ঢাকায় আর্মেনীয়রা

অদিতি ফাল্গুনী
Published : 17 Sept 2011, 11:19 AM
Updated : 17 Sept 2011, 11:19 AM

……..
মিখাইল হোফসেফ মার্টিরোসেন। লেখকের তোলা ছবি।
……
খুশবন্ত সিংয়ের দিল্লী উপন্যাসে লেখক দিল্লীকে তার সেই রক্ষিতার সাথে তুলনা করেছেন যাকে লেখক ঘৃণা করেন অথচ যার কাছে না যেয়ে পারেন না। না, বাবা…আমি খুশবন্ত সিং নই। আমার জীবনের দীর্ঘতম বছরগুলো যে শহরে আমি কাটিয়েছি… সেই শহরকে বরং পুরনো দিনের বাংলা সিনেমা দীপ জ্বেলে যাই-এর একটি জনপ্রিয় গানের কলির ভাষায় বলতে চাই, 'এমন বন্ধু আর কে আছে? আমার মনের মতো মিস্টার/ কখনো বা ডার্লিং, কভু তুমি জননী/ কখনো বা স্নেহময়ী সিস্টার!' সুবা বাংলার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর বা দেবী ঢাকেশ্বরী যে নগরীর রক্ষয়িত্রী …শাঁখারি, কুট্টি, শিয়া, সুন্নী, বাঙালী, তেলেগু, কাশ্মিরী, চৈনিক, ইসমাইলিয়া, মগ (বর্মী), ইস্পাহানী মায় আর্মেনীয় জনস্রোতের বিপুল মিশ্রণে তিলে তিলে গড়ে ওঠা আমাদের এই এলিয়ট কথিত 'আনরিয়েল সিটি' বা 'অপ্রাকৃত নগরী।' লালবাগ মসজিদ, হোসনী দালান, বড় ও ছোট কাটরা, রূপলাল হাউস, ঢাকেশ্বরী মন্দির, বলধা গার্ডেন, পোগজ স্কুল, বর্ধমান হাউস, চামেলী হাউস, নর্থব্রুক হল… ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!


চার্চের সম্মুখভাগ। লেখকের তোলা ছবি।

আজ এই মধ্য বৈশাখের রাধাচূড়া-বাগানবিলাস-জারুল ও রক্তবর্ণ কৃষ্ণচূড়ার পুষ্পহারে শোভিতা নগরী যখন চারশ' বছর পার হয়েও পা দিলো মনে হয় আরো একটি বছরে, পাঠক… চলুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর নাজিমুদ্দিন রোড পার হয়ে আর একটু এগোলেই আমরা পেয়ে যাব আর্মেনীটোলার আর্মেনীয় গীর্জা! পুরনো ঢাকার ছোট ছোট গলি আর নর্দমার পাশেই আর্মেনীটোলা ও বাবুবাজারের শতেক দেশী আতর বা বিদেশী সুগন্ধীর খুচরা দোকানগুলোর গন্ধে আচ্ছন্ন বাতাস নাকে শুঁকতে শুঁকতে আপনি দেখতে পাবেন বয়সিনীর মতো সামনের দেয়ালে কিছুটা জীর্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর্মেনীয় গীর্জা। গীর্জা স্থাপনার সন ১৭৮১। গীর্জার প্রবেশ দরোজায় একটি বড় তালা। বাইরে থেকে লোহার শিকের ভেতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়ালে কলিং বেল অনেকক্ষণ ধরে টিপলে ঢাকার শেষ আর্মেনীয় মার্টিন মার্টিরোসেনের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ক শঙ্কর বা গীর্জার প্রহরী হিনু দরোজা খুলে দেবে। ভেতরে ঢুকতেই সার সার কবর। কবরের একপাশে উপাসনাগৃহ। কবরগুলো বহু অতীতের সাক্ষী। গত আড়াইশো বছরে মৃত প্রায় শ দেড়েক আর্মেনীয় নর-নারীর কবর এখানে। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশ কবরের এপিটাফেই ফাটল ধরেছে। ইংরেজি ও আর্মেনীয়… দু'টো ভাষাতেই এপিটাফ লেখা রয়েছে। অনভ্যস্ত চোখে আর্মেনীয় হরফ অনেকটা রুশ হরফের মতোই দেখতে মনে হয়। ইংরেজিতে খোদাই এপিটাফগুলো থেকে নানা তথ্য জানা যায়। ধরুন, সোফিয়া আলেক্সান্দার নাম্নী কোনো আর্মেনীয় নারী, যার জন্ম হয়েছিলো বর্তমান ইরানের বসরায় ১৮৬৪ সালে, আমাদের ঢাকায় তিনি দেহ রেখেছেন ১৯৪৩ সালে। তাঁর সমাধিগাত্রের শিলালিপি সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে:

In loving memory of Sophia Alexander,
Born in Bushire 1864,
Died in Dacca on 7th December 1943.
After a prolonged illness partially borne.
æ Rock of Ages cleft for me/
Left me hide myself in thee."

ইরানের বসরা বা ইরানের জুলফা, কার্মেন বা ইস্পাহান হতে প্রচুর আর্মেনীয় ভাগ্যের খোঁজে এসেছিলেন তদানীন্তন অবিভক্ত বঙ্গের কোলকাতা মায় ঢাকা শহর অবধি। আবার, ঢাকার আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের রিপসিমা নাম্নী এক মহিলার পাণিগ্রহণকারী কিন্তু জন্মসূত্রে আইরিশ এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জনৈক উইলিয়াম হার্নির কবরও এখানে আছে, যিনি এই ঢাকায় ১৯০১ সালে মারা গেছেন।

In loving memory of Willian Harney (Mutiny Veteran),
Born 23rd March 1830.
At Belfast, Ireland.
Died at Dacca on 16th July 1901- aged 71 years,
(It was hard to part with you dear grand pa/
No eyes can see me weep/
But, ever in my aching heart/
Your beautiful memory keep/).
: Inserted by his grand daughter Zenobia Stephen.

উইলিয়াম হার্নির সমাধির পাশেই আছে তাঁর স্ত্রী রিপসিমার সমাধি। শুধু ইংরেজিতে লেখা এমন ৯৬টি এপিটাফ আমি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছি নিতান্তই ইতিহাস সংরক্ষণের এক ধরনের ব্যক্তিগত দায় থেকে। আর্মেনীয় হরফে লেখা কবরগুলোর এপিটাফ অবশ্য সঙ্গত কারণেই আমার পক্ষে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয় নি। ২০০৭-এর এক ঠা ঠা দুপুরে আর্মেনীয় কবরের এপিটাফ উদ্ধারে ব্যস্ত থাকার সময়েই পরিচয় হয় জার্মান তরুণী কার্মেন ব্র্যান্ডটের সাথে। কার্মেন জার্মানীর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশীয় স্টাডিজের প্রভাষিকা। বাংলা, সংস্কৃত, জার্মান ও ইংরেজি সহ পাঁচটি ভাষা জানে। বাংলাদেশের বেদেদের উপর সে তার পিএইচ ডি-র কাজ করছে। কার্মেন তার পিএইচ ডি থিসিসে যে সম্পূর্ণ নতুন এক চ্যালেঞ্জ উত্থাপন করতে যাচ্ছে তা হলো: 'বেদে' শব্দটি নদীমাতৃক বাংলার জলযাযাবর সম্প্রদায়কে বর্ণনা করার জন্য তথাকথিত মধ্যবিত্ত লেখক ও গবেষক সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত বা স্বকপোলকল্পিত শব্দ। 'বেদে'রা নাকি নিজেদের কখনোই 'বেদে' হিসেবে পরিচয় দেয় না। তারা নিজেদের 'সামনা,' 'বৈদ্য' কি 'ওঝা' হিসেবে পরিচয় দেয়।

বেদে সম্প্রদায়ের উপর কাজ ছাড়াও কোলকাতা ও ঢাকায় একদা বসবাসরত আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের উপরও একটি গবেষণার কাজ করছে কার্মেন। কিন্তু, ঢাকার শেষ আর্মেনীয় মিখাইল হোফসেফ মার্টিরোসেন যখন গর্ব ভরে কার্মেনকে জানায় যে ভারতীয় বা বাঙালীদের সাথে মিশ্রণের পরিবর্তে জাতিগত বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে গিয়ে ভারত উপমহাদেশে বসবাসকারী আর্মেনীয় জনগোষ্ঠি বিলুপ্তপ্রায় হয়েছে, বাঙালী যুবক দীপু ভাইকে বিয়ে করা কার্মেন তখন একটু হকচকিয়েই যায়। কার্মেনের জীবনসঙ্গী দীপু ভাইকে (ওনার ভাল নাম বা দাপ্তরিক নামটি এই মূহূর্তে মনে না পড়ায় খারাপ লাগছে) আমি চিনতাম কার্মেনকে চিনবারও বহু আগে থেকে। ২০০০ সালে আমি যখন পেশাগত ভাবেই একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রতিবেদকের কাজ করছি, তখন দীপু ভাই একটি সেমিনারে আমাকে অনুরোধ করায় পরদিন ঢাকার কাকরাইল কি ফকিরেরপুল এলাকায় শিশু ও কিশোরী যৌনকর্মীদের একটি শেল্টার পরিদর্শন করেছিলাম। দীপু ভাইদের উন্নয়ন সংস্থা 'ইনসিডিন বাংলাদেশ' রাতের ঢাকার ভ্রাম্যমাণ শিশু ও কিশোরী যৌনকর্মীদের জন্য এই শেল্টারটি পরিচালনা করে। ছিন্নমূল মেয়েরা সারা রাতের অবসাদের পর এই শেল্টারে এসে দিনের বেলা ঘুমায় ও স্নান করে। সেই ২০০০ সালের পর দীপু ভাইকে আর দেখি নি। কার্মেনের জীবনসঙ্গী হিসেবে দেখার পর দুই পাগলের এই সমন্বয় বেশ মজার লাগে আমার। বছরে এক মাস দীপু ভাই জার্মানী যায় ও এক মাস কার্মেন বাংলাদেশে আসে। বাকি সময়টা দু'জনেই দু'জনের পেশাগত ভুবনে ব্যস্ত থাকে। এহেন কার্মেনকে পরবর্তী সময়ে ই-মেইলে ছিয়ানব্বইটি আর্মেনীয় কবরের এপিটাফ কম্পোজ করে অ্যাটাচ করে পাঠালে কার্মেন আমাকে উত্তরে সাবধান করে দেয় যে নিজের মেহনতের বস্তু বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে গিয়ে এমন বোকামি আমি যেন আর না করি। কার্মেন আরো জানায় যে উন্নত বিশ্বের বহু গবেষক এসে তৃতীয় বিশ্বের লেখক বা গবেষকদের সাথে 'সখ্য' পাতানোর পর তৃতীয় বিশ্বের হাবাগোবা লেখক বা গবেষকরা তাদের রক্তজল করা বহু কাজ সরল বিশ্বাসে ঝানু পশ্চিমাদের কাছে পাঠালে, পশ্চিমারা প্রায়ই তা নিজের কাজ হিসেবে উদরস্থ করে ফ্যালে। আমি আর কী করবো… কার্মেনের উদারতা ও পশ্চিমা হিসেবে আত্মসমালোচনা করার এই অকপটতায় মাথা নোয়াই!


আভেটিক থমাসের সমাধি। লেখকের তোলা ছবি।

ওহো, বন্ধুর মাহাত্ম্য বর্ণনায় বড় বেশি সময় নিলাম। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ঢাকার আর্মেনীয়দের এই সমাধিক্ষেত্রের পাশেই উপাসনাগৃহ। অল্পস্বল্প বাগান রয়েছে এই ক্যাম্পাসে যেখানে মধ্য বৈশাখে ফুটছে বিস্তর বাগানবিলাস। এই সমাধিক্ষেত্রেই রয়েছে জনৈক ক্যাটচিক আভেটিক থমাসের সমাধির উপর তার স্ত্রী কর্তৃক স্থাপিত একটি মনোহর মূর্তি। উপাসনাগৃহে বহুদিন হয় আর কোনো প্রার্থনা হয় না। যেহেতু ঢাকায় কোনো আর্মেনীয়ই বর্তমানে আর অবশিষ্ট নেই এক মিখাইল মার্টিরোসেন ছাড়া। ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগকারী আর্মেনীয় দম্পতি হোফসেফ মার্টিরোসেন ও এলিনা মার্টিরোসেনের নয় সন্তানের ভেতর একা মিখাইলই আজ ঢাকার শেষ আর্মেনীয় হিসেবে রয়ে গেছেন আমাদের এ শহরে। মুনতাসীর মামুন তাঁর ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী গ্রন্থে জানাচ্ছেন:

আর্মেনীটোলায় থিতু হয়ে বসার পর আর্মেনীরা এখানে নির্মাণ করেছিলেন তাঁদের গীর্জা।… গীর্জা নির্মাণের জন্য গোরস্থানের আশেপাশে যে বিস্তৃত জমি তা দান করেছিলেন আগা মিনাস ক্যাটচিক। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, জানিয়েছেন ফার্মিঙ্গার, গীর্জাটি নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন চারজন–মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটা সেতুর সিভর্গ, আগা এমনিয়াস এবং মার্কার পোগজ। গীর্জাটি লম্বায় সাড়ে সাতশো ফুট, দরজা চারটি, জানালা সাতাশটি। এর পাশেই ছিল একটি ঘড়িঘর। এটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন জোহানস কারু পিয়েত সার্কিস। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভেঙে গিয়েছিলো ঘড়িঘরটি।… ১৮৪০ সালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর চাকুরে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ডেভিডসন এসেছিলেন ঢাকায়। আর্মেনীদের ক্রীসমাস পালন উৎসবে তিনি হঠাৎ গিয়েছিলেন আর্মেনী গীর্জায়। দালানের ভেতর মেঝে বিভক্ত তিনভাগে, রেলিং দিয়ে ঘেরা একটি বেদী, মাঝখানের অংশে আছে দু'টি ফোল্ডিং দরজা। তৃতীয় ভাগটি বেষ্টনী দিয়ে আলাদা করা যাতে বসেছিলো মহিলা ও শিশুরা। এর ওপরে আছে আবার একটি গ্যালারী। দেয়াল থেকে চারফুট দূরে অর্ধবৃত্তাকার বেদী, মনে হয় তা কাঠের তৈরি এবং দশফুটের মতো উঁচু। সিঁড়ি আছে ওপরে ওঠার। সিঁড়িতে তিনফুট করে লম্বা চব্বিশটি মোমবাতি আর চকচকে ধাতুর কিছু ক্রশ। রোদালো সকাল, তবুও জ্বলছিলো সব মোমবাতি। ১

এককালের এহেন সরগরম আর্মেনীয় গীর্জায় এখন চব্বিশ ঘণ্টাই তালা। মাঝে মাঝে বিদেশী পর্যটকরা ঢোকার অনুমতি পায়। এই অধম নিবন্ধকারও পেয়েছে অবশ্য। প্রথমবার একাই। দ্বিতীয়বার সঙ্গে ছিল অনুজ কবি পিয়াস মজিদ। ওর সনির্বন্ধ অনুরোধই ছিল আমার প্রতি, 'অদিতি দি, আপনি যখন আবার যাবেন, আমাকে সাথে করে নিয়ে যাবেন।' পিয়াস আবার ইতিহাসের ছাত্র। কাজেই আর্মেনীয় এই ঐতিহাসিক স্থানের যা কিছুই দেখছিল সে, তাতেই তার প্রবল উচ্ছাস। উপাসনাগৃহের অভ্যন্তরে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চিত্রকর চার্লস পোট কর্তৃক কার্পেটে আঁকা যীশুখ্রিষ্টের মুখাবয়ব দেখেও পিয়াসের মুগ্ধতার শেষ নেই।

ঢাকায় আসা আর্মেনীয়দের সম্পর্কে মুনতাসীর মামুনের গ্রন্থ হতে জানা যাচ্ছে:

আর্মেনীয়রা ঢাকায় এসেছিলেন কবে জানা যায়নি। তবে ধরে নিতে পারি, মুঘল আমলে ভাগ্য বদলাতে দেশ-বিদেশ থেকে যখন অনেকে এসেছিলেন ঢাকায়, আর্মেনীরাও এসেছিলেন তখনই। তেজগাঁয় পর্তুগীজ কবর আছে কয়েকজন আর্মেনীয়ানের, যাঁদের মৃত্যুও হয়েছিল ১৭৪১ থেকে ১৭৯৫ সালের মধ্যে। সুতরাং, ধরে নিতে পারি সপ্তদশ শতকেই আর্মেনীরা দু'-একজন করে আসতে থাকেন ঢাকায়। এবং বসবাস শুরু করেন এ অঞ্চলে। তাইফুর জানিয়েছেন, সব আর্মেনী যে আর্মেনীটোলায় বাস করতেন এমন নয়। কেউ কেউ বাস করতেন মৌলবীবাজার ও নলগোলায়। ২

ফওজুল করিম অনূদিত জেমস ওয়াইজের নোটস অন দি রেসেস, কাস্টস অ্যান্ড ট্রেডস অফ ইস্টার্ণ বেঙ্গল বা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ-এর তৃতীয় ভাগ-এ বলা হচ্ছে:

ঢাকার আর্মানি জনবসতির কোনো সংরক্ষিত ইতিহাস নেই। অনির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, ১৬৯৮ সালে জব চার্নক যখন কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন তিনি ঢাকার আর্মানিদের নয়া শহরে বসবাসের আমন্ত্রণ জানান। তবে আর্মানিদের সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায় তা হল ঢাকার তেজগাঁও গীর্জা প্রাঙ্গনে একটি জরাজীর্ণ কবর। কবরগাত্রের লিপি থেকে জানা যায়, এটি হলো আভিটিস নামে এক আর্মানি ব্যবসায়ীর। তাঁর মৃত্যু হয় ১৭১৪ সালে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আর্মানি ও ইউরোপীয়রা দাস ব্যবসায় জড়িত ছিল।

…১৮৭২ সালে সারা বাংলায় আর্মানি ছিল ৮৭৫ জন। এর মধ্যে ৭১০ জন বাস কলকাতা এবং তার আশেপাশে; আর ১১৩ জন ঢাকায়। ১৮৭০ সালে মি: আই জি এন পোগজের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় আর্মানিদের সংখ্যা ছিল ১০৭ জন, তার মধ্যে ৩৬ জন পুরুষ, ২৩ জন স্ত্রীলোক, আর শিশুর সংখ্যা ৪৮ জন। পেশা ও জীবিকা অনুসারে পুরুষদের অবস্থা নিম্নরূপ: যাজক ১ জন, ভূস্বামী ৫ জন, ব্যারিষ্টার ১ জন, দোকানদার ৫ জন, দোকানের কর্মচারী ৭ জন, আর সরকারী চাকুরে ৪ জন। ৩

জেমস ওয়াইজের এই গ্রন্থ হতেই আমরা জানতে পারছি ভারত উপমহাদেশে আর্মেনীয়রা তাদের প্রথম বসতি গড়ে তুলেছিলেন গোয়ায়। সময়টা ষোড়শ শতাব্দী। ভারত উপমহাদেশে মূলতঃ সেই আর্মেনীয়রাই এসেছিলেন যারা পারস্যে ইরানী ও আফগান শাসকদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। জেমস ওয়াইজের ভাষ্যে:

শাহ আব্বাস ১৬০৫ সালে আর্মেনিয়ার আক্রমণ পরিচালনা করেন। আর্মেনিয়ার জুলফা নগরীর ১২ হাজার অধিবাসীকে নিয়ে এসে তিনি ইরানের ইসপাহান নগরীর উপকণ্ঠে পুনর্বাসিত করেন। সেখানে জিন্দারুদ নদীর তীরে তাদের জমি বরাদ্দ করা হয়। কালক্রমে সেখানে একটি শহর গড়ে ওঠে। শহরের নাম নয়া জুলফা। পুনর্বাসিত আর্মানিদের সম্পর্কে শাহ আব্বাসের নীতি ছিল উদার। তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন আর্মানিরা বিনাসুদে টাকা ধার পেয়েছে, বিনা বাধায় নিজেদের ধর্মকর্ম পালন করতে পেরেছে। এমন কি তাদের তিনি নিজ সম্প্রদায়ের নেতা নির্বাচন করতে দিয়েছেন। এই নেতাকে বলা হতো কালান তার। আর্মানিদের শহরে কোনো মুসলমানকে বাস করতে দেওয়া হতো না। কোনো আর্মানিকে হত্যা করলে হত্যাকারীর কঠোর সাজা হতো। এর ফলে পারস্যবাসীরা আর্মানিদের ভয় করত ও শ্রদ্ধার চোখে দেখত। শাহ হোসেনের রাজত্বকালে আর্মেনিরা এ সব সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত হন। তখন এক জন আর্মানিকে হত্যা করলে হত্যাকারী যদি এক বস্তা শস্যদানা দিত, তাহলে সে শাস্তি থেকে রেহাই পেত। ১৭২২ সালের দিকে শাহ মাহমুদ ও আফগানরা এই সমৃদ্ধ জনবসতির প্রচণ্ড ক্ষতিসাধন করে। অবশ্য আর্মানিরাও প্রতিরোধ করে। আফগান হামলার পূর্ব পর্যন্ত পারস্যে আর্মানিদের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ হাজার। ১৭৪২ সালে নাদির শাহের চরম নির্যাতনের ফলে আর্মানিরা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারত ও অন্যান্য স্থানে আশ্রয় নেয়। এর ফলে ১৮২৯ সালে নয়া জুলফায় থেকে যায় প্রায় নিঃসম্বল ৫০০ আর্মানি; অথচ পূর্বে সেখানে বাস করত প্রায় আড়াই হাজার পরিবার। সমগ্র পারস্যে আর্মানিদের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে মাত্র ১২ হাজার ৩৮৩ জনে দাঁড়ায়। ১৮৭৭ সালে আর্মেনিয়ার জুলফায় জনসংখ্যা হ্রাস পায় মাত্র ২ হাজারে। খ্রীষ্টান চার্চ মিশনারিদের দাতব্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করত এদের সন্তান সন্ততিরা। দারিদ্রপীড়িত পারস্য থেকে আর্মানি যুব সম্প্রদায় ভাগ্যাণ্বেষণে যাতে ভারতে পাড়ি জমাতে পারে সেই জন্যেই ছিল এই শিক্ষার ব্যবস্থা।৪

আর্মেনীয় পুরাণ অনুসারে মহাপ্লাবনের শেষে হযরত নূহ আলায়হেত সাল্লামের বজরা আরারাত পাহাড়ের চূড়ায় এসে ঠেকে, চারপাশে প্রবল জলরাশির ভেতর নূহ নবী সতর্ক চোখে তাকাতে তাকাতে সহসাই দেখেন দূরে শুকনো মাটি। তিনি গর্জন করেন, 'ইয়েরেভান! ঐ দেখা যায়!' সেই হতে ইয়েরেভান নগরী আর্মেনিয়ার রাজধানী। ইরান ও তুরস্কের সীমান্তের দেশ আর্মেনিয়া কখনো তুর্কি সেনাবাহিনী, কখনো ইরানী সৈন্য আবার কখনো রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরাভূত হয়েছে। তারও আগে এদেশে গ্রিক-রোমক-বাইজান্টিয়াম নানা দেশের সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়েছে বারবার। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রদেশ আর্মেনিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে, এই আর্মেনিয়া মূল আর্মেনীয় ভূখণ্ডের মাত্র চারভাগের একভাগ। বাকি ভূখণ্ড ইরান ও তুরস্ক কর্তৃক বিজিত। ভাগ্যের হাতে বিভিন্ন সময় পর্যুদস্ত আর্মেনীয় জনগণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইহুদিদের মতো উদ্বাস্তু জীবন পার করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।

'ঢাকার আর্মেনীয়রা লবণ ও পাটের ব্যবসা করতেন। আমি নিজেও খুলনায় বহু বছর পাটের ব্যবসা করেছি,' ঢাকার শেষ আর্মেনীয় ও আর্মেনীটোলার গীর্জা ও সমাধিক্ষেত্রের তত্ত্বাবধায়ক মিখাইল হোফসেফ মার্টিরোসেন বলেন।

মুনতাসির মামুনের গ্রন্থে বলা হচ্ছে:

'উনিশ শতকের ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে যে ক'টি আর্মেনী পরিবারের নাম পাওয়া যায় সেগুলি হলো–পোগস, আরাতুন, পানিয়াটি, কোজা মাইকেল, মানুক, হানি এবং সার্কিস। এঁদের বিত্তের ভিত্তি ছিল জমিদারি এবং ব্যবসা। বিদেশী হয়েও জমিদারি কেনার আরেকটি কারণ থাকতে পারে–আভিজাত্য অর্জন এবং সমাজের শীর্ষে থাকা। ১৭৮১ সালে কোম্পানীর এক চিঠিতে জানা যায় পানিয়াটি আলেকজান্ডার চাটগাঁ ও ভুলুয়াতে (নোয়াখালি) লবণ বিক্রি করে পেয়েছিলেন ৬৪৫০ টাকা। লবণের ঠিকাদারি করে বড়লোক হয়েছিলেন পানিয়াটি।… কোজা মাইকেল ১৭৮৬ সালে কিনেছিলেন দক্ষিণ শাহবাজপুরের জমিদারি (ভোলা)। আরাতুনের জমিদারি ছিল পরগণা হুসেন শাহীতে। লুকাস ছিলেন দৌলত খাঁর জমিদার। ১৮৬৮ সালের ঢাকার জমিদারদের এক তালিকায় দেখা যায়, ছ'জন ইউরোপীয় জমিদারের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন আর্মেনী। এঁরা হলেন–জে.জি.এন. পোগজ, জি.সি. পানিয়াটি, জে. স্টিফান, জে.টি. লুকাস এবং ডব্লিউ হার্নি।

এসব ধনী আর্মেনিয়ানরা ঢাকায় তৈরি করেছিলেন নিজেদের থাকার জন্য প্রাসাদতুল্য সব বাড়ি। ফরাশগঞ্জের বর্তমান রূপলাল হাউস ছিল আরাতুনের। বর্তমান আণবিক শক্তি কমিশন যেখানে সেখানে ছিল তাঁর বাগানবাড়ি। মানুক থাকতেন সদরঘাটে। বর্তমানে 'বাফা' যে বাড়িতে, আদতে সেটি ছিল নিকি পোগজের। পরে, আর্মেনীটোলায় নির্মিত হয়েছিলো 'নিকি সাহেবের কুঠি'। এ বাড়িটি তখন কিনে নিয়েছিলেন নীলকর ওয়াইজ। ঢাকার সিভিল সার্জন ডা: ওয়াইজও কিছুদিন ছিলেন এ বাড়িতে। পরবর্তীকালে এটি ছিল ঢাকার নবাবদের চীফ ম্যানেজারের বাড়ি। তাজমহল সিনেমা যেখানে সেখানে ছিল পানিয়াটির অট্টালিকা। কাচাতুরের বাড়ি ছিল বাবুবাজার পুলের উত্তর-পশ্চিমে।

…উনিশ শতকের মাঝামাঝি অনেক আর্মেনী ঝুঁকে পড়েছিলেন ব্যবসার দিকে। ধরে নিতে পারি, ঢাকায় প্রথম জিনিসপত্র বিক্রি করার জন্য দোকান খুলেছিলেন, জি,এম সিরকোর, ১৮৫৭ সালে। শাঁখারী বাজারে স্থাপিত এ দোকানটির নাম ছিল 'সিরকোর এন্ড সন্স'। সি.জে. মানুক, জে.এ. মিনাস এবং আনানিয়া দোকান খুলেছিলেন পটুয়াটুলি, বাংলাবাজার, দিগবাজারে।

'মেসার্স আনানিয়া এন্ড কোম্পানী' ছিল প্রতিষ্ঠিত মদ ব্যবসায়ী। সি.এম. সিরকোর যেসব মহার্ঘ্য দ্রব্য বিক্রি করতেন তার একটি ছিল চা। ১৮৫৬ সালে সিরকোরই প্রথম ঢাকায় চালু করেছিলেন ঘোড়ার গাড়ি, যা পরিচিত ছিল তখন 'ঠিকা গাড়ি' নামে।'৫

কেন আর্মেনীয়দের সংখ্যা কমে এলো ঢাকায়? ভারত উপমহাদেশে আসার পর থেকে ইউরোপীয় আচার আচরণের পরিবর্তে গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ায় ক্রমাগত অলস জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়া, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা ও অমিতব্যয়িতার স্রোতে ভেসে যাওয়া, বাল্যবিয়ে ও এদেশীয়দের সাথে রক্তের সংমিশ্রণ এড়াতে নিকটাত্মীয়দের ভেতর বিয়ের কারণে রুগ্ন ও রোগক্লিষ্ট শিশুদের জন্ম ও শিশুমৃত্যুর উঁচু হার প্রভৃতি কারণকেই বাংলায় আর্মেনীয়দের ক্ষয় ও পতনের কারণ বলে মনে করেন ইতিহাসবেত্তা জেমস ওয়াইজ।

'পাকিস্তান আমলেও কিছু আর্মেনীয় আছিলো। তো বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে আর্মেনীয়রা প্রায় সবাই একে একে চলিয়া যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। আমার চার ছেলে-মেয়ে কানাডায় থাকে। ভাই-বোনরা ইন্ডিয়া, বার্মা ও লন্ডন… ওয়ার্ল্ডের নানা দেশে আছে। ফোনে ওদের সাথে কথা হয়। আমি একা নয়। মাই ওয়াইফ স্লিপস হেয়ার। মাই প্যারেন্টস স্লিপ হেয়ার। তাই, আমি এখানেই থাকবে। টিল আই ডাই!' আশি পার করা মিখাইল মার্টিরোসেন জানান ইংরেজি ও হিন্দি মেশানো ভাঙা বাংলায়।

'আমার জন্ম ঢাকায়। পড়াশুনা করেছি ক্যালকাটা আর বোম্বাইয়ে। সেভেন্টি ওয়ানের আগে জুটের বিজনেস করেছি খুলনায়। সেভেন্টি ওয়ানের ম্যাসাকার দেখেছি। হিন্দু আর মুসলমান, বাঙালীর এই দুই সম্প্রদায়েরই অনেক আচার-বিচার আমি জানে। এখন বয়স হয়েছে। নাউ ওয়েটিং ফর দ্য ডে গড উড টেক মি অন হিজ ল্যাপ!' বলেন একাকী মার্টিরোসেন।

তথ্যসূত্র
১ মুনতাসীর মামুন, ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, পৃষ্ঠা ৩১।
২ প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭-২৮।
৩ পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ, জেমস ওয়াইজ, তৃতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা ২০৮-২১৪।
৪ পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ, জেমস ওয়াইজ, তৃতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা ২০৮
৫ মুনতাসীর মামুন, ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, পৃষ্ঠা ২৯-৩০

এপ্রিল ২০০৯

—–


অদিতি ফাল্গুনী
…….

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: অদিতি ফাল্গুনী
ইমেইল: a_falgun@yahoo.com

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts