হাসান হাফিজ: পরিণামে ভিন্ন ফল ও অন্যান্য

হাসান হাফিজহাসান হাফিজ
Published : 6 July 2022, 02:37 PM
Updated : 6 July 2022, 02:37 PM


সংজ্ঞায়ন

শব্দ উৎস, অমৃত-আধার
শব্দ বিষ, জন্ম-মৃত্যু, আনন্দ অপার
কাঁটালতা শব্দ তুমি, কবিতার তীর্থভূমি শান্তি পারাবার
শব্দ ব্রহ্মা, ওম শব্দ শান্তি ও শিশির
আবেগ কল্পনালতা ঝর্না ঝিরিঝির
অচঞ্চল আকণ্ঠ তিয়াসা সে দূরগামী এবং অস্থির!

পরিণামে ভিন্ন ফল

চন্দ্রাহত বলেই তো এমন বন্ধুর পথ, জীবন্ত মৃত্যুর পথ আলগোছে
নির্বাচন করেছি নিজেই। পুড়তে পুড়তে একজীবন নিভে যায়
আশা কিন্তু থেকে গেল অপূরণই, হায় রে আশা বেলাজা প্রত্যাশা!
সৃষ্টিছাড়া বলেই তো উপেক্ষিত হতে হতে অসম্মান করেছি নিজের,
অর্জনের খুদকুঁড়ো যা কিছু কপালে ছিল, ভালোবেসে গ্রহণ করেছি।
সামান্যকে ভেবেছি অধিক, স্বপ্নে স্বপ্নে লোভাতুর আনত হয়েছি,
নীলকণ্ঠ হবো বলে মধু ছেড়ে বিষভাÐে দিতে হলো তৃষিত চুমুক–
চন্দ্রাহত মানুষের এরকমই বিধিলিপি সংসারের আদিম নিয়ম
করুণার গোপন ছোরায় তোমরা দীর্ণ বিদ্ধ জখমে পেয়েছো সুখ
কিন্তু সেই অপমান পুষ্প আর নদী হয়ে স্নিগ্ধতায় ছড়ালো সৌরভ…

মোক্ষধামে চল্ দোঁহে যাই

গাঙের ঘাটে নৌকা বান্ধা
মাঝির হদিস নাই
ওই পারেতে ভুবনতীর্থে ক্যামনে তবে যাই?
আকাশ কালো ঘনাইছে মেঘ
উথালপাথাল ঝড়ের নাচন হয়তো সহসাই
করবে আঁধার চাদ্দিকেতে উড়বে ধুলো ছাই
দুঃসময়ে কোন্ উছিলায় মাঝির দেখা পাই?
ও মাঝি তুই দেখা দে রে
কান্দি আকুল কণ্ঠ ছেড়ে…
যাবো ওপার সাধুর কাছে আপনজনের ঠাঁই
গাঙ বেতালা রাক্ষুসে হা কোথায় মাঝি ভাই?
পার হবো রে তৃষায় ডুবে প্রাণ করে আইঢাই
হঠাৎ মাঝি উধাও কেন শাস্তি বিধান চাই
তাপ অনুতাপ উছলে পড়ে তিক্ত সে আশনাই
ও মাঝি তুই নিকটে আয়
কালসন্ধ্যার এই বিরানায়
চল্ দু'জনায়, মোক্ষধামে পথ চেয়ে র'ন সাঁই

দ্বন্ধযুদ্ধ জীবনের,মরণের

নিভে যেতে চায় কেন মালসার সামান্য আগুন
আলগোছে কমতে থাকে দরদিয়া পিপাসার উম
শীতের কামড়ে নিভছে পলাতক নিশীথিনী ঘুম।
ধিকিধিকি যৎসামান্য বাউলিয়ানা ছেঁড়াখোঁড়া আঁচে
জীবনের তৃষ্ণাটুকু নিলাজা বেহায়া কেন হয়ে উঠছে
ধানথোড় কতখানি একলাএকলি দুধবিনে বাঁচে?
বাঁচতে হবেই তাকে, নিশ্চয়তা ভরসা তো নাই
শরমের মাথা খেয়ে বাঁচতে চায় যদিও সে জানে
জীবন মৃত্যুর মত গোঁয়ার চশমখোর অদ্ভুতুড়ে নয়
মেনে নিতে চায় না সে চোরাবালি অন্ধ অপচয়
সেজন্যেই ডানা মেলে ছটফট আকুলিবিকুলি করে
প্রতিধ্বনি ঠোকরে রক্তাক্ত ক্ষতে প্রতœ সে পাথরে
বিরানায় পড়ে থাকে নিঃসঙ্গ আদিমচর অগম্যপাতালখোঁজা
পাড়ভাঙা খরস্রোতা নদীটির বিরুদ্ধ উজানে
জীবন-মৃত্যুর দ্বন্ধ্বে টানাপড়েনের ছন্দে পড়ে আসে বেলা
চরাচর খাঁচাশূন্য নিঃসীমের নভোনীলে বিহঙ্গ একেলা…


সিক্ত, রিক্ত বিরহ-বর্ষায়

আকাশ কখন ভাঙে? যখন বিরহ তীব্র হয়–
বৃষ্টি হয়ে ব্যথা হয়ে সরব গোঙানি হয়ে ঝরতে থাকে
ধুলোময়লা মরতে থাকে, গীতিকবিতার ছন্দে মহানন্দে
পঙ্ক্তিমালা সৃজনের পালাক্রম শুরু হয়,
কিন্তু আছে অতিবর্ষণেরও ভয়, কখনো যা জীবনসংশয়
বিশ্ব ক্রমে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর, সঙ্কট প্রখরতর
সর্ব অঙ্গ নীল বিষে জরোজরো, প্লাবনের থরোথরো
বিপদের পূর্বাভাস, বর্ষা আনে দীর্ঘশ্বাস, তারপরও বৃষ্টি তুমি
সিক্ত করো তৃষাতুর বনাঞ্চল আবছা আলতো মনোভূমি,
আকাক্সক্ষার নিভৃত রুমালে আঁকো মিলনের রূপকল্প ছবি
তোমার বন্দনাগানে আরাধনে মগ্ন হয় শিল্পী কবি
তোমাকে বুনন করে, নিঃশব্দে সৃষ্টিও করে, বিরহের খাদে পড়ে
জন্ম নেয়, বারবার স্বেচ্ছাদহনের তীব্র আঁচে পোড়ে ও পোড়ায়…

নির্জলা উপোস
খরিদ করেছি দুঃখ যাতনালাঞ্ছন
থাকুক সে একান্তই নিভৃতে আমার
ইচ্ছেসুখ ঠোকরাবে, দাগা দেবে
নিরিবিলি রক্ত ঝরবে হৃদয়ের
কারো কিচ্ছু আসে যায় এতে?
দুঃখ কিনে ভালো লাগছে
ওয়ারিশ কেহ কিন্তু নাই
নিরঙ্কুশ মালিকানা ভোগস্বত্ব শুধুই আমার
আমি তার বশ্য হতে
আক্রোশের নিরীহ শিকার হতে
ভালোবাসছি, পুড়ে মরছি
তোমার কী আসে যায় কিছু?
পাথর না হতে যদি
হয়তো কিছু আসতো যেতো, যা হওয়ার নয়
এক জন্ম এভাবেই কেটে গেল নির্জলা উপোস!

প্রশ্নের পাহাড়
'মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান'
-সৈয়দ শামসুল হক

জন্মভিটি, তোমার সঘন ওম স্নেডূহমায়া ছেড়েছুড়ে
চলে যাচ্ছি অনিশ্চিত আঁধারিয়া আরেক জীবনে
বাধ্য হচ্ছি মৃত্যুময় মহাসড়কের পথে সভয়ে দৌড়াতে
চলচ্ছক্তি নাই লাখো মানুষের, চোখেমুখে আতঙ্ক ভয়াল
অন্য দেশে কত শান্তি, কতটুকু মানবিক অধিকার
কিচ্ছু এর জানা বোঝা নাই
সহায় সম্পদ আর সম্ভ্রম হারিয়ে
লুণ্ঠিত ও অগ্নিদগ্ধ সময়ের
করাল ঘাতকচিহ্ন শরীরে মননে বয়ে চলেছে অগস্ত্যযাত্রা
কোনোদিন কী ফেরা হবে আর? মুক্ত দেশ বাতায়ন কোনোদিন
দেখবো কিনা সংশয়ের ঘেরাটোপে বন্দি ও জখমি সত্য
হাহাকার ক্ষুধা জরা নিত্যসঙ্গী, আর্তনাদও ভুলে গেছি
একবিংশ শতকের এই প্রাপ্তি? এত ঠুনকো প্রগতি অর্জন?