আর্টস বৈঠকমেহেরজান বিতর্ক (কিস্তি ৪)

admin
Published : 30 March 2011, 07:28 PM
Updated : 30 March 2011, 07:28 PM

কিস্তি তিন-এর পর


ওমর রহিম মেহেরজান-এর ওয়াসিম রূপে সিনেমার পোস্টারে

ব্রাত্য রাইসু: আচ্ছা, আপনি কি…আজম কিছু বলবেন নাকি?

মোহাম্মদ আজম: না, সলিম ভাইয়ের ইয়ের সঙ্গে আমি একটা জায়গায় ইয়ে করতে চাই। সেটা হল যে—মেহের এবং ওয়াসিমের প্রেমকে পাকিস্তানি এবং বাঙালির প্রেম হিসেবে কীভাবে বোঝা যাবে, যখন ওয়াসিম তো কোন অর্থেই পাকিস্তানের ফাইটিং ফোর্সটার প্রতিনিধিত্ব করছে না?

[ব্রাত্য রাইসু: আজম ভাই, নামটা বইলা নিলে সুবিধা হয়।]

মোহাম্মদ আজম: আচ্ছা, আমি মোহাম্মদ আজম; বাংলা বিভাগে পড়াই, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে।

সলিমুল্লাহ খান: আচ্ছা, ওয়াসিম কি ওখানে বেড়াইতে আসছে? ফাইটিং ফোর্সের প্রতিনিধিত্ব করছে না তো কী জন্যে আসছিলো গ্রামে?

মোহাম্মদ আজম: ওখানে সে পাকিস্তান আর্মির পক্ষ হয়ে এসেছে।

সলিমুল্লাহ খান: তো, তাহলে কী?

মোহাম্মদ আজম: আসার পর তাকে বলা হচ্ছে, তাকে আমরা যখন আবিষ্কার করি ফিল্মে, তখন আমরা তাকে দেখি দুইটা পজিশনে দেখি। নাম্বার ওয়ান, সে হল পাকিস্তান পক্ষ থেকে পালিয়ে এসেছে যার কোর্ট মার্শাল হয়েছিল, সেই ধরনের একজন লোক। তার মানে সে পাকিস্তানের বিপক্ষের একজন লোক। এটা সিনেমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি না, এর ফলে সিনেমার তাৎপর্য চেঞ্জ হয়েছে কি না, আমি সেটা বলছি না। এক্সাক্ট আমি ইনফরমেশনটা বলছি। এটা গেল একটা, আর দু'নম্বর হল সে—দেখাচ্ছে সিনেমায়, সেটাও রিয়েলিস্টিক কি না সেটা আমি দাবী করছি না, যেটা দেখাচ্ছে—যে যোদ্ধারা ঐ পাশ দিয়ে যাচ্ছে, মানে পাকিস্তানি সৈন্যরা—ঐ পাশ দিয়ে যাচ্ছে, তাদের হাত থেকে সে মেহেরকে রক্ষা করছে। এটা হল ইনফরমেশন। I am just putting it. নাম্বার ওয়ান। নাম্বার টু–আপনি (সলিমুল্লাহ খান) যেটা বলছেন যে মেহের পরবর্তী কালে—থার্টি এইট ইয়ার্স, এখানে সে কিন্তু ওয়াসিমের জন্য অপেক্ষা করছে বা ওয়াসিমের জন্য কাতর হয়ে দিন গুজরান করছে এ কথাটা কিন্তু ওর পরবর্তী কালে কোন ন্যারেটিভস-এ পরিষ্কার নয়।

সলিমুল্লাহ খান: ন্যারেটিভস এ পরিষ্কার আছে। সে কী বলছে?

মোহাম্মদ আজম: সে বলছে যে, 'আমি গ্লানিতে ভুগছিলাম'।

সলিমুল্লাহ খান: নো, আপনি…ঐ যখন সারা আসল, সারার সাথে আলাপে সে বলে কী—এই যুদ্ধ আমার পরিবারকে ছারখার করে দিয়েছে। বলে নাই?

মোহাম্মদ আজম: বলেছে।

সলিমুল্লাহ খান: এই ছারখার করার একটা অংশ হচ্ছে—'আমার এই একাকিত্ব'।

মোহাম্মদ আজম: একা…কিন্তু, সে তো বলছে—'আমি গ্লানিতে ভুগছি এ সম্পর্কের জন্য'।


আর্টস বৈঠক: মেহেরজান বিতর্ক কিস্তি ০৪

সলিমুল্লাহ খান: আশ্চর্য। সে কথাই হল তো! সে সারা'র সাথে আলাপ করার পর সে বলল যে—আমার প্লানি এখন দূরীভূত।

মোহাম্মদ আজম: আমি বলছি, এই দুই ইনফরমেশনের পরে ওয়াসিম এবং মেহেরের প্রেমকে আমরা পাকিস্তান ভার্সেস বাঙালির প্রেম হিসাবে এই সিনেমায় নিতে পারি কিনা?

সলিমুল্লাহ খান: আচ্ছা, একটা উদাহরণ দেই; নিতে পারেন কিভাবে—সিনেমার ভিতরে আমি উদাহরণ দেই, সিনেমার ভিতরে যখন, লক্ষ্য করেন, জঙ্গলের মধ্যে ওয়াসিম যখন মেহেরের মুখ চেপে ধরল, মেহের শুয়ে পড়ল, লক্ষ্যণীয় দু'বার দেখাইছে কিন্তু এইটা, প্রথমে একবার অল্প করে দেখাইছে পরে আবার—দুইবার দেখাইছে, তখন মেয়েটা তার হাত দিয়ে তাকে আঘাত করে। চুড়ি দিয়ে। চুড়ি দিয়ে—তার কপালের মধ্যে রক্ত আসে। পরে দেখা গেল কী যে, না, সে মনে করছিল, 'এই ছেলে তাকে রেইপ করতে আসছে'। (মোহাম্মদ আজম: ডেফিনিটলি।) তখন সে—পরে যখন সে টের পেল, না না না, সে তো আসলে আমাকে রক্ষা করতেছে তখন ধীরে ধীরে সে তার প্রেমে পড়ে, তার কাহিনীটা জানে। তার মানে কি? এটা যে—একদম অ্যালেগরিক্যাল রিপ্রেজেন্টেশন অব দি রিলেশনশিপ বিটউইন ওয়েস্ট পাকিস্তান এন্ড ইস্ট পাকিস্তান । কেন? মানে 'পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের আক্রমণ করতে আসছিল'—আমি ভুল করে তারে আঘাত করেছি। কিন্তু আসলে পশ্চিম পাকিস্তান আমাকে রক্ষা করতে আসছিলো।

মোহাম্মদ আজম: কেন, উল্টা পার্ট আরো স্ট্রং হবে! উল্টা পার্ট অনেক স্ট্রং হবে, সেই স্ট্রং-টা হবে এই—পূর্ব বাংলায় তখন বা বাংলাদেশে তখন পাকিস্তানের হাজার হাজার সৈনিক। ওদের মধ্যে ওয়াসিমের মতো এরকম লোক, এই পরিচালকের পক্ষে, যদি এই পরিচালক এই ব্যাপারটা—পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের একটা রূপক বা প্রতীক হিসাবে এটা উপস্থাপন করতে চাইতেন, তাঁর পক্ষে খুবই ইজি ছিলো যে—পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ফাইটিং ফোর্সের কোন একজন লোককে এ ধরনের রিলেশনে নিয়ে আসা? খুবই ইজি!

সলিমুল্লাহ খান: সেইটা, সেইটা তাঁর—পারসুয়েড করবে না কাউকে। আপনার, ছবির তো ন্যারেটিভ টেকনিক লাগবে?

মোহাম্মদ আজম: আমি বলতে চাচ্ছি যে আমি—এর দ্বারা রিকনসিলিয়েসন বুঝায় কি না—আমি সেই তর্কে যাচ্ছি না, আমি শুধু ইনফর্মেশন দিচ্ছি—সে তো আপনাকে প্রথমে বাধ্য করছে ভাবতে যে এই ওয়াসিম যে চরিত্রটা, সে চরিত্রটা ওই ফোর্সের সঙ্গে শুধু বিযুক্ত নয়, ওই ফোর্স তাকে পেলে—আমরা ধরে নিতে পারি—সে যেহেতু তার কর্তৃপক্ষের অর্ডার লংঘন করেছে, ফলে তাকে…মানে কোর্ট মার্শাল হবে এবং তার ফাঁসি হবে, আমরা এ রকম ধরে নিতে পারি, সেই সামরিক আইনে।

সলিমুল্লাহ খান: আচ্ছা, সেই কথাগুলো উপন্যাসে আছে…

মোহাম্মদ আজম: সিনেমায়ও আছে!

সলিমুল্লাহ খান: সিনেমায় একটু কম।

মোহাম্মদ আজম: সিনেমায়—এটা তো পরিষ্কার! পরিষ্কার মানে—সে ভায়োলেট করেছে তার অর্ডার, সিনিয়রের অর্ডার ভায়োলেট করেছে, আমরা আর্মির নিয়ম, প্রাইমারি নিয়ম জানি। ভায়োলেট করার মধ্য দিয়ে, সে তো আছে এমন এক পজিশনে, যে পজিশনে তাঁর যেটা সেল্ফ—তার পক্ষের যেটা সেল্ফ, সেটা তাকে রীতিমত আঘাত করবে, তাকে মেরে ফেলবে। ফলে আমরা কীভাবে এই সিনেমার যে কনোটেটিং মিনিংগুলা দেবো, আমরা এর যে সিম্বলিক অথবা মেটাফরিক মিনিংগুলা দেবো, তখন সেখানে আমরা ওকে পাকিস্তান পক্ষের একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসাবে সরাসরি—ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমরা ভাবতে পারি—কিন্তু সরাসরি আমরা উপস্থাপন করতে পারি কি না—এই হলো আমার প্রশ্ন।

সলিমুল্লাহ খান: ঠিকই আছে, আমরা সরাসরি পারি না।…

মোহাম্মদ আজম: আর দ্বিতীয়টা আমি যেটা বললাম, আবার বলতেছি—মেহের পরবর্তিকালে তাঁর যে প্রেজেন্স, আটত্রিশ বছর ধরে—সে কিন্তু গ্লানির কথা বলেছে, একাধিকবার। সে গ্লানিতে ভুগছে এবং ইয়েকে বলছে, সারাকে বলছে যে, ওর—সারার পজিশন থেকে সে নিজে ওই গ্লানি থেকে মুক্ত হয়েছে।

সলিমুল্লাহ খান: আপনি একই কথা—আগেই বললেন—

আমি যে বলছি যে—'এই যুদ্ধ আমার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে'—দ্যাটস্ ট্রু। সে সবসময় এটাকে যুদ্ধ বলছে, এই যুদ্ধের ক্যারেক্টার সম্পর্কে তাঁর পজিশনটা কি? আমি বলছি কিন্তু—কথায় নয়, তাঁর কাজেও। যুদ্ধটা তাঁর কাছে এম্বিগুয়াসলি। গ্লানির অর্থ হচ্ছে—এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমি অনেক ত্যাগ করেছি। আমার পরিবার ত্যাগ করেছি, অথবা আমার সম্বল ত্যাগ করেছি, আমার জীবন…তারপরেও মানুষ—বলে কী এই— যুদ্ধের একটা অ্যাসেসমেন্ট প্রত্যেক মানুষ করে, আমরা বলি কি—এইটা ভালো দিক, এইটা মন্দ দিক, অ্যাজ এ হোল…

মোহাম্মদ আজম: এই সিনেমার—এই সিনেমার…পরিচালকের দিক থেকে যুদ্ধ সংক্রান্ত তাৎপর্য নির্ধারণের জন্য যদি মেহেরের কাছে যাওয়া হয়, তাহলে এটা সিনেমার টেক্সট রিডিং এবং এটা পরিচালকের জন্য খুব বড় অবিচার হবে। মেহের এখানে, মেহের এখানে আমরা বলব যে—মেটাফরিক্যাল রিপ্রেজেন্টেসন হিসেবে পড়া অনেক বেশি আরামদায়ক, সিনেমার পক্ষ থেকে, পরিচালকের উদ্দেশ্যের দিক থেকে। কিন্তু এই যুদ্ধ সম্পর্কে পরিচালকের যে মনোভঙ্গি, সেটা বোঝার জন্য আমাদের অবশ্যই যেতে হবে অন্য চরিত্রগুলোর দিকে। প্রচুর আছে, আমরা বলব যে 'নানাজান'-এর কাচে যেতে।

সলিমুল্লাহ খান: আচ্ছা, প্রচুর আছে…একটু আসেন আমি লাস্ট লাইন শেষ করি। আমি তিনটা পয়েন্ট বলছিলাম, একটা হচ্ছে—ছবির ভিতরের ক্যাকেক্টার হিসাবে—যেমন ধরেন, নীলার যে চিৎকার—আমি এ সন্তান চাই বা সন্তান চাই না, ফিল্মে এবং উপন্যাসে বেশ-কম আছে, আরো একটা জায়গায় বেশ-কম আছে—এই যে খাজা সাহেব…

ব্রাত্য রাইসু: একটা জিনিস জিজ্ঞেস করবো, সলিম ভাই; সেইটা হলো যে, উপন্যাসটা কি এই ফিল্মের আলোচনার জন্য জরুরী মনে করছেন কিনা আপনি।

সলিমুল্লাহ খান: হ্যা, আমি জরুরী মনে করছি এই জন্য যে—ছবির ইন্টারপ্রেটেশনের জন্য এটা একটা রেফারেন্স টেক্সট। আমি বোঝাচ্ছি যে পার্থক্যের মধ্য থেকেই আমি…করানোর চেষ্টা করছি। ছবিতে বলছে—যেমন ধরেন, খাজা সাহেবকে কে মেরেছে? ছবিতে এমন সাজেশন আছে যে, সুমন সাহেব তখন অস্ত্র হাতে নিচ্ছে, আর ওইদিকে পাকিস্তানি আর্মিরা আসছে। এমন একটা সাউন্ড হলো যে—ওনাকে পাকিস্তানি আর্মিও মারতে পারে, অথবা সুমনও মারতে পারে। পরিচালকের, দু'দিন পরে প্রথম আলোতে যে লেখা ছাপিয়েছে—পরিচালকের দুই দিনের দুইটা লেখা আমি দেখলাম, একটা—ইন্টারভিয়্যুতে উনি বলছেন, 'এই ছবিতে বিতর্কের কিছু নেই।' নেক্সট দিন উন বললেন, 'এই ছবিতে বিতর্ক আছে এবং সেই বিতর্ক চলতে থাকুক। বহু রকমের ব্যাখ্যা হতে পারে।' আমরা হয়তো সেই সুযোগই গ্রহণ করছি।

আমার আলোচনা থেকে আপনি মনে যদি করেন যে আমি ছবিটা বন্ধ করার জন্য ওকালতি করছি, সেটা ভুল ব্যাখ্যা হবে। আমি একমত মোরশেদুল ইসলামের সাথে যে—ছবির বন্ধ করার ডিসকোর্সে আমি নাই। কিন্তু ছবিটা যদি চলে তাহলে ছবিটা আমাদেরকে—আমরা কী বুঝি ছবি থেকে, আমি বলছি—আমি দর্শক হিসেবে কী বুঝি, আমি তো আমার কথা বলছি, আর কারো কথা বলছি না।

ব্রাত্য রাইসু: না না, সলিম ভাই, আমার যেইটা প্রশ্ন ছিল যে—উপন্যাসের সঙ্গে চলচ্চিত্রের যে তুলনাটা আপনি করতেছেন তা দরকারি কি না?

সলিমুল্লাহ খান: এক্সাক্টলি, আমি তো দরকার বলছি তো।…

[মোহাম্মদ আজম: রেফারেন্স চাচ্ছি।]

সলিমুল্লাহ খান: না, রেফারেন্স বলছি, সেইখানে—উপন্যাসে পরিস্কার আছে, সুমনের গুলিতে সে মারা যায়।

ব্রাত্য রাইসু: কিন্তু সেটা আমরা ছবিতে…

মোরশেদুল ইসলাম: ছবিতে কিন্তু ক্লিয়ার করা হয়নি যে পাকিস্থান আর্মির গুলিতে সে মারা যায়।


মেহেরজান সিনেমার পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন ক্যামেরার মধ্য দিয়ে ফ্রেম দেখছেন

সলিমুল্লাহ খান: রাইট, ছবিতে এম্বিকুইটি তৈরি করা হয়েছে। আমি এইটাই বলছি, রুবাইয়্যাত নিজেও বলছেন কি–রুবাইয়্যাত নিজেই বলছে—পাকিস্তানি আর্মির গুলিতে মারা যায়। ছবিতে ক্লিয়ার না কিন্তু। উনি পরে ইন্টারভিউতে বলেছেন। কিন্তু ঔপন্যাসিক, যিনি আগে ছিলেন, যার নাম ফিল্মে স্বীকার করা হয়েছে, তিনি বলছেন কী যে, সুমনই তাকে মারে আর কি। পরিষ্কার কিন্তু; আর উনি বলছেন যে, না কে মারে আমি এটা দেখাব না। কিন্তু আবার উনি ইন্টারভিউতে বলছেন আমি ওকে (পাক আর্মি) দিয়া মারাইছি। এই যে নানা জায়গাতে যে ট্রিট এন্ড রি-ট্রিট, তাতে বোঝা যায়, এই ছবির যে মূল প্রোটাগোনিস্ট–খাজা সাহেব, মানে যার ন্যারেটিভের মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পরিবার প্রধান–প্যাট্রিয়ার্ক। ইট ইজ এ্যান অটাম অব দি প্যাট্রিয়ার্ক। অর্থাৎ, তার যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে, নতুন যুগের উদ্বোধন হচ্ছে এই ছবির একমাত্র পজিটিভ পয়েন্ট হিসেবে তারা যেটা বারবার বলছে–এটা নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বানানো ছবি। নারীর সেনসিবিলিটির দিক থেকে বানানো ছবি, এটা ফিমেল সেক্সুয়ালিটির একটা বলা যায় অভিপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, রুবাইয়াতের লেখার মধ্যে এবং সেল্ফ রিপ্রেজেন্টেশনের মধ্যে আমি যেটা শুনলাম, পত্রিকায়, উনি বললেন যে, আমি মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত একটা থিসিস লিখেছিলাম। এটা আপনি বলবেন আবার রেলেভেন্ট কি না? আমি রেলেভেন্ট বলছি কারণ, উনি যেহেতু বলছেন রেলেভেন্ট। আমি ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার সাউথ এশিয়ান স্টডিজ ডিপার্টমেন্টে একটা থিসিস লিখেছিলাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের ট্রিট করা হয়, এইটা ঠিকভাবে করা হয়েছে কিনা। তারা কি হিরোইন নাকি তাঁরা লজ্জাবতী। ইংরেজিটা অনুবাদ করতে পারছি না–অ্যাশেইমড অর হিরোইনস? এই রকম আছে। তো সেই জায়গা থেকেই উনি বলছেন উনি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। সেইজন্য আমি বলবো যে, ওম্যানস্ ট্রিটমেন্ট কীভাবে করেছেন উনি এখানে? নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রিটমেন্টটা কী? এইখানে শুনলাম পেয়ারাবাগানে একটা যুদ্ধ হচ্ছে, সেখানে জাহানারা বলে একজন কমান্ডার আছেন, যেখানে শেষ পর্যন্ত নীলা চলে গেল। তাইলে এটা মুক্তিযুদ্ধের পিছনের একটা পটভূমি ব্যবহার করা হলো। এখন, আমি এইখানে–ইতিহাস বলছে কি—একজন জাহানারা নামে কোন নারী কমান্ডার ছিলেন কিনা, সেটা বড় প্রশ্ন নয়। ছবির থেকে তাকে এক্সিট করার জন্য এই পথটা নেওয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে কি, সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। কি–সন্তান জন্মের সময় মৃত্যু হয় নাকি যুদ্ধে মৃত্যু হয়, সেটা আমরা জানি না। কিন্তু, এইখানে আরও ঐতিহাসিক কতগুলি ডিসকোর্স উনি ব্যবহার করছেন যে–উপন্যাসের কাহিনীর সাথে আবারও ওখানে চলচ্চিত্রের তুলনা করতে হয়। উপন্যাসে বলছে কি, তাঁকে একজন পাকিস্তানি মেজর তুলে নিয়ে গিয়েছিল, 'সফদার' না কী নাম দিয়েছে এবং তাকে দশদিন পরে দিয়ে যায়। আর ফিল্মে বলছে, তার বাবাকে ধরে নিয়েছিল বলে সে খুঁজতে যায় এবং তাঁকে নিয়ে পাকিস্তানিরা আটক রাখে। এবং সেইটাকে যেয়ে আমার…এইটা হলো শেষ পয়েন্ট এই পর্বে, সেটা হচ্ছে যে, এই যে–রেইপকে গ্লোরিফাই করা হইছে এখানে। এটা হচ্ছে ইন্টারেস্টিং জিনিস। রেইপকে কনডেম না করে গ্লোরিফাই করার চেষ্টা হয়েছে, যেমন বলে যে, পাকিস্তানি আর্মিরা যখন আমাকে রেইপ করতে—উপন্যাসে লিখছে, আমি আবার উপন্যাস বলছি এইজন্যে—সেখানে বলছে যে, হারামজাদারা সাহস করত না আমার কাছে একা আসতে, দলে দলে আসত। সুতরাং, ইটস এ কেইস অব গ্যাং রেইপ, উপন্যাসের মতে। ফিল্মে এসে বলতেছে, হারামজাদারা রেইপ করার সময় আমার মুখে হুইস্কি ঢেলে দিত। মানে—এইটা একটা–আনফরচুনেটলি আমি এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি, এটার স্টেটমেন্টটা হচ্ছে এরকম যে, 'ইফ রেইপ ইজ ইনভিটেবল দেন হোয়াই নট এনজয় ইট? এই দৃষ্টিভঙ্গিতে এটাকে রিপ্রেজেন্ট করা হইছে। অর্থাৎ, রেইপকে লেজিটিমাইজ করার এর চেয়ে চমৎকার পথ আর নেই।

ব্রাত্য রাইসু: এ ব্যাপারে ফাহমিদুল কিছু বলবেন?

মুসতাইন জহির: আচ্ছা, আমি দুইটা ইনফরমেশন দিয়ে শুরু করি। উপন্যাসের কথা যেহেতু আসছে, না করলে ইয়ে হবে না। উপন্যাসে নীলা চরিত্রের…(চরিত্র) দিয়ে যেটা বলা হইছে নানাজানকে যে মারছে সুমন, নানাজানকে মারতে কিন্তু উপন্যাসে দেখা যায় যে—নীলাই তাঁকে বলেছে যে, এই হারামজাদা রাজাকার বুড়াটাকে তুমি মারতেছ না কেন? সেটা কিন্তু খেয়াল করতে হবে, নীলা চরিত্র তাঁর নাতনী, নাতনী তাঁকে রাজাকার বলে গালি দিচ্ছে এবং সুমনকে বলছে, তুমি কাপুরুষ, তুমি তাঁকে মারছ না কেন?

যদি তুমি তাঁকে মার এবং মেরে এই বাড়ির উঠোনে আস এবং আইসা যদি সবার সামনে আমাকে বিয়ে কর তাহলে আমি তোমার সঙ্গে যাব। ফলে আমরা যেন খণ্ডিত ইনফরমেশন না নেই।

ব্রাত্য রাইসু: আমরা বলতে?

মুসতাইন জহির: আমি সলিম ভাইয়ের এই বক্তব্য থেকে দেখলাম যে– সুমন মেরেছে কিনা–যে এম্বিগুইটিটা তৈরি করেছে—আপনি বললেন। তাহলে এখানে এই ইনফরমেশনটাও দেওয়া, মানে প্রয়োজনীয় যে সুমনকে– এটা মারছে, নীলার কন্ট্রিবিউশনটা সেখানে কী? বা এই ক্যারেক্টারটা এভাবে ডেভেলাপ করেছে কেন?

সলিমুল্লাহ খান: এখানে নীলা আমার আলোচ্য নয়। আমার আলোচ্য হচ্ছে কি, আলোচ্য হচ্ছে দুইটা। পাকিস্তান আর্মি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অংশ গ্রহণকারী একজন, সে বামপন্থী, সুমন। এই দু'জনের মধ্যে কে মেরেছে? এবাদুরের সাজেশন হচ্ছে সুমন মেরেছে ফিল্ম মেকারের সাজেশন হচ্ছে–মুখে বলছেন পাকিস্তানি আর্মি মেরেছে বলে আমি দেখেয়েছি। আবার মাঝামাঝি—আমরা বলছি উপন্যাস এবং ফিল্ম কেউই যদি না দেখতাম, আমরা কিছু জানতাম না। শুধু ফিল্ম দেখলে দেখবেন যে–এম্বিগুইটি। উপন্যাসটা পড়লে মনে হয় সুমন। এখন সুমনে দিয়ে মেরেছে–ইনফরমেশনগুলো ঠিক আছে কিনা। কিন্তু সেটা আমার জন্য–ইট ডাজ নট মেক এনি ডিফারেন্স।

জাকির হোসেন রাজু: সলিম ভাই, আমরা তো…উপন্যাসটা তো পড়ি নাই আমরা। [ব্রাত্য রাইসু: নামটা বলবেন রাজু ভাই] আমার নাম—জাকির হোসেন রাজু। উপন্যাসটা আমরা বেশিরভাগ পড়ি নাই। আমি শুধু এই পয়েন্টটা ধরে বলছি, সেটা হলো যে– আমার ছবিটার মধ্যে যেটা মনে হয়েছে যে সুমনকে আমরা দেখি যে রাতের অন্ধকারে একটা কিছু তুলে নিয়ে যায়, তাই না? একটা ব্যাগের মধ্যে সে একটা কিছু তুলে নিয়ে যায়। [ফাহমিদুল হক: একটা কিছু মানে পিস্তল।] হ্যা, পিস্তল; তো তারপরে হইল আপনার ওই পাকিস্তানি আর্মিরা এ্যাটাক করে। তাতে কিন্তু এ্যাপারেন্টলি মনে হয় যে পাকিস্তানি আর্মিরাই খাজা সাহেবকে মেরেছে।

মোরশেদুল ইসলাম: অ্যাপারেন্টলি মনে হয়। কিন্তু, এখানে কিন্তু স্পষ্ট করা হয়নি।

মোহাম্মদ আজম: এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই। এই সিনেমার বিষয়ে আমার প্রচুর সমালোচনা আছে। অলরেডি যেগুলো বলা হয়েছে সেগুলোর অনেকগুলোর সাথে আমি একমত। একমত না হওয়ার কোন কারণ নাই। আমার একটা প্রধান সমালোচনা হল যে, উপন্যাসে…দশটা উপন্যাসে…স্যরি এই সিনেমায়, দশটা সিনেমার কাজ একটা সিনেমায় করতে গিয়ে এই পরিচালক খুবই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছেন। অনেক কিছু ঠিক মতো করে উঠতে পারে নাই; আর যাকে আমরা…স্ক্রিপ্টরাইটারের মধ্যে যদি একজন ঔপন্যাসিকের দৃষ্টি থাকে, ঔপন্যাসিক যেভাবে প্রপোরশনেটলি ব্যাপারগুলোকে ডিল করতে পারে, এই স্ক্রিপ্ট রাইটার সেটা করতে পারে নাই। তার ফল হয়েছে এই যে, যুদ্ধ যেখানে, যুদ্ধের মধ্যে অন্য যে ঘটনাগুলো ঘটছে, যে কায়কারবার গুলো ঘটছে, তার মধ্যে যুদ্ধের ছাঁচটা এটা অরগানিক্যালি লাগছে না। ওটা একটা পৃথক এরিয়া হিসেবে থেকে যাচ্ছে। আমি শুধু ডিজ-অ্যাগ্রি করছি, আপনার (মোরশেদুল ইসলাম) সঙ্গে এই জায়গায় যে, এখানে কিছু অংশ কিন্তু নন-রিয়েলিস্টিক ভঙ্গিতে করা হয়েছে। বিশেষত, পরিচালক যে চরিত্রটাতে অভিনয় করেছে, ওই অংশটা কিন্তু কমপ্লিটলি এক ধরনের–আমি বলব যে, শব্দটা, অন্য শব্দের অভাবে, আমি বলবো যে–ম্যাজিক রিয়েলিস্টিক ভঙ্গিতে করার চেষ্টা আছে। [মুসতাইন জহির: একটা অ্যাবসার্ড ক্যারেকটার আকারে আছে।] একটা অ্যাবসার্ডিটি আছে। নানান ধরনের–রঙের ব্যবহার থেকে শুরু করে, ভিতরের…তাঁর নানান ধরণের কথাবার্তা দিয়ে শুরু করে আমি দেখার সময় ভাবতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছিলাম–বোধহয় একটা মার্কেজিয় প্রভাবজাত একটা চরিত্র এবং তাঁর আনুসঙ্গিক কিছু। কিন্তু শেষ…দৃশ্যটা নিয়ে আমি একটা কথা বলি, আমার কাছে মনে হয়েছে, অন্য ব্যাখ্যা বা অ্যাম্বিগুইটি যদি সবাই দেখে থাকে দেখতে পারে। আমি কিন্তু দেখার সময়ই পরিষ্কার দেখছিলাম যে এই মৃত্যুটা ডেফিনেটলি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী করেছে। আমার পয়েন্টটা হল এই যে, এখানে–ওটা আমার কাছে এই সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণগুলোর একটাই মনে হয়েছে রীতিমত যে, খাজা সাহেব, নানাজান—খাজা সাহেব, তিনি মৃত্যুকে সেলিব্রেট করেছেন। সেলিব্রেশনটা হল তিনি একটা দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর ঐতিহ্যবাহী যেই পোশাক-আশাক এবং তার যে ওই যে খানিকটা পীরালি ভঙ্গি ইত্যাদি, তারপর চোখে সুরমা দেওয়া, তারপর পরে এমনকি বুকে আতর দেওয়া ইত্যাদি নানান কিছু করে তিনি এমন একটা ভঙ্গিতে বেড়িয়েছেন যেই ভঙ্গিটা প্রমাণ করে, নিশ্চিত করে আমাকে অন্তত যে, তাঁকে পাকিস্তানি বাহিনী খবর দিয়েছিল দেখা করার জন্য।– কারণ, মনে রাখতে হবে, সুমন যদি তাঁকে মারে তবে খবর দিয়ে মারবে না, একমাত্র মারতে পারে পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁকে খবর দিয়েছিল এবং তিনি গেছেন–এইটা হল এক নম্বর। দুই নম্বর হল–ওখানে যে চেয়ারের সজ্জা, ওই যে—দৃশ্যটা দেখানে হয় নাই–তার মৃত্যুর পরে পাশে যে খালি চেয়ারের সজ্জা, সেখান থেকেও এটা পরিস্কার যে এটা–প্রথম চেয়ারের সজ্জাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কমান্ডার যে বসেছিল এসে সেটার সঙ্গে এক ধরনের সিমিলারিটি ছিল। এবং সিমিলারিটির মধ্য দিয়া আর ইমিডিয়েট আগে পাকিস্তানি গ্রুপটা—গাড়িটা এসছে ইত্যাদি নানান কিছু মিলিয়ে আমি মনে করি যে এই সিনেমায় অত্যন্ত যত্ম করে এই দৃশ্যটা তৈরি করা হয়েছে এবং পাকিস্তানি বাহিনী-ই যে তাঁকে মেরেছে—এই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিচ্ছন্ন হয়েছে।

সলিমুল্লাহ খান: আচ্ছা আমার বক্তব্য, এক মিনিটের, হচ্ছে—আপনারা বলছেন যে ছবিতে যেখানে—ইন্টারপ্রিটেশন আছে, আমরা যারা মন্তব্য করছি এটাও ইন্টারপ্রিটেশন। আপনার ইন্টারপ্রিটেশনের জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু আমি মনে করি এটা ভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশন, এর জন্যেই আমি আবারও উপন্যাসের রেফারেন্স দেব। উপন্যাসে পরিষ্কার আছে উনি ফুল লাগাচ্ছেন, খাজা সাহেব, সিনেমায় দেখাচ্ছে বারবার আতর-টাতর দিচ্ছেন; মানে এটা রিচ্যুয়াল আর কি। তো, দেওয়ার সময়, ফুল দেওয়ার সময় সে কিন্তু সামনে ইয়েকে বলছে…

ব্রাত্য রাইসু: কিন্তু সলিম ভাই, সেখানে ফিল্মটা উপন্যাস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে সেখানে আপনি আবার ফেরত (উপন্যাসে) পাঠাচ্ছেন কেন?

সলিমুল্লাহ: ফেরত পাঠাচ্ছি কারণ হচ্ছে, এগজাক্টলি টু ইন্টাপ্রেট ইন আ ডিফারেন্ট ওয়ে। উপন্যাসের মধ্যে বলছে যে, পরিস্কারভাবে, গুলিটা এমনভাবে করবে–খাজা সাহেব জানে তাকে গুলি করা হবে–যে ফুলটা যেন ঠিক থাকে গুলি করার সময়। এটা কিন্তু সিনেমায় এ কথাটা নাই। আমি এজন্য বলছি আপনাকে, ওই যে সাব টেক্সটটা–যেটা ডুবে আছে মাটির নিচে, সেটা যদি বের করে আনেন তাহলে বোঝা যাবে যে…

ব্রাত্য রাইসু: এইটা আপনি মনে করেন সলিম ভাই, যে…ওই উপন্যাসের দায় কি, যেমন সত্যের দায় বহন করে শিল্প, সেরকম উপন্যাসের দায় কি সিমেনা বহন করে কিনা?

সলিমুল্লাহ খান: না না, দায় তো বহন করছে না। আমি বলছি যে, উনি সেল্ফ কনশাসলি—যে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছেন—সেটা, ও বলছে যে তাঁকে পাকিস্তানি আর্মি মারবে, সেটা, এইটা উনি জানেন। আমি বলছি, তা নয়। মানে ছবিতে যা আছে সেটা নিয়ে আমি দ্বিমত করছি না। কিন্তু উপন্যাসে যে ভার্সন ছিল সেইখানে সে সুমনকে বলছে, গুলিটা করবে যেন আমার ফুলটা ঠিক থাকে! ওর মধ্যে একটা ফান আছে। আমি বলছি মৃত্যুকে উনি সহজভাবে নিচ্ছেন—মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান। বলছে, আমার, এই শ্যামের সঙ্গে আমার বিরোধ নাই। কিন্তু এই শ্যামের একটিভিস্ট কে, এই বিষয়ে যখন দ্বন্দ্ব হয়েছে তাই আমি–এইটা সাব টেক্সট—রেফারেন্স দিয়া রাখলাম। আপনি ইচ্ছা হলে গ্রহণ করেন, না হয় করেন। আমি মনে করিয়ে দিলাম।

ব্রাত্য রাইসু: না না, সেইটা ঠিক আছে। কিন্তু উপন্যাসের দায় যদি সিনেমা বহন করে তাইলে এটা আমরা মানতে রাজি আছি, কিন্তু যদি দায় বহন না করে…

সলিমুল্লাহ খান: না, বহন করে না। আমরা সিনেমা নিয়ে আলাপ করছি।

ব্রাত্য রাইসু: না, সেইটা, আমরা উপন্যাস নিয়েও আলাপ করতে পারি।

মোহাম্মদ আজম: না, সলিম ভাইয়ের এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে আমার আর একটা ছোট্ট বক্তব্য আছে। সেটা হলো এই যে, কাউন্টার ভার্সনটা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে তাঁকে অবশ্যই উপন্যাসে যেতে হবে, কারণ সিনেমায় সেটা নাই।

মোরশেদুল ইসলাম: না, ঠিক আছে, উপন্যাসে আমরা যা দেখছি সেটা—আমি কিন্তু—উপন্যাসটা আমরা…

মোহাম্মদ আজম: প্রয়োজন হলে আলাপ করতে পারি, কিন্তু আমার ধারণা এখানে প্রয়োজন নাই।

মোরশেদুল ইসলাম: ঠিক আছে, উপন্যাসটা আমি পড়ি নাই।

সলিমুল্লাহ খান: না, আমি চাই ভবিষ্যতে এটা নিয়ে যেন আলোচনা হয়।

মোরশেদুল ইসলাম: আমি উপন্যাসটা পড়ি নাই, এটা সলিমুল্লাহ ভাই পড়েছেন, কিন্তু আমি পড়ি নাই। [মোহাম্মদ আজম: আমি পড়েছে, হ্যা, আমি পড়েছি।] ওকে, এখন কিন্তু আমি এই উপন্যাস নিয়ে কোন কথাই বলছি না; আমার কাছেও কিন্তু সলিমুল্লাহ ভাই যেভাবে দেখেছেন ছবিটা, আমার কাছেও কিন্তু ছবিটাকে তাই মনে হয়েছে মোটামুটি, তাই না? সুতরাং–আমি তো উপন্যাসটা পড়ি নাই উপন্যাসটা পড়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। ছবিতে যেই দুর্বলতাগুলো আছে, দেখেন, পরিচালক বলছে যে নীলার ক্যারেকটারটাকে সে খুব স্ট্রং দেখিয়েছে। কিন্তু সেইখানে আবার বাচ্চা হওয়ার সময় সে বলছে, আমি এই বাচ্চা চাই না, হ্যা? তো, এইটা একটা কন্ট্রাডিকটরি ব্যাপার তো আছেই। নীলা যে…

মোহাম্মদ আজম: আচ্ছা, একটা ছোট্ট কথা, স্ট্রং চরিত্র বলতে আমরা কি সবসময় অপোজিং চরিত্র বুঝব? মানে যেই চরিত্র–আমি এই চরিত্রের পক্ষে দাঁড়াচ্ছি না, তার কারণ হল নীলা চরিত্র আসলেই ঠিকভাবে ডেফিনেটেড হয় নাই, কোন সন্দেহ নাই এতে। এবং (ছবিতে) পরিচালক দশটা জিনিস একত্র করতে গিয়ে একদম হ্যাফাজার্ড করে ফেলেছেন, কিন্তু স্ট্রং বলতে তো এ ক্যারেকটারের কন্ট্রাডিশনও হতে পারে।

মোরশেদুল ইসলাম: না, ঠিক আছে, চলতে পারে; কিন্তু স্ট্রং বলতে এখানে যেটা পরিচালক বোঝাতে চেয়েছেন বা যেভাবে পোর্ট্রে করেছেন পুরা ক্যারেক্টারটাকে সেটা হচ্ছে, সে অন্য দশজন বাঙ্গালি নারীর–অন্য দশজন বাঙ্গালি নারীর মত না, যাঁরা নাকি নির্যাতিত হয়ে

[মোহাম্মদ আজম: চুপসে গেছে?]

তাঁরা চুপসে গেছে, সেরকম না। সে স্ট্রং প্রতিবাদ করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে ঐ জিনিসটা আবার কন্ট্রাডিকটারি—সেটাই আমি বলছি।

[ব্রাত্য রাইসু: আচ্ছা…]

আরেকটা জিনিস—আমি যেটা, আমি শুধু শেষ করবো এক্ষুণি, সেটা হচ্ছে, আমি খুব ইম্পর্টেন্ট একটা যেটা পয়েন্ট, সলিমুল্লাহ ভাইয়ের কথায় এসছে এবং আমি কিন্তু প্রথমেই সেটা বলেছি–যে, এটা যুদ্ধের ছবি না মুক্তিযুদ্ধের ছবি? যদি–যুদ্ধবিরোধী ছবি আমরা অনেক দেখেছি, এটাকে আমরা তাহলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছবি বলব কিনা? এটাকে…পরিচালক কিন্তু যুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধ দুইটা জিনিসকে আলাদা করেছে, এটা একটা খুবই ইম্পর্টেন্ট পয়েন্ট এ ছবির জন্য।

সলিমুল্লাহ খান: মোর্শেদ ভাই, এক সেকেন্ড। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, যেটাকে আমরা বলি–জার্মানি যখন ফ্রান্স দখল করে তিরি…কয়েক দিনের মধ্যেই, ১৯৪০-এর পর থেকে, তখন ফ্রান্সে যে যুদ্ধ হয়েছিল সেইটাকে বাংলায় আমরা প্রতিরোধ যুদ্ধ বলি। রেজিস্ট্যান্স বলে ওরা ইংরেজিতে, ফরাসিতে কী একটা আছে। তাহলে, সেইটাকে যদি আপনি নেহায়েত যুদ্ধ বলেন লক্ষ্য করার বিষয় যে আমাদের দেশেও তখন কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো প্রথমে বলছে এটাকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ।

যখন—ওই মানে, রাশিয়া আক্রান্ত হল তখন এটা গণযুদ্ধ হয়ে গেল। কারণ যুদ্ধের ক্যারেকটারাইজেশন লোকের পলিটিক্যাল পয়েন্ট অব ভিউয়ের উপর নির্ভর করে। কিন্তু ফ্রান্স যখন সত্যি সত্যি জার্মানির দখলে চলে গেল তখন ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবীরা, গণিতবিদেরা সকলেই যুদ্ধে গেল। তখন তারা বলল, আমরা প্রতিরোধ যুদ্ধ করছি। আমরা যাদের কবিতা পড়ি–পল এডওয়ার্ড, লুই আরা…তাদের কবিতার মধ্যে আমরা এটা পাই। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এই চলচ্চিত্রকার বা এই চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্ররা কোথাও মুক্তিযুদ্ধ বা রেজিস্ট্যান্স ওয়ার বলে দেখছে না এটাকে নিছক যুদ্ধ বলছে, এটা শুধু মেহের নয়, সেটা সালমাও—সবাই, যে এটা এটা যুদ্ধ, যুদ্ধ। কাজেই অ্যাজ ইফ, যেন এটা একটা মহাযুদ্ধ।


মেহেরজান-এর নানাজানের চেয়ারে বসা পাকিস্তানি মেজরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন নানাজান

এটা, এটা কি ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ার? আনের্স্ট হেমিংওয়ে যেমন 'এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস' লিখেছে যে—আমি ওই যুদ্ধে একটা ভাড়াটিয়া সৈন্য হিসাবে যুদ্ধ করতে গেছি–ব্যাপারটা তো তা না। ব্যাপারটা অনেক জটিল। আমি বলছি একটা মুক্তিযুদ্ধকে একটা সাধারণ যুদ্ধ হিসেবে দেখানো–আমি এটাকে বলছি সত্যের প্রতি দায় পালন না করা।

মুসতাইন জহির: আচ্ছা সলিম ভাই, এই যুদ্ধের মধ্যে অনেকগুলা চরিত্রের পারসপেকটিভ যেমন আছে—আমি বলছি না…ওভার অল সবার যে আলোচনা–অনেক জায়গায়ই আমি একমত। প্রথম কথা হল, এই ছবিতে কোনটাকে সবলভাবে দেখানো হয়েছে, কোনটাকে দুর্বল ভাবে দেখানো হয়েছে এটাকে আমরা আলাদা করতে চাচ্ছি। এই ছবিতে কোন চরিত্রই সফলভাবে দাঁড়ায় নি। পরিচালকের যে ব্যর্থতা, কাহিনীর যে ব্যর্থতা, তাতে কোন কিছুই ষ্ট্রাবলিশ হয় নি। ফলে ঐটা ষ্ট্যাবলিশ হইছে, আরেকটা হয় নাই—এই যুক্তি আবার আমরা কীভাবে টানছি—আমি সেটা জানি না। নাম্বার টু হইলো—এই ছবিতে কিন্তু সুমনের ক্যারেকটারের মধ্যে বারবার তাঁর মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে—এটা একটা গণযুদ্ধ, জনগণের…। তাঁর পার্টি, মানে, পলিটিক্যাল লাইনের জায়গা থেকে বলানো হয়েছে। আমরা কেন বলছি যে–এটা বলা হয় নি? এটা তো আমি মনে করি ঠিক না।

মোহাম্মদ আজম: আর মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আমি একটু ইয়ে করে রাখি, এই ছবিতে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রধান যে আইকনগুলা, সিম্বলিক আইকনগুলা, এগুলা সবগুলা ব্যবহৃত হয়েছে। রাজাকার, শান্তিবাহিনী, পাকিস্তানি আর্মি, তারপরে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধে এখানে সবচেয়ে বেশি আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি, যেটা অন্য কোন সিনেমায় দেখি নাই, সেটা হল এই, যে, এখানে কতগুলো বামপক্ষ যে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল—এটা আমি যে ছবিগুলো দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা বা ইত্যাদি, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসও আমাকে পড়তে হয়েছে নানান কারণে, তার মধ্যে আমি খুব একটা–মনে পড়ছে না যে উল্লেখিত আছে। ফলে, মানে, 'মুক্তিযুদ্ধ বলা হয় নি' এটা বলতে আমি খুব একটা রাজি না।

সলিমুল্লাহ খান: আপনার রাজি হবার দরকার নাই, আমি একটা পয়েন্ট শেষ করছিলাম যে, ছবির যে মূল প্রোটাগোনিস্ট খাজাসাহেব, তাঁকে যখন পাকিস্তান আমি জিজ্ঞেস করে, এখন পাকিস্তান ভেঙ্গে যাচ্ছে, আপনার, ইউনাইটেড করার জন্য আপনি কী করবেন, তখন উনি যে জবাবটা দেন তা লক্ষণীয়। উনি বলছেন, ইংরেজিতেই বললেন, যে, আই এম ইন ফেভার অফ নো সেপারেটিস্ট মুভমেন্ট, আমি আগেও সেপারেটিজম চাই নাই, অর্থাৎ পাকিস্তান যে হয়েছিলো ৪৭ সালে—ওটা একটা সেপারেটিস্ট মুভমেন্ট ছিল, এবং ইমপ্লাইডলি এটা একটা সেপারেটিস্ট ওয়ার। এটা ওই চরিত্রের সাথে মানানসই। সে এইটাকে সেপারেটিস্ট ওয়ার-ই মনে করছে। কিন্তু আরেক জায়গায় তারা বলতেছে যে, এই যে আমাদের কৃষকেরা, বাঙ্গালিরা যে বহুদিন লড়াই করেছে আগে কিন্তু তাদের ফলাফল বেহাত হয়ে গেছে, এইবার তারা সেই ফল রাখতে পারবে কিনা? ওনার এম্বিগুইটির সাথে এটা খাপ খায়। কাজেই আপনি যে বলছেন–, মুক্তিযুদ্ধ কথাটা কোথাও ব্যবহার না করলেও একজনের মুখ দিয়ে সেপারেটিস্ট কথাটা ব্যবহার করা হয়েছে, আরেকজনের মুখ দিয়ে গণযুদ্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে এটা যে একটা ন্যাশনাল ওয়ার, নট দ্য ওয়ার অব এ পার্টিক্যুলার ক্লাস, ইট ইজ এ ওয়ার অব মেনি ক্লাসেস, এই কথাটা ছবিতে সাজেস্ট করা হয় নি। এখন সাজেস্ট না করার স্বাধীনতা তাঁর আছে, এইজন্য আমি তাকে ফাঁসি দেয়ার পক্ষপাতি না; কিন্তু যা আছে, তাই তো বলতে হবে আমাদের। আপনি যদি মনে করেন, আপনিও মনে করতে পারেন যে–এটা ন্যাশনাল ওয়ার ছিল না। তাইলে, ঠিক আছে, আমি বলছি যে, সত্যের বিভিন্ন ভার্সন আছে। আমরা যারা সত্যের ভার্সনকে করি করি যে–এটা একটা ন্যাশনাল ওয়ার ছিল, এ ন্যাশনাল ওয়ার অব রেজিষ্ট্যান্স ছিল এবং এটা ছিল–এ ওয়ার অব অ্যাগ্রেশন অন বিহাফ অব পাকিস্তান, হেল্ড বাই ওয়েস্টার্ন ইম্পেরিয়ালিজম। সেই দিক থেকে আমরা এই যুদ্ধকে বলব–বাংলাদেশের দিক থেকে–জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ আর ওদের দিক থেকে ঔপনিবেশিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। এই মূল কথাটা থেকে আপনি কেন সরতে পাচ্ছেন–আমি এটাতে আপনার ব্যাখ্যা জানতে চাই।

মোহাম্মদ আজম: আমি সরতে চাচ্ছি না বরং আমি বলতে চাচ্ছি যে এখানে 'নানা সাহেব' যে চরিত্রটি, তাঁর নানান ধরনের দোলাচল সত্ত্বেও, ঐতিহাসিক অনেক লিংক রক্ষা করতে গিয়ে, তাঁর উপর অনেক বক্তব্য চাপাতে গিয়ে, আমার এক বন্ধু যেমন বলেছে যে, এই সিনেমায় আমরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হইছি, যে, আমাকে একটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাসে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, প্রচুর কথা বলানো হয়েছে এই ছবির মুখ দিয়ে, যা আমি শুনতে আগ্রহী না সিনেমা থেকে। এই চরিত্রের উপর এসব অত্যাচার করা সত্ত্বেও, এই চরিত্রটির মুক্তিযুদ্ধের প্রতি–তাঁর মত করে নিষ্ঠা, একেবারে আড়ালে চলে যাওয়ার কথা নয়।

এটা আমি খুবই অপছন্দ করেছি যে, বলা হচ্ছে যে, ঐ লম্বুটা আমার চাই, ইত্যাদি ইত্যাদি যে কথা বলা হয়েছে–ওগুলো ডেফিনিটলি আমি অপছন্দ করেছি; কিন্তু এই লোক যে মুক্তিযোদ্ধা একটা গ্রুপকে, মুক্তিযোদ্ধা একটা গ্রুপের প্যাট্রন, তাদেরকে যে ইয়ে (সাহায্য) করে, এটা তো–সেটার মধ্যে শ্রেণী চরিত্র আছে কিনা, এটা পসিবল কিনা সে প্রশ্ন অবশ্য উঠতে পারে, আমি নিশ্চিত না….

মোরশেদুল ইসলাম: চরিত্রটা তো কিছুই দাঁড়ায়নি; এই চরিত্রটা কি? এই চরিত্রটা একবার মুক্তিযুদ্ধের, মানে, মনে হচ্ছে সাপোর্ট করছে, আরেকবার ভিন্ন কথা বলছে, বিভিন্ন ধরনের আচরণ তাঁর।

মোহাম্মদ আজম: সে ভিন্ন কথা বলছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের বাইরে অন্য কোন পক্ষকে সাপোর্ট করে নাই।

মোরশেদুল ইসলাম: কীভাবে সাপোর্ট করে নাই, সে তো বলেছে, আমার গ্রামে আমি কোন গণ্ডগোল হতে দেব না।

মুসতাইন জহির: আচ্ছা, আরেকটা বিষয় হলো, তাঁর নাতনী…

মোহাম্মদ আজম: গণ্ডগোল হতে দেবে না? একটা কথা হলো–আমি এই চরিত্রটাকে, অন্য অনেক কিছুর মধ্যে, একটা দিক থেকে দেখতে চাই যে, এই চরিত্র কিন্তু বাংলাদেশে উইন করে নাই। হি হ্যাজ গন। সে তো মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই মারা গেছে, তার ফ্যামিলি ধ্বংস হয়ে গেছে।


ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts