আসেম আনসারীর একক প্রদর্শনী : চিত্রের কাব্য ভ্রমণ

অলাত এহ্সান
Published : 4 Feb 2016, 12:34 PM
Updated : 4 Feb 2016, 12:34 PM

চৈনিক কবি লি পো চাঁদের মোহনীতায় এতটাই আকৃষ্ট ছিলেন যে, এক চাঁদনী রাতে ঝিলের জলে নৌকা ভাসালেন চাঁদ দেখার জন্য। একসময় তাঁর খেয়াল হলো ঝিলের স্বচ্ছ জলেও আরেক চাঁদ দেখা যাচ্ছে যা আকাশের চাঁদের মতোই আকর্ষণীয় এবং তিনি ইচ্ছে করলেই এই চাঁদটা ধরতে পারেন। লি পো সেই চাঁদ ধরতে গিয়েই জলে ডুবে মারা যান। 'চাঁদে পাওয়া' বিষয়টা মুটোমুটি এই। সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কবিদের ভেতর এমন কথা বেশি প্রচলিত। যখন কিনা কাব্যের ঘোর তৈরি হয় তখন একে বলেন 'চান্দে পাওয়া মানুষ'। অর্থাৎ ভাবই কবিকে তাড়িত করে কবিতা লেখার জন্য।

চাঁদের প্রতি যার আকর্ষণ আত্মিক, মাঘের এই শিশির ঝরা রাতে পূর্ণিমার চাঁদ দেখা থেকে তাকে কোনোভাবেই নিবৃত করা যাবে না। তখন আমাদের মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতা 'আট বছর আগের একদিন'র লাইলগুলো—'শোনা গেল লাশকাটা ঘরে/ নিয়ে গেছে তারে;/ কাল রাতে- ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হলো তার সাধ'। চিত্রকর্মেও এই বিষয়টা পাওয়া যায় আসেম আনসারীর কাজে। গত ১৫—৩১ জানুয়ারি, রাজধানীর ধানমণ্ডির ৬ নাম্বার রোডের ৪ নাম্বার বাড়ির 'গ্যালারী চিত্রক'-এ হয়ে গেল তার চতুর্থ একক চিত্র প্রদর্শনী। 'Less is more' শিরোনামের ১৬ দিনব্যাপী এই চিত্র প্রদর্শনী। মাঘের সন্ধ্যার লগ্নে বরেণ্য চিত্রশিল্পী অধ্যাপক সমরজিৎ রায় চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত চিত্র শিল্পী মনিরুল ইসলাম।
৩টি জল রং এবং ৩১টি মিশ্র মাধ্যমে আঁকা চিত্রকর্ম স্থান পায় প্রদর্শনীতে। এগুলো সেই ২০১৩ থেকে শুরু করে '১৫-এর শেষ অবধি, বিভিন্ন সময়ে এঁকেছেন শিল্পী। এক-একটি চিত্রে শিল্পীর আঁকার প্রতি যত্ন ও অনুভূতির অতল বোঝা যায়। দীর্ঘ বিরতির পর প্রদর্শনীর মতোই জনাব আনসারী যেন মাটির গভীরে ফিরতে চেয়েছেন ছবিতে। তার ছবির বিষয়বস্তুর দিকে দৃষ্টি দিলেই তা বোঝা যায়।

যেমন—বাঁশের খুঁটিতে চটের বেড়া,পাটখড়ি কিংবা নলিবাঁশের বেড়ায় ছড়ানো ছিন্ন কাপড়, দিঘীর জলে ভেসে বেড়ানো পাতি হাঁস, জ্যোসনা রাতে ক্লান্ত ঘোড়সাওয়ারের নদী পার হওয়া, পুরনো উঠোনে জমা বৃষ্টির জল এড়িয়ে কুঠিরে যাওয়ার জন্য ভাঙাচোড়া পথ, বেদেনীর ভাসমান গৃহ কিংবা নৌকা, ফসলের মাঠে আসা বর্ষার নতুন জলের মাছ ধরা, নদীরে পাড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে খালে মাছ ধরতে থাকা কিশোর-কিশোরীদের দেখা, গোধুলীতে গরুর পাল নিয়ে কৃষানের ঘরে ফেরা, গাগড়ি ভরে জল নিয়ে কৃষানির ঘরমুখী যাত্রা, মহিশের নদীর পাড় হওয়া, জলমগ্ন একাকী নৌকা, রশির অজস্র গিঁটে তৈরি ঝুলন্ত সেতু, পাট-খড়ির বেড়া দেয়া দুই ঘরের ফাঁক, মাছ ধরার নৌকার স্থির বসে থাকা, খয়াটে চাঁদের উপস্থিতে বেদেনী উদাম-উদাস মূর্তি, তেমনি রাতে তিন নারী কিংবা এক নারীর বিরহ যাপনের ন্যুড ইত্যাদি। আসেম আনসারির চিত্রে চাঁদ ও পাখিদের উপস্থিতি বহুবিধ। নদীর জলের ওপর এলিয়ে থাকা গাছের শাখায় শালিকের বিচরণ, ডালের ওপর জুবুথুবু বক, রহস্যময় আলোছড়ানো চাঁদনী রাতের শকুন, রৌদ্রস্নাত দুপুরে সোনালী ডানার চিলের ওড়াউড়ি ইত্যাদি।
আসেম আনসারীর ছবির গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সময়ের সীমারেখা অতিক্রম করা। দৃশ্যের গভীর চিন্তা ও অনুভূতিকে তিনি নানানভাবেই তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। প্রতিটি ছবিকেই এক কাব্যময়তার ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন তিনি। যেমন তার আধুনিক আদম ও ইভের দৃশ্যটি যা কিনা আজকের দিনের নারী-পুরুষের চরিত্র-চিন্তা আঁকা নিয়ে কথা বলে। ছবিটিতে দেখা যায়, মুখোমুখি বেতের চেয়ারে উপবিষ্ট একজন পুরুষ ও একজন নারী পরস্পরের দিকে সন্দেহ আর বিষাদের চোখে তাকিয়ে আছে। তারা হতে পারতো সম্মোহিত হতে। অথচ তারা সন্দেহের জগতে আজও ঘুরপাক খাচ্ছে। ফ্লোর জুড়ে আছে অজস্র ঝড়া পাতা, মনে হয় কতকাল ধরে তারা এইভাবে বসে আছে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ আর অন্তর্গত বিষাদ নিয়ে। একটা কুকুর আর মুরগীর উপস্থিতি তাদের গৃহস্থ দিনের কথা বলে, কিন্তু বেসিনে রাখা আধোয়া বাসন-কোসন দেখে মনে হয় সংসারের অনেক দিনের অমিমাংসিত কথা। যাদের যাতায়াতের জন্য বাইসাইকেলও আছে। কিন্তু পুরুষের পাশে রাখা টি-টেবিলে এক কামড় খাওয়া আপেল দেখে আমাদের মনে পড়ে যায় আদম ও হাওয়ার মিথের কাহিনী। একটা মিহি পর্দার ওপাশের ক্ষয়াটে হলুদ চাঁদ সেই অধিজগতের সঙ্গে এই জগতের দূরত্ব ও সময়ের পরিবর্তনকে আলাদা করেছে বটে; ছবির কোনো দেয়াল নেই, আছে একটা বৃক্ষশোভিত আবহ। অর্থাৎ সময়হীন একটা আভাস। তবে সেদিনও যেভাবে পুরুষ তার দুরবস্থা ও বিষাদের জন্য নারীকে দায়ি করেছে, একইভাবে নারীও; আজকের দিনেও তাদের সেই অবস্থাই আছে। যদিও চিত্রে তাদের নাগালে যোগাযোগের আধুনিক সরঞ্জাম—মোবাইল, ল্যাপটপের উপস্থিত আমরা দেখতে পাই। চিত্রের শিরোনামায় চিত্রী লিখেছেন, 'Today's Adam and Eve-/Same old fear and grief?!'

আনসারীর সব চিত্রে এমনিভাবে কবিতা, এক থেকে ছয় লাইনের পঙক্তি পাওয়া যায়। তার ছবিতে প্রবেশ ও অনুভবের জন্য এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ কবিতা ও চিত্রের একটা সমন্বয়ও দেখা যায়। আসেম আনসারী এক সময় মনের আনন্দে কবিতা লিখতেন।
তিনি একটা দৃশ্যকে শুধু দেখেনই না, তার ভেতর নিহিত অর্থও তৈরি করেন। যেমন দিঘীতে বেড়-জালে মাঝ ধরা। তিনি দেখেন, মাছেরা জলের সঙ্গে কথোপকথনে মত্ত—যদিও তাদের ধরার জন্য জাল ক্রমেই গুটিয়ে আসছে। 'In the borders of our lives/ With the dangling Conversations!'
আমাদের অস্বীকার করা সুযোগ নেই, সমাজে কিংবা সংসারে মানুষে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল, শত-সহস্র গিরুতে বাঁধা। এসব দিয়েই তৈরি হয়েছে পারস্পরিক সম্পর্কের সেতু। সেই সেতু পেরিয়েই মানুষের মনোলোকে অনন্ত যাত্রা। এই গিঁটগুলো খুললে কী বেরিয়ে আসবে আমরা জানি না, হয়তো সেতুটাই আলগা হয়ে যাবে। তাই একটা খুলে শেষ দেখতে গেলে হয়তো সবগুলো গিঁটই আলগা করতে হবে। তাতে করে শেষ পর্যন্ত হয়তো মানুষের নিত্য যাতায়াতের সেতুটাই ভেঙে পড়বে। এই গিঁটে বাঁধা পড়ে আছে কত শত স্মৃতি, হয়তো তা বেদনার। ছবি দেখে আমাদের মনে পড়বে জীবনানন্দ দাশের কবিতা, 'আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুড়ে / বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!' (হায় চিল)। চিত্রির ভাষায়, 'Who digs a knotted chain/ From the bottom of pain?' তার সোনালী ডানার চিল দেখেই মনে হবে, 'হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে / তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!' চিত্রি লিখেন, 'Golden winged eagle don't cry/ It's all over Bangla's river and sky.'। এভাবে আসেম আনসারীর চিত্রে জীবনানন্দ দাশের কবিতার ছায়া ও চিত্রের সুসমন্বয় দেখা যায়। তার চিত্রশিরোনামও জীবনানন্দের কবিতা থেকে নেয়া।

শুধু নস্টালজিয়া নয়, তার চিত্রে ইতিহাস-সচেতনতাও পাওয়া যায়। যেমন তার শকুনের চিত্রটি। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখবো, একজন হস্তারকের কাছেই কেবল হত্যার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায়। কারণ এই তথাকথিক সভ্য সমাজ মানুষের খবর রাখে না। আমাদের ইতিহাস বিকৃতির যে একটি পরিকল্পিত দিক আছে, তা আজ সবার কাছে পরিষ্কার। এই ইতিহাস-খেকো শকুন সম্পর্কে চিত্রি নিজেও সচেতন। তিনি জানেন শকুনের বিষ্ঠা ও বমি থেকে তৈরি হচ্ছে যে বিকৃতি, সেটাই আমাদের ইতিহাস হিসেবে দেখানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বা ঐতিহাসিকগণ না জানলেও ইতিহাস বিকৃতকারীরা ঠিকই জানে—তারা কী কী বিষয়ে পরিকল্পিত বিকৃতি ঘটিয়েছে। তাই শকুন নিয়ে আঁকা ছবিতে লিখেছেন, 'You may ask a vulture / for real history and culture.'। অর্থাৎ কিনা, ওই শকুনকে জিজ্ঞেস করলেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত সত্য। তা এও নির্দেশ করে, এখনও জাতির পতাকা খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন। যদিও ইতিহাস দলীয়করণে ঘ্যাঙগর নৃত্যে ভুলে আছে, কে সেই প্রকৃত শকুন।
আসেম আনসারীর চিত্রের একটি বিশেষ দিকে হলো বিশ্বস্ততার প্রসঙ্গ। তাদের চিত্রের নারীদের শরীর দেখলেই বোঝা যায় এটা বাংলার নারীর শরীর। বহু ব্যবহার আর অবহেলা-অনাদরে বাঁধন আলগা হয়ে যাওয়া শরীর তাদের। তাই তো চাঁদনীরাতে তাদের বেদনারা বেরিয়ে আসে উদাম শরীরে। হোক সে বেদেনী, প্রতীক্ষিতা কিংবা পটিয়সী। এই উদাম শরীর আবার বিশ্বস্ততা ও দৃষ্টিভঙ্গিকেই নির্দেশ করে। তারা উদাম হয় মায়াবী চাঁদনী রাতে, বেদনার গাঢ় রসে জারিত হয়ে। কিন্তু আদমের মুখোমুখি সে ঠিকই কিন্তু বুকে জড়িয়েছে কাপড়। এই উদাম শরীর সময়হীনতারও প্রতীক। আদিম মানুষ যেমন পরস্পরের প্রতি সহনশীল দৃষ্টির অধিকারী বলেই সবার সামনে অবলীলায় উদাম হতে পেরেছে, নারী-পুরুষ তেমনি সম্মোহন-সঙ্গমের ক্ষণে খুব ঘনিষ্টতা ও বিশ্বস্ততার মুহূর্তেও উদাম করে দেয় নিজেকে। এই মিলন সময়ের প্রবাহকে থামিয়েই প্রবাহিত হয়। তখন সময় স্থির থাকে কিংবা সময়ের প্রবাহ কোনো বিবেচনার নয়। অর্থাৎ শিল্পী নিছক শরীর আঁকতে চান নি। জীবনানন্দর ভাষায় 'স্বপ্নের ভিতরে বুঝি- ফাল্গুনের জোছনার ভিতরে/ দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে/ হরিণেরা; রুপালি চাঁদের হাত শিশিরের পাতায়;/ বাতাস ঝাড়িছে ফাঁকে—বনে বনে—হরিণের চোখে;/ হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে' (হরিণেরা)। চিত্রি লিখেন, 'Some mysterious silence came / By the window and called her name.' কিংবা 'Forty billions miles/ Beneath her brain.'

আসেম আনসারীর ছবিগুলো মায়াময়তার সঙ্গে আত্মারভ্রমণের দিগন্তস্পর্শী। চিত্রি শহরের মানুষ হয়েও কাজের সুবাদে বহুবার গ্রামে যাওয়া ও গভীর অভিনিবেশে দেখার মধ্য দিয়ে আত্মীকরণ করেছেন দৃশ্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গৌতম বুদ্ধের নির্বান প্রাপ্তির মতো মায়াময় কাব্যিক দ্যূতি। ক্যানভাসের ওপর এ্যাক্রেলিক রং আর তেলের সঙ্গে বালির মিশ্রণে যে ছবিগুলো আঁকেন কিংবা আবার তার কাব্য-আশ্রিত শিরোনামগুলো –এসব আমাদের উপলদ্ধিকে আন্দোলিত করে । তার চিত্রে রঙের ছড়া ও ব্রাশের টানের পরিমিত ও অত্যাবশ্যকীয় ব্যবহার শিল্পের নান্দনিকতার বিচারে মার্গ স্পর্শী। তিনি মিশ্রমাধ্যমেই কাজ করতে আনন্দ বোধ করেন।

১৯৭২ সালে তৎকালীন সরকারি আর্ট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা শিল্পী পরবর্তীতে দেশে-বিদেশে নানান প্রশিক্ষণ ও স্বল্পকালীন কোর্সে অংশগ্রহণ করেছেন। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ব্রাকসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকার সুবাদে তার কাজে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্বদেশ দর্শনের সম্মিলন ঘটেছে। তিনটি একক প্রদর্শনীসহ বেশ কয়েকটি দেশে যৌথ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন এই চিত্রী। পেয়েছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও। চিত্রকলা ছাড়াও আসেম আনসারী আলোকচিত্র ও ভিডিও মাধ্যমেও দক্ষ। কয়েকটি নন্দিত ডকুমেন্টারি আছে তার। তবে ক্যানভাসই তার শিল্পচর্চার আপন ভূমি। শিল্পী আশা করেন, দীর্ঘ দিনের আড়মোড়া ভেঙে দ্রুতই তার পঞ্চম একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। এই প্রদর্শনীর মতো চিত্রের কাব্য-দর্শন সেখানেও যে প্রস্ফূটিত হবে তা, সহজেই অনুমেয়।