জেমস জয়েসের ধারাবাহিক উপন্যাস: ইউলেসিস (কিস্তি-১)

আবদুস সেলিমআবদুস সেলিম
Published : 5 July 2021, 11:23 AM
Updated : 5 July 2021, 11:23 AM

ইংরেজি মুলঃ জেমস জয়েস
বাংলা ভাষান্তরঃ আবদুস সেলিম

ভুমিকা
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দশটি উপন্যাসের তালিকায় অনিবার্যভাবে জেমস জয়েসের (১৮৮২-১৯৪১) ইউলিসিস অন্তর্ভুক্ত হয়ে আসছে আজ প্রায় একশত বছর ধরে—অর্থাৎ ১৯২২ সালে উপন্যাসটি প্রকাশ হবার পর থেকেই। কিন্তু একথাও সত্য এই উপন্যাসটি বিশ্বের দুর্বোধ্যতম উপন্যাস বলেই গণ্য হয়েছে শুধু অন্যান্য ভাষাভাষী পাঠকদের কাছেই নয়, স্বয়ং যে-ভাষাতে এ উপন্যাসটি রচিত সেই ইংরেজি ভাষাভাষীদের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ পাঠকের কাছেও। এটি সর্বস্বীকৃতভাবে একটি অগম্য উপন্যাস। এমনকি লেখকের সমসাময়িক এবং স্বদেশী, বিখ্যাত কবি, উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসও (১৮৬৫-১৯৩৯)—দু'জনই আইরিশ—এই উপন্যাসটি পড়ে শেষ করতে পারেননি বলে কথিত আছে এর ভাষা, জটিল রচনাশৈলী, পরোক্ষ উল্লেখের (allusion) বাধাহীন পর্যাপ্ততা এবং সর্বোপরি লেখকের গল্প রচনার কৌশলী পদ্ধতি—যা সাহিত্য জগতে জয়সের এক অনন্য চারিত্র—যাকে আমরা চেতনা প্রবাহ বা stream of consciousness বলে জানি, এসব কিছুর কারণে। তবুও কেনো এ উপন্যাস এতো গুরুত্বপুর্ণ?
এর অন্যতম কারণ এই অসাধারণ উপন্যাসে একাধারে সংমিশ্রিত হয়েছে পুরাণ, প্রতীক, দর্শন, সামাজিক বাস্তবতা এবং সর্বোপরি মনুষ্যধর্ম। ফলে উপন্যাসটি সর্বঅর্থে আধুনিকতার প্রাজননিক সাহিত্যকর্ম, এটি বিশ্বসাহিত্যের সকল সীমারেখাকে অতিক্রম করে এক নতুন জানরার বা শিল্পরীতির জন্ম দিয়েছে। অনেক সাহিত্যামোদীই এই উপন্যাসকে চিহ্নিত করেছেন 'অননুকরণীয়, এবং অপ্রকিতিস্থ' শিল্পকর্ম রূপে। প্রসঙ্গত সমসাময়িক আর এক কবি—যিনি জয়েসের মতোই পরোক্ষ উল্লেখের (allusion) প্রতি প্রায় অপ্রকিতিস্থভাবে আকর্ষণ বোধ করতেন তাঁর কবিতা রচনাতে—সেই টমাস স্টার্ন্স এলিয়টের (১৮৮৮-১৯৬৫) ইউলেসিস সম্মন্ধে একটি বক্তব্য ছিলো এমন: আমি এই গ্রন্থটিকে বর্তমান সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ অভিব্যাক্তি বলে গণ্য করি: এটি এমন একটি উপন্যাস যার প্রতি আমরা সবাই আকর্ণ ঋণী, যার প্রভাব থেকে আমাদের পরিত্রাণের কোনোই উপায় নেই।
সহজেই অনুমেয় এমন একটি উপন্যাসের অনুবাদ একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ—সে যে ভাষাতেই হোক। আমার জানা মতে ইউলেসিস বাংলাভাষাতে এপর্যন্ত অনূদিত হয়নি—আমি হলফ করে বলতে পারছিনা যদিও। এটি অনুবাদের যে প্রধান প্রতিকূলতা/প্রতিবন্ধকতা তার আভাস আমি ইতিমধ্যে দিয়েছি—জটিল রচনাশৈলী, পরোক্ষ উল্লেখের (allusion) বাধাহীন পর্যাপ্ততা এবং সর্বোপরি লেখকের গল্প রচনার নতুন পদ্ধতি—যা সাহিত্য জগতে জয়সের প্রায় একান্ত—যাকে আমরা চেতনা প্রবাহ বা stream of consciousness বলে জানি। যদিও আমার মনে পড়ে কমল কুমার মজুমদার (১৯৪১-১৯৭৯) চেতনা প্রবাহ নিরীক্ষায় তাঁর অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাস রচনাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, কারো কারো মতে ধুর্ঝটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও, কিন্তু সেই জানরা বাংলা সাহিত্যে কখনোই তেমন সচল হয়নি এবং এই রীতিতে ইউলেসিস-এর মতো সফল কোনো উপন্যাস বাংলাতে রচিতও হয় নি। উপন্যাসে যদিও ডরোথি রিচার্ডসন (১৮৭৩-১৯৫৭) প্রথম চেতনা-প্রবাহের ব্যাবহার করেন, কিন্তু জেমস জয়েসই এই ধারাটির অর্থপূর্ণ ব্যাবহার করেছেন তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসে, বিশেষ করে আ পোর্ট্রেট অফ দ্যা আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়াংম্যান এবং ইউলেসিস-এ।


ইউলেসিস অনুবাদের সংকটটা শুধুমাত্র চেতনা প্রবাহের ভেতরই সীমাবদ্ধ নয়—এর নানাবিধ সমস্যার মধ্যে অন্যতম, পরোক্ষ উল্লেখের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার যার ভেতর রয়েছে, রোমান ক্যাথোলিক এবং অ্যাপোস্টলিক চার্চের বাড়াবাড়ির সঙ্কট এবং বিভিন্ন খ্রিস্টিয় আচারআচরণের পারস্পরিক সঙ্ঘাত যা জয়েসের সময়ে বর্তমান ছিলো, এবং সর্বোপরি ইংল্যান্ড ও আইরিশ রাজনীতির জটিল অবিশ্বাস। এ বিষয়গুলোর সাথে আমি অনুবাদকালে আমাদের পাকিস্তান সময়কালের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমানের ধর্মীয় চিন্তাভাবনার ক্রমপরিবর্তণশীলতার অভাবনীয় সাযুজ্য দেখতে পেয়েছি। এটিই আসলে সেই উপরে বর্ণিত মনুষ্যধর্মের সাথে প্রচারিত ধর্মের সঙ্ঘাত।
উপন্যাসটি তিনটি মূল ভাগে ভাগ করা এবং সব মিলিয়ে মোট উনিশটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত—প্রথম ভাগে তিনটি, দ্বিতীয় ভাগে তেরোটি এবং তৃতীয় ভাগে তিনটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। কিন্তু সবচাইতে উল্লেখ্য বিষয়টি হলো উপন্যাসের বিন্যাস হোমারের দ্যা ওডেসি মহাকাব্যের অনুকরণে। উনিশটি পরিচ্ছেদের বিষয়বস্তু হুবহু একই, যদিও উত্তরআধুনিকতাতে রূপান্তরিত। জেমস জয়েস একাধিক ভাষা জানতেন—লাতিন, ইতালিও, ফরাসি, জর্মন, এবং নরওয়েজিও। ফলে এই উপন্যাসে প্রতুল পরিমাণে বাইবেল, মূল ওডেসি, ইতালিও, লাতিন, এবং জর্মন উদ্ধৃতি রয়েছে যার অনুবাদ পরিপ্রেক্ষিত বিচারে সহজ নয়। শুধু তাই নয়, এই উদ্ধৃতিগুলোর সাথে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক এবং গল্পের আনুক্রমিক সমঞ্জস অনুধাবন করে ভাষান্তর করা এবং ঐ ভাষার পাঠকের কাছে বোধগম্য করা সুকঠিন। বিশেষ, এটি এমন উপন্যাস যা খোদ ইংরেজি ভাষাভাষীর কাছেও সহজবোধ্য নয়। বাস্তবতা হলো, এই উপন্যাসের বিভিন্ন বিস্তৃত টিকাটিপ্পনি রয়েছে একাধিক খ্যাতিমান সাহিত্যানুরাগী এবং সমালোচকদের। আমার নিজের কাছেই এমন টিকাটিপ্পনির মুদ্রিত তিনশো পৃষ্ঠার গ্রন্থ আছে যা আমি অনুবাদে ব্যাবহার করছি। এরই সাথে আমাকে প্রতিটি লাইনের বিভিন্ন ভাষার উদ্ধৃতির ব্যাখ্যার জন্য ওয়েবপেজে যেতে হচ্ছে বারংবার।

আমি আশা করিনা আমার এই অনুবাদের পাঠকরা এইভাবে উপন্যাসটি পাঠ করবেন, অর্থাৎ টিকাটিপ্পনি এবং ওয়েবপেজ সংযোগে উপন্যাসটি বোঝার চেষ্টা করবেন। আমি যে পরিচ্ছেদটি বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম-এর আর্টস বিভাগে প্রকাশের জন্য দিয়েছি তার শিরোনাম টেলেমেকাস—যদিও জয়েস তাঁর মূল উপন্যাসে পরিচ্ছেদের কোনোটির নামকরণ করেন নি। আসলে তাঁর আখ্যানচারিত্র সহজেই ইঙ্গিত করে হোমারের ওডেসির আখ্যানরীতি ও নামকরণের দিকে। আমার এই অনুবাদ আর্টস বিভাগে প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য হলো এই সুকঠিন বিশাল মহাকাব্যিক উপন্যাসের (মুদ্রিত ৮০০ পৃষ্ঠা) অনুবাদ পাঠ-প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করা এবং সেই সাথে বিদগ্ধ পাঠকদের কাছ থেকে মূল্যবান পরামর্শ গ্রহণ করা যা এই অনুবাদ গ্রন্থাকারে প্রকাশে (যদি অনুবাদ আমার জীবদ্দশাতে সম্পন্ন করতে পারি) সহায়ক হবে।
সবশেষে বলতে চাই, এই উপন্যাস জেমস জয়েস লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন প্যারিসে ১৯০৬ সালে, ১৯১৯ সালে প্রথম পাঁচটি কিস্তি ধারাবাহিক ছাপা হয় ইগোইস্ট পত্রিকাতে। পরবর্তিকালে ১৯২০ সালে এজরা পাউন্ড তাঁর লিটল রিভিউ পত্রিকাতে তেরোটি পরিচ্ছেদ মুদ্রণ করেন। কিন্তু এ সময়ে ন্যু ইয়র্কের সোসাইটি অব প্রিভেনশন অব ভাইস যৌন অশ্লীলতার উপাদান থাকার অভিযোগে উপন্যাসটি মুদ্রণ নিষিদ্ধ করে। ফলে জয়েসকে বেশ হেনস্তা হতে হন। ইউলেসিস পরিপূর্ণ উপন্যাসাকারে মুদ্রিত হয় সেই প্যারিসেই ১৯২২ সালে। আমার অনুবাদ চলমান, এবং এই অনূদিত উপন্যাসের কিস্তি রূপে প্রকাশিত হতে থাকবে যদিও ধারাবাহিক রূপে নয়—অংশবিশেষ, তবে প্রতিটি কিস্তির স্বয়ংসম্পূর্ণ আদল ও অর্থসহ।
আশাকরি বিদ্যান পাঠককূল তাদের বিজ্ঞ প্রতিক্রিয়া দিয়ে আমাকে এই অনুবাদে সাহায্য করবেন, কারণ আমি মনে করি এই অনুবাদ আমাদের বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদের রচনাশৈলীকে সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হতে পারে। উল্লেখ্য, উপন্যাসের মূল আখ্যানশৈলী (narrative style) যতটা সম্ভব অপরিবর্তিত রাখার চেষ্টা করেছি বাংলাভাষার সার্বিক বোধগম্যতা ও গ্রহণক্ষমতাকে ব্যবহার করে। যে-কোনো পরামর্শ থাকলে এই লেখার নিচে মন্তব্যের ঘরে অথবা অনুবাদককে সরাসরি ইমেইলেও জানাতে পারেন: selimminubd@gmail.com



রাজসিক, গোলগাল বাখ মুলিগান সিঁড়ির মাথার ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে আসে, হাতে দাড়ি কাটার সাবানের পাত্র যার ওপর একটা আয়না এবং ক্ষুর আড়াআড়ি ভাবে রাখা। সামনেখোলা গায়ের হলুদ ড্রেসিং গাউনটা সকালের বাতাসে তার পেছনে হাল্কাভাবে উড়ে। পাত্রটা সে মাথার উপরে স্তোত্র পাঠের মতো ধরে সুর করে গায়:
–Introibo ad altare Dei—আমি যাব, যাব রে ভাই, দয়ালেরই দরশনে।
সুর বন্ধ করে সে এবার অন্ধকারে ঘোরানো সিঁড়ির নিচের দিকে অনুসন্ধানি চোখে তাকিয়ে বাজখাই গলায় চেঁচায়:
–উপরে এসো, কিঞ্চ। উপরে চলে এসো, ভিতুর ডিম পাদ্রি সাহেব।
সে এগিয়ে এসে সিঁড়ির কামান দাগার মতো গোল হাতলের উপর উঠে বসে। এরপর তিনবার দুর্গ, আশপাশ এবং সকালে জেগে ওঠা পাহাড়গুলোকে গম্ভীর আশীর্বাদ করে। তারপর স্টিফেন ডেডোলাসকে দেখতে পেয়ে তার দিকে ঝুঁকে শূন্যে দ্রুত ক্রুশ চিহ্ন এঁকে গলায় গড়গড়ার শব্দ করে মাথা নাড়তে শুরু করে। স্টিফেন ডেডোলাস স্পষ্টতই বিরক্ত এবং তন্দ্রাচ্ছন্ন, তার দু' বাহু সিঁড়ির মাথার উপর রেখে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঐ গড়গড়া শব্দ সহ মাথা নেড়ে আশীর্বাদ করা মুখের দিকে। মুখটা দেখাচ্ছিলো ঘোড়ার মতো লম্বা, না-কামানো অপ্রতুল চুলগুলো যেনো ধূসর ওক গাছের আঁশের গোছার মতো।
বাখ মুলিগান এক মুহুর্ত আয়নার নিচের দিকে চোখ বুলিয়ে দাড়ি কাটার পাত্রটা চটপট ঢেকে দেয়।
–ব্যারাকে ফির যাও, ঘোষণা দেয় কঠিণ স্বরে।
তারসাথে ধর্মপ্রচারকের মতো যোগ করে:
–এই হলো, শুনে রাখুন প্রিয়জনেরা, সত্যিকারের খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা: দেহে এবং মনে এবং রক্তে এবং ক্রুশবিদ্ধ শরীরে। দয়া করে ধীর লয়ে বাজান। সবাই চোখ বন্ধ করুন। এক মুহূর্ত। রক্তের ওইসব শ্বেতকণার সামান্য দূষণ। চুপ থাকবেন, সবাই।

সে পাশে উপরের দিকে চায়, নিচু স্বরে লম্বা শিষ দেয়, তারপর থেমে কানখাড়া করে কিছুক্ষণ শোনে, তার কয়েকটা সোনা মোড়া দাঁত এসময়ে এখানেওখানে চিকচিক করে উঠে। যেনো সোনাকন্ঠি বাগ্মী ক্রিসসতম। দুটো উচ্চনাদী শিষ সজোরে উত্তর দেয়। তারপর সব সুনসান।
–ধন্যবাদ, বন্ধুরা, সে ঝটপট জোরে বলে উঠে। ঠিক আছে, ওতেই বেশ চলবে। এবার স্যুইচটা বন্ধ করে দাও, ঠিক আছে?
কামানদাগার আসন থেকে নেমে পড়ে সে তার দিকে চেয়ে থাকা সবার উপর গম্ভীর চোখ বোলায়, পায়ের কাছে তার গাউনের ঢিলে অংশ সামলে নেয়। তার গোলগাল আবছা মুখ আর ডিমের মতো ফোলাফোলা শুয়োরের গাল এক বিশপের কথা মনে করিয়ে দেয়, মধ্যযুগের এক শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক। এক প্রশান্ত হাসি তার মুখে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়ে।
–এ এক ধরনের মজা, সে উচ্চারণ করে মহানন্দে। তোমার নামটা অদ্ভুত, গ্রীক পুরাণের।
নিজেনিজে হাসতেহাসতে বন্ধুসুলভ আঙ্গুলের ইসারা করে প্যারাপেটের দিকে চলে যায় সে। অবসন্ন স্টিফেন ডেডোলাস সিঁড়ি বেয়ে উঠে তাকে মাঝ পথ পর্যন্ত অনুসরণ কোরে সেই কামানদাগা আসনের কোনাতে এসে বসে। তারপর দেখতে থাকে কিভাবে সে প্যরাপেটের উপর আয়নাটা খাড়া করে রেখে, ব্রাশটা পাত্রের ভেতর চুবিয়ে তার গাল এবং ঘাড়ে সাবান মাখে।

বাখ মুলিগানের খোশমেজাজি কন্ঠস্বর চলমান।
–আমার নামটাও উদ্ভট: মালুকি মুলিগান, বেশ মত্রাবৃত্তে ছন্দময়। তবে এর ভেতরে একটা হেলেনিও সুরও আছে, তাই না? একদম ছন্দেছন্দে দুলি আনন্দে, আবার বেশ রৌদ্রছায়ার খেলাও, ঠিক যেনো মর্দা হরিনের মতো। আমাদের এথেন্সে যাওয়া উচিত। যাবে নাকি যদি খালার কাছ থেকে কিছু টাকা ফুশলেফাশলে আদায় করতে পারি?
সে এরপর ব্রাশটাকে সরিয়ে রেখে, হাস্যোজ্জল কন্ঠে বলে:
—আসবে নাকি, গোবর্ধন পাদ্রী সাহেব?
থামে, তারপর সে সযত্নে দাড়ি কাটতে মনযোগী হয়।
–একটা কথা মুলিগান, স্টিফেন শান্ত কন্ঠে বলে।
–হ্যাঁ, বলো?
–এই হেইন্স-টা আর কতোদিন থাকবে এই দুর্গে?
ডান ঘাড়ের পাশ দিয়ে বাখ মুলিগান তার দাড়িকাটা একটা গাল ঘোরায়।
–ঈশ্বরের ওয়াস্তে ওটা একটা আস্ত গজব, তাই না? তার সোজাসাপ্টা কথা। একদম ভাবগম্ভির স্যাক্সন। ছোকরাটা ভাবে তুমি একটা খ্যাত। এই ইংরেজগুলো যে কি মাল দিয়ে তৈরি। টাকাপয়সা আর বদহজমে টইটুম্বুর। ওর বাড়ি অক্সফোর্ডে। একটা কথা কি ডেডোলাস, তোমার চালচলন কিন্তু একেবারে সত্যিকার অক্সফোর্ডিয়দেরর মতো। আমি কিন্তু তোমার নামটা বেড়ে দিয়েছি: কিঞ্চ, ধারালো চাকু।
সে সতর্ক দাড়ি কেটে চলে।
–গত সারাটা রাত এক কালো প্যান্থার নিয়ে যা ক্ষ্যাপামি করেছে, স্টিফেন বলে। চেঁচিয়েছে এই বলে, তার বন্দুকের বাক্সটা কই?
–আচ্ছা পাগল, মুলিগান বলে। ভয় পেয়েছিলে নাকি?
–পেয়েছিলামই তো, স্টিফেন জোরে এবং ভয়ে উত্তর দেয়। ওই অন্ধকার জায়গায় একজন অচেনা মানুষ এক কালো প্যান্থারকে গুলি করে মারার জন্যে ক্ষ্যাপামি আর চেঁচামেচি করছে, ভাবলেই ভয় লাগে। আপনি অনেক ডুবন্ত মানুষকে বাঁচিয়েছেন। আমি কিন্তু কোনো মহানায়ক নই। ও যদি এখানে থাকে তাহলে আমি আর নেই।
বাখ মুলিগান তার ক্ষুরে আটকে থাকা সাবানের ফেনার দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকায়, তারপর তার দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমে তড়িঘড়ি প্যান্টের পকেট হাতড়াতে শুরু করে।
–যত সব বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার, সে বিরক্তির সাথে বলে উঠে।
তারপর সেই কামানদাগার জায়গাতে এসে স্টিফেনের বুক পকেটে হাতড়ে বলে:
–তোমার নাকঝাড়া কাপড়টা একটু ধার দাও তো আমার ক্ষুরটা পরিস্কার করি।
স্টিফেন ইচ্ছে করে মুলিগানকে তার পকেট হাতড়ে একটা ময়লা দোমড়ানো রুমাল বের করে কোণা ধরে উঁচুতে দেখাতে বাধ্য করে। বাখ মুলিগান তার ক্ষুর সেটা দিয়ে সযত্নে মোছে। তারপর রুমালটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে:
–কবিআলের নাকমোছা রুমাল। আমাদের আইরিশ কবিদের জন্যে এটা এক নান্দনিক রং: শিকনিসবুজ। তুমি ইচ্ছে করলে চেখে দেখতে পারো, কি বলো?
সে আবার প্যরাপেটের উপর আসীন হয়ে সামনে ডাবলিন উপসাগরের দিকে দৃষ্টি দেয়, তার সাদা ওকধূসর চুলগুলো বিশৃঙ্খল হয়।
–ঈশ্বর, বিড়বিড় করে বলে। সমুদ্রের কথা বলতে গিয়ে অ্যালজি বলেছিলো না: এক ধূসর মিষ্টি মা? শিকনিসবুজ সাগর। হোমার বলেছে Epi oinopa ponton—গহিন লালমদ সাগরে। আহ, ডেডোলাস, আবার সেই গ্রীকদের কথা। তোমাকে আমার শেখাতেই হবে। মূলটা না পড়লে কোনোই লাভ নেই। Thalatta! Thalatta!—থালাটা! থালাটা! লবণজল ভূমধ্যসাগর। সেই আমাদের মিষ্টি মা। এসে দেখে যাও।
স্টিফেন উঠে প্যরাপেটের কাছে যায়। দেয়ালে ঝুঁকে নিচে পানির দিকে তাকায়, দেখে ডাকজাহাজগুলো কিংসটন বন্দরের মুখ পেরিয়ে চলে যাচ্ছে।
–আমাদের মাতা সাহসিকা, বাখ মুলিগান বলে উঠে।
সে হঠাৎ সমুদ্রের দিক থেকে তার গভীর অনুসন্ধানি দৃষ্টি ফেরায় স্টিফেনের মুখের দিকে।
–খালা মনে করে তুমি তোমার মাকে খুন করেছো, সে বলে। তাই তোমার সাথে মেলামেশা করতে আমাকে বারন করেছে।
–খুন কেউ একজন তাকে করেছে, স্টিফেন বিষণ্ণ ভাবে বলে।
–তুমি হাটুভেঙ্গে বসতে পারতে কিন্তু, কিঞ্চ। একদম ঠিক করো নি। মৃত্যুশয্যায় তোমার মা তোমাকে এতো করে বলেছিলো, বাখ মুলিগান বলে। আমিও তোমার মতোই উত্তরগোলার্ধের মানুষ। কিন্তু তবুও মা যখন অত করে বলেছিলো হাটুমুড়ে তার জন্যে প্রার্থনা করতে, তুমি করলে না। কথাটা মনে হলেই খারাপ লাগে। তোমার ভেতর একধরনের কুফা কাজ করে…
সে থামে, গালের অন্যনান্য দিকে আবার সাবান মাখতে থাকে। ঠোঁটে একধরনের সহিষ্ণু হাসির রেখা।
–তবে দারুণ অভিনেতা, সে ফিসফিস করে নিজেকে বলে। কিঞ্চ, সব চাইতে চমৎকার অভিনেতা।
সে মসৃণ ভাবে, সযত্নে, নিরবে, মনোযোগ দিয়ে দাড়ি কামাতে থাকে।
স্টিফেন, একটা কনুই অমসৃণ গ্র্যানিটের ওপর রেখে হাতের তালু ভ্রুর উপর ভর করে তার চকচকে কালো কোটের হাতার মলিন প্রান্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। যাতনা, তখনও ভালবাসা যাতনা হয়ে উঠতে পারে নি, তার মনটাকে অস্থির করে। চুপিচুপি, স্বপ্নের ভেতর সে তার কাছে এসেছিলো মৃত্যুর পর, ঢিলেঢালা বাদামি কাফনে মোড়া তার গলিত শরীর নিয়ে, মোম আর গোলাপকাঠের এক সুঘ্রাণ নিয়ে, তার নিশ্বাস, শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নিশ্বাস, শব্দহীন, দুখী, ভস্মের ভেজা সোঁদা গন্ধ নিয়ে। সেই সুতো ওঠা কোটের হাতা পেরিয়ে সে দেখতে পায় সাগরটাকে, যে সাগরের সবল ডাক তার মনে পড়িয়ে দেয় তার পাশে থাকা অবিস্মরণীয় মিষ্টি মাকে। বন্দরের গোলক এবং আকাশের দিগন্তরেখা রচনা করেছে এক বিষণ্ণ শ্যামল তারল্যের স্তূপ। মায়ের মৃত্যুশয্যার পাশে ছিলো সাদা চিনামাটির একটা পাত্র যার ভেতর ধরা ছিলো তার পচন ধরা যকৃৎ থেকে ভয়ঙ্কর শব্দময় বমন আকারে উদ্গত সবুজ তরল পাচক রস।
বাখ মুলিগান আবার তার ক্ষুরটা মুছে পরিষ্কার করে।

–আহ, বেচারা গতরখাটা মানুষ, তার গলায় দরদের সুর। তোমাকে আমি ক'টা সার্ট আর নাকমোছা কাপড় দেবো। ওই পুরনো পাতলুনগুলো কেমন ছিলো?
–মাপ মতোই ছিলো সব, উত্তর স্টিফেনের।
বাখ মুলিগান এবার তার নিচের ঠোঁটের ফোকড়ে ক্ষুরের আক্রমণ চালায়।
–দারুণ মজার, তার আত্মতৃপ্ত বক্তব্য, ব্যাবহার করা জিনিস ঐ রকমই হয়। ঈশ্বর জানে কোন গরিবি হাল এসব ওদের বেচতে বাধ্য করে। আমার একটা সুন্দর ডোরাকাটা জামা আছে, ছাইরঙ্গা। তোমার গায়ে দারুণ মানাবে। সত্যি বলছি, কিঞ্চ। ভালো কাপড় পরলে তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগে।
–ধন্যবাদ, স্টিফেন বলে। ছাইরঙ্গা হলে আমি পরতে পারবো না।
–বলছে পরতে পারবে না, বাখ মুলিগান আয়নাতে তাকিয়ে নিজেকে নিজে বলে। ভদ্রতা কিন্তু ভদ্রতাই। মাকে মেরেছে অথচ বলে কিনা ছাইরঙ্গা জামা পরতে পারবে না।
সে এবার ক্ষুরটা গুছিয়ে যত্ন করে রাখে, তারপর আঙ্গুল দিয়ে তার মসৃণ চামড়া ছুঁয়ে দেখতে থাকে।
স্টিফেন তার চোখ সমুদ্র থেকে ফিরিয়ে আবদ্ধ করে ছাইনীল সচল চোখের সেই ফোলা মুখের দিকে।
–গতরাতে জাহাজে যে লোকটার সাথে আমি ছিলাম, বলে বাখ মুলিগান, বলছিলো তোমার নাকি জি. পি. আই. আছে। লোকটা নাকি ডোটিভিলে থাকে কোনলি নরম্যানের সাথে। মানে তোমার জেনারেল প্যরালেসিস অফ দি ইনসেইন রোগ আছে।
সে আয়নাটা অর্ধবৃত্তাকারে শূন্যে ঘুরিয়ে ধরে দুরে সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর উজ্জ্বল সূর্যের আলোর ঝলকানি ধরার জন্য। তার কামানো ঠোটে বাঁকা হাসি, তারই ফাঁকে খানিকটা সাদা দাঁতের বিচ্ছুরন। হাসিতে তার পুরো সমর্থ সুঠাম শরির ঝাঁকুনি খায়।
–নিজেকে একবার এসে দেখো, বলে সে, গাইয়া কবিআল।
স্টিফেন সামনের দিকে ঝুঁকে তার দিকে বাড়িয়ে দেয়া আয়নায় উঁকি দেয়, চিড়খাওয়া আয়নার ফাঁকে, যার শেষ প্রান্তে একটা চুল আটকে আছে। ও আর অন্যরা সবাই আমাকে এভাবেই দেখে। আমার এই চেহারা কে দিয়েছে? এই মিন্তির ক্ষয়ে যাওয়া শরীর। আমার মুখটা আমাকেও ঐ কথা জিজ্ঞেস করে।
–আমি এটা চাকরদের ঘর থেকে হাতিয়েছি, বাখ মুলিগান বলে। ঠিক করেছি। খালা সবসময় মালুকির জন্যে যত্তসব সাদামাটা চেহারার চাকবাকর রাখে। যাতে ফস্টিনস্টি করার দুর্বুদ্ধি না হয়। এবারের মেয়েটার নাম উরসুলা।
আবার হেসে সে স্টিফেনের উঁকি দেয়া দৃষ্টি থেকে আয়নাটা সরিয়ে আনে।
–নিজের চেহারা আয়নাতে দেখতে না পারায় ক্যালিবানের গোস্বা, সে বলে। তোমাকে দেখার জন্যে আজ ওয়াইল্ড যদি বেঁচে থাকতো।
পেছন দিকে সরে আঙ্গুল নেড়ে তেতো স্বরে স্টিফেন বলে:
–এটা আইরিশ শিল্পের একটা প্রতীক। চাকরের চিড়খাওয়া আয়না।
বাখ মুলিগান তার বাহুর সাথে স্টিফেনের বাহু মিলিয়ে পুরো দুর্গটা হেঁটে ঘোরে, তার পকেটে গুঁজে রাখা ক্ষুর আর আয়নাটা হাঁটার সাথেসাথে খটখট শব্দ করে।
–তোমাকে এভাবে ঠাট্টা করাটা ঠিক নয়, কিঞ্চ, তাই না? তার গয়লায় সহানুভুতি। ঈশ্বর জানে ওদের অনেকের চাইতে তোমার অনেক মনের জোর।
আবার আপোষ। ও আমার দু'ধারি ছুরির কৌশল ভয় পায় যেমন আমি ওরটা ভয় পাই। শান্ত আপোষবাদ্য।
–চাকরের চিড়খাওয়া আয়না। কথাটা নিচের ঐ অক্সি ছোঁড়াটাকে বলে এক গিনি চেয়ে দেখো। ব্যাটার শরীরে টাকার দুর্গন্ধ আর তোমাকে মনে করে একটা গাঁইয়া। ওর বাপ জুলুদের কাছে শেকড়বাকড় বেচে কিম্বা কোনো চুরিচামারি করে অথবা অন্য কোনো বদ উপায়ে অনেক টাকা কামিয়েছে। ঈশ্বর, ভেবে দেখলাম কিঞ্চ, তুমি আর আমি মিলে একসাথে কাজ করলে এই দেশের জন্যে নিশ্চয় কিছু করতে পারতাম। হেলেনিয় ভাবে সংস্কৃতবান বানিয়ে ফেলতে পারতাম।
ক্র্যানলির হাত। তার হাত।
–আর তুমি এই শুয়োরের বাচ্চাগুলোর কাছে হাত পেতে কিছু নিচ্ছ ভাবতেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়। একমাত্র আমিই জানি তুমি কেমন মানুষ। অথচ তুমি আমাকে তেমন বিশ্বাস করো না কেনো বুঝিনা? আমার বিরুদ্ধে তোমার এতো অভিযোগটা কিসের বলো তো? কারণটা কি হায়েন্স? ও যদি বেশি চিল্লাফাল্লি করে তবে আমি সিমোরকে ডেকে এনে সবাই মিলে এমন প্যাদানি দেবো যা ক্লাইভ কেম্পথ্রপকেও ওরা দিতে পারেনি।
বিত্তবান কন্ঠস্বরে তরুণ চেঁচামেচি ক্লাইভ কেম্পথ্রপের ঘরগুলো থেকে। সব পান্ডুমুখোরা: বুকের পাঁজর চেপে ধরে তারা হাসে, একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরে, ওহ, আমি শেষ! খবরটা ওকে, মানে মহিলাকে, ধিরেসুস্থে শুনিও, অব্রে! আমি একদম মরে যাবো! টেবিলের চারধারে যখন সে তড়কাতে-তড়কাতে আর ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে দৌড়াচ্ছিলো তখন তার ফিতের মতো ফালাফালা করে ছেঁড়া সার্টের অংশগুলো বাতাসে তড়পাচ্ছিলো, তার পাতলুন পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নামানো, আর তার পেছনপেছন তাড়া করে ফিরছিলো দর্জির কাঁচি হাতে এইডস আর মডেলিন। ভয় পাওয়া বাছুরের মুখ আচার দিয়ে লেপটানো। আমি সবার সামনে নেঙ্গু হতে চাই না! আমার সাথে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ব্যাবহার করোনা!

খোলা জানালার ভেতর থেকে চেঁচামেচি আয়তোক্ষেত্রের সন্ধ্যাকে চমকে দিতে থাকে। কানে খাটো এক মালি, অ্যাপ্রন পরা, মুখে ম্যাথু আরনল্ডের মুখোস, তার ঘাস কাটা যন্ত্র ঠেলছে নীরস লনে আর চোখ কুঁচকে দেখছে সবুজের উপর নৃত্যরত কাটা ছোটছোট ঘাসের টুকরোগুলো।
আমরা আমাদের জন্যে . . . নব পৌত্তলিকতা . . . পৃথিবীর নাভিকুন্ড . . .।
–ও থাকুক এখানে, স্টিফেন বলে। ঐ রাতের ব্যাপারটা ছাড়া ওকে নিয়ে আর কোনো সমস্যা নেই।
–তাহলে ব্যাপারটা কি? অস্থির বাখ মুলিগান জিজ্ঞেস করে। ঝেড়ে কাশো স্টিফেন। আমি তোমার সাথে সব ব্যাপারে খোলামেলা। আমার সাথে তোমার সমস্যাটা কি নিয়ে?
ওরা থামে, দৃষ্টি দূরে, ঘুমন্ত তিমির নাকের মতো পানির উপর পড়ে থাকা ভোঁতা বেই হেইডের অন্তরিপের দিকে। স্টিফেন নিঃশব্দে তার হাত ছাড়িয়ে নেয়।
–আপনি সত্যিসত্যি জানতে চান? সে জিজ্ঞেস করে।
–হ্যাঁ, ব্যাপারটা কি? বাখ মুলিগান উত্তর দেয়। আমার কিছুই মনে পড়ছেনা।
সে স্টিফেনের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে। একটা হাল্কা বাতাস তার ভ্রুর উপর দিয়ে বয়ে যায়, তার এলোমেলো সাদা চুলগুলোকে নাড়া দেয়, চোখগুলোতে এক ধরনের রুপালী চিন্তার রেশ।
স্টিফেন, নিজের কন্ঠস্বরে নিজেই বিষণ্ণ, বলে:
–মনে আছে আমার মা মারা যাবার পর আমি প্রথম যেদিন আপনাদের বাসায় গেছিলাম?
বাখ মুলিগান দ্রুত ভ্রুকুটি করে বলে:
–কি? কোথাই? আমি তো কিছু মনে করতে পারছিনা। আমি শুধু যা ভাবি আর অনুভব করি তাই মনে রাখি। কেনো? ঈশ্বরের দোহাই বলে ফেলো তো দেখি কি হয়েছিলো?
–আপনি চা বানাচ্ছিলেন, স্টিফেন বলে, আমি সিঁড়ির খোলা যায়গা পেরুচ্ছিলাম আরও গরম পানি আনতে। আপনার মা আর কিছু অতিথি সেই সময় বসারঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আপনার মা জিজ্ঞেস করলেন আপনার ঘরে কে।
–আচ্ছা? বাখ মুলিগান বলে। তো আমি কি বললাম? আমার একদম মনে নেই।
–আপনি উত্তরে বললেন, ও, ওটা ঐ ডেডোলাস যার মা জঘন্যভাবে মারা গেছে।
বাখ মুলিগানের গাল চলকে উঠলো আর মনে হলো সে আরও তরুণ আর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
–তাই বলেছিলাম নাকি? সে জিজ্ঞেস করে। আচ্ছা? তাতে হয়েছেটা কি?
সে তার বিব্রতের চাপটা কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে।
–আর মৃত্যুটা আসলে কি, সে প্রশ্ন করে, তোমার মার কিম্বা আমার আপন মার? তুমি শুধু তোমার মার মৃত্যু দেখেছো। আমি মিটর আর রিচমন্ডে অমন অনেককে সারাদিনভর মরতেই শুধু দেখিনা, কেটেছিড়ে কুটিকুটি হতে দেখি ঐ লাশকাটাঘরে। সে একেবারে জঘন্য ব্যাপার। এসবে একদম কিছু যায় আসে না। তুমি তোমার মার মরার বিছানার পাশে হাটুমুড়ে বসতে চাও নি। কেনো? কারণ তোমার ভেতর খৃষ্টীয় আচার আচরণ নিয়ে একধরনের অশালীন ধারণা আছে, ওটা তোমার ভেতর ভুলভাবে ইঞ্জেক্সন দিয়ে ঢোকানো হয়েছে। আমার কাছে সবটাই তামাশা আর জঘন্য ব্যাপারস্যাপার। তার স্নায়ু কাজ করছিলো না। ডাক্তার স্যার পিটার টিজলকে খবর দিয়েছিলো আর তোমার মা শুয়েশুয়ে তার স্মৃতি তর্পণ করছিলো। সব শেষ হবার আগে খোশমেজাজে থাকা আর কি। মরার আগে তার শেষ ইচ্ছেকে পাত্তাই দাওনি আর এখন তুমি আমার সাথে বাহাস করো আমি কেনো ভাড়া করা ঐ লালুয়টদের মতো ফিসফিসিয়ে বিরক্তিকর প্যানপ্যানানি করিনি। অসম্ভব! এখন আমার মনে হচ্ছে আমি ওইকথা আসলেই বলেছিলাম। তবে আমি তোমার মার স্মৃতিকে ব্যাঙ্গ করার জন্যে বলিনি।

সে তার কথাগুলো শেষ করে বেশ জোরের সাথে। স্টিফেন, এই কথাগুলো তার মনে যে ক্ষরণ ধরিয়েছিলো তা আড়াল করে ঠান্ডা গলায় বলে:
–আমি আমার মাকে ব্যাঙ্গ করার কথা নিয়ে ভাবছিনা।
–তাহলে ভাবছোটা কি নিয়ে? বাখ মুলিগান প্রশ্ন করে।
–আমাকে ব্যঙ্গ করার কথা বলছি, স্টিফেন উত্তর দেয়।
বাখ মুলিগান তার গোড়ালির উপর একটা চক্কর দেয়।
–ও, শ্রীমান মহামহাপাধ্যায়! তার বিস্মিত বক্তব্য।
সে দ্রুত হেঁটে ছাদের প্যরাপেটটা ঘুরে পার হয়। স্টিফেন তার নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে শান্ত সমুদ্রপ্রান্তের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্র আর তার দিগন্তরেখা এখন অস্পস্ট হয়ে উঠেছে। চোখের পাতায় দ্রুত পলক, দৃষ্টি অবগুন্ঠিত হচ্ছে, গালদুটোতে জ্বরের আভাস।
দুর্গের ভেতর থেকে উচ্চকন্ঠের ডাক:
–ওখানে আছ নাকি, মুলিগান?
–আমি আসছি, বাখ মুলিগানের উত্তর।
সে স্টিফেনের দিকে ঘুরে বলে:
–সাগরটাকে দেখো। এই সব ঠাট্টা-তামাশা নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যাথা আছে? পাদ্রী চাক লয়লা, কিঞ্চ, চলে এসো। সাসান্যাক তার সকালের নাশতায় মাংসের তলব করেছে।
তার মাথাটা এক মুহুর্তের জন্যে আবার স্থির হয় সিঁড়ির মাথায়, ঠিক ছাদ বরাবর।
–সারাদিন ওই নিয়ে মনমরা হয়ে কাটিও না, সে বলে। অমন অসগলগ্ন কথা আমি বলেই থাকি। মন খারাপ করা বাদ দাও।
মাথা অদৃশ্য হয় কিন্তু তার দূরে সরে যাওয়া কন্ঠস্বরের রেশ সিঁড়ির শেষ প্রান্ত থেকে একঘেয়ে ভেসে আসে।
এখন আর মুখঘুরিয়ে মনমরা হয়ে থাকা নয়
ভালোবাসার তিতকুটে মায়াজালে কেনোরে এতো ভয়
ফারগাসের পিতলা রথ নিদানকালে সহায় হয়।
সিঁড়ির মাথা থেকে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তার চোখে পড়ে সকালের শান্তির আভরনে বৃক্ষছায়া নিঃশব্দে ভাসছে। তটভূমি এবং দূর প্রান্তে জলছবি শুভ্রতায় ভরে গেছে আলোছায়ার চঞ্চল লুকোচুরিতে। সমুদ্রের শুভ্র বুক আবছায়া। বীণার তারে তাল, তারে-তারে তাল। বীণার দুই তারে হাত বোলানো সমান তালে। সফেন সাদা ঢেউ শব্দের সাথে মিশে ঝলমল করছে অলস জলের প্রবাহে।
একটা মেঘ এসে ধীরে সূর্যটাকে ঢেকে ফেলতে শুরু করে, এক ঘণ শ্যামলীমা নেমে আসে উপকুলে। তার পেছনে পড়ে থাকে সবটাই, এক পাত্র তেতো জল। ফারগাসের গান: আমি গেয়েছি একাএকা বাসায়, বীণার কালো তারগুলোকে আঁকড়ে ধরে। মার দরজা খোলা ছিলো: আমার বাজনা শুনতে চেয়েছিলো। হতভম্ভ নিস্তব্ধতায় আর অনুকম্পায় আমি তার বিছানার পাশে গিয়েছিলাম। অসহায় বিছানাতে শুয়ে সে কাঁদছিলো। গানের সেই কথাগুলো শুনে, স্টিফেন: ভালোবাসার তিতকুটে মায়জালে কেনোরে এতো ভয়।
কোথায় এখন?
তার সঙ্গোপন: পালকের পুরোনো কয়টা পাখা, নাচের সঙ্গীদের নাম লেখা সুতোবাঁধা কার্ড। সুগন্ধিগুড়ো মাখা মুখোশ, ড্রয়ারে তালা দেয়া চকচকে হলদে-বাদামি রঙ্গের জপমালা। অল্প বয়সে তার বাড়ির রোদমাখা জানালার সাথে ঝোলানো থাকতো একটা পাখির খাঁচা। মূক অভিনয়ে রয়েসের গান ভয়ঙ্কর টার্কোর এই কথাগুলো শুনে সবার সাথে হেসে গড়িয়ে পড়তো:
আমি তো সেই সে ছেলে
যে তখনি থাকে হেসেখেলে
যখন যায় সে চোখের আড়ালে।
সে এক অলৌকিক আনন্দোচ্ছাস, একদম নিখাদ: সুগন্ধিগুড়োমাখা মুখোশ।
এখন আর মুখঘুরিয়ে মনমরা হয়ে থাকা নয় …
তার খেলনাগুলোর সাথে প্রতিবেশ-স্মরণে সাজিয়ে রাখা থাকে ওই সব। এক তীব্র স্মৃতিচারণ তার বিষণ্ণ চিন্তাকে আঁকড়ে ধরে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাবার আগে রান্নাঘরের ট্যাপ থেকে তার গ্লাসে পানি ভরা। হেমন্তের এক গাড় সন্ধ্যায় লোহার চুলোতে বাদামি চিনি মাখা শাঁসালো আপেল তার জন্যে সেঁকতে দেয়া। তার সুশ্রী নখে বাচ্চাদের জামা থেকে উকুন বেছে মারার রক্তের লাল দাগ।

এক স্বপ্নের ভেতর, নিঃশব্দে, সে তার কাছে এসেছিলো, ঢিলেঢালা বাদামি কাফনে মোড়া গলিত শরীর নিয়ে, মোম আর গোলাপকাঠের এক সুঘ্রাণ নিয়ে, তার নিশ্বাস, শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নিশ্বাস, নিস্তেজ রহস্যময় শব্দ, আর ভস্মের ভেজা এক ম্লান সোঁদা গন্ধ নিয়ে।
মার চকচকে চোখজোড়া, মৃত্যুকে অতিক্রম করা দৃষ্টি, আমার মনের ভেতরটা কাঁপিয়ে দেয়, দলে-মুচড়ে দেয়। শুধু আমাকেই। তার দুখজাগানিয়া প্রেতসুদ্ধি মোমবাতির আলো। যন্ত্রণাক্লিষ্ট অবয়বে ভৌতিক আলোছায়া। তার কর্কশ উচ্চগ্রাম শ্বাসপ্রশ্বাস আতঙ্কময় শব্দায়মান। চারদিকে সবাই হাটুমুড়ে প্রার্থনা রত। তার চোখগুলো আমার উপর স্থির নিবদ্ধ আমাকে নিরুদ্দিষ্ট করার জন্য। Liliata rutilantium te confessorum turma circumdet: iubilantium te virginum chorus excipiat—দীপ্যমান পাপস্বীকারকারিদের কমল-পরশ তোমাকে আবৃত করুক; মাতা মেরির মতো সতীকুমারীরা তাদের উদ্বেলিত ধর্মসংগীতে তোমাকে স্বাগত জানাক।
পিশাচ! লাশ চর্বক!
না মা। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, বাঁচতে দাও।
–কিঞ্চ, অই!
দুর্গের ভেতত থেকে বাখ মুলিগানের সুরেলা কন্ঠ শোনা যায়। সে উপরে সিঁড়িরধাপে এসে আবার একবার ডাক দেয়। স্টিফেন, তখনও তার আত্মার ক্ষরণে অসলগ্ন, এক ধাবমান রৌদ্রকরোজ্জল বাতাসের ভেতরে পেছনে শুনতে পায় মুলিগানের সুহৃদ শব্দমালা।
–ডেডোলাস, চলে এসো, লক্ষ্মী ছেলের মতো। নাশতা তৈরি। হাইয়েন্স মাফ চাইছে কাল রাতে আমাদের ঘুম নষ্ট করার জন্যে। সব একদম ঠিকঠাক।
–আসছি আমি, স্টিফেন তার দিকে ফিরে বলে।
–চলে এসো, যীশুর নামে, বাখ মুলিগান বলে। আমার নামে, আমাদের সবার নামে।
তার মাথা অদৃশ্য হয়, আবার দৃশ্যমান হওয়ার জন্য।
–আমি ওকে তোমার ওই আইরিশ শিল্পকলার প্রতীকের কথা বলেছি। ব্যাপারটা ওর কাছে দারুণ লেগেছে। ওকে খুশি হয়ে কিছু মালকড়ি দিয়ে দিও, ঠিক আছে? মানে, একটা গিনি।
–আজ সকালে বেতন পাবো, স্টিফেন বলে।
–স্কুলে ঝিমুতেঝিমুতে কাজ করার জন্যে? বাখ মুলিগান বলে। কত? চার গিনি? আমাদের এক গিনি ধার দিও।
–লাগলে দেবো, স্টিফেন বলে।
–চারটে ঝকঝকে সোনার গিনি, আনন্দে ঝলমল বাখ মুলিগান চেঁচিয়ে ওঠে। আমরা তাহলে মদ গিলে এমন টং হবো যে ওই মান্ধাত্তা আমলের ধর্মগুরুগুলো অবাক হয়ে শিউরেবে। চার চারটে নগদ সর্বশক্তিমান সোনার টাকা বলে কথা।
সে তার হাত দুদিকে ছড়িয়ে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ধপাধপ নিচে নামে, মুখে লন্ডনি কোকনি উচ্চারণে বেসুরো গান:
ও, আমরা কি ফুর্তি করবো নারে ভাই
খাবো না হুইস্কি, বিয়ার, উয়াইন, কোনটাই
আজ রাজাভিষেক
তাই নারে ভাই?
ফুর্তি করতে নাই মানা তাই
আজ তো রাজাভিষেক, ঠিক কিনা ভাই?
সমুদ্রের উপর গরম বাতাস খেলে বেড়ায়। ছাদের প্যরাপেটের উপর অবহেলায় পড়ে থাকা দাড়ি কাটার নিকেল করা পাত্রটা চকচক করে। আমি ওটা তুলে নিচে নেবো কি করণে? নাকি সারাদিন ওখানেই পড়ে থাকবে, ভুলে যাওয়া বন্ধুত্তের মতো?

সে হেঁটে পাত্রটার কাছে যায়, কিছুক্ষণ হাতে ধরে রাখে, পাত্রের শীতলতা উপভোগ করে, সাবানের ফেনার চটচটে গাঁজলার, যার ভেতর ব্রাশটা চুবানো হয়েছিলো, গন্ধ শোকে। আমি নৌকোটা তাই ক্লংগোজে বেয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। এখন আমি অন্যকেউ, অথচ সেই একই। এক ভৃত্যও বটে। ভৃত্যকে সেবা করা ভৃত্য।
দুর্গে গম্বুজাকৃতি অনালোকিত সময় কাটাবার ঘরে বাখ মুলিগানের গাউনাবৃত অবয়ব আগুন পোহাবার চুলার কাছে চঞ্চল হাটাহাটিতে রত। গাউনের হলুদাভ রং আলোর সাথে লুকোচুরি খেলে। উঁচু লম্বা থামের ফাঁক থেকে দিনের মৃদু আলোর দুটি তীর এসে লম্বা ভাবে পড়ে থাকে বিষণ্ণ মেঝে জুড়ে: আর ঠিক যেখানে আলোর রেশদুটো মিলেছে সেখানে তেলপোড়া কয়লার কালো ধোঁয়া এবং বাস্প ঘুরেঘুরে ভেসে বেড়ায়।
–দম আটকে মরবো সবাই, বাখ মুলিগান বলে। হাইয়েন্স, ঐ দরজাটা খুলে দাউ জলদি, বুঝতে পেরেছো?
স্টিফেন দাড়ি কামাবার পাত্রটা লকারের উপর রেখে দেয়। একটা বসে থাকা দীর্ঘ শরীর হ্যামক থেকে নামে, দরজার কাছে যেয়ে ভেতরের কপাটদুটো খুলে দেয়।
–তোমার কাছে চাবি আছে? একটা কন্ঠস্বর শোনা যায়।
–ডেডোলাসের কাছে আছে, বাখ মুলিগান বলে। জেনি ম্যাক, আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আগুনের দিকথেকে চোখ না সরিয়ে সে হুঙ্কার ছাড়ে:
–কিঞ্চ!
–ওটা ওখানে লকারে, স্টিফেন বলে, সামনে এগিয়ে।
চাবি দুবার অস্থির ঘষটায়, তারপর যখন ভারি কপাটজোড়া দুদিকে অবারিত খুলে যায়, স্বস্তির আলো এবং উজ্জ্বল বাতাস ভেতরে ঢোকে। হাইয়েন্স দরজার মুখে দাঁড়িয়ে, বাইরে দৃষ্টি। স্টিফেন, ব্যাগটার উপর দিকটা ধরে টেনে আনে টেবিলের কাছে তারপর বসে অপেক্ষা করে। বাখ মুলিগান ভাজিটা তার পাশে রাখা পাত্রে চালান করে। তারপর ঐ পাত্রটা আর বড়সড় একটা চায়ের পট টেবিলে নিয়ে আসে, শব্দ করে রাখে, এবং বেশ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে।
–আমি গলে যাচ্ছি, সে বলে, যেমন মোমবাতি মন্তব্য করেছিলো যখন . . .। কিন্তু চুপ। ঐ বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা নয়। কিঞ্চ, কি ধ্যান করছো। রুটি, মাখন, মধু। হাইয়েন্স, তুমিও এসো। গেলার জন্যে সব তৈরি। হে ঈশ্বর, আমাদের তুমি রক্ষা করো, আর এ সবই তো তোমারি দান। চিনি গেলো কোথাই? হাই কপাল, দুধ নেই দেখছি।
স্টিফেন রুটি আর মধুর পাত্র এবং মাখন রাখার মাটির ঠান্ডা পাত্রটা লকার থেকে বের করে আনে। বাখ মুলিগান হঠাৎ ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে।
–এটা কেমন ধরনের কাজ? সে বলে। আমি ওকে আটটার পরে আসতে বলেছিলাম।
–আমরা রং চা'ই খেতে পারি, স্টিফেন বলে। লকারে লেবুও আছে।
–তোমার আর তোমার ঐসব প্যারিসিও আদিখ্যেতা আমি একদম সহ্য করতে পারিনা, মুলিগান বলে। আমি এখনি স্যান্ডিকোভের দুধ চাই।
হাইয়েন্স দরজার কাছ থেকে সরে এসে শান্তভাবে বলে:
–ঐ মহিলা দুধ নিয়ে আসছে।
–ঈশ্বরের করুণা তোমার উপর বর্ষিত হোক, বাখ মুলিগান উচ্চকন্ঠে বলে, সেই সাথে তার চেয়ারে লাফিয়ে উঠে। বসো। চা ঢালো। ওখানে ব্যাগের ভেতর চিনি আছে। নাও, এই জঘন্য ডিমগুলো পাতে তুলে দেয়া আমার কাছে বড্ড ঝামেলার লাগে। সে প্লেটে রাখা ভাজা ডিমের নিচে চামুচ ঢুকিয়ে তিনজনের পাতে থপাথপ করে তুলে দিয়ে বলে:
–In nomine Patris et Filli et Spiritus Sancti—পবিত্র পিতার নামে, পবিত্র পুত্রের নামে এবং পবিত্র আত্মার নামে।
হাইয়েন্স বসে চা ঢালার জন্য।
–আমি প্রত্যেককে দুই ঢোক করে দিচ্ছি। কিন্তু একটা কথা মুলিগান, তুমি চা বড্ড কড়া করে ফেলো, তাই না?
বাখ মুলিগান, পাউরুটির মোটা টুকরো কাটতে-কাটতে মেয়েলি ন্যাকামো সুরে বলে:
–আমি যখন চা করি তখন চাই করি, ঠিক যেমনটা বুড়ি মাদার গ্রগান বলতো। আর যখন পেশাব করি তখন পেশাবই করি।
–জোভের কিরে, এটা নির্ভেজাল চাই হয়েছে, হাইয়েন্স বলে।
বাখ মুলিগান পুরু করে রুটি কাটার সাথেসাথে তার মেয়েলি ন্যাকামো সুর চালিয়ে যেতে থাকে:
–আমি এমনই করি, মিসেস কাহিল, সে বলে। তাই নাকি, উত্তর মিসেস কাহিলের, ঈশ্বরের দোহাই আর যাই করো দুটো জিনিস যেনো একসাথে একই পাত্রে করোনা।

সে একেএকে পুরু পাউরুটির টুকরো ছুরির আগাতে ফুঁড়ে তার মেসসদস্যদের দিকে এগিয়ে দিতে থাকে।
–তোমাকে ধন্যবাদ, সে বলে আন্তরিক ভাবে, তোমার বইয়ের জন্যে, হাইয়েন্স। পাঁচ লাইনের লেখার সাথে লোকগাথা আর ডান্ড্রামের মৎসদেবতাদের নিয়ে দশ পাতার নোট। তিন ভুতুড়ে বোনেরা মিলে ছাপিয়েছে সেই বিরাট ঝড়ের বছরে।
সে স্টিফেনের দিকে ঘুরে ভুরু নাচিয়ে স্পষ্টত বিমূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে:
–আচ্ছা বলতে পারো ভায়া, এই যে মাদার গ্রগানের চা আর পানির পাত্র নিয়ে যে সংলাপটা বললাম ওটা কি ম্যাবিনজিওনের না উপনিষদের?
–আমার দুটোতেই সন্দেহ আছে, স্টিফেনের গম্ভীর উত্তর।
–এখনও সন্দেহ? বাখ মুলিগান সেই একই লয়ে বলে। তোমার যুক্তিটা শুনতে পারি দয়া করে?
–আমি মনে করি, স্টিফেন খেতে-খেতে উত্তর দেয়, ম্যাবিনজিওনের আগাগোড়া কোথাও এসবের কোনই অস্তিত্ব নেই। মাদার গ্রগান ছিল, সবাই মনে করে, ম্যারি অ্যানের রাজপরিবারের রক্ত সম্পর্কের আত্মিয়া।
বাখ মুলিগানের মুখ আনন্দে হাস্যোজ্জল হয়ে উঠে।
–চমৎকার, বেশ একটা ভঙ্গি নিয়ে মিষ্টি স্বরে বলে, তার সাদা দাঁত এবং চোখের মিটমিটে চাহনিতে সুখাবহ ঝিলিক। তোমার কি মনে হয় কথাটা ঠিক? ব্যাপারটা বেশ লাগছে কিন্তু।
তারপর তার সব চালচলন মুহুর্তে বদল করে জোরেশোরে রুটি কাটতে-কাটতে সে তার হেড়ে ঘ্যাসঘ্যাসে গলায় গেয়ে উঠে:
–কারণ সবার চেনা ম্যারি অ্যান
কাউকে দেয়না এক পইসার দাম
তাই, যেখানেসেখানে পেটিকোট তুলে . . .
সে মুখের ভেতর ডিমভাজি পুরে চিবাতেচিবাতে গুনগুন করতে থাকে।

(চলবে)