুবাদক যে-'অ'টি যোগ করেছেন সেটি বর্ণ নয়, ধ্বনি।
বস্তুবাচক সর্বনাম ও ব্যক্তিবাচক সর্বনাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে গোলযোগ বাংলা লেখায় প্রায়ই চোখে পড়ে। ফাহমিদুল হকও বাদ যান নি। 'আর যে-সমস্ত তত্ত্ব অর্থের এই মৌলিক মডেল অনুসরণ করে, সামাজিক বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক অধ্যয়নে তাদের 'ভাষাতাত্ত্বিক ঝোঁকসম্পন্ন বলা হয়ে থাকে' (পৃ. ১২)—এখানে 'তাদের' শব্দটা ব্যক্তিবাচক ঝোঁকসম্পন্ন বলে এ-বাক্যে বস্তুবাচক 'সেগুলোকে' ব্যবহার করা সমীচীন। একইভাবে, 'কার সঙ্গে কী যাবে না তাও নির্দিষ্ট থাকে—সান্ধ্য পোশাকের সঙ্গে বেল্ট পরিত্যাজ্য' (পৃ. ২৮)—এখানে বস্তুবাচক 'কীসের' ব্যবহার করা সমীচীন; ব্যক্তিবাচক 'কার' পরিত্যাজ্য।
'সস্যুরের ভাষার প্রতি এধরণের আলোকপাত খুবই অনন্য মনে হতে পারে।'—পদবিন্যাসের ত্রুটির কারণে বাক্যটি দ্ব্যর্থক হয়ে পড়েছে। অদ্ব্যর্থক পদবিন্যাস হবে: 'ভাষার প্রতি সস্যুরের এ-ধরনের আলোকপাত অনন্য মনে হতে পারে।'
গুরুতর একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে এ-প্রবন্ধের আলোচনা শেষ করব। চিহ্নের রকমফের বোঝাতে গিয়ে বলা হয়েছে:
চিহ্নবিদ্যায় যাদের হাতেখড়িমাত্র হয়েছে তারাও জানেন, লেখ্য বা কথ্য চিহ্ন সাংকেতিক (symbolic); নির্দেশক নয়। সাংকেতিক চিহ্নে দ্যোতক ও দ্যোতিতের মধ্যে সম্পর্ক এমন থাকে যে, চিহ্নের অর্থ বোঝার জন্য সেটা শিখে নেওয়ার দরকার পড়ে। যেমন: মানুষের ভাষা। আর প্রতীকী (iconic) চিহ্ন হল সেগুলোই, যেগুলোতে দ্যোতক ও দ্যোতিতের মধ্যে সাদৃশ্যের সম্পর্ক থাকে। যেমন: খাতায় আঁকা গাছের ছবি, ব্যঙ্গচিত্র ইত্যাদি। অন্যদিকে, নির্দেশক (indexical) চিহ্নে দ্যোতক ও দ্যোতিতের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক থাকে। চিহ্নের অর্থ বোঝার জন্য এ-ক্ষেত্রে কোনো প্রশিক্ষণের দরকার পড়ে না। যেমন: ধূঁয়া, দরজায় টোকা ইত্যাদি।২ আরও লক্ষণীয়, 'iconic'-এর বাংলায় ফাহমিদুল হক লিখেছেন 'প্রতিমাময়'। এ-নিয়ম মেনে 'symbolic'-এর বাংলা লিখতে হয় 'সংকেতময়', 'linguistic'-এর বাংলা 'ভাষাময়', 'geometric'-এর বাংলা 'জ্যামিতিময়'!
পরবর্তী লেখাটি জার্মান সাহিত্যসমালোচক ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের বিখ্যাত প্রবন্ধ 'দ্য ওয়ার্ক অব আর্ট ইন দ্য এজ অব মেকানিকাল রিপ্রোডাকশন'-এর বঙ্গানুবাদ 'যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকলা'। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, 'ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের অতি-মূল্যবান লেখাটির সাবলীল অনুবাদ করেছেন জাকির হোসেন মজুমদার ও মোহাম্মদ আজম।' 'ক' ও 'খ' পয়েন্টের আলোকে এবার 'সাবলীল অনুবাদ'টা পাঠ করা যাক।
'the work of art'-এর বাংলায় সম্পাদক ব্যবহার করেছেন 'শিল্পবস্তু', প্রবন্ধের শিরোনামে অনুবাদকদ্বয় ব্যবহার করেছেন 'শিল্পকলা', একই অর্থে প্রবন্ধের ভিতরে তারা ব্যবহার করেছেন 'শিল্পবস্তু'ও। ইংরেজি 'art'-এর বাংলায় 'শিল্পকলা' এবং 'work of art'-এর বাংলায় 'শিল্পকর্ম' বহুল ব্যবহৃত ও যথোপযুক্ত। ইংরেজি শিরোনামটির বিশ্বস্ত অনুবাদ হত 'যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকর্ম' লিখলে। অনুবাদকদ্বয় একই অর্থে কোথাও 'শিল্পকলা', 'শিল্পবস্তু', কোথাওবা 'শিল্পকর্ম' শব্দ ব্যবহার করেছেন সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই।
উদ্ধৃতিটিকে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন প্রবেশকের মতো ব্যবহার করেছেন, যেখানে পুরো প্রবন্ধের বক্তব্যের শাঁসটা পাওয়া যায়। দীর্ঘ হলেও উদ্ধৃতিটি তাই পুরো তুলে দিলাম। এর বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে:
দেখতে পাচ্ছি, মূলে 'সুদূর অতীতে'র কোনো ব্যাপারই ছিল না। অনুবাদকেরা হয়তো অর্থ স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে এটা আমদানি করেছেন, কিন্তু এর কোনো দরকার ছিল না। অপ্রয়োজনীয়ভাবে এ-আমদানি করতে গিয়ে তারা আরেকটি বিপত্তিও ঘটিয়েছেন। সেটা হল 'ঘরানা' শব্দের ব্যবহার। 'ঘরানা' বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, তা 'সুদূর অতীতে'র নয়, বরং অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের ব্যাপার। আর মূলে 'types' বলতে মোটেও 'ঘরানা' বোঝানো হয় নি, বোঝানো হয়েছে শিল্পকলার বিভিন্ন 'ধরন'কে। যেমন: চিত্রশিল্প, মৃৎশিল্প প্রভৃতি। সম্ভবত একই উদ্দেশ্যে অনুবাদকেরা 'নানান বিবেচনা'য় কথাটাও আমদানি করেছেন। এরও প্রয়োজন ছিল না। তৃতীয় বাক্যে 'আন্দাজ' শব্দটা একেবারেই খাপ খায় নি। সহজ ও প্রচলিত শব্দ 'ধারণা' ব্যবহার করলে মূলের প্রতি বিশ্বস্তও থাকা যেত, আড়ষ্টতাও এড়ানো যেত। পরের বাক্যের 'শারীরী অঙ্গসংস্থান' একইসঙ্গে আমাদের 'ক' ও 'খ' অনুসিদ্ধান্তের উপযুক্ত উদাহরণ! অঙ্গসংস্থানের ব্যাপারটা এখানে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক। কথাটা এখানে শিল্পের বস্তুগত বা উপকরণগত দিক নিয়ে। 'শারীরী' শব্দটিও ভুল; 'শরীর' শব্দের শুদ্ধ বিশেষণ 'শারীর' বা 'শরীরী'। শেষ বাক্যে 'বড় ধরনের সৃষ্টিশীলতা' সৃষ্টি করেছে বড় ধরনের গোলযোগ! এখানে ব্যবহার করা উচিত ছিল 'উদ্ভাবনা' বা 'আবিষ্কার'। 'আবিষ্কার' ব্যবহার করলে 'invention' শব্দের বাংলা 'উদ্ভাবন'-এর সঙ্গে গোলযোগ বাধারও আশঙ্কা থাকত না। তবে, 'উদ্ভাবন' ও 'উদ্ভাবনা' ব্যবহার করলে মূলের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে বাংলা ভাষায় শব্দটির দুটো রূপের চমৎকার প্রয়োগ দেখানো যেত। 'amazing'-এর বাংলায় 'রোমাঞ্চকর'-এর চাইতে বিশ্বস্ত ও সুন্দর হতে পারত 'বিস্ময়কর'। অনুবাদটা হতে পারত এমন: 'আমরা এমন সব বড় বড় উদ্ভাবনার আশা করতে পারি, যা শিল্পকলার যাবতীয় কৌশলকে পাল্টে দেবে, পরিণামে শৈল্পিক উদ্ভাবনের ব্যাপারটিকেই প্রভাবিত করবে, এবং হয়তো শিল্পকলা সম্পর্কে আমাদের ধারণাতেই বিস্ময়কর পরিবর্তন আনবে।' অথবা এমন: 'এমন সব বড় বড় আবিষ্কারের প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি, যা শিল্পকলার যাবতীয় কৌশলকে পাল্টে দেবে, পরিণামে শৈল্পিক উদ্ভাবনের ব্যাপারটিকেই প্রভাবিত করবে, এবং হয়তো শিল্পকলা সম্পর্কে আমাদের ধারণাতেই বিস্ময়কর পরিবর্তন আনবে।' নিম্নরেখ প্রত্যয় খেয়াল করলে প্রত্যয়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার করে কীভাবে বক্তব্যের জোর বা ঝোঁককে ধরা যায়, সেটা বোঝা যাবে। অনুবাদের পারদর্শিতা জাহির করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার করা এ-দুটো অনুবাদও 'ক' অনুসিদ্ধান্তের বাইরে নয়। মূলানুগ থেকে কতটা সহজবোধ্য অনুবাদ করা যায়, সে-চেষ্টাই করা গেল।
'একজন মঞ্চাভিনেতা দর্শকের সামনে নিজের অভিনয়শৈলীর উপস্থাপনা ব্যক্তি-স্বরূপেই করে থাকেন। কিন্তু চিত্রাভিনেতার ক্ষেত্রে তা উপস্থাপিত হয় ক্যামেরার মাধ্যমে। অভিনয়ের পর অন্তত দু'ধাপ পেরিয়ে তা দর্শকের কাছে পৌঁছে।' (পৃ. ৬২)—এটাকে এভাবে লিখলে অর্থ স্পষ্ট হত, বাক্য ভাঙাভাঙিও এড়ানো যেত: 'মঞ্চাভিনয়ে অভিনেতা দর্শকের সামনে স্ব-শরীরেই উপস্থাপনা করে থাকেন, কিন্তু চিত্রাভিনেতার ক্ষেত্রে তা দর্শকের কাছে পৌঁছে ক্যামেরার মাধ্যমে, মাঝে দুই ধাপ পেরিয়ে।'
'অন্যগুলো ছিল একেশ্বর এবং পুনরুৎপাদনের অনুপযোগী' (পৃ. ৫৫)—এখানে 'unique' অর্থে 'একেশ্বর' শব্দের ব্যবহার অপ্রয়োজনীয়, বেখাপ্পা ও গোলমেলে। অনুবাদকদ্বয় অভিধান দেখে 'landscape'-এর বাংলা করেছেন 'ভূ-প্রাকৃতিক দৃশ্য' (পৃ. ৫৬); এখানে 'নিসর্গদৃশ্য' লেখা যেত বা 'ল্যান্ডস্কেপ' রেখে দেওয়া যেত। 'নিশ্চয় ছবিসম্বলিত ম্যাগাজিন ও সংবাদনির্ভর ছায়াছবি যে-ধরনের পুনরুৎপাদিত ছবি হাজির করে, তা খালি চোখে দেখা ছবি থেকে পৃথক।' (পৃ. ৫৮; নিম্নরেখ আমার)—এ-বাক্যে দ্বিতীয় 'ছবি'টির জায়গায় 'দৃশ্য' রাখলে বুঝতে সুবিধা হত, খালি চোখে দেখতেও অসুবিধা হত না!
পদপ্রয়োগের অসতর্কতা কীভাবে দ্ব্যর্থতা সৃষ্টি করে, এর একটা মজার দৃষ্টান্ত পাচ্ছি এ-বাক্যে: 'মার্কস যে-কালে পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন, তখনো তার শিশুকাল কাটে নি।' (পৃ. ৫৪) মনে হচ্ছে, তখনো মার্কসের শিশুকাল কাটে নি! এখানে 'তার'-এর পরিবর্তে বস্তুবাচক 'এর' সর্বনাম ব্যবহার করলেই দ্ব্যর্থতা কেটে যেত।
বাংলায় অনেক আরবি-ফারসি শব্দ এমনভাবে আত্মীকৃত হয়ে গেছে যে, পড়ার সময় ওগুলোকে বিভাষী শব্দ বলে মনেই হয় না। শৈলীসচেতন লেখকদের রচনায় বিদেশি শব্দের চমৎকার আলংকারিক প্রয়োগও দেখা যায়। কিন্তু এ-প্রবন্ধে 'হদিস', 'এনতেজাম', 'জাহির', 'ফজিলত' প্রভৃতি আরবি এবং 'কামিয়াব' প্রভৃতি ফারসি শব্দ অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বক্তব্যও টাল খেয়ে গেছে। কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি: 'পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থার মূল প্রবণতাগুলো চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে তা কী রূপ নেবে, তার হদিস ['directed' অর্থে] দেওয়াই ছিল মার্কসের লক্ষ্য।' (পৃ. ৫৪; নিম্নরেখ আমার); 'এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে আলোক প্রক্ষেপণ বা এতদসংশ্লিষ্ট এনতেজামের ['installation' অর্থে] কথা বলতে পারি।' (পৃ. ৬৪; নিম্নরেখ আমার); 'আর আজ নিজ পেশার অভিজ্ঞতা, অভাব-অভিযোগ, প্রামাণ্য দলিল কিংবা আরও অনেক কিছু কোনো-না-কোনোভাবে ছাপানোর সুযোগ পান না—এমন কামিয়াব ['gainfully employed' অর্থে] ইউরোপীয় খুঁজে পাওয়াই মুশকিল।' (পৃ. ৬৫; নিম্নরেখ আমার); 'একটা বিবর্ধিত স্ন্যাপশট আমাদের পরিচিত বস্তুকে আরও নিখুঁত ও স্বচ্ছভাবেই কেবল উপস্থাপনা করে না, সংশ্লিষ্ট বস্তুটির অন্ধিসন্ধির নানা অজানা খবরও জাহির ['reveal' অর্থে] করে।' (পৃ. ৬৯; নিম্নরেখ আমার); 'এখানেই ক্যামেরার ফজিলত' [মূলে ছিল না, অনুবাদকেরা এটি আমদানি করেছেন] (পৃ. ৬৯; নিম্নরেখ আমার) ইত্যাদি। 'যে দৃষ্টি আচারমূল্যকে জাহির রাখে, এই ভঙ্গি সে বস্তু নয়।' (পৃ. ৬৩)—এখানে 'জাহির' শব্দের বদলে 'জারি শব্দ ব্যবহার করলে ভঙ্গিটাও 'জাহির' করা যেত, মূলের ব্যঞ্জনাটাও 'জারি' থাকত!
যোগাযোগ-এর বর্তমান সংখ্যার প্রথম দুটো প্রবন্ধকে উদাহরণ হিসাবে নিয়ে, তাত্ত্বিক প্রবন্ধ বঙ্গানুবাদের সমস্যার স্বরূপ সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু আলাপ সারা গেল। এ-সংখ্যার অন্যান্য অনূদিত লেখার ক্ষেত্রেও আমাদের অনুসিদ্ধান্তদুটো কমবেশি প্রযোজ্য। তাই, সবগুলো লেখার বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে পরের লেখাগুলোর আলাপ আমরা সংক্ষেপে সেরে নেব।
ওপরে আলোচিত প্রবন্ধদুটোর পরে আছে আবদুল্লাহ আল মামুনের দুটো অনুবাদ-প্রবন্ধ 'ইতিহাসের দর্শনবিষয়ক সূত্রাবলি' ও 'প্রতীকজগত'। প্রথমটির মূল প্রবন্ধকার ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, দ্বিতীয়টির জাক লাকাঁ। অনুবাদের ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আল মামুন বেশ সতর্ক ও যথাসম্ভব মূলানুগ। 'ক' আর 'খ' তো আছেই, তার অনুবাদে আছে এমন বাক্যও:
নিম্নরেখাহীন অংশে, ইংরেজি বাক্যের বিন্যাস অন্ধভাবে অনুসরণ করার কারণে তিনি 'হচ্ছে' শব্দটিকে বিচ্ছিন্ন রেখে দিয়েছেন। ফলে, বাক্যটা 'হচ্ছে'তে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে। আর নিম্নরেখ অংশ অনুবাদের ব্যর্থতা ও শোচনীয়তার উদাহরণ!
লুসি লিনফিল্ড থেকে অনুবাদ করেছেন এ এস এম আসাদুজ্জামান, রচনার শিরোনাম 'পলকের (ফ্রেম) বন্দিশালা'। কিছুটা স্বাধীনতা নিয়ে অনুবাদকে সাবলীল ও প্রাঞ্জল করে তোলার যথেষ্ট সুযোগ মূল রচনায় ছিল, কিন্তু অনুবাদক তা নেন নি। তিনি তৈরি করেছেন এরকম বাক্য: 'অবশ্যই আলোকচিত্র আমাদের কিছু দেখায়, তবে যেহেতু এর বর্ণনক্ষমতা নেই, তাই চিত্র আসলে আমাদের কিছুই বলে না।' (পৃ. ৯৫); 'আমরা আক্রান্তদের দেখতে ভয়ঙ্করভাবে দক্ষ হয়ে গেছি, যাদের প্রয়োজন আমাদের দান।' (পৃ. ৯৭)। বাংলা ভাষায় এ-ধরনের অনুবাদ দেখতে আমরা এতটাই 'ভয়ঙ্করভাবে দক্ষ হয়ে গেছি' যে, এ-বিষয়ে আমাদের আর 'বর্ণনক্ষমতা' নেই!
লরা মালভি-র 'ভিসুয়াল প্লেজার এন্ড ন্যারেটিভ সিনেমা' প্রবন্ধের ফাহমিদুল হক-কৃত অনুবাদ 'চোখের আরাম ও বর্ণনাধর্মী চলচ্চিত্র'। এ-অনুবাদ তাকে এতটাই ভুগিয়েছে যে, অনুবাদের বাইরে নিজের লেখা ভূমিকায়ও তিনি তৈরি করেছেন ইংরেজি-ধরনের এ-রকম কিম্ভূত বাক্য: 'ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, এপর্যন্ত অনুবাদকর্মের যা-অভিজ্ঞতা, এটিই সম্ভবত, সবচেয়ে ভুগিয়েছে আমাকে।' (পৃ. ১২০) 'তাই তুষ্টিদায়ক তাকানো উপাদানগতভাবে হুমকিস্বরূপ, এবং নারীই রেপ্রিজেন্টেশন/ইমেজ হিসেবে এই প্যারাডক্সকে স্ফটিকীকরণ করে' (পৃ. ১২৫)—অত্যন্ত 'তুষ্টিদায়ক' ও 'স্ফটিক-স্বচ্ছ' অনুবাদের দৃষ্টান্ত!
'গণমাধ্যম নিয়ে বুশের দোষারোপ-নাটক' শিরোনামের লেখায় ('মিডিয়া চ্যানেল' সাইটে জনৈক নরমান সলোমনের ২৩ মার্চ ২০০৬ তারিখে পোস্ট করা ব্লগের অনুবাদ) পাচ্ছি এ-ধরনের বঙ্গাক্ষরিকানুবাদ: 'কিন্তু সিএনএন বা ফক্স টিভিতে, সংবাদ শিরোনামে, স্থানীয় সংবাদে এই ভিডিও-ফুটেজ প্রচারিত হবে না … কারণ … এর আধেয় ভালো ও প্রশংসনীয়'; 'আর এই অভিযোগগুলো যুদ্ধ-সমর্থক গণমাধ্যমগুলোতে রুটিনমাফিক বৃদ্ধি পাচ্ছে' (পৃ. ২৫২; নিম্নরেখ আমার)। তবে, অনুবাদক শাওন্তী হায়দারের মুনশিয়ানারও ছাপ আছে কয়েক জায়গায়। আলংকারিক ধ্বনিপ্রয়োগে সরস বঙ্গানুবাদ: 'বৃথা বকবকানির বাতিল বাদশাহ' ও 'বিত্তবানের পা-চাটা বলহীন বেহায়া বাহিনী।' (পৃ. ২৫৩)
নোয়াম চমস্কির একটি সাক্ষাৎকারের সাবলীল বঙ্গানুবাদ করেছেন উদিসা ইসলাম। তবে, এ-রকম দৃষ্টান্তও এখানে আছে: 'ইন্ডাস্ট্রি দুটো কথা মনে রাখে। সেটা হলো বিষয়বস্তু এবং জায়গা ভরে ফেলা। বিষয়বস্তু হলো বিজ্ঞাপিত বিষয়, আর জায়গা ভরে ফেলা হলো গাড়ি চালানো প্রতিযোগিতা অথবা যৌন-উদ্দীপক দৃশ্য অথবা এধরনের কিছু যেগুলো বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে আপনি দেখে থাকেন।' (পৃ. ২৫৬-২৫৭; নিম্নরেখ আমার); 'আপনি বা অন্য অনেকেই আছেন যারা এ্যনিমেল ফার্ম বইটি পড়েছেন কিন্তু বইটির সূচনা পাঠ করেননি।' (পৃ. ২৫৯) বর্তমান লেখার 'সূচনা' যারা পাঠ করেছেন, তাদের নিশ্চয়ই 'ক' ও 'খ'-ধরনের কিছু মনে পড়ছে!
আফরোজা বুলবুলের অনুবাদ 'শিশুদের বিজ্ঞাপনে উপস্থাপিত 'পরিবার' : একটি সেমিওটিক বিশ্লেষণ'-এ পাচ্ছি এ-ধরনের শব্দপ্রয়োগ ও বাক্য: 'এসব ক্ষেত্রে কল্পনা ও মতাদর্শের উপস্থাপনের সাথে সাথে ছাঁচীকৃত ধ্যান-ধারণার সমর্থনের ফলে বাস্তবতার বিচ্যুতি ঘটে।' (পৃ. ২৬২); 'এর মাধ্যমে, বিজ্ঞাপন শিশুদের ওপর কী-ধরনের প্রভাব ফেলে সেসম্পর্কে প্রমিত যুক্তিতর্কের অবতারণা হয়।' (পৃ. ২৬২); 'কিন্তু ভালোবাসার সাথে এসব ক্রিয়াকলাপকেন্দ্রিক অনুভূতির কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই।' (পৃ. ২৬৫) অনুবাদের 'ক্রিয়াকলাপকেন্দ্রিক' আলোচনায় এরকম 'ছাঁচীকৃত' অনুবাদ কিছু 'প্রমিত যুক্তিতর্কের' অবতারণা করতে পারে বৈকি!
এডগার স্নো-র বিশেষ কিছু লেখার অনুবাদের সংকলন জেগে ওঠা মানুষের বার্তাবহ আর ফিদেল কাস্ত্রো-র একটি বক্তৃতার অনুবাদ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন নিয়ে আলোচনা করেছেন ওমর তারেক চৌধুরী। আলোচনাটি পরিচিতিমূলক ও প্রেক্ষাপট-নির্ভর।
নোয়াম চমস্কির 'দিল্লি-বক্তৃতা'র অংশবিশেষের অনুবাদ করেছেন মাহমুদুল সুমন। মূলানুগতার পরাকাষ্ঠা ও কষ্টকল্পনার কাষ্ঠালয় এ-অনুবাদ। প্রথম বাক্যটি এমন: 'ভাষার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে যা অনেক কাল ধরেই মানুষ স্বতপ্রণোদিতভাবেই বুঝে ফেলেছে।' (পৃ. ২৭৭) আশা করি, এর মাজেজা পাঠক 'স্বতপ্রণোদিতভাবেই' বুঝে ফেলেছেন 'অনেক কাল ধরেই'! চমস্কি ব্যবহৃত 'descriptive adequacy' ও 'explanational adequacy' পরিভাষিক শব্দদুটির অনুবাদ তিনি করেছেন যথাক্রমে 'বর্ণনামূলক যথোপযোগিতা' ও 'ব্যাখ্যামূলক যথোপযোগিতা'। অনুবাদের যথোপযোগিতা পাওয়া যেত যথাক্রমে 'বর্ণনাত্মক পর্যাপ্ততা' ও 'ব্যাখ্যাত্মক পর্যাপ্ততা' ব্যবহার করলে।৪ চমস্কি-ব্যবহৃত পারিভাষিক শব্দ 'language faculty'-র বাংলায় তিনি কোথাও 'ভাষা ক্ষমতা' (পৃ. ২৭৮, ২৮১), কোথাও 'ভাষাতন্ত্র' (পৃ. ২৮১) ব্যবহার করেছেন; প্রচলিত ও উপযুক্ত পরিভাষা 'ভাষা অনুষদ' ব্যবহার করেন নি।
নোয়াম চমস্কি ও মিশেল ফুকোর একটি দীর্ঘ বিতর্কের অনুবাদ আর এ-দুই তাত্ত্বিকের তত্ত্ব ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তৃত একটি ভূমিকা মিলে আ-আল মামুনের গ্রন্থ মানবপ্রকৃতি : ন্যয়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা [মুখোমুখি নোম চমস্কি এবং মিশেল ফুকো]। যোগাযোগ এ-সংখ্যায় বইটির ওপর আলোচনা লিখেছেন মাহমুদুল সুমন। বইটির ভূমিকায় ('ভূমিকার বদলে') আ-আল মামুন লিখেছিলেন, 'বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় চমস্কি ও ফুকো অধ্যয়নের স্বল্পতার কারণে এবং বিষয়ের জটিলতা ও আমার অদক্ষতার কারণে পাঠকের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হবে না হয়তো।'৫ আর, গ্রন্থালোচনায় মাহমুদুল লিখেছেন, '… বিশেষ করে [আ-আল মামুন] অনুবাদ-কর্মে স্বাচ্ছন্দ্যের পরিচয় দিয়েছেন।' (পৃ. ২৮৮)
আ-আল মামুনের বইটি যারা পড়েছেন, তারা আর যাই পান, এতে অনুবাদের 'স্বাচ্ছন্দ্যের পরিচয়' পাবেন না। এর ভাষা আগাগোড়াই আড়ষ্ট। একাধিক ইংরেজি রচনার বাক্যের পর বাক্য, অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ শোচনীয় বঙ্গাক্ষরিক অনুবাদ করে তিনি গড়ে তুলেছেন স্বরচিত ভূমিকার শিংহভাগ। চমস্কি বিষয়ে (বিশেষত, চমস্কীয় ব্যাকরণ বিষয়ে) কোনো বাংলা লেখাই তিনি পড়েছেন বলে মনে হয় না। এ-ধরনের অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাষাবিজ্ঞানের যে-মৌল বিষয়গুলোর ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার, তাও গ্রন্থকারের নেই। অতি-পরিচিত ও উপযুক্ত পরিভাষার বদলে তিনি তৈরি করেছেন বিদঘুটে ও বিভ্রান্তিকর কিছু শব্দ। যেমন: চমস্কি-ব্যবহৃত পারিভাষিক শব্দ 'competance' ও 'performance'-এর বাংলায় প্রচলিত যথাক্রমে 'ভাষাবোধ' ও 'ভাষাপ্রয়োগ'-এর বদলে তিনি ব্যবহার করেছেন 'ভাষা সামর্থ্য'৬ ও 'কার্যকরণ'৭! 'phoneme'-এর বাংলা তিনি লিখেছেন 'ধ্বনিরীতি', 'morpheme'-এর বাংলা 'শব্দমূল'৮ ; অথচ বাংলা ভাষাতত্ত্বে এ-দুটো যথাক্রমে 'ধ্বনিমূল' ও 'রূপমূল' হিসাবেই প্রচলিত ও যথোপযুক্ত। 'এই জন্যই মূলত মানবমন অধ্যয়নের ক্ষেত্রে একটা রূপগত-ব্যবস্থা (formal system) হিসেবে ভাষা অধ্যয়ন চমস্কির কাছে অসাধারণ একটা পদ্ধতি বিবেচিত হয়'৯ , কিংবা 'চমস্কির ব্যকরণের সবচে দুর্বল দিক এর অর্থগত উপাদানটি ঘিরে'১০ —এর মতো ভুল ও বিভ্রান্তিকর বাক্য গ্রন্থটিতে সহজপ্রাপ্য; 'একজন মানব শিশু'১১র মতো হাস্যকর শব্দপ্রয়োগও দুর্লক্ষ্য নয়। 'জীববিদ্যা' অর্থে তিনি বারবার 'প্রাণীবিদ্যা' শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
গ্রন্থালোচক লিখেছেন, 'এরকম কাজের একটা নিট ফলাফল এই যে এখন অনায়াসে চমস্কি বা ফুকো নিয়ে কিছু কথা বলতে যেয়ে মামুনের এই কাজটার ঝকঝকে পাতার কথা মনে পড়ে!' (পৃ. ২৮৮) গ্রন্থালোচনাটির 'নিট ফলাফল' এই যে, এটি পড়ে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না, 'ঝকঝকে পাতাগুলো' সামান্য নাড়াচাড়া করে এখান-ওখান থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে মাহমুদুল সুমন চটজলদি আলোচনাটি লিখেছেন।
তিন
এবার স্বভাষীমূল লেখার প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রথমে আছে মানস চৌধুরীর 'নিজ-অবয়ব, সংঘাত ও সংশ্লেষ : ডিপজল প্রপঞ্চ'। বক্তব্য ও ব্যঞ্জনা দুদিক থেকেই লেখাটি অনন্য। বৈঠকি আলাপের ভঙ্গির মধ্যে মানস চৌধুরী অনায়াসে ঢুকিয়ে দেন অধুনাতম তত্ত্ব-প্রপঞ্চ, ইংরেজি তৎসম বাংলা ফারসি শব্দ ও প্রত্যয়ের সচেতন ও উপযুক্ত মিশেলে নির্মাণ করেন স্বকীয় একটি শৈলী। বাংলা সিনেমার 'বিখ্যাত' ভিলেন-চরিত্র ডিপজলের একটি 'আগর্দান' ছবি কীভাবে 'লাইফস্টাইল নৈরাজ্যবাদ'-এর সৃষ্টি করে, তা নিয়েই এ-লেখা। রিপ্রেজেন্টেশনের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ বোঝার জন্য মানস চৌধুরীর লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পরের লেখাটি খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের। লেখাটির শিরোনাম—'ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রাসঙ্গিকতা : পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ'। শিরোনামটাই সর্বস্ব, ভেতরে যা আছে তা ভীষণ বিশৃঙ্খল ও পারম্পর্যহীন। তিনি লিখেছেন, 'চলচ্চিত্র কোনো দ্রব্য বা পদার্থের নাম নয়, এটি একটা শিল্প-মাধ্যম।' (পৃ. ১১২) লেখাটি পড়ে আমরা বুঝতে পারি, এটিও কোনো দ্রব্য বা পদার্থের নাম নয়; একটা প্রবন্ধ! আছে গালভরা তকমা—'৯ম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব, ঢাকা ২০০৫-এর জাতীয় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসাবে পাঠ করা হয়, ডিসেম্বর, ২০০৫।' কিন্তু আমরা জানি, ১৬ মি. মি. ফরম্যাটে বানানো হলেই যেমন 'আর্ট ফিল্ম' হয় না, ৬ ইঞ্চি বাই ৮ ইঞ্চি মাপে ছাপানো হলেই যেমন 'লিটলম্যাগ' হয় না, তেমনি জাতীয় সেমিনারে পাঠ করা হলেই 'প্রবন্ধ' হয় না।
যোগাযোগ এ-সংখ্যা বেরোনোর পর এ-পর্যন্ত যে-প্রবন্ধের আলাপ-আলোচনা সবচেয়ে বেশি শুনেছি, সেটা হল আ-আল মামুনের 'বাংলাসিনেমা উদ্ধারপ্রকল্প: চন্দ্রকথা, ব্যাচেলরদের পোয়াবারো'। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থানের স্পষ্টতায়, বক্তব্যের যথাযথতা ও উদ্দেশ্যানুগতায় প্রবন্ধটি অনন্য। হুমায়ূন আহমেদের উ(অ)পন্যাস ও চ(ে)লচ্চিত্র (বাজারে বেশি চলে যে-চিত্র) বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্ববিরোধ-প্রকাশের চমৎকার একটি ক্ষেত্র। এ-শ্রেণির অধিকাংশ পাঠক-দর্শক বিকল্প কিছুর অনুসন্ধান না করেই ওগুলো নিয়মিত পড়েন এবং দ্যাখেন; অতঃপর সান্ধ্য আসরে চায়ের কাপে ঝেড়ে গাইল পাড়েন! হুমায়ূন-ভক্তির মতো হুমায়ূন-বিরোধিতাও বর্তমানে জনপ্রিয় সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু, আ-আল মামুন ঐ সহজ পথে পা না বাড়িয়ে, অত্যন্ত দায়বদ্ধ অবস্থান থেকে, খুবই সময়োপযোগী, দীর্ঘ এ-লেখাটি লিখেছেন। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, সুস্থ বিনোদনের দোহাই দিয়ে এ-ধরনের ছবিগুলো কীভাবে একটি 'আদর্শ মধ্যবিত্ত ভোক্তা সংস্কৃতি' নির্মাণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
পরের লেখাটিও আ-আল মামুনের। শিরোনাম—'মগজে কারফিউ: কোনটাকে বলি সংবাদ?'। প্রবন্ধকার লিখেছেন: 'বিদ্যায়তনিক শাস্ত্রগুলোতে সংবাদ, সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা ও সংবাদের উপাদান সম্পর্কে 'ঈশ্বরের প্রত্যাদেশতুল্য' যে-বয়ান প্রবল প্রতাপে হাজির আছে—এবং যে বয়ান সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী ও তাদের 'বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ' গুরুমণ্ডলী প্রশ্নাতীত আনুগত্যে অহর্নিশ জপ করেন—তার একটা সমালোচনাত্মক বিশ্লেষণ খাড়া করা নাতিদীর্ঘ এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।' (পৃ. ১৫৭) আমার মতে, আ-আল মামুনের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। পুঁজিবাদী অর্থ-কাঠামোতে সংবাদ যে নির্বিকল্পভাবে একটা পণ্যমাত্র, এর পঠন-পাঠনও যে প্রকারান্তরে পণ্য-সংস্কৃতিরই অঙ্গ—তা এই নাতিদীর্ঘ লেখায় স্পষ্ট হয়েছে। উপরি-পাওনাটা হল—বাংলায় লেখা অধিকাংশ পাঠ্যপুস্তকই যে নানান বিদেশি 'মহান' পুস্তকের অযোগ্য কাট-পেস্টের চাইতে বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারে নি, এর প্রমাণও আরেকবার হাতেনাতে পাওয়া গেল।
বাংলাদেশের কয়েকটি বহুল প্রচারিত দৈনিক থেকে বিপুল উদাহরণ নিয়ে ড. সৌমিত্র শেখর লিখেছেন 'সংবাদপত্রে বাংলা ভাষা : ভাষিক বিচ্যুতি'। ভাষিক অজ্ঞতা, অদক্ষতা ও অসতর্কতা কীভাবে দ্ব্যর্থতার সৃষ্টি করে, আর্থ বিপর্যয় ঘটায়, ভাষাকে দুর্বল ও পীড়াদায়ক করে—তা স্পষ্ট করেছেন প্রবন্ধকার। তবে, তার লেখাতেও আমরা পাচ্ছি 'ঘন্টা', 'ইংরেজী' ইত্যাদি ভুল ও অ-প্রমিত বানানের উদাহরণ। পাচ্ছি অসতর্ক বাক্য ও মন্তব্য। উদাহরণ:
'মিথ্যা' শব্দটি এখানে ভুলভাবে প্রযুক্ত হয়েছে। এখানে যথোপযুক্ত শব্দ হবে 'ভুল'; কেননা ব্যাপারটা সত্য/মিথ্যা নিয়ে নয়, ভুল/শুদ্ধ নিয়ে। মনে হয়, 'ভুল' শব্দের ব্যবহারের বাহুল্য এড়াতে লেখক পরের 'ভুল'-এর জায়গায় 'মিথ্যা' লিখেছেন। সেটা অন্যভাবেও এড়ানো যেত। উদাহরণ:
অথবা,
অথবা,
'যে কথা বললেন পাঠকরা নিজেরাই'—এখানে বহুবচন ব্যবহারের বাহুল্যদোষ ধরে প্রবন্ধকার নিম্নোক্ত 'শুদ্ধ' উদাহরণদুটো দিয়েছেন:
এমন উদ্ভট উদাহরণ তিনি কীভাবে তৈরি করলেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। কারণ, বাংলা ভাষায় 'আমি নিজে/ আমরা নিজেরা', 'তুমি নিজে/ তোমরা নিজেরা', 'সে নিজে/ তারা নিজেরা'—এ-রকম প্রয়োগ স্বাভাবিক ও সঙ্গত। ইংরেজিতেও 'I myself/ we ourselves', 'you yourself/ you yourselves', 'he himself/ they themselves'—এ-রকম প্রয়োগ স্বাভাবিক ও সঙ্গত। সম্ভবত, লেখকের চিন্তায় ছিল 'সব ছেলেরা', 'এইসব মানুষগুলো', 'সকল শুভানুধ্যায়ীরা'-ধরনের বহুবচন ব্যবহারের বাহুল্যদোষের উদাহরণ।
পরের প্রবন্ধদুটি যথাক্রমে কাজী মামুন হায়দার এবং এ এস এম আনিসুর রহমানের গবেষণা-সন্দর্ভ। 'বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ পরিবেশনার বিচারমূলক পাঠ' এবং 'সংবাদ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণের কাঠমোগত শর্ত বিশ্লেষণ : এটিএন বাংলার ওপরে সমীক্ষা'—প্রবন্ধদুটিকে পরস্পরের সম্পূরক হিসাবে পড়া যায়। আর, ভূমিকাস্বরূপ আ-আল মামুনের 'মগজে কারফিউ: কোনটাকে বলি সংবাদ?' পড়ে নিলে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে সংবাদ-এর উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও উপস্থাপন সম্পর্কে আর কোনো 'কারফিউ'ই মগজে থাকার কথা নয়! টুপিখোলা অভিনন্দন এ-তিন প্রবন্ধকারকে।
উদিসা ইসলামের 'নারীর স্বপ্নপূরণ : এবার ফেয়ার এ্যান্ড লাভলীর টিউবে বন্দি' নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা। তবে, পড়তে গিয়ে, আমার অন্তত, বার বার মনে হয়েছে, লেখিকাও কিছুটা অন্য টিউবে বন্দি! উদাহরণ: 'পাঠক, কী আর করা বলুন, এই আকালে চাইলেই চোখ বন্ধ করে তো আর থাকা যায় না।' (পৃ. ২৬৯; নিম্নরেখ আমার); 'বর্তমান সময়ে আমি এটুকু মেনে নিতে বাধ্য হই যে, যদি ভালো কাজ করতেও চান তবে দরকার টাকা।' (পৃ. ২৭১; নিম্নরেখ আমার); 'সব প্রক্রিয়া শেষে যখন পুরস্কার প্রদানের বিষয়টি আসে তখন মঞ্চে উপস্থিত হন বাঘা বাঘা নারীনেত্রীরা, যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে যথেষ্ট দায়িত্বশীল। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদেরকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার চোখে দেখি। এমনটা নয় যে পুরস্কারপ্রদানের মঞ্চে দেখে শ্রদ্ধা কমে গেছে কিন্তু এটা তো ঠিক খটকা লেগেছে। তাদের সেখানে যাওয়া নিয়ে নিজেদের শক্তিশালী যুক্তি নিশ্চয় আছে। কিন্তু তাদের উপস্থিতি এতবড় একটা দুইনম্বরীকে, নারীর প্রতি খাটো দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন দেয় যে খটকা না-লাগার কারণ থাকে না। এই যুক্তি তারা কীভাবে খণ্ডন করবেন? আমি যদি ভুল ব্যাখ্যা করে থাকি তবে তারা আমাকে ক্ষমা করবেন আশা করি।' (পৃ. ২৭২; নিম্নরেখ আমার); 'তাহলে ক্ষমতায়নের ক্ষেত্র তৈরি হবার স্বপ্ন আয়োজকরা কীভাবে দেখেন বুঝি না' (পৃ. ২৭৩; নিম্নরেখ আমার); 'পাঠক, আপনি ভাবতে পারেন আমি ইচ্ছে করে ঝগড়া করতে চাইছি। কিন্তু আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে এইসব 'খুঁটিনাটি বৈষম্যমূলক চিত্রগুলো আমরা নিজেরাই বেশিরভাগ সময় জেনে আর কখনো কখনো না-জেনে ঘটিয়ে চলেছি' (পৃ. ২৭৬; নিম্নরেখ আমার)
নিম্নরেখ করে না দিলেও আশা করি পাঠক বুঝতে পারতেন 'টিউব'টি অন্তত তিন স্তরবিশিষ্ট—বক্তব্যে দৃঢ়তার অভাব, ভাষাপ্রয়োগের দুর্বলতা ও কিছুটা মেয়েলিপনা১২।
চার
যে-বৈশিষ্ট্যটি যোগাযোগকে স্বাতন্ত্র্য-ঋদ্ধ করেছে, তা হল এর উদ্দেশ্যের একমুখিনতা। বাংলাদেশের অধিকাংশ সাময়িক পত্রিকায় এর অভাব থাকার কারণে সামগ্রিকভাবে পত্রিকার কোনো চারিত্র দাঁড়ায় না। তারেক মাসুদের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত লেখাটা, আর মাহমুদুল সুমনের বায়বীয় গ্রন্থালোচনাটার কথা ছেড়ে দিলে নির্দ্বিধায় বলা যায়—যোগাযোগ এ-সংখ্যাও বাংলাদেশের সাময়িক পত্রিকার 'ধীরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে বহমান দায়বদ্ধ ধারা'কে পুষ্ট করবে। সম্পাদক লিখেছেন:
লগ্নী পুঁজির আগ্রাসী প্রকল্প যখন এ-দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণীকে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে কিনে ফেলেছে, তেমন একটি সময়ে যোগাযোগ-সম্পাদকের এমন স্পর্ধিত ও দায়বদ্ধ উচ্চারণ আমাদেরকেও সাহসী করে তোলে। পাঠক ও লেখকের যূথবদ্ধতায় সম্পাদকের আস্থা পত্রিকাটির প্রতি আমাদেরকে শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাবান করে। যোগাযোগ আরও অনেকদিন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুক বাংলাভাষী পাঠককুলের সঙ্গে। বিকশিত হোক প্রলেতারিয়েত-সংস্কৃতি-চর্চা।
৪. চমস্কি-ব্যবহৃত এ-সংক্রান্ত তিনটি পারিভাষিক শব্দ 'observational adequacy', 'descriptive adequacy' ও 'explanatory adequacy'-র বাংলায় হুমায়ুন আজাদ ব্যবহার করেছেন যথাক্রমে 'পর্যবেক্ষণাত্মক যোগ্যতা', 'বর্ণনাত্মক যোগ্যতা' ও 'ব্যাখ্যাত্মক যোগ্যতা'। দ্রষ্টব্য, হুমায়ুন আজাদ, বাক্যতত্ত্ব, প্রথম প্রকাশ : ফেব্র"য়ারি ১৯৮৪, দ্বিতীয় সংস্করণ : ডিসেম্বর ১৯৯৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, পৃ. ১৫২। বিনয় বর্মন ব্যবহার করেছেন যথাক্রমে 'পর্যবেক্ষণাত্মক পর্যাপ্ততা', 'বর্ণনাত্মক পর্যাপ্ততা' ও 'ব্যাখ্যাত্মক পর্যাপ্ততা'। দ্রষ্টব্য, বিনয় বর্মন, চমস্কীয় ব্যাকরণ: বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক বিশ্লেষণ, ঐতিহ্য, ঢাকা ২০০৭, পৃ. ৪৬
১২. 'মেয়েলিপনা' শব্দটি দেখে চটে যেতে পারেন, এমন অনেক 'নারীবাদী' বাংলাদেশে আছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নারীবাদ এ-রকম অগভীর ব্যাপার নয়। কনটেক্সট না বুঝে চট করে চটে গিয়ে বাংলাদেশের তথাকথিত অনেক 'নারীবাদী' হুমায়ুন আজাদের পিছনে লেগেছিলেন। হুমায়ুন আজাদ এদের এক শ্রেণির নাম দিয়েছিলেন 'স্ত্রীবাদী'; আমরা আরেক শ্রেণির নাম দিতে পারি 'মেয়েবাদী'। আন্তর্জালিক ব্লগসমূহের বদৌলতে ইদানীং এদের দেখা আরও বেশি মেলে।
কথা, ৫ম সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত