সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য: প্রত্যাখ্যাত রাউলিং ও পুনর্বাসনে লুইয এলিজাবেত ভিযে ল্য ব্রাঁ

বিপাশা চক্রবর্তীবিপাশা চক্রবর্তী
Published : 30 March 2016, 09:13 AM
Updated : 30 March 2016, 09:13 AM

এই সময়ের সবচেয়ে সফল নারী লেখক

হ্যারী পটার খ্যাত জে কে রাউলিং সম্প্রতি টুইটারে বেশ কিছু প্রত্যাখান পত্র প্রকাশ করেছেন। না কোন প্রেম প্রত্যাখান পত্র নয়, বরং বিভিন্ন প্রকাশকদের কাছে পাঠানো তার বইয়ের পান্ডুলিপির প্রত্যাখ্যান পত্র। হ্যাঁ, জে কে রাউলিং যিনি প্রথম নারী লেখক হিসেবে পৃথিবীর অন্যতম বিলিয়েনিয়ারদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন, তিনি একসময় বিভিন্ন প্রকাশকদের কাছে তার বইয়ের পান্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন আর সেই পান্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশে অনেক প্রকাশক অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন! তবে রাউলিং সেসমস্ত পান্ডুলিপিতে তার নিজের আসল নাম ব্যবহার করেন নি। ছদ্মনাম রবার্ট গিলব্রেথ ব্যবহার করেছেন।

রাউলিং এক ভক্তের অনুরোধে প্রকাশকদের কাছ থেকে পাওয়া সেই চিঠিগুলোর কপি তার টুইটার একাউন্টে প্রকাশ করেন। তার পরপরই ব্যাপারটা বেশ সাড়া ফেলে। ছদ্মনাম – রবার্ট গিলব্রেথ হিসেবে তার প্রথম গল্প 'দ্য কাক্কুস কলিং' প্রকাশের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল । শুধু তাই নয়, শিশু সাহিত্যে সাড়া জাগানো বিশ্বে ৪০০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রিত রাউলিংয়ের হ্যারী পটার বইটির ক্ষেত্রেও কয়েকবার প্রকাশক ছাপতে চায়নি। তবে এর জন্য তিনি নিরুৎসাহিত হননি বরং তাকে আরো ভাল করার শক্তি যুগিয়েছে।

রাউলিং যখন আসল পরিচয় গোপন রেখে লিখলেন রবার্ট গিলব্রেথ ছদ্মনামে তখন অনেকবারই প্রকাশকদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। এমনকি তাকে লেখার জন্য কোর্স করার পরামর্শও দিয়েছিলেন এক প্রকাশক। প্রথম বইটি প্রত্যাখানের পরেও চেষ্টা চালিয়ে যান রাউলিং এবং ছদ্মনামে তিনটি বই প্রকাশিত হয়। এবং উপন্যাস তিনটি বেশ সফলতাও পায়।
রাউলিং টুইটারে প্রকাশিত চিঠিগুলো থেকে প্রাকশকের স্বাক্ষর মুছে দিয়ে প্রকাশ করেছেন। টুইট বার্তায় তিনি বলেছেন, তার উদ্দেশ্য কাউকে হেয় করা বা প্রতিশোধ নেয়া নয়। বরং অন্য লেখকদের উৎসাহ দেয়াই তার লক্ষ্য। তবে হ্যারী পটার বইটি ছাপতে যে সকল প্রকাশক অস্বীকৃতি জানিয়ে ইমেল বার্তা দিয়েছিলেন সেই চিঠিগুলো রাউলিং প্রকাশ করেননি। সেগুলো তার ব্যক্তিগত সংরক্ষণশালায় রেখে দিয়েছেন। সব থেকে ভদ্র ও বিস্তারিত প্রত্যাখান পত্রটি তিনি পেয়েছিলেন, প্রকাশনা সংস্থা কন্সটেবল এন্ড রবিনসন্স থেকে। তারা তাকে লেখালেখি করার জন্য ট্রেনিং কোর্স করতে বলেছেন। সেই সাথে প্রকাশকদের কিভাবে বেছে নিতে হবে এবং কোন অবস্থাতেই হাল ছাড়া যাবে না সে-ই টিপসও তিনি পেয়েছিলেন। প্রকাশক আরো যোগ করেছিলেন, "আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ব্যবসায়িক সাফল্য আসবে না বিধায় বা বাণিজ্যিক সম্ভাবনা না থাকায় আমরা আপনার লেখাটি বই আকারে ছাপতে অপারগ"।
আরেকটি প্রকাশনী ক্রিমে ডা লা ক্রাইম-এর পক্ষ থেকে জানানো হয় তারা অন্য আরেকটি প্রকাশনা গ্রুপের সাথে সংযুক্ত হতে যাচ্ছে, তাই নতুন কোন বই প্রকাশের কাজ নিচ্ছে না।
২০১৩ সালে যখন রবার্ট গিলব্রেথ ছদ্মনামে রাউলিংয়ের 'কাক্কুস কলিং' প্রকাশিত হয় তখন সেটির বিক্রি ছিল সম্মানজনক। আর লেখকের আসল সত্যিকারের পরিচয় জানার পর তা বিক্রির শীর্ষ তালিকায় উঠে আসে।
এখানে এসে প্রসঙ্গক্রমেই পাঠকদের স্বরণে আসতে পারে, মহান আইরিশ উপন্যাসিক জেমস জয়েসের ক্লাসিক মাস্টারপিস ইউলিসিস এর কথা। ১৯২২ সালে প্যারিস থেকে বন্ধু সিলভিয়া বিচ-এর সহযোগিতায় বইটি প্রথম প্রকাশের আগে পরপর বেশ কয়েকবার প্রকাশক দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। কয়েক বছর আগে ইউলিসিস-এর সেই প্রথম সংস্করণের একটি কপি ২ লক্ষ ৭৫ হাজার ডলারে বিক্রি হয়।
এমনকি জর্জ অরওয়েলের এনিমেল ফার্মকে এক বাক্যে 'আনকনভিনসিং' বলে নাকচ করে দিয়েছিলেন স্বয়ং টি এস এলিয়ট, যখন তিনি ফেবার এন্ড ফেবার প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদকের ভূমিকায় ছিলেন।

বিস্মৃত এক সার্থক চিত্রশিল্পীর গল্প

সম্ভবত ইনিই আঠারো ও উনিশ শতকের সবচেয়ে প্রতিভাবান ফরাসী প্রতিকৃতিশিল্পী। শুধু তাই নয় এযাবতকালের সব নারী চিত্রকরদের মাঝে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিত্রশিল্পী মনে করা হয় তাকে। লুইয এলিজাবেত ভিযে ল্য ব্রাঁ যিনি মাদাম ল্য ব্রাঁ নামেও পরিচিত।

যার কাজের ধারাকে বলা হয়ে থাকে সেই সময়ের চিত্রশিল্পের একটি বিশেষ ধারা রকোকো-পরবর্তী ফলস্বরুপ নিউক্লাসিজিম বা নব্যধ্রুপদী শৈলীর অংশ। যিনি ব্যতিক্রমী দক্ষতা, আত্মপ্রচেষ্টা ও স্বকীয় প্রাযুক্তিক জ্ঞান দ্বারা ফ্রান্স ও ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল ও অশান্ত সময়সীমার মধ্যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন।

নিউইয়র্ক শহরে মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট-এ চলছে তাঁর চিত্র প্রদর্শনী( ১৫ ফেব্রুইয়ারী-১৫ মে ২০১৬)। অন্যদিকে কানাডার অটোয়ার ন্যাশনাল গ্যালারীতে আগামী জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আয়োজিত হবে এই প্রদর্শনী । তাঁকে নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন শিল্পবিশারদ ও ঐতিহাসিক জোসেফ বাইলিলো। ভিযে ল্য ব্রাঁ কাজের উপরে ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত ২৭৮ পৃষ্ঠার একটি ক্যাটালগ পাওয়া যাবে এই আয়োজনে।

কিন্তু এটি আশ্চর্য বিষয় যে, তাঁর নিজের দেশ ফ্রান্সে এই গুণী শিল্পীর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনীর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। কিন্তু কেন? আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে এই শিল্পীর তুলনামূলক ভাল একটি প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল টেক্সাসের কিমবেল আর্ট মিউজিয়ামে। তাও শিল্পবিশারদ জোসেফ বাইলিলোর প্রচেষ্টায়। নিউইয়র্ক-এ মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট এ এখনকার যে দৃশ্য তা কেন কখনো দেখা যায়নি শিল্পীর নিজ ভুমিতে?
এটা ঠিক যে তাঁর কাজের মান নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠে নি কখনো। তাহলে? নাকি নারী শিল্পীর কাজকে অবিশ্বাসের চোখে দেখার সমাজের সেই প্রাচীন হীন মানসিকতা দায়ী। এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ইতিহাসের দিকে।
লুইয এলিজাবেত ভিযে ল্য ব্রাঁর জন্ম শিল্পী বাবা মায়ের ঘরে ১৭৫৫ সালের ১৬ই এপ্রিল। বাবা ছিলেন একজন চিত্রকর যিনি প্যাস্টেল রঙয়ের ব্যবহার করে প্রতিকৃতি অাঁকতেন। আর মা ছিলেন সেই সময়ের একজন হেয়ারস্টাইলিস্ট। স্বামী ছিলেন চিত্রাংকন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত একজন সফল ব্যবসায়ী। প্রাকৃতিক চারুতা, নতুন মনোভাব আর দার্শনিক জাঁ জ্যাক রুশো দ্বারা জোরালোভাবে প্রভাবিত ছিলেন ভিযে ল্য ব্রাঁ। তাঁর কাজগুলোতে ছিল ফরাসী নবজাগরণ সময়ের সবচেয়ে আকর্ষক উপাদানগুলোতে সমৃদ্ধ। দীর্ঘ শৈল্পিক বর্ণাঢ্যময় জীবনে মারা যাবার আগে তিনি ৬৬০টির অধিক প্রতিকৃতি রেখে গিয়েছেন। ফ্রান্সের প্যারিসেই ১৮৪২ সালের ৩০ মার্চ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই গুণী, শিল্পের জাদুকর। মৃত্যুর আগে ১৮৩৪-এ তাঁর স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়। যেখানে তিনি জীবনের ঐসব ঘটনাবহুল সময়ের স্মৃতিচারণ করেন। চিত্রশিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। সেই সময়ের রয়েল একডেমির প্রভাব, শোষণ ও চিত্রশিল্পীদের প্রতি বৈরি আচরণের কথাও উল্লেখ করেন। লুইয এলিজাবেত ভিযে ল্য ব্রাঁ ছিলেন রাজপরিবারের একজন ঘনিষ্ঠজন। রানী আন্তোনিয়েতা-এর ব্যক্তিগত চিত্রকর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন বেশ কিছুকাল। আর এটাকেই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে ধরা হয়। কেন না ফরাসী বিপ্লবের সময় রাজপরিবারের বিরূপ আচরণ ও বিশেষ করে রানী আন্তোনিয়েতার নেতিবাচক ভূমিকা, বিশ্বাসঘাতকতা এর জন্য দায়ী। ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ও রানী আন্তোনিয়েতার ফাঁসী কার্যকর হবার পর দীর্ঘদিন ভিযে ল্য ব্রাঁ লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। ঐতিহাসিকদের মতে, ঐ সময় তিনি তাঁর কন্যাসন্তান জুলিকে নিয়ে পালিয়ে যান ফ্রান্সের বাইরে। তারপর বহুবছর ইতালি, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার রাজনৈতিক আশ্রয়ে বাস করেন এবং সেখানেও তিনি তাঁর অসাধারণ কর্মময়তার ছাপ রাখেন। দীর্ঘকাল পর ফ্রান্সে ফিরে আসলেও তাঁর প্রতি সদাচারন করা হয়নি। ঐতিহাসিকদের মতে, তাঁর অাঁকা চিত্রকর্মের মাধ্যমে ফরাসী জাগরণের সময়কার অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের দেখা মেলে যা সমৃদ্ধ করে ইতিহাসকে ।

তথ্যসুত্র দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।

আর্টস বিভাগে প্রকাশিত বিপাশা চক্রবর্তীর আরও লেখা:
জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গম: অর্ধনারীশ্বর অথবা তৃতীয় প্রকৃতি