পলাতক জীবনের বাঁকে বাঁকে (পর্ব চার)

muhammad_takiullah
Published : 5 Sept 2016, 02:54 PM
Updated : 5 Sept 2016, 02:54 PM

১৯৫১ সালে শুরু হয় আমার জেলজীবন। বিভিন্ন সময়ে জেলজীবনের কথা অনেকেই জানতে চেয়েছেন আমার কাছে, হ্যাঁ, বলার মতো অনেক কথা তো আছেই। আশির দশকে একবার আমি ভেবেছিলাম নিজের জীবন নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবো। তখন পঞ্চাশের দশকের সেই জেল জীবনের কথা লিখতে চেয়েছিলাম। উপন্যাসের শিরোনাম ঠিক করেছিলাম 'খাঁচার পাখির গান'। জেলজীবন মানেই তো খাঁচায় বন্দী জীবন। তবে সেই বন্দী জীবনেও কিন্তু আমাদের সকলের কণ্ঠ রোধ করা সম্ভব হয়নি। আমাদের মধ্যে অনেকেই তো বন্দী জীবনে কলমকে থামিয়ে রাখেননি। তারা লিখেছেন। যেমন, বন্ধু শহীদুল্লাহ কায়সারকে দেখেছি জেলেও লেখালেখি করতে।
ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের নিউ টুয়েন্টি খাতায় আমি রাজবন্দী হিসেবে ছিলাম দীর্ঘ পাঁচ বছর। সেসময় ওয়ার্ডেও যেমন থেকেছি তেমনি আবার বেশ কিছুটা সময় কনডেমড সেলেও বন্দী থেকেছি। বিভিন্ন সময় আমার সঙ্গে এক সেলে বা এক ওয়ার্ডে ছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সার, সরদার ফজলুল করিম, সন্তোষ গুপ্ত, শেখ মুজিবর রহমান ও আরও অনেকে। রণেশদা মানে রণেশ দাশগুপ্ত রাজনৈতিক জীবনে আমার দীক্ষাগুরু ছিলেন। কিন্তু জেলে তার সঙ্গে থেকেছি কিনা এখন মনে করতে পারছি না। স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে।
আমরা রাজবন্দী ছিলাম বলে বাড়িথেকে কখনও কখনও( বিশেষ দিনগুলোয়) খাবার এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নিতে পারতাম। পঞ্চাশ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর হিন্দু কমরেডদের অনেকেরই আত্মীয় স্বজন ধীরে ধীরে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যাচ্ছিলেন। তাই যে হিন্দু কমরেডরা জেলে বন্দী ছিলেন তাদের বেশ সমস্যা হতো। কারণ তাদের জন্য বাড়ি থেকে খাবার পাঠাবার বা টাকা পাঠাবার কেউ ছিলেন না। আমার জন্য বাড়ি থেকে হরলিকস পাঠানো হতো। মা পাঠাতেন। আরও কয়েকজনের জন্যও খাবার আসতো। আমরা সেসব খাবার ও টাকা সব কমরেডদের মধ্যে ভাগ করে নিতাম। আমাদের জন্য মাথাপিছু রান্নার টাকা বরাদ্দ ছিল সরকার থেকে। সেই টাকায় একসঙ্গে আমরা সকলের রান্না করতাম। আমি মাছ খেতে কখনও খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। কাঁটার ভয় পাই। এজন্য অন্য সহবন্দীরা যখন ইলিশ মাছ খেতেন তখন ডিমটা বরাদ্দ থাকতো আমার জন্য। এ নিয়ে কারও কখনও আপত্তি হয়নি। বলতে গেলে জেলে আমরা মিনি সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম। জেলের মধ্যে আমাদের যে ঘনিষ্টতা হয়েছিল তা বাইরের জীবনে কখনও সম্ভব হতো না। কারণ বাইরের জীবনের দাবি ব্যাপক, পরিধিও বিস্তৃত। জেলে আমরা সবাই যেন সেম বোট ব্রাদার। এ সময়ই মুজিবভাই ও অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শের বন্দীদের সঙ্গে বেশি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমরা বুঝতে শিখেছিলাম যে মত ও পথ ভিন্ন হোক কিন্তু উদ্দেশ্য তো আমাদের একই- জন্মভূমির সেবা করা। আমি ও শহীদুল্লাহ কায়সার যুবলীগ গঠনেও ভূমিকা রেখেছিলাম। তাই মুজিবভাইয়ের সঙ্গে আমাদের ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।

জেলে আমাদের প্রধান বিনোদন ছিল ভলিবল খেলা, তাস খেলা,বই পড়া আর গান গাওয়া। আমি ভলিবল খেলতাম কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। ভালো খেলতাম সেসময়। পুরস্কার টুরস্কারও পেয়েছি। জেলেও বেশ ভালোই খেলতাম। গান গাইতে পারি না। সুর মেলে না একেবারেই। তবে কমিউনিস্ট ইন্টার ন্যাশনাল গাইতে পারতাম। মূল গানটি এবং কাজী নজরুলের অনুবাদ 'অনশন বন্দী ওঠো রে জাগো' গাইতাম কোরাসে। 'কারার ওই লৌহ কপাট'ও গাইতাম। বিপ্লবী কবিতা আবৃত্তি করতো কয়েকজন। সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা তখন খুব জনপ্রিয়। কয়েক জনের মুখস্ত ছিল একটি মোরগের কাহিনী, লেনিন, দেশলাই কাঠি, ছাড়পত্র ইত্যাদি কবিতা। রবীন্দ্রনাথকে অনেকে বুর্জোয়া কবি বলতেন। কিন্তু আমি তার 'রাশিয়ার চিঠি' পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাই রবীন্দ্রসংগীত কেউ গাইলে আমার বড় ভালো লাগতো। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করতো পাকিস্তান সরকার। আমার বাবা রবীন্দ্র-ভক্ত এবং সরকারের রবীন্দ্র-বিরোধিতার কড়া সমালোচক, আমি তাই রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির আপনজন ভাবতাম। আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন নিয়ে এবং জেল থেকে ছাড়া পাবার পর আবার কিভাবে পার্টির কাজকর্ম চালাবো সেটা নিয়েও আলাপ করতাম। আমি তাস খেলতে ভালোবাসি না। তাই জেললাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়তাম। সে সময় ইংরেজি সাহিত্যের অনেক ক্ল্যাসিক বই পড়ার সুযোগ হয়। ফরাসি ভাষার ক্ল্যাসিক বইগুলোও ইংরেজি অনুবাদে পড়েছিলাম। জেলে থেকেই আমি চীনা ভাষা ও রুশ ভাষা কিছু কিছু শিখি। জেলের লা্ইব্রেরিতে চীনা ও রুশ ভাষার সেলফ-টট বই ছিল। ভেবেছিলাম কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রয়োজনে এ দুটি সমাজবাদী দেশের কমরেডদের সঙ্গে আলাপ করতে এ ভাষাগুলো প্রয়োজন হতে পারে। আমরা তখন লেনিন, স্ট্যালিনের পাশাপাশি মাও সে তুং-এরও ভক্ত হয়ে পড়ি।
১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ কমরেড জোসেফ স্ট্যালিন মৃত্যুবরণ করেন। জেলে থেকেই সে সংবাদ পেলাম আমরা। আমি শোকে ভেঙে পড়লাম। স্ট্যালিনের মৃত্যুসংবাদ আমার কাছে পরম প্রিয়জনের মৃত্যুর চেয়েও বেশি আঘাত হেনেছিল। মনে পড়ে আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনে আমাকে ও শহীদুল্লাহ কায়সারকে একত্রে সবাই বলতো লেনিন-স্ট্যালিন। আমাকে স্ট্যালিন ও কায়সারকে লেনিন বলা হতো কারণ উচ্চতায় আমি কায়সারের চেয়ে একটু বেশি ছিলাম। স্ট্যালিন মারা যাবার পর আমরা জেলখানাতেই শোকসভা করি। সেই শোক সভায় আমি নিজের লেখা কবিতা পড়েছিলাম।

অনেক পরে ক্রুশ্চেভের সময় বা তারও পরে স্ট্যালিনের অনেক সমালোচনা শুনেছি, তার নামে নিষ্ঠুরতার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু আমি কখনও ভুলতে পারিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি নাৎসী বাহিনীর কাছে নতি স্বীকার করেননি। বরং নিজের সন্তানকে উৎসর্গ করেছিলেন। তার ছেলে নাৎসী বাহিনীর ক্যাম্পে বন্দী ছিল। স্ট্যালিনের দৃঢ় নেতৃত্ব না থাকলে সে সময় হিটলার বাহিনীর হাতে সোভিয়েতের নামনিশানা মুছে যেত। আমার কাছে স্ট্যালিন সবসময়ই আদর্শ দৃঢ় চরিত্র কমিউনিস্ট নেতা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের বীরোচিত সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কারণেই নাৎসীবাদ পরাজিত হয় যা পুরো দুনিয়ার জন্যই ছিল পরম মঙ্গলকর।
জেলখানায় আমরা বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলাম। সরদার ফজলুল করিম আর আমি জেলে বেশ ঘনিষ্ট ছিলাম। জেল থেকেই সরদার ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এবং জয়ী হয়েছিলেন।
জেলখানায় আমরা অনশন করেছি বিভিন্ন দাবীদাওয়া নিয়ে। ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদেও অনশন করেছি। অনশন করার সময় প্রহরীরা জোর করে আমাদের মুখে খাবার পুরে দিত। এটা ছিল খুবই বিপদজনক। কমরেড ফণী গুহ মারা গিয়েছিলেন এইভাবে। তিনি অনশনরত ছিলেন। পুলিশ জোর করে তার নাকের ভিতর দিয়ে নল ঢুকিয়ে দুধ খাওয়াতে চায়। সেটা পাকস্থলীর পরিবর্তে ফুসফুসে চলে যায়। ফলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফণী গুহর এই করুণ মৃত্যু থেকে আমরা সাবধান হই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে একটা স্লোগান ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই।
আমি জেলপুলিশ ইউনিয়ন গঠনে কাজ করেছিলাম। তাই জেল পুলিশরা আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। মনে আছে ১৯৬২ সালে যখন আবার জেলে যাই তখন সহবন্দী মুজিবভাই বলতেন 'আমি হলাম বাংলার রাজা আর তকীয়ূল্লাহ হলো জেলের রাজা'। ষাট দশকে মুজিবভাই সত্যিই বাংলার অবিসংবাদিত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি অতো বিখ্যাত হননি বলাই বাহুল্য। তবে তখনও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। জেলবন্দীদের মধ্যেও।
জেলখানায় যখন রাত নেমে আসতো চারিদিক শুনশান হয়ে যেত আমি কান পেতে বাইরের জগতের শব্দ শুনতে চাইতাম। আমার পৈতৃক বাড়ি পেয়ারা হাউজ ৭৯ বেগম বাজার। সেটা চকের মোড়ে। সেখান থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে জেলখানা। রাত নিঝুম হতো। হয়তো কোনো দেরীতে ফেরা পথিক হেঁটে যাচ্ছে জেলখানার পাশ দিয়ে, আমি ভাবতাম এই হয়তো আমার ভাই লালু বাড়ি ফিরছে। সাইকেলের বেলের আওয়াজ শুনলে মনে হতো হয়তো বকুল ফিরছে রাত করে। আমার ছোটো ভাই বকুল(মুর্তজা বশীর) কমিউনিস্ট পার্টির ম্যাসেঞ্জার ছিল। পোস্টারিংও করতো। গোপন চিঠি আদান প্রদান করতো। আমার ভাই বলে তার বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে সবার ভালো ধারণা ছিল। একবার জেলেও যেতে হয়েছিল তাকে। মনে হতো বাড়ির অনেকের গলার আওয়াজ যেন পাচ্ছি। সবচেয়ে বেশি দেখতে ইচ্ছা করতো মাকে। আমার মা ছিলেন খুব পর্দানশীন মহিলা। সে যুগের রেওয়াজ অনুযায়ী বোরখা পরে চলতেন। বাড়ির বাইরে খুব কমই যেতেন। যদিও মনে মনে তিনি যথেষ্ট প্রগতিশীল ছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে জেলে দেখা করেছেন অনেকবার। মায়ের জন্য মনটা খুব খারাপ লাগতো। কারণ জানতাম তিনিও আমার জন্য কাঁদছেন।
চক বাজার মহল্লায় মায়ের বেশ নামডাক ছিল চিকিৎসক হিসেবে। অনেকেই তার কাছে বিভিন্ন কবিরাজি ওষুধের জন্য আসতো। জেলের পুলিশও অনেকে মায়ের রোগী ছিল। জেলার সাহেবের স্ত্রীও মায়ের রোগীদের মধ্যে একজন। সেই সুবাদে আমি একটু বেশি খাতির যত্ন পেতাম। সে সময় রাজবন্দীদের অনেক খাওয়ানো হতো জেলে। কারণটা হলো সরকার মনে করতো আরামে থেকে খাওয়া দাওয়া করে যদি মোটা হয়ে যায় বন্দীরা তাহলে তারা মুক্তি পাবার পর আর রাজনৈতিকভাবে কর্মক্ষম থাকবে না। আমি চেষ্টা করতাম যাতে মোটা না হয়ে যাই। কনডেম সেলে থাকার সময়ও ব্যায়াম করতাম। হাঁটতাম ছো্ট্ট সেলের ভিতরেই। জেলে আমি একটা কাক পুষেছিলাম। কাকটাকে নিয়মিত খাবার দিতাম। কাকের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতাম, কিছুটা বুঝতেও পেরেছিলাম হয়তো। মনে হতো কাকটা আমার চেয়ে সুখি কারণ ও মুক্ত। ওতো চাইলেই উড়ে যেতে পারে যেখানে খুশি।
জেলের জীবনে আমি একবার বেশ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। অসুখটা ছিল কমিউনিস্ট কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে কমন অসুখ। গ্যাসট্রিক ট্রাবল। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা পুলিশের কাছ থেকে পালিযে বেড়ানো, আত্মগোপন, আন্দোলন, সংগ্রামসহ ঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপন করতেন। পদে পদে তাদের ছিল বিপদের হাতছানি। টেনশন ছিল নিত্যসঙ্গী। আর খাবার দাবারের নিয়ম বা সময় বলতে তো কিছুই ছিল না। অনাহার বা অর্ধাহারও ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। তাই অবধারিতভাবে তারা আক্রান্ত হতেন গ্যাস্ট্রিক ট্রাবলে। আলসার হয়ে যেত অনেকেরই। আলসার থেকে মৃত্যুবরণও ছিল সাধারণ ঘটনা। সেসময় এত ধরণের অ্যান্টাসিড ও আলসারের ওষুধপত্র ছিল না। বাড়ির সেবা যত্নই ছিল প্রধান ওষুধ। আর আমাদের কাছে বাড়ির সেবা যত্ন তো অমাবস্যার চাঁদ। আমরা তো জীবন পণ করেই দেশের মানুষের মুক্তির পথে নেমেছি।

আন্ডার গ্রাউন্ড জীবনের অনিশ্চয়তায কিন্তু আমার তেমন কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যা হয়নি। তবে জেল জীবনের মানসিক কষ্ট আমাকে কুর কুরে খাওয়া শুরু করে। তখনই গ্যাস্ট্রিক আলসার বাসা বাঁধে শরীরে। আমার লৌহকঠিন স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ছিল। যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লাম তখন জেল হাসপাতালে পাঠানো হলো আমাকে। হাসপাতালের পাহারা স্বাভাবিকভাবেই সেলের তুলনায় কিছুটা কম। আমি পালানোর পরিকল্পনা করতে লাগলাম। হাসপাতালের আরাম আয়েসে আমার মধ্যে একটা অপরাধবোধ জন্মাতো। মনে হতো আমার অন্য সহবন্দীদের তুলনায় আমি বেশি সুবিধা নিচ্ছি।
এদিকে অসুখটা বাড়ছিল। কারা কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যেই মুচলেকার প্রস্তাব নিয়ে আসতো। মুক্তি পেলে আর কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়াবো না এমন আন্ডার টেকিং দিলে নাকি আমাকে ছেড়ে দিবে। আমি প্রতিবারই জবাব দিতাম, আমার দেহের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত আমি সাম্যবাদের পথে থাকবো। আর আমার কমরেডদের সঙ্গে বেইমানি করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমার বাবাকে বলা হয়েছিল আপনার ছেলে দেশদ্রোহী। তাকে মুচলেকা দিতে বলেন তাহলে মুক্তি পাবে। বাবু বলেছিলেন, 'আমার ছেলে দেশদ্রোহী নয়। সেটা হলে তাকে আমি নিজে হাতে গুলি করতাম। আমার ছেলে দেশপ্রেমিক। সে মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করে। তাকে আমি নতি স্বীকারের কথা বলতে পারবো না।'
শরীর বেশি অসুস্থ হওয়ার পর আমি পরিকল্পনা করতাম অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে পালানোর। আমাকে বাইরের হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানোর কথা আলোচনা হচ্ছিল। কারণ আমার জীবন সংকট চলছে বলে চিকিৎসকরা রায় দিয়েছিলেন। এদিকে ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে। রাজবন্দীরা মুক্তি পেতে থাকেন একে একে। অবাক কাণ্ড যে, যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিজয় লাভের খবর পাওয়ার পর থেকেই আমি একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকি। হয়তো মনে আশার সঞ্চার হয় যে, গণতন্ত্র আমাদের জন্য নতুন জীবনের পথ খুলে দিবে। ওষুধ যে কাজ করতে পারেনি যুক্তফ্রন্টের বিজয় সে কাজ করলো। আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। অবশ্য এরপর থেকে বাকি জীবন গ্যাস্ট্রিক ট্রাবল নিত্য সঙ্গী হয়ে ছিল। তবে হাসপাতালে আর কখনও যেতে হয়নি। এই ৮৯ বছর বয়স পর্যন্ত আমার ডায়বেটিস, হাই ব্লাডপ্রেশার বা অন্য কোনো ধরণের অসুখ নেই।
যাক যা বলছিলাম যুক্তফ্রন্ট সরকার বেশিদিন টেকেনি। সেটা ছিল আমাদের জন্য চরম হতাশারও।
১৯৫৫ সালের গোড়ায় আমি মুক্তি পেলাম দীর্ঘ কারাজীবন থেকে।
মুক্তির অনুভূতি কেমন ছিল? খুব নাটকীয় কিছু ছিল না এটুকু মনে আছে। কারণ আমি জানতাম আবার কাজ শুরু করতে হবে। হয়তো আবারও ফিরে আসতে হবে লৌহকপাটের ভিতরে। কিংবা এবার হয়তো পুলিশের গুলিতে জীবন দিতে হবে। তবে যাই হোক, নতুন করে বিপ্লবের কাজ শুরু করতে পারবো, আবার সাংগঠনিক কাজগুলো এগিয়ে নিতে পারব এই চিন্তা আমাকে আনন্দ দিচ্ছিল। নতুন নতুন অনেক পরিকল্পনা ছিল মাথায় যেগুলোর ছক কেটেছি গত পাঁচ বছর ধরে।
জেল থেকে মুক্তির দিন আমাকে নিতে কারাফটকে আসেন ভাইয়া(আমার বড় ভাই আ ফ ম সফীয়ূল্লাহ)। ভাইয়ার নিজের গাড়ি ছিল। জেল থেকে বেরিয়েই ভাইয়াকে দেখে অন্য রকম এক ভালো লাগায় মনটা ভরে উঠলো। ভাইয়া আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বললেন, 'বাড়ি যাবার আগে তোমাকে অন্য একটা জায়গায় নিয়ে যাবো।' বুঝতে পারলাম না উনি আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চান।
ভাইয়া আমাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিকে গাড়ি হাঁকালেন। চিরচেনা রাজপথ অন্য রকম লাগছিল। একটু বেশি আলো যেন আজকের দিনটায়। এক বড় গেটের সামনে এসে গাড়ি থামলো। ঢাকা নিউমার্কেট।
ভাইয়া বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন। আমি যখন বন্দী ছিলাম তখন ঢাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নতুন অনেক ভবন, অনেক পথঘাট আর অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েছে। নতুন ঢাকার সবচেয়ে আধুনিক আর বড় মার্কেট হয়েছে এটি যার নাম ঢাকা নিউ মার্কেট। এই নিউমার্কেট হয়ে দাঁড়িয়েছে আধুনিক ঢাকাবাসীর জীবনের একটি অংশ। এখানে নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে যেখানে আমাকে খাওয়াবার জন্য নিয়ে এসেছেন তিনি। নিউ মার্কেটের ভিতরে ঢুকে এর খোলামেলা ভাব, স্থাপত্য এবং জাঁকজমক দেখছিলাম। দোকানে দোকানে অনেক জিনিষপত্র সাজানো। বাজার অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে। জাঁকজমক আছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটছে। ভালোই। কিন্তু এই জাঁকজমকের অন্তরালে রয়েছে কৃষক ও শ্রমিককে শোষণ করে জমাকৃত পুঁজি। অধিকাংশ দোকান মালিকই তো মনে হয় অবাঙালি। তার মানে বাঙালিকে শোষণও চলছে। অবশ্য বাঙালি কিংবা অবাঙালি যাই হোক শোষকের চেহারায় খুব বেশি পার্থক্য তো আর হয় না। আরেকটা কথা ভাবছিলাম এখানে এত দোকান। এইসব দোকানের কর্মচারীরা কি ঠিক মতো তাদের অধিকারগুলো পাচ্ছেন? তাদের ছুটিছাটা বেতন বোনাস কেমন? এদের জন্য তো মনে হয় কোনো কর্মচারী ইউনিয়ন গড়ে ওঠেনি।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে মনে মনে আমি আমার পরবর্তি কাজ স্থির করে ফেললাম। এই নিউমার্কেটের দোকান কর্মচারীদের ইউনিয়ন গঠনের জন্য কাজ করতে হবে। হ্যা, জেল থেকে ছাড়া পাওয়াটা সত্যি বেশ ভালো ব্যাপার। মানুষের অধিকার আদায়ের কাজটা দ্রুত শুরু করা যাবে।

অনুলিখন: শান্তা মারিয়া

( কমরেড তকীয়ূল্লাহ ২১ জুলাই থেকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নিউমোনিয়া ও ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের কারণে ১৪ দিন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। বর্তমানে ক্যাবিনে আছেন।)।