‘নিষিদ্ধ’ তকমার আড়ালে ভণ্ডামির বয়ান

মিঠুন চৌধুরী
Published : 13 April 2019, 09:37 AM
Updated : 13 April 2019, 09:37 AM

মধ্যযুগের ভারতে প্রেম ও পূজায় মানব শরীরের আরাধনা হলেও বর্তমানে যৌন শিক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে 'নিষিদ্ধ' তকমা লাগিয়ে।

ভন্ডামিপূর্ণ এই সমাজ বাস্তবতার উৎস সন্ধান চলেছে ঐতিহাসিক নির্দশন থেকে তীর্থ, সাধারণ থেকে বিশেষজ্ঞ সবখানে, সবার কাছে।

অনামিকা ব্যানার্জির 'দ্যা থার্ড ব্রেস্ট' তথ্যচিত্র ভন্ডামির মুখোশ উন্মোচনের এক বন্ধুর যাত্রা।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বন্দর নগরীর মেহেদীবাগে 'বিস্তার: চিটাগাং আর্টস কমপ্লেক্স'-এর পরম্পরা কক্ষে এর প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

এক ঘণ্টার কম দৈর্ঘের তথ্যচিত্রটি মন কেড়েছে চট্টগ্রামের বোদ্ধা দর্শকের। প্রদর্শনী শেষে আলোচনায় অংশগ্রহণ আর উচ্ছ্বাস প্রমাণ করে তা কতটা।

গোয়া সমুদ্র তীরে পিতামহীর গল্প বলার স্মৃতিচারণার মধুর স্মৃতি দিয়ে তথ্যচিত্রটির সূচনা হলেও দ্বিতীয় দৃশ্যটি দর্শককে নিয়ে যায় এক বিরূপ বৈপরিত্যে।


২০১২ সালে দিল্লী ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে একের পর এক গণধর্ষণের সংবাদ শিরোনামে ভেসে ওঠে। এরপরই সবখানে শুরু হয় ধর্ষণ ও যৌন অসদাচরণ নিয়ে আলোচনা।

কিন্তু ভারতের বিদ্যালয়ে যৌন শিক্ষা নিষিদ্ধ। কেন? 'ভারতীয় ঐতিহ্যের বিরোধী' অভিহিত করে আড়াল করে রাখা হয়েছে এই শিক্ষা পদ্ধতি।

কী সেই ঐতিহ্য? তা সন্ধানে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে আসেন অনামিকা।

সে যাত্রা কেমন ছিল? অনামিকা বলেন, আমি অনেকের কাছে গেছি। বিখ্যাত অনেকেই এ বিষয়ে ক্যামরার সামনে কথা বলতেই রাজি হননি।

শুধু তাই নয় বাধা এসেছে দৃশ্যায়নেও।

বেনারসের রাস্তায় দৃশ্যধারণের বর্ণনা দিয়ে অনামিকা বলেন, সেখানকার লোকজন আমার দলকে রাস্তায় ঘিরে ফেলে। এরপর পুলিশ এসে আমাদের উদ্ধার করে।


কী সেই ভারতীয় ঐতিহ্য? এরই সন্ধানে ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটে যান অনামিকা। কথা বলেন বিজ্ঞানী, সমাজ কর্মী, শিক্ষার্থী ও সাধারণের সাথে।

সেসব মন্দিরে যান যেখানে দেবদেবীর প্রেম ও কামনার দৃশ্যচিত্র ধারণ করা আছে স্থাপত্যে। নিত্য পূজা চলে এখনো সেই দেবদেবীর। আরাধনা হয় পুংজননেন্দ্রিয়ের এবং ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে নারী জননেন্দ্রিয়েরও পূজা হয়। কিন্তু মধ্যযুগীয় উন্মুক্ত দেহী নারী দেবীর পূজায় আগ্রহ নেই বর্তমানের তরুণদের।

এমনকি সেসব মন্দিরে সংক্ষিপ্ত দৈর্ঘের পোশাক পরিহিত নারীদের প্রবেশাধিকারও নিষিদ্ধ।

দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ভেসে ওঠে গীত গোবিন্দের বয়ান। বেজে যায় হাসন রাজার গান।

পিতৃতন্ত্র কিভাবে জেঁকে বসেছে উদার এক সমাজের পিঠে অনামিকা আমাদেরকে সেই দিকটা দেখিয়ে দেন।


এসময়ের ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বলেন, যৌন শিক্ষা সম্পর্কে তারা নিজেরাই জেনে নেন নিজেদের মত করে। আবার এও স্বীকার করেন, অবদমনের ফলে নারীর শরীরের প্রতিই সব থেকে বেশি আকর্ষণ তাদের।

তিন হাজার বছর আগে মানব শরীর যেখানে পবিত্র জ্ঞানে পূজিত হতো সেই ভারতে যৌন শিক্ষা আজ ভন্ডামির আড়ালে নিষিদ্ধ শুধু ঐতিহ্যের অজুহাতে।

তথ্যচিত্রে সেই প্রাচীন দেবী মিনাক্ষীর কথা জানা যায় যার ছিল তৃতীয় স্তন। এই 'বিকৃতি' চিন্তায় ফেলেছিল মিনাক্ষীর পিতামাতা রাজা ও রানীকে।

তারা মিনাক্ষীকে ছেলে হিসেবেই বড় করেন। একের পর এক যুদ্ধে জয়ী মিনাক্ষী 'পূর্ণতা' পাওয়ার দৈববাণী হয়েছিল জন্ম লগ্নেই। বলা হয়েছিল, বিবাহের পরই তার তৃতীয় স্তন বিলুপ্ত হবে। তার আগে নয়।

নারী জীবনে পুরুষের 'অপরিহার্যতার' ট্যাবু প্রাচীনকালেও ছিল। এতসব বাধা ডিঙ্গিয়েই নারীর এগিয়ে যাওয়ারই উপাখ্যান 'দ্যা থার্ড ব্রেস্ট'।


প্রদর্শনী শেষে আলোচনায় প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ বলেন, অনামিকার দ্যা থার্ড ব্রেস্ট এক দুঃসাহসী ছবি। ছবিতে লোকজ সংস্কৃতি ও আদিবাসী জীবনচিত্র খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

সাহিত্যিক রাজু আলাউদ্দিন বলেন, ধর্ম ও যৌন শিক্ষার মত বিষয়গুলো নিয়ে অনামিকার মত এখনই বলা উচিত। আমি মনে করি, তিনি চেতনার শিক্ষক। তাকে আমাদের মাঝে পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত।

এই তথ্যচিত্রে 'পিরাভি' খ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার সানি জোসেফের কাজ প্রশংসিত হয়েছে দর্শকদের কাছে।