রোদ্দুরের আয়োজনে কবিদের আড্ডা

admin
Published : 12 Sept 2008, 01:41 PM
Updated : 12 Sept 2008, 01:41 PM

১৯৯৫ সালে ছোটপত্রিকা রোদ্দুর-এর সম্পাদক লতিফ সিদ্দিকী কয়েকজন কবিকে নিয়ে জুন মাসের এক

……..
রোদ্দুরের সম্পাদক লতিফ সিদ্দিকী
…….
সকালবেলায় একটি আড্ডা বসিয়েছিলেন গ্রীন রোডের থিয়েটার সেন্টারে। "প্রজন্মান্তরে কবিতার বদল" — এই ছিল আড্ডার আলোচনার বিষয়। আড্ডার ধর্মানুসারে ফ্যামিলি প্ল্যানিং, আমলা কবি, কবিতার ক্ষতি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, আবুল হাসান, পঞ্চাশ, ষাট, কবিতার জনপ্রিয়তা কেন কমে যাচ্ছে… ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ চলে আসে আলোচনায়। প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যে টিনের চালের নিচে আড্ডা চলে দুপুর পর্যন্ত। উল্লেখ্য, সে আড্ডার তিনজন এখন আর নেই। লতিফ সিদ্দিকী মারা গিয়েছিলেন ক্যান্সারে। পরে কবি আবু কায়সার এবং কবি শামসুর রাহমানও মারা যান। তাঁদের স্মরণে রেখে আড্ডাটি পুনঃপ্রকাশিত হলো। শুরুতে লতিফ সিদ্দিকীর ভূমিকা।

অংশগ্রহণ: শামসুর রাহমান, আবু কায়সার, আলতাফ হোসেন, সাজ্জাদ শরিফ, আনিসুল হক, ব্রাত্য রাইসু, আদিত্য কবির, হুমায়ূন রেজা

সম্পাদক লতিফ সিদ্দিকীর ভূমিকা
ইংরেজি ১৬ জুন ছিল বাংলায় ২ আষাঢ়। সকাল থেকেই আকাশ অন্ধকার। গ্রীণ স্কোয়ারে থিয়েটার সেন্টারের মিলনায়তনে রোদ্দুরের আয়োজনে


……..
রোদ্দুর, চতুর্থ সংখ্যা, জুলাই ১৯৯৫
………
কবিদের আড্ডা। রোদ্দুরের সম্পাদক হিসেবে আয়োজনের দায়িত্ব আমার। শান্তিনগর (বাসা) থেকে রিকশায় চেপে শিল্পকলা একাডেমী পর্যন্ত যেতেই শুরু হলো বৃষ্টি। শিশু পার্কের কাছাকাছি পৌছুতেই কানফাটানো শব্দে বাজ পড়লো কোথাও একটা। সেই সঙ্গে শুরু হলো প্রবল বর্ষণ। থিয়েটার সেন্টার যথারীতি তখনো কেউ আসেননি। এমন আবহাওয়ায় কেউ যে আসবেন সেরকম ভরসা পাই না। এসময় অলকদা (অলক গুপ্ত, নাট্যকর্মী, সাংবাদিক) আসেন। খানিক বাদে আসেন আলতাফ ভাই। আস্তে আস্তে সবাই আসেন, কেবল সিকদার আমিনুল হক ছাড়া। আড্ডায় সেদিন। যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের নাম ওপরে দেওয়া হলো। এরা ছাড়াও আড্ডায় যারা উপস্থিত ছিলেন কিন্তু আলোচনায় অংশ নেননি তারা হলেন। দিলওয়ার হাসান (গল্পকার), মুনির রানা (কবি, সাংবাদিক) ও আবেদীন চৌধুরী স্টিভ। আড্ডায় সূত্রধরের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে আমাকে।

●●●

লতিফ সিদ্দিকী: রাহমান ভাই বয়োজ্যেষ্ঠ। জীবিতদের মধ্যে প্রবীণতম সম্ভবত।

আবু কায়সার: উহু, আবুল হোসেন আছেন।

লতিফ: না, আবুল হোসেন ঠিক ততোটা সক্রিয় নন কবিতা রচনায়।

কায়সার: বলুন যে রাহমান ভাই হলেন প্রবীণদের মধ্যে সবচেয়ে গ্ল্যামারাস।

লতিফ: সে যাই হোক, রাহমান ভাইরা তাদের সময়ে যেভাবে লিখতেন, এখনকার কবিরা সেভাবে লেখেন না। কবিতার ধারার পরিবর্তন হয়েছে, কবিতা সম্পর্কে কবিদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হয়েছে।

ব্রাত্য রাইসু: এটা কি আপনি ধরে নিয়ে কথা বলছেন?

লতিফ: হ্যাঁ।

রাইসু: রাহমান ভাইদের সময়েও তো সবাই একরকম লিখতেন না।

লতিফ: যা হোক, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তো কবিতা বদলায়, কবিতার কাঠামো বদলায়, কবিতায় বলবার বিষয় বদলায়। আজকের মুক্ত আলোচনার বিষয় এটাই। এই পরিবর্তনটা। পরিবর্তনের ধরনটা — এক প্রজন্মের কবিতা আরেক প্রজন্মের চোখে, নিজেদের কবিতা নিজেদের চোখে।

সাজ্জাদ শরিফ: তাহলে শুরু করা যাক। রাহমান ভাইকে দিয়ে শুরু করুন। প্রশ্ন করুন তাঁকে।

লতিফ: সেই পঞ্চাশের দশক থেকে এখনও পর্যন্ত ক্লান্তিহীনভাবে লিখে চলছেন রাহমান ভাই। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আপনার নিজের কবিতাও বদলেছে। সেই পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে বলুন। এখনকার কবিতাই বা কেমন ঠেকছে আপনার চোখে?

শামসুর রাহমান: প্রথমত, কবিতা সম্পর্কে কিছু বলা অত্যন্ত কঠিন। এ সম্পর্কে এতো কথা বলা হয়, কিন্তু এখনো ঠিক কবিতা কাকে বলা হয়, মানে এর এবিসিডি কখগঘঙ — আমি বলতে পারবো না। তবে কবিতা আসলে বোধের ব্যাপার। একে সংজ্ঞা দিয়ে বোঝানো মুশকিল। আরেকটা জিনিস আমি বিশ্বাস করি না — কবিদের দশকবন্দি করাটা, এই যেমন অমুক কবি এই দশকের। কবি যিনি, তিনি সব দশকেরই। রবীন্দ্রনাথকে আমরা কোন দশকের কবি বলবো? তেমনি ত্রিশের কবি আমরা যাদের বলি, তারা তো এখনো সক্রিয় কোনো না কোনোভাবে — এমনকি তাদের মৃত্যুর পরও। কাজেই দশকের ব্যাপারটা ঝুট-ঝামেলার। তবু সমালোচকদের সুবিধা হয় কারো গায়ে একটা লেবেল এঁটে দিতে পারলে। অনেক সময় বলা হয়, এরা এই ধারার কবি, এদের কবিতায় রিরংসা আছে, এদের কবিতায় বিপ্লব আছে। বিষ্ণু দেকে বলা হয় মার্ক্সিস্ট ধারার কবি। কিন্তু তিনি তো এমন অনেক কবিতাও লিখেছেন, যা মার্কসীয় ধারায় পড়ে না। তিনি প্রেমের কবিতা লিখেছেন, নিসর্গের কবিতা লিখেছেন, বিদ্রোহের কবিতাও লিখেছেন।

আমরা আমাদের কথা বলতে পারি। পঞ্চাশের দশকে আমরা যাখন লিখতে শুরু করি, তখন এখানে এই ঢাকায় — ঢাকায় মানে বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ববাংলায় — পাকিস্তান হবে হবে অবস্থা। অবশ্য আমি লিখতে শুরু করি পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে, ১৯৪৮ সাল থেকে। পাকিস্তান তখন একটা নতুন রাষ্ট্র, ভুল হোক যাই হোক তখন তার একটা উন্মাদনা ছিল। সে উন্মাদনা কবিদের মধ্যেও সঞ্চারিত ছিল। মানে যারা আমাদের অগ্রজ কবি ছিলেন সে সময়ে তাদের মধ্যে। কারো কারো মধ্যে একটু বেশি, আবার কারো মধ্যে স্তিমিতভাবে। আমরা যখন লিখতে শুরু করলাম আমাদের ভেতর এটা ছিল না। আমাদের মনে হয়েছে, হয়তো ঠিক সজ্ঞানে নয় সচেতনভাবে নয় — বিশেষত আমি খুব সচেতন ছিলাম না — কিন্তু এই কবিতা ঠিক আমার কবিতা নয়, এরকম ধারণা আমার ভেতর জন্মেছিলো। অবশ্য আমার যারা সর্তীর্থ ছিলেন সে সময় — হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আলাউদ্দিন আল আজাদ।

সাজ্জাদ: আল মাহমুদ?

রাহমান: না, আল মাহমুদ তখনো আসেননি। আল মাহমুদ আর শহীদ কাদরী আরো পরে এসেছেন, সৈয়দ শামসুল হকও পরে এসেছেন। তখন আমাদের মনে হতো এরকম যে এটা নট আওয়ার কাপ অফ টি। সুতরাং আমাদের লেখা অসচেতনভাবেই আমাদের মতো হয়ে ওঠে। কী বলবো যে, আমরা কিন্তু কোমর বেঁধে কারো বিরুদ্ধে লাগিনি যে এর বিরুদ্ধে লিখতে হবে। আমরা নিজেদের কথা, পারসোনাল ফিলিংস লেখার চেষ্টা করেছি। আমাদের ওপর পূর্ববর্তী কবিদের প্রভাব ছিল। এটা অস্বীকার করার কোনো যো নেই। আর সেই প্রভাবটাকে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেবো এমন কোনো প্রতিজ্ঞাও আমরা করিনি। আমরা ভেবেছি আমাদের আকাক্সক্ষা, আমাদের আবেগ, আমাদের স্বপ্ন আমরা যেভাবে প্রকাশ করতে চাই সেভাবে করবো।

আমাদের পরে যারা এলেন — খুব বেশি পরে নয় — তারা হলেন আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী আর এদের কিছুটা আগে সৈয়দ হক। তখন অলরেডি আমাদের মধ্যে একটা আন্দোলনের মতো শুরু হয়ে গেছে। আমি বলি পঞ্চাশের দশক হলো সবচেয়ে নীরব দশক, নীরব বংশ। এসময়ের কবিরা নিজেদের ঢোল পেটায়নি। আমরা এ করবো সে করবো — এরকম করে কিছু এরা বলেনি। আমরা লিখে গেছি বিনীতভাবে। আমরা আগের কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র কিছু করেছি বলে আমার বিশ্বাস। তবে তা কতটুকু সফল বা ব্যর্থ, তা পাঠকরা বিবেচনা করবেন। এইভাবে আমাদের যাত্রা শুরু। আমি এখনো লিখে যাচ্ছি। কখনো কখনো মনে হয় যে আমার ঠিক কিছু হচ্ছে না — আমার নিজের কাজ নিজের কাছে গ্রাহ্য হচ্ছে না, কারো কারো কাছে হয়তো গ্রাহ্য হচ্ছে। এখনো আমার কবিতা হয়তো কারো কারো কাছে ভালোও লাগে। অনেকে হয়তো অবহেলা করেন, তুচ্ছ মনে করেন। এটা হয়-ই। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে পরের প্রজন্মের কবিদের লেখা সবসময় মনোযোগ দিয়ে পড়ি। যতোটা সাধ্যে কুলোয়।

আমি ভেবেছিলাম, একজন প্রকৃত কবির জীবন যাপন করবো। কবিতার বাইরে আর কোনো আকর্ষণ আমার থাকবে না। কবিতাই হবে আমার ধ্যান, কর্ম — সব কিছু। এরকমই আকাঙ্ক্ষা ছিল। তবে ভাবনাটা একটু দেরিতে এসেছিল। তার আগেই আমি এমন কিছু কাজ করে ফেলেছি, যার জের আমাকে এখনো বহন করতে হচ্ছে। আমিও…

সাজ্জাদ: বিয়ে করে ফেলেছেন?

রাহমান: হ্যাঁ, মাত্র ২৭ বছর বয়সে বিয়ে করে ফেলেছি। বিয়ে করাটা — কী বলবো — ঠিক দোষণীয় কিছু নয়। অনেকেই বিয়ে করেন।

সাজ্জাদ: একাধিকও করে কেউ কেউ।

রাহমান: হ্যাঁ, প্রাচ্যেও করেন, পাশ্চাত্যেও করেন। আবার এও দেখা যায়, কোনো কোনো কবি বিয়ে করেন না। এখন, তারা ঠিক দৈহিক কারণে করেননি নাকি অন্য কারণে — বলতে পারবো না।

কায়সার: অনেকে তো আবার একটা ছাড়েন আরেকটা করেন।

রাহমান: তা আমি বলতে চাইছি না। এটা যার যার ইচ্ছের ব্যাপার। বিয়ের কথাটা আমি এজন্যই বললাম যে একজন মানুষের জীবনে এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, মূল সিদ্ধান্ত। আপনি একজন মহিলাকে বিয়ে করলেন, করার পর তার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। আমাকে যেমন নিতে হয়েছে আমি যে কালে বিয়ে করি তখন সমাজটা এরকম ছিল না যে স্বামী চাকরি করছেন স্ত্রীও চাকরি করছেন। আমি একটা বড় রিস্ক নিয়েছি না জেনে না বুঝেই। আমার সিদ্ধান্তটা …

সাজ্জাদ: ভুল সিদ্ধান্ত?

রাহমান: ভুল। আসছি সে কথায়। যেহেতু আমি একজন প্রকৃত কবির জীবন যাপন করতে চেয়েছিলাম, কাজেই বিয়ের সিদ্ধান্তকে আমি মনে করি ভুল ছিল। তবে আমাদের সমাজে নানা কারণে বিয়ে মানুষ করে। তো, এর ফলে হয়েছে কী, আমাকে চাকরি করতে হয়েছে, যা না করলেও পারতাম। আমি হয়তো ব্রাত্য রাইসুর মতো জীবন যাপন করতে পারতাম — এই যেমন আমাকে কারো ভরণপোষণ করতে হবে না, আজ এখানে তো কাল সেখানে, পরশু ফুটপাতে গিয়ে শোবো — এই সব। এসব করতে হয়নি আমাকে। যা করতে হয়েছে তা হলো — এই জোয়াল আজ পর্যন্ত বহন করতে হচ্ছে। তারপর সন্তান হলো। সন্তানের বিয়েটিয়ে। আমাদের সময়ে, আমি ঠিক ফ্যামিলি প্ল্যানিং যেটাকে বলে, তা করিনি।

কায়সার: আপনি তো তবু বিচক্ষণ বলতে হবে। কোনো কোনো কবির তো শুনি ১০টা ১৫টা সন্তান।

রাহমান: যা-ই হোক। একজন মানুষ যদি সৎ হয়, তাহলে তার পরিবারের প্রতি অবিচার করতে পারে না।

আলতাফ হোসেন: আপনি কি এখানে উপস্থিত অবিবাহিত তরুণদের বিয়ে না করার পরামর্শ দিচ্ছেন?

রাহমান: না, আমি তো নিজেই করেছি বিয়ে। কাজেই না করার পরামর্শ কী করে দেই। আমি বলছি যে প্রকৃত কবির জীবন হলো এমনই একটা জীবন — সেটা কাম্য কি কাম্য নয় তা ভিন্ন প্রশ্ন — যা ডিমান্ড করে ত্যাগ। যে ত্যাগ অবশ্য সজ্ঞানে আমি করিনি। অজ্ঞানেই করে ফেলেছি। ত্যাগের প্রশ্নটি খুবই ভাইটাল। পরে তো আমাকে কাজ করতে হয়েছে ছেলের জন্য, মেয়ের জন্য, মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে সেজন্য। আরো একটা ট্রাজেডি আছে — আমি প্রায় সারাটা জীবন কাজ করলাম সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায়। এটাও একটা দুর্ঘটনার মতোই। আমার বিয়ের সময়, এমনকি প্রথম সন্তানের জন্মের সময়ও আমার চাকরি ছিল না। এতদিন পর্যন্ত যে আমার পিতা সহ্য করেছেন স্ত্রীপুত্রসহ আমাকে — সেজন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।

তো, সেটা ছিল আ সিরিজ অফ ডিজ্যাসটারস। যেভাবে চেয়েছিলাম জীবনটাকে, সেভাবে সাজাতে পারলাম না। যে জীবন যাপন করলাম, তা আমার নয়, আমার কাম্য নয় — অনেস্টলি স্পিকিং, এর মধ্যে কোনো ভণ্ডামি নেই, শঠতা নেই। ফলে, যতোটা সময় কবিতাকে দেওয়া উচিত ছিল, তা দিতে পারিনি সাংসারিক কারণে।

সাজ্জাদ: তার মানে আরো কবিতা লিখতেন? এমনিতেই তো রবীন্দ্রনাথের পর সম্ভবত আপনিই, কবিতার সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে অগ্রসর কবি।

রাহমান: কী জানি, হয়তো আরো বেশি লিখতাম, হয়তো নয়।

আনিসুল হক: আপনি যদি বিয়ে না করতেন এবং এ বয়সে আসতেন, তাহলে আপনার মনে হতো বিয়ে করলে খুব ভালো করতাম।

রাহমান: প্রকৃত কবির জীবনের ধারণা লাভের ব্যাপারে আমরা সবসময় অগ্রজ কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হই। যেমন বোদলেয়ার…।

সাজ্জাদ: র্যাঁবো…।

রাহমান: রাইনার মারিয়া রিলকে…।

রাইসু: অথবা রবীন্দ্রনাথের মতোও করা যায়। বউ রেখে ঘোরাঘুরি করা যায় পদ্মায়।

আনিসুল: রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মারা গেছেন রবীন্দ্রনাথের বহু বছর আয়ু থাকতেই।

রাহমান: রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী খুব বিবেচক ছিলেন। আমার ধারণা, আগে মারা গিয়ে তিনি খুব সুবিবেচনার কাজ করেছেন। (এসময় উচ্চরবে হেসে ওঠেন আড্ডার সবাই। টিনের চালায় প্রবল বৃষ্টিপাতের শব্দকে হার মানায় সে সজোর হাসির কোরাস। আর মৃদুভাষী শামসুর রাহমানের একটা দুটো বাক্য হারিয়ে যায় সে শব্দতরঙ্গে) আমার কথাটা হয়তো নিষ্ঠুর শোনালো।

তো, যাই হোক, বিবেচক ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী, স্বামীকে তিনি একা রেখে গেছেন। তবু রবীন্দ্রনাথ তার সন্তানের মৃত্যুর শোক সহ্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো এত শোক আর কোনো বাঙালি কবিকে সইতে হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই।

সাজ্জাদ: স্ত্রী মৃত্যু নিয়ে কোনো শোক তাঁর কোনো লেখায় আমি দেখিনি।

কায়সার: পারিবারিক অশান্তি তাঁকে কম কষ্ট দেয়নি। মেয়ের বিয়ের পর এক জামাই তাকে খুব কষ্ট দিয়েছে।

রাহমান: হ্যাঁ, জামাই তাঁকে খুব কষ্ট দিয়েছে।

কায়সার: রবীন্দ্রনাথকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে জামাইয়ের কাছে।

রাহমান: যাহোক এ ব্যাপারে শেষ কথা যেটা বলতে চাই — অবশ্য শেষ কথা বলে কোনো কথা নেই — একজনের জীবন আরেকজনের হয় না। আমরা যারা এখানে বসে আছি, আমাদের প্রত্যেকেরই জীবন যার যার মতো। আমি ব্রাত্য রাইসুর মতো হতে চাইলেই হতে পারবো না, সেও পারবে না আমার মতো হতে। কাজেই আমি আমার বর্তমান অবস্থানকে মেনে নেই, মনে করি — যা হয়েছি এটাই হবার কথা ছিল আমার। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি আরেকবার জন্মলাভের সুযোগ পাই তাহলে কি এই জীবনটাকেই বেছে নেবো? হয়তো সবটুকু নেবো না, কিছু কিছু বিষয় নেবো। যেমন –

সাজ্জাদ: মেয়েদের সঙ্গে প্রেম।

রাহমান: হ্যাঁ, নারীর প্রতি আকর্ষণ, তারপর কবিতার সঙ্গে গেরস্থালী — এসব আমি বেছে নেবো।

কায়সার: সুরাসক্তি।

রাহমান: হ্যাঁ, অবশ্য এখন আর পারি না আগের মতো। পান করি মাঝে মধ্যে। তবে হ্যাঁ, আরেকবার জন্মলাভের সুযোগ পেলে বিয়ে টিয়ে আমি করতাম না। কোনো মহিলাকে বিয়ে করতাম না।

সাজ্জাদ: ততোদিনে পুরুষে পুরুষে বিয়ের আইন অবশ্য পাস হয়ে যেতো দেশে।

রাহমান: (উচ্চ হাসি, শামসুর রাহমানের পক্ষে যতোটা সম্ভব) না না না, ওতে আমার কোনো আগ্রহ নেই, কোনো ইন্টারেস্ট নেই।

যাই হোক, অন্য কথায় আসি। সাধারণত এরকম দেখা যায়, আগের প্রজন্মের কবিরা পরের প্রজন্মের কবিদের সহ্য করতে পারেন না। আবার ইমিডিয়েট পরবর্তী প্রজন্মের কবিরাও অগ্রজদের সহ্য করতে পারেন না। আগের প্রজন্মের কোনো কবি যদি তার সমকালবর্তী দ্বিতীয় প্রজন্মের দ্বারা গৃহীত ও পঠিত হন তো বুঝতে হবে তার ভেতর…। কেননা কেউ তো খামোখা কারো প্রচার করছে না। অনেক সময় নির্বাচন ভুল হয়, কিন্তু এই যে আকর্ষণের যে স্পৃহা এর মূল্য আছে। আমি একজন কবিকে হয়তো পছন্দ করতে পারি যিনি অতটা পছন্দ করার মতো নন। তিনটি ধারণার কথা বলা যায় — শ্রেষ্ঠ কবি, উৎকৃষ্ট কবি ও ফেভারিট কবি, প্রিয় কবি। প্রিয় কবি যে সবসময় বড়ো মাপেরই হবেন, এমন কোনো কথা নেই। একজন গৌণ কবিও আমার প্রিয় হতে পারেন।

অনেস্টলি বলি, আমি আমার পরের প্রজন্মের কবিদের কখনো শক্র মনে করি না। আমি তো এক সময় বেগম-এ প্রকাশিত কবিতাও পড়তাম। আজকাল অবশ্য পেরে উঠি না।

সাজ্জাদ: মেয়েদের কবিতা বলে?

রাহমান: না, সে জন্য না। কবি তো কবিই, মেয়ে কবি আর ছেলে কবি কী? আনফরচুনেটলি আমাদের দেশে পুরুষ কবির সংখ্যাই বেশি।

কায়সার: এই যেমন আজকের আড্ডা, নারীচরিত্র বর্জিত নাটক আর কি।

লতিফ: একজনের অবশ্য আসার কথা।

রাহমান: এটাও একটা দিক সমাজের। আমাদের সমাজে কবিতা লেখাকে এক সময় চরিত্রহীনদের কাজ বলে মনে করা হতো। এখন অবশ্য সে অবস্থা নেই। এটার জন্য, বিনীতভাবে আমি বলতে চাই, ব্যক্তিগতভাবে আমার একটা ভূমিকা আছে। কবিতা লেখাকে এখন অনেকে, এমনকি, সোশ্যাল প্রেস্টিজ বলে মনে করে। যে কারণে অনেক আমলাও কবিতা লেখেন।

সাজ্জাদ: একজন প্রেসিডেন্টও লিখতেন।

রাহমান: হ্যাঁ, আমলারা এখন আর কেবল তাদের আমলাগিরি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। কবির একটা পেখম তাদের নিজেদের পুচ্ছে লাগানো দরকার।

সাজ্জাদ: এরশাদ তো নাকি আপনার কবিতার খুব ভক্ত ছিলেন।

আনিসুল: সেটা কি কেবল প্রেস্টিজের প্রয়োজনেই? নিজেকে প্রকাশ করার আকাক্সক্ষা থেকে নয়?

রাহমান: থাকতে পারে।

আনিসুল: তাছাড়া আগের দিনের রাজাবাদশারাও কি কেউ কেউ কবিতা লিখতেন না?

সাজ্জাদ: না, সামন্ত যুগের ব্যাপারটা অন্যরকম।

কায়সার: কোথায় সেইসব রাজাবাদশা আর কোথায় একালের আমলা।

রাইসু: বাজে কবিতা লিখে যখন আমলারা প্রকাশ করে তখন বুঝতে হবে তা কোন আকাক্সক্ষা থেকে লেখা।

রাহমান: যাই হোক, আমলার কবিতা লেখার অধিকার নেই — সেটা বলছি না আমি।

কায়সার: আমলাদের মধ্যেও প্রকৃত কবি কেউ কেউ আছেন।

আনিসুল: কবিতা হয়তো ভালো হয়নি, কিন্তু মহৎ কবি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তো থাকতে পারে। আকাঙ্ক্ষার সততা থাকতে পারে।

রাহমান: আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ যেমন। তিনি আমলা হওয়ার অনেক আগে থেকেই কবিতা লিখতেন।

আনিসুল: আবার এরকমও আছে যে অনেক কিছু তো হলো — অর্থ, প্রতিপত্তি — এবার একটু কবিখ্যাতি দরকার।

রাহমান: আমার আপত্তিটা সেখানেই। যাহোক। আমি আমার পরের প্রজন্মের কবিদের এক অর্থে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। তারা আমাকে কী মনে করেন, তা অবশ্য আমি জানি না। আমি মনে করি না যে কোনো দশকই একেবারে শূন্য বা নিষ্ফলা থাকে। সবাই দাঁড়াতে পারেন না। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে যান, প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।

তবে এখন আমার যেটা মনে হয়, এখনকার কবিরা অনেক বেশি চতুর। অনেক বেশি ধান্দাবাজ। চাতুর্য এবং ধান্ধা কবিদের জন্য স্বাস্থ্যকর হতে পারে না।

সাজ্জাদ: সত্তর দশকের কিছু কবিদের ফেলা যায় এ কাতারে।

রাহমান: না, আমি নির্দিষ্ট কোনো দশকের উল্লেখ করতে চাই না।

আনিসুল: চাতুর্য থাকার পরও আপনাদের সময়কার কেউ কেউ বেশ ভালোই কবিতা লিখতেন। আমার তো বেশ ভালোই মনে হয় তেমন কবির কবিতা। কিন্তু খুব চতুর মনে হয় লোকটাকে। মনে হয় ধান্দাবাজ। কবিতা লিখে যতটুকু পাবার কথা ছিল সমাজের কাছ থেকে ঐ কবি ততটুকু পাননি — সবাই মনে করেন ও তো কবি নয়, ধান্দাবাজ।

সাজ্জাদ: কারো নাম বলতে চাই না রাহমান ভাই। আপনাদের দশকের অন্তত দুজন কবি তো ধান্দাবাজ হিসেবে খুবই পরিচিত।

রাহমান: আমার মনে হয় না তারা কবি হিসেবে উৎকৃষ্ট কিছু।

সাজ্জাদ: এদের একজনের তো কবিখ্যাতি খুবই ভালো।

রাহমান: হতে পারে।

আনিসুল: হ্যাঁ, সেটাই তো কথা, লোকেরা তাকে চতুর হিসেবেই বেশি চেনে।

রাহমান: একজন চোরও ভালো কবিতা লিখতে পারে। তবে আমার মনে হয় কবির চতুর না হওয়াই ভালো।

সাজ্জাদ: রাহমান ভাই, একটা কথা বলি। আগের প্রজন্মের কবিরা কিন্তু পরের প্রজন্মের কবিদের সম্পর্কে একটা মনোভাব সব সময়ই পোষণ করেন, তাহলো, 'এরা তো আমাদের অতিক্রম করতে পারলো না।' সাধারণ মনোভাব এটা। ব্যতিক্রম দুএকজনের বেলায় হতে পারে। যখনই নতুন কবিতার আকাঙক্ষা জন্ম নেয়, সময় তো বদলাচ্ছে, এর সঙ্গে মানুষের সংবেদনশীলতার ধরন বদলায়, মানুষের নতুন নতুন স্পৃহা জেগে ওঠে, নতুন বাস্তবতার জন্ম হয় — তখন নেচার‌্যালি কবিতা নতুনভাবে তৈরি হতে চায়। প্রত্যেকটা সময়ের কবিই সেই জিনিসটাকে ধরতে চান। কেউ সফল হন, কেউ হন না। যেহেতু বাস্তবতা বদলে যাচ্ছে, ব্যক্তি বদলে যাচ্ছে, সমাজ বদলে যাচ্ছে — কবিতা তো বদলাবেই। তখন হয় কী, আগের প্রজন্মের কবিরা বুঝতে পারেন না পরের প্রজন্মের কবিদের। এটা কিন্তু ওয়াইডলিই দেখা গেছে।

কায়সার: বুঝতে না পারাটা খুবই স্বাভাবিক।

সাজ্জাদ: যেমন রবীন্দ্রনাথকে তাঁর আগের প্রজন্মের কবিরা বলতেন পায়রা কবি। রবীন্দ্রনাথ আবার ত্রিশের কবিদের বুঝতে পারতেন না। বুদ্ধদের বসুর মতো সাহিত্যের সর্বগ্রাসী পাঠকও বলেছেন, পঞ্চাশের দশকের কবিতা বুঝতে পারছি না। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে এক প্রজন্মের কবিদের প্রতি আরেক প্রজন্মের কবিদের যে অ্যাটিচ্যুড — তা সব সময় সুখকর নয়। পরের প্রজন্মের কবিদের সম্পর্কে আগের প্রজন্মের সাধারণ মন্তব্য হলো, 'এরকম তো এক সময় আমরাও করেছি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, বয়স হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।' আর পরের প্রজন্মের কবিদের সংবেদনশীলতার চরিত যখন পাল্টে যায়, একটা বড় সময়ের ভেতর দিয়ে যখন তারা সামনে যায় — তখন আগের প্রজন্মের কবিরা যে কী স্ট্রাগলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছেন তা বিবেচনা করে না, পরিপ্রেক্ষিতটা বিবেচনা করে না। এক ধরনের নিষ্ঠুর মন্তব্য হয়তো তাদের প্রতি আসে। তো, রাহমান ভাই, পরবর্তী প্রজন্মের কবি হিসেবে আমি যেটা ফিল করি তা হলো, ত্রিশের কবিদের কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু ত্রিশের ব্যাপারে অনেক সমালোচনা আমার আছে। পঞ্চাশের কবিদের লড়াই করতে হয়েছে প্রবলভাবে। সে সময় খুবই গতানুগতিক ধাঁচের পাকিস্তানপন্থী কবিতা রচিত হচ্ছিল — এসব কবিতায় সমকালীন বাস্তবতার আকাক্সক্ষা ঠাঁই পাচ্ছিল না। ফলে, রাহমান ভাই, আপনারা কলম ধরেছিলেন, নতুন কবিতার ভাষা নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন। খুবই পজিটিভ কাজ ছিল এটা, সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে।

রাহমান: আমাদের সময়ে শুদ্ধ বাংলায় কবিতা লেখাটাও কিন্তু একটা বড় কাজ ছিল। কারণ বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে এক নজরুল ছাড়া আলোকপ্রাপ্ত তেমন আর কেউ ছিলেন না আমাদের সামনে তখন উদাহরণ হিসেবে।

সাজ্জাদ: অসম বিকাশ তো হয়েছেই।

রাহমান: যা বলছিলাম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কথা বলার মতো কোনো বাঙালি মুসলমান তাঁর সময়ে ছিল না। তো কাজেই একটা ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স আমাদের ভেতর ছিল। একারণে আমরা অনেক সময় বাড়াবাড়ি করেছি। যেমন সংস্কৃতঘেষা ভাষার অধিক ব্যবহার করেছি আমরা।

সচেতনভাবেই। এটা করেছি আমরা এজন্য যে আমাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার একটা চক্রান্ত ছিল। এই অবস্থার অবসানের পর, উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা দূর হওয়ার পর, পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি অতিরিক্ত সংস্কৃতিঘেষা শব্দ ব্যবহার কমিয়ে দেই। আমি শব্দের ভেতর বৈচিত্র্য নিয়ে আসি। ব্যবহার করি ঢাকার লোকভাষা, উর্দু বা ফার্সী শব্দ।

সাজ্জাদ: আপনি তা করেছেন রাহমান ভাই, কিন্তু সাধারণভাবে আমাদের গদ্যের যে ঢালাইটা হয়েছে তার ভিত্তি হলো ইউরোপীয় ও সংস্কৃতঘেষা ভাষারীতি। এটা কিন্তু একটা বড় ক্ষতি করেছে আমাদের বাংলা ভাষার।

রাহমান: সাজ্জাদ যেটা বললেন, এক প্রজন্মের প্রতি আরেক প্রজন্মের কবিদের মনোভাবের ব্যাপারটা। এটা খুবই ভুল মনোভাব, ক্ষতিকর এটা। কারণ আমার দাদু যে পোশাক পরতেন আমার বাবা তা পরেননি। আবার বাবা যা পরতেন আমি তা পরছি না। আমার ছেলে এরপর কী পরবে আমি জানি না। আমি লিখে দিতে পারি, যে ভাষায় আমি কথা বলি, লিখি, আমার পিতামহ বা মাতামহ সে ভাষায় কথা বলতেন না। আমার নাতনী আবার দেখা যাবে যে আমার ভাষায় কথা বলছে না। কারণ জন্মের পর থেকে সে দেখছে টিভি, বিদেশী চ্যানেলের সব প্রোগ্রাম। কাজেই তার ভাষা বদলাতে বাধ্য। হয়তো এমনও হতে পারে যে দেখা যাবে আমি তার ভাষা বুঝবো না। তাই বলে ওর ভাষাটাকে আমি অগ্রাহ্য করবো, বলবো যে ও আমাকে অতিক্রম করে যেতে পারলো না, তা আমি বলবো না। আসলে অতিক্রম করাটা কোনো ব্যাপার না। ভিন্নতাটা হলো আসল কথা। কবিদের একটা মুশকিল হলো এই যে, তারা সব সময়ই শঙ্কায় থাকেন — এই বুঝি আমার আসন টলে গেলো। কারো আসন কেউ টলাতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের আসন ত্রিশের কবিরা টলাতে পারেননি। ত্রিশের কবিদের আসন চল্লিশের কবিরা টলাতে পারেননি। এটা কোনো কাজের কথা নয়। যার যেটুকু প্রাপ্য তিনি সেটুকু পাবেনই। আজ নয়তো কাল। আমার লেখায় যদি ভালো কিছু থাকে তাহলে পরবর্তী প্রজন্মে তার মূল্যায়ন হবে। নয়তো তার পরের প্রজন্মে হবে। যদি তা কোনোদিনই না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে আমার ভেতরে মূল্যায়নযোগ্য কিছু নেই। সুতরাং এগুলো হলো মনের ক্ষুদ্রতা। রাজা হারানোর ভয়।

রাইসু: কবিরা তো, রাহমান ভাই জীবিতকালেই অনেকে বেশ সম্মান মূল্যায়ন পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় খ্যাতি পেয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ। সুতরাং এরকম কেউ বোধহয় নেই যাকে আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি। এটা আমার মনে হয় এক ধরনের ইয়ে, কবিদের নিজেদের সাফাই।

সাজ্জাদ: রাইসুর কথার জের ধরে বলি, যিনি প্রকৃত কবি, তিনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সংস্কৃতিতে গৃহীত হবেনই। যিনি গৃহীত হন না, বুঝতে হবে তার মধ্যে সমস্যা আছে।

আনিসুল: এই সান্ত্বনা নিয়ে কেউ হয়তো মরে যেতে পারে যে একশ-দুশ' বছর পর কেউ হয়তো আমাকে আবিষ্কার করবে। এটা ভেবে সান্ত্বনা পাওয়া যেতে পারে কিন্তু তাতে কোনো লাভ নেই।

রাইসু: হ্যাঁ, ততোদিনে তো ভোকাবুলারি চেঞ্জ হয়ে যাবে।

আনিসুল: তার মানে কবিকে তার সমাজে এবং তার সময়েই কোথাও না কোথাও গৃহীত হতে হবে।

রাহমান: তবে একটা জিনিস মনে রাখা দরকার যে আমিই একমাত্র কবি, আর কেউ নয়, এ ধরনের মনোভাব থাকা ঠিক নয়। এ একরকম ফ্যাসিস্ট মনোভাব।

আনিসুল: আমার তো মনে হয় কবি ও কবিতার ভেতর একটা আমিত্ব সব সময়ই কাজ করে।

রাহমান: সে তো থাকবেই। আমি তো আমাকেই প্রকাশ করতে চাই। সব সময়ই চাই। এটা খারাপ না।

সাজ্জাদ: এ ব্যাপারে ছফা ভাইয়ের একটা কথা বলি। তিনি বলেন, প্রতিভা হচ্ছে নিজেকে এক্সটার্নালাইজ করতে পারার ক্ষমতা। তার মানে আমি আমার এক্সপ্রেশনটা করলাম। তবু এক্সপ্রেশন নয়, আমি আমার সংস্কৃতির ওপর আপন চৈতন্যের ছাপটা রাখলাম। এর মধ্যে একটা আমিত্বের ব্যাপার তো থাকবেই। তবে সেটাই একমাত্র নয়।

রাহমান: রাইসু একটা ঠিক কথা বলেছে। এই আলো ঝলমলে বিজ্ঞাপনের যুগে কোনো কবিই আর আজকাল আড়ালে থাকেন না। বরং দেখা যায় অনেক নিম্নমানের কবি বড়ো বেশি মূল্য পেয়ে যায়।

আনিসুল: এটা একটা সমস্যা।

সাজ্জাদ: এটা তো আছেই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংস্কৃতিতে গৃহীত হবেন কি না ঐ কবি, তা কিন্তু বলা যাবে না।

রাহমান: জীবনানন্দ দাশের তাঁর জীবদ্দশায় যতটুকু পাবার কথা ছিল ততটুকু পাননি। আজকাল উন্নত নানা মিডিয়ার কল্যাণে অনেক মাইনর কবিও অনেক বেশি প্রচার পাচ্ছে। যেমন বিট জেনারেশন, ব্যাপক প্রচার পেল তারা।

রাইসু: কবির প্রচার বোধহয় কবিকে নষ্ট করে। আপনার যে বিশাল প্রচার হলো এতে আপনার কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না?

সাজ্জাদ: আপনি তো বহুল প্রচারিত কবি।

আনিসুল: কবির প্রাপ্তি নিয় কথা হচ্ছিল। কবির প্রাপ্তিটা কী?

রাহমান: আমার আবার প্রাপ্তি কী? আমার কি সাতমহলা বাড়ি হয়েছে? আমার কি দশটা গাড়ি হয়েছে?

সাজ্জাদ: মেয়েরা আমাদের কাছে চিঠি না লিখে আপনার কাছে লেখে।

আনিসুল: রাহমান ভাই, আপনি কিন্তু শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবির খেতাব পেয়েছেন। আপনার ভালো লাগে না? আপনাকে না দিয়ে এই খেতাব তো আমাকে দেওয়া যেতে পারতো।

রাইসু: রাহমান ভাই বোধ হয় এক ধরনের কমিক্যাল মজা পান এতে।

রাহমান: তা পাই, কমিক্যাল মজা পাই। তবে নিজের ওপর দিয়ে এই মজাটা করা হলে খারাপ লাগে।
তবে প্রাপ্তির কথা যদি বলেন তো বলি। অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। মানুষ আমাকে ভালোবাসা দিয়েছে যেখানেই গেছি। তারা হয়তো কবিতা বিষয়টা ভালো করে বোঝেও না। তবু কবিকে ভালোবাসে তারা।

সাজ্জাদ: হ্যাঁ। তাছাড়া সুপুরুষ কবির সংখ্যা তো এদেশে এমনিতেই কম।

আলতাফ: আপনি যখন বুঝেছেন যে ওরা হয়তো আপনার কবিতা বোঝেনি। তখন ওদের ভালোবাসা কেমন লেগেছে আপনার?

রাহমান: আমরা সবসময়ই কিছু কিছু লোককে হয় ওভার-এস্টিমেট করি, নয়তো আন্ডার-এস্টিমেট করি। অনেক সময় এমএ পাস অধ্যাপকের চেয়ে একাডেমিক শিক্ষাবিহীন লোকও কবিতা ভালো বোঝে। তা বুঝুক বা না বুঝুক এই যে ভালোবাসা এর মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা নেই। বিভিন্ন জায়গায় গেলে মানুষ হাত মেলাতে আসে। এটা বিব্রতকর ঠেকে অনেক সময়। আবার ভালোও লাগে। মানুষ তো মানুষের কাছেই আসে।

সাজ্জাদ: অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনারা একটা কাজ করেছিলেন, একটা ভাষা নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন যা নতুন বাস্তবতাকে, তার আকাক্সক্ষাকে ধারণ করতে পারে। কিন্তু আজ যদি দূর থেকে দেখি তাহলে বলা যায় সেটা ছিল একটা সীমিত অংশের মানুষের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করার ভাষা, সীমিত মানুষের কবিতার ভাষা। সে কারণে কবিতা আজ জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।

রাহমান: আমি সেটা মনে করি না। কারণ আমার ভাষা আংশিক হলেও ভগ্নাংশ হলেও আপনাদের প্রজন্মের কাছে এসে পৌছাতে পেরেছে।

সাজ্জাদ: এটা হয়তো আপনার ব্যক্তিগত অর্জন। অবশ্য আপনার কবিতার ভাষার ব্যাপারে আমার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুধরনের মতই আছে। আপনার যেমন তত্ত্ব আছে একটা — আপনি একবার কথায় কথায় বলেছিলেন আমাকে — কবিতা হচ্ছে একটা ফুলের মতো। তার মধ্যে ভালো কিছু পঙ্ক্তি থাকে, একে সাজিয়ে তোলে আরো কিছু পঙ্ক্তি। ওগুলোকে বলা যায় ফুলের চারদিককার পাতার মতো। আর আমার পজিশনটা হলো এই যে — কবিতার প্রথম বর্ণ থেকে শেষ বর্ণ পর্যন্ত হচ্ছে একটা শব্দ। যেমন কলম শব্দটার ল ক-এর আগে আনলে তা অর্থ হারিয়ে ফেলবে, কবিতারও তেমনি একটা শব্দ বদলে দিলে এর মানে হারিয়ে যাবে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা — কবিতা হচ্ছে এরকমই পঙ্ক্তিমালা যে তার ভেতর থেকে কোনো পঙ্ক্তি আলাদাভাবে উদ্ধৃত করা যাবে না। উদ্ধৃত করতে চাইলে পুরোটাই করতে হবে। আমি মনে করি কবিতা এরকমই হওয়া উচিত। কিন্তু আপনারা কবিতাকে সেভাবে দেখেননি। আপনার বেলায় দেখা গেলো, পরবর্তী কবিদের ওপর আপনার প্রভাব একচেটিয়া। যারা ব্যতিক্রম তাদের কথা আলাদা। ফলে একটা দীর্ঘ সময়ব্যাপী আমাদের কবিতায় একটা বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ষাটের দশকে আরো একটা বাজে ব্যাপার হয়েছে, তথাকথিত বিপ্লবী কবিতার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এটা পুজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটা পশ্চাৎপদ প্রতিক্রিয়া — বিপ্লবী কবিতা নয়। দেখা গেলো গ্রাম থেকে কবি এসেছেন। শহরে এসে দেখলেন এখানকার সমাজ একটা নতুন গড়ন পাচ্ছে যা তার এতোদিনকার চিন্তার সঙ্গে খাপ খায় না। ফলে তার প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এই সমাজের প্রতি এবং সমাজতন্ত্রের ছদ্মাবরণে সামন্ততান্ত্রিক এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন কবি। এটা বিপ্লব নয়। এক ধরনের বিপ্লবীপনা — আর ভাষাটা তো আপনার কাছ থেকে নেওয়া। এই দুইতে মিলে তৈরি হলো কবিতা। খুবই কর্তৃত্বপরায়ণ ছিল এই ধারা। আমি মনে করি বাংলা ভাষায় একটা অসুস্থ কবিতার কালপর্যায় সৃষ্টি করেছে এই ধারা।

তো, আমি কবিতা কেন পড়ি? কবিতার মধ্যে মানুষের চৈতন্যকে জানা যায় বলে কবিতা পড়ি। কারণ চৈতন্য যখন প্রকাশিত হয় ভাষার মধ্য দিয়ে তখন সে ভাষাকে নিজের মতো করে রি-অ্যারেঞ্জ করে। ফলে দেখা যাবে যুক্তি অগ্রাহ্য হচ্ছে, ব্যাকরণ মানা হচ্ছে না। এ কারণে মানছে না যে আমি যখন চিন্তা করি, গদ্য লিখি তখন আমার চিন্তা ভাষাটাকে সাজায়, আর আমি যখন কবিতা লিখি তখন আমার চৈতন্য ভাষাকে সাজায়। পুরোপুরি রিভার্স। এখন, একটা লোকের সংবেদনশীলতা তৈরি হচ্ছে, উপলব্ধি তৈরি হচ্ছে, তার চেতনাকে সে বিশেষ মুহূর্তে প্রকাশ করতে চাইছে এবং প্রকাশ করতে গিয়ে আরেকজনের ভাষাকে সে ধার করে আনছে — তখন ভাষা ডিকটেট করতে চাইছে তার চৈতন্যকে। এটা তো সম্ভব নয়। মানুষের চৈতন্য তো ভাষাপূর্ব। কখনোই ভালো কবিতা এই প্রক্রিয়ায় হতে পারে না।
রাইসু: সেটা পদ্যে পরিণত হচ্ছে।

সাজ্জাদ: দেখা যাচ্ছে, প্রথম থেকে শেষ লাইন পর্যন্ত নানা কথাবার্তা আছে, এলোমেলো, ছড়ানো ছিটানো। ফলে আমাদের যেটা করণীয় হয়ে ওঠে তা হলো কবিতাকে কী করে ঐ ভাষারীতির বেষ্টনি থেকে বের করে আনা যায়, কবিতাকে কী করে চৈতন্যের ওপর দাঁড় করানো যায়।

রাহমান: সাজ্জাদ যে বললো প্রত্যেকটি লাইনই কবিতা হয়ে উঠতে হবে, জ্বলজ্বলে হতে হবে — এটা তো একটা খুবই আদর্শ ব্যাপার। কিন্তু আমি আগের কথাতে ফিরে যাই। কদম ফুলই বলো আর গোলাপ ফুলই বলো — পাতা ছাড়া কিন্তু ফুলের সৌন্দর্য বাড়ে না। পাতা ছিঁড়ে ফেলে দাও, ফুলটাকে ততো সুন্দর আর লাগবে না। তুমি যতো বড় শ্রেষ্ঠ কবিই হও না কেন, আমার তো মনে হয় না তোমার প্রতিটি কবিতার সব কটি লাইনই কবিতা হয়ে উঠবে।

কায়সার: আমি একবার একটা মেয়েকে চুমু খেয়েছিলাম। মেয়েটার গালটায় ছিল কাটা দাগ। তারপর কতো মেয়েই তো দেখলাম, তার মতো সুন্দর আর কাউকে লাগলো না। কবিতাকে আমার কাছে এরকমই মনে হয়। জাপানিদের বাগান আমার কাছে খুব অশ্লীল লাগে। কৃত্রিম লাগে। এমনকি ওরা যে পুরনো খবরের কাগজ ঘরে সাজিয়ে রাখে — আমি দেখেছি আমার এক জাপানি বন্ধুর বাড়িতে — দেখলে মনে হবে সবগুলোই বুঝি আজকের। একেবারে পরিপাটি, যেন ইস্ত্রি করা। কবিতার আদর্শ বা আদর্শ কবিতা সম্পর্কে যা বলা হলো তা আমার কাছে জাপানি পরিপাট্যের মতোই কৃত্রিম মনে হয়। ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিলাম বলেই হয়তো আমার কাছে ব্রিটিশ আদর্শের বাগান পছন্দ হয়। এলোমেলো সাজসজ্জাটা চোখ ধাঁধায় না। আমার মনে হয় কবিতা এই অস্পষ্ট সৌন্দর্যের মতোই। তবে এ আলোচনায় না যাওয়াই ভালো। বিশেষ করে কবিতার শুদ্ধতা নিয়ে 'কবি গাহিয়াছেন' ধরনের আলোচনায়। একটা বাগানের ভেতর নানা রকম ফুল থাকে। সবগুলোই যদি ভালো হয় তাহলে সেটা সুন্দর বাগান না। আমার কাছেও মনে হয় এরকম যে, কোনো কবিতার সবগুলো লাইনই যদি কোট করার মতো হয় তাহলে কখনোই সেটা ভালো কবিতা হতে পারে না। কবিতা এতই রহস্যময় অস্পষ্ট ব্যাপার যে একে ঠিক কোনো ফরম্যাটে ফেলা যায় না।

আনিসুল: আমার কাছে মনে হয় — এটা কি সম্ভব যে, চৈতন্য দিয়ে কবিতা লিখবো আর চিন্তা অনুবাদ করে গদ্য লিখবো? মানুষ যখন চিন্তা করে তখন তার ভেতরে গদ্য পদ্য দুটোই চলে আসে। তার মানে কবিতাকে হতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত। আমি তা মনে করি না। স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা আসে তা যেমন কবিতা হতে পারে তেমনি যেগুলো বানিয়ে লেখা হয় সেগুলোও কবিতা হতে পারে। কবিতা অনেক রকম। যে যেভাবে লেখে। এখন আমার কবিতা, যা ভালো লাগে, সেটা কীভাবে লিখিত হলো, সেটা আপনার পদ্ধতিতে লিখিত হলো নাকি গদ্যকে পদ্যের মতো করে লেখা হলো — সেটা বিষয় নয়। কবিতাটি আমার ভালো গেলেও যেতে পারে। এটা হলো কবির রুচির ব্যাপার আর পাঠকের বোধের ব্যাপার। একটা কবিতা পাঠকের ভালো লাগতে পারে, আবার নাও লাগতে পারে। আপনি আপনার মতো লিখবেন, আমি আমার মতো। শেষ পর্যন্ত কবিতা কী — এটা সংজ্ঞা দিয়ে বলা খুবই কঠিন।

রাহমান: মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ওপর তার মৃত্যুর পর এক লেখায় একটা কবিতা কোট করেছেন।

সাজ্জাদ: শক্তির?

রাহমান: না, একজন পশ্চিমা কবির কবিতা। কবিতাটি এরকম — 'আমি একজন কবি। কেন আপনাকে কবি বলবো? কেন আপনি কবি? কারণ আমি কবিতা লিখি।' এখন বলো, এর মধ্যে কোনটা কবিতার লাইন? এর ভেতর কি কোনো জ্বলজ্বলে কিছু আছে?

সাজ্জাদ: আমিও সেটাই বলতে চাই। আমি কিন্তু কবিতা কীভাবে লিখিত হবে সেটা বলতে চাইছি না। আমার বলার বিষয় হলো যখন একটা বিশেষ ধারার কবিতার ভাষা অথরিটেটিভ হয়ে ওঠে, আর ওই ভাষারীতির মধ্যে যদি সমস্যা থাকে, ঐ ভাষায় সবাই কবিতা লিখতে চায় তখন সমস্যা হয়। কবিতা তো বিচিত্রই হবে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা চৈতন্যের ধরন আছে। সবার কবিতাই শেষ পর্যন্ত তাই আলাদা হতে হয়।

আলতাফ: তাই তো হবে। কবিতা তো আর একই রকম হবে না।

আনিসুল: আমি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র ছিলাম। আর্কিটেকচার বলে একটা সাবজেক্ট আছে সেখানে। আমরা যখন বিল্ডিং বানাই আমাদের বলে দেওয়া হয় যে এরকম লোড হবে, এতগুলো লোক থাকবে — ডিজাইন করে দাও। সকল ইঞ্জিনিয়ারের ডিজাইনের জন্যই কিন্তু একই রকম হিসাব লাগে। এতগুলো লোহা লাগবে, এতগুলো সিমেন্ট লাগবে, ইট লাগবে ইত্যাদি। কিন্তু আর্কিটেক্ট যখন বিল্ডিং বানায় তখন কিন্তু একেকজনের বিল্ডিং একেক রকম হয় দেখতে। কবিতার ক্ষেত্রেও ঘটনাটি আমার কাছে একই রকম মনে হয়। একই উপাদান দুজন কবিকে দিলে দুরকম কবিতা লেখা হবে।

রাইসু: সব সময় একই রকম হয় না। রাহমান ভাইদের সময়ে বা তার কিছুটা পরেও দেখা গেছে সবাই একই ভঙ্গীতে, একই ভাষায়, একই মুডে লিখছে।

আনিসুল: সেটা রাহমান ভাইয়ের সাফল্য। প্রধান কবির সাফল্য তো তাই। সমকাল বা পরবর্তী কালকে প্রভাবিত করেন তিনি। আরেকজন শক্তিশালী কবি এসে এই ধারাটা বদলে দেবেন।

রাইসু: এটা আমরা ধরে নিচ্ছি। কিন্তু এটা তার কবিতার সাফল্য হতে পারে না, ভাষার সাফল্য হতে পারে।

সাজ্জাদ: এটা রাহমান ভাইয়ের সাফল্য হতে পারে কিন্তু বাংলা কবিতার জন্য এটা ক্ষতিকর।

আনিসুল: কবিতার জন্য ক্ষতিকর অক্ষতিকর বলে কিছু নাই। এখন আমি যদি নিজেকে প্রধান কবি হিসেবে দাঁড় করাতে চাই তাহলে আমি আর শামসুর রাহমানের মতো লিখবো না। কবিতার কেউ ক্ষতি করতে পারে না। মানে আমি একটা বাজে কবিতা লিখে কবিতার ক্ষতি করে ফেলতে পারবো এরকম মনে হয় না।

কায়সার: কবিতার কেউ ক্ষতি করতে পারে না।

সাজ্জাদ: কবিতা ক্ষতি করতে পারে কবিতার …।

রাহমান: ধরি, মি. এক্স — তার ভাষা অনেকে ফলো করছে। ভাষাটা তার নিজস্ব কিছু না। ভাষার ব্যবহারটাই হলো কথা। যেমন জীবনানন্দ বললেন 'পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন'। আলাদা আলাদা ভাবে এই পঙ্ক্তির কোনো শব্দই জীবনানন্দের নিজস্ব নয়। পাখি নয় নীড় নয় চোখ নয়। কিন্তু সিনট্যাক্সটা তাঁর নিজস্ব। ভাষাটা তো আর কবিতা নয়। কেউ কেউ অবশ্য বলেন শব্দই কবিতা। কিন্তু ব্যাপার হলো আলাদা আলাদাভাবে কোনো কিছু কবিতা নয়। সবকিছু মিলেই কবিতা।
রাইসু: কিন্তু আমরা দেখি জীবনানন্দের পরে, অনেক পরে কাজলেন্দু দে লিখছেন, তিনি জীবনানন্দ থেকে খুব বেশি দুরে নন। একই রকমভাবে লিখছেন তিনি।

আনিসুল: এটা তো বিপদ।

রাইসু: তাঁকে আলাদা করা যাচ্ছে না। জীবনানন্দ বেঁচে থাকলে কাজলেন্দুকে আর কবিতা লিখতে হতো না। কেমন ক্ষতিকর হতে পারে জীবনানন্দ আর কাজলেন্দুর পার্থক্যটা খোঁজার চেষ্টা করলেই বোঝা যাবে।

আদিত্য কবির: কাজলেন্দু তো হতেই পেরেছে জীবনানন্দ মারা গেছে বলে।

রাহমান: এখনো জীবনানন্দের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। তিনি বেঁচে থাকলে যা হতো এখনো তাই হচ্ছে।
সাজ্জাদ: রাহমান ভাই, আমি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মনে করি কবিতা ক্ষতি করতে পারে। কারণ প্রতীকের ভাষা যখন একটা জনগোষ্ঠীর ওপর ছুড়ে দেওয়া হয় তখন তার একটা প্রভাব পড়ে কালচারের ওপর, পজিটিভ অর নেগেটিভ। কারণ আমরা দেখি বঙ্কিমের 'বন্দে মাতরম' আমাদের এখানে কীরকম প্রভাব ফেলেছিল। স্বদেশী আন্দোলনের প্রাণ এই কবিতা থেকে জন্মেছে। এটা তো সবারই জানা। যেটা বাংলাকে বিভক্ত করেছে।

আনিসুল: এটা তো গেলো সামাজিক ক্ষতির ব্যাপার। কিন্তু কবিতার ক্ষতিটা হলো কোথায়?

রাইসু: ভুয়া প্রতীক তো কবিতার ক্ষতি করবেই।

সাজ্জাদ: কবিতার ক্ষতির ব্যাপারটা হলো এরকম যে কবিতার ক্ষতি তো আপনি কবিতার ভেতর দিয়ে দেখতে পাবেন না। আপনাকে কবিতার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে। কবিতার বাইরে সোসাইটিতে দাঁড়িয়ে দেখবেন এর ক্ষতিকর প্রভাবটা সুদূরপ্রসারীভাবে কালচারের ওপর পড়ছে। সেখান থেকে ঘুরে আসছে কবিতায়। কালচারের ওপর যে প্রভাবটা পড়ে তা এক সময় ইরাপটেড হবে, বিস্ফোরিত হবে।

আনিসুল: তার মানে কবিতার রাজনৈতিক দিকটাই সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ালো।

সাজ্জাদ: না না না, তা না।

আদিত্য: রাজনৈতিক দিকটা ছোট করবেন কীভাবে?

সাজ্জাদ: সবগুলো জিনিস আমাদের এক সঙ্গে দেখতে হবে। কবিতা তো কিছু একটা কনটেইন করে।

আদিত্য: কবিতা একটা কিছু কনটেইন করে আবার কবিতাকে কনটেইন করে একটা কিছু।

সাজ্জাদ: রাইট, এটাকে বাদ দিয়ে তো কবিতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে না। তাই না?

আনিসুল: না, আপনি বললেন যে কবিতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কবিতা থেকে বের হওয়াটা কী রকম?

সাজ্জাদ: আপনি বলছিলেন যে কবিতা ক্ষতি করলো কি না।

আনিসুল: ধরা যাক একজন লোক একটা কবিতা লিখলো। সে তো ভালো মনে করেই লিখলো। আমরা বললাম বাজে কবিতা।

আদিত্য: এইখানে আমি একটা কথা বলতে চাই। আমার ধারণা বাজে কবিতার তেমন ক্ষমতা নেই ক্ষতি করার। ভালো কবিতাই ক্ষতি করতে পারে।

আনিসুল: মানে কী। ভালো কবিতা — তার মানে কী?

আদিত্য: গোলাম মোস্তফার কবিতা ক্ষতি করতে পেরেছে তার কারণ তার কবিতাগুলো ভালোই হয়েছে।

আনিসুল: তার মানে কী দাঁড়ালো। কবিতার ভেতরকার সামাজিক বক্তব্যই বড় হয়ে দাঁড়ালো, কবিতার নিজের তাহলে ভালো বা খারাপ হবার ক্ষমতা নেই।

সাজ্জাদ: না, কেন থাকবে না।

আনিসুল: মানে কী — একটা বিষয় হচ্ছে কবিতা সমাজে গৃহীত বা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে কিন্তু সমাজের ভেতর তা নিয়ে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। এখন এই প্রতিক্রিয়া ভালো হলো না খারাপ হলো এর ওপর নির্ভর করছে কবিতাটি ভালো না মন্দ।

রাইসু: আমার মনে হয় দুটো বিষয় এখানে একত্রে বলা হচ্ছে। একটা হলো যে কবিতার ক্ষতি বলতে আমরা ধরে নিয়েছি কবিতার গাঠনিক ক্ষতি। আরেকটা হলো সামাজিক ক্ষতি।

কায়সার: ভালো মন্দের দিকে না গিয়ে সামাজিক লাভক্ষতির দিকে যাওয়াই বোধ হয় ভালো।

আনিসুল: তাহলে কী দাড়ায়। একটা কবিতার ভালো মন্দ সকল সামাজিক প্রভাবের যোগফলকে আমরা বলবো ভালো বা মন্দ কবিতা?

রাইসু: এটা সব সময় নয়।

আনিসুল: আমি একটা অলস মুহূর্তে বা গোপন বা প্রকাশ্য মুহূর্তে নিজের কোনোও প্রয়োজনে জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ছি। পড়ে আমি আনন্দ পাচ্ছি। আমার বউ হয়তো পাচ্ছে না, কাজের মেয়ে পাচ্ছে না। এই আনন্দটা আমি কবিতার কাছে পেতে চাই।

সাজ্জাদ: অবশ্যই পেতে চাইবেন। চাইবেন না কেন? আপনি যখন কবিতাটি পড়ছেন, কোনো একটি কবিতা, তা কিন্তু আপনার চৈতন্যকে একটা গড়ন দেয়। আপনি যখন সমাজের ভেতরে কাজ করেন, সেই চৈতন্যের একটা এক্সপ্রেশন থাকে তার ভেতর। এখন প্রশ্ন আসতে পারে কবিতার ক্ষতিকর বা ভালোর দিকটা বাদ দিলেও কবিতাকে কবিতার মধ্যে রেখে বিচার করা যায় কি না, অর্থাৎ কবিতাটি সমাজের মধ্যে কী করলো না করলো তা বাদ দিয়ে বিচার করবো কি না। আপনার প্রশ্ন বোধ হয় সেটাই।

আনিসুল: আমার প্রশ্ন হলো, ধরা যাক আমি একটা কবিতা লিখলাম, কবিতাটা ভালো হলো না — এখন এরকমভাবে কবিতা লিখে আমি কবিতার কোনো ক্ষতি করতে পারি কি না? আমার মনে হয়, ভালো কবিতা যেটা সেটা ভালো হিসেবে গৃহীত হবে। সেই ভালো কবিতাটির কোনো ক্ষতি আমার খারাপ কবিতাটি করতে পারবে না।

রাহমান: বাজে কবিতা যিনি লিখছেন, তিনি নিজের ক্ষতিই করছেন। কারণ ঐ বাজে কবিতাটি তিনি যখন লিখছেন সে সময়টাতে তিনি একটা ভালো সিনেমা দেখতে পারেন। চিত্রপ্রদর্শনীতে যেতে পারেন বা নারীসঙ্গ উপভোগ করতে পারেন। তা না করে তিনি বাজে কবিতা লিখলেন। ক্ষতিটা এখানেই। (এ সময়ে একযোগে ছাদ ফাটানো স্বরে হেসে ওঠেন সবাই)।

আনিসুল: কিন্তু সমস্যা একটা আছে। আমি হয়তো মনে করছি কবিতাটি বাজে। কিন্তু কবি মনে করছেন তা উৎকৃষ্ট এবং আশপাশের কিছু লোক উৎকৃষ্ট বলছে। তার কিছু পুরুষ ও নারী গুণগ্রাহী আছে, তারা ভালো বলছে।

রাইসু: আবার পুরুষ কেন কবিতার মধ্যে।

(আবার সমস্বর হাসি।)

রাইসু: বাজে কবিতা বলতে বোঝানো হচ্ছে যে যেসব কবিতা লিখতে গিয়ে আমরা ছাড় দেই, জানি যে কবিতাটা পুরোপুরি ভালো হয়নি, কিন্তু চালিয়ে দিচ্ছি।

আনিসুল: একটা লোক কোনো রকম ছাড় না দিয়ে জীবনের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে একটা কবিতা লিখলো। কিন্তু সেটা খারাপ হতে পারে, আমার কাছে। সবার কাছে। কিন্তু সে নিজে বলছে এটা ভালো।

রাইসু: তাহলে সেটা ভালো।

আনিসুল: কাজেই কবিতা তো ভালোমন্দ দিয়ে বিচার করা যায় না।

(এ সময় সবাই যথাসম্ভব উচ্চস্বরে একযোগে যার যার মত প্রকাশ করতে শুরু করেন। ক্যাসেট শুনে আলাদা আলাদাভাবে তা বোঝার সাধ্য নেই। এক সময় শামসুর রাহমান কথা বলতে শুরু করেন। অন্যদের বলাবলি কমে আসে তাঁর স্বরক্ষেপে।)

রাহমান: অনেকের তো কোনো কবিতাই হয় না। কিন্তু অনেক আবেগ দিয়ে রাত জেগে ধরা যাক কেউ একটা কবিতা লিখলো। তার বন্ধুবান্ধবরা আবার তাকে উৎসাহিত করছে বই বের করার জন্য। তারপর সে তার নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে বই বের করছে। বইটি যথারীতি বিক্রি হচ্ছে না …।

সাজ্জাদ: রীতিমতো আর্থসামাজিক ক্ষতি।

রাহমান: এ কারণেই আমি বলছিলাম, খারাপ কবিতা যে লেখে তার নিজেরই ক্ষতি হয় বেশি। তবে সে যদি আনন্দ পায় তো লিখতে পারে। আনন্দ পাবার অধিকার তার আছে।

আদিত্য: অন্যের ক্ষতি করার চাইতে এটা মন্দ কী? যারা কবিতা নিয়ে কোনো দিন ভাবলোই না, ইনডেনটিং-এর ব্যবসা নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলো — তাদের চাইতে এ লোকটা মন্দ কী?

কায়সার: অনেক ভালো অনেক ভালো।

সাজ্জাদ: কবিতা লেখাটা তো ইটসেলফ একটা ভালো কাজ — এরকমটা আমি বলি না অবশ্য। ইনডেনটিং-এর ব্যবসা করাটাও ভালো কাজ হতে পারে।

কায়সার: কবিতা লেখাটা তো একটা খুবই অনুৎপাদনশীল কাজ।

(অতঃপর সমস্বর মন্তব্য।)

রাহমান: যে লোক সুরাবিলাসী, অষ্টপ্রহর সুরা পান করাটাই তার কাছে শ্রেষ্ঠ কাজ। যে ঠিকাদার, ঠিকাদারীই তার কাছে সবচেয়ে বড় কাজ। বীমা কোম্পানীর দালাল মনে করেন খদ্দের ধরাটাই সেরা কাজ। কবির কাছে কবিতা লেখার কাজটাও সেরকম। সুতরাং এগুলো খুব আপেক্ষিক।

রাইসু: এটা ব্যক্তির কাছে আপেক্ষিক হতে পারে। কিন্তু কবিতা তো প্রকাশিত হয়, পাঠকের কাছে যায়।

সাজ্জাদ: ঐ প্রশ্নটার কাছে ফেরত যাওয়া দরকার। মিটুন (আনিসুল হক) হয়তো একটু মোটা দাগে আমার কথাটাকে ধরেছেন।

কায়সার: মুক্ত আলোচনা তো, এখানে মোটা চিকন সব দাগেরই কথা চলতে পারে।

সাজ্জাদ: আমি তো আমার বক্তব্যটা বিশদ করবো, নাকি?

কায়সার: তা তো নিশ্চয়ই।

(এ সময়ে ক্যাসেট পাল্টাতে গিয়ে কিছু কথা বাদ পড়ে যায়। পাঠক, মাঝখানকার কথাবার্তা একটু অনুগ্রহ করে ভেবে বসিয়ে নেবেন)।

সাজ্জাদ: আমি বিপ্লবী না, মার্ক্সিস্টও না।

রাইসু: কবিতার সোশ্যাল ইমপ্লিকেশন কেন থাকবে না? কবিতা তো আমরাই পড়ি, সোশ্যাল লোকজনই তো পড়ে।

কায়সার: কবিরা তো সমাজের বাইরের কেউ না।

সাজ্জাদ: কবিতা যখন লিখিত এবং পঠিত হচ্ছে তখন তার প্রভাব তো মানুষের চিন্তা-চেতনার ওপর পড়ছে। এবং দেখা যাচ্ছে ঐটা শেষ পর্যন্ত নানাভাবে প্রস্ফূটিত হচ্ছে তার কালচারের ভেতরে। কবি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কী? কবিতা লেখা। কিন্তু যে একটু দূর থেকে দেখে সে কী দেখবে? আমি যখন লিখি, আমি তো পড়িও — বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি। সব কবিরই একটা সচেতন প্রয়াস থাকে নিজেকে শুধরে নেবার, কবিতাকে শোধরানোর। এটা করি তো আমরা। আমরা ছন্দ শিখি। কিন্তু যখন কবিতা লিখতে যাই তখন কিন্তু অক্ষরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্ত ভেবে বা মাত্রা মেপে কবিতা লিখি না। এটা নিশ্চয়ই কোনো কবিই করেন না। আদিত্য থেকে রাহমান ভাই — কেউ করেন না। লিখতে গেলে কবিতাটা আপনা আপনিই আসে মাত্রার ভেতর। কিন্তু এক সময় তো শিখতে হয়েছে। এক সময় মাত্রা গুনে লিখতে হয়েছে। এভাবে এক সময় তার সাবকনশাসে এসে যায় ব্যাপারটা। কবিতা এরপর ছন্দসহ আপনা আপনিই আসে। এরকম অনেক ব্যাপারেই কবির নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় — চৈতন্যের, ভাষার, সংবেদনশীলতার। একজন কবির কাঁচামাল কী কী? তার চৈতন্য এবং তার ভাষা।

রাহমান: ভ্যালেরি বোধ হয় বলেছেন, 'আ পোয়েট পিউরিফাইস দ্য ল্যাংগুয়েজ অফ হিজ ট্রাইব।' এটাই হলো কবির সামাজিক দায়িত্ব।

সাজ্জাদ: অফকোর্স, অনেক দায়িত্বের একটা।

রাহমান: এটা যদি আমরা ধরে নেই তাহলে কোনো ক্ষতি নেই।

কায়সার: কবিরা তো সমাজেরই মানুষ, নাকি। অন্য কোনো গ্রহে তো আর থাকে না কবিরা।

রাইসু: অন্য গ্রহে মানুষ থাকলে সেখানে কবিও থাকতে পারে।

কায়সার: থাকলেও আমাদের কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু আমরা যারা এই গ্রহে আছি, আমাদের বাজারে যেতে হয়, ভালোবাসতে হয়, ঘৃণা করতে হয়, দলাদলির মধ্যে যেতে হয়, রাজনীতিতে যেতে হয়, মৌলবাদে যেতে হয় — নানান ঝামেলা। সমাজের ভেতরে থেকেই করতে হয় এসব আমাদের। কাজেই কবি আর সমাজের বাইরে থাকে কী করে? কাজেই কবিকে তো আর অসামাজিক বলতে পারবেন না। শামসুর রাহমানকে কি বলা যাবে যে তিনি অসামাজিক?

রাইসু: একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত।

(সমস্বরে প্রবল হাসি)

কায়সার: কবিতার সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক অবশ্যই আছে। সমাজের জন্য কবিরা অবশ্যই কিছু না কিছু করেন।

আনিসুল: এই কথাটা প্রচলিত যে কবিতা তার ভাষাকে পরিশুদ্ধ করে, পরিশ্র"ত করে। কীভাবে করে কাজটা? যখন ভাষাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভাষাকে পরিশ্র"ত করাটাই কি তাহলে কবিতার পরম কাজ?

কায়সার: না, ভাষা বলতে কেবল মোটা দাগের মুখের বা লেখার ভাষা নয়।

রাহমান: ভাষা বলতে এখানে বোঝাচ্ছে মানুষের চিন্তা, চেতনা, রুচি, অভিপ্রায়।

রাইসু: মানুষ তার ভবিষ্যতকে রচনা করে যে ভাষায়।

রাহমান: বলা হয় যে অমুক কবির ভাষা বেশ উন্নত। এটা কী করে হয়? ভাষা তো একই থাকে। আসলে তার উন্নত বোধ উন্নত চেতনা ভাষাটাকে ডেকে আনে।

সাজ্জাদ: রাহমান ভাই যে লাইনটা বললেন, ভ্যালেরির — তার ব্যাখ্যা কিন্তু বহু রকম হতে পারে। মানুষের চেতনার ওপর প্রতীকের ভাষার একটা প্রচণ্ড প্রভাব আছে। কারণ অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে মানুষ আলাদা এ কারণে যে মানুষের ভাষা আছে। সেই ভাষা অফুরন্তভাবে নিজেকে অর্গানাইজ করতে পারে। আর চমস্কি ভদ্রলোক যা বলেন, থাক, সেসব আমি আনতে চাই না আলোচনায়। চিন্তাটা হলো ভাষারই এক ধরনের সিস্টেমেটিক ফ্লো।

আদিত্য: মানুষ ভাষা দিয়ে চিন্তা করে।

সাজ্জাদ: ভাষা দিয়েই চিন্তা করে। ফলে, ভাষাকে পিউরিফাই করার মানে হচ্ছে, ঐ ভাষার যে জনগোষ্ঠী তার চিন্তাচেতনার নতুন সৃজনশীল ক্ষেত্র উন্মোচন করা। তার প্রভাব পড়বেই শেষ পর্যন্ত। ফলে কবিতা ভাষাকে নতুনভাবে অর্গানাইজ তো করেই, সেই সঙ্গে সমাজের ভেতর সৃষ্ট অগ্রবর্তী সংবেদনশীলতাকে গড়ন দেয়।

রাইসু: নতুন সংবেদনশীলতা তৈরিও করে।

সাজ্জাদ: অবশ্যই, অবশ্যই। তৈরিও করে। ফলে কবিতার কিন্তু একটা ব্যাপক প্রভাব থেকেই যাচ্ছে। আমরা তো কবিতা লিখেই খালাস। কবি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ফিনিশ। কবির জন্য এটুকুই যথেষ্ট। তিনি যদি তার সংবেদনশীলতার প্রতি সৎ থাকেন, দ্যাটস এনাফ। সৎ কবি কে? যিনি তার সংবেদনশীলতাকে কোনোরকম ছাড় না দিয়ে প্রকাশ করেন। এখন কবিতা লিখতে লিখতে, হঠাৎ প্রেমের কবিতা লিখতে গিয়ে আমার মনে হলো যে জামাতের সঙ্গে তো আমার সম্পর্ক আছে কাজেই কবিতায় একটা কোথাও আল্লারসুলের নাম ঢুকিয়ে দিতে হবে। কোনো কবিতার এক জায়গায় লিখলাম — 'নৌকার পাল বরে উঠলো আল্লাহ আল্লাহ'। এটা তো অসততা। এই আরোপ করাটা। কবিতাটি কিন্তু নষ্ট হয়ে গেলো।

রাইসু: আরোপ না, বলুন ঢুকিয়ে দেওয়া যা স্বাভাবিকভাবে যায় না ঐ কবিতার সঙ্গে।

রেজা: এখানে যে রকম কথাবার্তা শুরু হলো, আরোপ শব্দটা ঠিক হবে কি হবে না এভাবে চলতে পারে, বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু এতে করে আমাদের কথাবার্তার ফ্লো ব্যাহত হতে পারে। ধরে নেওয়া যেতে পারে আরোপ করা কথাটাই ঠিক। পজিটিভ।

রাইসু: কবিতার ক্ষেত্রে পজিটিভ বিষয়গুলোই তো আমরা খুঁজতে চাইছি।

আদিত্য: কিন্তু এই যে বলা হলো যে আল্লাহু ঢুকাতে চায় কাজেই ঢুকিয়ে দিলো।

আনিসুল: না না, আমি তো ঢোকাতেই পারি।

কায়সার: তা পারেন। কিন্তু তা যদি অটোম্যাটিক্যালি হয় ঝরনাধারার নুড়ির মতো, তো আপত্তি নেই।
রাইসু: কবি কী করেন? শব্দগুলো নিয়ে ভাবেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে শব্দগুলো আসে বা কবি অ্যারেঞ্জ করেন। কিন্তু আরোপ করলে যেটা হয় তাহলো যেটা যায় না সেটাকে জোর করে ঢোকায়।

আনিসুল: এটা তো পাঠকের ব্যাপার।

আদিত্য: কবিতায় জোর করে কিছু ঢোকানো হয়েছে কি না বা আরোপ করা হয়েছে কি না এটা পাঠক নির্ধারণ করবে।

(সমস্বরে তর্ক শুরু হয়। আলাদাভাবে কারো একটি পুরো বাক্য উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। এই হট্টরোল এড়াতে ক্যাসেট রেকর্ডার শামসুর রাহমানের নিকটবর্তী করা হয়।)

রাহমান: কবিতা হচ্ছে গাছের শাখায় পাতা গজাবার মতো। পাতাটি গজাচ্ছে কিন্তু কেউ এর গজানোর প্রক্রিয়াটি টের পাচ্ছে না। মানে কবিতায় শব্দের প্রয়োগ হবে গাছে পাতা জন্মাবার মতো স্মুদলি, পাঠক যেন টের না পায়।

আনিসুল: পাঠক হিসেবে অবশ্য আমি তাই মনে করি। কোনো একটা জায়গায় যদি কষ্ট লাগে কবিতাটি পড়তে গিয়ে, যদি বুঝি যে কবি এখানে কেরদানি করার চেষ্টা করেছেন, তার কেরদানির কষ্টটা যদি ধরা পড়ে যায় আমার কাছে, তখন খারাপ লাগে। কবির কষ্ট আমাকে কষ্ট দেয়। (এ বিষয়ে সবাই সমস্বরে নিজ নিজ মন্তব্য প্রকাশ করতে থাকেন। আলাদাভাবে রাইসুর কণ্ঠটি ধরা পড়ে রেকর্ডারে, যন্ত্রটি তার দিকে সরিয়ে নেওয়ায়।)

রাইসু: একটা ভালো কবিতার মতো তো আরেকটি ভালো কবিতা হতে পারে না, রাহমান ভাই কী বলেন?

রাহমান: এখন তোমার কথা কি সিরিয়াসলি নেবো নাকি হাল্কাভাবে, এ নিয়ে বরাবরই আমার দ্বিধা হয়।

(সমস্বরে উচ্চকণ্ঠে হেসে ওঠেন সবাই।)

রাইসু: সব ভালো কবিতাই নতুন কোনো সংবেদনশীলতা তৈরি করে। অর্থাৎ ভালো কবিতা আমরা বিচার করবো এভাবে যে কবিতাটি কোনো নতুন অনুভূতি কোনো নতুন সংবেদনশীলতা দিতে পারছে কি না, যা সমাজে নাই।

রাহমান: আবেগ যেটা, সেটা কি দশকে দশকে শতাব্দীতে শতাব্দীতে চেঞ্জ হয়?

আদিত্য: আমার মনে হয় কমপ্লেক্সিটি বাড়ে।

রাহমান: প্রেম, ঈর্ষা, ভক্তি, রিরংসা, বিদ্রোহ, মাতৃস্নেহ কিংবা হিপোক্রেসি — এগুলো কি চেঞ্জ হয়?

কায়সার: প্রকাশটা ভিন্ন হতে পারে।

রাহমান: কিন্তু মূল জিনিস তো একই থাকে।

কায়সার: একজন গুহামানবের অনুভূতির সঙ্গে আমাদের অমিল কোথায়।

আদিত্য: আমার মনে হয় না যে গুহামানবদের এলিয়েনেশনের সমস্যা ছিল না।

রাহমান: এলিয়েনেশন যে গুহামানবদের ছিল না, তুমি কি নিশ্চিত এ ব্যাপারে।

আলতাফ: আমার মনে হয় প্রকাশভঙ্গিটার বদল হয়, অনুভূতিটা একই থাকে।

রাহমান: গুহামানব তো আর আজকের মানুষ না। আমরা যতদূর জানি ইতিহাসকে সচেতন মানুষ হিসেবে আমরা দেখি শেক্সপিয়র যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন ইয়েটসও সেসব বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন, নেরুদাও হয়তো তাই করেছেন। একেকজনের প্রকাশভঙ্গি কেবল আলাদা আলাদা।

আলতাফ: পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু নতুন বিষয় যুক্ত হয়।

রেজা: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন কোনারকে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর যে অনুভূতি হয়েছিল, আর আমি যখন কোনারকে যাবো –

লতিফ: যাবো মানে কী, তুমি তো ঘুরেই এলে কদিন আগে ওখান থেকে।

রেজা: দুজনের অনুভূতি কি এক হবে?

রাহমান: সৌন্দর্য সম্পর্কে যে অনুভূতি সেটা তো দুজনের বেলাতেই এক।

কায়সার: তার প্রকাশটা আলাদা হতে পারে।

আদিত্য: দেখুন খাজুরাহে যেসব সুন্দরীর চিত্র আঁকা হয়েছে, বিশাল নিতম্ব, বিশাল উরু, বিরাট বক্ষদেশ — সেগুলো নিশ্চয়ই এখন আর সুন্দর লাগবে না কারো কাছে। এখন সুন্দরী নারীর প্রতীক হচ্ছে ঐশ্বর্য রাই।

রাহমান: দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন তো হবেই। কিন্তু সৌন্দর্য সম্পর্কে মুগ্ধতার বোধ কি বদলাচ্ছে? অরিজিনাল ফিলিংস বদলাচ্ছে না।

সাজ্জাদ: বুদ্ধদের বসু তাঁর কোনো একটি বইয়ের ভূমিকাতে লিখেছেন যে, কালীদাসের কবিতার আগে প্রেমঘটিত নিঃসঙ্গতার বোধ সংস্কৃত কবিতায় দেখা যায়নি। তারপর দেখুন প্রাচীন ভারতীয় মূর্তিগুলোয় কামভাবের প্রকাশ দেখতে পাবেন, প্রেমভাবের প্রকাশ খুঁজে পাবেন না। তারপর বাইবেলে দেখেন, একটু আগে এলিয়েনেশনের কথা উঠল, সে বিষয়ে বলি। কেইনকে যখন ক্ল্যান থেকে বের করে দিলেন অ্যাডাম, তখন কেইন বললো, 'এই নিঃসঙ্গতার ভার আমি কী করে বইবো।' এলিয়েনেশনের প্রথম উদাহরণ বলা হয় এটাকে। এটা কিন্তু এলিয়েনেশন না। এটা ছিল সমাজ থেকে বের হয়ে যাবার কারণে নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক। কারণ সমাজটাই তার কাছে ছিল সব। এখনকার যে এলিয়েনেশনের বোধ, সেটা তো তৈরি হচ্ছে সমাজের ভেতরে থেকেই। মানে কী? বোধের পরিবর্তনটা স্পাইরাল এবং সম্মুখবর্তী। চক্রাকারে তা ঘুরে ঘুরে আসে না, উচ্চতর পর্যায়ে চলে যায়। কারণ পৃথিবীর বৈষয়িক বদল হয়। এভাবে কবিতার বিষয়ও পাল্টায়।

কায়সার: সৌন্দর্য বোধ ঘৃণা এগুলোর কি পরিবর্তন হয়েছে?

সাজ্জাদ: কনসেপ্টটা চেঞ্জ হয়ে গেছে।

আনিসুল: আনন্দ পায় একেক জন একেক ভাবে। শেক্সপিয়রের সনেট পড়লে আমি এখনো মজা পাই।

আদিত্য: চসার পড়লে পান না, পুরনো লাগে।

আনিসুল: আবার জীবনানন্দ দাশ পড়ে মজা পাই। একটা প্রেমের কবিতা পড়ে আমি আমার নিজের প্রেমে পড়ার সঙ্গে মিলিয়ে দেখি, মজা পাই। নিজের অনুভূতির সঙ্গে মিলে যাওয়ার কারণেও আমার ধারণা বহু লোক কবিতা পড়ে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমাদের কালে যত মানুষ পড়ে, আমার ধারণা নির্মলেন্দু গুণের কবিতা পড়ে তার চেয়ে বেশি মানুষ। তার মানে সমকালীন কবি তার সময়ের আবেগ অনুভূতিগুলোকে ধরতে পারেন বেশি ভালো করে। আবার চারশ বছর আগের যে কবিতাটি আমার আবেগকে স্পর্শ করে, প্রাসঙ্গিক মনে হয় আমার কাছে — আমি মনে করি তা উৎকৃষ্ট, মহৎ। কবিতার এটাই ভালোত্ব।

সাজ্জাদ: মিটুনের এই কথা প্রসঙ্গে আমি আমার নিজের তত্ত্ব বলি। ভুল হোক শুদ্ধ হোক, মানুষের তো নিজস্ব কিছু তত্ত্ব থাকেই। তত্ত্বটা হচ্ছে এই — প্রত্যেকটা কালচারের পেছনে থাকে বহু মানুষের কন্ট্রিবিউশন। বড় বড় কবিদের কন্ট্রিবিউশনটা কালচারের মধ্যে থেকে যায়। ধরা যাক চণ্ডীদাস বা অন্য কেউ। আমি চণ্ডীদাস পড়ি বা না পড়ি তার উপাদান তো কালচারের মধ্যে আছে। তার কবিতা আমার চৈতন্যকে সংস্কৃতির ভেতর থেকে গড়ন দিয়েছে। ফলে আমি যখন তার কবিতা পড়ি তখন অ্যাটইজ ফিল করি। কারণ আমার মধ্যে উপাদানগুলো আছে। কিন্তু যে কবিরা কালচার থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে, অ্যাকসেপটেড হয়নি কালচারে, তাদের কবিতা পড়তে গিয়ে কিন্তু এরকম হয় না। ধরা যাক গোলাম মোস্তফা। তার কবিতা পড়ে কিন্তু আমি মজা পাচ্ছি না। কারণ সংস্কৃতি তাঁকে প্রত্যাখান করেছে। কেউ কেউ তার সময়ের সংবেদনশীলতাগুলো ধরতে পারে। আবার কেউ কেউ পারে না। তারা করে কী একটা ফ্যাশন তৈরি করে — একথা চিন্তা করে যে এ সময়ে এরকম কবিতা খাবে ভালো। পারপাস সার্ভ করবে। সুকান্ত যেমন করেছিলেন।

কায়সার: নজরুল।

সাজ্জাদ: না, নজরুলকে এই ধারায় ফেলা ঠিক হবে না। যা হোক সময়ের উপযোগী ফ্যাশন তৈরি করে অনেকে পপুলার হয়। যেমন নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। এদের মধ্যে কেউ শেষ পর্যন্ত গৃহীত হবেন কি না জানি না। কিন্তু তাঁরা পপুলার।

কায়সার: পপুলারিটি কথাটাই তো খারাপ, কবিতার জন্য।

আদিত্য: না না, বড় কবিকে অবশ্যই পপুলার হতে হবে। শেক্সপিয়রের চেয়ে বেশি পপুলার কাউকে দেখেন আপনি?

রাহমান: খুব খারাপ জিনিস অনেক সময় পপুলার হয়, ভালো জিনিসও হয়।

আলতাফ: আমাদের ভাষায়ও তো মহৎ পপুলার কবি আছেন। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশি পপুলার আর কোন কবি?

কায়সার: যে অর্থে শেক্সপিয়ার পপুলার সে অর্থে কি নির্মলেন্দু গুণ পপুলার? পপুলার শব্দটার ব্যাপারেই আমার আপত্তি।

(একযোগে কথা বলতে থাকে এসময় সবাই।)

আদিত্য: বেশি বই বিক্রি হওয়াটাও বড় কবির লক্ষণ। দীর্ঘদিন ধরে বহু বই বিক্রি। যেমন রবীন্দ্রনাথ বা শেক্সপিয়র।

কায়সার: এটা হলে তো সেবা প্রকাশনীর লেখকরাই সবচেয়ে বড়। কারণ প্রচুর বই বিক্রি হয় তাদের। অথবা হুমায়ূন আহমেদ।

আদিত্য: এখন সেবা'র যে বইগুলো বিক্রি হচ্ছে পাঁচ বছর পর কিন্তু ওগুলো আর বিকোবে না।

সাজ্জাদ: রাইসু একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিল। যে কবিতা আমাদের নতুন সংবেদনশীলতা দেয় সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক কবিই, যদি তিনি সৎ কবি হন, তার কবিতার ভেতরে কিন্তু অগ্রসর বোধ থাকে। তিনি ধারণ করেন এবং প্রকাশ করেন। ফলে একটা নতুন সংবেদনশীলতা তৈরি হয়। এটাও কিন্তু কবির একটা কাজ। তিনি নতুন সংবেদশীলতা সমাজের ভেতরে পৌঁছে দেন এবং এভাবে সমাজচৈতন্যকে তৈরি করেন।

আলতাফ: সংবেদনশীলতা কি কবির নিজের নাকি সমাজের?

সাজ্জাদ: সমাজের …।

আলতাফ: তার সমাজের সংবেদনশীলতাটা নিয়ে কবি কেবল নাড়াচাড়া করেন।

সাজ্জাদ: সমাজের থাকে, কবির নিজের থাকে। এর মধ্যে যেগুলোর সঙ্গে কবির মিল হয় তিনি সেগুলো গ্রহণ করেন।

আলতাফ: তার মানে কী হলো? কবি কি নতুন সংবেদনশীলতা তৈরি করলেন না কি সমাজের নতুন সংবেদনশীলতা নিয়ে কাজ করলেন তিনি?

সাজ্জাদ: এটা হচ্ছে ইন্টার‌্যাকটিভ প্রসেস। একটা সময়ে তো আর একটা মাত্র সংবেদনশীলতা তৈরি হয় না। অজস্র। ধরুন একই সময়ে কাজ করছেন দশজন কবি। এই দশজন কিন্তু ইনডিভিজ্যুয়ালও বটে। তাদের চৈতন্যের গড়ন আলাদা। এখন এদের কোনো একজন সমাজের যেসব সংবেদনশীলতার প্রতি অ্যাটইজ ফিল করেন, সেগুলো ধারণ করেন, গৃহীত হয় তার চৈতন্যে। এরপর তা চেঞ্জ হয়ে যায়, মানবিকীকৃত হয়। তার নিজের উপলব্ধির সংযোগ ঘটে এর সঙ্গে। এর পর তিনি তা যখন এক্সপ্রেস করেন তখন তা কালচারের ওপর প্রভাব ফেলে। এখন কবি যে এটা সচেতনভাবে করেন, সবসময় তা নাও হতে পারে। তিনি কবিতাটাই লেখেন। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়াটা ঘটে যায়।

রাহমান: এলিয়ট বলেন যে, আ পোয়েট, আ গ্রেট পোয়েট বিকামস দ্য ভয়েস অফ হিজ ট্রাইব।

আনিসুল: তার মানে কী হলো, সে তো সময়েরই ভয়েস হলো কেবল।

সাজ্জাদ: কী বলবো, কবি তো মেশিন না, রোবট না, বা অ্যামপ্লিফায়ার না যে তিনি কেবল প্রাপ্ত আওয়াজটাকে বাড়িয়ে দেবেন। তিনি তো মানুষ। তার ভেতরে যখন সংবেদনশীলতা ঢোকে, তিনি তো নিজের চৈতন্যের ওপর তার ছাপ নেন। তাকে মানবিকীকৃত করে ফেলেন। তিনি অনেক নতুন মালমশলা যুক্ত করেন এর সঙ্গে। আর তিনি যখন তা এক্সপ্রেস করেন, তা তো করেন তার ভাষার মাধ্যমে। সেই ভাষার আছে একটা সাংস্কৃতিক ইতিহাস। ভাষা একটা সামাজিক সম্পত্তি। কবি যখন ভাষার মাধ্যমে এক্সপ্রেস করেন তখন তা কিন্তু অনেকগুলো চৈতন্যের ওপর কাজ করে। ফলে কবির কবিতা লেখার প্রক্রিয়াটি ব্যক্তিগত হলেও কাজটা হয় সামাজিক। তার মানে কী? কবিকে যখন বলা হয় ভয়েস অফ দ্য টাইম তখন একারণেই বলা হয় যে তিনি একই সঙ্গে সমাজের সংবেদনশীলতাকে ধারণ করেন এবং নিজের চেতনাও তার ওপর আরোপ করেন।

রাইসু: দি ক্রিয়েটর অফ দ্য টাইম।

রাহমান: কবির নিজের স্বর থাকতেই হবে। তা এরকম হবে যে একটা সময়কে তিনি ধারণ করবেন, তারপর তা তার ভেতরে জারিত হয়ে রসায়নের মাধ্যমে তার ভেতর থেকে প্রকাশিত হবে।

সাজ্জাদ: সুতরাং তিনি নতুন সময়ের জন্মও দেন।

আলতাফ: তার মানে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো — যে সময়ের কণ্ঠস্বর হচ্ছেন কবি।

রেজা: ঠিকই আছে। কিন্তু আমার মনে হয় দুটো দিক আছে এর। একটা হলো যে এই যেমন শামসুর রাহমান একজন কবি, তিনি হলেন তার সময়ের সমাজের কণ্ঠস্বর। আবার আমার এরকম মনে হয়েছে আবুল হাসান তার সময়ের সমাজের কণ্ঠস্বর হলেও তার একটা তির্যক দেখার ভঙ্গি আছে, যা ¯ূ'ল ক্লেদাক্ত শিথিল প্রবাহের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। আমার মতে এই দুটো ধারা আছে।

সাজ্জাদ: তবে আবুল হাসান কিন্তু, বুঝলে রেজা, সত্তরে দশকে কিছু ভাবালু রোমান্টিকতাও তৈরি করেছেন। ভাবালু রোমান্টিকতার এসময়ের জনক হলেন আবুল হাসান। এর একটা প্রভাব কিন্তু পড়েছে এসময়ের পপুলার কালচারের ওপর। তুমি কিন্তু একাই আবুল হাসানের ভক্ত না, সত্তরের দশকের কবিতার যারা পাঠক তাদের অনেকেই আবুল হাসানের ভক্ত। এখানে উপস্থিত মুনির রানাও তাঁর ভক্ত। আমিও ছিলাম এক সময়।

আনিসুল: এটা আবুল হাসানের শক্তিরই পরিচয়।

রেজা: সে কারণেই আমি বলেছিলাম যে ব্যাপারটা ঠিক –

রাহমান: সে কারণে আমি গোড়াতেই বলেছিলাম কবিতা নিয়ে আলোচনাটা কোনো সহজ কাজ নয়। ইট ইজ লাইক আ কানাগলি, গোলকধাঁধা।

আনিসুল: শেষ পর্যন্ত কি গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেলাম আমরা?

রাইসু: আমরা আবুল হাসানকে গোলকধাঁধা বলছি — এটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না।

(সমস্বর উচ্চ হাসি।)

রাইসু: আবুল হাসানকে গোলকধাঁধা বলতে পারি না আমরা। আবুল হাসান যেসব ভুল আবেগ তৈরি করেছেন, আমরা সেসবের কথা বলতে পারি। এটা সমাজের কী রকম ক্ষতি করতে পারে তা আমরা দেখতে পারি।

রেজা: আমার মনে হয় ব্যক্তির অভিব্যক্তি বিভিন্ন রকম হবেই। সেক্ষেত্রে আমরা সহস্র বছর তর্ক করতে পারি।

(সবাই হৈ চৈ করে কথা বলতে থাকেন এক সঙ্গে।)

আনিসুল: আচ্ছা ভুল আবেগ জিনিসটা কী রকম?

রাইসু: আচ্ছা ঠিক আছে, আমি শুধরে নিচ্ছি। ভুল আবেগ নয়, ভুয়া আবেগ।

(প্রচণ্ড শব্দে হেসে ওঠে সবাই।)

আনিসুল: আবেগ আবার ভুয়া হয় কী করে?

রাইসু: সেটা এরকম যে — এই যেমন 'আমার এখন চাঁদ দেখতে খারাপ লাগে' — এর মধ্যে এমন একটা ভঙ্গি আছে যেন বলা হচ্ছে যে, দ্যাখো, আমার খারাপ লাগে, তোমাদের হয়তো লাগে না। আমি তোমাদের চেয়ে একটু অন্যরকম।

(সমস্বর হাসি।)

রেজা: এই যে আপনি এত বড় বড় চুল রেখেছেন এটা কি অন্যরকম দেখানোর জন্য নয়?

রাইসু: আমি তো আর কাউকে ডেকে দেখাচ্ছি না।

আনিসুল: কবি তো ডেকে বলেন না বলেই লেখেন।

রাইসু: কিন্তু আবুল হাসান তো ডেকে দেখায়, যে, দ্যাখো, আমার এখন চাঁদ দেখতে খারাপ লাগে।
আনিসুল: কবি মাত্রেই তাই করে। আমার এখন কী রকম লাগছে তোমরা পড়ে দ্যাখো।

রাইসু: আরেকটা বিষয় আছে — আবুল হাসানের বয়স অনুযায়ী তাঁর আবেগটা কেমন যেন মেলে না। কিছু নাবালক আবেগ আছে তার ভেতর। একটা তেত্রিশ বছরের লোকের মধ্যে তের বছর বয়সের আবেগ।

রেজা: ঘটনাটা যদি একজন কবির বেলায় ঘটে তাহলে আমি বলবো তা ঠিকই আছে। পঞ্চাশ বছরের কবিও শিশুর মতো সরল হতে পারেন।

(প্রবল তর্ক, সকলেই একসঙ্গে। বোঝা যায় না কারো কথা।)

আদিত্য: বৈজ্ঞানিকভাবেই কথাটা ঠিক নয়। পঞ্চাশ বছর বয়সে একজন মানুষের মস্তিকের অনেক কোষই ক্ষয় হয়ে যায়।

সাজ্জাদ: রেজা, আনিসুল হক আর রাইসুর বিতর্ক থেকে আমরা বুঝতে পারবো আমাদের সময়ে কবিতার জনপ্রিয়তা কেন কমে যাচ্ছে।

আনিসুল: কবিতা কি কোনোকালেই খুব জনপ্রিয় ছিল?

সাজ্জাদ: ছিল। কালীদাসের কালে ছিল, চৈতন্যদেবের সময়ে ছিল। ছিল না এটা বলা ঠিক নয়।

আনিসুল: তাহলে আমাদের কালে কবিতার জনপ্রিয়তা হারোনোর কারণটা কী?

সাজ্জাদ: কবিদের কিন্তু অহমিকা একটা আছে। বাজারে সকল পণ্যই বিক্রি হয়। কবিতাটা বিক্রি হচ্ছে কম। মানে কবিতার পণ্যমূল্য খুব বেশি না। ফলে কবিদের একটা আলগা অহমিকা তৈরি হয়। তারা বলেন যে, আমি তো খুব গুরুত্বপূর্ণ কবি, আমার মার্কেট দরকার নেই। আমি মহৎ।

(প্রবল তর্ক, সমস্বরে।)

আনিসুল: আমি কবিতা লিখি কেন? কবিতা লিখে আমি গুরুত্বপূর্ণ হতে চাই, মহিলাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

রাইসু: এটা আপনি কবিতার চাইতে গদ্যকার্টুন দিয়ে ভালো পারেন। সুতরাং এ কারণে যে আপনি কবিতা লেখেন এটা ঠিক নয়।

আনিসুল: গদ্য লিখে হয় না সেটা। যখন কেউ বলে যে দ্যাখো লোকটা কবি, কবিতা লেখে। তখন আরো বেশি ভালো লাগে। আমার নিজের মত হচ্ছে, মানুষ শেষ পর্যন্ত নিজেকে নিজে স্যাটিসফাই করার জন্য কবিতা লেখে।

সাজ্জাদ: যা হোক কবি মনে করেন পাঠককে আরো শিক্ষিত হতে হবে তার কবিতা বোঝার জন্য। পাঠককে আগে আইনস্টাইন বুঝে আসতে হবে তারপর আমার কবিতা। আমি কিন্তু এর ঘোরতর বিরোধী। কারণ কবিতা হচ্ছে কালচারাল এক্সপ্রেশন। যে কেউ পারটিসিপেট করতে পারে এতে। এটা ই ইকুয়েলস টু এমসি স্কোয়ার না।

আদিত্য: আরেকটা কথা হলো ই ইকুয়েলস টু এমসি স্কোয়ার দিয়ে অ্যাটম বোমা বানানো যায়। কবিতা দিয়ে সত্যি সত্যি একটা ওরকম বোমা কেউ বানিয়ে দেখাক দেখি।

কায়সার: কবিতা অক্ষম অস্ত্র আমার।

সাজ্জাদ: ফলে, আমি মনে করি কবিরা বহুদিন পাঠকদের অবহেলা করেছেন। তার ফল হচ্ছে পাঠকরা কবিদের প্রত্যাখ্যান করেছে।

রাইসু: এটা কি সত্যি?

সাজ্জাদ: অফকোর্স অবহেলা করেছে। তারা নিরীক্ষার নামে অহেতুক দুর্বোধ্য করেছে কবিতাকে। আমি মনে করি গৌণ কবিরা নিরীক্ষা করেন, মৌলিক কবিরা তা করেন না। নিজের কথাটা লিখে যান তারা।

কায়সার: এই তর্ক তো জীবনেও শেষ হবে না। রাহমান ভাই, আপনি একটা মধুরেণ সমাপয়েৎ করে দিন।

রাহমান: টয়লেটে গিয়ে আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম। দেখি বদনা থেকে পানি বেরুচ্ছে। আমি তা ব্যবহার করতে পারছি না। কারণ বদনায় একটা ছিদ্র আছে। ছিদ্র দিয়ে সব পড়ে গিয়ে খালি হয়ে যাচ্ছে বদনাটা। আমাদের আড্ডাটাও এ রকম।

কায়সার: ছিদ্রটা বন্ধ করে দিন রাহমান ভাই।

সাজ্জাদ: রীতিমতো হেগেলীয় উপমা। কবিতা নিয়ে হেগেলের একটা কথা আছে। তিনি বলেছেন কবিতা হলো আবর্জনা। ইতিহাসের আবর্জনা। মানে পৃথিবী তার প্রকৃত ইতিহাসের দিকে পৌঁছুনোর জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই পরম লক্ষ্যের সঙ্গে বর্তমান ইতিহাসের ফাঁক গলিয়ে যেসব আবর্জনা বেরিয়ে আসছে তা হলো কবিতা।

আনিসুল: আলতাফ ভাই কিছু একটা বলেন।

আলতাফ: আমার কথা হলো কবিতা যদি ভেতর থেকে আসে তাহলেই তা লেখা যায় অন্যথায় নয়।

আনিসুল: আলতাফ ভাই আপনি কোন দশকের কবি।

আলতাফ: আমি দশক টশকের হিসাব মানি না। আমি তো এখনও লিখছি। যারা দশক বিভাজন করে তারা আমাকে ষাটের দশকে ফেলে।

আনিসুল: আপনি তো এখনও লিখছেন। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি এমনকি সাম্প্রতিক কবিতাও পড়েছেন। আপনার কি মনে হয় বর্তমান কবিতায় কোথাও কোনো পরিবর্তন ঘটছে। কোনো স্পষ্ট বাঁক কি দেখছেন?

আলতাফ: বেশি দিন না, কবছর হলো চোখে পড়ছে পরিবর্তন। ভাষা বদলাচ্ছে, ভঙ্গি বদলাচ্ছে।

আনিসুল: ভাষায় ভঙ্গিতে ফ্যাশনে মননে যদি আশির কোনো কোনো কবি দাঁড়িয়ে যান, তাহলে রাহমান ভাইদের কবিতা কি চামড়ায় বাঁধানো ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত রচনাবলীতে পরিণত হবে না? শেষ পর্যন্ত যা গবেষকদের কাজে লাগে, সমকালের আনন্দবেদনাকে ধারণ করতে পারে না বলে তা সাধারণ পাঠককে আনন্দ দেয় না।

আদিত্য: এবাবে বললে বুদ্ধদেব বসু অনেকখানিই বাজে।

আনিসুল: বুদ্ধদেব বসু পড়েন, আমার ধারণা, যারা বাংলা সাহিত্য পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারা। রাহমান ভাই, আপনাকে যে বলা হয় আপনি জীবনানন্দ দাশের অনুসারী। আমার তো মনে হয় আপনি বুদ্ধদেবের অনুসারী।

রাহমান: কবিতা, কবিতাই বা বলি কেন, সাহিত্য যে ভালোবাসার জিনিস, এটা আমি শিখেছি বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকে। অনেকে অধ্যাপনা করেন বাংলা ভাষায়, যারা সাহিত্য ভালোবাসেন না। সাহিত্য তো ভালোবাসার জিনিস। আমার বলতে লজ্জা নেই সাহিত্যকে ভালোবাসার ব্যাপারটা শিখেছি আমি বুদ্ধদেবের কাছ থেকে। বুদ্ধদেব আমার শিক্ষক।

সাজ্জাদ: শিক্ষক, কিন্তু আমার মনে হয়েছে তিনি ভুল শিক্ষক।

রাহমান: সেটা একেকজনের একেকরকম মনে হতে পারে।

কায়সার: কবি হিসেবে তাকে ছোট বড় যাই বলা হোক না কেন, তিনি কিন্তু একজন ভালো সংগঠক।

সাজ্জাদ: হ্যাঁ, এটা ঠিক। তিনি কবিতায় এক ধরনের মানদণ্ড তৈরি করেছেন, কবিতা পত্রিকা বের করেছেন, অনেক নতুন কবি আবিষ্কার করেছেন।

(এসময় বাইরে হর্ন বাজে শামসুর রাহমানকে নিতে আসা গাড়ির। তিনি উঠে পড়েন। কেউ কেউ তাঁকে আরেকটু বসে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কেউ কেউ বলেন, রাহমান ভাই না হয় যান কিন্তু বাকিরা থাকুন। আমরা শেষ করি বাদবাকি প্রসঙ্গ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই আর বসেন না। বেলা ১টায় ভেঙে যায় আড্ডা।)

রোদ্দুর (চতুর্থ সংখ্যা, জুলাই ১৯৯৫) কবিতা সংখ্যা।