আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: ১৭ নভেম্বরের সেই সকালটি

ইকতিয়ার চৌধুরী
Published : 20 Feb 2021, 08:18 PM
Updated : 20 Feb 2021, 08:18 PM


প্যারিস, ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯। এটি শুধু একটি ডেটলাইন নয়। বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য বিশেষ একটি দিন। ওই দিন ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পৃথিবী জুড়ে প্রতি বছর উদযাপিত হবার স্বীকৃতি পায়। জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো ১৭ নভেম্বর সকালে তার প্লেনারি সেশনে বাংলাদেশের প্রস্তাবে সর্বসম্মত এই বিরল স্বীকৃতি প্রদান করে। যা ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন। এই অর্জন সহজ ছিলনা। প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের যারা এই স্পর্শকাতর কূটনৈতিক লড়াইয়ে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়েছিল তারা তার সবটা দেখেছিলাম। পেশাদার কূটনীতিবিদ ছাড়াও এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোর সচিব প্রফেসর কফিলউদ্দিন আহমেদ এবং ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ফেডেরিকো মেয়রের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ডঃ তোজাম্মেল টনি হক। ডঃ হক ইউকে প্রবাসী বাংলাদেশী এবং নব্বই দশকের শুরুতে ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্পর্কিত প্রস্তাবের সার-সংক্ষেপ অনুমোদন করেছিলেন ৯ সেপ্টেম্বর '৯৯। ১০ সেপ্টেম্বর ছিল ইউনেস্কোতে তা উত্থাপনের শেষ দিন। উত্থাপনের শেষ দিন বিকেলে ঢাকা থেকে ফ্যাক্সে পাঠানো প্রস্তাব দূতাবাসে এলো। অস্পষ্ট। প্রফেসর কফিলউদ্দিনকে ফোনে সমস্যা জানালে বললেন তাদের ফ্যাক্স মেশিন ঠিকমত কাজ করছে না। অতএব আমি প্রাপ্ত প্রস্তাব/রেজ্যুলিশনের ধীরে ধীরে পাঠোদ্ধার করতে থাকি আর আমার সহকারী তা টাইপ করে চলেন। অফিস সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের প্রোগ্রাম পেশালিস্ট আনা মারিয়া মাজলফকে অনুরোধ করে ওর দপ্তরে বসিয়ে রেখেছিলাম যাতে বাংলাদেশের রেজ্যুলিশনটি শেষ দিনে তারা গ্রহন করতে পারে।
আমার তখন জানা ছিল না একুশ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার উদ্যোগ কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলামদের সংগঠন মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দি ওয়ার্ল্ড-এর। এজন্যে তারা জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান বরাবর একটি আবেদনও করেছিলেন। সদস্য রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কেউ যেহেতু জাতিসংঘে এ ধরণের আবেদন করতে পারেনা তাই তাদেরকে বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশনের মাধ্যমে তা করার পরামর্শ দেয়া হয়। আমি তখন এও জানব না একুশ ফেব্রুয়ারীর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পর 'গফরগাও থিয়েটার' নামক একটি নাট্যদল দাবী করবে রফিকুল ইসলাম নয়, ১৯৯৭ সালে তারাই প্রথম ঘোষনা করেছিল একমাত্র একুশ ফেব্রুয়ারীই হতে পারে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস পালনের উপযুক্ত দিন। ১৯৯৯ সালে একুশের সংকলনেও তারা পুনর্ব্যক্ত করেছিল তাদের দাবী।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অর্জনের কূটনৈতিক অভিযাত্রায় আমাদের নেতা ছিলেন ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোতে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। আমি ছিলাম ওঁর ডেপুটি- উপস্থায়ী প্রতিনিধি। এই লড়াইয়ে দূতাবাস হতে আরেক সংগী ছিল প্রথম সচিব মোস্তাফিজুর রহমান ( বর্তমানে জেনেভায় জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি)। আর আমাদের সামনে ছিল বাঁধা-পাহার সমান।
যে সমস্ত দিবস বা অনুষ্ঠান উদযাপনে আর্থিক সংশ্লেষ থাকবে তাতে ইউনেস্কো বিধি নিষেধ আরোপ করেছিল। অন্যান্য দাতা দেশগুলো যারা তাদের তহবিলে অর্থ জোগায় বিশেষ করে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো অতি প্রয়োজনীয় খাত ছাড়া অর্থ ঢালতে রাজী ছিলনা। আরেকটি বাঁধা ছিল নতুন একটি আন্তর্জাতিক দিবস পেতে ইউনেস্কোর অনাগ্রহ। পর্বত দিবস, টেলিভিশন দিবস ইত্যাদিসহ দু'শ'র বেশী এরকম দিবসে আরো একটি দিন যুক্ত হোক এবং তা বিশ্বব্যাপী উদযাপনে ইউনেস্কোর প্রতিবছর লক্ষাধিক ডলার খরচ হোক সে বিষয়ে সম্মতি অর্জন সহজ ছিলনা। প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ইউনেস্কো সচিবালয়ের সাথে অনেকগুলো বৈঠক হলো। নানাভাবে তাদেরকে আমরা রেজ্যুলিশনের খসড়া করে দেখালাম যাতে বিতর্ক পাশ কাটিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায় সম্ভব হয়। এদিকে সাধারণ অধিবেশনের সময়ও এগিয়ে আসছিল। তার আগেই এই সমস্যা সুরাহার প্রয়োজন ছিল তা' না হলে আমাদের প্রস্তাব ইউনেস্কো সচিবালয়ের মাধ্যমে খসড়া আকারে অধিবেশনে আলোচনা/সম্মতির জন্য উঠবেনা।
আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতায় সমস্যাভেদী সাহায্য করলেন ইউনেস্কোর ডাইরেক্টর জেনারেল প্রফেসর ফেডেরিকো মেয়রের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ডঃ টনি হক। তার মাধ্যমে ডিজিকে রাষ্ট্রদূত বোঝাতে সক্ষম হলেন যে প্রথমতঃ তিনি বাংলাদেশের প্রস্তাবে অনুমোদন দিন। দ্বিতীয়তঃ অধিবেশনে সদস্য দেশগুলো তাতে সম্মতি দিলে মাতৃভাষা দিবস পালনে যে আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছে তা সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ তহবিল থেকে নির্বাহ করবে। ফলে ইউনেস্কোর কোন বাজেটের দরকার পড়বেনা। স্পেনের নাগরিক ও দেশটির এক সময়ের মন্ত্রী ডিজি ফেডেরিকোর কাছ হতে আমরা প্রত্যাশিত সমর্থন পেয়েছিলাম। তাতে করে ড্রাফট রেজ্যুলিশন প্রকাশের শেষ দিন ২৬ অক্টোবর ১৯৯৯ বাংলাদেশের প্রস্তাব ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে ১৯০টি সদস্য রাষ্ট্রের বিবেচনার জন্য প্রকাশিত হলো।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কিত প্রস্তাবটি ছিল ইউনেস্কো কমিশন-২ এর অধিক্ষেত্রাধীন। এই ধাপে আমাদের তাই প্রয়োজন পড়ল রেজ্যুলিশনটির বিষয়ে তাদের সুপারিশ যাতে করে সাধারণ কমিশন তা অনুমোদন করে। সমর্থন পেতে কমিশনের চেয়ারপার্সন স্লোভাকিয়ার মিঃ মোলনারের সাথে মোয়াজ্জেম আলী স্যার আমাকে সংগে করে অনেকগুলো বৈঠক করলেন। মোলনার বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তার দেশ অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রের মত একাত্তরে আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করেছিল। অনেকগুলো বৈঠকের দরকার হয়েছিল কারণ কমিশনের স্ক্যান্ডানেভিয়ান রাষ্ট্রগুলোসহ অপরাপর দাতা দেশ্গুলোর সম্মতি আদায় কঠিন ছিল। এছাড়া প্রস্তাবটির প্রতি ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বেলজিয়াম, পর্তুগাল, অষ্ট্রিয়া ও স্পেনও রক্ষণশীল মনোভাব দেখায়। কমিশনের বৈঠকে আরও একটি কারণে আমরা বাধাঁর সম্মুক্ষীন হই। তা হলো পৃথিবীর বহু ভাষাভাষি বিভিন্ন দেশে ভাষা নিয়ে স্পর্শকাতরতা। এই দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া, ভারত, হাঙ্গেরী, রুমানিয়া, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়া উল্লেখযোগ্য। জাতিসংঘের একটি অঙ্গ সংস্থা দ্বারা ২১ ফেব্রুরারী ভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক দিবসের স্বীকৃতি ওই সমস্ত দেশে স্বাধিকার কিংবা বিচ্ছিন্নতা উসকে দিতে পারে এই আশঙ্কাও তাদের ছিল। তবে আনন্দের বিষয় বহু ভাষাভাষি দেশগুলোর অনেকেই শেষ পর্যন্ত আমাদের সমর্থন করেছিল। বৈঠকের পাশাপাশি আমরা অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের সমর্থন আদায় শুরু করেছিলাম। প্রথম আনুষ্ঠানিক সমর্থন দানকারী দেশ সৌদি আরব। শুধু সমর্থন নয় তারা বাংলাদেশের প্রস্তাবের কো-স্পন্সর। মোট আটাশটি দেশ আমাদের রেজ্যুলিশনকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন জানায়। আসলে আটাশটি নয়- উনত্রিশটি। উনত্রিশতম দেশটি সুরিনাম। অজ্ঞাত কারণে সুরিনামের নামটি ইউনেস্কোর দলিলভুক্ত হয়নি।
সমর্থক রাষ্ট্রগুলোর মাঝে পাকিস্তানকে পাওয়া ছিল অবিশ্বাস্য। এর আপাতঃ কারণ ছিল ইউনেস্কোতে পাকিস্তানের ডেপুটি পার্মানেন্ট ডেলিগেট মাদাম রিফাতের সাথে সখ্যতা। তবে তখন আমরা জানতাম না ১৭ নভেম্বর সাধারণ অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাবার পরদিন পাকিস্তান তার ভুল বুঝতে পেরে ওই সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে। অধিবেশনে মাতৃভাষা দিবসের ওপর সম্ভাব্য ভোটাভুটির মত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রায় সত্তরটি সদস্য দেশ নিয়ে আমরা কয়েকদিনের কঠিন পরিশ্রমে একটি 'ভোট ব্যাংক' তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলাম। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থার নির্বাচনে পারস্পরিক সমর্থনের ভিত্তিতে আমরা এই ভোট ব্যাংক তৈরী করি।
১২ নভেম্বর কমিশন-২ এর অধিবেশনে রাষ্ট্রদূত মোয়াজ্জেম আলী ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার প্রস্তাব এক লিখিত বিবৃতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রদূত তাঁর বিবৃতিতে বলেন ভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন ইউনেস্কোর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভাষা একটি অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রচলন কেবল ভাষাতত্ত্বের বহুমুখীতা ও বহুমুখী শিক্ষাই উৎসাহিত করবেনা বিষয়টি সারা বিশ্বের সচেতনা বৃদ্ধিতেও সহায়ক ভুমিকা পালন করবে। তিনি উদ্বেগের সাথে আরো উল্লেখ করেন সময়ের সাথে সাথে বহু ভাষা বিলুপ্তির পথে যা আশু রোধ করা প্রয়োজন। বিবৃতিটির সময় ঢাকা থেকে আসা প্রতিনিধি দলের বিকল্প নেতা ডঃ সা'দত হুসাইন, প্রফেসর কফিলউদ্দিন, ডঃ তোজাম্মেল টনি হক ও আমি উপস্থিত ছিলাম। ওই দিনই কমিশন আমাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানাল। চুড়ান্ত অনুমোদন দিল ১৬ নভেম্বর। চূড়ান্ত অনুমোদনের আগের কয়েকটি মাত্র দিনে সমর্থনদানকারী ২৮টি দেশের সাথে তাদের প্রতিশ্রুতি মজবুতের লক্ষ্যে ঝটিকা গতির পৃথক পৃথক বৈঠক কিভাবে সম্ভম হয়েছিল তার জবাব আজও নেই। কমিশন-২ এর পর বাকী থাকল আরেকটি ধাপ। শেষ ধাপ- ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত প্রদানকারী সর্বোচ্চ অঙ্গ সাধারণ অধিবেশনের প্লেনারি সেশনে প্রস্তাবটির সর্বসম্মত অনুমোদন।
মাত্র চব্বিশ ঘন্টা পরেই ছিল ওই প্লেনারি সেশন। চব্বিশ ঘণ্টাও নয়। একটি রাত পরেই ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ প্লেনারির সকালের বৈঠকে উঠেছিল বাংলাদেশের প্রস্তাব। প্রতিনিধি দলের আসনে অন্যান্যদের সাথে বসে ছিলাম। নিশ্চুপ। কারণ আমার ভেতরের উৎকণ্ঠা আমাকে স্তব্ধ করে রেখেছিল। বুকের মাঝখানটা স্পন্দিত হচ্ছিল তিরতির করে। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সর্বসম্মত অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবটি প্লেনারিতে দেয়া হলো। সারা হলরুমে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম। কোন দেশই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাবে বিরোধিতা করলনা। আমাদের যুগপৎ আনন্দিত ও শিহরিত করে তা পাশ হয়ে গেল। উত্তেজনায় ডঃ সা'দত, মান্যবর রাষ্ট্রদূত, ডঃ হক, প্রফেসর কফিলউদ্দিন ও আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। উষ্ণ করমর্দন চলল আমাদের মাঝে। দু'মাস ধরে আনুষ্ঠানিক/অনানুষ্ঠানিক যে কূটনৈতিক লড়াই চলছিল, যার বিস্তৃতি ঘটেছিল সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো ছাড়াও ইউনেস্কো ভবনের করিডর থেকে শুরু করে ক্যাফে, প্রদর্শনী কক্ষ, ডকস পিজন হোলস্‌ এমনকি স্যুভিনির সপ পর্যন্ত, তার কাঙ্খিত সমাপ্তিতে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম।
প্যারিসে ততদিনে শীত জাকিয়ে বসেছে। ক্লোক রুমের দিকে সবাই হাঁটছি। রাষ্ট্রদূতকে বললাম,'স্যার আমরা এই মুহুর্তে হয়তো ধারণাও করতে পারছিনা আজ বাঙালির জন্য কি ইতিহাস তৈরী হলো।' তিনি জবাব দিলেন,' হ্যাঁ অনেক বড় ইতিহাস। এই মুহুর্তে বোঝা না গেলেও একদিন অবশ্যই বোঝা যাবে।' ক্লোক রুম থেকে শীতের কাপড় নিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি ইউনেস্কো ভবনের প্রধান ফটকের দিকে। রাষ্ট্রদূত, ডঃ সা'দত ও ডঃ হক সামনে। পাশাপাশি। প্রফেসর কফিল ও আমি পেছনে। ওভারকোট পরিহিত সামনের দীর্ঘকায় তিনজনকে মনে হচ্ছিল একটু যেন ভীন দেশী। মনে হচ্ছে ইতিহাসের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনজন মানুষ। তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। রাষ্ট্রদূত মোয়াজ্জেম আলী(প্রয়াত) মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন ১৯৭১ সালে। ডঃ সা'দতও(প্রয়াত) একজন মুক্তিযোদ্ধা। সিএসপি এই কর্মকর্তা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ছিলেন মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলীর একান্ত সচিব। আর মুক্তিযুদ্ধকালে ডঃ তোজাম্মেল টনি হক(বর্তমানে বার্মিংহাম-এ বসবাসরত) ছিলেন যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ রিলিফ এন্ড এ্যাকসন কমিটির উপদেষ্টা ও মুখ্য ভুমিকা পালনকারীদের একজন।
আমরা ইউনেস্কো ভবন থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরে শীতের মরা রোদে আমাদের ছায়াগুলোকে অস্পষ্ট দেখায়। ডঃ হক আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ জানান। যা ছিল আমাদের কূটনৈতিক সাফল্যর প্রথম উৎসব। আমরা প্রথমে এভিনিউ সাক্স-এ ওঁর ফ্ল্যাটে যাই। গাড়ীতে যেতে যেতে এক পশলা বৃষ্টি পাই। শীতে প্যারিসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম নয়। আমরা খোশ চিত্তে চীনে রেস্তোঁরা 'ক্যাথে রয়্যাল'এ লাঞ্চ করি। খাবার জন্য রীতিনুযায়ী তারা আমাদের দু'টো করে কাঠি দেয়। তখন আমার মনে পড়ে পাঠশালা জীবন। পাঠ্য বইয়ে পড়েছি চীনারা দু'টো কাঠিতে খায়। কিভাবে খায় তা ছিল এক বিরাট রহস্য।
লাঞ্চের পর আমি দূতাবাসে ফিরি। সেখানেও উৎসবের আমেজ। একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের খবর ঢাকায় প্রেরণের তোড়জোড় শুরু হয়। ঢাকা থেকেও ফোন আসতে থাকে। বিশেষ করে সংবাদপত্র থেকে। তাদের মধ্যে অনেক ঘনিষ্ঠ জনও রয়েছেন। কিন্তু আমি মুখ খুলতে পারিনা। কারণ আমাকে জানানো হয়েছে স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর বাঙালির এই বিশেষ অর্জন শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক স্বয়ং প্রেস মিটিং-এ জানাতে চান। বুকের মধ্যে আনন্দ তোলপাড় করে অথচ তা চাউর করা যায়না।
আমার কল্পনায় উঠে আসতে থাকে অনাগত দিন। আগামী দিনের পৃথিবী। পঞ্চাশ, একশ' বছর পরের বিশ্ব। আর বিশ্ব জুড়ে ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন উৎসব। আমার চোখের কোণে আনন্দাশ্রু জমে। এরকম আনন্দাশ্রু জমেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। কিশোর গেরিলা আমি সেদিন ছিলাম সিরাজগঞ্জের জন্মভিটা থেকে অনেক দূরে রৌমারির তাবুতে। সেদিনের মত আবেগ বহুকাল পর আমার হৃদয়ের বেলাভুমিতে আবারও উর্মিমালার মত আছড়ে পড়ে। গাঢ় হতে থাকে চোখের ধারের অশ্রুকণা। আমি উঠে দাঁড়াই। দূতাবাসে আমার তিনতলার রুমের মধ্যে হাঁটি একটু। দাঁড়াই জানালার পাশে। পাশের বাসার মাপেল ট্রি'র দিকে চোখ যায়। নভেম্বরের তীব্র শীতে ঝরে পড়েছে তাদের সব পাতা। চোখে তখন অশ্রু আসে। আমি হাতটান করে আড়মোড়া ভাঙি। বুঁজে আসে চোখের পাতা আর সেই সাথে আমার চোখ দিয়ে আমার নয় গড়িয়ে পড়ে বাঙালি জাতির আনন্দাশ্রু।
ইকতিয়ার চৌধুরীঃ কথাসাহিত্যিক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত।