সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতি

বিপাশা চক্রবর্তীবিপাশা চক্রবর্তী
Published : 24 Nov 2015, 05:43 AM
Updated : 24 Nov 2015, 05:43 AM

স্বাধীনতা পেল শেলীর যে কবিতাটি

শেলী-ভক্ত পাঠক, সমালোচক ও বিশ্লেষকদের জন্য চমকপ্রদ খবর রয়েছে। অবশেষে অনেকদিন পর শেলীর একটি কবিতা প্রকাশিত হবার স্বাধীনতা পেল। গত নয় বছর ধরে তাঁর 'স্টেট অব থিংস'-এর উপর ছন্দোবদ্ধ রচনাটি ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। এটি আদৌ সহজলভ্য ছিল না। এই কবিতার প্রেক্ষাপট হল ১৮১১ সাল। শেলীর তখন মাত্র ১৮ বছর বয়স। অক্সফোর্ডে পড়াশুনা করতেন। ঐসময় নেদারল্যান্ডে ফরাসীদের বিপক্ষে বৃটেনের যুদ্ধের বিভীষীকার উপর একজন আইরিশ সাংবাদিক পিটার ফিনার্টি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এর ফলে সরকার ঐ সাংবাদিককে ১৮ মাসের কারাদন্ড দেয়। তখন তার মুক্তির জন্য চলে আন্দোলন। ঠিক ঐ সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে শেলী ১৭২ লাইনের 'ছন্দোবদ্ধ রচনা- 'স্টেট অব থিংস' লেখেন। রচনাতে তিনি ফিনার্টির জন্য তহবিল সংগ্রহকারী বারডের জন্য প্রশংসা বর্ণনা করেছেন। রচনাটি ১৮১১ সালের ২ মার্চ থেকে ২০০৬-এর জুলাই পর্যন্ত লাপাত্তা ছিল। কবিতাটি যিনি এতদিন সংরক্ষণ করেছেন পেশায় তিনি একজন অধ্যাপক। ২০০৬ সালে তিনি এটি জনসম্মুখে প্রকাশের অনুমতি দেন।

গত ১০ নভেম্বর বোদলেইন লাইব্রেরী এটি সংগ্রহ করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে। জানা যায়, রচনাটি একটি রাজনৈতিক প্রপাগন্ডামূলক। এতে নেই কোন ব্যক্তিক সম্পর্ক, নেই প্রকৃতির কোন রূপ, নেই ভাষার অলংকার। আছে বস্তুবাচক শব্দের সমাহার, যেমনঃ স্বৈরতন্ত্র, নিপীড়ন, বিভেদ, প্রশংসা, গর্ব, শক্তি, স্বার্থ ইত্যাদি। শেলীর এই লেখাকে সমাজের দুটি শ্রেণীর মধ্যে ভাগ করা যায়। একদিকে তিনি কবিতার বর্ণনায় রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত, স্বাধীনতা, শ্রমজীবিদের বেদনা ও স্বাধীনতার কথা তুলে ধরেছেন। আরেকদিকে ছোট ছোট ছত্রে রেখেছেন সাহিত্যকর্মের ছাপ।

আমাজনের বর্ষসেরা বই ঘোষণা

অনলাইন জায়ান্ট আমাজন ২০১৫ সালের সেরা দশ বইয়ের নাম ঘোষণা করেছে। শীর্ষ স্থানটি পেয়েছে ৩৭ বছর বয়সী আমেরিকান গল্পকার লরেন গ্রোফের লেখা বই ' ফেটস এন্ড ফিউরিস' । বইটিকে এবারের সেরা বই বলে নির্বাচিত করেছে আমাজনের সম্পদনা পর্ষদ। এটি সম্পূর্ণরূপে একটি বিয়ের গল্প। তবুও এতে নারী পুরুষের সম্পর্ক প্রেম ভালবাসা জীবনবোধ এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে শৈল্পিক গতিতে। পাঠকদের মতামত এবং সম্পাদকদের পছন্দের ভিত্তিতে হয়েছে এই নির্বাচন।
এই তালিকায় পরের স্থান গুলোতে আছে লেখক টা নিহেশি কোয়াটসের লেখা বর্ণবাদ বিরোধী পত্রসাহিত্য 'বিটুইন দ্য ওয়ার্ল্ড এন্ড মি" । আর জোনাথন ফ্রাঞ্জেন-এর 'পিউরিটি'।
আরও আছে এমি এলিস নাটস-এর 'বিকামিং নিকোল'। তৃতীয় প্রকৃতির একটি মেয়ে ও তাঁর পরিবারের গল্প। সাবাহ তাহির-এর 'এন এম্বার ইন দ্য এশেস' বইটি। এবং ক্রিস্টিনা হান্নাহ রচিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দুই ফরাসী বোনের গল্প 'দ্য নাইটএঙ্গেল'। পলা হকিংসের থ্রিলার 'দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন' আছে দশম স্থানে।

নতুনভাবে বাঁধা পড়লেন অমঙ্গলের চিত্রকর

কসাইখানা, প্রিয় জায়গা হিসেবে নিশ্চয়ই আপনার পছন্দের মধ্যে পড়বে না। সেখানে মাংস কাটা, ঝুলিয়ে রাখা মাংস, মাংসের রঙ, রক্ত–এসব? খুব স্বাভাবিকভাবেই রক্ত মাংসে গড়া মানুষের পছন্দের সাধারণ হিসেবের বাইরে পড়বে এই কসাইখানা। অথচ এই মানুষ হয়েও এসব কিছুই পছন্দ ছিল ফ্রান্সিস বেকন-এর। তাহলে কি তিনি সাধারণ ছিলেন না? তিনি কি এর মাঝে জৈবিক, জান্তব,আদিমতার সন্ধান পেয়েছিলেন? তা নাহলে এই মাংসের রঙ্গ, রক্ত, খন্ডিত বিকৃত বীভৎসতাকে ধারন-করা তার চিত্রকর্মগুলো নিয়ে কেন আজও মেতে আছে পুরো পশ্চিমা পৃথিবী? চিত্রকর হিসেবে আমরা পিকাসো, সালভাদর দালি, ভ্যান গখ অথবা মাতিসকে যেভাবে চিনি ফ্রান্সিস বেকনকে সেভাবে নয়। সুন্দর ছবি বা সুন্দর করে আঁকা ছবি–এ দুটির যে-কোনটাতে ফেলতেই অনেকে দ্বিধা করবেন বেকনের আঁকা ছবিগুলোকে। অথচ ১৯৯২ সালের এপ্রিলে মারা যাবার আগে তিনিই ছিলেন তার সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে দামী চিত্রকর। তার আঁকা ছবিগুলো মানুষকে কেমন অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেয় । ভয়, হিংসা, রিরংসা, হিংস্রতা, বিবমিষার প্রতীক যেন ছবিগুলো। সুন্দর, মানবিক আনন্দের বিপরীত। উন্মোচিত পৃথিবীর আড়ালে যা কিছু থাকে তাই যেন তুলে এনেছেন তাঁর ক্যানভাসে। বেকনের ছবির ব্যপ্তি ছিল বিশাল। সাধারণ মাপের ক্যানভাস ছাড়িয়ে ট্রিপটিচ বা ডিপটিচ-এ। ছবিতো এঁকেছেন কিন্তু সচরাচর চিত্রকলার সমস্ত ধরন, নিয়ম, ছন্দ, আকার সব ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে। এ জন্য সমালোচনাও কিছু কম জোটেনি। সম্ভবত এ কারনেই তাঁকে অমঙ্গলের চিত্রকর বলা হয়ে থাকে। আজীবন শ্বাসকষ্টে ভোগা এই মানুষটি ১৯০৯ সালে ইংল্যান্ডে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর ছবির ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে গবেষক ও জীবনীকারেরা বেকনের ব্যক্তিগত জীবনের রহস্য উন্মোচনের পিছনেও ছুটেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত জীবনের নৈরাশ্য, হতাশা, সমকামিতা , অবিশ্বাস, মদ, জুয়া আর অসুস্থতা–এসবের মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি তার কাজের মধ্যে খুঁজেছেন কেউ কেউ । আবার নাটক, কবিতা, বিজ্ঞান, দর্শন, আলোকচিত্রের প্রতি অনুরাগের প্রতিফলও খোঁজা হয়েছে। ফ্রয়েড, নিৎসে, ইবসেন ভালবাসতেন বেকন। মনে করতেন, ফ্রয়েড আর নিৎসের ভাবনাগুলো একই। তাই পরবর্তীতে অনেক গবেষকই তাঁর ছবির মনস্তত্ব খুঁজতে গিয়ে ফ্রয়েডিয় তত্ত্ব প্রয়োগ করেছেন। শেক্সপিয়রের নাটকগুলো পছন্দ করতেন বেকন। একসময়য় ভাবা হতো, শেক্সপিয়রের এই নাটকগুলো লিখেছেন আরেক ফ্রান্সিস বেকন, ষোড়শ শতকের ইংরেজ দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। এবং তিনিও সমকামী ছিলেন। এ ব্যাপারটি নিয়ে বেশ মজাও করতেন বেকন। নাটকের প্রতি তাঁর ভালবাসার কারণ ছিল মঞ্চ, আর মঞ্চ নাটকের অভিনেতা বা চরিত্ররা। ক্যানভাসের স্বল্প পরিসরে যেভাবে একজন চিত্রকর নানা ছোট ছোট অভিব্যক্তির বিশালতা প্রকাশ করেন ঠিক সেভাবেই যেন মঞ্চনাটকের অভিনেতারা জীবনের নানা ভাঙা গড়া ঘাত-প্রতিঘাত মঞ্চের সীমাব্ধতায় ফুটিয়ে তোলেন। জীবদ্দশায় বেকন তাঁর আঁকা অনেক চিত্রকর্মই ধ্বংস করে ফেলেন। এখন পর্যন্ত তাঁর মোট ৫৮৪টি চিত্রকর্মের মধ্যে অর্ধেকের খোঁজ মিলেছে। তাঁর ছবিগুলোর হদিশ, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজটি ফ্রান্সিস বেকন স্টেট করছে। এই প্রতিষ্ঠানটি খুব শীঘ্রই বেকনের ১০০টির বেশী নতুন চিত্রকর্মের ক্যাটালগ তৈরির দশ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পের কাজ শেষ করতে যাচ্ছে। এখানে তাঁর শ্রেষ্ঠ বিদ্রূপাত্মক চিত্রকর্মগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে 'চিৎকার করা পোপ' শিরোনামের ছবিটি। এ শিল্পটি এতদিন ইতালীতে ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। 'চিৎকার' বেকনের ছবির একটি বিষয়। চিৎকার প্রকাশবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। বেকনের ছবিতে চিৎকার শুধু রঙের নয়, জীবনেরও। শিল্পকলার ঐতিহাসিক মার্টিন হ্যরিসন তাঁকে নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। তিনি জানান পোপ নিয়ে তাঁর এই চিত্রকর্ম শুধু অসাধারণই নয়, বরং ঐতিহাসিকভাবেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি বেকন অনেক স্বেচ্ছাচারী ছিলেন। যৌনতাকেও তিনি বিভিন্নভাবে তাঁর শিল্পকর্মে ধারন করেছেন। উত্তরাধুনিকতার উপাদানও খুঁজে পাওয়া যায় বেকনের শিল্পে।
বেকনের শিল্পকর্মের ধারাবাহিক ক্যাটালগ প্রকাশ পেলে তাঁর সকল কাজ যেমন একসাথে দেখা যাবে, তেমনি মানুষের মনে নতুন উপলব্ধি তৈরি হবে।
ফ্রান্সিস বেকনের উপর এই প্রকল্পটি শেষ করা অনেক কঠিন ছিল। তাঁর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিল্পকর্মগুলি একত্র করতে সমগ্র ইউরোপ, আমেরিকা থেকে জাপান, এমনকি অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত ঘুরতে হয়েছে।
ইতালির হ্যানী প্রকাশনা আগামী বছর ২৮ এপ্রিল বেকনের কাপড়ে বাঁধানো ৭টি ভলিউমের ক্যাটালগ প্রকাশ করবে। যার মধ্যে ৩টি চিত্রকর্ম, ২টি করে তথ্যসূত্র ও জীবনী থাকবে। এটির মূল্য হবে ১০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড।

কাজিমির ম্যালেভিচের দুটি দুর্লভ মাস্টারপিস চিত্রকর্ম আবিষ্কার

শিল্পে সুপারমেটিজম ব্যাপারটি যার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই রাশিয়ান চিত্রকর কাজিমির ম্যালেভিচের অনেক আগের দুটি একরঙা দুর্লভ মাস্টারপিস আবিষ্কৃত হয়েছে সম্প্রতি। রাশিয়ান একদল শিল্প-বিশেষজ্ঞ এমনটাই দাবী করেছেন।
১৮৭৮ সালের তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বর্তমান ইউক্রেন-এ পোলিশ বাবা মায়ের ঘরে জন্ম নেন কাজিমির। তিনি বিভিন্ন ঢঙয়ে শিল্পকর্ম করলেও আঁকার ব্যাপারে মৌলিক জ্যামিতিক ধারণার সমর্থন করতেন। এবং এজন্যই বিখ্যাত ছিলেন। চতুর্ভুজ, ত্রিভুজ, বৃত্ত এসবের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ককে সচিত্র উপস্থাপন করতেন। শিল্পসম্মত দার্শনিক ভাবনা, বিমূর্ত কল্পনা ও অবস্তুগত রূপের এই প্রকাশই কাজিমির ম্যালেভিচের সুপারমেটিজম তত্ত্ব হিসেবে খ্যাত। এই ব্যাপারটি পরবর্তীতে অন্যান্য আধুনিক চিত্রকরদের শিল্পকর্মেও প্রবাহিত হয়। ১৯১৫ সালে কাজিমির আঁকা 'ব্লাক স্কয়ার' চিত্রকর্মটি এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

এবছর মস্কোয় ট্রেটিইয়াকভ গ্যালারিতে 'ব্লাক স্কয়ার' নামক চিত্রকর্মটি এক্স-রে'র মাধ্যমে পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা দেখতে পান যে, কিউবিস্ট ঘরানার আরও দুটি চিত্র সেটির কালো আস্তরণের নিচে লুকানো আছে। সেখানে ছবির বর্ডারে শিল্পীর লেখা কোডের মতো কিছু ম্যাসেজ খুঁজে পান তারা ।
ট্রেটিইয়াকভ গ্যালারির শিল্পবিশেষজ্ঞ ইকাতারিনা ভরোনিনা এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে জানান, ' ব্লাক স্কয়ার-এর নিচে কিছু থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছিলাম। কিন্তু সেটি যে দুটি চিত্রকর্ম হবে তা ভাবিনি'।
মনে করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে উচুদরের এই শিল্পী সম্পর্কে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যাবে। কাজিমির ম্যালেভিচের এই দুটি শিল্পকর্মের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ফিউচারিজমের সাথে কিউবিজমের সংমিশ্রণ। ফিউচারিজম হচ্ছে বিংশ শতাব্দির শুরুতে ইতালির শিল্প ও সামাজিক বিপ্লব, আর কিউবিজম হচ্ছে একই শতাব্দীতে ইউরোপে ঘটে যাওয়া চিত্র ও ভাস্কর্য শিল্পের বিপ্লব। এ পর্যন্ত কাজিমিরকে নিয়ে পাওয়া সব তথ্য ও দুর্লভ কিছু চিত্রকর্ম নিয়ে এ সপ্তাহেই একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করার কথা জানিয়েছে ট্রেটিইয়াকভ গ্যালারি।

( দি গার্ডিয়ান পত্রিকার চিত্র ও তথ্যাশ্রয়ে রচিত)

আর্টস বিভাগে প্রকাশিত বিপাশা চক্রবর্তীর আরও লেখা:
জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গম: অর্ধনারীশ্বর অথবা তৃতীয় প্রকৃতি