জাপানে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি

প্রবীর বিকাশ সরকার
Published : 7 Nov 2015, 03:01 PM
Updated : 7 Nov 2015, 03:01 PM


য়োকোহামার সানকেইএন বাগানবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঁদিক থেকে নোমুরা য়োওজোও, হারা তোমিতারোও, আরাই কাম্পো এবং অপূর্বকুমার চন্দ

১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষবারের মতো জাপানে আসেন। এটা তাঁর পঞ্চম ভ্রমণ। আমন্ত্রিত হয়ে কানাডা থেকে আমেরিকায় যান বক্তৃতা দেবার জন্য। কিন্তু তাঁর পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেন সহযাত্রী এবং ব্যক্তিগত সচিব অধ্যাপক অপূর্বকুমার চন্দ। যে কারণে তিনি আমেরিকায় প্রবেশ করতে পারেননি। অভিবাসন কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। অপমানিত হয়ে ব্যথাভারাক্রান্ত মনে স্বদেশে ফেরার পথে জাপানে নেমে মানসিক ক্লান্তি ও বিষাদ দূর করবেন বলে স্থির করেন। জাহাজ থেকেই বার্তা পাঠান তাঁর ভক্ত ও দোভাষী মাদাম কোরা তোমিকে। সে-বার্তা গিয়ে পৌঁছায় জাপানে রাজনৈতিকভাবে আশ্রিত মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর কাছে।

গুরুদেব আসবেন তাঁর থাকার জন্য উপযুক্ত একটি আবাস খুঁজে বের করার দায়িত্ব বর্তালো তাঁর ওপর। কবিগুরুর বয়স তখন ৬৮ এবং অসুস্থ। তিনি বিশ্রাম গ্রহণ এবং লেখালেখি করতে পারেন এমন একটি বাসস্থান কোথায় আছে খুঁজতে লাগলেন।

খুঁজতে গিয়ে তাঁর হঠাৎ মনে হলো কাগজ আমদানীকারক শিল্পপতি ও আধ্যাত্মিক গবেষক ড.ওকুরা কুনিহিকোর নাম। গভীর জাতীয়তাবোধসম্পন্ন এশিয়াবাদী কুনিহিকো ছিলেন রাসবিহারীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনিই প্রথম জাপানে আধুনিক আধ্যাত্মিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ওকুরা সেইশিন কেনকিউজো' অর্থাৎ 'ওকুরা স্পিরিচুয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট' স্থাপন করেন য়োকোহামা বন্দরনগরের ওকুরায়ামা শহরে। তাঁর সঙ্গেই গুরুদেবের মিলমিশ হবে ভালো বলে রাসবিহারী মনে করলেন এবং বাস্তবে তাই-ই হয়েছিল। রাসবিহারী দূরদৃষ্টিসমপন্ন ছিলেন তিনি ওকুরা কুনিহিকোর সঙ্গে গুরুদেবের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিধ্বস্তপ্রায় জাপানে রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মবর্ষ ঘটা করে উদযাপনের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তাঁর শেষজীবনের বন্ধু জাপানি মনীষী ড.ওকুরা কুনিহিকো। বহির্বিশ্বে এরকম বিরল ঘটনা আর দ্বিতীয়টি ঘটেছে বলে জানা নেই।

কালবিলম্ব না করে ওকুরা কুনিহিকোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গুরুদেবের জাপান আগমনের সংবাদটি দিলেন এবং অনুরোধ জানালেন তাঁর বাসভবনে গুরুদেব কিছুদিন বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারেন কিনা।

রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যের প্রথম নোবেলবিজয়ী কবি এবং ১৯১৩ সালে যখন নোবেল পদকে ভূষিত হন জাপানে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। সমগ্র এশিয়া মহাদেশের প্রথম আধুনিক শিল্পোন্নত দেশের জাপানি বুদ্ধিজীবীমহল ধরে নিয়ে নিয়েছিলেন এই দেশেরই কেউ সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কারটি পাবেন! সেইসময় পরাধীন ভারতীয় বাঙালি কবি ও সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম জাপানে জানতেন মুষ্টিমেয় কিছু পণ্ডিত ও ধর্মীয় নেতা বা পুরোহিত। তাঁদের অন্যতম প্রধান ছিলেন শিল্পাচার্য ওকাকুরা (কাকুজোও) তেনশিন। যিনি ১৯০২ সালে বৃটিশ-ভারতের রাজধানী কলিকাতায় গিয়ে ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন স্বামী বিবেকানন্দের কল্যাণে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বে বাঁধা পড়েন। সূচনা হয় জাপান-বাংলা শিক্ষা-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক বিনিময়ের। যে ধারা শতবর্ষ পেরিয়ে আজও অব্যাহত।

বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এই সম্পর্কের সূচনা হলেও জাপানে তা আদৌ প্রভাব ফেলতে পারেনি ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল অর্জন পর্যন্ত। যখন গুরুদেব পুরস্কারটি পেলেন সেই সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল জাপানের সর্বত্র! নড়েচড়ে উঠলেন জাপানের সর্বস্তরের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা: কে এই রবীন্দ্রনাথ টেগোর যে পরাধীন ভারত থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হলেন! অতিদ্রুত জাপানে তাঁর ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। অনুবাদ হতে থাকলো তাঁর সদ্য নোবেলেভূষিত 'গীতাঞ্জলি'সহ একাধিক গ্রন্থ ইংরেজি থেকে। নতুন ভক্তরা তাঁকে প্রাচ্যের ঋষিকবি, দার্শনিক, শিক্ষক, ধর্মীয় সংস্কারক প্রভৃতি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে সচেষ্ট হলেন। অগণিত ভক্তরা কবিকে জাপানে দেখতে চান, তাঁর কথা শুনতে চান, তাঁকে জানতে চান প্রত্যক্ষভাবে। কিন্তু কে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাবে? ওদিকে বন্ধু ওকাকুরার সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ জাপান নামক প্রাচ্যের 'সামুরাই-দেশ'টি কেমন তা স্বচক্ষে দেখার এবং জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু মোক্ষম সুযোগ আসছিল না। অথচ ওকাকুরার বদলৌতে জাপানি সংস্কৃতি প্রবেশ করতে শুরু করেছে শান্তিনিকেতনে। যেমন জুদোও বা জুজুৎসু ক্রীড়া, ইকেবানা বা ফুলসজ্জা, চাদোও বা ঐতিহ্যবাহী চা-অনুষ্ঠান, নিহোনগা বা জাপানি চিত্রকলা, তেইএন বা বাগানচর্চা, কাঠের কারুকাজ ইত্যাদি যা বিশ্বে স্বতন্ত্রধারার জাপানি ঐতিহ্য। ততদিনে বন্ধু ওকাকুরাও বেঁচে নেই। ১৯১২ সালে দ্বিতীয়বার তথা শেষবারের মতো কলকাতায় ওকাকুরার পুরনো বন্ধু রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে আতিথ্যগ্রহণ করেন সেপ্টেম্বর মাসে, রবীন্দ্রনাথ তখন তৃতীয়বারের মতো বিদেশভ্রমণে য়োরোপ ও আমেরিকায় অবস্থান করছিলেন। সাক্ষাৎ হয়নি তাঁদের। সুরেন্দ্রনাথের বাড়িতে ওকাকুরার সম্মানার্থে আয়োজিত চা-সমাবেশে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়া কবি প্রিয়ম্বদা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে ওকাকুরার। তিনি তখন ৫০ আর বিধবা প্রিয়ম্বদা ৪১। এই প্রথম সাক্ষাতেই দুজন দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পরিণতি শেষমেষ প্রণয়ে। সে আরেক ইতিহাস।


সানকেইএন বাগানবাড়ির বিলুপ্ত অতিথিভবন 'শোওফুউকাকু'তে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ সালে

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ওকাকুরা তেনশিন রবীন্দ্রনাথের নোবেল অর্জনের মাত্র কয়েকদিন আগে স্বর্গবাসী হন ১৯১৩ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তারিখে। তিনি বেঁচে থাকলে কী যে আনন্দিত হতেন তা আজ কল্পনারও বাইরে! বেঁচে থাকলে তিনিও একদিন নোবেল অর্জন করতে পারতেন বলে ধারণা করা যায় তাঁর লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থ 'দি বুক অফ টি'র জন্য (১৯০৬)। কালজয়ী এই গ্রন্থটি 'গীতাঞ্জলির' মতোই আধ্যাত্মিক সুরাশ্রিত অসাধারণ একটি দর্শন। অবশ্য তাঁর পক্ষে নোবেলে ভূষিত না হওয়ার শক্তিশালী পটভূমিও ছিল এই জগৎশ্রেষ্ঠ 'শ্বেতাঙ্গ-স্বীকৃতি'র ক্ষেত্রে।

সে যাইহোক। ওকাকুরা বেঁচে নেই, থাকলে তিনিই উদ্যোগ গ্রহণ করতেন রবীন্দ্রনাথকে জাপানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য, কাজেই তাঁর পরিবর্তে জাপান সরকারকে একটা উদ্যোগ গ্রহণের জন্য নিশ্চয়ই নাড়া দিয়েছিল কেউ। ধারণা করা যায় 'এশিয়া ইজ ওয়ান' বা 'এক এশিয়া' এই আপ্তবাক্যটি উচ্চারিত 'প্রাচ্যভাতৃত্ববাদ' বা 'প্যান-এশিয়ানিজম'-এর উদ্গাতা ওকাকুরা তেনশিনের ভাবশিষ্যদের কেউ হবেন; তিনি হতে পারেন আধুনিক জাপানের অন্যতম প্রধান কারিগর শিল্পপতি ভিসকাউন্ট শিবুসাওয়া এইইচি অথবা রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওকাকুরার শিষ্য প্রভাবশালী চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান যিনি নাড়াটি দিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়েছিল। সরকার প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন কলকাতায় — কোনো কোনো সূত্র থেকে তা জানা যায়। তবে আমন্ত্রণ জানালেও রবীন্দ্রনাথ জাপানে আসতে পারবেন কিনা এই নিয়ে সন্দেহ ছিল। সন্দেহ এই কারণে যে, যুগপৎ জাতীয়তাবাদী এবং এশিয়াবাদী ওকাকুরা প্রথম কলকাতায় ঠাকুর পরিবারের সদস্য তথা রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসভবনে প্রায় দশ মাস আতিথ্য গ্রহণকালে (১৯০২) এক সংবর্ধনা সভায় সরাসরি সুরেন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'আপনি ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে কী ভাবছেন?' গুপ্ত বিপ্ল­বী সংগঠন 'অনুশীলন সমিতি' গঠনে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন অর্থাৎ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের শিখাটিতে তিনি আগুন জ্বালিয়েছিলেন। সেই আগুন পরবর্তীকালে বাংলা থেকে দূরপ্রাচ্যের জাপানে সম্প্রসারিত হয়েছিল ১৯১৫ সালে পলাতক বিপ্ল­বী রাসবিহারী বসুর 'পি এন ঠাকুর' (প্রিয়নাথ ঠাকুর) নামে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় পরিচয়ে জাপানপ্রবাসী হওয়ার মধ্য দিয়ে। তাঁর কঠোর পরিশ্রম ও লাগাতার প্রচেষ্টা ছাড়া ভারতের স্বাধীনতা ১৯৪৭ সালে আদৌ মিলত বলে মনে হয় না।

দুর্ধর্ষ বিপ্লবী রাসবিহারী ইতিমধ্যেই জাপানে আশ্রয় নিয়েছেন এবং আশ্রয় দিয়েছেন ওকাকুরার ভাবানুসারী একচ্ছত্র রাজনৈতিক আধিপত্যবাদী, প্যান-এশিয়ানিস্ট, প্রচণ্ড শক্তিশালী গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী সংস্থা 'গেনয়োশা'র প্রতিষ্ঠাতা গুরু তোওয়ামা মিৎসুর"। যিনি ইতিমধ্যে চীনা জাতীয়তাবাদী নেতা ড.সান-ইয়াৎ সেনকে জাপানে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছেন জাপান সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করেই। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ জাপানভ্রমণ করলে পরে ওকাকুরার অসংখ্য ভাবানুসারীর সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ হবে এবং ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলন, সংগ্রাম ও লড়াই ক্রমাগত শক্তিশালী হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। জাপান উদীয়মান সাম্রাজ্যবাদী শ্বেতাঙ্গ শক্তি রাশিয়াকে যুদ্ধে (১৯০৪-'৫) পরাস্ত করে ফেলেছে! এর আগে শিনো-জাপান যুদ্ধে চীনকে পরাজিত করেছে (১৮৯৪-'৯৫)। যদিওবা জাপান-ব্রিটিশ মৈত্রীচুক্তি স্কাক্ষরিত হয়েছে ১৯০২ সালে। কিন্তু জাপান সরকারকে চালায় মূলত ওকাকুরার ভাবশিষ্য প্যান-এশিয়ানিস্টরা যাঁরা চাইছে এশিয়া মহাদেশ থেকে দখলদার শ্বেতাঙ্গ শক্তিকে হটিয়ে দিতে। শ্বেতাঙ্গরা প্রাচ্যদর্শন, প্রাচ্য সংস্কৃতি ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলেছে সতের শতাব্দী থেকে।

কাজেই রবীন্দ্রনাথকে জাপানভ্রমণের বিষয়ে বাধা দিতে পারে ব্রিটিশ সরকার। এর আগে ১৯০৩ সালে ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদে শৈল্পিক কারুকাজ করার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন ওকাকুরার দুই ঘনিষ্ঠ শিষ্য চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান এবং হিশিদা শুনসোও কিন্তু তাঁদেরকে কাজ করার সুযোগ দেয়নি ব্রিটিশ সরকার রবীন্দ্রনাথের চেষ্টা-তদ্বির সত্ত্বেও। সুতরাং রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণের প্রস্তাব রবীন্দ্রনাথ সাদরে গ্রহণ করলেও ব্রিটিশরাজ তাঁকে ছাড়পত্র দেবে কিনা সন্দেহ ছিল। বস্তুত, গোপনে দেনদরবার করেই রবীন্দ্রনাথের জাপানভ্রমণের অনুমোদন মিলেছিল বলে ধারণা হয়, যদিওবা রবীন্দ্রনাথ জাপানভ্রমণের ক্ষেত্রে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়েছেন। ১৯১৫ সালেই তিনি জাপানভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন বলে জানা যায় কিন্তু সেই বছর বিপ্লবীদ্বয় রাসবিহারী বসু ও হেরম্বলাল গুপ্ত জাপানে প্রবেশ করেন গোপনে, তখন তাঁদের মাথার ওপর ঝুলছে ধরিয়ে দেয়ার বিপুল টাকার পুরস্কার! কাজেই ওই বছর জাপানে এলে পরিস্থিতি সুখকর হতো না কারণ জাপান সরকার বিপ্ল­বী দুজনকে জাপান ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের আবেদনে সাড়া দিয়ে। কিন্তু রক্ষা করেছিলেন গুরু তোওয়ামা মিৎসুর।

যাহোক, পরের বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানে এলেন, তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ইন্ডিয়া-জাপান অ্যাসোসিয়েশন যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০৩ সালে। এর তৃতীয় প্রেসিডেন্ট ভিসকাউন্ট শিবুসাওয়া এইইচি আমন্ত্রণ পাঠান কবিকে।

নোবেলবিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ শেষমেষ জাপানে এসে রীতিমতো বিপ্লব ঘটালেন গণমাধ্যমে, একাধিক সভা ও সংবর্ধনায় জাপান সরকারের বিপক্ষে, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং আগ্রাসী সমরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি জাপানিদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় আঘাত করেন এবং বুদ্ধিজীবী মহলে সমালোচিত ও শীতল মনোভাবের কারণ হন। অবশ্য পরবর্তী বক্তৃতা দেন প্রসিদ্ধ কেইওগিজুকু বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানি আধ্যাত্ম্য, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যচিন্তার ওপর, তাতে করে কিছুটা শীতলতা কেটে গেলেও এক শ্রেণীর কট্টোর জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীর কাছে তিনি অপছন্দনীয়ই থেকে যান।

প্রকৃতপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ একটা ডিপ্ল­ম্যাসি খেলেছিলেন এখানে, তিনি জাপানিদের সুহৃদও ছিলেন আবার কঠোর সমালোচকও ছিলেন ব্রিটিশরা যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল। জাপানে যতবার রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ততবার তাঁর অগণিত ভক্তরা তাঁকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, অভিমানীরা অভিমান করেই থেকেছেন, রাসবিহারী বসুসহ জাপান প্রবাসী তরুণ বিপ্লবীরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, শান্তিনিকেতনের জন্য চাঁদা তুলে দিয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রবাসী বিপ্লবীদেরকে উৎসাহিত করেছেন কবিগুরু। রাসবিহারীর মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গুরু তোওয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ হয়েছেন, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন তাঁকে ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে সহযোগী হওয়ার জন্য, গুরু তোওয়ামা 'গেনয়োশা' সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁকে জমকালো সংবর্ধনাও প্রদান করেছেন টোকিওর অভিজাত 'উয়েনো সেইয়োওকেন' মিলনায়তনে ১৯২৪ সালে।


সানকেইএন বাগানবাড়ির একাংশ

১৯১৬ সালে প্রথম এসে প্রায় তিন মাস ছিলেন য়োকোহামার বিখ্যাত সিল্ক বণিক ও দেশীয় শিল্পকলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হারা তোমিতারোও'র সবুজসমৃদ্ধ নয়নাভিরাম 'সানকেইএন' বাগানবাড়িতে। তোমিতারোও'র সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বে আবদ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বন্ধুকে তিনি ভুলে যাননি শেষবার ১৯২৯ সালে যখন নতুন শুভাকাঙক্ষী ড.ওকুরা কুনিহিকোর প্রাসাদোপম বাসভবনে অতিথি ছিলেন। একবার 'সানকেইএন' বাগানবাড়িটি পরিদর্শনে যান, মনোমুগ্ধকর এই সবুজ বাগানবাড়িটি তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল যেমনটি করেছিল প্রথম ভ্রমণেই নাগানো-প্রিফেকচারের কারুইজাওয়ার প্রাকৃতিক শোভা। শান্তিনিকেতনকে 'সানকেইএন'-এর মতোই সাজাতে চেয়েছিলেন কবিগুরু যা ফলপ্রসূ হয়নি তাঁর জীবদ্দশাতে।