আর্টস বৈঠকমেহেরজান বিতর্ক (কিস্তি ৭)

admin
Published : 1 June 2011, 09:02 PM
Updated : 1 June 2011, 09:02 PM

কিস্তি ৬-এর পর
————-

মুসতাইন জহির: আচ্ছা আমি এই ফাঁকে, চা আনতে আনতে একটা কথা বলি। সুমন ভাই যেটা বললেন—মানে আমার মনে হয় যে, ছবিটাতে আমরা প্রধানতঃ, এইখানে আলোচনায় প্রধানতঃ যে জিনিসটা শুনলাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ যে চরিত্র, তার যে বীরত্ব—সমস্ত কিছু, পরিপূর্ণ দায়-দায়িত্ব নিয়েই যে কাউকে ছবি বানাইতে হবে; এটা প্রতিষ্ঠিত এখানকার আলোচনায়। তাতে কেউ বিচ্যূত হইলে তাঁর সমস্যা এবং তাঁর খবর আছে। এবং মুক্তিযুদ্ধকে আমরা–বাংলাদেশে গত দশ বছরে শুধু ফ্যাসিজম দেখেছেন আপনি—তা না, বইটা নিয়ে এসেছি, মাঝখানে ভাবছিলাম আলোচনা করবো না, এটা ১৯৯৩ সালে 'খবরের কাগজ,-এ ছাপা হয়েছে, হুমায়ুন আজাদের একটা লেখা, এটার নাম হলো—আমার মুক্তিযুদ্ধ। আপনারা, আমি জানি না কারা কারা পড়েছেন। লেখাটা তিন পৃষ্ঠার, পুরাটা আমি পড়বো না, অনেকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে। সংক্ষেপে গল্পটা হলো—উনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭১-এর যুদ্ধের পরে গিয়েছে, সেখানে এক ফরাসি মেয়েকে দেখেছে এক পাকিস্তানির সাথে বসে আছে, এখন এই পাকিস্তানির হাত থেকে এই মেয়েকে উদ্ধার করে তিনি কিভাবে এই মেয়েকে দখল করলেন—এটা হলো তাঁর মুক্তিযুদ্ধ। এটা কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদী আবেগের এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান আমি মনে করি। শেষে উনি বলেছেন,


মেহেরজান বিতর্ক: কিস্তি ০৭

'আমি পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করেছিলাম একাত্তরের কয়েক বছর পর। বাংলাদেশ থেকে সুদূর এডিনবরায় একটি হানাদারকে খুন করার সুখ আজো আমার বুক ভরে আছে।'
ফরাসিরা কবিতা, নন্দন, শিল্পকলা—এগুলা বোঝে জানে কিন্তু পাকিস্তানিরা জানে না। রেসিজম নিয়ে যে তর্কটা হচ্ছে, সেটার জন্য হুমায়ুন আজাদের উদ্ধৃতিটা বলি,

'আমি জানি পাকিস্তানিরা কবিতা ছাড়াই বাঁচে, রক্ত খেয়ে বাঁচে, কিন্তু মেয়েটি জানে না।'

আরো বলি,–
[পিয়াস করিম: হুমায়ুন আজাদ অনেক দায়-দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন…] 'মেয়েটিকে কি সে চুমু খাবে, সোনালী চুলের ঘ্রাণ নেবে, নাকি ধর্ষণ করবে? আমার মনে হলো, পটিয়ে ঘরে নিতে পারলেই পাকিস্তানিটি ধর্ষণ করবে ঐ সোনালীকে। আমার মনে হতে লাগলো, পাকিস্তান-ধর্ষণ, পাকিস্তান-ধর্ষণ, ধর্ষণ,…'

এই রেসিজম এবং এই যে বিকট এবং উৎকট যে ঘৃণা এবং মুক্তিযুদ্ধের নামে…এই লেখাটা লিখেছেন, 'আমার মুক্তিযুদ্ধ' নামে। আজ পর্যন্ত আমি দেখি নাই—এ ধরনের বক্তব্য দেখার পরে কেউ আপত্তি করেছে।
[পিয়াস করিম: আমি বলবো যে, আমাদের হেজেমনিক লিবারাল-সেক্যুলার ডিসকোর্সের মধ্যে সবচেয়ে সংকটের জায়গাটা হচ্ছে এটা…] এই যে চেতনা আমরা ধারণ করছি, জাতিগতভাবে আমার মনে হয় এটারও আমাদের দায় নেওয়া দরকার। এবং এই ফ্যাসিজমগুলা কিন্তু একদিনে আসে নাই, ফ্যাসিজম হঠাৎ করে গত দুই বছরে তৈরি হয় নাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যখন আমরা বলি, একটু যেন সাবধানে বলি। এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকেই…

মোরশেদুল ইসলাম: কেন, সাবধানে বলবো কেন?

মুসতাইন জহির: কারণ, এগুলাও (হুমায়ুন আজাদের বইটি দেখিয়ে) এটার সাথে যুক্ত…[মোরশেদুল ইসলাম: না, এগুলা যুক্ত না।] অবশ্যই যুক্ত।

মোরশেদুল ইসলাম: এইটা একজন লেখকের ব্যক্তিজত অভিজ্ঞতা হতে পারে বা ব্যক্তিগত মতামত হতে পারে। এর সাথে এখানে, মুক্তিযুদ্ধ যুক্ত করা যায় না।

মুসতাইন জহির: না, এধরনের একটা অশ্লীল এবং উৎকট কথা যখন একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে [মোরশেদুল ইসলাম: সেটাকেও আমরা কনডেম করবো, সেটাকে আমরা গ্রহণ করি নাই।] সেটাই বলছি, 'আমরা সাবধানে বলি' বলতে আমি সেটাই বলছি—আমরা এ ধরনের উৎকট ও বিকট যে চিন্তাগুলো আছে, যেগুলো আমাদের এ ধরনের ফ্যাসিস্টিক টেন্ডেন্সির দিকে নিয়ে যেতে পারে, সেগুলো আমরা…

সুমন রহমান: সেগুলো আগে থেকেই হয়ে আসছিলো।

মুসতাইন জহির: আগে থেকেই হয়ে আসছিলো এবং সেটাই তো এখানে পুষ্ট করেছে। আমরা ২০১১ সালে এসে যে এটা প্রথম দেখছি—তা না তো। এটা তো গত বিশ বছরে, পঁচিশ বছরে আস্তে আস্তে তৈরি হয়েছে। এই যে সবাই রাজাকার খুঁজছে, যখনি এই ছবি নিয়ে কেউ ভিন্ন কথা বলছে, তাঁকে রাজাকার বলছে, ওনাকে রাজাকার বলছে, কেন? এই ছবিটি যে বানিয়েছে সে পরিষ্কারভাবে আওয়ামী লীগের ঘরের সন্তান, তাঁর বাবা মন্ত্রী, কিন্তু এই ছবি নিয়ে…

পিয়াস করিম: তাঁর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রুবাইয়াত ব্যক্তিগত জীবনে একজন লেফটিস্ট।

মুসতাইন জহির: আমি শেষ করি একটু। এই ছবি নিয়ে প্রথম যারা আপত্তি করেছেন এবং সলিম ভাই যাদের বললেন, বাংলাদেশের একটা এলিট এবং বাংলাদেশের একটা সামন্তীয়… যে আপনার রোমান্টিসিজম আছে, যারা এটাকে মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে দেখতে চায় না। এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম আপত্তির জায়গা–যারা সেন্সরের কথা… আপত্তি তুলেছে, যারা এই ছবিটা নিষিদ্ধ করার কথা বলেছে, তারাও সবাই এলিট।


মেহেরজান সিনেমার দৃশ্য

মোরশেদুল ইসলাম: কেউ কিন্তু ছবিটাকে নিষিদ্ধ করার কথা বলেনি।

মুসতাইন জহির: তা না হলে কাবেরী গায়েন বা অন্য যারা যৌথ যে লেখাটা লিখেছে, সেখানে কথাটা আসল কেন? আমরা…

মোরশেদুল ইসলাম: সেখানে ছবি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়নি।

মুসতাইন জহির: অবশ্যই।… বন্ধ করার কথা বলেছে।

সলিমুল্লাহ খান: আচ্ছা, এখানে একটা বিপদ আছে। বিপদটা হচ্ছে…

মোরশেদুল ইসলাম: না, না, এখানে "ছবিটা নিষিদ্ধ না করা"র কথা বলা হয়েছে।

সলিমুল্লাহ খান: মোরশেদ ভাই, এক সেকেন্ড, আমি বলি, একটা বিপদ হচ্ছে কী–এই ছবিকে যারা নিষিদ্ধ করার জন্য বলছে, ধরেন, আমরা, মানে, এদেরকে আমরা ফ্যাসিস্ট বলে গাল দিচ্ছি। এটা আমি মনে করি, একটা যুক্তিসঙ্গত চিন্তা, কিন্তু এই ছবিকে যদি–যে কেউ সমালোচনা করে, সাথে সাথে তাদেরকে ওই ফ্যাসিস্ট জাতীয়তাবাদীদের অংশ মনে করাটা কিন্তু আরেকটা ফ্যাসিজম।

মোরশেদুল ইসলাম: এবং আমি বললাম যে আমি বিশ্বাস করি, আমি প্রথমে আমার বক্তব্যে কিন্তু বলেছি যে, আমি বিশ্বাস করি যে, ছবিটা যারা বানিয়েছে, শুধু রুবাইয়াত না, তার সাথে আরও যারা ছিল তারা নিশ্চয় প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ এবং তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটা ছবি খুব ভেবেচিন্তে বানিয়েছে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমার মনে হয়েছে, এটা তাদের, মানে যেকোনো কারণে এটা ঘটতে পারে, বিভ্রান্তির কারণে—কিন্তু, আমি জানি না, মানে, কিন্তু, মানে এই ছবি হয়তো, মানে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে উসকেও দিতে পারে, বা উৎসাহিতও করতে পারে। এখনো আমার মনে হচ্ছে।

সুমন রহমান: এখন–কোন অর্থে করতে পারে?

মোরশেদুল ইসলাম: বিভিন্ন অর্থে করতে পারে। [সুমন রহমান: মানে, একটু যদি আপনি…] বলা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আমরা যারা কথা বলি, তারা যেন একটু সাবধানে বলি। এ ধরনের কথা যখন বলা হচ্ছে তখন তো আমি সেই…

মুসতাইন জহির: আচ্ছা, আমি স্যরি, আমি বলছিলাম যে এই ধরনের (হুমায়ুন আজাদের বই) অবস্থান…

মোরশেদুল ইসলাম: আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আবেগ থাকবে–সেইটা কি–সেইটা কি খুব বাজে ব্যাপার?

সুমন রহমান: না, না, সেটা থাকবেই, আবেগ তো থাকবেই…

মুসতাইন জহির: আবেগটা উৎকট হলে, সেটা নিয়ে আমাদের সাবধান হতে হবে না?

মোরশেদুল ইসলাম: উৎকট হলে, হ্যাঁ, ওই রকম হুমায়ুন আজাদ…হলে তো আমরা—সেটা অন্য কথা।

পিয়াস করিম: কিন্তু মেহেরজান মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি উসকে দিতে পারে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি এতটা ঠুনকো হওয়ার কথা ছিল? [মোরশেদুল ইসলাম: না, আমি মনে করি না।] মেহেরজান… এটা কি…

সলিমুল্লাহ খান: না, না, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এতটা ঠুনকো নয়। হুমায়ুন আজাদ যেটা লিখেছে…

মোরশেদুল ইসলাম: আর এক সপ্তাহ ছবিটা থাকলে এই ছবিটার স্বাভাবিক মৃত্যু হতো। দর্শকরাই ছবিটা নামিয়ে দিত।

সলিমুল্লাহ খান: হুমায়ুন আজাদের লেখাটা হচ্ছে, হুমায়ুন আজাদের লেখা হচ্ছে–সিম্পল হোয়াইট ট্র্যাশ।

পিয়াস করিম: আমি একমত।

সলিমুল্লাহ: এইটাকে রিপ্রেজেন্ট করার, এটা কোনো সিগনিফিক্যান্ট বলে আমি মনে করি না।

পিয়াস করিম: পুরোপুরি একমত আপনার সাথে।

সলিমুল্লাহ খান: এটা সমালোচনার যোগ্য একটা বক্তব্য নয়। অর্থাৎ এটা হচ্ছে একজন ইনসেইন লোকের বহিঃপ্রকাশ। এখন বলেন, আমাদের হোল সোসাইটিতে আমরা ইনসেইন হই, সমস্ত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা মুক্তিযুদ্ধের সাথে, মানে, চেতনা বলে এখন আইডেন্টিফাই করে, তাহলে এটা আমাদের সমালোচনা করতে হবে; এখন হুমায়ুন আজাদ রিপ্রেজেন্ট কিনা?

মুসতাইন জহির: আচ্ছা, আমি একটু, আমি একটু ক্লারিফাই করি। এই কথাটা উল্লেখ করেছি আমি এই কারণে, আমি, নামটা এস্‌ছে, আমি নিজে নামটা নিতে চাই না, যেমন নায়লা জামান খানের যে চিঠিপত্র চালাচালি হয়েছে, সেটা একই জিনিস রিপ্রেজেন্ট করে। একই সাইকোলজি রিপ্রেজেন্ট করে।

ব্রাত্য রাইসু: কী করে, বলেন?

মোহাম্মদ জহির: তিনি যেভাবে উত্তেজিত হয়েছেন–তাঁর ভাষাভঙ্গি। তিনি বলেছেন, 'কোট আনকোট', যে এটা প্রো-পাকিস্তানিদের পয়সায় এই ছবি হয়েছে। হোয়াট ডাজ ইট মিন?

ব্রাত্য রাইসু: এটা কি উনার মেইলের?

মোহাম্মদ জহির: উনার মেইলের মধ্যে এটা পরিষ্কারভাবে আছে।

পিয়াস করিম: আমি যতদূর জানি রুবাইয়াতের বাবা টাকা দিয়েছে, আর কি। রুবাইয়াতের বাবা তো আওয়ামী লীগের যোগাযোগমন্ত্রী।

ফরহাদ মজহার: আমি এর দু-একটা পয়েন্ট বলি। আপনাদের সবার কথা অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে শুনছি। দয়া করে আমার দু-একটা পয়েন্ট শোনেন। প্রথম কথাটা হচ্ছে এই যে, আমরা তো প্রথম থেকে যে ক্যাম্পেইনটা চলেছে ছবিটার বিরুদ্ধে, আমি ছবিটার অন্যান্য যে… করা হয়েছে, ক্যারেকটারগুলি স্টাবলিশ্‌ড্‌ হয় নি। এটা দুর্বল ছবি, এগুলো আমি মেনে নিচ্ছি। এখন আমি… আমার কাছে সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতার জায়গা যেটা, কনসার্ন যেটা, সেই কনসার্নের ব্যাপারটা হলো এই, সেটা আমি বলব যে, কিছুটা আমি ফাহমিদের সাথে অত্যন্ত একমত, যে উদ্বিগ্নতা সে প্রকাশ করেছে—একটা হলো যে, আপনি যখনই, আমরা বলি শুরু থেকেই, প্রথম থেকেই। ছবির হল থেকে বেরিয়েই অনেকের মুখে শুনেছি, লিখিতভাবেই দেখেছি যে, একটা নির্ভেজাল এটা একটা পাকিস্তানি প্রপাগান্ডার ছবি। এটাই কিন্তু বলা হয়েছিল…এবং খুব পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, এটার উদ্দেশ্যই হচ্ছে যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারকে দ্বিধাগ্রস্ত করা, বাধাগ্রস্ত করা। মানে এটাই কিন্তু—প্রথম প্রপাগান্ডার জায়গা কিন্তু এটাই। আমি বলছি, এটা কারেক্ট কি ইনকারেক্ট, আমি সেটা বলছি না। প্রপাগান্ডার জায়গাটা এই জায়গায়। আর দ্বিতীয়ত, এটা হলো আমার প্রথম জিনিসটা হচ্ছে যে এই—এইটাই আমরা পরবর্তীকালে এই পর্যন্ত ছবিটা সম্পর্কে যারা বিরোধিতা করেছে, তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কিন্তু, আমরা ওই কাঠামোটাই কিন্তু আগাগোড়া দেখছি। এটা প্রপাগান্ডার জায়গা। এটা সেলিম বোধ হয় আলোচনা করলে আরও পরিষ্কার করতে পারত যে—সেলিমের আলোচনার মধ্য দিয়ে, কিন্তু বেসিক্যালি যেটা আমরা ওই বাঙালি ন্যাশনালিজমের কাঠামোটা বেসিক্যালি দেখছি। আমি কিন্তু আদৌ তোমার, তোমার ক্রিটিক্যাল জায়গা—তোমাকে আরো সময় দিলে হয়তো তুমি ক্লিয়ার ধরতে পারতা। কারণ, আমাদের কাছে যেটা দরকার, জরুরি কাজ করার–সেটা হচ্ছে যে, আমাদের যে–আহমদ ছফা যে মুক্তিযুদ্ধকে ওউন করার পরে একইসঙ্গে কিন্তু বাঙালি রেইসিজমকে কিন্তু ওউন করে নাই। আমরা হুমায়ুন আজাদের মধ্যে দেখতে পাইতেছি একটা উৎকট রেইসিজম। সেই রেইসিজমটা কিন্তু আমরা যখন অসতর্ক থাকি, আমরা যখন আরও ভালোভাবে বলতে পারি, হুমায়ুন আজাদের মতো ট্র্যাশ না লিখে সুন্দর করে তর্ক করতে পারি, বলতে পারি, তখন আমাদের মধ্যে কিন্তু আমাদের অবচেতনে কিন্তু সেই রেইসিজমটা কিন্তু আমাদের কাজ করে। কাজ করে বলে ওয়াসিম–আমি বলছি, ছবিটা খুব খারাপ ছবি। আমি বলছি যে, আমি আপনাদের সঙ্গে, অনেকের সঙ্গে আমি একমত–ওয়াসিমের মতো একটা লোক, বালুচ–যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ডিজার্টার হওয়ার পরেও, মসজিদে গুলি করতে মানা করার পরেও এবং তার পরে সে পালিয়ে বেড়াবার পরেও, লিটারেলি সে কিন্তু পাকিস্তানিও নয়, বাঙালিও নয়, হি ইজ লিটারেলি এ পারসন হু ইজ জাস্ট গোয়িং টু বি কিলড। সে তবু কিন্তু বাঙালিদের মন জয় করতে পারে নি। মানে, আমি বলছি, কল্পনার দ্বারাও—এরকম একটা চরিত্র অবাস্তব মনে করি আমি।

ব্রাত্য রাইসু: এবং এখনো পারে নি।

ফরহাদ মজহার: এখনও সে পারে নি এবং আমাদের এখানেও কিন্তু আমরা পারি নি কিন্তু।… এটা যে একটা, এটা একটা পসিবল, ধরেন, এটা কল্পনা, এটা ফ্যান্টাসি। এখন এটা একটা ফ্যান্টাসি বললে আমরা কিন্তু রিজেক্ট করে দিতে পারি এটাকে। কিন্তু যখনই এটাকে আমরা পাকি ফান্টাসি বলি তখনই কিন্তু আমরা রেইসিজমের মধ্যে কিন্তু প্রবেশ করি, বা আমি বলি এসেনশিয়ালি বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে তার যে ইনহ্যারেন্ট রেইসিস্ট যে ক্যারেকটারটা রয়ে গেছে, যেটা আমরা মুক্তিযুদ্ধকে ওউন করার মধ্যে দিয়ে–এটাকে যে আমরা ক্রিটিক করব, এখান থেকে যে বেরিয়ে আসব—এখান থেকে কিন্তু আমরা কেউ বেরিয়ে আসতে পারি নাই। আমি তার সবচেয়ে বড় প্রধান ভুক্তভোগী কারণ আমি যখন প্রথম 'ইবাদতনামা' লেখি তখন আমি… প্রথম… সেলিম [সলিমুল্লাহ খান] জানে, প্রথম প্রপাগান্ডা শুরু হয় যে, আমি মৌলবাদী হয়ে গেছি। আমি কয়েকদিন পর… কী বলে, আমাদের আল মাহমুদের মতন মৌলবাদীদের দলে আমি চলে যাব। আমাদের তো কাজটা ছিলো যে, এই কারণে বা যেটা ফাহমিদুল দিতে চেষ্টা করেছে যে, মুসলমানিত্বের একটা ব্যাপার আমরা আলাদা করে রেখে দিছি। একটা হিস্টোরিক্যাল রিজনে, কারণ যেটা সেলিম বলছে আমরা একটা ঔপনিবেশিকতা দ্বারা আমরা নিপীড়িত হয়েছি, একটু পার্থক্য আছে আমার, কিন্তু আমি একমতও আছি, বেলা গেলে হয়তো পরিষ্কার হবে। তার মানে আমরা এখনো পর্যন্ত আমাদের যেই বা যেটা ছফার মধ্যে ছিল, এর আগেও আমরা চেষ্টা করেছি যে, বাঙালি মুসলমানের যে কতগুলো হিস্টোরিক্যাল, তার যে লিগেসিগুলো আছে–যে কারণে সে একদিকে তার সে কম্যুনাল ক্যারেকটার তার প্রতিক্রিয়াশীল ক্যারেকটারটা যেমন আছে, একইসঙ্গে ইসলামের একটা ইগালেটারিয়ান ক্যারেকটার তার রয়ে গেছে, সে ধারণ করে ওটা। অ্যান্টি কাস্ট তার একটা চরিত্র আছে। তার একটা ভিন্ন একটা তার মাত্রা, সে নিম্নবর্গের মানুষ থেকে, নমঃশূদ্র থেকে—তার একটা ব্যাপার আছে, তার ক্লাসের ব্যাপারটা আছে। এটা ধরবার জন্য, আমাদের যে কালচারাল যে কাজগুলো করার কথা ছিল, যেটা আমরা রিসলভ করতে পারতাম, সেটা আমরা কিন্তু ইন্টেলেকচুয়ালি অনেক সময় আমরা আমাদের হাত থেকে আমরা ফেলে দিচ্ছি। আমরা অনেক সময় এড়িয়ে গেছি বা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি ওটাকে, যেটাকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট করা দরকার। যে কারণে আমি অনেক সময় বলি, মনে করি যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করা বেস্ট, সহজ, আমি সরলীকরণের কথা বলছি, সরলীকরণ—যদি আমরা সেভেনটি ওয়ানকে দেখি, যেটা আসলে বাঙালি মুসলমানের জায়গা ওখানে–বাঙালি বলে স্বীকারই করা হয়নি হিস্টোরিক্যালি, স্বীকারই করা হয়নি। তাকে রক্ত দিয়ে কিন্তু প্রমাণ করতে হয়েছে যে সে বাঙালি। সেভেনটি ওয়ান, দিস ইজ দ্য ইন্টারপ্রিটেশন।


মেহেরজান সিনেমায় নামাজে বয়স্ক মেহের (জয়া বচ্চন)

আর তার পাল্টা ইন্টারপ্রিটেশন ছিল যে ইসলাম এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এমন একটা অন্তর্ঘাতমূলক একটা সম্পর্ক আছে, যার সঙ্গে মিলন অসম্ভব। আর ফলে ওয়াসিমকে আপনি–কিছুতেই বাঙালি মেয়ের সঙ্গে মিলন করতে দেব না আমরা। হি সিম্বোলাইজেস নট ওনলি পাকিস্তান, হি সিম্বোলাইজেস অলসো দ্য সেইম টাইম 'দ্য রিলিজিয়ন'। যেটা আমরা, যেটাকে আমরা, সব সময় আমরা, ক্রিটিক আমরা করি। যেটা যাবার কারণে… আমরা বলছি, প্রথমে বলছি ছবিটার প্রতি অবিচার হয়েছে। অবিচার এই কারণে নয় যে, ছবিটা, আপনাদের সমালোচনার সাথে আমি অ্যাগ্রি করি না। আমি একশ ভাগ একমত করি। অবিচারটা হয়েছে যে, আমাদের নিজেদের যে পোষণ করা যে… যেটাকে আমরা যদি গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ না বলি ফাহমিদের মতো… আমরা নিজেরা যা পোষণ করি, যে বয়ানটা আমি, আরাম লাগে আমার কাছে, যেটা শুনলে আমি স্বস্তিতে ঘুমাইতে পারি, সেটা যখন–সংঘাতটা তার মধ্যে লাগে, তখনই কিন্তু আমরা এটাকে সহজে, এটাকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না। এটা আমার কাছে খুব, খুবই সমস্যা মনে হয়। কারণ ব্যক্তিগতভাবে এটা সাফার করি বলে এটা আমি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি। আমি মনে করি যে, একইভাবে আমি মনে করি যে আজকে রুবাইয়াত হোসেন—আমি যতটুকু তার পরিবারিক পরিচয় জানি বা তাদের যে দলটল যতটুকু জানি, এটা তো… আওয়ামী ঘরানার নারী। আমি খারাপ অর্থে বলছি না, মানে খুব খুব–পরিচিতির জন্য, আমাদের বামপন্থী যেটা আমরা শুনলাম যে—প্রগতিশীল, লেখা তার চিন্তাভাবনাগুলায় আছে, কারণ তার লেখার মধ্যে এক ধরনের ক্রিটিক করার চেষ্টা করছে সে, বিভিন্ন ধরনের জায়গাতে। একটা ক্রিটিক্যাল তার দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তাহলে সে নিঃসন্দেহে একটা পাকি প্রপাগান্ডার ছবি বানাবে না। মানে এটা তো আমাদের, ন্যূনতম আমাদের এই চিন্তাটা থাকা দরকার। তার মানে, আমরা একটা ব্যক্তিকেও—আমরা, তাঁর বিরুদ্ধে যে সব অশ্লীল লেখা আমি ব্লগে দেখেছি, অতি বাজে, নোংরা। আমরা একটা, একটা মেয়ে, ইয়ং মেয়ে অতি তরুণমাত্র একটা আসছে। তাঁকে আমরা যেভাবে হেনস্তা করছি, তাঁর হেনস্তা—আমি তখন চিন্তা করলাম যে গত–আজকে থেকে ১৯৮০ সালের শেষ থেকে আমরা আজ পর্যন্ত কতভাবে হেনস্তা হয়েছি, মানে তার চেয়েও বেশি হয়েছে। এটা আমি মনে করি যে, আমার অ্যাপিলটা থাকবে যে–আমরা যেন এগুলা সতর্ক থাকি, যে আমরা কীভাবে আসলে একটা ব্যক্তিকে কমপ্লিটলি সাইলেন্সড করে দেই, ক্রিটিকটা করার আমরা সুযোগ রাখি না।


মেহেরজান সিনেমার দৃশ্য

সেলিমের জায়গাতে আমি যেটা বলব যে, সেলিমের ডেফিনিটলি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে, যেখানে আমি বোধ হয় আমার, ওর সঙ্গে—আমি বলব যে, ভাবতে বলব ওকে, প্রথমত, এই যে আমি কিন্তু পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ব্যাপারটাকে শুধুমাত্র কলোনিয়াল অপ্রেশন বলতে রাজি না। যেটা অ্যাকচুয়ালি–কারণটা হলো এই যে, আমাদের সেভেনটি ওয়ানের সময় যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পেছনে অন্যান্য যে বামপন্থী আন্দোলনগুলো ছিল, তাদের যে ধারাগুলো ছিল, এটা যথেষ্ট জীবন্ত ধারা ছিল। তা যথেষ্ট অ্যাকটিভ, সক্রিয় ধারা ছিল। তারা রাজনীতি ভুল করেছে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। তাদের আপনার 'দুই কুকুরের লড়াই' বলে তারা হয়তো ভুল করতে পারে। যদিও আমি এটার পক্ষে–আমার যতটুকু অভিজ্ঞতা, আমি মনে করি না এটা ডমিনেন্ট একটা টেনডেন্সি ছিল বঙ্গের মধ্যে। কারণ সেখানে মূল যে তর্কটা ছিল যে, সে সময় যে দুই অর্থনীতির যে তত্ত্বটা বড় কথা ছিল, যে দুই অর্থনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ কলোনিয়ালি শোষিত হচ্ছে; তার পাল্টা–এখানকার যারা, বিশেষত যারা বিপ্লবী রাজনীতির ছিল, তাদের পাল্টা বক্তব্য ছিল, পাকিস্তান তখন একটা ক্যাপিটালিস্ট ইকোনমি ফলো করতেছিল হার্ভার্ড ইকোনমিস্টদের দ্বারা। কারণ আপনারা আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালো জানবেন। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি এখানে আছেন। হার্ভার্ড ইকোনমিস্টদের দ্বারা, যেখানে পাকিস্তান একটা ক্যাপিটালিস্ট ডেভেলপমেন্ট হিসেবে ডেভেলপ করছে, তখন স্বভাবতই ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরগুলো, শহরগুলো তখন গ্রামকে শোষণ করে। ফলে বাংলাদেশের শোষণের চরিত্র, তারা বারবারই বলছিল–এটা ক্যাপিটালিস্ট চরিত্রের। এটা একটা–যেভাবে রেসিয়ালি দেখা হয়েছে নাইনটিন সেভেনটি ওয়ানকে–তা ছিল না। যে কারণে তারা বলেছে, সারা পাকিস্তানব্যাপী একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লব করতে। কারণ যদি আমরা পাকিস্তানে, আলাদা করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনটা করি, তাহলে পাকিস্তান একটা—ফিউডালিজমকে আমরা পরাস্ত করতে পারব না। দ্যাট ওয়াজ, যে কারণে আমরা পরবর্তীকালে পাঞ্জাবি ছাত্রদের লড়াই, বাংলাদেশের আপনার ভাসানীর সঙ্গে যে সম্পর্ক পশ্চিম পাকিস্তানের, কারণ এই–একটা পাকিস্তানভিত্তিক যে একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটা চিন্তা, স্বপ্ন তাদের মধ্যে ছিল, এটা ভুল হতে পারে। কারণ এটা তখন, সে সময় আমি মনে করি যে, একমাত্র সম্ভবত সিরাজ শিকদারের দল ছাড়া আরও দু-একটা স্পিন্টেড গ্রুপ ছিল, তারা ছাড়া জাতীয় প্রশ্ন বনাম শ্রেণী প্রশ্ন, মানে আমাদের সংগ্রামটা, যেখানে জাতিদ্বন্দ্ব-প্রধান নাকি শ্রেণীদ্বন্দ্ব-প্রধান, এই প্রশ্নটাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ সেভেনটি ওয়ানের বিতর্ক ছিল। আমি বলছি যে, এই ছবিটা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত আপত্তিটা আরও অনেক বড়, কিন্তু এটা আমি মনে করি, যে—আপনাদের সমালোচনার তুলনায় আমার, সুমনের যে ক্যারেকটার দেখানো হয়েছে—এত সিম্‌প্লিস্টিক না, এবাদের বইটা আমি পড়ি নাই; মানে বামপন্থীদের আন্দোলনটা অত সরলীকরণ করা যাবে না, কারণ সেখানে যথেষ্ট তত্ত্বগত দিক ছিল এবং যথেষ্ট লড়াইয়ের দিক ছিল। তার মানে সেভেনটি ওয়ান থেকে দুটো ধারা আমরা দেখেছি—একটা ধারা পরাজিত হয়েছে।

ভিডিও ধারণ ও অনুলিখন: প্রমা সঞ্চিতা অত্রি

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts