ঐতিহাসিক দিলীপকুমার বিশ্বাস: শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি

দেবব্রত চক্রবর্তীদেবব্রত চক্রবর্তী
Published : 30 June 2020, 07:48 PM
Updated : 30 June 2020, 07:48 PM


প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের একজন দিকপাল ঐতিহাসিক ও "রামমোহন সমীক্ষা" খ্যাত দিলীপকুমার বিশ্বাস মহাশয়ের (৭ জুলাই ১৯২০, মৃত্যু ২৩ নভেম্বর ২০০৩) জন্ম শতবর্ষে (১৯২০-২০২০) তাঁকে স্মরণ ক'রে ও শ্রদ্ধা জানিয়ে দিলীপকুমারের সুযোগ্য ছাত্র যথাক্রমে প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও কবি দেবব্রত চক্রবর্তী যে বইখানি লিখেছেন, সেই "ছায়ানটের রাগিণীতে" নামক গ্রন্থের খুব সামান্য একটু অংশই এখানে আজ তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশ করা হল৷ বইটি শীঘ্র প্রকাশিত হবে৷
এই প্রসঙ্গে একটা কথা জানিয়ে রাখি৷ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পূর্ণ জনসমক্ষে অনুপস্থিত যে ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালে রামমনোহর লোহিয়ার (১৯১০-১৯৬৭) উদ্যোগে কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক দলের পক্ষ থেকে কলকাতায় গোপনে যে বেতার কেন্দ্র খোলা হয়েছিল তার চারজন পরিচালকের মধ্যে দিলীপকুমার বিশ্বাস ছিলেন অন্যতম৷ মুম্বইয়ে ঊষা মেহতা পরিচালিত কংগ্রেসের বেতার কেন্দ্র সম্পর্কে সকলে অবগত আছেন৷ কিন্তু কলকাতায় সেই প্রচেষ্টার কথা সম্পূর্ণ অজানা থেকে গেছে৷ "ছায়ানটের রাগিণীতে" বইটিতে এই অধ্যায়ের বিস্তৃত বিবরণ আছে৷ — সম্পাদক

কোন্ গহন অরণ্যে তারে এলেম হারায়ে
কোন্ দূর জনমের কোন্ স্মৃতিবিস্মৃতিছায়ে॥
আজ আলো-আঁধারে
কখন্-বুঝি দেখি, কখন্ দেখি না তারে–
কোন্ মিলনসুখের স্বপনসাগর এল পারায়ে॥
ধরা-অধরার মাঝে
ছায়ানটের রাগিণীতে আমার বাঁশি বাজে।

সময়টা ইদানীং বড় সুখের নয়, বরং আতঙ্কেরই৷ দেশের মানুষের আশ্রয়হরণের তোড়জোড় চলতে চলতেই করোনা কোবিদ ১৯ মহামারির ছোবল৷ এর ফাঁকে পড়ে গেলেন আমাদের প্রিয় অধ্যাপকও৷ তাঁর শতবর্ষ পালন কিভাবে করব তা নিয়ে সত্যিই কিংকর্তব্যবিমূঢ় যাকে বলে তাই৷ যুগান্তরের গ্লানি এসে পড়েছে দোরগোড়ায়, তাকে তো আগে সামাল দিতে হবে৷
তবু বলব, জমজমাট অনুষ্ঠানের চেয়ে লেখাটাই আমার ভাল লাগে৷ ওর চেয়ে স্থায়ী কিছু আর হয় না৷ কিছুটা পারিও অবশ্য আমি ওটাই৷ অনুষ্ঠান পালনে আগ্রহ আমার কোনওদিনই ছিল না, আজও নেই৷ কিন্তু যেভাবে তাঁকে নতুন ক'রে পাওয়া যেতে পারে, যেভাবে তাঁর সব গুণাবলীকে একত্র ক'রে একটা পরিসরের মধ্যে এনে ফেলবার ব্যবস্থা করা যায়, সেটা হল লেখা এবং সেটাই আমার কাছে সহজতম ব'লে মনে হয়৷
যদিও কলেজে পড়বার সময় ইতিহাস আমার বিষয় ছিল না, তবু দূর থেকে দেখেছি তাঁকে৷ প্রেসিডেন্সিতে ছিলেন তখন৷ ১৯৬৯-এ আমাদের তৃতীয় বর্ষে তিনি সংস্কৃত কলেজে এলেন প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান হয়ে৷ কিন্তু পাইকপাড়াতে বাস করতে আসবার পর নিজেরই একান্ত প্রয়োজনে তাঁর কাছে গেলাম এবং তার পর যে সখ্য হল, তা জীবনে একটা স্থায়ী রূপ নিয়েছিল৷
অনেকে তাঁর বৈদগ্ধ্য নিয়ে অনেক কথা বলতে পারেন, তেমন কথা বলবার ক্ষমতা ও যোগ্যতা কোনওটাই আমার নেই৷ অবশ্য উৎসাহও নেই৷ মানুষটাই তো কত বড় মাপের, তাঁর কাছে তাঁর নিজের লেখাজোখা সেও তো সব খাটো ব'লে মনে হয়৷ এছাড়া আমি তাঁকে যেভাবে দেখেছি, তাতে অমন একটা নিটোল আড্ডাবাজ ঘরোয়া আটপৌরে মানুষকে নিয়ে কথা বলব নাই বা কেন৷ সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়ে তো তিনি মানুষটাই আগে, নাকি? তাঁকে ছাড়া গীত হবে কি ক'রে? যদি একটা ছবি আঁকবার চেষ্টা করি, তাহলে সেটা হতে পারে তাঁরই আনন্দঘন মূর্তি৷ কিন্তু সেটাই কি সোজা নাকি? ছড়ানো তাঁর জীবন৷ মুঠো ক'রে ধ'রে দেখাতে পারি, সাধ্য কি আমার?


ছবি:নিতাই বসু

একেবারে ক্লাসের ছাত্র না হলেও তাঁর কাছে নাড়া বেঁধেছিলুম বটে পিএইচডি-র জন্য৷ কিন্তু সেসব কথা এখানে বলবার নয়৷
গানটা তাঁর জীবনের অনেকখানি জুড়ে ছিল৷ খেয়াল শিখেছেন রীতিমত ওস্তাদের কাছে৷ গান নিয়ে যে কত প্রসঙ্গ এসেছে আড্ডায়! কখনও কখনও গেয়েও শুনিয়েছেন৷ একসঙ্গে গলা মিলিয়েছি কখনও৷ একদিন কোনও গানের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছি, বললেন, এই গানের জন্যেই তো পিএইচডি-টা করা হল না৷ গোটা শীতই তো কলকাতা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে জমজমাট৷ পীযূষদা (রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম গায়ক পীযূষকান্তি সরকার: ১৯৩৭-২০০১) আর আমি যেদিন ওঁর বাড়িতে ঢুঁ মারতাম, সেদিন তো গানে গানে ভেসে যেতাম আমরা সকলে৷ কিন্তু নিতাইদা, সেতারী নিতাই বসুর (১৯২৭-২০০৯) সঙ্গে ব'সে গেলে পরিবেশ অন্যরকম৷ যেসব আলোচনা হত সেসব সত্যিই ঔপনিষদিক পর্যায়ের৷ গান নিয়েই নয়, জগৎ ও জীবনের অখণ্ড সাঙ্গীতিক ঐকতানে তাঁরা নিবিষ্ট হয়ে উঠতেন৷ একদিন মনে আছে পাইকপাড়ার মোহন কাননে একটা অনুষ্ঠান হল৷ সঙ্গে কুমার বসুর তবলা ছিল৷ দিলীপবাবু সামনে ব'সে৷ বললেন, নিতাইববাবু, সব শেষে যদি লচাও ঠুংরিটা একটু বাজান৷ নিতাইদা সেতারে সেদিন লচাও ঠুংরির সুর বাজিয়ে আমাদের মুগ্ধ ক'রে দিয়েছিলেন৷

এর পরের আড্ডাতেই শুরু হল তাঁর বিচার বিশ্লেষণ৷ বললেন, ওই জায়গায় ভাবো তো নিতাইবাবুর সুরটাকে — না না ওখানে ওটা ঠিকই আছে, আরে, হবেই বা কি ক'রে, সেতারে তো ওই জায়গাটা ঠিক আদায় হবে না, আহা হত যদি এস্রাজ, জমে যেত ঠিক! এ তো গণপত রাও ভাইয়ার আশ্চর্য সৃষ্টি, না? বলতে পার ধ্রুপদের হাত থেকে ধার ক'রে নেওয়া অতি সূক্ষ্ম কারুকাজে ঠাসা একটা বিলম্বিত গমনভঙ্গীর খেলা৷ মুখের ধরতাই থেকে পঙক্তিটি এমনভাবে বাঁক নেবে, তারপর যেন লীলাভরে এগোতে এগোতে প্রতি মাত্রায় সুরের ঐশ্বর্য প্রকাশ করবে, আর সেসব কি রঙদার! প্রথম একটা রঙ ভেসে উঠল, পরক্ষণেই আর একটি রঙের স্তর এসে চোখ ভাসিয়ে দিল, তারপর একের পর এক রঙের ফণা তুলতে তুলতে শেষে রামধনুর মত হয়ে প্রকট হয়ে উঠল ঠুংরির গোটাটা৷ এই লচাও ঠুংরির অদ্বিতীয় শিল্পী ছিলেন মউজুদ্দিন খাঁ এবং বাঈজীদের মধ্যে গহরজান, দুই মালকা, জদ্দনবাঈ, বেনারসের বড়ি মোতি বাঈ, রসুলন বাঈ, সিদ্ধেশ্বরী বাঈ, তাঁর মেয়ে গিরিজা বাঈ, উসনাজান প্রমুখ অনেকে৷ এই জায়গাটায় এলে স্যার কথা বলতেন ঝর্ণার মত৷ তারপর শুরু হত এই বিষয়ে তাঁর বিস্তৃত ভাষ্য৷
একদিন কেসর বাঈয়ের কথা উঠল৷ বললেন, ওহ্ সেবার ওঁর কন্ঠে দেশ রাগটা যা শুনেছিলাম, তার তুলনা নেই৷ জমে গিয়েছিল খুব সেদিন৷ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ডিকশন লেনের বাড়িতে মহফিল বসেছিল৷ প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ বি. এম. সেনকে সভাপতি ক'রে নিয়ে যাওয়া হল৷ তিনি তো কিছুতেই যেতে চান না, বলেন, আামি গানের কি কিছু বুঝি যে যাব? যাহোক গেলেন৷ গান শুরু হবার পর একটু পরে দেখি বাপরে, কারও যেন হুঁশ নেই৷ সবাই একভাবে দুলছে৷ কি যেন একটা হয়ে গিয়েছিল৷ বি. এম. সেনও রেহাই পাননি৷


ছবি: বিশ্বনাথ কর (১৮৬৪-১৯৩৪) দিলীপকুমারের মাতামহ, উড়িষ্যার উৎকল সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক৷

দিলীপবাবু যখন কৃষ্ণনগর কলেজে ছিলেন, তখন সঙ্গীতজ্ঞ অমিয়নাথ সান্যালের (১৮৯৫-১৯৭৮) বাড়িতে তাঁর যাতায়াত ছিল খুব৷ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নির্মলকান্তি মজুমদার তাঁকে অমিয়বাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন৷

একবার অমিয়নাথের কাছে রবীন্দ্রনাথের "এবার অবগুন্ঠন খোলো…"-এই গানটি গেয়ে শুনিয়ে দিলীপবাবু তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এটা কি রাগ, ঠিক ধরতে পারছি না৷ অমিয়বাবু বললেন আচ্ছা আমি নিরিবিলিতে ব'সে এটা দেখে রাখব৷ পরে অমিয়বাবু বলেছিলেন, এটা একটা বিশেষ ধরণের মল্লার যাকে বলে "চরযূ কি মল্লার"৷ শোনাই যায় না প্রায়৷ অবাক হলেন, বললেন রবীন্দ্রনাথ তো প্রথাগত ভাবে শেখেননি৷ কোথায় পেলেন তিনি এ রাগ? রাগটা অবশ্য অমিয়নাথ বদল খাঁয়ের কাছে শিখেছিলেন৷ পরে স্যার ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের একটি ঘরোয় আসরে এ রাগেরই একটি গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন৷ গানটা হল "আজু ঝরলায়ো৷" অমিয় সান্যাল কবির অনুরোধে একবার গান গেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে৷ কবি বলেছিলেন, "ভয় পেয়েছিলুম৷ ভেবেছিলুম অমিয় বুঝি ওস্তাদ৷ অশিক্ষিত লোক ওস্তাদকে বরাবর ভয় করে৷ কিন্তু দেখছি ও হল শিল্পী৷"

সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ ও সংস্কৃতের অসামান্য পণ্ডিত বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য (১৯২১-২০০০?) ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দিলীপবাবুর "ব্যাচ মেট৷" আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম৷ উনি বেশ কিছুদিন ওই পাইকপাড়ার আশুবাবুর বাজার সংলগ্ন হাউজিং-এ দিলীপবাবুর প্রতিবেশী ছিলেন৷ ঘটনাটা দিলীপবাবুর মুখেই শোনা৷ ষাটের দশক৷ তখন পশ্চিমবঙ্গে চালের খুব আকাল চলছিল৷ কর্ডনিং ছিল চালের, গ্রাম থেকে বিশেষ ক'রে মহিলারা ট্রেনে ক'রে চাল পাচার ক'রে নিয়ে এসে তখন কলকাতায় বিক্রী করতেন৷ তা এইরকম একজন বর্ষীয়সী মহিলা একদিন সুগন্ধ গোবিন্দভোগ চাল নিয়ে এসে বিক্রি করতে এসেছেন ফ্ল্যাটে৷ ওঁর স্ত্রী ছায়া দেবী দরজা খুলে দেখতে গেছেন চালটা৷ বলছেন, "কি বলছ? এই গন্ধ? এসব দু মিনিট পরেই দেখব উধাও হয়ে গেছে৷" বৃদ্ধা বললেন, "হাতের কাঁকন দেখতে হলে কি আরশির দরকার হয় মা?" বিষ্ণুবাবু ঘরে পড়াশুনা করছিলেন৷ কথাটা তাঁর কানে যেতেই উনি উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন৷ আরে, এ তো সুবন্ধুর বাসবদত্তা থেকে বলছে! "কিং করকঙ্কনদর্শনায় দর্পণাদপেক্ষা?" কথাটা বিষ্ণুবাবু পরে স্যারের কাছে বলেছিলেন৷ বস্তুতপক্ষে বিষ্ণুবাবুকে আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পেয়েছিলাম৷ রসগঙ্গাধর পড়াতেন৷ খুবই ভয় পেতাম আমরা তাঁকে৷ ভারি রাশভারী মানুষ ছিলেন৷ এই আশুবাবুর বাজার সংলগ্ন হাউজিং থেকে এর পরে বোধ হয় তিনি চণ্ডীবাড়ি স্ট্রীটে চলে যান৷ জানতাম, কারণ সেই চণ্ডীবাড়ি স্ট্রীটের বাড়িতে একবার বিশেষ কাজে যেতে হয়েছিল আমাকে৷ পরবর্তীতে বহুকাল পর বিশ্বভারতীর একটা অনুষ্ঠানে কলকাতায় তাঁকে দেখি এবং প্রণাম করি৷ বললাম, স্যার আপনার ছাত্র ছিলাম৷ স্বভাবসিদ্ধ রীতিতে জিজ্ঞেস করলেন, "কোন ব্যাচ?" বললাম৷ তখন আমার সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ কথা বলবার পর উনি আমাকে তাঁর বিধান শিশু উদ্যানের ফ্ল্যাটে যেতে বললেন, নিজে হাতে ঠিকানা লিখে দিলেন৷ তাঁর কাছে যাতায়াত করেছি তাঁর আমৃত্যু৷ দিলীপবাবু ও তিনি দুজনেরই বৃদ্ধ বয়স, আমি একটা সেতু রক্ষা করতাম দুজনের মধ্যে৷


ছবি: দিলীপকুমার বিশ্বাসের স্ত্রী ভারতী ও মা নর্মদা – বাঁদিক থেকে

অনেকদিন পর পুণাতে একটা লম্বা সেমিনার-এ গিয়ে সেখানে ছিলাম, তখন আমাদের প্রবাদ প্রবচনের ওপর ক্লাস নিতেন ড. স্কোর (Dr. Skor. পুরো নামটা ভুলে গেছি৷ ছিলেন আসলে পূর্ব জার্মানির মানুষ) তাঁকে আমি এই ঘটনাটি ক্লাসে বলেছিলাম, সেইসঙ্গে একথাও বলি যে দেখুন সংস্কৃত পণ্ডিত মশায়ের কাছে সুবন্ধুর এই শ্লোকটি শুনে গ্রামে গ্রামে কথাটা কিরকম ছড়িয়ে গিয়ে সাধারণ প্রবাদে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল৷ উনি বললেন, তা কেন? এমনও তো হতে পারে যে কথাটা গ্রামে গ্রামে প্রচলিতই ছিল? সুবন্ধু সেইটাই তাঁর রচনায় গ্রহণ করেছিলেন?
বিষ্ণুবাবু মারা গেলে তাঁর স্মৃতিতে একটা কবিতা লিখি৷ কবিতাটি দেখে দিলীপবাবু খুব অভিভূত বোধ করেছিলেন৷ বললেন, আমাকে একটা কপি ক'রে দিও তো৷ কবিতাটি যে কবিতা হিসাবে এমন কিছু আহামরি তা নয়৷ জীবনের শেষ দিক, তাই হয়তো কবিতার কথাগুলি তাঁকে স্পর্শ করেছিল৷ ওটার জায়গা হয়েছিল স্যারের আর্কাইভস-এ, মানে তোশকের তলায়৷ জগন্নাথবাবুও (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের এককালীন প্রধান জগন্নাথ চক্রবর্তী)খুব আকৃষ্ট হয়েছিলেন৷ কিন্তু কবিতাটা কখনও ছাপানো হয়নি৷ খুব স্নেহ করতেন আমাকে জগন্নাথবাবু৷ দিলীপবাবুর সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ভালই ছিল৷ তাঁর মৃত্যু আকস্মিক৷ কর্কট রোগ ধরা পড়ল ঠিক অবসর নেবার পর৷ শেষ দিন আমার হাতদুটো ধ'রে বলেছিলেন, আশীর্বাদ করি, আশীর্বাদ করি৷ তাঁর মৃত্যুর পর লিখেছিলাম :
হাতদুটো ধ'রে শুধু বলেছিলে আশীর্বাদ করি
আর যত কথা ছিল স্খলিত কন্ঠের থেকে
অশ্রুত মণ্ডলে যেতে যেতে
কখন আকাশ জুড়ে অগণিত তারায় তারায়
নৈঃশব্দ্যমালায় গাঁথা হল
শিরোধার্য করি সেই নিঃশব্দ মন্ত্রের স্বর
সারাটা জীবন৷

জগন্নাথবাবু সংসার করেননি৷ কাটিয়ে গেলেন সারাটা জীবন প্রায় সরোজ আচার্য-মঞ্জু আচার্যের বাড়িতে৷ ওখানে গেলে হিমুদার (সাংবাদিক ও লেখক হিমানীশ গোস্বামীর) সঙ্গে দেখা হয়ে যেত খুব৷ জগন্নাথবাবু মারা গেলে দিলীপবাবু তাঁর সম্পর্কে কত স্মৃতিচারণা করেছিলেন৷ স্যার বলতেন, ওঁর সংস্কৃত জ্ঞানের তুলনা নেই৷ সংস্কৃত পণ্ডিতের ছেলে ছিলেন৷ উত্তম সংস্কৃত লিখতেন৷ অনেকেই জানে না এই কথা৷ আমি গ্যুন্টার গ্রাসের "জিভ কাটো লজ্জায়" যখন অনুবাদ করি, তখন জগন্নাথবাবু কবিতার অংশটা আমাকে পরিমার্জনা ক'রে দিয়েছিলেন৷ আলোচনার সময় লক্ষ করেছি, শব্দ-উদ্ভাবনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন৷ সংস্কৃত গভীরভাবে না জানলে ওটা সম্ভব নয়৷ আর ওঁর ঋণও আমার শোধ হবার নয়৷
সুরেন সেনের (১৮৯০-১৯৫৯) কথা বলতেন কখনও কখনও৷ একদিন বললেন এত সুন্দর ও সুখপাঠ্য ইতিহাসের বই লিখেছেন যার তুলনা হয় না৷ বিশেষ ক'রে মহারাষ্ট্রের ইতিহাস৷ অনেকদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন৷ তারপর গেলেন দিল্লীতে ইম্পিপরিয়াল ডিপার্টমেন্ট অব ডকুমেন্টস-এ৷ এটাই পরে ন্যাশনাল আর্কাইভস হয়৷ শেষে ১৯৪৯-এ এসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পদে৷ মারাঠাদের ইতিহাসে তাঁর খুব আগ্রহ ছিল৷ "শিব ছত্রপতি" নামে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২০ সনে৷ ইংরেজীতে আরও কতকগুলি বই লিখেছিলেন তিনি৷ মানুষটি ছিলেন সরল ও সাদাসিধে, দেশ বরিশালে এবং ওই অঞ্চলের ভাষাটিই সবসময় ব্যবহার করতেন৷ রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত (১৯১৫-২০০৯) তখন দিল্লীতে অধ্যাপক৷ উনিও বরিশাল৷ স্নেহ করতেন তাঁকে৷ অনেক সময় ওঁকে নিয়েও কোথাও কোথাও যেতেন৷ দিল্লীতে আর্ট-এর এক পৃষ্ঠপোষকের বাড়ি সুরেনবাবুকে যেতে হত৷ সেখানে ওঁকে এর আগেও নিয়ে গেছেন৷ একদিন ঠিক করা হল আবার রবীন্দ্রকুমারবাবুকে উনি নিয়ে যাবেন৷ কারণ এদিন তাঁকে খুব দরকার৷ বললেন, রবি, চলো ওখানে একটু তাড়াতাড়ি চলে যাই৷ রবিবাবু বললেন, তা না, আমরা বরং আর একটু দেরী ক'রে যাই৷ আমি পাঁচটার সময় চা-টা খেয়ে চলে যাব৷ উনি বললেন, না না অত দেরীতে গেলে চলবে না৷ অনেক আলোচনা আছে৷ উনি বললেন, ওরা একেবারে চা টা কিছু দেয় না, আমার পরে বড় মাথা ধরে৷ সুরেনবাবু বললেন, না না ওরা দেবে৷ যা হোক, সুরেনবাবুর নির্বন্ধাতিশয্যে রবিবাবুকে তাড়াতাড়িই যেতে হল৷ গিয়ে কথা বলতে শুরু করার একটু পরেই দেখা গেল যে ট্রলিতে ক'রে চা এবং আরও আনুষঙ্গিক কিছু আসছে৷ সুরেনবাবু রবীন্দ্রকুমারবাবুকে ট্রলির দিকে আঙুল দেখিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলেন, "কি রবি, বলসিলাম না দিবে?" রবিবাবু তো লজ্জায় একেবারে অধোবদন৷

সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৯০-১৯৭৭) কথা বলতে গিয়ে খুব শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়তেন৷ বলতেন, ওইরকম মাপের লোক, অথচ কোনও অহমিকা ছিল না৷ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে কোনও কাজের জন্য এলে খানিকক্ষণ বাদেই উসখুশ করতেন৷ "দিলীপবাবু, ওই চা-টা একটু আনলেন না?" চা বলতে ওখানে ছিল উলটো দিকের ফুটপাতের ওপর স্টোভে তৈরি করা ভাঁড়ের চা৷ সেই চা-টি খেয়েই খুব তৃপ্তি বোধ করতেন৷ ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) ছিলেন সংস্কৃতের অধ্যাপক৷ দুর্ধর্ষ পণ্ডিত ছিলেন বেদ ও পাণিনি ব্যাকরণের৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন বি এ আর এম এ ক্লাসের জন্য বেদিক রীডার ক'রে দেবার জন্য৷ ক'রেও দিয়েছিলেন তিনি৷ উত্তম জার্মান জানতেন৷ তার ফলে সুবিধাও হয়েছিল৷ সংহিতাপাঠ থেকে পদপাঠ করবার জন্য আমাদের প্রাচীন যে বিধি ছিল, তার মধ্যে পণ্ডিতমশায়রা কোনও ফাঁক দেখলেই সেটাকে সুপাং সুলুক ব'লে মিলিয়ে দিতেন৷ কিন্তু ক্ষিতীশবাবু জার্মান জানতেন ব'লে তিনি ভাকেরনাগেল-এর আল্ট-ইন্ডিশে গ্রামাটিক (Alt-indische Grammatik, Jakob Wackernagel: ১৮৫৩-১৯৩৮ ) নামে বইখানা ব্যবহার করেছিলেন (বইটি সম্বন্ধে বটকৃষ্ণ ঘোষ তিনটি বিশেষণ ব্যবহার করেছিলেন, সেটা হল historical, descriptive এবং exhaustive)৷ বইটি আসলে সংস্কৃত ধ্বনিতত্ত্ব (Sanskrit phonology) ও বিশেষ্যসম্বন্ধী রূপতত্ত্ব (nominal morphology)নিয়ে৷ ভাকারনাগেল মারা যাবার পর তাঁর ছাত্র ডেব্রুনার (Albert Debrunner:১৮৮৪-১৯৫৮) কাজটা শেষ করেছিলেন বটে, তবে ক্রিয়াপদের ওপর কাজটা বাকিই ছিল৷ কার্ল হোফমান (Karl Hoffmann:১৯১৫-১৯৯৬)-কে কাজটি দেওয়া হলে তিনিও সেটি শেষ করতে পারেননি৷ তা যাই হোক, ভাকারনাগেল-এর বইটি পড়ে ক্ষিতীশবাবু ব্যাকরণের যে ফাঁকগুলি ছিল তা পূরণ করেন এবং তাঁর বইতে সঠিক টীকা দেন৷ এর ফলে বইগুলি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়৷ অনার্স স্তরে সংহিতাপাঠ থেকে পদপাঠ করতে আমাদের কোনও অসুবিধা হত না৷

তা এহেন ক্ষিতীশবাবুকে সুনীতিবাবু একদিন একটা অনুরোধ করলেন, বললেন, "ক্ষিতীশবাবু, আমি খানিকটা বেশ শ্লোক রচনা করেছি, আপনি যদি একটু দেখে দেন৷" সুনীতিবাবু তো আসলে সেইভাবে সংস্কৃতের লোক ছিলেন না৷ ক্ষিতীশবাবু বললেন, বেশ তো, দেব৷ কিন্তু এইবারই হল মুশকিল৷ ক্ষিতীশবাবু সুনীতিবাবুকে আর ধরা দেন না৷ দূর থেকে তাঁকে দেখলেই অন্য দিক দিয়ে পালান৷ এমন করতে করতে একদিন আর পালাতে পারেননি, ধরা পড়ে গেছেন৷ তখন দেখা হতেই সুনীতিবাবু একথা সেকথার পর তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, "ক্ষিতীশবাবু, আমি যে সেই শ্লোকগুলো দিয়েছিলাম আপনাকে, সেগুলো কি দেখেছেন?" ক্ষিতীশবাবু বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ দেখেছি বৈকি৷" সুনীতিবাবু বললেন, কেমন হয়েছে? ক্ষিতীশবাবু বললেন: "আপনার পক্ষে ভালই হয়েছে৷"
সুনীতিবাবু কিন্তু একটুও চটলেন না৷ বললেন: "তা তো বটেই, তা তো বটেই৷ আমি কি আর সংস্কৃত সেরকম শিখতে পারলুম৷"
সুনীতিবাবু তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ৷ ইচ্ছে করলেই তিনি ক্ষিতীশবাবুর ক্ষতি করতে পারতেন৷ কিন্তু ওসব তাঁর মাথাতেই আসেনি৷
স্যার প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর ইংরেজীর অধ্যাপক সুবোধ সেনগুপ্ত মশায়ের (১৯০৩-১৯৯৮) কথা খুব বলতেন৷ আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা সুবোধ সেনগুপ্ত সংস্কৃত শিখেছিলেন কবে এবং কোথায়৷ কারণ আনন্দবর্ধনের ধ্বন্যালোকের একটি বাংলায় লেখা টীকাসহ বই আছে তাঁর৷ তিনি তো বিদগ্ধ না হয়ে এই কাজটি করবেন না? উনি বললেন, হ্যাঁ, জানতেনই তো উত্তম সংস্কৃত৷ রাজশাহী কলেজে যখন গেলেন তখন পড়িয়ে এবং পড়াশুনা করেও খানিকটা সময় পেতেন৷ তাই ওখানকার কলেজ বা টোল "মহারাণী হেমন্তকুমারী কলেজ"-এর রমেশচন্দ্র তর্কতীর্থের (১৮৮১-১৯৬০) কাছে ধ্বন্যালোক পড়া শুরু করলেন৷ আসলে অতুলচন্দ্র গুপ্তের "কাব্যজিজ্ঞাসা" পড়েই তাঁর সংস্কৃত ইস্থেটিক পড়বার ইচ্ছা হয়েছিল৷ রমেশবাবু ছিলেন আবার নব্যন্যায়ের লোক, তাঁর এসব পড়াতে মোটে ভাল লাগত না৷ "এঃহ্! কাব্যের মধ্যে কোনও সারবস্তু আছে নাকি?" মাঝে মাঝে সখেদে বলতেন, "রঘুরপি কাব্যং তদপি চ পাঠ্যং, তস্যা চ টীকা সাপি কিং পাঠ্যা?" এইসব ছাইপাঁশ তিনি আগে পড়েননি৷ এইবার পড়লেন৷ ধ্বন্যালোক পড়া হয়ে গেলে সুবোধবাবু তাঁর কাছে মহিমভট্টের ব্যক্তিবিবেকও পড়লেন৷ মহিমভট্ট পড়িয়ে রমেশচন্দ্র খুব বীতশ্রদ্ধ৷ বলতেন এই লোকটার রসোপলব্ধির কোনও মৌলিকতাই নেই৷ পরে রসগঙ্গাধরও পড়েন সুবোধবাবু তাঁর কাছে৷ কিন্তু বেশ কিছু ঘটনাপরম্পরায় তর্কতীর্থ মশায়কে মানুষ হিসাবে তাঁকে উচ্চাসনে বসাতেন৷ তাঁর কথায় বলতেন, "সুখদুঃখেষু বিগতস্পৃহঃ৷" সুবোধবাবু সম্পর্কে স্যার আর একটি ঘটনা বলেছিলেন৷ প্রেসিডেন্সি কলেজের লনে ব'সে একত্রে বন্ধুরা, মানে অমলেশ ত্রিপাঠী, প্রতাপচন্দ্র চন্দ, সিদ্ধার্থশঙ্কর, এবং বোধ হয় আরও কেউ কেউ গুলতানি করছেন তখন৷ হঠাৎ কথা উঠল শেক্সপীয়রের কমেডি নিয়ে লেখা সুবোধবাবুর বই নিয়ে৷ সুবোধবাবু কয়েকদিন আগেই সখেদে বলেছিলেন যে শেক্সপীয়রের কমেডি নিয়ে লেখা তাঁর বইখানা তারকনাথ সেনকে (১৯০৯-১৯৭১) দিয়ে কত খুঁটিয়ে পরিমার্জিত ক'রে নানান পরামর্শ নিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে পাঠিয়েছিলেন৷ ছাপানোর জন্যে ওরা যদি অনুমোদন করে তাহলে ওখানেই ছাপা হবে৷ কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, সম্প্রতি জানতে পেরেছেন যে এই সময় একটা জাহাজডুবিতে নাকি সেই পাণ্ডুলিপিটির সলিলাবসান হয়েছে৷ অমলেশবাবু বললেন, যাক, বাঁচা গেল৷ অন্তত এই বইখানা আর আমাদের গিলতে হল না৷
পরে অবশ্য ১৯৫০ সালে এই বইটি বেরিয়েছিল৷ পাণ্ডুলিপি নতুন ক'রে পাঠাবার ফলে৷ বইটি প্রকাশের জন্য তাঁর বাইশটি বছর ব্যয় হয়েছিল জীবনের৷
স্যার তখন কৃষ্ণনগর সরকারী কলেজে আছেন৷ সূর্যোপাসনা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন৷ সংস্কৃত ও বাংলার বর্ষীয়ান অধ্যাপক চিন্তাহরণ চক্রবর্তীকে (১৯০০-১৯৭২) বলেছিলেন, স্যার সূর্যোপাসনা নিয়ে আমি কাজ করব, আমার লেখা যদি ক্রমে ক্রমে একটু দেখে দেন, তো খুব ভাল হয়৷ চিন্তাহরণবাবু বললেন, "আপনার আবার অভিমান নেই তো?" স্যার একটু অবাক হলেন৷ বললেন, "না, তা কেন? যেখানে ভুল হবে আপনি সেখানে আমাকে বলতেই পারেন৷ বলবেনও৷ না হলে আমি এগোব কি ক'রে?" চিন্তাহরণবাবু তাঁর লেখা আদ্যন্ত বিচার ক'রে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে দিতেন৷
এই প্রশ্নটা আমারও বরাবর ছিল যে লেখা একটু দেখে ব'লে দিন ত্রুটি কোথায় আছে৷ তিনি বলতেন, বেশ হয়েছে, ভাল হয়েছে৷ আমি বলতাম, স্যার, ত্রুটিগুলো দেখান৷ না হলে আমি এগোব কি ক'রে?
বলতেন যে না, তুমি যে জায়গাটায় আছ ঠিকই আছ৷ কিন্তু তোমার এগিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে৷ সেটা দেখাও যাচ্ছে৷ এগোও, নিজের ত্রুটি নিজেই বার করতে পারবে৷ তাঁর কথা আজ খুব মনে পড়ছে, কারণ যে লেখাটি নিয়ে এই কথাটা হয়েছিল, ইদানীং সেই রচনাটি নবকলেবরে বার করব ব'লে পুরোনো লেখাটা পড়তে গিয়েই হাড়গোড় সহ আমার রচনার কঙ্কাল বেরিয়ে আসছে৷

এখানে নিজের একটা সমস্যার কথা বলি৷ সেটা আমার অনূদিত টোমাস মান-এর "ভেনিসে মৃত্যু" নিয়ে৷
স্যারের সূত্রেই পরিচিত একজন রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞকে বইখানি দেওয়াতে উনি তার পাঠপ্রতিক্রিয়া হিসাবে বলেছিলেন এটা একটা জঘন্য কাজ হয়েছে৷ মনটা হয়তো তাৎক্ষণিক খারাপ হয়েছিল৷ কিন্তু আমাকে উনি কারণও বলেছিলেন৷ বললেন, "তোমার ভাষা ব্যবহার একেবারেই ভাল হয়নি৷ সহজ সরল বাক্য কোথায়? দূরে কোথাও জনপ্রাণী নেই – এমন সহজ বাক্যের পাশেই হয়তো একটা তৎসমগন্ধী বাক্য৷ গদ্যরী্তিতে ভারসাম্যের একটা অভাব প্রাণশক্তির অভাবই সূচিত করেছে৷" একজন বিচারকের দৃষ্টিকে মান্য করা উচিত, কিন্তু আমার যেদিকে চোখ গিয়েছিল, সেটা আমার অজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতার অভাব প্রসূত না, সেটা হল মূল জার্মান গদ্যের দৈর্ঘ্য, দার্ঢ্য ও জটিলতা৷ এইগুলিকে হাতে রাখতে গেলে যে সমস্যা হতে পারে সেটা আমার মাথায় কাজ করেছিল এবং বাংলা কানে টোমাস মান-এর গদ্যের যে ভাবগ্রাহিতা, তাকে বাংলায় বসিয়ে দেওয়া এইভাবে সবচেয়ে ভাল উপায়ে সম্ভব ব'লেই মনে হয়েছিল৷ সুতরাং মনে করেছিলাম যে গদ্যের এই ফর্মটাই যথোপযুক্ত হবে৷ জার্মান ভাষার সাহিত্য ব'লেই নয়, টোমাস মান-এর নিজের ভাষাব্যবহারে জার্মান পাঠকের মধ্যেও একটা অসন্তোষ আছে, বিভ্রান্তি আছে, যেমন: "নিছক আলঙ্কারিক গদ্য…" "যে ব্যাপারগুলো খুব জীবন্ত, বাস্তব হতে পারত, তা আয়রনি দিয়ে মুড়ে সরিয়ে ফেলা হয়েছে…" "মোদ্দা কথা দেখুন, এই মহৎ সাহিত্যিকের যত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অভিযোগ, ভদ্রলোক শ্রেণীর যাবতীয় মুদ্রাদোষ…" "লোকটার যেন গ্যোয়েটে সাজবার ধান্দা…" (গ্যুন্টার গ্রাস দেখুন, টোমাস মান পুরস্কার নিতে গিয়ে যে ভাষণ দেন, সেই বক্তৃতায় উল্লেখিত)৷ এর পর মান-এর গায়ে জল ঢেলে তাঁকে তরল ক'রে দেওয়া উচিত কিনা সেই প্রশ্নটা থেকেই যায়৷
জিজ্ঞেস করেছিলুম উজ্জ্বলদাকে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ড. উজ্জ্বল মজুমদার: ১৯৩৫-২০১৬?), তিনি বলেছিলেন এই অনুবাদের মধ্যে তিনি কোনও ত্রুটি দেখতে পাননি৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও এক দুজন গদ্যের এই "ফর্ম" দেখে অবাক হয়েছিলেন, আবুল বাশারও (জ. ১৯৫১) একদিন বলেছিলেন তিনি বিজ্ঞাপন দেখে সেইদিনই কলেজ স্ট্রীটে গিয়ে বইটি কিনে আনেন, পড়ে কিন্তু মোটেই হতাশ হননি৷ জয়-কে (জয় গোস্বামী: ১৯৫৪)একটি বই উপহার দিয়েছিলাম, সে পেয়ে উলটে পালটে দেখে নিজেই একটা জায়গা থেকে নিজকন্ঠে পাঠ করল৷ ইংরেজীর অধ্যাপিকা কৃষ্ণা সেন বলেছিলেন, "খুব লীরিক্যাল৷" মূল রচনা সম্পর্কেও একথা অনেক সমালোচক বলেছেন৷ কবি শঙ্করনাথ চক্রবর্তী বলেছিলেন, প্রথম অনুচ্ছেদ পড়েই তাঁর মনে হয়েছিল যে ইংরেজী অনুবাদক লো পোর্টার-এর অনুবাদ থেকে যেমন মনে হয়েছিল, মূল তেমনটি নয় মোটেই৷ বলেছিলেন বাংলা গদ্যটাও খুব শক্তিশালী, যা ওইরকম মাপের একজন জার্মান সাহিত্যরচয়িতার পক্ষে মানানসই৷ বলা বাহুল্য এখানে আমার ব্যক্তিগত কথাটা আসেনি, সাধারণভাবে সমস্যা ও সমস্যার মোকাবিলার কথাটাই প্রাধান্য পেয়েছে৷ স্যার নিজেও বলেছিলেন যে এ ধরণের টেক্সট-এর অনুবাদে আমাদের নিজস্ব ভাষা নিয়ে একটা সমস্যা থাকেই৷ তিনি নিজে উত্তম ফরাসী জানতেন, বটকৃষ্ণ ঘোষের (১৯০৫-১৯৫০) "P"-এর ওপর লেখা থিসিস তিনি ইংরেজীতে অনুবাদও করেছিলেন (Nominal and verbal formations in -p- in Sanskrit, tr. by Dilip Kumar Biswas. Sanskrit Pustak Bhandar, 1982)৷ তখন আমি তাঁকে বললুম লো পোর্টার-এর কথা৷ মান তো তাঁর ওপর খেপেই গিয়েছিলেন৷ কারণ তিনি তাঁর রচনাটিকে আদ্যন্ত সহজপাচ্য করবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন৷ কেনেথ বার্ক খারাপ না, কিন্তু তিনি আবার একটু বেশী নীরস৷ কাজের দিকে নয়, বরং পাঠকের দিকেই যেন তাঁরা তাকিয়ে আছেন হাঁ ক'রে৷ এতটাই যে মূল রচনার ছবি বা রঙ কোনওটাই তাঁরা রক্ষা করতে পারেননি৷ টোমাস মান-এর উচ্চতার ধারে কাছে ওঁরা নেই৷ ডেভিড লিউক-এরও একটা অনুবাদ আছে বটে এই বইয়ের৷ সেও তথৈবচ৷ জেফারসন চেস বরং একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন অ্যাংলো আমেরিকান-এ অনুবাদ করবার সময়৷ মাইকেল হেনরি হাইম বোধ হয় সবচেয়ে ভাল অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজীতে, প্রত্যেকে নিজের মত ক'রে অনুবাদের চেষ্টা করলেও হাইম-ই বোধ হয় একমাত্র সফল৷ বাংলাভাষার অভিব্যক্তির প্রকৃতির মধ্যে টোমাস মান-এর গদ্যের গঠনপ্রকৃতিকে কতখানি ঢেলে সাজানো যায় সে নিয়ে ভাবনা চিন্তার অবকাশ আছে৷

"ভেনিসে মৃত্যু"-র আগে আমি গ্যুন্টার গ্রাস-এর কলকাতা-কেন্দ্রিক ৎসুঙে ৎসাইগেন নামে জার্মান ভাষায় লেখা বইটির বাংলা অনুবাদ করি, যার নাম "জিভ কাটো লজ্জায়৷"এটি আমার প্রথম বই৷ সবসময় খোঁজ নিতেন কতটা হল৷ কিছুদিন না গেলে ফোনও করতেন৷ মাঝে মাঝে অনুবাদ নিয়ে গিয়ে তাঁর সামনে পড়ে শোনাতাম৷ বলতেন, খুব ভাল হচ্ছে, উৎসাহ দিতেন৷ বইটির মধ্যে গ্রাস এমন এমন কিছু কথা বলেছিলেন যা এদেশে রাজনৈতিকভাবে আপত্তিকর হতে পারত৷ স্যার বললেন, "ওগুলো অনুবাদ ক'রে দিও, কিন্তু প্রকাশককে জানিয়ে রেখো৷ কারণ বই প্রকাশ করবেন তিনিই৷" এক জার্মানজ্ঞ কবি কাজটাকে কেড়ে নিতে না পেরে প্রকাশককে ভয় দেখিয়ে এসেছিলেন, বলেছিলেন যে বই প্রকাশ হলে সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করবে৷ প্রকাশক ভয় না পেলেও কতকগুলি জায়গা বাদ অবশ্যই দিয়েছিলেন৷ বইটা প্রকাশিত হলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল পাঠক সমাজে৷ স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন, আমাকে কিছু বলেননি, কিন্তু তাঁর আর এক ছাত্র, বয়সে আমাদের অনেক বড়, সরকারী কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক দিলীপদা, দিলীপ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে বলেছিলেন, "এই অনুবাদটা অনুবাদের মডেল হওয়া উচিত৷" এটা আমার কাছে একটা বড় পুরষ্কার৷

এই প্রসঙ্গে বলতে পারি যে বাংলায় অনুবাদসাহিত্য সামগ্রিকভাবে একটা খুব অপরিণত চর্চার ফসল, মনে হয় যেন শৈশবাবস্থায় রয়েছে৷ অনুবাদ যদি আমাদের সাহিত্যে সত্যিই বিপুলভাবে হয়ে থাকে, তাহলে বলব, সে বাংলাদেশে৷ সেদিক থেকে বাঙালী হিসাবে খুব গর্ব অনুভব করি৷ কিন্তু তার মান সামগ্রিকভাবে কেমন সেকথা আমার পক্ষে বলা খুব মুশকিল৷ এছাড়া অনুবাদ নিয়ে আলোচনা সভা যতখানি হওয়া উচিত তার সিকির সিকি ভাগও হয় কিনা সন্দেহ৷ আমাদের দেশে সাহিত্য অকাদেমীর অমন দুচারটে অনুবাদ কর্মশালায় আমি গিয়েছি বটে, তবে সেখানে চিরকালই সেই একই ঘ্যানঘ্যানানি, বিশ্বস্ততা ও অবিশ্বস্ততা নামে কতকগুলি বস্তাপচা কথা নিয়ে আলোচনা হয়৷ ইউরোপে এ নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও কাজ হয়, তদুপরি এটা যে একটা প্রয়োজনীয়তা, সে সম্পর্কে তাদের সদাজাগ্রত মন৷ এ নিয়ে স্যারের সঙ্গে আমার কত আলোচনা হত৷ বলতেন এই অনুবাদ ক'রে ক'রেই তো খৃষ্ট ধর্ম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল৷ গ্যুন্টার গ্রাস তো তাঁর প্রতিটি বই অনুবাদের কথা উঠলে অনুবাদকদের নিয়ে সম্মেলন করতেন৷ একসঙ্গে বিভিন্ন ভাষার অনুবাদক সেখানে উপস্থিত থাকতেন৷ শব্দ, বাগধারা, পশ্চাৎপটের ব্যাখ্যা, ইতিহাস, সব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচিত হত, আলোচনার খসড়াও বার হত৷ অনুবাদ যে লক্ষ্যভাষাকে কতখানি সমৃদ্ধ ক'রে দিতে পারে, তার খাত কতটা রূপান্তরিত করতে পারে সেসব নিয়ে ভাবনা চিন্তাটা লোকে ঠিক গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে না৷ দিলীপবাবু নিজে খুব প্রাণিত হয়ে এই বিষয়ে কথা বলতেন সবসময়৷ স্যারের ভাবনা চিন্তার ক্যানভাসটা এত বড় ছিল যে কোনও কিছুই তাঁর আলোচনার বিষয়ের বাইরে যেতে পারত না৷ তাঁর সঙ্গে আলোচনা ক'রে যেমন অনেক কিছু জানতে পারতাম, তেমনি তৃপ্তও হতাম৷
বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-১৯৭৪) অনূদিত রিলকের কবিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল একদিন৷ তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর অনুবাদগুলি মূলের সঙ্গে আমি মিলিয়ে প'ড়ে দেখেছি কিনা৷ আমার মনে আছে বলেছিলাম, খুব উপযুক্ত অনুবাদ হয়নি৷ তবে এটা যে বলেছিলুম, সেটা শ্রদ্ধা সহকারেই৷ বলেছিলাম যে রিলকের কবিতা বাংলায় পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে যেন বুদ্ধদেব বসুর কবিতাই পড়ছি৷ কবি সাহিত্যিকদের একটা অসুবিধা হল তাঁরা নিজেদের শৈলীকে বড় একটা ছাড়াতে পারেন না৷ সচেতনই নন বেশীর ভাগ কবি সাহিত্যিক৷ কিন্তু কেউ বলতে পারবেন না যে সঠিক অর্থ থেকে বুদ্ধদেব বসু কোথাও বিচ্যুত হয়েছেন৷ প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তাঁর অসম্ভব জ্ঞান গোটা বইটির মধ্যে ছড়িয়ে আছে৷


ছবি: দিলীপকুমার বিশ্বাস ও তাঁর স্ত্রী ভারতী বিশ্বাস – লেখকের তোলা

দিলীপবাবুর পিতামহ দ্বিজদাস (১৮৬০-১৮৯২) যে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর প্রভাবেই৷ এজন্য তিনি শান্তিপুরের বাসভূমি থেকে বিতাড়িত হন৷ পোস্টাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন৷ মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়৷ সেসময় দিলীপবাবুর বাবা জিতেন্দ্রকুমার বিশ্বাসের (১৮৮৮-১৯৬৫) বয়স মাত্র চার বছর৷ দ্বিজদাসের স্ত্রী গিরিবালা এক পুত্র ও ছয় বছর বয়সের এক কন্যা নিয়ে অকুল পাথারে পড়েন৷ মৃত্যুর পূর্বে দ্বিজদাস শিবনাথ শাস্ত্রীকে অনুরোধ ক'রে যান পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ করতে৷ গিরিবালা সেলাই ফোঁড়াই ও ফুলের সাজি তৈরি ক'রে খানিকটা সামাল দিতেন৷ বাংলা ও ইংরেজী পড়াতেন ছেলেমেয়েদের৷ শাস্ত্রীমশায়ও তাঁর দায়িত্ব পালন করতেন৷
দিলীপবাবুর জন্ম ৭ জুলাই, ১৯২০-তে কটকে তাঁর মামাবাড়িতে৷ মা নর্মদা কর (১৮৯২-১৯৮৪) কটকের স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ ক'রে কলকাতায় আসেন বেথুন কলেজে পড়তে৷ তাঁর বাবা বিশ্বনাথ কর (১৮৬৪-১৯৩৪) ছিলেন "উৎকল সাহিত্য" পত্রিকার সম্পাদক৷ ওঁর মা নর্মদা দেবী ১৯১০ সালে কলকাতার বেথুন কলেজে এসেছিলেন পড়তে৷ এই সময় তাঁর ১৭ বছর বয়স৷ ১৯১৪-তে বি.এ পাশ করেন৷ সেসময় অধ্যক্ষা ছিলেন কুমুদিনী দাস৷ তখন ইংরেজী পড়াতেন পরেশনাথ সেন ও বিজয়গোপাল মুখোপাধ্যায়, সংস্কৃত পড়াতেন দেবেন্দ্রনাথ রায়, বোটানি হেমপ্রভা বসু৷ ইতিহাস পড়াতেন সুরবালা ঘোষ ও অক্ষয় সরকার৷ আই এ তে তিনি বাংলা নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু বিএ-তে নিয়েছিলেন ওড়িয়া৷ নর্মদা দেবীর বাবা খুব উত্তম বাংলা জানতেন৷ ছুটিছাটায় বাড়িতে গেলে নর্মদা তাঁর বাবার কাছেই আই. এ.-র বাংলাটা পড়ে নিতেন৷ তাঁর একটি স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৯-তে বেথুন কলেজের শতবার্ষিকীর সময়৷ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বড় মেয়ে শান্তা দেবী (১৮৯৩-১৯৮৪) পড়তেন তাঁর সঙ্গে৷
দিলীপবাবুর বাবা জিতেন্দ্রনাথ প্রথমে ওকালতি শুরু করেন ওড়িশার শোনপুর স্টেট-এর বিজয়চন্দ্র মজুমদারের কাছে৷ অবিভক্ত বঙ্গে পরে বিচারক হিসাবে যোগ দেন৷ যেজন্য তাঁকে নানাস্থানী হতে হত৷ পূর্ববঙ্গের গাইবান্ধার পর তিনি তমলুকে স্থানান্তরিত হন৷ এখানে এসে স্যার তমলুক হ্যামিলটন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন৷ পড়েন ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত৷ স্কুলে সহপাঠী হিসাবে পান অমলেশ ত্রিপাঠীকে, পরে বাবা বরিশালে চলে যাবার কারণে আর এই স্কুল থেকে পরীক্ষা দিতে পারেননি৷ পিরোজপুর সরকারী স্কুলে (১৯৩৪-১৯৩৬) সহপাঠী অরুণ রায় চৌধুরী তাঁর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হন, যাঁর অনুজ ছিলেন ঐতিহাসিক তপন রায় চৌধুরী (১৯২৬-২০১৪)৷ এখান থেকেই ১৯৩৬ সনে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন৷ এর পর চলে আসেন কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে৷ ভর্তি হন আই এ ক্লাসে৷ তারপর বি এ পাশ করেন ১৯৪০-এ৷ এর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৪০-১৯৪২)থেকে এম এ পাশ করেন৷


ছবি:নীহাররঞ্জন রায়ের


ছবি: রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়


ছবি: সুশোভন সরকার


ছবি: হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী

কাদের পেয়েছেন শিক্ষক হিসাবে? প্রেসিডেন্সি-তে ইংরেজীর প্রফুল্ল ঘোষ, হামফ্রে হাউজ, সুবোধ সেনগুপ্ত, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, তারকনাথ সেন, হিরণকুমার ব্যানার্জি; বাংলা ও সংস্কৃতের প্রধান রাধাগোবিন্দ বসাক, শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য (অংক ও ইংরেজীতেও তিনি অসাধারণ ছিলেন), গৌরীনাথ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী, শশাঙ্কশেখর বাগচী (বাংলা ও তুলনামূলক দর্শন); ইতিহাসে প্রধান ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ সেন, সুশোভন সরকার (১৯০০-১৯৮২), উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল, সুরেশচন্দ্র মজুমদার; দর্শনে প্রধান প্রভু দত্তশাস্ত্রী (১৮৮৫-?) (ইনি ছিলেন পাঞ্জাবদেশীয়:রাজশাহী কলেজেও ছিলেন), ড. নলিনীকান্ত ব্রহ্ম, মহেন্দ্রনাথ সরকার, আবু সঈদ আইয়ুব (১৯০৬-১৯৮২) (মহেন্দ্র সরকার বিলেত গেলে তাঁর শূন্যস্থানে আসেন); সিভিক্স পড়াতেন ড. যোগেশচন্দ্র সিংহ, উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল (জুনিয়র)৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ইতিহাস বিভাগের প্রধান ছিলেন হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী (১৮৯২-১৯৫৭) (দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকরের পর: ১৮৭৫-১৯৫০), হেমচন্দ্র রায় , প্রবোধচন্দ্র বাগচী (১৮৯৮-১৯৫৬), বিনয়চন্দ্র সেন, দীনেশচন্দ্র সরকার (বয়সে তিনি তখন সকলের চেয়ে ছোট:১৯০৭-১৯৮৫), কালিদাস নাগ (স্যারকে তিনি পুত্রবৎ স্নেহ করতেন:১৮৯২-১৯৬৬), স্টেলা ক্রামরিশ (১৮৯৬-১৯৯৩), জিতেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি (হেমবাবুর পর তিনি কারমাইকেল অধ্যাপক হন, এঁর কাছে স্যার পি এইচ ডি শুরু করলেও পরে ছেড়ে দেন), সরসীকুমার সরস্বতী (১৯০৬-১৯৮০), নীহাররঞ্জন রায় (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক ছিলেন৷ কিন্তু ক্লাসও নিতেন: ১৯০৩-১৯৮১), এছাড়া যাঁরা আংশিক সময়ের অধ্যাপক ছিলেন তাঁরাও ছিলেন, যেমন ড. ই. এন. ঘোষাল, ড. রাধাগোবিন্দ বসাক (১৮৮৫-১৯৮২) ও কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামী৷ পালি-তে ছিলেন বেণীমাধব বড়ুয়া (১৮৮৮-১৯৪৮), নলিনাক্ষ দত্ত (১৮৯৩-১৯৭৩)৷ চারুকলায় ছিলেন দেবপ্রসাদ ঘোষ (১৮৯৪-১৯৮৫) এবং শাহেদ সুরাবর্দি (১৮৯২-১৯৬৩)৷ শেষোক্ত অধ্যাপক স্প্যানিশ ও রুশ ভাষাও পড়াতেন৷ তখন শিক্ষায় একটা আন্তঃশাস্ত্রীয় পদ্ধতি চালু ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ এঁদের সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিচারণ আছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঁচাত্তরতম জন্মবার্ষিকী গ্রন্থে৷
যাঁদের কাছে পড়েছেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন যাঁরা খুব ভাল পড়াতেন৷ এঁরা হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী, প্রেসিডেন্সি-তে সুশোভন সরকার, ইংরেজী সাহিত্যে প্রেসিডেন্সি-তে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ (১৮৮৩-১৯৪৮) ও শিবপ্রসাদ ঘোষ৷ সংস্কৃত কলেজে টোলে শ্রীমোহন তর্কবেদান্ততীর্থের কাছে পরবর্তীকালে পড়েছেন শাঙ্করভাষ্য সহ বৃহদারণ্যক উপনিষদ, বেদান্ত পরিভাষা, বিবরণপ্রমেয় সংগ্রহ৷ হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী, সুশোভন সরকার এবং শ্রীমোহন তর্কবেদান্ততীর্থ তাঁর মতে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন৷
সহপাঠী হিসাবে পেয়েছেন অমলেশ ত্রিপাঠী, সত্যজিৎ রায়, প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য, রণজিৎ গুপ্ত, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় প্রমুখকে৷
ওঁর একটা কথাই ছিল যে তিনি ব্রিটিশের চাকরী করবেন না৷ তাই শান্তিনিকেতনে সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসাবে যোগ দেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়৷ গ্রন্থাগারিক ছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়৷ সেসময় সেখানে পেয়েছেন রামকিঙ্কর বেজ, নন্দিতা কৃপালনি, রাণী চন্দ ও দিনকর কৌশিককে৷ ১৯৪৫-এ যোগ দেন সিটি কলেজে৷ পরে দেশ স্বাধীন হলে যখন সরকারী কলেজগুলি থেকে মুসলিম অধ্যাপকরা পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাচ্ছেন, তখন অনেক শূন্যপদ তৈরি হয় এবং সুবোধ সেনগুপ্ত মহাশয়কে নিয়ে Education Partition Council স্থাপিত হয়৷ সুবোধবাবু ওঁকে সরকারী কলেজে যোগ দিতে বলেন৷ ১৯৪৮ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত দিলীপকুমার বিশ্বাস সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করেন৷ পড়িয়েছেন কৃষ্ণনগর, দার্জিলিঙ, কুচবিহার, প্রেসিডেন্সি —আর সবশেষে সংস্কৃত কলেজে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান হয়ে৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আংশিক সময়ের অধ্যাপক হিসাবে পড়িয়েছেন ১৯৬০ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত৷ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক ছিলেন ১৯৭০-১৯৭৫ ও সভাপতি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত৷ এছাড়া এশিয়াটিক সোসাইটির সভাধিপতি ছিলেন ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত৷ ১৯৮৪-তে "রামমোহন সমীক্ষা"-র জন্য পান রবীন্দ্র পুরষ্কার, একই বছরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দেন সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক৷ ১৯৮৫-তে পান কালিদাস নাগ স্মারক পুরষ্কার, ২০০০-এ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী শতবার্ষিকী স্বর্ণপদক, একই বছরে পান Honourary Fellowship Of The Asiatic Society.

বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ হয়, সদস্য না হয়েও দিলীপবাবু উদয়ন চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে তাঁদের হয়ে কাজ করতে থাকেন৷ প্রথমে ফ্রি ইন্ডিয়া বুলেটিন নামে একটা পত্রিকা তাঁরা আংশিক বিক্রী করতেন দু আনায়, আংশিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সেঁটে দিতেন৷ এতে থাকত সরকারী ছাড়পত্র না পাওয়া (uncensored) খবর, ব্রিটিশদের অত্যাচারের ঘটনাগুলি এবং একটি সম্পাদকীয় কলম৷ পরে স্বাধীন ভারতের (নিষিদ্ধ)প্রথম বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করতেন ইংরেজী অনুষ্ঠান ৪১.৬৮ মিটার ব্যান্ড-এ, শর্ট ওয়েভ-এ৷ হিন্দিতে বলতেন মোহন সিং স্যাণ্ডার৷ এটা ছিল রামমোহন লোহিয়ার পরিকল্পনা৷ রাত নটা থেকে শুরু হত অনুষ্ঠান : This is a Congress Radio Calling from somewhere in India. Hallo everybody! Here is the news – এই কথাগুলিই ব'লেই খবর পড়তেন তাঁর সহযোদ্ধা উদয়ন চট্টোপাধ্যায়, থাকতেন উদয়নের অনুজ সম্বরণ, দিলীপবাবু পড়তেন একটি কথিকা, আর সে খবর শোনা যেত উত্তর ভারত, এমন কি আবহাওয়া অনুকুল থাকলে সুদূর বর্মা দেশ থেকেও৷ স্যাবোটাজ-এর খবর থাকত, ব্রিটিশদের অত্যাচারের খবর থাকত৷ প্রথম দিকে নটা থেকে নটা পনেরো, এবং অবিলম্বে জনপ্রিয় হলে অনেকক্ষণ চলত৷ ধরা পড়ার ভয়ে এক একদিন এক এক জায়গা থেকে সম্প্রচার হত৷সেসময় Anti-Piracy Detection Van তখন কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত৷ বেশীর ভাগই ভাড়া বাড়ি থেকে, পরিত্যক্ত জায়গা থেকে তাঁরা সম্প্রচার করতেন৷ একদিন তো বরানগরে জাপানী বোমাবর্ষণ হয়, তাঁরা ঝাড়া তিন ঘন্টা হোসপাইপের মধ্যে শুয়ে কাটান৷ উদয়ন গ্রেপ্তার হন ১৯৪৩-এ, যদিও এই বেতার সংযোগের অস্তিত্ব পুলিশ ঘুণাক্ষরেও তাঁর কাছ থেকে জানতে পারেনি৷ দিলীপবাবু ধরা পড়েননি কখনও, কিন্তু পুলিশ সন্দেহ করে তাঁকে শেষের দিকে৷ লর্ড সিনহা রোডে ডাকাডাকি শুরু হল৷ কিন্তু তখন স্বাধীনতা একেবারে দোরগোড়ায়৷

মুম্বইয়ে ঊষা মেহতা পরিচালিত কংগ্রেসের বেতার কেন্দ্র সম্পর্কে সকলে অবগত আছেন৷ কিন্তু কলকাতায় সেই প্রচেষ্টার কথা সম্পূর্ণ অজানা থেকে গেছে৷ অন্তত উইকিপেডিয়াতে এই খবরটি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার৷ তথ্য আরও আছে৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দী সেনাদের মু্তিতর জন্য ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়৷ ২১ নভেম্বর ১৯৪৫-এ কলককাতার ধর্মতলায় যে বিশাল সমাবেশ হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন ছাত্র কংগ্রেস নেতা দিলীপকুমার বিশ্বাস৷ নিহত হন রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২৫-১৯৪৫)৷
আড্ডার কথাটাই বলতে পারি৷ তাঁর ভাণ্ডারে কত যে গল্প, পুরোনো ভুলে যাওয়া প্রসঙ্গ ও স্মৃতিকথন ঘরে ফিরে এসেছে, যা তাঁর শৈশবের, যৌবনকালের বা আরও কত প্রাচীন কালের, জানা-না-জানা কথার সঙ্গে আমাদের ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত এনে দিয়েছে৷ এক ব্যাপক গণ অভ্যুত্থানের শুরু হয়৷

একদিন ক্ষিতিমোহন সেনের কথা উঠল৷ বললেন, আমরা যখন অবিভক্ত উত্তরঙ্গের গাইবান্ধায় ছিলাম, ক্ষিতিমোহন সেন এসে আমাদের বাড়িতে এক সপ্তাহ ছিলেন৷ আগে থেকেই লিখে পাঠিয়েছিলেন, যেতে পারি, কিন্তু আমার জন্যে বেলের বন্দোবস্ত রাখা চাই, ওটা ছাড়া আমার চলে না৷ এখান ওখান থেকে বেল সংগ্রহ করা হল৷ আমরা বালকেরা তো ওঁর ফাই-ফরমাশ খাটতে পারলে কৃতার্থ হয়ে যেতাম৷ তা বেলের ওপর খোলাটাও তিনি ভিজিয়ে রাখতে বলতেন৷ খোলা নরম হয়ে গ'লে জলের সঙ্গে মিশে গেলে পরদিন উনি খেতেন৷ ১৯৪৪-এ দিলীপবাবু শান্তিনিকেতনে যান সহকারী গ্রন্থাগারিকের চাকরী নিয়ে৷ তখন ক্ষিতিমোহনকে পান সেখানে৷ বলেন ওখানে চা-চক্রে বিকেলবেলা আমাদের আড্ডা হচ্ছে, তখন কতই বা আমার বয়স! আড্ডায় ছিলেন সেদিন অনিল চন্দ, ক্ষিতীশ রায়, আরও কেউ কেউ, এবং তৎসহ জ্ঞান চট্টোপাধ্যায়৷ জ্ঞানবাবুর বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি প্রচণ্ড সিগারেট খেতেন এবং সেই সঙ্গে প্রবল কাশতেন৷ এইসবই চলছে তখন, সেসময় ক্ষিতিমোহন বিদ্যাভবন থেকে নেমে বাড়ির দিকে চলেছেন, গায়ে ফতুয়া, পরনে ধুতি এবং কাঁধে একটি ঝোলা৷ সেসময় এই রকমই পোশাক আশাক ওঁদের, বিধুশেখর শাস্ত্রীরও ওইরকম পরিচ্ছদ ছিল৷ ক্ষিতিমোহন সকলকে দেখে বললেন, কি হচ্ছে সব, অ্যাঁ, চা খাওয়া হচ্ছে বুঝি? জ্ঞানবাবু তো ওঁকে দেখতে পেয়েই সিগারেটটি ফেলে দিয়েছেন, আর গাল মন্দ করছেন, অবশ্য অতি মার্জিত ভাষায় এবং নিচু গলায়৷ কিন্তু ওই ৫৫৫ সিগারেটের টিনটা কোথাও সরাতে না পেরে পিঠে লুকিয়েছেন৷ ক্ষিতিমোহন ওই অবস্থায়ই তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন৷ জ্ঞানবাবুও কথা বলছেন, আর সিগারেটের কৌটোটিও পিঠের দিকে ক্রমাগত ঠেলে চলেছেন৷ তারপর ক্ষিতিমোহনবাবু যথারীতি চলে গেলেন, কিন্তু মাঠে নামবার আগেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন৷ পিছন ফিরে বললেন, জ্ঞান, তুমি যে বস্তুটি ওখানে লুকিয়ে রেখেছ সেটা কিন্তু তোমার কাশির ওষুধ নয়৷ জ্ঞানবাবু থমকে গেলেন৷ তারপর ক্ষিতিমোহন দৃশ্যের বাইরে যেতেই আবার তাঁর গালমন্দ শুরু হল৷

আর একদিনের কথা৷ মডার্ন রিভিউ-এর প্রসঙ্গেই প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কথা উঠল৷ বললেন একবার লীগ অব নেশনস্ থেকে প্রস্তাব এসেছিল তিনি তাঁদের অর্থে তাঁদের ওখানে ঘুরে এসে তাঁদের সম্পর্কে প্রতিবেদন লিখবেন৷ রামানন্দবাবু বললেন, গেলে আমি নিজের অর্থেই যাব৷ তা না হলে নিরপেক্ষভাবে লিখতে পারব না৷ গিয়েছিলেনও তাই৷ উঠেছিলেন রজনীকান্ত দাসের বাড়িতে৷ জেনিভা-র লীগ অব নেশনস্-এর জেনারেল অ্যাসেম্বলি সেশন-এ যোগও দিয়েছিলেন৷ রজনীকান্ত দাস আবার নিরামিষাশী ছিলেন৷ সুতরাং ওঁর বাড়ির শাকপাতা খেয়ে রামানন্দবাবুর নিমোনিয়া হয়ে গেল৷ যাহোক, চিকিৎসায় ভাল হলেন এবং ভালোয় ভালোয় দেশে ফিরে এসে লিখলেনও৷


ছবি: আচার্য যদুনাথ সরকার

আচার্য যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮) রাজশাহীর লোক ছিলেন, তাঁর বাবা রাজকুমার সরকার (১৮৩৯-১৯১৪)ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত জমিদার৷ স্যার বললেন একদিন শিয়ালদার রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, দেখি উনি পাঁঠার মাংস কিনছেন৷ আমার ধারণা পারিবারিক সূত্রে স্যারের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল তাঁর৷ বললেন, পাঁঠার মাংস কিনতে হলে এই দোকানটাতেই আসি৷ মাংসটা এখানে ভাল৷ সময়টা কখন আমার জানা নেই৷ তবে নিশ্চয় ১৯৩৮-এর আগে৷ দেখা হতে কথা শুরু করলেন৷ অবাক হলাম৷ সেই বাদুড়বাগানের বাড়ি থেকে এসে? স্যার বললেন, তিনি বরাবর নিজে হাতেই বাজার করতেন৷ এমন কি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকবার সময়েও৷ বাদুড়বাগান থেকে থলি হাতে নিয়ে সুকিয়া স্ট্রীট ধ'রে শ্রীমানি মার্কেট৷ আর অন্যদিকে কেউ ওঁর কাছে গবেষণা করতে চাইলে আগে জিজ্ঞেস করতেন আরবি ফারসী জানে কিনা৷ না জানলে শিখে আসতে বলতেন৷ স্যার বললেন রায়টের সময় ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ ওঁর বড় ছেলে ট্রাম থেকে ধর্মতলায় নেমেছেন, এমন সময় এক অজ্ঞাত পরিচয় লোক তাঁকে ছোরা মেরে খুন ক'রে দেয়৷ সে কি অবস্থা! সুনীতিবাবু ও নীহাররঞ্জন রায় ছুটে গেলেন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর লেক টেরাস-এর বাড়িতে৷ গিয়ে দেখলেন যদুনাথ তাঁর গ্রন্থাগারের এককোণে ব'সে একটা বই থেকে কি একটা টুকে নিচ্ছেন৷ ওঁরা গিয়ে পড়লেন সেখানে, স্যার আপনি এখনও এখানে? যদুনাথ চেঁচিয়ে বললেন, তাহলে আমাকে কি করতে বল, ব'সে ব'সে মাথার চুল ছিঁড়ব?
শিয়ালদার কথা উঠতে মনে পড়ল, একদিন তিনি হেঁটে যাচ্ছেন, হঠাৎ সামনে পড়ল একটা ঘোড়ার গাড়ি৷ দরজা খুলে গেল৷ দেখলেন রথী ঠাকুর৷ দিলীপবাবু, নমস্কার৷ হাতজোড় ক'রে নমস্কার জানালেন এককালীন শান্তিনিকেতনের সহকারী গ্রন্থাগারিক অনুজপ্রতিমকে৷

বিশেষ কারণে মনে আছে ১২ ডিসেম্বর ১৯৯৩-এর কথা৷ সাহিত্য অকাদেমীর এক আমলা কয়েকদিন আগে আমাকে বলেছিলেন যে ফকীরমোহন সেনাপতির (১৮৪৩-১৯১৮) বংশের একজন তাঁর আত্মচরিতের যে বঙ্গানুবাদ করেছেন তা নাকি অতি প্রামাণ্য৷ কথাটা স্যারকে বলতে তিনি বললেন, দেখেছি৷ অনুবাদ মোটেই ভাল হয়নি৷ মূলের Force কোথায়? আলেখ্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ওই বইয়ের অনুবাদ স্যার নিজেও করেছিলেন মূল ওড়িয়া থেকে (আলেখ্য৷ আরম্ভ হয়েছিল শারদীয়া ষষ্ঠ বর্ষ ১৩৮২-১৩৮৭- ৩য় সংখ্যায় শেষ৷ [ষষ্ঠ বর্ষ ১ম সংখ্যা-একাদশ বর্ষ, ১৩৮৭, তৃতীয় সংখ্যা পর্যন্ত৷ আংশিক প্রকাশিত "ঐতিহাসিক' জানুয়ারী-এপ্রিল])৷ তাঁর মাতুল বংশ ওড়িয়াভাষী, মায়ের কাছেই তাঁর ওড়িয়া ভাষা শিক্ষা৷ উত্তম ওড়িয়া জানতেন স্যার৷ ওড়িয়াদের মতই৷ আর মাও তো দীর্ঘজীবী ছিলেন৷ ১৯৮৪-তে বিরানব্বই বছর বয়সে তিনি মারা যান৷ আমার ধারণা তাঁর কাছ থেকেও তিনি অনুবাদের কাজে সাহায্য পেয়েছিলেন৷ অকাদেমীর কাজটি পুলিনবিহারী সেন-কে ধ'রেই হস্তগত করা হয়৷ পুলিনবাবু পরে বলেছিলেন যে ফকীরমোহনের বংশধর, তাই সুপারিশ করেছিলাম৷ উনি জানতেন না যে দিলীপবাবু করেছিলেন৷ অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, দিলীপই ছিল এই অনুবাদের যোগ্য ব্যক্তি৷ কাজটা ওকে দেওয়া হল না কেন? শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায় দিলীপবাবুকে বইটার একটা রিভিউ লিখতে দিয়েছিলেন, সেটা অবশ্য তিনি ক'রে দেন৷ কথা প্রসঙ্গে স্যার বলেন, ফকীরমোহনের ভাষা "গড়জাত" এলাকার ভাষা৷ গড়জাত এলাকা পাহাড়ী ও জঙ্গলাকীর্ণ ব'লে ওখানে মুসলমানেরা পর্যন্ত ঢুকতে পারেনি৷ তাই তার ভাষা অতি archaic features-এ সমৃদ্ধ৷ একটা দুটো নমুনা স্যার দিয়েছিলেন৷ "আপনি বিজে করিবেন কি?" "বিজে" করা মানে "যাওয়া৷" ওখানে ভুল অনুবাদ করা হয়েছিল৷ অনুবাদিকা "উপস্থিতকবি"-কে "আধুনিক কবি" ব'লে চালালেন কিভাবে? ওড়িয়ায় মূলে "উপস্থিত কবি" শব্দটা বাংলায়ও এক৷ ওখানে সেই "লজ্জাবতী গন্তুং নেচ্ছতি" এই সংস্কৃত শ্লোকের পর তিনটি চরণ কবি পূরণ ক'রে দিচ্ছেন, এ দেখেও তাঁর ব্যাপারটা বোঝা উচিত ছিল৷ দিলীপবাবু মাতামহ বিশ্বনাথ করের সঙ্গে ফকীরমোহন সেনাপতির সখ্য ছিল খুব৷ দিলীপবাবুর মা যখন বেথুন কলেজে পড়তেন তখন ফকীরমোহন তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন কলকাতা এসেই৷ বলতেন তুমি আমাদের দেশের লোক৷ তোমাকে দেখে যাওয়া আমাদের কর্তব্য৷ ফকীরমোহন পুত্রবধূও এনেছিলেন এক ব্রাহ্মকন্যাকে৷
এই ফকীরমোহন বালেশ্বরে নুনের জাহাজের পাল তৈরির ঠিকাদারী করতেন৷ সেসব অভিজ্ঞতায় তাঁর আত্মচরিত সমৃদ্ধ৷ এর আগে পর্যন্ত কিন্তু তাঁর সাহিত্য রচনা সব বাংলায়৷ স্যার বললেন, জানো, অন্নদাশঙ্করের প্রথম দিকে লেখা কিন্তু ওড়িয়ায়৷ বিশ্বনাথ করের "উৎকল সাহিত্য" পত্রিকায় লিখতেন৷ তাঁকে একদিন সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন স্যুট বুট পরা অন্নদাশঙ্কর, এ দেখে তিনি নাকি তাঁর মাকে বলেছিলেন "মা দেখ সায়েব এয়েছে৷" অন্নদাশঙ্করের "সত্যাসত্য" উপন্যাসে নায়কের নাম রেখেছিলেন স্যারের ডাক নাম দিয়েই: বাদল৷ ফকীরমোহনের বাগান করবার খুব সখ ছিল৷ কটকে তিনি যে বাড়িতে থাকতেন তার সঙ্গে লাগোয়া একটা সুন্দর ফলের বাগান ছিল৷ এছাড়া বালেশ্বরে তাঁর পৈতৃক বাড়িতেও খুব বড় ফলের বাগান ছিল৷ একটা হাউসকোট প'রে থাকতেন তিনি সবসময়৷ পকেটে থাকত অনেক ফল৷ বাচ্চারা সব ওঁর চারপাশে ঘুরঘুর করত৷ ফট ক'রে হাত বাড়িয়ে উনি কাউকে হয়তো দিলেন একটা পেয়ারা, কাউকে বা আম৷ আত্মচরিতের ভাষা সম্পর্কে স্যার একবার বলেছিলেন যে আত্মচরিতে তাঁর ভাষা যেন একেবারে জীবন্ত! অশ্লীল শব্দেরও ব্যবহার আছে প্রয়োজনমত৷ চতুর্ভানীর হিন্দি অনুবাদক বাসুদেব শরণ আগরওয়াল তো তাঁর অনুবাদের জন্য রীতিমত বেনারসের আন্ডারওয়ার্লড-এর ভাষা শিখেছিলেন৷ আসলে ফকীরমোহন বালেশ্বরে নুনের জাহাজের পাল তৈরির ঠিকাদারী করতেন৷ পালের যে কাপড়, সেই কাপড় মেরামত করা বা নতুন পাল লাগানো, সাধারণ মানুষের কথাবার্তা, এই সমস্তের অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে কিছু অপশব্দ তো আসবেই৷ স্যার বলতেন, ফকীরমোহন — "He even transcends our Bankimchandra… "
এরকম কত শত কাহিনী, কত চিহ্ন দিয়ে ঘিরে রাখা আছে তাঁর ব্যক্তিত্ব আমার মনে৷ এক এক প্রসঙ্গে এক একরকম উপদেশ দিতেন, একটু খুব সামান্য ব্যক্তিগত ব্যাপারে ব্যথিত হয়েছিলাম, বলেছিলেন, ছোট ছোট কথা কখনও ধরবে না, মনে পুষে রাখবে না৷ এমন আঙ্গিকে বললেন, মনে গেঁথে গেল৷ যেমন সৌম্যদর্শন, তেমনই সৌম্য মনের অধিকারী ছিলেন৷ কখনও মিথ্যা কথা বলতেন না, নিছক অপ্রিয় কিছু হলে এড়িয়ে যেতেন৷ সূর্যেপাসনা নিয়ে তখনকার কারমাইকেল অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির কাছে গবেষণা শুরু করেন৷ ১৯৪২-এ আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া থেকে পঁচাত্তর টাকা ক'রে জলপানি পান৷ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায় সে গবেষণা থেকে সরে আসেন৷ কথাটা অন্যত্র শুনেছি৷ তাঁর মুখে থেকে কদাপি নয়৷ আমরা যারা আজ শিল্প ও জীবনের দ্বন্দ্বে বেদনাদায়ক জীবন কাটাচ্ছি, তাদের কাছে তিনি ছিলেন আত্মার আরাম, মনের আশ্রয়৷ বটগাছের মত আগলে রেখেছিলেন৷ কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন ও সমস্যা নিরসনে তিনি যেমন সহায় ছিলেন, তেমনি সমস্ত ব্যাপারেই তিনি ছিলেন যথোচিত নিরপেক্ষ৷ কারও দ্বারা প্রভাবিত হতেন না৷ ছাত্রদের মনে অসম্ভব প্রত্যয় ও অদম্য প্রেরণা গড়ে তুলতে পারতেন৷


ছবি: হাতে লেখা চিরকুট


ছবি: দিলীপকুমার বিশ্বাস (১৯২০-২০০৩) শিল্পী মিলন মিত্রঠাকুর

তাঁর "রামমোহন সমীক্ষা" দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগকে বিপুলভাবে আলোকিত করেছে, আমাদের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মানুষকেও আলোয় নিয়ে এসেছে৷ ব্রিটিশরা আসবার পর তাদের জ্ঞানের দিগন্ত আমাদের দিগন্তের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় আমাদের দেশে যে নবজাগরণ এল, তারই আলোয় তিনি রামমোহনকে দেখলেন এবং তাঁর মূল্যায়ন করলেন৷ রামমোহনের যে ছবি তিনি এঁকেছেন, তা প্রচলিত ধারার আলেখ্য নয়৷ তিনি বলতে চেয়েছেন যে প্রাচীর মাটিতে চর্চিত বেদ উপনিষদের কাল থেকে বয়ে আসা যে ঐতিহ্য ও আত্মচেতনার স্রোত প্রাচী-র জলস্রোতে ছিল, তারই মধ্যে এসে মিলিত হয়েছিল ব্রিটিশদের নিয়ে আসা শিক্ষা ও চিন্তাধার স্রোত৷ এরই পুণ্যস্রোতে অবগাহন করেছিলেন রামমোহন৷ বিশ্বমানব যে একজাতি, সেই তত্ত্বের প্রেরণা তাঁর এসেছিল এইভাবেই৷ হিন্দু ও ঐস্লামিক শাস্ত্রাদির নিবিড় পঠন পাঠন তাঁর মনকে উদার করে তুলেছিল, আর তার মধ্যে যখন পাশ্চাত্য ধ্যান ধারণা এসে মিলিত হল, তখন তাঁর দৃষ্টি হয়ে উঠল বিশ্বজনীন৷ এক ভারতপথিক কিভাবে বিশ্বপথিক হয়ে উঠেছিলেন, বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে সেই সত্যের প্রতিষ্ঠাই ছিল দিলীপকুমার বিশ্বাসের প্রতিপাদ্য৷ কাজটি করতে গিয়ে তাঁর জীবনের কুড়ি বছর ব্যয়িত হয়েছিল৷ সত্যিকারের একটি ভাল কাজ ক'রে কুল পাওয়া যায় না৷ আরও অনেক না-বলা যামিনী থেকে যায়, সেই যামিনীগুলিকে আলো দিতে আবার নতুন মানুষেরা আসেন৷ বাংলা অ্যাকাডেমীতে তাঁর জীবনের শেষের দিকের একটি বক্তৃতায় তাঁর গবেষণার ঐতিহাসিক অনেক উপাদানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ ক'রে তিনি বলেছিলেন, "আমাদের জীবন তো শেষ, এখন এই গবেষণাগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, আর এই এই বিষয়গুলি খুঁজে পেতে দেখতে হবে কি পাওয়া যায়, না যায়৷তার কি মূল্যায়ন করা যায়৷ তরুণরাই পারবেন এই কাজ৷" অযোগ্য ও শূন্যকুম্ভ মানুষের নমুনা আমরা অহরহ দেখতে পাই৷ যাঁরা ভাষণ দেন যে দিলীপকুমার বিশ্বাস মানুষের প্রত্যাশা না মিটিয়েই চলে গেছেন, তাঁদের বলতে হয় যে তাঁর দেওয়া মশালটা তাঁরাই বা হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন না কেন, কেনই বা তাঁরা শুধু ফাঁকা বক্তৃতা দিয়ে মানুষের কান ভারি ক'রে চলেছেন?

বিশেষ কোনও ধর্মমতাবলম্বীও তো তিনি ছিলেন না৷ তাঁর ধর্ম ছিল তাঁর নিজেরই অনুভূতি৷ একেবারে শেষের দিনগুলিতে কথা বড় কমে আসছিল৷ একদিন বললেন, "আমাকে আমার বাবা আর মা যেন ঘিরে রেখে দিয়েছেন৷" বুকটা ছ্যাঁৎ ক'রে উঠেছিল৷ অনেক সময় তাঁর বাড়িতে গিয়েছি, দেখতাম জানলার দিকে মুখ ক'রে উপনিষদের শ্লোক আবৃত্তি করছেন, কখনও বা রবীন্দ্রনাথের "জন্মদিনে" কাব্যের এই বারো সংখ্যক কবিতাটি:

বারবার মনে মনে বলিতেছি, আমি চলিলাম
যেথা নাই নাম,
যেখানে পেয়েছে লয়
সকল বিশেষ পরিচয়
নাই আর আছে
এক হয়ে যেথা মিশিয়াছে,
যেখানে অখণ্ড দিন
আলোহীন অন্ধকারহীন৷
আমার আমির ধারা মিলে যেথা যাবে ক্রমে ক্রমে
পরিপূর্ণ চৈতন্যের সাগরসঙ্গমে৷