‘মুনির আর্টিস্ট’ ও শিল্পী মনিরুল ইসলাম

প্রমা সঞ্চিতা অত্রি
Published : 28 Nov 2013, 10:49 AM
Updated : 28 Nov 2013, 10:49 AM

বিকাল ৫টা বাজতে না বাজতেই শুরু হল লোকের আনাগোনা। প্রথম শো'তে জায়গা না পেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল অনেককে। গত ২২শে নভেম্বর, শুক্রবার – এমনই এক চিত্র দেখা গেল ধানমণ্ডি ৭/এ-তে অবস্থিত 'ঢাকা আর্ট সেন্টার'-এর তৃতীয় তলার স্ক্রিনিং রুমের সামনে। শিল্পী মনিরুল ইসলামকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র 'মুনির আর্টিস্ট'-এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী ছিল সেদিন। ৩৩ মিনিটের এই স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন এ.কে.এম. জাকারিয়া। দীর্ঘ নয় বছর ধরে শিল্পী মনিরুল ইসলামের সাথে দেশ ও বিদেশের নানা জায়গায় ভ্রমণ করে তাঁর জীবনের নানা গল্প তুলে এনেছেন তিনি এই তথ্যচিত্রে।

তথ্যচিত্রটি শুরু হয় একটি লঞ্চযাত্রার দৃশ্য দিয়ে । মেঘনা নদী দিয়ে চাঁদপুর যাওয়ার একটি দৃশ্য। সাথে সাথে ব্যাকগ্রাউনণ্ড ভয়েসে ছিল শিল্পীর নিজের কিছু কথা। শিল্পী মনিরুল ইসলামের শৈশব, ছবি আঁকা, আর্টস কলেজে ভর্তি হওয়া ও পরবর্তীকালে চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার গল্পগুলো এক এক করে নিজের জবানীতেই বলে গেলেন তিনি। পাশাপাশি দেখানো হচ্ছিল তাঁর বাসা, ছবি আঁকার ঘর ও সাজ-সরঞ্জামের খুঁটিনাটি। পরবর্তীকালে তাঁর স্পেন যাত্রা, স্কলারশিপ ও প্রবাস জীবন নিয়ে বেশ কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় এই তথ্যচিত্রটিতে। বিদেশে তাঁর শিল্পী জীবন ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সরল ও অকপট বর্ণনা মুগ্ধ করেছে উপস্থিত দর্শকদের। এক্ষেত্রে তাঁর জীবনে 'নারী ও প্রেম' প্রসঙ্গ ছিল অন্যতম। এছাড়াও স্পেনের সংস্কৃতি ও চিত্রকলা কিভাবে তাঁকে প্রভাবিত করেছে সে সম্পর্কেও একটি সুন্দর ধারণা পাওয়া যাবে এ তথ্যচিত্রটি থেকে।

শিল্পী মনিরুল ইসলামের কাছে জানতে চাই 'মুনির আর্টিস্ট' শীর্ষক ডকুমেন্টারি প্রসঙ্গে। তিনি বলেন,"জাকারিয়াকে আমি চিনতাম জার্নালিস্ট হিসেবে। সে সময় আমাকে সে জানালো যে ও আমাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করতে চায়। এর আগেও বেঙ্গল-এ একটা ডকুমেন্টারি হয়েছিল আমাকে নিয়ে। ওটার নাম ছিল বোধহয় 'ফেরা' অথাৎ রিটার্ন। আর এরপর জাকারিয়া এটা করল। তো এই ডকুমেন্টারিটা করার সময় আমাদের যে ক্যামেরাম্যান ছিল, ইয়াং একটা ছেলে, ও মারা যায়। ওটা আমাদের জন্য খুব শকিং ছিল। তাই মাঝখানে কাজ বন্ধ ছিল অনেকদিন। তারপরে জাকারিয়া আবার কাজ শুরু করে, তা-ও প্রায় নয় বছর আগে। ও চেয়েছিল এটা একটা ইন্টিমেট ডকুমেন্টারি বানাতে। আমার স্পেনের যে জীবন আবার বাংলাদেশের যে আরেকটা জীবন এটা ও তুলে আনতে চেয়েছে। আমি ১৯৬৯ থেকে স্পেনে আছি, প্রায় ৪৩ বছর সেখানে আমার অ্যাডাপটেশন, আমার লাইফ, আমার শিল্প জীবনের কাজ, প্রবাস জীবনের বাঁধা-বিপত্তি এই বিষয়গুলো নিয়ে ও কাজ করেছে। দেশের বাইরের জীবন খুব কঠিন। বাংলাদেশ থেকে গিয়ে স্পেনের মত একটা জায়গায় টিকে থাকা, ওখানে প্রায় ৪৩ হাজারের মত আর্টিস্ট আছে, সেখানে ৪-৫ হাজারও হয়ত টিকে থাকতে পারে না। তো, ওইখানে ওই অবস্থায় আমাকে ফাইট করে টিকে থাকতে হয়েছে। ফাইট করে মানে কাজ করতে হয়েছে। তো ডকুমেন্টারিটা তো অনেক আগের করা। এখানে অনেক কথা আছে যেগুলো আমি বলতে গেলে প্রায় ভুলেই গেছিলাম। তো অনেকদিন পর আবার সেগুলো দেখলাম। আমার বেশ ভালোই লাগল। তাছাড়া আজকে যারা অডিয়েন্সে এসেছিল, দে এপ্রিসিয়েটেড ইট। এখন আমাকে নিয়ে এই যে ডকুমেন্টারিটা হল এটা হয়ত টেকনিক্যালি খুব একটা বিরাট কিছু না, কিন্তু ও যে সিম্পল ওয়েতে এটা করছে এটাই লোকদের অ্যাট্রাক্ট করছে। ছবিটার কন্টিনিউটি আছে। "

ডকুমেন্টারিতে প্রথমেই উঠে এসেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের জীবনের কথা। একটি মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে ছবি আঁকতে গিয়ে যে বাঁধার সম্মুখীন তাকে বলতে হয়েছে সে অভিজ্ঞতার কথা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "এখন থেকে প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগে মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে আমার জন্ম। তখন ছবি আঁকার ক্ষেত্রে প্রথম যে কথা ছিল তা হল, ছবি এঁকে হবেটা কী? অথাৎ সে খাবে কী? তখন সবার একটা ধারণা ছিল শিল্পী মানে সাইনবোর্ডে ছবি আঁকবে, ছাতায় নাম লেখবে, দোকানের সাইনবোর্ড লেখবে, রিকশার পিছে ছবি আঁকবে, আর বড়জোর সিনেমার ব্যানার আঁকবে। এই ছিল শিল্পী সম্পর্কে ধারণা। আর মানুষ হিসেবে শিল্পী থাকবে অগোছালো, বোহেমিয়ান, গাঁজা খাবে, তারপর… প্রেম করবে..ব্যর্থ প্রেম, তারপর যক্ষা হয়ে মরে যাবে। এই হল শিল্পীর একটা চেহারা তখনকার। কিন্তু সেই অবস্থা তো আর নাই এখন। তারা এখন একটা ভালো অবস্থানে আছে। আর্টের একটা ল্যাডার বা সিঁড়ি অনেক উপরে উঠে গেছে। এখন দেখা যায় সোসাইটিতে ঢোকার জন্য আর্টটা একটা মিডিয়া। এখন আর্ট ম্যাগাজিন হচ্ছে, আর্ট গ্যালারীতে ছবি প্রদর্শন হচ্ছে। এখন টাকা থাকলেও আর্টজ্ঞান না থাকলে ওই সোসাইটিতে সবাই এখন ঢুকতে পারে না। কালচারাল ব্যাপারটা তৈরি হয়েছে এখন। বাংলাদেশে এখন যে আর্ট গ্যালারী হচ্ছে, অনেক টাকা দিয়ে যে ছবি বিক্রি হচ্ছে এটা তো একটা অনেক বড় ব্যাপার, পঞ্চাশ বছর আগে তো কেউ চিন্তা করে নাই এটা। ইউরোপে কিন্তু এখন প্রায় ৯৫% ছবি বাঙালিদের এবং প্রচুর টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪০ লাখ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে ছবি।"

তাঁর শিল্পী জীবন ও পরবর্তীকালে স্পেন যাত্রার প্রসঙ্গে জানতে চাই তার কাছে। তিনি বলেন, "এখানে তো আমি 'আর্ট কলেজ'র টিচার ছিলাম ১৯৬৬-৬৯ পর্যন্ত। তারপর আমি স্পেন চলে যাই নয় মাসের জন্য। 'ইন্টারচেঞ্জ রিলেশন- মিনিস্ট্রি অব কালচার'-এর অধীনে ছিল এই স্কলারশিপ। আমি ছিলাম পাকিস্তান পিরিয়ডের লাস্ট স্কলারশিপ হোল্ডার স্টুডেন্ট। এই ন'মাসের জন্য যাওয়ার পর আমার আজকে এই ৪৩ বছর কেটে গেল ওখানে। আমার যদিও রিটার্ন টিকিট ছিল। এই জন্যই আমি একটা জিনিস বুঝি যে মানুষের একটা বোধ হয় ডেস্টিনি থাকে। স্পেন একটা সুন্দর দেশ যেখানে বিভিন্ন বিখ্যাত শিল্পীরা জন্ম নিয়েছে – গয়া, ভ্যালাস্কেস, মিরো, পিকাসো, দালি। তারপর এর একটা চমৎকার, সমৃদ্ধ হিস্ট্রি আছে। রোমান থেকে আরম্ভ করে আরবরা ছিল প্রায় ৮০০ বছর। আরবদের যে কালচার সেটা ওখানেই বেশি ডেভেলপ হয়েছে মুসলমানদের দ্বারা এবং সেখানেই শেষ।


গ্রানাডার মসজিদ, আল-হামরা, ওটা এখনও কত ইনট্যাক্ট। এগুলো দেখতে হাজার হাজার লোক আসে। স্প্যানিশরা বলে, 'উই আর প্রাউড টু ক্যারি দ্য আরব ব্লাড'। এখনও ওখানে সাউথে একদম আরবদের মত আচার-ব্যবহার এবং কোয়ালিটি অব লাইফ। তারা খুব হ্যাম্বল ও ওয়ার্ম হার্টেট লোক। আমাদের বাংলাদেশীদের সাথে যায় খুব ওদের ক্যারেকটার। তারপর তাদের ক্লাইমেট, গ্যাস্ট্রোনমি অর্থাৎ ফুড কালচার এগুলো অনেক ইম্পর্টেন্ট একটা পার্ট। আমি বাংলাদেশে এখন আসি। আমার ইচ্ছা এখন ছ'মাস থাকব এখানে আর ছ'মাস ওখানে। এখন আমি এতদিনে যেটা আয়ত্ত করছি, টেকনিক্যালি ও প্রফেশনালি, আমার ছবি আঁকার পদ্ধতি বা এচিং আর্ট মিডিয়া, ওটা আমি এখন দেশে আনতে চাই। আমি ওয়ার্কশপও করি। আমি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে প্রথম ওয়ার্কশপ করি, গ্রাফিক ওয়ার্কশপ। সেখানে আমার টিচার ও স্টুডেন্টরা ছিলেন। কামরুল হাসান, আমিনুল ইসলাম, কিবরিয়া।"

গ্রাফিক আর্ট ও তাঁর ছবি আঁকার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, "গ্রাফিক আর্টের কিছু আলাদা ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। সব কাজেরই কতগুলো টেকনিক আর মিডিয়া রয়েছে। টেকনিক আর মিডিয়া এরা দুটো দুই জিনিস। যেমন, জলরঙ বা তেলরঙ এটা একটা মিডিয়া, তারপর গ্রাফিক আর্ট এটা একটা মিডিয়া। গ্রাফিক আর্ট বা ছাপচিত্র যেটা : লিথোগ্রাফি, এচিং, উড কাট- এগুলোর মাধ্যমে পরে ছাপ দিতে হয়। তারপর স্কাল্পচার, সিরামিকস- আসলে এগুলো মিডিয়া, এটা হচ্ছে তুমি কাগজে বা কাঠ-পেন্সিলেও ছবি আঁকতে পারো আবার ওয়েল দিয়ে ব্রাশেও ছবি আঁকতে পারো। বেসিক্যালি ভ্যালু একই। তোমার চিন্তাটা তুমি বের করে আনতে পারো কিনা এটাই হল বিষয়। রবীন্দ্রনাথের মত একজন মানুষ কিন্তু ছবি আঁকছে। কিন্তু সে কখনো পেইন্টিং করে নাই। মূল ব্যাপারটা হল একজন আর্টিস্টের উচিৎ তার নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি করা। যেই কাজটা খুব কঠিন একটা কাজ, মোটেও সহজ কোনো কাজ না। তার ছবিতে তার পার্সোনালিটি থাকতে হবে। বাকি ৩০০ জন যা আঁকছে তুমিও তাই আঁকলে তো তোমার কোনো পার্সোনালিটি নাই। সুতরাং নিজের জগৎ তৈরি করা একজন আর্টিস্টের প্রথম কাজ। খারাপ, ভাল তার পরে।"
এরপর কথা হয় 'মুনির আর্টিস্ট' এর নির্মাতা এ কে এম জাকারিয়ার সাথে। তার কাছে জানতে চাই ছবি তৈরির কথা। "এটা খুব সম্ভবত ২০০৪ সালের কথা। আমি কাজটা শুরু করেছিলাম। তারপরে একটা দীর্ঘ সময় গেছে । আমি উনার ব্যাপারে কাজ করতে আগ্রহী হলাম এটা সম্ভবত ৯৮ কি তারও আগে, আমার এক্সাটলি মনে নাই। উনি তখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, একটা এক্সিবিশিন করেছিলেন শিল্পাঙ্গনে। আমি তো নিজে আর্টেরও লোক না বা পেইন্টিং-এর লোক না। আমরা তো উনাকে (শিল্পী মনিরুল ইসলামকে) চিনি একজন প্রবাসী শিল্পী হিসেবে। কিন্তু আমি যখন উনার কাজ দেখলাম তখন আমার কাছে মনে হল যে উনার কাজের মাঝে বাংলাদেশের যথেষ্ট উপস্থিতি রয়েছে, বাংলাদেশ ইজ ভেরি মাচ দেয়ার ইন হিজ ওয়ার্ক। বাংলাদেশের মাটি, নদী, জল, বৃষ্টি –এরকম জিনিসগুলো আছে উনার কাজে। তখন উনার প্রতি আমার আগ্রহ হয়। তো আমি উনার সাথে যোগাযোগ করি। আমি ছবির কাজ আগেও করতাম, তো উনাকে বললাম যে, মুনীর ভাই আপনার উপর আমি একটা কাজ করতে চাই। বললেন যে, আচ্ছা ঠিক আছে কর। তারপরে শুরু করলাম। এই করতে করতে আমার প্রায় ন'বছর চলে গেছে। পরে আমি উনার সাথে মাদ্রিদে গেছিলাম দুইবার। তখন আমি শুট্যিং করলাম। উনার সাথে আমি স্পেনের মাদ্রিদ, টলেডো ও সারগোসায় বিভিন্ন সময় শুট্যিং করেছি।"

উনার কাজের স্ট্রাকচারটা সম্পর্কে জানতে চাই। উনি বলেন, "আমি একটা পার্সনাল জায়গা থেকে এই ছবিটা বানাতে চাইছিলাম। আপনি দেখবেন যে আমি ঢাকা থেকে চাঁদপুর হয়ত উনার সাথে ট্রাভেল করছি। ওই ট্রাভেলের ফাঁকে ফাঁকে আমি উনার স্টোরিগুলো দেখাব। কিন্তু পরে ওই স্ট্রাকচারটা আমি আর রাখতে পারি নাই।" ছবির শেষে টু বি কনটিন্যিড প্রসঙ্গে বলেন, "এটা আমি লিখছি এই কারণে যে ছবির শুরুতে দেখবেন আমি একটা মেইল করছিলাম যে, মুনীর ভাই আমি এই ছবির কাজ কবে শুরু করছি আমার ঠিক মনেও নাই। আর তাছাড়া উনি যেহেতু আছেন, কাজেই আমার ছবিটাও তো শেষ করা চাই।"

ছবিটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হলেও আপাতত এটা আর কোথাও প্রদর্শনের সম্ভবনা নেই বলে জানালেন নির্মাতা এ.কে.এম. জাকারিয়া। উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে ছবিটি নিয়ে দর্শকের যে আগ্রহ তা দেখে ভাল লেগেছে বলে জানান। যদিও প্রথমে একটি প্রদর্শন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পরে দর্শক সংখ্যার কথা বিবেচনা করে ২য় প্রদর্শনী করা হয়েছে ছবিটির।