ইসাবেল : কালদগ্ধ ও রূপমুগ্ধ

মইনুদ্দীন খালেদ
Published : 23 Feb 2015, 09:31 AM
Updated : 23 Feb 2015, 09:31 AM

গত রোববার ( ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে ২২ থেকে ২৬ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত মেক্মিকোর তরুণ চিত্রশিল্পী ইসাবেল জামানের এক চিত্রপদর্শনীর উদ্বোধন হয়। উদ্বোধন করেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম। মেক্সিকান বংশোদ্ভূত শিল্পী ইসাবেলের এই একক প্রদর্শনীর বেশিরভাগ ছবির বিষয় বাংলাদেশ। বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকা বিভিন্ন আয়তনের মোট ২১টি ছবি রয়েছে। চলমান এই প্রদর্শনী নিয়ে লিখেছেন চিত্রসমালোচক মইনু্দ্দীন খালেদ। বি.স.

ইউরোপীয় দেশের ঔপনিবেশিক আবেশে দীর্ঘকাল জীবন যাপিত হওয়ার কারণে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার মানুষের বিদ্যা-বুদ্ধির চর্চা একটা জটিল চেহারা পেয়েছে। পশ্চিমের শিল্পাদর্শ অনুমোদন করে এই তিন মহাদেশের শিল্পীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে হয়েছে। পশ্চিমের আদর্শ মানে গ্রীক আদর্শ। এ আদর্শ ইতালীয় রেনেসাঁয় বিশেষ গতিবেগ পায়। তারপর বিস্তারিত হয় উপনিবেশের জাল। কিন্তু পশ্চিমের নন্দনতত্ত্বে তালিম নেয়ায় সন্তুষ্ট থাকতে পারে নি ঔপনিবেশিক শক্তি কবলিত দেশগুলো। কেন না তাদেরও ছিল হাজার হাজার বছরের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার নিজস্ব ইতিহাস। তাই তারা তাগিদ অনুভব করেছে স্বকীয় ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করে নতুন শিল্প-সৃজনের। কিন্তু শিল্প-চর্চা ততদিন নানা ধারার সংমিশ্রণে একটা শংকর চরিত্র পেয়ে গেছে। লাতিন আমেরিকার বর্ণ-সংকর মানুষদের মতই তাদের শিল্পও বহুসারবাহী। এই মহাদেশের শিল্পচর্চায় ইউরো-মার্কিন শিল্পাদর্শের সংগে যুক্ত হয়েছে দেশজ শিল্পভাষা ও শিল্পতত্ত্ব।

ইসাবেল জামানের জন্ম মেক্সিকোতে। লাতিন আমেরিকার এ দেশটি তার প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনের পাশাপাশি আধুনিক শিল্পচর্চাতেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। প্রি-কলামবিয়ান, উপনিবেশিক কালের আধুনিক চর্চা এবং সমকালীন বৈশ্বিক শিল্পভাবনার নানা অনুষঙ্গ মিলে যে মিশ্র শিল্পভাষা এদেশে সচল রয়েছে তারই অনুসারী ইসাবেলের শিল্পকর্ম। তিনি একান্তভাবে ইউরো-মার্কিন আধুনিক শিল্পভাষার অনুগামী থেকেছেন; আবার নিজস্ব সংস্কৃতিলগ্ন হয়ে ইন্ডিজেনিস্টা ও লোককলার শৈল্পিক পরিমার্জনাও গ্রাহ্য করেছেন। এ কথা বলা বোধ হয় অসমীচীন হবে না যে, ঐতিহাসিক কারণে যারা নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি ভিন্ন দেশের সংস্কৃতি চর্চা মেনে নিতে বাধ্য হয় তাদের মধ্যেই আত্মীকরণের ক্ষমতা বেশি মাত্রায় থাকে। এটা যে শুধু আধিপত্যবাদী পশ্চিমের শিল্পের সঙ্গে অ-পশ্চিমীয় শিল্পের সংযোগে নতুন মাত্রা পায় তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে দক্ষিণের তিন মহাদেশ লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশসমূহের পারস্পরিক যোগাযোগেও শিল্পে নতুন অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। মেক্সিকোর ইসাবেল বৈবাহিক সূত্রে বালাদেশের বাঙালির সঙ্গে সম্পর্কিত। তার শিল্পকর্মে যুগপৎ মিশে আছে মেক্সিকো ও বাংলাদেশ। বৈবাহিক কারণে শুধু এক বাঙালির সঙ্গেই তিনি জীবন জড়িয়েছেন যে তা নয়, বাংলাদেশের অনেক মানুষের জীবনভাবনা ও শৈল্পিক সৃষ্টির সঙ্গেও তিনি আত্মীয়তা গড়ে তুলেছেন।

ইসাবেলের শিল্পভাবনার মধ্যে আত্মরূপমুগ্ধতার এক বিরল বৈশিষ্ট্য আছে। এ জন্য তিনি ফুলের সঙ্গে নগ্ন নারীদেহ এঁকে সৌন্দর্যতত্ত্বের সমীকরণ টানেন। তবে ইসাবেলের কাজে মানবিকবোধ এবং এই বোধজাত মরমি ভাবনাটাও প্রবল। তার ছবি আঁকার প্রেরণা জন্মগত। তার রক্তবীজেই প্রণোদনা ছিল চিত্ররচনার। তাই তিনি শৈশব থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করেছেন। খনি-অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন বলেই হয়তো জীবনের নগ্নরূপকে তিনি স্বচ্ছতরভাবে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন। ছবি আঁকাও শুরু হয়েছিল তার খনির কয়লা, লালমাটি, গাছের পাতা ও প্রাকৃতিক রঙের প্রয়োগে। তবে পারিবারিক পরিবেশ তার ছবি আঁকার জন্য অনুকূল ছিল না। পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে অল্প বয়সে তাকে জীবিকা গ্রহণ করতে হয়। তাই নিরবচ্ছিন্ন শিল্পচর্চা তার ভাগ্যে জোটেনি। বিয়ের পর উদার-হৃদয় স্বামীর প্রেরণা তার শিল্পরচনার পথ নির্বিঘ্ন করে দেয়।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে সৃজনপ্রয়াসী মন বিশেষভাবে সাহসী হয়ে ওঠে। নিজের সৌন্দর্যভাবনা ও বক্তব্যকে পরস্পরিত করে যারা শিল্পরচনার সিদ্ধান্ত নেন তাদের কঠিন পরীক্ষার পথ পাড়ি দিতে হয়। ইসাবেলের ছবিতে ডকুমেন্টারি উপাদান শিল্পী-চেতনার নান্দনিক ভাবনায় পরিশ্রুত হয়ে অভিনবত্বের মাত্রা পেয়েছে। বাংলাদেশের স্মৃতিসৌধ ও কৃষ্ণচূড়ার সমন্বয়ে শিল্পী যে ছবিটি এঁকেছেন তাতে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুলরাশি আর তা ভেদ করে স্মৃতিসৌধের ভার্টিকাল উত্থানের মধ্যে বীরদের প্রতি এক বিরল শ্রদ্ধার্ঘ্য রচিত হয়েছে। সাদা-কালো কংক্রিটের স্থাপত্যের কাঠামো আর কৃষ্ণচূড়ার লালফুল মিলে-মিশে ইসাবেলের স্পেসে জন্ম নিয়েছে এক নতুন এপিটাফ। প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ যোজনে আমদের স্মৃতির সৌধ পেয়েছে এক কাব্যিক মাত্র।

ইসাবেলের আরাধনাপ্রবণ মনটার খবর পাওয়া যায় তার অন্য একটি ছবিতে। এবারও তিনি ফটোগ্রাফিক্স ডকুমেন্টের সঙ্গে যোগ করেছেন প্যাস্টেলে আঁকা ইমেজ। মিশ্র মাধ্যমের এই ছবিতে শিল্পী অসংখ্য মানুষের ফটোগ্রাফি সেঁটে দিয়েছেন। নারী-পুরুষ-শিশুর এই অজস্র ইমেজে রচিত হয়েছে ছবির প্রথম তল। তারপর তিনি ছবির মধ্যিখানে এঁকেছেন চেয়ারে বসে থাকা ধর্মগ্রন্থ হাতে এক বৃদ্ধকে। শুভ্রকেশ শশ্রুমন্ডিত মানুষটি কি নিপীড়িত মানুষের জন্য কোনো সান্তনার বাণী পাঠ করছেন! নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি ইসাবেলের শোকাঞ্জলি এ ছবিতে আরও শুচিতা পেয়ে গেল সাদা শিউলি ফুলের ইমেজ চিত্রায়নে।

বস্ত্র-কারখানা শ্রমিকেরা এদেশের মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। সেই শ্রমিকদের সিংহভাগই নারী। বুননশিল্প একান্তভাবে নারীর। সেই নারীর শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের স্থৈর্য কাজে লাগিয়ে চাঙ্গা হল এদেশের অর্থনীতি। কিন্তু অপরিকল্পিত কারখানায় দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে নারী। কখনো আগুনে দগ্ধ হয়ে, কখনো বা কারখানার দালান ভেঙ্গে পড়ায় তারা দেয়াল চাপা পড়ে মৃত্যুকে বরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রানা-প্লাজার গার্মেন্টস ইনডাসট্রির বিল্ডিং ধ্বসে পড়ার ঘটনা সবচেয়ে মর্মবিদারি। মেক্সিকোর মেয়ে ইসাবেলের মন এই ঘটনায় আর্তনাদ করেছে। তার আর্তনাদ থেকে জন্ম নিয়েছে শিল্প। ধ্বংস-স্তুপে চাপা পড়ে একটি মেয়ে দুটি হাত উচিয়ে বাঁচবার জন্য শেষ চেষ্টা করেছিল। তার সুন্দর দুটি হাত ইট আর সিমেন্টের পলেস্তারার গায়ে লেপ্টে আছে। এই দৃশ্য রূপায়নে ইসাবেল পরিমিত অনুষঙ্গের নির্ভরতায় ভয়ংকর নিষ্ঠুরতাকে সাংকেতিক ভাষায় জানান দিয়েছেন। শিল্পীর কাছে জীবনের মৃত্যু আর সুন্দরের মৃত্যু যেন সমার্থক। এ রকমই এক ব্যঞ্জনা আছে এ ছবিতে। এতে হাত দুটির অ্যানাটমি রিয়ালিস্টিক নয়। কোমল-পেলব হাত চিত্রিত করার মধ্যেই শিল্পীর মনোভঙ্গি পাঠ করা যায়।

সবুজ প্রাকৃতিতে লাল সূর্য,–এই আমাদের পতাকা। রক্তিম সূর্যের লাল রক্ত যেন লেগে আছে কোমল সবুজে। এ রকম ভাবনা বুনেছেন ইসাবেল বাংলাদেশের পতাকা এঁকে। এটা অবশ্য এ দেশের কোনো প্রামাণিক অফিসিয়াল পতাকা নয়। এটা একান্তভাবে শিল্পীর মনোলোকে বিধৃত পতাকা। এখানে মন্ময়ধর্মিতা অনূদিত হয়েছে বর্ণের ছোপে।

লেখাটার শুরুতে বলেছিলাম যে ইসাবেল আত্মরূপমুগ্ধতারও শিল্পী। সবাই আপন আয়নায় নিজেকে দেখে। নিজেকে সুন্দর বলে প্রমাণ করে নিভৃতিতে । নারী কি একটু বেশি দেখে না দর্পণে তার মুখ ও দেহ! নারীর সেই রূপতৃষ্ণা আর পুরুষালী সঙ্গলিপ্সার বিয়টি রূপকের ভাষায় চিত্রার্পিত হয়েছে ইসাবেলের স্পেসে। একটি নগ্নিকা এঁকেছেন তিনি এভাবে: নারীর মৃসণ পৃষ্ঠদেশ, সুডৌল নিতম্ব আর সুগঠিত পা দুটি দেখা যাচ্ছে। তার উরুদেশ থেকে পাপড়ি মেলেছে এক বিপুল নীল ফুল আর এই ফুলের মধ্যে একটি উড়ন্ত পাখি প্রবিষ্ট করেছে তার ঠোঁট। জীবন, যৌবন, ও যৌনতার এক সরল প্রাকৃত রূপ ইসাবেলের এই ছবি।

লাল প্রেক্ষাপটে কালো গাউন গায়ে এক দীর্ঘাঙ্গী নারীকে এঁকেছেন ইসাবেল। নারীর ছায়া পড়েছে লাল দেয়ালে। নারী আর তার ছায়া নির্জনে সুন্দরের মর্ম ব্যাখ্যা করতে চায় যেন। এক বিপুল তৃষ্ণা সুন্দরের জন্য। যেন কোনো নারীর শরীর নয়, রোমান্টিক বোধিই শারীরি রূপ লাভ করেছে। তাছাড়া নারী-পুরুষের যুগলবন্দি রূপও তিনি এঁকেছেন। বাস্তববাদি শিল্পাদর্শ অনুসরণ না করে পরিমিত রেখা ও বর্ণছোপে প্রকৃতি ও পুরুষের সম্মোহনী আবেশের জ্যামিতিকে তিনি পরিস্ফুট করেছেন। এভাবে মন আর চোখ অর্থাৎ আমি আর সে যুগপৎ ইসাবেলের চেতনা সৃজনে শিহরিত করে রাখে। তার সৃজন-রসায়নে স্বদেশ ও বিদেশমেক্সিকো ও বাংলাদেশ একাকার হয়ে এক মন্ময়ধর্মি শৈল্পিক মানচিত্র রচিত হয়েছে।