নীল মুকুটের রাজকন্যারা

ফাহমিদুলহক
Published : 7 Sept 2021, 07:56 AM
Updated : 7 Sept 2021, 07:56 AM


তাদের মাথায় নীল টুপি, সেই টুপিকেই বলা হচ্ছে নীল মুকুট। ওই ক্যাপের ওপর বাড়তি মহিমা আরোপের কারণ অবশ্য রয়েছে। এতদিন তারা ছিল অন্তরীণ ও শৃঙ্খলিত, পশ্চাৎপদতা ও অধস্তনতা ঘুচিয়ে আজ তারা শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে। এই দায়িত্ব পালনে তারা রওয়ানা দিয়েছে পৃথিবীর অপর প্রান্তে। জাতিসংঘ তাদের নিযুক্ত করেছে শান্তিপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায়। কামার আহমেদ সাইমনের 'নীল মুকুট'-এর বিষয় হয়েছেন বাংলাদেশের নারী পুলিশ, বিশেষত যারা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার বাহিনীতে নিযুক্ত হয়েছেন।

লিখিত-অলিখিত সেন্সর ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত স্ব-আরোপিত সেন্সরের দেশে কামার কি তাহলে দেশপ্রেমে গদগদ, নারীপ্রণোদনামূলক প্রামাণ্য বয়ান হাজির করলেন তার ছবিতে? যখন আমাদের দেশে পুলিশবাহিনী আগের তুলনায় মানে-সম্মানে-প্রতাপে অধিষ্ঠিত, এই কাহিনী বর্ণনায় কামার কতটুকু ভেতরে ঢুকতে পারলেন, এই প্রশ্ন উঠবে। বাইরে বাইরে তো শৃঙ্খলারক্ষার বাহিনীকে সর্বত্রই দেখা যায়, কিন্তু তাদের ভেতরের খবর তো আমরা কোথাও দেখি না। তাদের সামষ্টিক রূপের বহিরঙ্গ প্রকাশিত হবে তাদের তৎপরতায়, কিন্তু ভেতরের মানবিক কিংবা আবেগগত দিকটাকে আড়াল করে রাখাটাই হলো মূল ব্যাপার, তাদের শক্তির উৎসও সেখানেই। প্রশিক্ষণের সময়ই বলা হয়, "মনে যাই থাক ক্রাউডের সামনে শক্ত থাকতে হবে, এটিচিউড দেখে ক্রাউড ভয় পাবে।" এটা এত সতর্কভাবে অনুসরণ করা হয় যে, উর্দির আড়ালের জীবটিকে শেষ পর্যন্ত আমরা পুলিশ হিসেবেই মনে রাখি, রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে নয়। ছবি দেখে অনুমান করা সম্ভব, কামার নারীপ্রগতির বয়ান হাজির করার অঙ্গীকার ঘোষণার মধ্য দিয়ে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে ঢুকেছেন, আর উর্দির আড়ালে মানুষগুলোর মানবিক অনুভূতিগুলো ক্যামেরার মেমরি কার্ডে ভরে বের হয়ে এসেছেন।

আগের ছবি 'শুনতে কি পাও!'-এর মতোই পরিচালক প্রামাণ্য উপকরণের মধ্য দিয়ে গল্প বলার পদ্ধতিতে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন। নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চপদে উঠে আসা একজন সিনিয়র অফিসার শাহানা এবং জুনিয়র অফিসার মোনালিসা এই চলচ্চিত্রের প্রধান দুই চরিত্র। তবে অন্যান্য অফিসার যেমন আফরোজা, মাহমুদা, শাহজাদী, শালিনা এরকম আরও চরিত্র রয়েছেন তাদের ঘিরে। কাহিনীর দু'টি পর্যায়, বাংলাদেশ পর্ব ও হাইতি পর্ব। অর্থাৎ জাতিসংঘ শাহানা-মোনালিসাদের এই দলটিকে হাইতিতে শান্তিরক্ষার কাজে নিয়ে গিয়েছে। মূলত হাইতি পর্বটিই চলচ্চিত্রের বেশি অংশ জুড়ে রয়েছে। বাংলাদেশ পর্বটি জুড়ে প্রশিক্ষণ দেখানো হয়েছে ও প্রস্থানের প্রস্তুতির বর্ণনা রয়েছে। এই পর্বটি কিছুটা একঘেঁয়েও বটে। কিন্তু হাইতি পর্বটি, আমাদের মেয়েরা বিদেশে কীভাবে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে– দর্শককে এরকম একটা কৌতূহলী আগ্রহের মধ্যে আটকে রাখবে।


শাহানা তার কাজের ফাঁকে সন্তানের সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করছেন, পারিবারিক খুঁটিনাটি বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন, ফোনে বোন ও বোনজামাইয়ের দাম্পত্য কলহ মেটাতে ভূমিকা রাখছেন। অন্যদিকে মোনালিসা ফোনে গ্রামের বাড়ির উঠোনে স্বামী-সন্তানের বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য দেখছেন। মোনালিসার স্বামীও জাতিসংঘের মিশনে আফ্রিকায় রয়েছেন, তাদের মধ্যে সময় ব্যবধানের কারণে যোগাযোগ-সংকট তৈরী হয়েছে ও মান-অভিমানের জন্ম নিয়েছে, শাহানা তারও সমাধান বাতলে দিচ্ছেন। যদিও হাইতি অনেক সুন্দর দেশ, তাদের সবারই দেশের জন্য, দেশের মাটির জন্য মন খারাপ হয়। "এদেশের খাবারে টেস্ট নেই", "দেশের আম এদের খাওয়াতে পারলে এরা পাগল হয়ে যেত"–এরকম ছোটখাটো কথাবার্তায় গল্প জমে উঠতে থাকে। কিংবা সস্তা বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে "এই গুলিস্তান, গুলিস্তান" আওয়াজে তারা মুহূর্তগুলো আনন্দময় করার চেষ্টা করেন। আবার প্রবাসী জীবনের চাপ দূর করার অংশ হিসেবে, কঠোর প্রশিক্ষণের পরে, 'নাগিন'-নৃত্যে মেতে উঠেছেন কেউ কেউ। সেই নৃত্যের রেশ ধরে পুরুষ ঊর্ধ্বতন কর্তার রঙ্গতামাশার ব্যর্থ তৎপরতা অভিনয় করে দেখান শাহজাদী, সবাই মিলে জমজমাট হাসাহাসিতে মত্ত হয়ে ওঠেন তারা। রূপচর্চায় পারদর্শী শালিনা যে কেবল নিজেকেই সুন্দর করে সাজান তা নয়, অন্যদের সৌন্দর্য পরিচর্যার দায়িত্ব সবাই তার হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। এভাবে আনন্দবেদনার এক কাব্য রচিত হতে থাকে।

'শুনতে কি পাও!' চলচ্চিত্রে শেষের দিকে একটা ক্লাইমেক্স তৈরী হয়েছিল, বন্যা থেকে রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণে এলকাবাসী যৌথভাবে যেভাবে বিরাট যজ্ঞে অবতীর্ণ হয়েছিল, তা ঘটনার এক 'ঘনঘটা' হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল, যা চলচ্চিত্রের দর্শকদের উত্তেজনা সরবরাহ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে নারী পুলিশদের কোনো কঠোর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেখা যায় না, কোনো অ্যাকশনে যেতে দেখা যায় না। ফলে থ্রিল, উত্তেজনা বা ক্লাইমেক্সের মতো বড় বিষয় এই চলচ্চিত্রে নেই। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদেশে এই নারী পুলিশদের বড় কোনো দায়িত্বও দেয়া হয় না, টহল ও পাহারাই কেবল তাদের দায়িত্বের সীমা। বিপরীতে শাহানা মোনালিসার আলাপচারিতার দীর্ঘ সিকোয়েন্সটিই এখানে বিকল্প হিসেবে রয়েছে। শেষ দৃশ্যটি বেশ প্রতীকী। দেশের প্রশিক্ষণ পর্বে সবাই পুরুষ কর্তাদের অধীনেই কাজ করেছেন। হাইতিতেও পুলিশ কমিশনার থেকে শুরু করে জাতিসংঘের কর্তারা সব পুরুষ। শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, টাওয়ারে দায়িত্বরত এক নারী পুলিশ। তাকে ওয়াকিটকিতে নানান নির্দেশনা দিচ্ছেন এক পুরুষ ঊর্ধ্বতন, আর নারী সহজভাবে উত্তর দিচ্ছেন, "সিচুয়েশন সব ঠিক আছে, সুন্দরভাবে ডিউটি করছি স্যার"।
এই দায়িত্ববোধ, আত্মপ্রত্যয় তাদের নিশ্চয়ই একদিন নির্দেশনা দেবার জায়গায়ও নিয়ে যাবে।