সাহিত্যের চলচ্চিত্র হয়ে ওঠা

শবনম ফেরদৌসী
Published : 16 Nov 2019, 03:31 PM
Updated : 16 Nov 2019, 03:31 PM


শুরু করতে চাই কবি, চলচ্চিত্রকার পুর্নেন্দু পত্রী ও সত্যজিৎ রায়ের একটি আলাপ দিয়ে । পত্রী নতুন একটি ছবিতে হাত দিয়েছেন। এরকম সময়ে রায় বাবুর সাথে তাঁর দেখা। খুব সম্ভব মানিক বন্দোপাধ্যায়ের "ছোট বকুলপুরের যাত্রী" কিংবা রবীন্দ্রনাথের "স্ত্রীর পত্র" হবে। তো সত্যজিৎ শুনে বললেন, "শর্ট ফিল্ম"? পত্রী মনক্ষুন্ন হলেন এবং জোর গলায় জানালেন তিনি ফিচার লেন্থ ফিল্ম বানাচ্ছেন। সত্যজিৎ বললেন "কিন্তু , ওটা তো শর্ট ফিল্মের গল্প।" ছবিটি নির্মান করতে গিয়ে পত্রী পরে স্বীকার করেন " রায়বাবু ওয়াজ রাইট"। ছবিটি ঝুলে যায় এবং কাহিনীর সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। এই উদাহরণ টানলাম এ কারণে, ঠিক কোন সাহিত্যটি চলচ্চিত্র হবে এবং তা যথাযথ হয়ে উঠবে কিনা তা বর্তায় পরিচালকের ওপর। নির্মাতার পরিমিতিবোধের উপর। কোন গল্প বা উপন্যাসের কতখানি বিন্যাস ঘটবে তার পরিমাপ করার ক্ষমতা নির্মাতার জন্যে অপরিহার্য। না হলে সেই ছবিই শুধু নয়, ঐ সাহিত্যের প্রতিও অবিচার করা হয়। দুটো মাধ্যম একসঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে। সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মানের প্রথম চ্যালেঞ্জ বোধ করি এই পরিমিতি বোধ।
সাহিত্য কেন চলচ্চিত্রে সফল হয়ে উঠেনা , যদি সে আলাপে যাই তবে দেখবো সাহিত্যের দশা অনেকটা "আপনা মাসে হরিণা বৈরী"। সাহিত্য যে কাজটি করে তা হচ্ছে কল্পনাকে স্বাধীনতা দেয়। পাঠক সাহিত্য পড়ে তার নিজের মতো করে একটা দৃশ্যরূপ নির্মান করে। সেখানে কেউ শট দেখে ওয়াইড এ্যাংগেলে কেউ দেখে ক্লোজ আপে। কারো স্ক্রীন ছোট, কারো বড়। কারো ভালো লাগে লো কী লাইট, কারো হার্শ লাইট। ফলে লিপিবদ্ধ সাহিত্যের দৃশ্যরূপ যখন ক্যামেরায় ধারন করা হয় তখন তা এক ধরনের বন্দীত্বের শিকার হয়। নির্মাতা একধরনের সিদ্ধান্ত টেনে দেয় দর্শকের কল্পনার জগতে । দর্শকের কল্পনার সাথে পর্দার দৃশ্যায়নের যখন মিল খায়না তখনই বিপত্তিটা ঘটে। সেই সিনেমা একজনের ভালো লাগলো তো আরেকজনের লাগলোনা। এমনকি যিনি লেখক তারও হয়তো ভালো লেগেছে, কিন্তু দর্শকের ভালো নাও লাগতে পারে। উদাহরন হিসেবে 'চাকা'র কথা বলতে পারি। সেলিম আল দীনের মঞ্চনাটক "চাকা" দেখে অনুপ্রানিত হয়ে মোরশেদুল ইসলাম একটি চিত্রনাট্য রচনা করেন এবং ছবিটি নির্মান করেন। দেখা গেল, সেলিম আল দীন সে ছবি পছন্দ করলেন , কিন্তু দর্শক প্রত্যাখ্যান করলেন। এমন কি চাকার মঞ্চ নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ মেনে নিতে পারেননি সেলুলয়েডের 'চাকা'কে। তাঁর মতে ছবিতে 'চাকা'র স্পিরিচুয়াল দিকটি অনুপস্থিত। মঞ্চের ত্রি মাত্রিকতায় যে অপার্থিব মূহুর্তের জন্ম হয় তা চলচ্চিত্রে সঞ্চারিত হয়নি। কিন্তু এই 'চাকা'ই নির্মাতা ও বোদ্ধা দর্শকের কাছে ব্যপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। মোরশেদুল ইসলামের 'চাকা' বাংলাদেশের নির্মিত নান্দনিক ভাষার চলচ্চিত্রের একটি। নৈঃশব্দের ভাষা , চিত্রায়নের বিন্যাস ভঙ্গী ছবিটিকে উচ্চমার্গে পৌছাঁতে কম কিছু সাহায্য করেনা। তিনি বরং মঞ্চের ফর্ম কে ভেঙে তা চলচ্চিত্রিক ভাষা দানে সক্ষম হয়েছেন বলেই সমালোচকরা মনে করেন। ফলে সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমগত যে দ্বন্দ্ব তা থেকে মুক্তির উপায় হয়তো একটাই – নির্মাতার ঐ সাহিত্যটিকে হৃদয়ঙ্গম করবার প্রক্রিয়া। আমি বলবোনা সঠিক। সঠিক বলে কোন শব্দ নেই শিল্পের অভিধানে। নির্মাতা যদি তার মত করে গল্প, উপন্যাস, নাটক কিংবা কবিতাকে উদঘাটন করতে পারেন, তবে হয়তো একটা রিপ্রেজেন্টেশন ঘটতে পারে। আর তাতে চাই আলাদা কোন মাত্রা যা নির্মাতার একদম নিজস্ব। কবি বা লেখক যা বলে গেছেন তাই যদি নির্মাতা গড়গড় করে মুখস্তবিদ্যা আওড়ান তবে আর সিনেমা কেন? সিনেমার কাজই তো কথিত ভাষ্যের বাইরে নতুন কোন বয়ান । যা পাঠক দেখেনি তা দেখতে দেয়া। কিভাবে সে দেখাটা দেখানো যায় দর্শককে তার যোগ্য উদাহরন বোধ করি, বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র "হুলিয়া"। কবি নির্মলেন্দু গুনের ৮৩ লাইনের একটি কবিতাকে দৃশ্য কাহিনীতে রূপ দিলেন চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল। যে দর্শকের কবিতাটি পড়া নেই, তার বুঝতে সমস্যা হয়না ডায়লগ বিহীন আবহ সঙ্গীতের ঘটনা পরিক্রমা। ছবির এক পর্যায়ে দু-একটা ডায়লগ কবিতা থেকে ধার করা। হুলিয়া মাথায় করে গ্রামে ফেরত আসা বিপ্লবীর প্রাক্তন প্রেমিকার নান্দনিক উপস্থাপন এবং নেপথ্যে এক চিঠি পাঠ। যার সাথে মূল কবিতার কোন সম্পর্ক নেই। মূল কবিতায় বাসন্তী, বিহারে ডাকাত স্বামীর ঘর করে। ছবিতে সে কলকাতায় অভিবাসিত হয়েছে এবং বিপ্লবীর আসবার অপেক্ষা করছে। বিপ্লবী যখন পুনরায় হুলিয়া মাথায় নিয়ে গ্রাম ছাড়ছে তখন শুরু হয় কবিতাটি মনোলগের মতো করে। পুরো কবিতা কিন্তু ততক্ষনে দর্শকের দেখা হয়ে গেছে। তানভীর মোকাম্মেল কবিতাটিকে যে কতোভাবে শাফল করেছেন তার সিনেমা ভাষ্যে তা বুঝতে পারবেন কবিতার পাঠক এবং তাতে করে কবিতা এবং সিনেমার কাব্য ভাষার কারোরই মানহানি ঘটেনা। যথাযোগ্য মর্যাদায় দু'জন যেন দুজনের হাত ধরাধরি করে চলে।


এই যে "পাঠকে"র সাহিত্য "দর্শকে"র কাছে চলচ্চিত্র হয়ে উঠতে চায়না বলে আক্ষেপ, অথচ আমরা লক্ষ্য করে দেখবো বাংলাদেশের হাতেগোনা যে কয়টি চলচ্চিত্র শিল্প হয়ে উঠতে পেরেছে তার বেশিরভাগ সাহিত্য নির্ভর। 'চাকা' ও 'হুলিয়া'র কথা তো এসে গেলো। কিন্তু তার আগেই নির্মিত হয়ে গেছে ঋত্ত্বিক ঘটকের 'তিতাস একটি নদীর নাম' ,মসিহউদ্দীন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর 'সূর্য দীঘল বাড়ি' আব্দুল্লাহ আল মামুনের 'সারেং বউ' । এর পর একে একে নির্মিত হয়েছে আবু সাইয়ীদের আবর্তন (ছাতা), কীত্তনখোলা, শঙ্খনাদ, গৌতম ঘোষের পদ্মানদীর মাঝি, সুভাষ দত্তের বসুন্ধরা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর "লালসালু" নিয়ে তানভীর মোকাম্মেলের "লালসালু"। শহীদুল জহিরের গল্প অবলম্বনে নুরুল আলম আতিকের চতুর্থমাত্রা, আশিকের ফুলকুমার , ইলিয়াসের রেইনকোট অবলম্বনে জাহিদুর রহিম অঞ্জনের মেঘমল্লার এবং নূর ইমরানের কমলা রকেটের নাম উল্লেখ করতেই পারি। সাহিত্য থেকে ছবি বহু নির্মিত হয়েছে এদেশে। এক চাষী নজরুল ইসলামীইতো শরৎচন্দ্রের সাহিত্য কেন্দ্রীক বেশ কিছু ছবি নির্মান করে গেছেন।


ট্রিটমেন্ট একটি চ্যালেঞ্জের জায়গা সাহিত্যের সিনেমা হয়ে উঠার ক্ষেত্রে। আমি নিখুঁত নির্মানের কথা বলছিনা। বলছি সাহিত্যে যে কথাটি বলতে চাওয়া হচ্ছে, যা এই সাহিত্য সৃষ্টির মূল রস – সেই নার্ভটাকে ঠিকঠাক ধরতে পারা। ছবিটা কেন বানাতে চাচ্ছি ? কারন ঐ সাহিত্যের আসল নির্যাসটুকু আমাকে স্পর্শ করেছে বলেইতো। তো দেখা গেলো নির্মাতা ২ ঘন্টা ধরে পর্দার এ মাথা থেকে ও মাথা দৌড়াচ্ছেন। কিন্তু পোস্টে গোলটা যুৎসই মতো পড়ছেনা। আমরা গল্প দেখছি, কাহিনী শুনছি, কিন্তু কোথায় যেন স্পর্শ করছেনা। গল্প পড়ে যে আবেগ তাড়িত হয়েছিলাম ছবি দেখে সে আবেগ উথলে উঠছেনা। তাতে তো নির্মাতার পুরো শ্রম মাঠে মারা যাবে। দু'টি ছবির উদাহরন টানতে চাই। হুমায়ুন আহমেদের কাহিনী নির্ভর মোরশেদুল ইসলামের 'অনীল বাগচীর একদিন' এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'রেইনকোট' অবলম্বনে জাহিদুর রহিম অঞ্জনের 'মেঘমল্লার' । অনীল বাগচীতে হয়তো ভিজ্যুয়ালের মুন্সিয়ানা নেই, কিন্তু হুমায়ুনের গল্পের আবহটি অটুট আছে। এদিকে মেঘমল্লারে দেখা গেছে নান্দনিক দৃশ্যায়ন সুবিন্যস্ত কাঠামো। নির্দিষ্ট কিছু স্থানের বিভিন্ন সময়ের চিত্র দেখিয়ে একধরনের কাব্যিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে, বৃষ্টির সুন্দর শট , শব্দ ও আবহসঙ্গীতে সেই কাব্যকে পূর্নতা দিতে সহায়তা করে। কিন্তু রেইনকোটটি যে একটি রুপক , গল্পের ক্যাটালিস্ট ফোর্স তা পরিস্কার নয় ট্রিটমেন্টে গিয়ে। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার রেইনকোট গায়ে চাপাবার পর অপর এক ভীরু মানুষ যে সাহসী হয়ে ওঠে, তাতে করে নির্যাতনের দৃশ্যায়নে রেইনকোট ঘিরে যে ডিটেইলের দরকার ছিলো তা অনুপস্থিত। ফলে এই ভীরু শিক্ষকের আকস্মিক দেশপ্রেমের অটল কার্যকরন দর্শকের মনে তীব্র হয়ে দাগ ফেলে না। বিশেষ করে গল্পটি যাদের পড়া নেই। ঠিক তেমনি ভীরু এক ছাত্র অনীল বাগচী যখন মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে এদেশের মমতাময়ী রুপ দেখে আবেগতাড়িত হয়, তখন সে আবেগ আমাদেরও আপ্লুত করে বৈকি। এদিক থেকে একটি কাজ করতে পেরেছে নূর ইমরান মিঠুর " কমলা রকেট"। কাহিনীর গতিময়তার পাশাপাশি তীব্র সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছে দর্শককে। শ্রমিক- মালিকের চিরায়ত যে সত্য সম্পর্ক তা দর্শককে প্রভাবিত করে ছাড়ে। শাহাদুজ্জামানের দুটি ছোট গল্প "মৌলিক" ও "সাইপ্রাসে" এর যৌথ বয়ান কমলা রকেট। যেহেতু লেখক ও নির্মাতা একযোগে কাজ করেছেন চিত্রনাট্য নিয়ে সেইজন্যেই কিনা গল্পে ততটা ঘাটতি দেখা যায়নি। দুটি গল্পকে তারা একটি রকেটে ভালোভাবেই ওড়াতে সক্ষম হয়েছেন।
একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবেনা একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা আগে একজন লেখক। চিত্রনাট্য দাঁড় করাবার জন্য একের পর এক খসড়া লেখা লিখতে হয় তাকে। এবং তা বিভিন্ন ধাপে ধাপে। গল্প সংক্ষেপ থেকে শুরু করে কাহিনী এবং সবশেষে চিত্রনাট্য লেখা তার জন্যে অপরিহার্য। চিত্রনাট্য যদিও সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেনি। কিন্তু জগতে বহু চিত্রনাট্য আছে যা কম কাব্যিক নয় , গদ্য ভাষার বুননে তা কম পোক্ত নয়। মৌলিক সাহিত্যকেও নির্মাতা একই কাঠামোয় ঘষামাজা করেন। মৌলিক সাহিত্য তখন আরেক কাঠামোয় পুনঃস্থাপিত হয়। নির্মাতা যখন তাকে দৃশ্যরুপ দান করেন তখন তাও এক প্রকার সাহিত্য মূল্য বহন করে না কি? বরং এভাবেও ভাবা যেতে পারে সাহিত্য সেই দুর্লভ উপাত্ত যা পুনরায় নতুন কোন শিল্প নির্মান করতে পারে। ব্রেসো বলেছেন "চলচ্চিত্র প্রথমে আমার মাথায় জন্মলাভ করে এবং কাগজে তা মৃত্যুবরন করে , বাস্তব স্থানে জীবন্ত মানুষের অভিনয়ে তা আবার পুনঃজীবন লাভ করে যা আবার ফিল্মে মৃত্যুবরন করে আবার তাকে যথাযথ ভাবে সম্পাদনা করে পর্দায় প্রদর্শন করলে তা পানিতে পরিস্ফুটিত ফুলের মত জেগে উঠে। " এক্ষেত্রে আমরা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রকে যুগলবন্দী বলতে পারি। যদি সেই গৎ কোন পাকা জহুরীর হাতে পড়ে তবে পারস্পরিক বোঝাপড়া মন্দ হবার কথা নয়।