admin
Published : 21 July 2015, 08:43 AM
Updated : 21 July 2015, 08:43 AM

পলাতক জীবনের বাঁকে বাঁকে

মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ

আমার শৈশব কেটেছে এক অতি শান্তিময় পরিবেশে। কিন্তু উনচল্লিশ সালে শুরু হলো যুদ্ধের ডামাডোল। শান্তিময় পরিবেশে মানুষ অনেকদিন পর্যন্ত শিশু থাকে। আর যুদ্ধ, রাষ্ট্রবিপ্লবে শিশু দ্রুত বড় হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আমাকে বালক থেকে দ্রুত পূর্ণবয়স্ক মানুষে পরিণত করে দিল। দেখলাম তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, একটু ভাতের জন্য মানুষের হাহাকার, পথে পথে মৃত্যুর রাজ্যপাট। অন্যদিকে ভিনদেশী সৈন্যদের আমোদ ফূর্তি। আমাদের দেশের গরীব মানুষকে তারা মানুষ বলেই মনে করতো না। এসব দেখে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে মনের ভিতর ক্ষোভ জমা হচ্ছিল।

আমার বড় ভাই মুহম্মদ সফিউল্লাহ প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ভাইয়ার সূত্র ধরেই কমিউনিষ্ট পার্টির কর্মীদের সঙ্গে আলাপ শুরু হলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা ঢাকায় ছিলাম। আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র। সে সময় ব্রিটিশ ভারতের সরকার কলকাতায় প্রিক্যাডেট মিলিটারি ট্রেনিং স্কুল নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলে। সেখান থেকে ট্রেনিং প্রাপ্তরা মিলিটারি একাডেমিতে যেত ব্রিটিশ-ভারতের সৈন্যবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য।

আমার ইচ্ছা আমিও মহাযুদ্ধের সৈনিক হবো। তাই ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ পাশ করে প্রিক্যাডেট মিলিটারি ট্রেনিং স্কুলের জন্য পরীক্ষা দিলাম। এই স্কুলের ছাত্রদের নেওয়া হতো বিভিন্ন জেলাভিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে একটি বিশেষ সার্ভিস সিলেকশন বোর্ডের অধীনে। ঢাকা থেকে আমি নির্বাচিত হলাম। নারিকেল ডাঙাতে মিলিটারি ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হলাম। আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন জেমস বুকানন। তিনি আবার ব্রিটিশ হোমগারড বাহিনির প্রধান ছিলেন।

অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ছয় মাসের ট্রেনিং সমাপ্ত করলাম। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। তাই যুদ্ধে যাওয়া হলো না।

ট্রেনিং শেষে এবার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পালা। মধ্যপ্রদেশের দেরাদুনে গেলাম। সার্ভিস সিলেকশন বোর্ডে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলাম। কিন্তু আমাকে বলা হলো 'তোমার বয়স কম'। এক বছর পর আমাকে যোগ দিতে বলা হলো। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তির সেশনও শেষ হয়ে গেছে অগাস্ট মাসেই। এক বছর বসে থেকে কি করবো চলে গেলাম বগুড়াতে। বাবা তখন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল। তাই বগুড়ায় বাবার কাছেই গেলাম। মা আমার অন্য ভাইদের নিয়ে ঢাকায় ছিলেন। আমি বগুড়ায় বাবার দেখাশোনা করতাম আর কলেজে পড়তাম।

১৯৪৬ সালে আমি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের বি.এ ক্লাসের ছাত্র। সেসময় দেশে চূড়ান্ত অস্থিরতা। মুসলিম লিগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়েছে। পাকিস্তান গঠনের পক্ষে আন্দোলন চলছে। আমি কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে কাজ করতাম এবং পার্টির ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য ছিলাম। কিন্তু দেশের মানুষের সমর্থন ছিল মুসলিম লিগের পক্ষে। কারণ আমাদের বিপক্ষে প্রচারণা ছিল যে, কমিউনিস্টরা নাস্তিক, তারা ধর্ম মানে না। পার্টির পক্ষ থেকে আমাকে বলা হলো, মুসলিম লিগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দিতে এবং কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সদস্য হিসেবে কাজ করতে। পার্টির নির্দেশে আমি মুসলিম লিগ ন্যাশনাল গার্ডের শরীরচর্চার শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম।

১৯৪৭ সালের অগাস্টে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। বগুড়ায় দেখলাম কি দ্রুত
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো। বগুড়ায় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা ছিলেন। তারা হিন্দু ধর্মালম্বী। তাদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া শুরু হলো, আর চললো লুটতরাজ। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে আমরা চেষ্টা করলাম দাঙ্গা থামাতে। হিন্দুরা দেশ ছেড়ে পালালেন অনেকে। মানুষের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া দেখে ভীষণ দুঃখ হতো। দাঙ্গার বিভৎস রূপ দেখে শিউড়ে উঠতাম।
সেই সময় আমার উপলব্ধি হলো পাকিস্তান বা ধর্মভিত্তিক কোনো দেশ নয়, এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র আমাদের প্রয়োজন যেখানে মানুষের মানবিক অধিকারগুলো রক্ষিত হবে। সেসময়ই আমি সমাজতন্ত্রের আদর্শে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস আর শান্তিময় এক সমাজের স্বপ্ন দেখা শুরু করি।
এদিকে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে দেশ গঠনের কথা বেশ জোরে শোরে বলা হতে লাগলো। আমিও বি.এ পাশ করে ৪৭ এর শেষ নাগাদ ঢাকায় ফিরলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হলাম। ৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সভা হলো। সেখানে আমি, মতিন এবং আমার অন্য বন্ধুরা সবাই উপস্থিত ছিলাম। আমরা ছিলাম কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। আমরা বাংলাকে মাতৃভাষা করার পক্ষে ছিলাম।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় মুসলিম লিগের ছাত্র-কর্মী সম্মেলন ডাকা হলো। আমি তখন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা জেলা কমিটির সেক্রেটারি হয়েছি। কিন্তু এটা ছিল আমার গোপন পরিচয়। প্রকাশ্যে আমি মুসলিম লিগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনির সদস্য হিসেবে ছিলাম। আমার মতো আরও অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সদস্য ছিলেন। আমাদের নেতা ছিলেন নেপাল নাগ। তার ছদ্মনাম ছিল রহমান ভাই। তিনি খুব ভালো উর্দু জানতেন এবং প্রায়ই অবাঙালি পরিচয়ে পার্টির কাজ করতেন। নেপাল নাগ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রভিনশিয়াল কমিটির সেক্রেটারি। তার স্ত্রী নিবেদিতা নাগও পার্টির কর্মী ছিলেন। যতদূর মনে পড়ে সে সময় ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি ছিলেন সর্দার ফজলুল করিম। আবদুল হক ছিলেন যশোর কমিটিতে। মোহাম্মদ তোয়াহা ছিলেন আমার সঙ্গে। আমাদের নেতাদের মধ্যে ছিলেন অনিল মুখার্জি, জ্ঞান চক্রবর্তী, ফণী গুহ, রণেশ দাশগুপ্ত। কমরেড মণিসিংহ তখন ময়মনসিংহে পার্টির কাজে তেভাগা আন্দোলনে ব্যাপৃত ছিলেন। তাই সেসময় তার সঙ্গে পরিচয় হয়নি।

বগুড়ায় থাকতে আমি যদিও পার্টির নিজস্ব লোকই ছিলাম।তবু তখনও আমি পরিপূর্ণ সদস্যপদ পাইনি। সে সময় অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা যাচাই বাছাই করেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ দেওয়া হতো। হুট করে যে কেউ এর সদস্য হতে পারতো না। রাজনীতিতে যারা আসতেন তারা ছিলেন দেশের কল্যাণে নিবেদিত কর্মী। বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা প্রত্যেকেই ছিলেন আত্মত্যাগের আদর্শে দৃঢ় প্রত্যয়ী।
১৯৪৮ সালে ঢাকা মিউনিসিপালটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন খান সাহেব আবুল হাসনাত। যার নামে এখন পুরানো ঢাকায় আবুল হাসনাত রোড হয়েছে। তার বাড়ি ছিল বেচারাম দেউড়িতে।
সেখানে কর্মী সম্মেলন উপলক্ষে সারা দেশ থেকে আসা অনেক তরুণ যুবকের সঙ্গে পরিচয় হলো। সেখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হয়। যদিও তখন তিনি বঙ্গবন্ধু নন, মুজিবভাই নামেই পরিচিত ছিলেন। পরবর্তিকালে জেলখানায় তার সঙ্গে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।

যাই হোক '৪৮ সালের সেই কর্মী সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিল। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে কি না তার পক্ষে- বিপক্ষে বিভিন্ন কথা বলা হতে লাগলো। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিয়াউদ্দিন লিখলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা অবশ্যই উর্দু হবে। এর দাঁতভাঙা জবাব দিলেন আমার বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বললেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার পরিবর্তে অন্য কিছু হলে তা হবে পরাধীনতার নামান্তর।। বাবার লেখাটি প্রথমে কমরেড পত্রিকায় ও পরে আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।এই লেখাটি পড়ে আমরা মানে তরুণরা খুব উজ্জীবিত হই। আমরা যারা কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সদস্য হিসেবে কাজ করতাম তাদের মূল লক্ষ্য তখন ছিল বাংলা ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের একটি অংশে থাকতাম। পরর্তিতে তার নাম হয় ঢাকা হল। বর্তমানে সে অংশটির নাম শহীদুল্লাহ হল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রিয় বন্ধু ছিলেন শহীদল্লাহ কায়সার। তিনিও আমার মতোই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। আমাদের দুজনের উপর ভার ছিল ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের সংগঠিত করা। ছাত্রজীবনের সেসব মধুর স্মৃতি ভোলার নয়। শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে আমার পলাতক জীবনেরও অনেক স্মৃতি। অনেক সংগ্রামে আমরা ছিলাম সহযোদ্ধা। আজ থেকে প্রায় পয়ষট্টি-ছেষট্টি বছর আগের সেই দিনগুলোর দিকে তাকালে আজও দেখতে পাই আমার সেই সাহসী বন্ধুর দৃঢ় প্রত্যয়ী তারুণ্যদীপ্ত মুখ।

১৯৪৭ সালের শেষদিকে বাংলাভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গঠিত হয় তমুদ্দুন মজলিস নামে একটি সংগঠন। প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের নেতৃত্বে সেখানে মূলত ছাত্ররা একত্র হয়। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে আমি এবং আরও কয়েকজন কর্মী এর সদস্য হই। আমাদের চক বাজারের বাসা থেকে তমুদ্দুন মজলিসের অফিসে কয়েকটি চেয়ারটেবিলও পাঠিয়ে দেন বাবা।

সত্যিকথা বলতে কি, তখনও আমার মনে ব্যক্তিগত উচ্চাশা ছিল। ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দিব। ৪৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেকেন্ড কোর্সে সিলেকশন পরীক্ষা হয়। আমি সেই পরীক্ষায় অংশ নেই এবং প্রথম বাঙালি হিসেবে সিলেকটেড হই। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অফিসার হওয়ার জন্য ট্রেনিং শুরু হল। আমি প্রতি সপ্তাহে সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত সেই ট্রেনিংয়ে থাকতাম। আন্দোলনের খবর নেওয়ার জন্য শনিবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফিরতাম। আবার রবিবার সন্ধ্যায় ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতাম। মিলিটারি অফিসার হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ট্রেনিংয়েও বেশ ভালো ফলাফল করছিলাম। কিন্তু যখন ক্যাম্পাসে ফিরতাম তখন এক অপরাধবোধ আমাকে পেয়ে বসতো। মনে হতো আমার বন্ধু ও কমরেডরা মাতৃভাষার দাবীতে যখন আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন আমি কি স্বার্থপর হয়ে দূরে সরে থাকবো? বিশেষ করে শহীদুল্লাহ কায়সার যখন বললো, 'তকি, আমরা নতুন সমাজ গঠনের জন্য যখন বিপ্লব করবো, তুমি কি তখন আমাদের বুকে গুলি চালাবে?' আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, সেনাবাহিনীতে গিয়ে আমার কমরেডদের সঙ্গে বেইমানি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বলতে গেলে সেই মার্চ মাসেই আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সচিবালয়ের দিকে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। সারা রাত জেগে আমরা প্ল্যাকার্ড লিখলাম। 'শিক্ষা ও কৃষ্টির মূলে কুঠারাঘাত' 'উর্দুবাংলা ভাই ভাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' ইত্যাদি শ্লোগান লেখা হল।মিছিল যখন বের হলো আমি দৌঁড়ে হলের রুমে গিয়ে আমার ক্যামেরাটি নিয়ে এলাম। তখন ক্যামেরা এত সহজলভ্য ছিল না। বর্তমান ঢাকা মেডিকেলের সামনে দিয়ে যখন মিছিল যাচ্ছে সে সময় ছবি তুললাম। হাইকোর্টের কাছাকাছি পুলিশ যখন মিছিলে ব্যারিকেড দিয়েছে সেই ছবিও তুললাম। এখন মনে হয় ভাগ্যিস ছবিগুলো তুলেছিলাম। কারণ আমার তোলা সেই ছবিগুলোই ৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের একমাত্র ছবি। সচিবালয়ের সামনে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হলো। আমার লক্ষ্য তখন ক্যামেরাটা বাঁচানো। কারণ না হলে ছবিগুলো হারাবো। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের টুকরো ইত্যাদি ছাত্ররা ছুঁড়ছিলেন। আমি তখন ক্যামেরাটা
গলায় ঝুলিয়ে নিলাম। দেখি তোপখানা রোডের পাশে একটি গরুর মাথার হাড় পড়ে আছে। সেটিই ছুঁড়ে মারলাম পুলিশের দিকে। তারপর ক্যামেরা বাঁচিয়ে দৌঁড় দিলাম বাড়ির দিকে। এই ছবিগুলো সংরক্ষনের কৃতিত্ব আমার মায়ের। আমার পলাতক জীবন এবং টানা পাঁচবছর কারাগারে বন্দী থাকার সময় মা পরম মমতায় আমার ব্যক্তিগত জিনিষপত্র আগলে রেখেছিলেন। সেখানেই ছবির নেগেটিভগুলোও সংরক্ষিত ছিল, যা আজও আমার কাছে রয়েছে।

৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। একথা ঠিক যে তখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। এমনকি অনেক সাধারণ ছাত্রও তাকে শ্রদ্ধা করতো। আমরা যখন তার বিপক্ষে কোনো কথা বলতাম বা তার সমালোচনা করতাম তখন আমাদের উদ্দেশেও কটুক্তি করা হতো। কিন্তু ঢাকায় এসে জিন্নাহ সাহেব যখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করলেন তখনই আমরা প্রতিবাদ জানাই এবং সাধারণ ছাত্রদেরও চোখ খুলে যায়। তারাও তীব্রভাষায় জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে।

মার্চ মাসের শেষ দিকে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ফেডারেশনের সম্মেলন হলো জয়দেবপুরে। আমি তখন ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা জেলা কমিটির সেক্রেটারি। সে সময় দেশজুড়েই আন্দোলনের হাওয়া বইছে। রেলওয়ে শ্রমিকরা তাদের দাবি দাওয়া নিযে ধমর্ঘট করছেন। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে লক্ষ্মী-নারায়ণ কটন মিলে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে আমরা প্রতিটি আন্দোলনে সমর্থন জানাতাম, প্রতিনিধি দল পাঠাতাম এবং গোপনে সহযোগিতা দিতাম। শ্রমিক আন্দোলনকে সংগঠিত করাই ছিল আমাদের দায়িত্ব। সেই সঙ্গে প্রতিটি আন্দোলনের দাবীদাওয়ার মধ্যে আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিটি অন্তর্ভুক্ত করতাম।জয়দেবপুরে ছাত্র সম্মেলনে অংশ নিয়ে আমি, তোয়াহা, মতিন এবং আরও কয়েকজন কমরেড গেলাম নারয়াণগঞ্জে লক্ষীনারায়ণ কটনমিলে। সেখানে শ্রমিকদের সভায় অংশ নিলাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মিলের কয়েকজন কর্মচারী বললেন, যে মিলের লঞ্চ তো নারায়ণঞ্জ ঘাটে যাচ্ছে আপনারও সঙ্গে যান, ঢাকায় পৌঁছাতে সুবিধা হবে। লঞ্চে উঠলাম আমরা। তখন রাত। লঞ্চ যখন নারায়ণগঞ্জ ঘাটে ভিড়ছে সে সময় ডেকের উপর পুলিশের টর্চের কড়া আলো এসে পড়লো। আমরা পালানোর আগেই লঞ্চের উপর পুলিশ হানা দিল। আমার পকেটে তখন ছাত্র সম্মেলনের জরুরি কাগজপত্র, কয়েকজন কমরেডের নাম। আমি কাগজগুলো দলা পাকিয়ে পানিতে ছুঁড়ে ফেললাম। একজন পুলিশ আমার গালে সপাটে একটি চড় কষিয়ে বললো, 'কী ফেললি পানিতে?' ততোক্ষণে শীতলক্ষ্যার জলে আমাদের গোপন সিদ্ধান্ত ও কমরেডদের পরিচয়বাহী জরুরি কাগজপত্র ভেসে গেছে।
আমরা সবাই গ্রেপ্তার হলাম। আমাদের ধরে নিয়ে আসা হলো নারায়ণগঞ্জ থানায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ চললো, অন্যদিকে খবর গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। হল কর্তৃপক্ষ আমাকে জামিন দিয়ে ছাড়িয়ে আনলেন।

সেসময়ই কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে আমার পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস হয়ে গেল। হলের প্রভোস্ট ছিলেন ড. মাহমুদুর নামে একজন অবাঙালি উর্দুভাষী শিক্ষক। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন হল অফিসে। তারপর বললেন, 'তুমি কমিউনিস্ট, তুমি ইসলামের দুশমন। তোমাকে বহিষ্কার করা হবে'। তখন রোজার মাস। আমি রোজা ছিলাম এবং নিয়মিত নামাজ পড়তাম। জবাব দিলাম 'আমি কিভাবে নাস্তিক হলাম? আমি তো রোজা আছি এবং নামাজ
পড়ি। আপনি কি বলতে চান আমি ভন্ডামি করে রোজা রাখি? আমাকে বহিষ্কার করা হলে আপনাকে এর কারণ লিখিত আকারে দিতে হবে'। তর্কযুদ্ধে তিনি হেরে গেলেও আমাকে বহিষ্কার করা হলো। এর কয়েক মাস পরেই আমার নামে হুলিয়া জারি হয়। কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের পক্ষ থেকে আমাকে নির্দেশ দেওয়া হলো 'আন্ডারগ্রাউন্ডে' যাবার।
এরপর কমরেড মণিসিংহের নেতৃত্বে আমি যখন বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেই তখন আমাকে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দেবার জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। সেসময় পাঁচহাজার টাকায় ঢাকা শহরে একটি মাঝারি আকারের বাড়ি কেনা যেত।

১৯৪৮ সাল থেকেই শুরু হলো আমার পলাতক জীবন। সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন বুকে নিয়ে পথচলা সেই জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে আতংক, বিপদের হাতছানি আর পাশাপাশি কত না ঘটনা, কত আনন্দ বেদনার গল্প। তবে সেসব গল্প না হয় আরেকদিন হবে।
অনুলিখন: শান্তা মারিয়া

খণ্ডিত দেশ, অখণ্ডিত স্মৃতি

হাসান আজিজুল হক

শুয়ে-থাকা, বসে-থাকা মানুষদের ফাঁকে ফাঁকে হেঁটে বরিশাল এক্সপ্রেসের মোটামুটি খালি একটা কামরার খোঁজে এগিয়ে যাচ্ছি। বেশিরভাগ কামরাই দেখি ভর্তি। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। আমার একহাতে একটা বেতের স্যুটকেস– তখন খুব চালু ছিল এরকম স্যুটকেস– তাতে আমার সব সম্পত্তি। তেমন বেশি কিছু নয়– নতুন তৈরি একটা প্যান্ট, বেশ দামি কাপড়ের, দুটো পাজামা আর দুটো ফুলশার্ট। পুরনো হাফপ্যান্টগুলোও নিয়েছি। দু-চারটে বই, একটা শখের কমদামের ফাউন্টেন পেন, ফুলস্ক্যাপ কিছু কাগজ আর দাঁত মাজা ব্রাশ পেস্ট– এইসব। এদের অনেকগুলিই আমি জীবনে এই প্রথম ব্যবহার করব। খুব বেশি পীড়াপিড়ি করায় বাবা এগুলো কিনে দিয়েছেন। তবে দুর্লভ উপহারের মতো গতকাল এই কলকাতাতেই কেনা হয়েছে একজোড়া কাবুলি শ্যু। এখন পরে রয়েছি। পুরনো ছেঁড়া খোলতোলা জুতোজোড়া আমার সঙ্গে আছে নতুন কেনা জুতোর খালি বাকসোটায়। হঠাৎ মনে হলো এই বাকসোটায় পুরনো জুতোজোড়া রেখে কি হবে। আর তো পরা যাবে না ও জোড়া। মিছি মিছি বইছি কেন, ফেলে দিই। এই ভেবে স্যুটকেসটা মেঝেয় রেখে জুতোজোড়া বের করে একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, বাকসোটা ফেললাম আর এক দিকে। তারপরেই চেয়ে দেখি অন্তত চার পাঁচজন লোক হুমড়ি খেয়ে জুতো নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। একপাটি জুতো নিয়ে যখন এইরকম চলছে, তখন ছিটকে-পরা একপাটি জুতো ওদের একজন কব্জা করে প্রাণপণে পায়ে ঢোকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ছেঁড়া জুতো জোর করে পায়ে ঢোকাতে গিয়ে আরও ছিঁড়ে যাচ্ছে আর ওটা একজন দখল করেছে দেখে কোথা থেকে আর একজন এস ওর ঘাড়ে পড়ে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। আমি আর চেয়ে দেখতে পারলাম না। এরাই নাকি রিফ্যুজি– ওদের সবকিছু কেড়ে-কুড়ে নিয়ে পুব পাকিস্তান তাড়িয়ে দিয়েছে। নর্দমার কুকুরও এক টুকরো হাড় নিয়ে এরকম টানাটানি করে না।

খুঁজছি একটা খালি কামরা। কিছুতেই ছেঁড়া জুতোজোড়া নিয়ে হেঁচড়াহেঁচড়ির ঘটনাটা ভুলতে পারছি না। কে একজন একটা কলার খোসা আর একটা বিস্কুটের প্যাকেট ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ল দু-তিনটে ন্যাংটো ছেলে। প্যাকেটে একটা বিস্কুট ছিল বোধহয়, ওটা যে পেল সে প্রাণপণে ছুটছে, তার পিছু পিছু ছুটছে আর দুটো ছোঁড়া। না তারা বিস্কুট-টা একা খেতে দিল না ওকে– কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ওটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ল। সেখান থেকে কুড়িয়ে যে যা পারল মুখে পুরল। একটা ছেলে একজনের মুখ খামছে ধরেছে। পাল্টা সে-ও ধরেছে ওর চুল। দাঁত বেরিয়ে পড়েছে, চোখে কষ্ট আর অসম্ভব রাগ। এর মধ্যে একজন হঠাৎ ওদের ছেড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোকের সামনে হাত পেতে দাঁড়াল। এক একটা খুব সাধারণ ছোটখাটো ঘটনা চিরদিন মনে থাকে। কেন এমন হয় কে জানে। ঐ যে ছেলেটা ভদ্রলোকের সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে ওর মুখটা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব বলে মনে হয় না। সারা মুখে নখের আঁচড়, ওর মতো আর যারা রয়েছে তাদের সঙ্গে মারামারি না করে তো বেঁচে থাকতে পারবে না। ঐটুকু ছেলে, চোখের চাহনিটা একটুও গরম নয়, যে ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনি হাত-নেড়ে শুধু বললেন, যাঃ, যাঃ, এখান থেকে। কটমট করে ছেলেটা তাকালো তাঁর দিকে, পারলে লোকটার হাত মুচড়ে পকেট থেকে টাকা তুলে নেয়! আর লোকটার চোখেমুখে যে ঘেন্না ফুটে বেরুচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে একটা চড় ওর গালে এক্ষুণি মারা দরকার কিন্তু তাতে যে নোংরাটা তাঁর হাতে লাগবে সেই হাতটা এখানে ধোয়া যাবে কি করে, হুঁঃ, যতোসব রিফ্যুজি হাঘরে এসে জুটছে এখানে। মরবি তো সবাই, তা মরতে এখানে কেন, পাকিস্তানেই মরগে না। আর সরকারের বলিহারি যাই– হাট করে সিংহ দরজা খুলে রেখেছে– ঢোকার সাথে সাথে গুলি করে সব শুইয়ে দিতে পারলি না। এদিকে খবরের কাগজে কেঁউ কেঁউ করে যাচ্ছে–পূর্ব পাকিস্তানের সরকার জোর করে হিঁদু তাড়াচ্ছে দেশ থেকে, কিন্তু এমন তো কথা নয়, এখানে ওদের জায়গা দেব কি করে। পশ্চিমবঙ্গে জায়গা নেই। নেই তো মোচলমানদের তাড়িয়ে দিয়ে দেশটা একটু ফাঁকা করে অই রিফ্যুজি বেটাদের ঠাঁই করে দেনা। আমার সামনেই দেখলাম দৈনিক খবরের কাগজ নিয়ে বসে আছে একজন। একটা কাগজে মোটা মোটা অক্ষরে দেখছি– পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থী ঢুকছে। শেয়ালদহ স্টেশনে হাজার হাজার শরণার্থী। আর একটা কাগজে দেখছি, পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার শরণার্থী পিল পিল করে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকছে। আর একটা কাগজে : ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই। আর একবার সবকটা প্লাটফর্মের দিকে চেয়ে দেখলাম– একটুকু ফাঁকা জায়গা নেই– কয়েকশ' সংসার বসে গিয়েছে, মেয়েরা কেউ চুল আঁচড়াচ্ছে, কেউ উকুন বাছছে, একটানা ঘাড় নাড়িয়ে যাচ্ছে এক বুড়ি– ঘন ধোঁয়ার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে কাঠকুটো জ্বালানোর চেষ্টা করছে আধ বয়েসি কোনো বউ– বউ বলা কঠিন; ছেঁড়া শাড়ি, শতছিন্ন ব্লাউজের ভিতর দিয়ে পেট পিঠ বুক সবই দেখা যায়। চোখ-জুড়লো একটা দুটো দৃশ্য : এক মা তার কিশোরী মেয়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে– রুক্ষ চুল, জট পাকিয়ে আছে, তেল-টেল নেই– তবু কি যত্ন করেই না মেয়ের পিঠ ঘেঁষে বসে মা বিনুনি বাঁধছে।

মনে হচ্ছে বটে এইবার দুনিয়া দেখা আরম্ভ হলো। গাঁ থেকে বেরিয়ে আসা মানে একরকম মাতৃগর্ভ থেকে বাইরে আসা। তফাৎ শুধু এই: মাতৃগর্ভে থাকার কোনো স্মৃতি থাকে না– বাইরে এসে বোঝা যায় ভারি আরামে ভেসে বেরিয়েছিলাম– টের পাইনি ক্ষিধে তৃষ্ণা ঠাণ্ডা গরম–কোনোটাই। জন্মের পর কোল মিলেছিল। সেখানে কাটলো ষোলো বছর। এইবার বাইরে অজানা জগতে এসে পৌঁচেছি। এখন পাষাণে মাথা কুটতে হবে, কাদায় জলে ডুবতে হবে– পৃথিবীর বাতাসে কখনো কখনো টান পড়বে, তখন নাভিশ্বাস উঠবে। সেইযে গোপীপদ মাস্টারমশাই হাতের কঞ্চি দিয়ে মানচিত্র দেখাতেন, এ্যাদা, এ্যাদা, এই হলো বাংলাদেশ– একভাগ পশ্চিম বাংলা, আর এক ভাগ পূর্ব পাকিস্তান, আরে উদিকে কি দেখছিস, ডাইনে ডাইনে দ্যাখ, পুবদিকে, হ্যাঁ, এই হলো পূর্ব পাকিস্তান। এই দ্যাখ মোটা একটা লাইনের দাগ টেনে দু-ভাগ করা। তখন মনে হয়নি যে জিগগেস করি দাগ টেনে দুভাগ করার মানে কি।

দাগ এখনো পেরুইনি–এর মধ্যেই জন্মভূমি থেকে ছিটকে পড়ে বোঝা শুরু হয়ে গেল দাগ টানার মানে কি। দাগ দিলেই কি আলাদা হয়ে যবে। আমাদের রাঢ়ের বর্ধমানের সঙ্ড়ে মুর্শিদাবাদের কতো তফাৎ– ওটুকু তফাৎ তফাৎ-ই থাকবে, দাগ দেবার দরকার হবে না। তাহলে একটা বাংলাকে দুটো বাংলা কেন করল, কারা করল? ক্লাশ টেনে পড়ার সময় জেনেছিলাম ১৯০৫ সালে নাকি একবার বাংলাকে ভাগ করা ঠিক হয়েছিল। তখন বাংলাদেশের মানুষ সেই ভাগ মেনে নেয়নি, রুখে দাঁড়িয়েছিল। এখন দেখছি ভাগ করার সাথে সাথেই সবাই মেনে নিল আর তারপরেই দেখা যাচ্ছে ওভাগ থেকে মানুষ এভাগে আসছে আর নিশ্চয়ই এভাগের মানুষ ওভাগে গিয়ে ভাগ বসেছে। শেয়ালদহ স্টেশনে এসে মনে হচ্ছে হজার হাজার ছেঁড়া ঘুড়ি আকাশে উড়ছে, ছাদের কার্ণিশে, ল্যাম্পপোস্টে, গাছের ডালে আটকে আছে। অজ্ঞান মানুষ একরকম স্বর্গেই বাস করে– আমি এখন ভেবে দেখছি ভালো স্বর্গেই ছিলাম– কবে একবার শুনেছিলাম ভারত স্বাধীন হয়েছে, পাঞ্জাব আর বাংলা দুখাগ হয়েছে। পত্রিকা-টত্রিকা আসত বটে পূর্ব পাকিস্তান থেকে– কিন্তু সত্যিই দেশভাগের পর থেকে ৫/৭ বছর আমি এই বিষয়ে কিছু জানিও না, জানার আগ্রহ-ও হয়নি।
সেই ষোলো বছর বয়সে শেয়ালদহ স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো মায়ের কোল থেকে ছিটকে মাটিতে পড়লাম। কতোটুকু ছিল আমার পৃথিবী? অথচ কতো বড়োই না ভাবতাম তাকে। কোনো কোনো বর্ষায় তিন দিন, কখনো বা সাতদিনের বাদল নামত। সারাদিন বৃষ্টি, সারারাত বৃষ্টি, বাড়ি থেকে বেরুনোর উপায় নেই, মনে হতো দুনিয়া আর থাকবে না, একটা মাটির বাড়িও আর রক্ষা পাবে না। বাদল একদিন শেষ হতো– পুবে সুয্য উঠত লাজুক মুখে– বাড়ির এসে দেখতাম হুড়মুড় করে জল নামছে চারদিক থেকে– অত বড়ো দিঘি ভেসে গেছে, গাঁয়ের কাছের মাঠের জোতজমি শাদা পানিতে ভর্তি, ঢেউ উঠছে সারা বছরের শুকনো ঐ মাঠে দিঘি থেকে বেরিয়ে পড়েছে বিশ পঁচিশ সের ওজনের একটা রুই মাছ– মাঠে পড়েই সে তীরবেগে ছুটছে উত্তর দিকে– গাঁয়ের সব মানুষ ছুটছে তার পিছু পিছু, যে আগে ধরবে সেই মালিক হবে। এই পাথার দেখেই মনে হতো কতো বড়ো এই দুনিয়া! এখন মনে হচ্ছে আমি নিজে কতোটুকু? আমার পৃথিবী তো আমার মাপেরই ছিল। ঐখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মনে হলো মাপ এইবার বড়ো হতে শুরু করেছে। ভয় পেয়ে গেলাম। যেন হাজার হাজার পরীক্ষা আমার সামনে। ফেল করলেই বাদ। শেয়ালদহ স্টেশনে যারা শুয়ে-বসে আছে– উকুন ভরা শবের মতো চুল চুলকোতে চুলকোতে যে বুড়িটা মনে ছিঁড়ে ফেলবে চুল, শুকনো মাই যে বাচ্চাটার মুখে গুঁজে দিয়েছে মাঝবয়েসি বউটা, সে নিশ্চয়ই জানে বাচ্চাটা মরে যাবেই, কঞ্চির মতো হাত-পা, চুল-ওঠা, চামড়া-ঝোলা, মানুষের বাচ্চা বলে চেনা কঠিন খুকিটা যে কিছুতেই বেঁচে থাকবে না, তার মা নিশ্চয়ই তা জানে। এরা সবাই ফেল করেছে। কি করে হয়েছে এসব। দেশটা ভাগ হয়েছে তো– ওদিক ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে। এদিক থেকে যাদের তাড়ালো তাদের সঙ্গেও তাহলে দেখা হবে আমার। আমি যখন এদিক ছেড়ে ওদিক যাচ্ছি। ইচ্ছে হলো বাবাকে বলি পাসপোর্ট ফাসপোর্ট ফেলে দাও। চলো বাড়ি যাই। কিন্তু বাবাকে একথা বলার সাহস আমার নেই। তখুনি বাবা ডাকলেন, এদিকে এসো, এই কামড়াটা বেশ ফাঁকা, এটার জানলার পাশে বসে পড়ো। ট্রেন ছাড়বে এবার। ছোট্ট বেতের স্যুটকেসটা নিয়ে কামড়ার হ্যান্ডেল ধরে উঠতে গিয়ে বা-পা-টা কোনো নরম জিনিশের ওপর পড়ল মনে হলো। চেয়ে দেখি একটা বারো-তেরো বছরের ছেলের পিঠে আমার পা। তখন সেটা আর তুলে নেবার উপায় নেই, ডান পায়ের ওপর জোর দিয়ে ফেলছি। উঠেই পড়লাম। ছেলেটা পিটপিট করে চেয়ে আছে আমার দিকে।
ছিন্নভিন্ন পচা ঘুনে ধরা মানুষে ভরা প্লাটফর্ম আস্তে আস্তে পিছনে সরে যাচ্ছে। বাবা আমার কামড়ার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, পিছনে চলে যাচ্ছেন তিনি, হাত তিনি নাড়াবেন না জানি, বার বার ছায়া পড়ছে তাঁর মুখে, আবছা দেখতে পাচ্ছি তাঁকে, একবার হুইসেল―বরিশাল এক্সপ্রেস– চোখের আড়াল হলো প্লাটফর্ম। একটু মন খারাপ নিয়ে বাবা কি স্টেশনের বাইরে যাবার জন্যে গেটের দিকে এগোচ্ছেন? এই শক্ত মানুষটির চোখদুটি কি কখনো ভিজে ওঠে না। মানুষের সাড়াতেও না?
ট্রেন এগুচ্ছে খুবই ধীরে। মনে হচ্ছে কেবল ঘুম থেকে উঠেছে, শরীরে জুৎ পাচ্ছে না। আড়িমুড়ি ছাড়া দরকার। বা গা-ঝাড়া দিতে একটু তো সময় লাগবেই। দু-পাশে রেল-লাইনের জাল; সন্দেহ হয় এক লাইন, ঠিক লাইনটা ধরেছে তো? স্পীড আর একটু বাড়াল দেখছি আমাদের লাইনটা একা হচ্ছে। বাঁদিকে গেছে একটা লাইন বোঝা গেল ওটা অন্য কোথাও যাবার লাইন। স্পীড আর একটু বাড়ল, সিগন্যালগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে, খটখট শব্দে অন্যনান্য লাইনগুলি বাদ দিয়ে রাস্তাটা বেছে নিচ্ছে। বরিশাল এক্সপ্রেস এবার নিজের লাইনে উঠল, গুতিও বাড়লÑ দুপাশে কলকাতা শহর এখনো টানা চলছে। মহানগর কলকাতা কমেন করে শেষ হয় দেখার জন্যে আমি জানালা দিয়ে চেয়ে আছি। বড়ো বড়ো বাড়িগুলো জায়গায় দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট দালানকোঠা, তাদের ভিতর দিয়ে রাস্তাগুলি আর অতো চওড়া নয়, পরিস্কার তকতকেও নয়। যেখানে সেখানে আবর্জনা স্তূপাকার হয়ে আছে, দু-একটা এঁদো পুকুর চোখে পড়ছে। ট্রেনের গতি যথেষ্ট বেড়েছে বটে কিন্তু শহর আর ফুরোচ্ছে না। এখন আর কঠিন কলকাতা নয়, শহরতলি এসে গেছে। পাকা বাড়িঘর কমছে, রাস্তাগুলো আরও সরু গয়ে এসেছে, গলিঘঁজির মধ্যে ঢুকে পড়েছে রাস্তা। অনেক উঁচুতে একটা বিলবোর্ড দেখতে পাচ্ছি — চ্যাবনপ্রাশ, ডাবর। ট্রেন তার গতি এতক্ষণে বাড়াল, ঝক ঝক শব্দে পিছন দিয়ে দৌড়–চ্ছে শহরতলি কেবলি খানাখন্দ পুকুর ডোবা, পচে যাওয়া আবর্জনার দুর্গন্ধ, আকাশেও দেখছি মেঘের ময়লা, এই ছায়া, এই রোদ্দুর। মনটা ভীষণ দমে গেল। কোথায় যাচ্ছি তাহলে? শেয়ালদা স্টেশনের প্লাটফর্মে বার বার মনে হয়েছিল নরক কি এর চেয়ে খারাপ জায়গা– এখন মনে হচ্ছে মহানগর কলকাতা চারদিকে নরকঘেরা। অন্তত শহরতলি দেখে সেইরকমই মনে হচ্ছে– নরক তৈরি না করে স্বর্গ তৈরি করা যায় না বোধহয় স্বর্গ হয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত ফোলা বেলুন। এখন দুপাশে দেখছি গাঁয়ের মত কিছু একটা। না, রাঢ়ের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম নয়–এখানে সেখানে হতছাড়া দু-একটি বাড়ি, পাশে সেই এঁদো ডোবা। দিঘি পুকুর নয়, ডোবা, মোটা সরপড়া সবুজ জলের এক একটা বড়ো গর্ত। মনে হয় ঐটুকু ডোবা খুঁড়তে গিয়ে যে মাটি পাওয়া গিয়েছে, তাই দিয়েই তৈরি ভিটে আর বাড়িটা। ট্রেনে বসেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। স্টেশনের নাম শেয়ালদা কেন এখন বুঝতে পারি। এই ডোবাগুলিই দহ দহে পরিপূর্ণ এই এলাকা নিশ্চয়ই একসময় জনশূন্য ছিল, নির্জন বিষণ্ন ঝোপঝাড় আর খানাখন্দে পরিপূর্ণ এই নিচু এলাকায় দিন ছিল নিস্তব্ধ, রাতে তিন চারবার নির্জনতা ঝেড়ে শোনা যেত শেয়ালদের হাঁক। সফলা কলাগাছ, বুুনো কচুর বন আর ঐ ছোট ছোট বাড়ি ঝক ঝক শব্দে পার হয়ে ট্রেন এসে দাঁড়াল একটা ফাঁকা স্টেশনে। দুএকজন ট্রেনে উঠল, দু-একজন নামল।

মনে হচ্ছে কলকাতা শহরতলি পার হয়ে এসেছি। দু-পাশে বড়ো বড়ো মাঠ, ধানের সময় নয় এখন, ফাঁকা পড়ে রয়েছে। মাঠ কখনো নির্জন নিস্তব্ধ নয়, সেখানে বাতাসের শব্দ, ধুলোর স্তম্ভ,বিশাল বিশাল অশথ আর বটের অক্ষয় স্থিরতা, মেঠো পাখি কাক চিল শালিক ভুঁই চড়ুই, মাঠ
পুকুরে শামুক পানিফলের দাম, শ্যাওলা, মাঠের প্রাণ আছে, ট্রেন একটার পর একটা মাঠ পার হচ্ছে, গাঁয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে যে-সব স্টেশন আসছে, তাদের নাম কোনোদিন শুনিনি– হৃদয়পুর, বারাসাত, এরপর বনগাঁ সামনে। সেথানে সকলের মহাপরীক্ষা, পাসপোর্ট দেখবে, ভিসা দেখবে, মালপত্র পরীক্ষা করবে, প্রত্যেকের জামাকাপড় ঝেড়ে ঝেড়ে কিছু লুকনো আছে কিনা দেখবে। এইসব কথা শুনেছিলাম বটে। তবে তাতে আমার কি! আমার তো আছে একটা বেতের স্যুটকেস, তার মধ্যে গোটাকতক জামাতাপড় আর কয়েকটা বই, দাঁতের মাজন, দাড়িকাটার কোনো সরঞ্জাম নেই, গালে কালো রোঁয়া জমেছে, দাড়ি এখনো গজায়নি। ট্রেন বেশ জোরেই চলছিল, হু হু করে পিছনদিকে চলে যাচ্ছিল মাঠঘাট, গাছপালা ঝোপজঙ্গল। মনে হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তান ঠিক কোন্ জায়গা থেকে শুরু হয়েছে দেখতে পারলে মন্দ হতো না। এমনিতেই একটু একটু বদলে যাচ্ছিল দু-দিকের শুকনো ফাঁকা রুখো চেহারা, গাছপালা বাড়ছিল, এক একবার মনে হচ্ছিল ট্রেন বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, এখানে এসে ট্রেন লাইন এতটাই বেঁকেছে যে আমি কামরায় বসে থেকেই ইঞ্জিন আর বেশ কয়েকটা তামরা দেখতে পেলাম। বাঁকটা শেষ হয়েই ট্র্রেনর গতি এল কমে। তখন শুরু হলো ধুন্ধু আর কাণ্ড। দরজা জানালাগুলি গেল খুলে আর খোলা দরজা-জানালা ধুপধাপ ঝুপঝাপ করে ফেলা হতে লাগল বড়ো বড়ো বস্তা, মুখবাঁধা থলি, দড়িবাঁধা কাপড়ের পুটুলি। কি আঝে ওগুলোর মধ্যে কে জানে, চেয়ে দেখি অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে ঐ সব থবেস্তা বাক্স-প্যাঁটরা তুলে নেবার জন্যে, তারা টপাটপ একটা করে মাল কোনোটা মাথায় নিচ্ছে, কোনোটা কাঁধে বা হাতে, তারপর মাঠের ওপর দিয়ে দৌড়ে আড়ালে যাবার চেষ্টা করছে। ট্রেন যেন ফাঁকা হয়ে গেল, মালপত্র সব কাঁধে কাঁখে বগলে নিয়ে পড়িমরি দৌড়োচ্ছে সবাই মাঠের মধ্য দিয়ে। প্রচুর মেয়ে ছেলেও আছে ওদের মধ্যে পরিষ্কার বোঝা গেল আগে থেকেই করা আছে, সবাই জানে ড্রাইভার গাড়ি থামাবে না বটে, কিন্তু ট্রেন আস্তে আস্তে চালিয়ে মালপত্র ফেলে দেবার সুযোগ করে দেবে। আমার পাশে বসে থাকা লোকটা বলে উঠল উ: কতোদিনে যে এই স্মাগলিং বন্ধ হবে। দেশের মাল চলে যাচ্ছে বিদেশে।
দাদা, তার বদলে পাকিস্তানের মালও তো আসছে এখানে। একবার কি হিসেব করে দেখবেন, কি গেছে আর কি আসছে। ঐ হলো। ওদের যা দরকার তাই যাচ্ছে আর আমাদের যা দরকার তাই আসছে। সোজা হিশেব। চিরকাল এই হয়, সবদেশেই হচ্ছে। আপনি দেখছি মশাই দেশদ্রোহী লোক! দেশপ্রেম কেউ ধুয়ে খায় না।

দুজনের তর্ক বাড়তে বাড়তে হাতাহাতির জোগাড়। চোরাই কারবার নিয়ে তক্কাতক্কি হয়তো অনেকদূর গড়াত, সেটা আর হলো না। ট্রেন আউটার সিগন্যাল পেরিয়ে আস্তে আস্তে বনগাঁ স্টেশনের প্লাটফর্মে একবার এগিয়ে একবার পিছিয়ে লোহা ক্যাঁচ কোঁচ আওয়াজ করে দাঁড়িয়ে গেল। এক লহমায় জেগে উঠল স্টেশন। কয়েকজন পুলিমের লোক ট্রেনের দরজায় দরজায় লাঠির বাড়ি দিয়ে জানাল কেউ ট্রেন থেকে নামবে না। স্টেশরেন বিরাট প্লাটফর্মে যারা পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে বসেছিল এই ট্রেনে উঠবে বলে তাদেরও ধমক দিয়ে জানানো হলো এখন কেউ গাড়িতে উঠবে না। ট্রেনের অন্যদিকে চেয়ে দেখি বস্তা ঝুড়ি থলে ভর্তি মালপত্র বহুলোক প্রাণপণে মাঠের উপর দিয়ে দৌড়োচ্ছে। এই এলাকায় দেখছি গাছপালা খুব বেশি। লোকগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। তারপরেই কামড়ায় কামড়ায় পুলিশের লোক উঠে এল। এসেই ধমক কেউ নিজের জায়গা থেকে নড়বে না, মালপত্র চেক হবে। তারপর চেক করার নামে যা শুরু হলো তাতে একটা কথাই মনে হয়, এই গাড়িতে কোনো যাত্রী নেই, গাড়ি ভর্তি শুধুই কয়েদি, নানা মেয়াদে তাদের জেলের ঘানি টানতে হবে। প্রত্যেকটি প্যাসেঞ্জারের বাকসো প্যাটরা ব্যাডিং ঝোলাঝুলি খুলে তাদের ভিতরের জিনিসপত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজে ট্রেনের মেঝেতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল, তারপর কড়া গলায় আর কিছু আছে ঠিক করে বলুন, উঠে দাঁড়ান, জামাকাপড় দেখান, পারলে মানুষকে ন্যাংটো করে দেখে, শরীরের বেজায়গায় হাত দিয়ে টিপেটুপে দেখে,পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয়, পুরুষদের সঙ্গে কিছু মেয়ে পুলিশও আছে। তারা জিনিশপত্রের সঙ্গে মেয়েদের দেহও খানাতল্লাশি করতে লাগল, অবিশ্বাস হলে মহিলাকে টেনে বাথরুমে নিয়ে বোধহয় তার দেহ উদাম করেই পরীক্ষা করতে লাগল। কামড়াজুরে জিসিশপত্র ছড়ানো থাকল, প্রত্যেকের দেহ মালপত্র পরীক্ষা হয়ে গেলে তারা লাঠি দিয়ে কামড়ার দেয়াল পিটিয়ে আওয়াজ শুনতে লাগল, বাথরুমে দুমদাম পিটিয়ে দেখতে লাগল সেখানে কোনো লুকনো আছে কিনা। আমার জামাকাপড়ও ঝেড়েঝুড়ে দেখা হলো, বেতের স্যুটকেস খুলে দেখল, তারপর বলল, স্যুটকেস-টুটকেস যা আছে নিয়ে অফিসে আসুন।এই বলে গোটা কামড়াটা তছনছ করে ওরা দলবল নিয়ে চলে গেল। স্যুটকেসটা নিয়ে আমি নিচে নামতে নামতে দেখলাম আরো অনেকেই টানাটানি করে জিনিশপত্র নিয়ে নামছে। বুঝলাম আমরা সামান্য কয়েদি নই দাগী আসামি।

প্লাটফর্মের এক কোণে একটা ছোট অফিস ঘর।একটিমাত্র চেয়ার, তাতে একজন অফিসার বসে আছেন। স্যুটকেসটা মেঝেতে নামাতে নামাতে দেখলাম ঘরে আমরই মতো আরো অনেকে নিজের নিজের মাল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একজন কনস্টেবল তার হাতের রুলটা দিয়ে আমার পেটে লাগিয়ে বলল, এই ছোকরা পেছনে যাও। তারপর একজন একজন করে অফিসারের সামনে গিয়ে বাকসো প্যাঁটরা পুঁটুলি খুলে খুলে দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা জানে কোথাও না কোথাও বোমা
লুকনো আছে। এর কাছে না থাকলে ওর কাছে আছে। পাচ্ছে না বলে খুব পাপ হচ্ছে। মহিলা পুলিশগুলো ঘরের অন্য একটা কোণে মেয়েদের জিনিশপত্র খুঁজে দেখছে, তাদের ঝাঁঝ আবার একটু বেশি। তারা যা করছে তাতে সেদিকে তাকাতে আমার লজ্জা করছে। যাই হোক আমাদের সামনে যাবার পালা এল তিনি কড়া চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, পাসপোর্ট দেখি। সেটা তার হাতে দিলে সেটা গবেষণা করতে শুরু করলেন। দশবার উল্টেপাল্টে দেখেও তাঁর বিশ্বাস হতে চায় না এমন দূর্লভ জিনিশ আমি পেলাম কোথা থেকে। হুঁ দেখছি এক ক্যাটাগরির ভিসা হয়েছে। বাপরে, পুরো একবছর থাকা যাবে পাকিস্তানে। আবার ইচ্ছে কররে তিনবার যাতায়াত করা যাবে। এ ভিসা তো একমাত্র ছাত্র আর ব্যবসাদারদের দেয়। ব্যবসা-ট্যাবসা করবে নাকি হে ছোকরা? কি ব্যবসা করবে? না,আমি ছাত্র– লেখাই আছে। সে তো দেখতেই পাচ্ছি। লেখা অনেক কিছুই থাকে। কে আর দেখতে যাচ্ছে? মনে হলো বলেই ফেলি, একবার নাহয় দৌলতপুর কলেজে গিয়ে দেখেই আসবেন। শেষ পর্যন্ত কিছুই যখন বের করতে পারলেন না। ভিসার পাশে চৌকো একটা স্ট্যাম্প মেরে দিলেন– তাতে লেখা 'ডিপারচার'।
এই বিড়ম্বনার ফিরিস্তি আর আমি দিতে চাই না। সারা প্লাটফর্ম জুড়ে দক্ষযজ্ঞ চলছে। নিজের কামরায় এসে বসে থাকলাম। আর আমি কিছু দেখছিও না, শুনছিও না। এখন যা করছি, তার নাম হলো অপেক্ষা। কে বলে অপেক্ষা কোনো কাজ না, অপেক্ষার সময়টা কাঁদা মেয়েমানুষের মতো, তার মধ্যে কোনো উৎপাদন নেই? অপেক্ষার সময়টা মস্তিষ্ক বন্ধ থাকে। আমার মত ঠিক উলটো, অপেক্ষার উৎপাদন বিরক্তি হতাশা অসহায়তা। নিজেকে ছুটি দিতে বাধ্য হওয়া। আমার অপেক্ষার পরে যা কিছু ঘটবে, তার সম্বন্ধে আমার কোনোই আন্দাজ নেই আমার। একটা দেশ থেকে আরেকটা দেশে ঢুকতে চাচ্ছি। কখন থেকে তফাতটা দেখা শুরু হবে জানি না। আমি জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকি। প্লাটফর্মে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা দেখার একটুকু ইচ্ছে নেই। তবু মাঝে মাঝে চোখ চলে যাচ্ছে ওদিকে। পুলিশ একজন লাঠিপেটা করছে। চায়ের দোকানে বসে দুজন চা-বিস্কুট খাচ্ছে, একটা খোঁড়া ভিক্ষুক ভিক্ষে চেয়ে বেড়াচ্ছে। নিরাসক্ত চোখে মহিলারা বসে রয়েছে, মনে হচ্ছে তাদের বুঝি উঠতে বললেও উঠবে না। আমার চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়লো। বাইরের দিকে চেয়েও তো দেখার কিছু নেই। অপেক্ষা! কতোক্ষণ পেরিয়েছে, জানি না। ঘড়ি নেই আমার। এখনও হাতে ঘড়ি বাঁধা স্বপ্ন।
ট্রেনটা তো চলতে চলতেই এখানে এসে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েছে, অন্যান্য স্টেশনগুলিতেও তাই করেছে। তবে ফের চলতে শুরু করেছে দু-চার মিনিট পরে। কিন্তু এখানে এমন দাঁড়িয়ে রয়েছে, মনে হচ্ছে ওর প্রাণ নেই। আর তো কোনো দিনই চলবে না। লোহার রেললাইনের ওপর লোহার চাকার এই অনড় রেলগাড়ি একটু একটু করে আমার বুকের ওপর চেপে বসছে। অপেক্ষার এতো ভার? আমি জানি, এই অপেক্ষার আর শেষ নেই।

তবু পথের পার আছে। প্রত্যেক মানুষের গোনাগুনতি মুহূর্তগুলি পার হয়ে যাচ্ছে– একটুও তো দাঁড়াচ্ছে না কোথাও। দাঁড়াচ্ছে তবে এগুচ্ছে একটুও। … যেমন সত্য, … তেমন সত্য। এক সময়ে সামান্য একটু ধাক্কা। তারপর একটা উৎকট ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ। তারপর কিছুটা পিছন পিছনে সরানো, এগুতে বোধ হয় ইচ্ছে নেই, শেষ পর্যন্ত বরিশাল এক্সপ্রেস … মনে করতে করতে প্লাটফর্ম ছাড়লো। কিন্তু গতি তেমন বাড়লো না। সামনেই পেট্রাপোল, পাকিস্তানের বর্ডার। মাঝখানের জায়গাটুকু বোধ হয় কারো নয়। রেল লাইনের দুপাশেই আটদশ ফুট উঁচু উঁচু কাঁটাতারের বেড়া, সে টপকানো অসম্ভব। ঝোঁপ-জঙ্গলের আড়ালে কাঁটাতারগুলো ভালো করে চোখে পড়ে না। বেড়ার দুপারে জমিজমা, মাঠঘাট, পুকুর, গ্রাম– কিছুই দেখি না। মাঠের জায়গায় দুপাশে বুকসমান উঁচু বেনা ঘাস, কুশ ঘাস, আর কাশের জঙ্গল। কেউ এখানে বাড়িঘর করেনি; একেবারেই পোড়ো জায়গা। এখানে আগে কি কোনো দিন বাড়িঘর ছিল না? দেশ ভাগ হবার আগে নিশ্চয়ই এতো বড়ো জায়গা খালি পড়ে থাকতে পারে না। যারা ছিল তারা আর এখানে টিকতে পারেনি। সরে পড়েছে এদিক, নাহয় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য পেট্রাপোল স্টেশনটা কাছেই, বনগাঁ পেট্রাপোল পৌঁছোতে দশ মিনিটের বেশি লাগল না। এই স্টেশনটার প্লাটফর্মই নেই, স্টেশনে ঘরের মতো ছোট্ট একটা পাকা ঘর দেখছি। আর দেখছি পুলিশের লোক। এরা হলো পাকিস্তানি পুলিশ, পোশাক অন্যরকম। আর প্রায় সবাই তাগড়া তাগড়া জোয়ান। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এরা বাঙালি নয়। দুয়েকজন থাকলেও থাকতে পারে। আমি তেমন দেখতে পেলাম না। ট্রেনের প্যাসেঞ্জারও কমে এসেছে। যাঁরা পাকিস্তান যাচ্ছে না, তারা সব নেমে গেছে। তবে আমাদের কামরাতে দু-তিনটি হিন্দু পরিবার রয়েছে। দেশটা কদিন আগেও বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের ছিল, এখন ভাগ হয়ে যাবার পরে প্রচুর মুসলমান বাঙালি যেমন পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে, নিশ্চয়ই পূর্ব পাকিস্তানে তেমন অনেক হিন্দু রয়েছে। এই কামরার পরিবারগুলোর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে পাকিস্তানে যাচ্ছে পাসপোর্ট-ভিসা করে। কেমন অদ্ভুত মনে হয় না? আমি পড়াশুনা করার জন্য বর্ধমান, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের আরো কোনো জায়গায় আমি যেতে পারতাম, তা না করে খুলনায় বোনের কাছে যাচ্ছি। যখন খুশি ফিরে আসবো। এখন মনে হচ্ছে এতো সহজ ব্যাপার নয়। আজ আমি আমার দেশ ছেড়েছি, অন্তত ছাড়ার পথ ধরেছি। আমার বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল। বনগাঁয় যা যা হয়েছিল, এখানেও ঠিক সে রকমই হলো। পুলিশগুলো উর্দুতে কথা বলছিল। আমি হিন্দিও বুঝি না, উর্দুও না। এদের ব্যবহার আরো কর্কশ। যখন তখন বা যাকে ইচ্ছে রুল দিয়ে পেটাচ্ছিল। একটা আমাকে পাসপোর্ট সুটকেস নিয়ে নিচে নামাল, পাকা ছোটো ঘরটায়।

খণ্ড চিত্র

আমানুল্লাহ কবীর

যারা ছিল সঙ্গীঁ-সাথী, তারা এখন পরলোকবাসী। যাদের জন্ম হয়নি, তাদের জন্ম অনিবার্য কিনা, তা বলতে পারে কেবল নিয়তি, তবে জন্মের পর মৃত্যু অনিবার্য। অনিবার্য মৃত্যুর পরিণতিতে যারা ফিরেছে শিকড়ে, তারা স্বজনের চোখে কেবলই ছবি। দৃশ্যমান ছবির ইতিহাস লুকিয়ে তাদের অদৃশ্য অন্তরে। এ ইতিহাস যখন কথা বলে, তখন তা হয়ে উঠে বাঙময় উপন্যাস। ছোট-বড়ো, ধনীÑদরিদ্র যাই হোক, প্রতিটি মানুষই এক-একটি ইতিহাস, এক-একটি উপন্যাস। প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ ও কার্মকান্ড আয়নাতে ধারণ করে যদি অবিকল লেখায় প্রকাশ করা যেতো, তবে তা হতো নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দাবিদার এক-একটি উপন্যাস। ওই যে সহায়-স্বম্বলহীন বৃদ্ধা যার দিন রাত কাটে রোদ-বৃষ্টিতে ফুটপাতে, তার জীবনও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত একটা উপন্যাস, যার প্রধান চরিত্র সে নিজেই। এমনি কতো ইতিহাস, কতো উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আমাদের জীবদ্দশায় আসে-যায়, তা কে নির্ণয় করতে পারে? যাদের সান্নিধ্যে আমরা আসি, তাদের সম্পর্কে আমাদের স্মৃতি পূর্ণাঙ্গ নয়, খন্ডিত। খন্ডিত স্মৃতি নিয়ে একজন পূর্ণাঙ্গঁ মানুষের চিত্র আঁকা যায় না, বিচারও করা যায় না। একজন ঘাতকের স্নেহপ্রেমের যেমন মূল্যায়ন হয় না, তেমনি মূল্যায়ন হয় না একজন ধার্মিকের নিষ্ঠুরতার। ভাল-মন্দ মিশিয়েই মানুষ, যারা তা মাপার জন্য দাড়িপাল্লা নিয়ে বসে আছেন, তারা সবকিছু দেখেন সমালোচকের চোখে। তা দোষের কিছু নয় যদি তা হয় সম-আলোচনার ভিত্তিতে, একতরফা নয়।

যাহোক, কিছু খন্ডিত স্মৃতির তাগিদ অনুভব করছি অনেক দিন ধরেই চারণ করার জন্য। যাদের স্মৃতি ভর করে আছে আমার উপর, তাদের অধিকাংশই আর ইহলোকের বাসিন্দা নন। তাদের কেউ আমার পেশা সাংবাদিকতায় শ্রদ্ধেয় গুরুজন, কেউ বন্ধুজন। তাদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে কখনো পেশাগত কাজে, কখনো সাংবাদিক ইউনিয়নের কর্মকান্ডে। তখনকার অবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়ন ছিলো দেশের অত্যন্ত শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন। এর সামাজিক মর্যাদাও ছিল তেমনি শীর্ষে। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নসহ (বিএফইউজে) এর অঙ্গ ইউনিয়নের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা পেশাদার হিসেবে সবাই ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। আমার পেশাজীবনের আরেকটি সৌভাগ্য হচ্ছে যে, ইংরেজী-বাংলা মিলিয়ে যতগুলো নতুন দৈনিক পত্রিকা প্রকাশনার সুযোগ হয়েছিল, তা সম্ভবত আর কারো হয়নি। এটা কখনো ভাগ্যের ফেরে ঘটেছে, কখনো স্বেচ্ছায় হয়েছে। এর ফলেও প্রোথিতযশা অনেক সাংবাদিক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ্যালবামের পাতা উল্টালে মনে হয় তারা এখনো কতো জীবন্ত, কতো আপন, যাদের ভিড়ে আমিও ছিলাম একদিন। স্মৃতিকাতর কেনা?

যখন পেশাজীবন শুরু করেছিলাম তখন ছিল কাঠের গ্যালি আর সীসার টাইপের যুগ। গ্যালিতে এক-এক করে অক্ষর সাজিয়ে তৈরি করা হতো শব্দ, শব্দের পর শব্দ মিলিয়ে বাক্য, তারপর একটা খবর। আর কাঠের উপর গরম সীমা ঢেলে তৈরি করা হতো ছবির ব্লক। রঙিন ছবি ও হেডলাইন ছাপা হতো কালে-ভাদ্রে খবরের গুরুত্ব বুঝে। পত্রিকার নাম আর গুরুত্বপূর্ণ হেডলাইন হাঁকতে হাঁকতে রাস্তায় ছোটাছুটি করে কাগজ বিক্রি করতো হকার। পটু সেলসম্যান বলতে হবে হকারদের। সিনিয়রদের মুখে শুনেছি একদিনের ঘটনা। পাকিস্তানে মাওলানা ভাসানী তখন খুবই আলোচিত রাজনৈতিক নেতা। সোচ্চার বিরোধী কণ্ঠ। প্রতিদিনই পত্রিকায় তার খবর থাকে। ওই দিন ভাসানীর খবর নেই। পত্রিকায় আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদও নেই। এক চতুর হকার তখন আওয়াজ তুললো 'ভাসানীর খবর নেই, ভাসানীর খবর নেই'। পথচারীরা চমকে উঠলো। কী ব্যাপার! ভাসানীর খবর নেই! তারপর পত্রিকা হট কেক। হকার ছুটছে, আর পত্রিকা বিক্রি হচ্ছে। সেই হকার পত্রিকা হাতে এখনো ছুটছে। তার ভাগ্যের পরিবর্তন না হলেও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে পত্রিকা তথা মিডিয়া জগতে। বিপ্লব। বিপ্লব এনে দিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি। মূদ্রণে সীমাবদ্ধ নেই পত্রিকা, পত্রিকা চলে গিয়েছে অন-লাইনে। সময়ের বিবর্তনে গ্যালির যুগ অতিক্রম করে আমিও ঢুকে পড়েছি অন-লাইন যুগে। এখন পত্রিকার জন্য পরের দিন ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। এখন অন-লাইনে মুহূর্তের খবর মুহূর্তে চলে যায় বিশ্বের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। সন্ধ্যা হলেই রিপোর্টার-ফটোগ্রাফারকে অফিসে ছুটে যাওয়ার তাগিদ নেই। ভোর রাত পর্যন্ত জেগে পত্রিকা প্রকাশের ঝুঁকি-ঝাক্কিও নেই।

প্রযুক্তি মিডিয়া জগতে বিপ্লব ঘটালেও মিডিয়া কর্মীরা (সাংবাদিকসহ) হারিয়ে ফেলেছে অতীতের বৈপ্লবিক শক্তি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে সাংবাদিক ইউনিয়ন, সংবাদপত্র প্রেস শ্রমিক ইউনিয়ন, সাধারণ কর্মচারী ইউনিয়ন ও হকার্স ইউনিয়ন ছিলো একজোট। তারা একযোগে ঘুরে দাঁড়ালে কেবল মালিক-কর্তৃপক্ষই নয়, কেঁপে উঠতো সরকারের তখতে-তাউসও। ১৯৯০ সালের ২৬ নভেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ জরুরী অবস্থা জারি করলে তার প্রতিবাদে সাংবাদিক ইউনিয়ন সারা দেশে সকল সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থা বন্ধ করে দেয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য। সরকার ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা কৌশল অবলম্বন করেও সুদূর মফস্বলেরও কোনো পত্রিকা প্রকাশ করতে পারেনি। সরকারের খবর জানে না দেশের মানুষ, দেশের মানুষের খবর জানে না সরকার। অন্ধকারে খাবি খেতে খেতে এরশাদ সরকারের পতন হলে ছয় দিন পর পত্রিকা আবার আলোর মুখ দেখে। রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের ফিনিশিং টাচ ঘটে এমনিভাবেই। ওই সময় জাতীয় প্রেস ক্লাব পরিণত হয়েছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে, যে কারণে তখন প্রেস ক্লাবকে বলা হতো 'গণতন্ত্র স্কয়ার'। সকাল-বিকাল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ছাত্র ও পেশাজীবী নেতারা হাজির হতেন প্রেস ক্লাব চত্বরে। সাংবাদিকরা সংবাদপত্র প্রকাশনা বন্ধ করে দিলে সে ভিড় আরো বেড়ে যায়, প্রেস ক্লাবের চত্বর ও সামনের রাস্তা মুখরিত হয়ে উঠে জনসমাগমে। সেদিন অনেক নেতানেত্রীই আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্যাপকতা জনগণকে অবহিত করার জন্য পত্রিকা পুণঃপ্রকাশের জন্য যুক্তিতর্ক হাজির করেছিলেন, কিন্তু আমরা এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত সিদ্ধান্তে ছিলাম অনড়। এরশাদের পতনের পর ছাত্রদের একটা বিরাট মিছিল ছুটে গিয়েছিলো দৈনিক ইনকিলাব-ভবন অভিমুখে হামলার জন্য। কিন্তু আমরা কয়েকজন তার আগেই হাজির হয়ে তাদের বিরত করি। অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বির্তক চলছিলো, তখন প্রেস ক্লাবে ছাত্রনেতাদের কাছে আমরাই প্রধান বিচারপতির নাম প্রস্তাব করেছিলাম।

কিন্তু এক-এগারোতে জরুরী অবস্থা জারি করা হলে বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়ন তার প্রতিবাদে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। সাংবাদিকরা বিভক্ত থাকার ফলে প্রায় সব সংবাদপত্রের সম্পাদক ও অনেক সাংবাদিক এক-এগারোর সুশীল-সামরিক অভ্যুত্থানের সমর্থনে অনৈতিকভাবে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করে। তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে সাংবাদিকদের একটা অংশও। এক-এগারোর সরকারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হওয়ার ফলে তাদের ভূমিকা ছিলো গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী। অগণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে তাদের এ সহযোগিতার ভূমিকা সাংবাদিকদের সংগ্রামী ঐতিহ্যে কলঙ্ক লেপন করেছে। আমার মনে আছে, আমি তখন 'আমার দেশ'-এর সম্পাদক, বেগম খালেদা জিয়ার একটি বিবৃতি প্রকাশের পরদিন (যা দৈনিক দিনকাল ছাড়া আর কোনো পত্রিকা প্রকাশ করেনি) আমাকে ও চীফ রিপোর্টারকে ডিজিএফআই অফিসে তলব করা হয়। দীর্ঘক্ষণ আমাদের interrogate করা হয়। Interrogation-এর পালা শেষ হলে ডিজএফআইয়ের আরেক কর্মকর্তা আমাকে তার কক্ষে চা-পানের আমন্ত্রণ করেন। আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে তিনিই জানালেন, 'আপনি ছাড়া সব সম্পাদকই আমদের অফিসে নিয়মিত আসেন, যোগাযোগ করেন। ঠিক আছে, আপনি যোগাযোগ না করলে আপনার সঙ্গেঁ আমরাই যোগাযোগ রাখবো।' সাংবাদিকদের একটা অংশ আগ বাড়িয়ে ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনকে সহযোগিতা করেছে। জেনারেল মইনউদ্দিন সম্পাদকের যে বৈঠক করেছিলেন, তার পক্ষে তাতে সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তিনি অবশ্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বিনয়ের সঙ্গে, কারণ ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিন সরকারের ব্যাপারে 'আমার দেশ' এর ভূমিকা তার অজানা ছিলো না। 'আমার দেশ' ও 'বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম' ছাড়া আর একমাত্র 'নিউ এইজ'ই (New Age) ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিন সরকারের তলপিবাহকের ভূমিকা পালন করেনি। আরেকদিনের ঘটনা। ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন তখন উপদেষ্টা হিসেবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। সম্পাদকদের বৈঠক ডেকেছেন। মইনুল হোসেন অল্পেই উত্তেজিত হয়ে যান। তার খবরদারিসুলভ বক্তব্যের এক পর্যায়ে মাহফুজ আনাম চটে যান। টেবিল চাপড়িয়ে মাহফুজ আনাম বলতে থাকেন, 'এই সরকার আমরা এনেছি। আপনি কে?' তার কথা শুনে আমরা সবাই স্তম্ভিত, নীরব। একমাত্র 'প্রথম আলো'র সম্পাদক মতিউর রহমান তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে উম্মা প্রকাশ করলেন।

রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লন্ডভন্ড অবস্থা। বাজারে নানা গুঞ্জন, নানা গুজব। তিনি যেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন সেদিন আমিও বঙ্গভবনে উপস্থিত ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফয়েজ আহমদকে বললাম, ইয়াজউদ্দিন স্যার মারাত্মক ভুল করলেন। উপাচার্য ফয়েজ আমার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করলেন, বললেন, স্যার কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেন না। পরে শুনেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার ব্যাপারে ফয়েজ আহমদও তাকে উৎসাহিত করেছিলেন। ওই অস্থির সময়ে ইয়াজউদ্দিন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করা কতো বড় ভুল ছিলো, তার খেসারত এখনো কেবল বিএনপিকে নয়, দেশের মানুষকেও দিতে হচ্ছে।

কয়েকদিন আগে প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান মেজর জেনারেল আমজাদ হোসেন খান ইন্তকাল করেছেন। এরশাদের সামরিক সরকারের প্রথম দিকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। তখন তিনি সম্ভবত প্রেসিডেন্ট এরশাদের পিএসও অথবা মিলিটারি সেক্রেটারী। যতোদূর মনে পড়ে সাংবাদিক ইউনিয়ন ওই সময় কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে। এরশাদ ইউনিয়ন নেতাদের ডাকলেন তার অফিসে। তার অফিসে হাজির হলাম আমরা চারজন–হুমায়ুন ভাই (বিএফইউজের সভাপতি আহমেদ হুমায়ুন), জাহিদ ভাই (ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আনোয়ার জাহিদ), রিয়াজ ভাই (বিএফইউজের মহাসচিব রিয়াজউদ্দিন আহমদ) ও আমি (ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক)। এরশাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে জেনারেল আমজাদ তার অফিসকক্ষে আমাদের ডাকলেন চা খেতে। আলোচনার মাঝখানে জেনারেল
আমজাদ একটা প্রসঙ্গে তুলতেই আমি তাকে মুখের উপর জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে এব্যাপারে নির্দেশটা আপনিই দিয়েছিলেন? জেনারেল অপ্রস্তুত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য চুপ মেরে গেলেন। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আর তিন নেতাও বিব্রত। চায়ের ধোঁয়ার ভ্যাপসা ছাপ যেন পড়েছে তাদের চোখে-মুখে। তার অফিসকক্ষ থেকে বের হয়ে যখন বারান্দা দিয়ে ফিরছি তখন হুমায়ুন ভাই গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, কবীরকে নিয়ে কোথাও যাবে না। ঢাকা সাংবাদিক ইউয়িন ওই সময় বিএফইউজের সবচেয়ে শক্তিশালী অঙ্গসংগঠন, তদোপরি প্রতিনিধিত্ব করে কেন্দ্রে অবস্থিত জাতীয় দৈনিক ও সংবাদ সংস্থাগুলোর সাংবাদিকদের। সুতরাং আমাকে ছাড়া কোনো দেনদরবারে যাওয়া ছিল অসম্ভব। এরশাদের আমলে এমনি আরেকবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় তাদের। ১৯৮৬ সাল। দৈনিক দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। ওদিকে সার্ক সম্মেলন আসন্ন। সব সদস্য দেশের সরকার প্রধানরা যোগ দেবেন। গণতন্ত্র হত্যা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার টুটি চেপে রাজত্ব করছেন এরশাদ। তার এ বদনাম বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে। তাই সম্মেলনের পূর্বেই দৈনিক দেশ-এর প্রকাশনার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য আমাদের আলোচনায় ডাকলেন। তিন নেতাই রাজি, কিন্তু আমি শর্ত দিয়ে বসলাম আলোচনা হবে সম্মেলনের পরে, কেননা এরশাদ যাতে বড়াই করে সার্ক নেতাদের সামনে বলতে না পারেন যে তার দেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর কোনো বিধিনিষেধ নেই। প্রতিদিন কয়েকবার টেলিফোন করে তোয়াব ভাই (বর্তমানে দৈনিক জণকণ্ঠ-এর উপদেষ্ঠা সম্পাদক তোয়াব খান তখন প্রেসিডেন্ট এরশাদের প্রেস সেক্রেটারি) ও তথ্যসচিব এবিএম গোলাম মোস্তফা আমার উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। আমি ওই সময় New Nation-এর চীফ রির্পোটার। বললাম, সার্ক সম্মেলন কভারে ব্যস্ত আছি, সম্মেলনের পরে আলোচনা হবে। আলোচনা সম্মেলনের পরেই হলো। আমার শর্ত ছিলো আলোচনায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ ও আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ উপস্থিত থাকবেন না, কোনো টিভি কভারেজ (তখন কেবল বিটিভি ছিলো) হবে না এবং আমাদের সঙ্গে আলোচনার উল্লেখ না করে সরকার সরাসরি দৈনিক দেশ-এর প্রকাশনার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবে। বিকেলের দিকে কর্ণেল শাহাবউদ্দিন তার প্রাইভেট কারে নিজে ড্রাইভ করে আমাদেরকে প্রেস ক্লাব থেকে ক্যান্টনমেন্টে এরশাদের বাসায় নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখি এরশাদ একাকী লনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। শর্ত অনুসারেই সবকিছু হলো। পরের দিন ছোট্ট এক প্যারার নিউজে 'দৈনিক দেশ'-এর প্রকাশনার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হলো। আরেকটি মজার ঘটনা ঘটেছিলো, যা আমানউল্লাহ ভাই (বাসস-এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক) নিজে আমাকে বলেছেন। সরকার বাসস-এর নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক নিয়োগ দেবে। তোয়াব ভাই নাম প্রস্তাব করলেন আমানাউল্লাহ ভাইয়ের। এরশাদ নাম দেখে চমকে উঠলেন। তোয়াব ভাইয়ের দিকে চোখ তুলে বললেন, এ তো Holiday-তে আমার বিরুদ্ধে লেখে। নাম বিভ্রাট। New Nation-এর মালিক কর্তৃপক্ষ আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, Holiday-তে আমি নিজের নামে লিখতে পারবো না। তাই শুধু আমানুল্লাহ নামে লিখতাম। আমানউল্লাহ ভাইকে সশরীরে হাজির করলে এরশাদের সেই বিভ্রান্তি কেটে যায় এবং তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।

কোন ইস্যুতে সেদিন আমরা বিক্ষোভ করেছিলাম তা সঠিক মনে নেই। একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। ট্রাস্টের দুটি দৈনিক–দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমস এবং দুটি সাপ্তাহিক –বিচিত্রা ও আনন্দ বিচিত্রা-বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে প্রায় সাত-আটশ' সাংবাদিক, কর্মচারী ও শ্রমকি বেকার হয়ে পড়েছে।
শেখ হাসিনা প্রেস ক্লাবে আওয়ামী লীগ-সমর্থক ইউনিয়নের একটা কনফারেন্সে এসেছেন। অডিটরিয়ামে কনফারেন্স। একদিকে অডিটরিয়ামে কনফারেন্স চলছে, অপরদিকে প্রেস ক্লাবের গেইটের মুখে মাইক লাগিয়ে আমরা ১৫/২০ জন শ্লোগান দিচ্ছি ও বিক্ষোভ করছি। আমাদের বিক্ষোভে পুলিশ বা দলীয় কর্মীরা বাধা দেয়নি। বিক্ষোভ শেষে ক্লাবের ভেতরে বসে আমরা চা খাচ্ছি। ইতিমধ্যে দুপুরের দিকে কনফারেন্স শেষ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা ক্লাবের লাউঞ্জে ঢুকলেন। ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন। আমার টেবিলে এসে আমাকে লক্ষ্য করে স্বভাবসূলভ হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, 'আমার উপর এতো রাগ কেন? একদিন আমার অফিসে আসেন।' তারপর কাকে যেন বললেন, ওনাকে আমার অফিসে নিয়ে আসবেন। পরে আমাকে কেউ আর বলেননি, আমারও যাওয়া হয়নি।

দ্বিতীয়বার বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমাকে বাসস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমাকে বললেন নাজিমউদ্দিন মোস্তানের (প্রয়াত, ইত্তেফাক-এর সাবেক চীফ রিপোর্টার। অত্যন্ত মেধাবী সাংবাদিক) সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তাকে প্রেস ইনন্টিটিউটের মহাপরিচালক করবেন। স্ট্রোক করার পর মোস্তানের বাম হাত অবশ হয়ে গেছে। ইত্তেফাক থেকে অবসর নিয়ে বাসায়ই থাকেন, তবে এক-আধটু চলাফেরা করতে পারেন। পেশাজীবনের প্রথম দিকে মোস্তান ও আমি একটি বাংলা দৈনিকে কিছুদিন একসঙ্গে কাজ করেছি। আমার খুব ঘনিষ্ট। মোস্তানকে টেলিফোনে বেগম খালেদা জিয়ার ইচ্ছার কথা জানালে তিনি সরাসরি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। খালেদা জিয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে আন্দোলনের সময় তার সঙ্গে মোস্তানের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। প্রথম যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি কিছুদিন সচিবালয়ে অফিস করেছেন। একদিন তিনি লিফট থেকে নেমে বারান্দা দিয়ে হেঁটে অফিসকক্ষে ঢুকতে যাচ্ছেন। এমন সময় মোস্তান এগিয়ে গিয়ে তাকে বললেন, 'ম্যাডাম, একটু জরুরি কথা আছে।' খালেদা জিয়া অনেকটা বিরক্তির সঙ্গে বললেন, 'পরে আসেন।' আমি পাশেই ছিলাম। মোস্তান দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে মুখ ফিরিয়ে হন-হন করে চলে গেলেন। মোস্তান ছিলেন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ মানুষ। আমি স্পষ্টই বুঝতে পারলাম মোস্তান আর কখনো খালেদা জিয়ার দিকে ফিরে তাকাবেন না। হয়েছিলও তাই। মোস্তানদের মতো নিবেদিত সাংবাদিকরাই একদিন খালেদা জিয়ার নামের আগে 'আপসহীন নেত্রী' কথাটা যোগ করে দিয়েছিলেন।

ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই নেত্রীকে দেশছাড়ার আয়োজন করছে। শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই বিদেশে। হুমকি-ধমকি সত্ত্বেও খালেদা জিয়া দেশ ছাড়ছেন না। বললেন, দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। কিন্তু ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিন পণ করেছেন তাকে দেশছাড়া করতেই হবে। কাওরান বাজারের আমার দেশ অফিস পুড়ে গেছে, আমরা অফিস করি তেজগাঁও প্রেসে। একদিন সন্ধ্যায় চীফ রিপোর্টার আবদাল আহমদ (প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক) হন্তদন্ত হয়ে এসে আমাকে জানালো, 'ম্যাডামের বাসায় সেনাবাহিনীর লোকজন ঢুকেছে, আজ রাতেই তাকে একটা ফ্লাইটে তুলে দেয়া হবে। জিনিষপত্র সব প্যাকআপ করা হচ্ছে।' বাসার সব লোকজন বের করে দেয়া হয়েছে, ফোনে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করে অবশেষে বাড়ির কেয়ারটেকারকে ধরা গেলো। তাকেও গেইটের বাইরে বের করা দেয়া হয়েছে। আমাদের পীড়াপীড়িতে সে কিভাবে বাসার ভেতরে ঢুকে খালেদা জিয়ার হাতে তার মোবাইল ফোনটি ধরিয়ে দিলো। আমি কথা বললাম। ফোন ধরে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, 'আপনার বন্ধু মান্নান ভুঁইয়াই তো এজন্য দায়ী। ওরা কেউ আমার খোঁজ রাখে না, কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে না।' তারপর কান্নাভেজা কণ্ঠে আরো কিছু বললেন। আমি তাকে সান্তনা দিয়ে বললাম, 'ম্যাডাম, ওরা যতো জোরাজুরিই করুক, আপনি কিছুতেই দেশ ছেড়ে যাবেন না। জনগণ আপনার পাশে আছে।' ম্যাডাম যেন ভরসা পেলেন। একটু থেমে বললেন, 'ঠিক আছে, আমি দেশ ছেড়ে যাবো না। কপালে যা-ই ঘটুক।' এরপর টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শত চেষ্টা করেও আর ধরতে পারিনি। সম্ভবত সেনাবাহনীর উপস্থিত লোকজন টের পেয়ে মোবাইল ফোনটি তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো। মনে হয়, ওইটিই ছিলো তাকে শেষ কল, এরপর খালেদা জিয়ার সঙ্গে আর কারো যোগযোগ হয়নি। তবে ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের চক্রান্ত পণ্ড হয়ে গিয়েছিলো। খালেদা জিয়া দেশ ছেড়ে যাননি। পরে শেখ হাসিনাও দেশে ফিরে আসেন। তার ওই সাহসী সিদ্ধান্তের কারণেই ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের কপাল পুড়েছিলো, সাধের রাজত্ব সংক্ষিপ্ত করে দেশ ছাড়তে হয়েছিলো তাদেরই।