বরেণ্য শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর

syed_iqbal
Published : 7 June 2014, 08:54 AM
Updated : 7 June 2014, 08:54 AM

প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে সৈয়দ জাহাঙ্গীর নিজে যেমন শৈলিপ্রবণ তেমনি ওনার কাজেও সেটা বিদ্যমান। ৩১শে মে শনিবার সন্ধ্যা ছয়টায় আরেক বরণ্যে ব্যক্তিত্ব বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রধান অতিথি হিসেবে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ৪১ তম একক প্রদর্শনী Of man and earth উদ্বোধন করেন গুলশানে বেঙ্গল লাউনজে। বিশেষ অতিথি ও আলোচক ছিলেন স্থপতি শামসুল ওয়ারেশ। উপস্থাপনায় ছিলেন বেঙ্গল শিল্পালয়ের প্রধান কর্মকর্তা নাহিদ লুভা চৌধুরী। উপস্থিত ছিলেন গ্যালারী ডিরেক্টর নওশীন খায়ের এবং নতুন ব্যাবস্থাপক হেড্রিয়ান ভিয়াজ। অনান্য অতিথিদের মধ্যে ছিলেন মুনতাসীর মামুন, শিল্পী মাহমুদুল হক, শেখ আফজাল, বিপাশা হায়াতসহ অনেকে। শিল্পী জাহাঙ্গীর আশা ব্যক্ত করেন ৫০তম একক পর্যন্ত করে যাওয়ার। উদ্বোধনকালে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেন, দীর্ঘ ৫০ বছর বন্ধু সৈয়দ জাহাঙ্গীরের কাজ দেখে আসছি। যতই দিন যাচ্ছে তিনি দেশের, গ্রামের মানুষ আর প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিচ্ছেন ।

রিয়ালিস্টিক ফর্মে ছবি আঁকছেন, এদেশের সাধারণ দর্শকের বোধের সঙ্গে সহজে নিজেকে মেশাতে চাইছেন। এর ফলে তিনি গত দশ বছর ধরে ছবিতে বিমূর্ততা থেকে সরে এসেছেন। রঙেও প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশের গ্রামের খোলা আকাশ নীলে-নীল ভরা বিশালতা। মাটির রঙ পাকা ধানের রঙ হিসেবে এসেছে গাঢ় হলুদ যাকে ইয়োলো ওকার বলে। তার প্রায় ছবিতে ক্যানভাসের জমিন জুড়ে রাজত্ব করে এই দুই রঙ। সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ছবির এই পরিপক্কতা তিনি অর্জন করেছেন থেকে বহুদিনের চর্চার ফলে। একটু পেছনে ঘুরে হাঁটলে বোঝা যাবে সৈয়দ জাহাঙ্গীর অন্য দশজন শিল্পী থেকে কতটা আলাদা। ছবি আঁকার ব্যাপারে তার একাগ্রতাও নবীন শিল্পীদের জন্যে এক উদাহরণ হয়ে থাকতে পারে। চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করে বেরিয়ে ছিলেন ১৯৫৫ সালে। তারপর ২২টি বছর প্রায় তিনি নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন একজন পুরোদমে ফুলটাইম ছবি আঁকার শিল্পী হিসেবে। বিখ্যাত সাহিত্যিক ও 'সমকাল' সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের ছোট্ট ভাই হিসেবে সেই পাকিস্তান আমলে ভালো ভালো চাকরীর অফার পেয়েও অবহেলায় ঠেলে দিয়েছেন শুধু সারাক্ষণ যাতে ছবি আঁকতে পারেন। আর্থিক সংকটে পড়েছেন মাঝে মাঝে তবে তাকে উদ্ধার করেছে সব সময় তার নিজের ছবি। পাশ করে বেরুনোর পর থেকে তার ছবির চাহিদা ছিলো তখনকার এদেশে থাকা বিদেশী বড় সব কর্মকর্তাদের কাছে। ১৯৫৮ সালে আমেরিকায় ফেলোশীপ পেলেন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বিনিময় প্রোগ্রামের আওতায়। ছোট খাটো কিছু ষ্টেট বাদ দিয়ে তাকে প্রায় সব আমেরিকান ষ্টেটে ঘুরে বেড়াতে হয়। আমেরিকান আর্টিষ্টদের সঙ্গে মিলতে হয়, বুঝতে চেষ্টা করেছেন তখনকার আমেরিকান আর্টের ধারা। লেকচার দিয়েছেন তখনকার পাকিস্তানি আর্ট সম্পর্কে, বিশেষ করে সে সময়কার সমকালীন শিল্পী জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, রশীদ চৌধুরী, রাজ্জাক, বাসেতের ছবির জগত ও কাজের ধরণ নিয়ে। আলাপ হয় তখনকার নামী মার্কিন শিল্পী জন মারীর সঙ্গে। তখন আমেরিকান আর্টে জ্যাকসন পোলাক তুঙ্গে। তার এই আমেরিকান অভিজ্ঞতা পরে তার জীবনযাপনে ও কাজে অনেকটা প্রভাব ফেলে, তার কাজের মধ্যে অনেক ডিসিপ্লিন আনে। বিদেশেী গ্রাহকদের কাছ তার ছবির গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে ক্রমশঃ।


ঢাকা ফিরে তিনি উপলব্দি করেন তাকে দেশের মধ্যে থাকতে হবে, তখনকার অবিভক্ত পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ চলে যান। তার ছবি ভীষণভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায় সেখানে। সে সময় প্রেমে পড়েন ভারতের ইউপি থেকে পাকিস্তানে আসা স¤্রান্ত পরিবারের এক সুন্দরী নারীর সঙ্গে। তিনি শুধু সুন্দরীই নন, ফোকলোর স্পেশালিষ্ট এবং দিল্লী ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী প্রাপ্ত। স্ত্রীর সরকারী বড় চাকরী আর জাহাঙ্গীরের ছবির কদর তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী মহল ও অভিজাত শ্রেণীতে পরিচিত করে তোলে ।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রাণের টানে হিন্দুকুশ পাহাড়, আফগানিস্তান পার হয়ে তিনি স্ত্রী নিয়ে ফিরে এলেন ঢাকায়। বাংলাদেশ তার নিজের একটা দেশ। মন ভরে গেলো। তার কৈশোর কেটেছে সাতক্ষিরা জেলার তেতুলিয়া গ্রামে। আজো সেই গ্রামের খোলা প্রান্তর নীল আকাশ খুরে ঘুরে তার ছবিতে আসে নানা ফর্মে, অনেক ভাবে।

১৯৭৭ পর্যন্ত নিজের ছবি আঁকা নিয়েই ছিলেন। হঠাৎ তিনি অন্তরে অনুভব করলেন নিজের দেশে চারুকলার জন্যে কিছু করতে হবে। একা একা যা করা সম্ভব নয়। তিনি জীবনে প্রথম শিল্পকলা একাডেমীর চারুকলার প্রধান পদের চাকরী নিলেন। একটানা ১৯৯৭ পর্যন্ত চাকরী করে বাংলার শহরে গ্রামে জেলায় তৈরী করলেন চারুকলার চাহিদা। তার আমলেই শিল্পকলা একাডেমী দ্বিবার্ষিক আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শন শুরু হয় এবং মাত্র দশ বছরে এশিয়া ও বিশ্বের শিল্পজগতে তা সমাদৃত হয়। প্রতি বছর এশিয়া, অষ্টেলিয়া মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু দেশের তাতে অংশ গ্রহণ থাকে।

তিনি শিল্পকলা একাডেমীর চারুকলাবিভাগের পরিচালক থাকতেই জেলা উপজেলা পর্যায়ে ভ্রাম্যমান চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজন খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলো। তখনকার চারুকলার এই জ্ঞান বিতরণ যেমন চারুকলায় পড়তে তরুণদের আগ্রহ বাড়িয়েছে, তেমনি ছবি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকেও দিয়েছে জ্ঞান।


আমেরিকা থাকতে ওয়াশিংটন ডিসি ও ফিলাডেলফিয়াতে তার প্রদর্শনী হয়েছে। পাকিস্তানে থাকতে হয়েছে সোলো এক্সজিবিশন। দেশে ফিরেও করেছেন তবে শিল্পকলা একাডেমীতে পরিচালক হিসেবে প্রায় ১৬ বছর দায়িত্ব পালনকালে তার একক একটিও প্রদর্শনী করেননি। ছবি আঁকাও কমে এসেছিলো, তবে ছাড়েননি।

চাকরী থেকে অবসর গ্রহণের পর আবার পুরোদমে এঁকে গেছেন, প্রদর্শনী করেছেন। এর মধ্যে ইয়োরোপ ঘুরেছেন। প্যারিসের শিল্পজগত খুটে-খুটে দেখে এসেছেন।

দেশ স্বাধীনের পর তার বিখ্যাত প্রদর্শনী ও সিরিজের নাম হচ্ছে 'আত্মার উজ্জীবন,' 'উল্লাস,' 'ধ্বনি,' 'অজানা অন্বেষা'। ১৯৭৪-৭৫ সালে ঘুমোট রাজনীতি নিয়ে সিরিজ ও প্রদর্শনী করেছিলেন 'অশনি সংকেত' নামে।

তার মতে পাকিস্তানি আমলে এখানে শিল্পকর্মের ক্রেতা ৯৫% ভাগ ছিলো বিদেশী, কিন্তু আজ ৯৫% ভাগ বাংলদেশী আর ৫% ভাগ বিদেশী। আমাদের গার্মেন্টস আর বিদেশে শ্রম থেকে আসা টাকাই বদলে দিয়েছে জীবন।