আর্টস বৈঠক মনের মানুষ (কিস্তি ১)

admin
Published : 29 Nov 2011, 05:56 PM
Updated : 29 Nov 2011, 05:56 PM


গৌতম ঘোষ (জন্ম. ২৪ জুলাই ১৯৫০)

১৫০ মিনিট দৈর্ঘ্যের সিনেমা 'মনের মানুষ' মুক্তি পায় ২০১০ সালের ০৩ ডিসেম্বর। পরিচালক গৌতম ঘোষ। প্রযোজনা করেছেন গৌতম কুণ্ডু এবং হাবিবুর রহমান খান। বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ার যৌথ প্রযোজনায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনের মানুষ উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি নির্মিত। উপন্যাস মনের মানুষ প্রকাশিত হয় ১৪১৫ বঙ্গাব্দে দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় (আগ্রহীরা পড়তে পারেন: মনের মানুষ)।

মুক্তির পরে মনের মানুষ দর্শকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া পায়। মুগ্ধ দর্শকের বিপরীতে বহু দর্শক ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে লালন নিয়ে ভাবেন, লেখেন, করেন–এমন অনেকেই মনের মানুষ-এ পরিবেশিত লালনকে গ্রহণ করতে পারেননি, মনের মানুষ-এ লালন ও তাঁর দর্শন খণ্ডিত হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন।

এই কনটেক্সটে ২০১১ সালের ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আর্টস বৈঠক ডাকা হয় bdnews24.com-এর তখনকার ধানমণ্ডি অফিসের সভাকক্ষে। বৈঠক সঞ্চালন করেছেন ব্রাত্য রাইসু। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন—

ফরহাদ মজহার (কবি, লেখক ও গীতিকার)
সলিমুল্লাহ খান (শিক্ষক, লেখক ও অনুবাদক)
গৌতম দাস (লেখক, প্রবাসী)
মানস চৌধুরী (শিক্ষক, লেখক)
রাজু আলাউদ্দিন (কবি, সাংবাদিক)
জাকির হোসেন রাজু (চলচ্চিত্র সমালোচক ও নির্মাতা)
ফাহমিদুল হক (শিক্ষক ও লেখক)
অরূপ রাহী (গায়ক, সংস্কৃতি-রাজনীতি চিন্তুক)
মোহাম্মদ আজম (শিক্ষক ও লেখক)
সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী (শিক্ষক)
মুসতাইন জহির (লেখক)
এস এম রেজাউল করিম (লেখক)


আর্টস বৈঠক: মনের মানুষ (কিস্তি-০১)
ভিডিও ধারণ: প্রমা সঞ্চিতা অত্রি

বি.দ্র. অডিও/ভিডিও ডাউনলোড করার জন্য নিচের ঠিকানা থেকে মজলিা ফায়ারফক্স অ্যাড-অন ইনস্টল করে নিন।

ফায়ারফক্স অ্যাড-অন: অডিও/ভিডিও ডাউনলোড অ্যাড-অন
অ্যাড-অন লিংক-এ ডাউনলোড করার নির্দেশনা দেওয়া আছে।–বি.স.

—————-

আর্টস বৈঠক: মনের মানুষ

ব্রাত্য রাইসু: কীভাবে শুরু করা যায়? এক হইতে পারে যে, যাঁরা দেখছেন 'মনের মানুষ' ছবিটি—তাঁরা প্রত্যেকে দুই-এক মিনিট কইরা বললেন, যাঁর যা নোট করা দরকার করলেন, তারপরে কেউ একজন আলোচনা শুরু করলেন। তারপরে আগাইতে থাকলো। মানে, গোল টেবিলের মতো না কইরা আমরা এইভাবে করতে পারি কিনা?

ফরহাদ মজহার: কোনো অসুবিধা নাই।

ফাহমিদুল হক: আপনার, অর্গানাইজার হিসাবে আপনার কোনো বক্তব্য প্রথমে শুনে নেওয়া উচিত।

ফরহাদ মজহার: আপনি কেন এটা করতে চাইছেন?


ব্রাত্য রাইসু: ও আচ্ছা। যেটা হলো যে, মনের মানুষ—খুবই জনপ্রিয় হইছে সিনেমাটা। আমি দেখলাম যে, ওইদিন আমরা গিয়েছিলাম একটা অনুষ্ঠানে। সিএনজি থেকে নামছি আমি আর রেজাউল করিম। আমার সঙ্গে উনি আর্টসে কাজ করেন। তো নামার পরে আমাকে ডাকলেন সিএনজিঅলা, ভাই, একটু শুনেন। আমি বললাম, কী ব্যাপার? বলেন যে, ওনারে মনের মানুষের লোকটার মতো লাগতেছে। বললাম কী, কোন লোক? বলে যে, নামটা মনে নাই। আমি বললাম, লালন? বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, লালন, লালন। তো এই যে জিনিসটা, মানে সবার কাছে জিনিসটা পৌঁছাইছে। এর গুরুত্ব অনেক। এখন একইসঙ্গে মনের মানুষ ছবি নিয়ে ফেসবুকে দেখলাম কিছু আলোচনা এবং আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের কাছে এটার ব্যাপারে শুনলাম অনেকগুলো আপত্তির কথা। ফলে এই দুটো জিনিসকে একসঙ্গে বোঝার জন্য আমরা এই আয়োজনটা করেছি যে, মনের মানুষের মধ্যে লালনকে যেভাবে উপস্থাপন করছেন তাতে দোষ-গুণ কী আছে, না আছে—সেই আর কি।

ফরহাদ মজহার: তাহলে আমার মনে হয়, একটা কুইক কমেন্ট প্রত্যেকে একবার করে যাক; তারপরে সাবস্ট্যানটিভ কমেন্ট পরে আসবে—এ রকম চাচ্ছেন আপনি?

ব্রাত্য রাইসু: মানে, সিনেমাটা দেইখা যেটা মনে হইছে—নিজেদের মতো কইরা এক মিনিট, দুই মিনিট যদি সবাই বলেন। ফাহমিদুল যেহেতু শুরুতে আছেন…

ফাহমিদুল হক: আমি শুরুতে নেই!

ব্রাত্য রাইসু: আপনি শুরুতে না হলে তো আমারে শুরুতে ধরতে হয়—সেটা ঠিক হবে না। ফলে আপনি শুরু করেন।

ফাহমিদুল হক: কঠিন কাজ। সেটা হলো যে, আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, আমি এখানে আমন্ত্রিত হয়েছি…। এই মনের মানুষের দুটো আসপেক্ট আছে। একটা হলো চলচ্চিত্র আসপেক্ট, আরেকটা হলো বাউল দর্শন আসপেক্ট। তো আমি চলচ্চিত্র আসপেক্ট—ওই সেক্টর থেকে মনে হয় আমন্ত্রিত। কারণ, আমি বাউল দর্শন বিষয়ে আগ্রহী, কিন্তু আমার দখল নেই। তো আমি দু-একটা কথা বলেই রক্ষা পেতে চাই। একটা হলো যে, ছবিটি শুরুই হয়েছে—মানে ছবিটার ন্যারেটিভ দাঁড়িয়ে আছে হলো লালনের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনভারসেশনের উপর। এটা খুব বেশি সময় দেখা না গেলেও এটা কিন্তু কাঠামো। একটা ছবিতে ন্যারেটিভ থাকে, ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার আর কি। তো এই জায়গায় মনে হয়েছে যেটা–আমি জানি না, মনের মানুষ উপন্যাস আমার পড়া নাই, সেখানেও এই রকম আছে কিনা। এটা মনে হয়েছে যে, যাদের জন্য এই ছবিটা বা গ্রন্থটা লিখিত বা ছবিটা নির্মিত, সেই টার্গেট অডিয়েন্সকে—এই ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারের মাধ্যমেই প্রথমত পরিচালক পৌঁছাতে চেয়েছেন। কারণ এটা লালন বা লালনের জীবনীনির্ভর ছবি, কিন্তু এটা ভেতর থেকে আসছে না; এটা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপস্থিতি দিয়েই আসলে মিডল ক্লাস বা সেই সময়ের ফিউডাল–এই যে এলিট ক্লাসের কাছে পৌঁছা হলো এইভাবে।


এটা একটা আসপেক্ট আমার মনে হয়েছে; আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বেশি রিঅ্যাকশন জায়গায় এসছে, সেটা হলো, যৌনতা ও লালন—এই রকম একটা এরিয়ায়। তো সেই এরিয়ায় আমি বিশেষ কিছু কমেন্ট—আমি এই মুহূর্তে করতে চাচ্ছি না। আমি আরো সবারটা শোনার পরে বলতে চাচ্ছি। এমনিতে ছবিটা গৌতম ঘোষের, আর ৫টা ছবির তুলনায়–আমি সবগুলো দেখি নি—আমার মনে হয়েছে, ওয়েল মেড। তবে গৌতম ঘোষের ছবিতে যে গরিবি দারিদ্র্যপনা থাকে, এই ছবিতে সেটা আছে; কিন্তু তারপরও একটা গ্লজ দিয়ে মোড়ানো আছে। যার ফলে অন্তর্জ্বলি যাত্রা'র যে গরিবি, সেটা এখানে নাই; যদিও প্রেক্ষাপট প্রায় একই রকম, মানে একই রকম ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাটাস ব্যাকগ্রাউন্ড, কিংবা ওই যে আমাদের পদ্মা নদীর মাঝির যে গরিবি, সেটা এখানে থাকার কথা ছিল, কিন্তু নাই। মানে আমি পোশাক-আশাকের কথা বলছি। [ফরহাদ মজহার: 'গরিবি'…গরিবি মানে…] গরিবি মানে এক ধরনের যে আর্থিক অবস্থা, সেটা লালনের পোশাকের মধ্যে যদি আমরা সিম্বলাইজড ধরি, সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এইটুকুই আমার আপাতত।

ব্রাত্য রাইসু: এবার আপনি, সাবরিনা। আপনার নামটা বলে নিয়েন একটু।

সাবরিনা সুলতানা: সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী। ফাহমিদ ভাই যেটা বলছিলেন যে, দুটো আসপেক্ট থেকে—আমি দুটো আসপেক্ট থেকে একেবারেই দেখছি না। আমরা যেহেতু একেবারে মনের মানুষ ছবিটা নিয়েই কথা বলতে বসেছি, আমার মনে হয়, ফিল্মের আসপেক্ট থেকেই আমাকে এটা দেখতে হবে। আর সেইখান থেকে যদি বলি যে, হ্যাঁ, ছবিটা নির্মাণগত দিক থেকে ভালো, কিন্তু যদি লালনকে বোঝার জন্যে, আমরা যদি সেই বাউলতত্ত্ব বা দেহতত্ত্ব বা সেই দিকটাতে যাই, তাহলে একেবারে লালনকে বোঝার জন্যে মনের মানুষ না। আমি শুধু আরেকটা জিনিস অ্যাড করতে চাই এর সাথে যে, আরেকটু কিছু বোধহয় আলোচনার সুযোগ ছবিটা আমার দিকে দিবে, সেটা হচ্ছে যে, রিলিজিয়াস টলারেন্সের যে বিষয়গুলি এবং আমি বিয়িং এ ওমেন, একটা কথা বলতে চাই যে, একজন নারীর যে সেক্সুয়াল ফ্রিডমের যে জায়গাটা, আমার খালি মনে হয়েছে খানিকটা–সেদিকটাতেই ইঙ্গিত আছে মনের মানুষে

মানস চৌধুরী: আমার নাম মানস চৌধুরী। আমি জাহাঙ্গীরনগরে মাস্টারি করি। আমার কাছে, ফাহমিদ একটা একটা জায়গা দাঁড় করিয়েছে, জিনিসটাকে কী কী ভাবে দেখা যায়—সেটা সুবিধাও দিতে পারে কোনোভাবে। আমার জন্য এটা সাংস্কৃতিক প্রোডাক্ট মাত্র এবং গৌতম ঘোষের প্রায় সব ছবি দেখা সত্ত্বেও আমার কাছে গৌতম ঘোষের আবার অরণ্যে খুব ইরিটেটিং ছিলো; সকল কারণে, নানান কারণে।


এই ছবির, যেহেতু ছবির ক্ষেত্রে বা অন্যান্য কালচারাল প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে একটা শক্তিশালী আলাদা জগৎ আছে, আপনার এন্টারটেইনমেন্ট বনাম সিরিয়াসনেস, যদিও আমার সিরিয়াসনেস-এর প্রতি বিশেষ কোনো লয়্যালটি নাই, কিন্তু–বরং এন্টারটেইনমেন্ট বলতে যে কথাটা বলা হয়, সেটার প্রতি—সেদিক থেকে চিন্তা করলে ছবিটা এন্টারটেইনিং, আমার প্রথম রি-অ্যাকশন হচ্ছে–ছবিটায় যথেষ্ট চিত্ত আমোদিত হয়। তো এটা হচ্ছে প্রথম প্রতিক্রিয়া; এবং গৌতম ঘোষ এ ধরনের চিত্তামোদমূলক ছবি বানাতে পারেন, যদিও তিনি 'আবার অরণ্যে'-এ অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু দর্শক হিসাবে আমার মনে হয়েছে–প্যাথেটিক। তো সেই অর্থে বলে গেলে, উনি যে চিত্ত-আমোদনমূলক, বিনোদনমূলক একটা ছবি বানাতে পারেন, সেটা ভালো লেগেছে। আর দুই হলো যে, আমি এমনিতেই, এটা আরো বোধ হয় বড় আলোচনার সময় আসতে হবে যে, মাধ্যম বদলে যদি দার্শনিক সূত্র খুঁজতে যাওয়া হয়, এটার আমি খুব পক্ষপাতী লোকও না, মানে ইয়ের দিক থেকে, ধরুন…

ব্রাত্য রাইসু: এটা, আপনার কথাটা বোঝা গেল না, আরেকবার বলেন।

মানস চৌধুরী: ধরুন, কথার কথা–লালনকে খুঁজবার জন্য মনের মানুষ-এ যেতে হবে, এটা আমার জন্য, মানে জরুরি মনে হয় না এমনিতেই।

ব্রাত্য রাইসু: আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা এই পয়েন্টটাতে পরে হয়তো আবার ঘুরে আসব যে, লালনকে খোঁজার জন্য মনের মানুষে যাওয়ার দরকার আছে কি না। জহির—নাম বইলা নিয়েন।

মুসতাইন জহির: আমার নাম মুসতাইন জহির। পাক্ষিক চিন্তা'য় আছি, কাজ করি। আমার কাছে যেটা মনে হইছে যে, ছবিটাতে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে লালনকে, সেই দিক থেকে বলি। পুরা ছবিটা দেখে আমার কাছে মনে হইছে যে, একটা গুপ্ত জীবনকে প্রকাশ্য করার জন্য লালনকে উন্মোচন করা হচ্ছে। যে লালনের যে জীবনটা গুপ্ত ছিল, অপ্রকাশ্য ছিল—লালন নিজেই এখন সেটা ঠাকুরবাড়িতে বসে ঠাকুরের কাছে সেটা প্রকাশ করছেন। পুরো গল্পটা এইভাবে এগিয়েছে। যেগুলো ইতিহাসে জানা যায় না, যেগুলো লালনের শিষ্য-পরম্পরায় জানা যায়নি, যেগুলো নিয়ে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছেন, কেউ কোনো কনক্লুসিভ সিদ্ধান্তে আসেননি, আসাটা সঙ্গত কিনা–লালনের জীবনদর্শনে–সেসব দিক থেকে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এটাতে দেখানো হয়েছে।


কিন্তু ফরম্যাটটা এমন যে, দেখলে প্রথমত মনে হবে যে, ছবির প্রথম দৃশ্যেই লালনের একটা স্মৃতির উদ্রেক ঘটানোর মতো একটা দৃশ্য আছে যে, একটি সন্ধ্যা নামছে। ভেলাতে করে ভাসিয়ে দেওয়া লালন যাচ্ছে, তার পরে বোটটি চলে যায়। মনে হবে স্মৃতিচারণ, আসলে স্মৃতিচারণ না, এটা এক ধরনের লালনের মুখ দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করে নেওয়া। পুরো ন্যারেটিভটা সাজানো হয়েছে এবং সেই ন্যারেটিভের মধ্যে প্রধানত যেটা ডমিনেট করেছে, সেটা হলো গুপ্ত জীবনকে প্রকাশ্য করার একটা চেষ্টা এবং এই 'গুপ্ত' কথাটা একটু আমি বৃহৎ অর্থেই বলছি। সেটা হলো–লালন সম্পর্কে যে বিষয়গুলো মধ্যবিত্তের মধ্যে মনে হয় 'গুপ্ত-গুপ্ত' ভাব আছে, যেগুলো তারা জানতে চেষ্টা করেন, কিন্তু বুঝতে পারেন না। এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরও বারবার সে আক্ষেপ করছেন, আমি মনে হয় বুঝতে পারলাম, আবার মনে হয় পারলাম না। এই যে চেষ্টা এবং তদবির—এগুলো নিয়েই ছবিটা। এটা হলো প্রাথমিক অবজারভেশন। এখান থেকে আরো ডিটেইল হয়তো পরে সুযোগ পেলে বলতে পারবো।


মনের মানুষ ছবির দৃশ্য

মোহাম্মদ আজম: আমি মোহাম্মদ আজম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়াই। ছবিটি দেখার পর আমার প্রথম যে প্রশ্নটা আমার মধ্যে, নিজে বিবেচনার জন্য ঠিক করেছি, সেটা হলো যে, উপন্যাস থেকে যখন স্ক্রিপ্টটা তৈরি হয়েছে, তখন আমার মনে হয়েছে যে, কিছু উন্নতি—কোট আনকোট, কিছু উন্নতি হয়েছে। ওটা ঠিকই পিছন দিক থেকে সামনের দিক আসাতে ভালো হয়েছে, খারাপ হয় নি। আরেকটা জিনিস আমার মনে হয়েছে যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওই বোটে এই পুরো কাহিনীটি বলার সময়—এর অন্য ক্রিটিক চলতে পারে, যে ঠাকুরবাড়ির ওখানে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমার মনে হয়, কাজটা যে মধ্যবিত্ত একজন মেকার এবং তার অডিয়েন্সের দিক থেকে খুব খারাপ হয়েছে—আমার এ রকম মনে হয়নি। আমার বরং মনে হয়েছে, যেভাবে লালনকে শেষ জীবনের পোর্ট্রেট উপস্থাপন করা হয়েছে, আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের ছবি থেকে এই ইয়েটা নিয়েছে, উপস্থাপনের ভঙ্গিটাও আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। পুরো সিনেমার মধ্যে সেটা আছে। এবং ওই যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে বলছে বারবার যে, বুঝলাম না আপনার কথা, বুঝতেই পারলাম না–এটাও আমার মনে হয়েছে যে, পরিচালক খুব–লালনকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েই এই এক্সপ্রেশনটা দিয়েছেন। ইন স্পাইট অল দিজ, লালনের উপস্থাপনা হয়েছে খুবই জঘন্য। আমার কাছে প্রধান প্রশ্নটা হলো এটা যে, একটা লোক শ্রদ্ধার সঙ্গেই চেষ্টা করছে, অথচ সে পারছে না কেন, এটাই আমার কাছে প্রধান প্রশ্ন। আমার কাছে মনে হয়েছে যে তাঁর দিক থেকে শ্রদ্ধাটা ছিলো।

ব্রাত্য রাইসু: আচ্ছা, এইটা নিয়ে আপনি, আবার যখন আমরা ঘুইরা আসব, আপনি তখন বলতে চেষ্টা করতে পারেন যে, কেন পারে না। মানে, আপনার তো জিজ্ঞাসা, উত্তরটাও আপনি দিলেন আর কি…

মোহাম্মদ আজম: উত্তরটাও আমি যা ভেবেছি, কিছু কিছু বলবো।

গৌতম দাস: আমি গৌতম দাস। পেশাগতভাবে সাংস্কৃতিক জগতে আপনাদের পরিচয় দেবার মতো কিছু নাই আর কি। আমি বাইরে থাকি, বিদেশে, কালকে এসছি। লালন নিয়ে যে সিনেমাটা–সিনেমাটার আগে আমি একটু বলতে চাই বইটা সম্পর্কে, মনের মানুষ বই সম্পর্কে। উপন্যাসটা লেখার সময় উপন্যাসের শেষে লেখকের বক্তব্য বলে একটা এক পাতার একটা বক্তব্য আছে। আমার শুধু মনে হয়, উপন্যসটার চেয়েও এই বইয়ের এই পাতাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সুনীল কেন বইটা, উপন্যাসটা লেখার তাগিদ পেল বা লালন সম্পর্কে তার ধারণাটা কী, সেইসব বিষয়গুলো জানা যায়। মানে পুরো মনের মানুষ পড়ে তার সমালোচনা বা পছন্দ যা কিছু বুঝব আমরা, বুঝার আগেই বইটা যদি পড়ে নেয়া যায়, তা অনেক বেশি স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রথম বাক্যটা হলো এইরকম যে, এই লেখাটা—'এটা ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক কোনো জীবনকাহিনী না।' সুনীল নিজে বলছে, কিন্তু এটাকে সে আবার একটা উপন্যাস আকারে হাজির করছে। আমার কাছে পড়ে মনে হয়েছে যে, সুনীল যেরকমভাবে সেই সময় লিখছে, যেন—লালনকে নিয়ে একটা সেই সময় লিখতে গেছে সে। অনেক সাহিত্যিকেরই একটা জীবনস্বপ্ন থাকে–সেই সময় জাতীয় একটা কিছু কাজ করতে। সুনীলকে আমরা দেখছি যে দুইবার সেই একই কাজ করতে। তার মানে, তাঁর সার্টিফিকেট ডাবল হবে আর কি। যাই হোক এটার সমস্যাটা হলো–পরে সুনীল নিজেই বলছে যে, লালন সম্পর্কে ইনফরমেশন পাওয়া যায় না। খুবই দুঃসাধ্য, দুর্লভ এটা, কিন্তু উপন্যাস সে আবার লিখতে চাচ্ছে, সাবধান করে দিচ্ছে যে—ইতিহাস লিখছে না। আমার কাছে মনে হয়েছে যে, আগে সেই সময়-এর মতো যে একটা হিস্টোরিকাল ন্যারেটিভ–এটাকে সে উপন্যাস আকারে, এর ভিতরে কাহিনী ঢুকিয়ে একটা উপন্যাস আকারে করেছে। সম্ভব, সফলভাবে। লালনকে নিয়ে লিখতে গেলে বিপদ হবে যেটা, বিপদ হয়েছে কিন্তু। সেটা হলো, কারণ, হি ইজ এ ফিলোসফার। এখন একটা মানুষের জীবনী যদি আমরা লিখতে চাই, যার ফ্যাক্টস—ডে টু ডে ফ্যাক্টস কোনো কিছু পাওয়া যায় না, তাঁর সম্পর্কে যদি আমি লিখতে যাই, তাহলে এখন অ্যাভেইলেবল ফ্যাক্টস একটাই হাতে আছে–অ্যাট লিস্ট তার গানগুলো আছে, তার কর্মগুলো আছে। একটা মানুষকে বোঝার জন্য কি তার কর্ম ইম্পর্ট্যান্ট, না তাঁর কেমন কী ছিল, জীবনী বলতে যেটা বোঝায়, সেটা অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট? সেই হিসেবে স্বভাবতই তার কর্মগুলো সম্পর্কে যদি কিছু বলতে পারা যেতো, জানা যেতো। সেটাকে মাথায় রেখে একটি উপন্যাস যদি দাঁড় করানো যেত। সব সময় এই সমস্যাটা হইছে, যেখানেই আমি, যত জায়গায়, যা কিছু লেখা দেখেছি, সবাই এই পার্টটা এড়িয়ে গিয়ে সবাই ঝুঁকে পড়েছে তার জীবনী লিখতে হবে। মানে একটা মানুষের কর্মকে ব্যাখ্যা করে তাঁর সম্পর্কে জানা বা জানানো, সেটার চেয়ে তার জীবনী লেখার দিকে সবার ঝোঁক বেশি। তো এখানে সেই ব্যত্যয়টা হয় নাই, সুনীলও সেই দিকে গেছে।

ব্রাত্য রাইসু: মানে ইয়েটা কী? গৌতম ঘোষের ব্যাপারটায় যদি আসেন—

গৌতম দাস: এ তো গেলো–সুনীলের পার্টটা বললাম। গৌতম ঘোষের পার্টে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, ওটা আর এক স্টেপ অগ্রগতি বা উন্নতি—এই টাইপের কিছু একটা হইছে, মানে এবার সে স্ক্রিপ্টটাকে আরেক ধাপ কাল্পনিক জায়গায় নিয়ে গেছে। সুনীল যেখানে বলছে, আমি আমার গল্পটা বলার জন্য, যেহেতু ফ্যাক্টস পাওয়া যায় না, আমি বহু জায়গায় এর, বহু ক্যারেক্টারকে ঢুকিয়েছি। সুনীল নিজেই বলতেছে। কিন্তু এইখানে দেখা যাচ্ছে পুরো স্টোরিটাই আরেক ধাপ, আরেকটা বাঁক নিয়েছে।

ব্রাত্য রাইসু: ঠিক আছে। তাইলে আমরা এখন, জাকির ভাই, আপনি বলেন। মানে আমরা জানতে চাচ্ছি যে, প্রথম একটা জিনিস যে, ছবিটা দেখে আপনার কী মনে হইছে। এটা নিয়ে অল্প কথায় বলবেন। সবাই বলার পরে আবার আমরা ডিটেইল আলোচনায় যাব, বা কারো সঙ্গে যদি কোনো আলোচনায় আগানো যায়। ছবি দেখছেন তো আপনি?

জাকির হোসেন রাজু: ছবি দেখেছি। আমি বইটা পড়িনি, ছবিটা দেখেছি। আমি মূলত এসছি যে, সবার কাছে শুনবো, (এ) জন্য। আমার বলার চেয়ে শোনার আগ্রহটা বেশি। তো সংক্ষেপে যদি বলি যে, মানে নিশ্চয়ই ছবির যেটা উনি বলছিলেন যে, ছবির বা উপন্যাসের কনটেন্ট এবং কীভাবে বোথ ফিল্ম এবং বই বা উপন্যাস দুটোই খুব বেশি কাল্পনিক ইত্যাদি। তো আমার মনে হয়, এগুলা নিয়ে আমরা নিশ্চয়ই আরো আলোচনা করব। তো আমি এই টেক্সচুয়াল আসপেক্টের বাইরে একটু যেটা বলতে চাই, সেটা হলো যে, আমার কাছে, মানে আমাদের বাংলাদেশের আর্ট সিনেমার কনটেক্সটা যদি আমরা দেখি এবং সাম্প্রতিক যে পরিস্থিতিটা যদি আমরা দেখি আর কি, যে, আমাদের স্থানীয় যারা আর্ট সিনেমা তৈরি করছেন, খুব বেশি করছেন না—৫, ৭, ১০ জন হয়তো হবে আর কি। তো তারা বলে থাকেন যে, তারা লড়াই করছেন বিভিন্নভাবে, সংগ্রামে লিপ্ত আছেন। তো সেটাই অনেক ধরনের আলোচনা বা বিতর্ক হতে পড়ে; কিন্তু মোদ্দা কথাটা হলো যে, তারা এক ধরনের ছবি করেন বিভিন্ন কষ্ট করে। বিভিন্ন সূত্র থেকে তারা টাকা-পয়সা সংগ্রহ করেন এবং অ্যাট দ্য এন্ড যেটা হয় যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছবি আইদার সিনেমা হলে দেখানোই হয় না, অথবা দেখানো হলেও খুব কম দর্শক পান। খুব সাম্প্রতিক সময় যেটা–আজকে সকালে আমি তারেক মাসুদের কাছ থেকে একটা এসএমএস পেয়েছি কুষ্টিয়া থেকে যে, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামের বারো'শ সিটের অডিটোরিয়ামে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে তার রানওয়ে ছবিটা দেখানো হচ্ছে। তো এতে তিনি খুব খুশি যে, দেখানো হচ্ছে। অন্যদিকে কয়েক সপ্তাহ আগে আমাদের বন্ধু আবু সাঈদ একটা ছবি করেছেন। সেটি হচ্ছে, অপেক্ষা। তো সেটি বলাকায় এবং রাজশাহীতে একটি সিনেমা হলে মুক্তি দেয়া হয় এবং তাতে দর্শক বলতে গেলে আসেইনি।

আমি এবং আমার বন্ধু ফাহমিদ এখানে উপস্থিত থাকাতে এবং আমরা শিক্ষক হওয়াতে, আমরা যেই একটা সমস্যায় পড়েছি সেটা হলো, সাঈদ ভাই আমাদের বারবার বলেন যে, আমরা কেন আমাদের স্টুডেন্টদেরকে পাঠাই না, অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে কেন আমরা পাঠাই না ছবিটা দেখার জন্য। যদিও আপনারা জানেন যে, আমি স্টুডেন্টদেরকে বিভিন্ন কিছু করতে বলতে পারি, কিন্তু তাকে ছবি দেখতে বলাটা, যেটা চায় না, তাতে তাকে বাধ্য করাটা খুব পসিবল না। তো যাই হোক, আমি যেটা বলছি যে, এই পরিস্থিতিতে আমার মনে হয় যে, আমরা এই কনটেক্সটে যদি মনের মানুষকে একটু দেখার চেষ্টা করি–এটা আমার, মানে সবার কাছে আমার প্রস্তাবনা আর কি। সেটা হচ্ছে যে, গৌতম ঘোষ—আমরা জানি যে একজন সুখ্যাতিসম্পন্ন আর্ট সিনেমা নির্মাতা–পশ্চিমবঙ্গের। তবে গত কয়েক বছর আমি তার তেমন কোনো কাজ দেখিনি। মানে মনের মানুষ ছাড়া আমি ঠিক সচেতনও না যে, তিনি আর কোনো কাজ করেছেন কিনা গত কয়েক বছরের মধ্যে। তাঁর প্রথম দিকটার কিছু কাজ আমরা দেখেছি এবং যেগুলো বলতে হবে যে, যেগুলোতে মনে হয়েছে যে, তাঁর নিজের ছবির সঙ্গে তাঁর—যে, নিজের মনের সংযোগটা বেশি ছিল, তার প্রথম দিককার ছবিতে। আমি, সর্বশেষ যতটুকু মনে পড়ে, তাঁর আরেকটি ছবি যেটি ঠিক একই ধরনের, আমাদের হাবিব খান সাহেবের প্রণোদনায় নির্মিত, ১৯৯২ বা '৯৪ সালে, যেটি হচ্ছে পদ্মা নদীর মাঝি, সেটি আমি দেখেছি। তো আমার প্রস্তাবনাটা হচ্ছে এইরকম যে, এই যে এক ধরনের 'এপার বাংলা ওপার বাংলা'র যৌথ উদ্যোগে নির্মিত আর্ট সিনেমা। এটার সাথে আমাদের স্থানীয় যারা আর্ট সিনেমা নির্মাতা–এদের পারস্পরিক তুলনা বা সম্পর্কটা কেমন, সেটা আমরা একটু বোঝার দিকে যেতে পারি কিনা।

ব্রাত্য রাইসু: মানে পশ্চিমবঙ্গের আর্ট ছবি এবং আমাদের আর্ট ছবির তুলনা।

জাকির হোসেন রাজু: না, না, সরাসরি তা না। আমি বলছি যে, পশ্চিমবঙ্গের আর্ট ছবি নির্মাতাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে আমাদের এখানে যে ছবি নির্মাণ করার একটা চেষ্টা, এর [ব্রাত্য রাইসু: কারণটা কী?] এর কারণটা বা যাওয়ার কনটেক্সটা কী এবং যেখানে আমাদের নির্মাতারাও বিভিন্ন রকমের চেষ্টা করছেন—কম বেশি সফল বা…

ফাহমিদুল হক: আমি এখানে অল্প একটু যোগ করতে চাই, সংক্ষেপে, প্রাসঙ্গিক। সেটা হলো যে, আমাদের আর্ট সিনেমা নির্মাতাদের একজন ডাকসাইটে বা প্রথম সারির তারেক মাসুদ। তিনিও হাবিব খানের ডিস্টিবিউশন পাবেন কিনা—তাঁর নরসুন্দর নিয়ে, এটা নিয়ে এক ধরনের টেনসনে থাকেন, অ্যাপ্রোচ করেন এবং নিশ্চিত হন না যে উনি আদৌ দয়া করবেন কিনা। এই কনটেক্সটে আমি বলতে চাচ্ছি যে, গৌতম ঘোষকে তিনি দুবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এখানকার ছবিতে। এবং ওখানের যে ছবি নির্মিত হচ্ছে, সেখানেও– আমরা হয়তো অনেক ইনভেস্টমেন্ট আমরা জানিও না। হাবিব খান পশ্চিমবঙ্গের ডিরেক্টরদের খুব পছন্দ করেন আর কি, ইনভেস্ট করার ক্ষেত্রে।

ব্রাত্য রাইসু: আচ্ছা, এইটার মধ্যে আমরা ঘুইরা আসবো। আপনি বলেন, নাম বইলা নিয়েন।

রেজাউল করিম: আমি রেজাউল করিম। আমি ভাবছিলাম, বলতে হবে না। আমার, আমি যখন দেখলাম, আমি একটা প্রস্তাব পেলাম আর কি মুভির ভেতরে যে, খারাপ সামন্তর তুলনায় ভালো সামন্ত কেমন হতে পারে। মানে দেবেন্দ্রনাথ খারাপ, তিনি ব্রাহ্ম হবার পরে আর খোঁজ-খবর রাখেন না তাঁর প্রজাদের। তার বিপরীতে একজন ভালো সামন্ত হিসেবে কী কী করা যায়, সেটা দেবেন্দ্রনাথের ছেলে লালনের কাছ থেকে শুনছে এবং লালনের যেই হাজির করা, সেই হাজির করার ভেতরে আমি দেখলাম যে, সে তাঁর প্রজাদের কীভাবে ম্যানেজমেন্ট করে–সেটা বলছে স্মৃতি হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্রকে, জ্যোতিরিন্দ্র যেন বা শিখছে, যদিও পরবর্তীতে জ্যোতিরিন্দ্রর সেই ইয়েটা দেখি নাই আমরা হিস্ট্রিক্যালি যে, কীভাবে সে সেটা করছে। জ্যোতিরিন্দ্র ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের সাথেও তাঁর দেখা হয়েছে। হয়তো এগুলিই বলছিলেন, সে কারণেই পরবর্তীতে তাঁর কৃষি এবং অন্যান্য কতগুলো ক্ষেত্রে—শিক্ষা, রবীন্দ্রনাথের যে ভূমিকা—কীভাবে নিয়ে আসছেন তিনি; তো সেই জিনিসগুলো হয়তো লালনের কাছ থেকেই শেখা এরকম একটা ইঙ্গিত এই ছবি থেকে পাওয়া যেতে পারে হয়তো।

অন্য যেই বিষয়টা যে, লালন তাকে শেখাচ্ছেন যে, কীভাবে ভালো হওয়া যায় এবং এই যে এই শেখাচ্ছে, যেহেতু হিস্ট্রিক্যালি ওই পর্বটা আমাদের অতীত। ফলে আমরা আসলে এই–ভালো সামন্ত খারাপ সামন্তকে শেখাচ্ছে, ভালো সামন্ত কীভাবে হওয়া যায় এবং সেটা এই আধুনিক পুঁজিবাদী মানুষজন সেটা দেখে বিনোদিত হচ্ছে। এ রকম একটা প্রস্তাব ওইখানে আছে। ফলে বিপরীতে আবার ওই সিনেমাটার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী মানুষকে আসলে কোনো বক্তব্য নাই। মানে এটা এক ধরনের বে-যোগাযোগ আর কি যে, শুধুমাত্র আমরা শুধু দেখছি, আমাদের কাছে লালন কিংবা জ্যোতিরিন্দ্র কিংবা ওই সময়– আসলে কোনো বক্তব্য নাই বরং আমরা একটা হিস্ট্রিক্যাল পাস্টকে দেখছি, আমাদের পাস্ট যেটা। সেই অর্থে পাস্টকে বোঝা জাতীয়তাবাদী কারণে গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। সে কারণে হয়তো মানে ওটা আমাদের দেখতে হয়, কিংবা দেখব। সে কারণেই হয়তো মুভিটা করা, আমি জানি না।

অন্য একটা বিষয়, সেটা হচ্ছে, সিনেমায় যৌনতা নিয়ে যেই প্রস্তাব এবং লালন এবং তাঁর যৌনতা—এই দুইটাকে, যেভাবে পরস্পরকে পরস্পরের সাথে অ্যাক্যুমুলেট করা হচ্ছে, সেটা আমার কাছে বিভিন্ন অর্থে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে; এই অর্থে যে, কোনো এক কারণে দেখলাম আমরা যে, লালন খুবই নিষ্কাম হবার চেষ্টা করছে। আমি ঠিক জানি না যে, লালনকে নিষ্কাম হতে হবে–নিষ্কাম মানে যৌনতার অর্থে যেই কাম, তো এই রকম একটা যৌন-উত্তীর্ণ মানুষ হতে হবে, এইটা লালন হবার জন্য হিস্ট্রিক্যালি প্রয়োজন কিনা–আমি ঠিক জানি না। এবং মানে যৌনতার চর্চার অন্য যেই জায়গাগুলো, যেমন, যখন আপনার ওই কমলির কাছে ইয়ে যায়—চঞ্চল চৌধুরীর নাম কী ছিল? [–কালুয়া] কালুয়া। সে যখন যায়, তখন অন্য একজন তাঁর সাথে থাকেন। ফলে কালুয়াকে সে ফেরত পাঠায়। এই যে আপনার তৃতীয় একজনার উপস্থিতিতে যৌনকর্ম করা যাবে না, এই যে এই, মূল্যবোধ হিসেবে এটা একদমই খুবই ভিক্টোরিয় দ্বৈত এবং আমাদের এখানকার তুলনায় মধ্যবিত্তের যে যৌনতার প্র্যাকটিস, যেইখানে আসলে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি কিংবা দেখবার সম্ভাবনা আছে, টের পাবার সম্ভাবনা আছে, সেখানে যৌনকর্ম করা যায় না; এই যে প্রস্তাব, সেটারই ইনসারশন আমি ওখানে একভাবে দেখলাম। আমি মানে জানি না যে, লালন কিংবা বাউলদের ভেতরে যৌনতার চর্চা সত্যিকার অর্থে কেমন ছিল কিংবা আছে। কিন্তু প্রজেক্ট হিসাবে যেহেতু মধ্যবিত্তের যেই আপনার, যৌনতার চর্চার ধরন, সে ধরনটা আমি ওখানে দেখছি। ফলে এ দুইটার ভেতরে বে-যোগাযোগ আছে, এটা ভাবা মুশকিল হয় আমার জন্য। ফলে আমি এটা ওইভাবে দেখি।

অন্য একটা একটা পার্ট হচ্ছে, যেই ধর্মীয় মূল্যবোধ লালনের মা দেখায়, সেটা–এই লালনের মার, একটা ছোট জাত হিসাবে তাঁর জাত যাবার চিন্তা অত প্রকট থাকবার কথা কিনা হিস্ট্রিক্যালি, সেটা নিয়ে আমার একটা প্রশ্ন আছে। মানস চৌধুরী যেটা বললেন যে, আমরা এ চরিত্রগুলোকে বুঝবার জন্য মুভির কাছে যাব কিনা। আমরা যাই বা না যাই, কিন্তু চরিত্রগুলোকে একভাবে যে পরিবেশন করে–যে, চরিত্রগুলো এমন ছিল। এখন ছোট জাতের একজন নারী তাঁর ছেলেকে সে গ্রহণ করবে কি করবে না, সেটার জন্য জাত বিষয়ে তার যেই চিন্তা, সেটা আসলে কতটা প্রকট হওয়া সম্ভব? মানে জাত হিসাবে তার ব্রাহ্মণী হওয়া হয়তো অনেক বেশি সঙ্গত ছিল; মানে, জাত বিষয়ে তাঁর যেই চিন্তা… এই রকম কতগুলো জায়গা, যেটা আমার মনে হয়েছে যে, এটা ইতিহাস নির্মাণের যেই ধরন যে, মধ্যবিত্তের যেই, কিংবা আপনার উপরের শ্রেণীগুলোর যেই চিন্তা এবং চর্চা তা আসলে তার নিচে পুরোটাই ব্যাপ্ত অবস্থায় থাকে, এই যে একটা পূর্বানুমান, সেই পূর্বানুমানেরই এক ধরনের প্রতিষ্ঠাকরণ আমি মুভিতে দেখতে পাই। এ পর্যন্তই এখন বললাম।

—-

কিস্তি ১ সমাপ্ত
চলবে…


ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts