গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস:নিঃসঙ্গতার একশ বছর

আনিসুজ্জামান
Published : 5 March 2016, 07:45 AM
Updated : 5 March 2016, 07:45 AM

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর মতো আর কোনো উপন্যাস প্রকাশের পরপরই এতটা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে কিনা সন্দেহ। জনপ্রিয়তার বিচারে যেমন, তেমনি শিল্পকুশলতা আর শিল্পমুক্তির ক্ষেত্রেও এটি হয়ে উঠেছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কেবল স্প্যানিশ সাহিত্যেই নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেই একটি মাত্র উপন্যাসে ইতিহাস, আখ্যান, সংস্কার, কুসংস্কার, জনশ্রুতি, বাস্তব, অবাস্তব, কল্পনা, ফ্যান্টাসি, যৌন-অযাচার ও স্বপ্ন– সবকিছুর এমন স্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য সহাবস্থান আগে কখনও দেখা যায়নি।
ঠিক এই কারণে মারিও বার্গাস যোসা এটিকে বলেছিলেন এক সামগ্রিক উপন্যাস (Novela Total), আর পাবলো নেরুদা একে বলেছিলেন, "সের্বান্তেসের ডন কিহোতের পর স্প্যানিশ ভাষায় সম্ভবত মহত্তম উন্মোচন ("perhaps the greatest revelation in the Spanish language since Don Quixote of Cervantes.")
বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কিংবদন্তিতুল্য এই উপন্যাসটি মূলভাষা থেকে অনূদিত হয়নি। এই প্রথম এটি আনিসুজ্জামানের অনুবাদে মূল থেকে ধারাবাহিক অনূদিত হচ্ছে। বি. স.

অনুবাদ: আনিসুজ্জামান

———————————————————————————
ধারাবাহিক উপন্যাস । কিস্তি ৩৩

মেমে তখন বয়সের দিক থেকে পরিপূর্ণ। সে সুন্দরী ছিল না যেমনটি আমারান্তাও কখনই ছিল না সুন্দরী, কিন্তু তার বদলে সে ছিল হাসিখুশি,সরল এক মেয়ে, যার ছিল প্রথম সাক্ষাতেই লোকজনের প্রিয়পাত্র হবার মত গুণ, ছিল আধুনিক একটা মন যা নাকি ফেরনান্দার সেকেলে সঙ্কীর্ণ ও আবদ্ধ মনকে করে আহত আর অন্যদিকে আউরিলিয়ানো সেগুন্দ আনন্দ পায় সেটাকে উৎসাহ যুগিয়ে। সে-ই মেমেকে ছেলেবেলা থেকে ব্যবহৃত শোবার ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসে যে ঘরে সেন্টদের ভীতিপ্রদ চোখগুলো ওর বয়ঃসন্ধিকালের আতঙ্ককে এখনও খোরাক যোগায় আর রাজকীয় বিছানা, বিশাল ড্রেসিং টেবিল, মখমলের পর্দা দিয়ে এক ঘর সাজায়, আর খেয়ালই করে না যে নিজের অজান্তেই সে পেত্রা কতেসের ঘরের দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরি করে ফেলেছে। মেমের প্রতি সে এতই দিলদরিয়া ছিল যে নিজেও জানত না ওকে কত অর্থ দিচ্ছে, কারণ মেমে নিজেই তার পকেট থেকে টাকা বের করে নিত আর কলা কোম্পানির কমিসারিতে যত ধরনের নিত্যনতুন সৌন্দর্যবর্ধক জিনিসপত্র আসতো আউরেলিয়ানো সেগুন্দ সেগুলোর কথা ওকে জানাত। নখ পালিশ করার জন্য ঝামা পাথরের পুটলি, চুল কোঁকরা করার উপাদান, চোখের দৃষ্টিতে স্বপ্নালু ভাব আনার ড্রপ, নিত্য নতুন সাজার জিনিসে মেমের ঘর এমনভাবে ভরে ওঠে যে প্রতিবারই ফেরনান্দা যখন ওর ঘর গোছানোর জন্য যেত, ড্রেসিং টেবিলটা ফরাসি রমণীদের টেবিলের মত মনে করে চিন্তিত হয়ে মর্মাহত হত। তখন ফেরনান্দার সময় বিভক্ত ছিল দুটো কাজে; জেদী, রুগ্ন আমারান্তা উরছুলার জন্য ও অদৃশ্য ডাক্তারদের সঙ্গে পত্রবিনিময়ের মধ্যে। ফলে যখন সে বাবা ও মেয়ের মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতা লক্ষ করে, আউরেলিয়ানো সেগুন্দর কাছ থেকে একমাত্র যে প্রতিশ্রুতি সে আদায় করে তা হচ্ছে কখনই মেমেকে পেত্রা কতেসের বাড়িতে না নেবার। আসলে এই সতর্কতার কোনো প্রয়জন ছিল না কারন আউরেলিয়ানো সেগুন্দর উপপত্নী তার সঙ্গে মেয়ের ঘনিষ্ঠতায় এতই বিরক্ত ছিল যে মেমের নামটাও শুনতে পারত না। এক অজানা আতংক তাকে উত্যক্ত করে তুলত; তার সহজাত প্রবৃত্তি যেন ওকে বলে দিচ্ছিল, শুধুমাত্র ইচ্ছে করলেই ফেরনান্দা যা করতে পারেনি, মেমে তা সহজেই করতে পারবে; তাকে বঞ্চিত করতে পারবে এমন এক ভালবাসা থেকে যা কিনা আমৃত্যু নিজের জন্য নিশ্চিত বলে জানত। প্রথমবারের মত আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে উপপত্নীর কঠোর মুখ ও তীব্র ক্ষোভ সহ্য করতে হয়, এমনকি সে ভয়ও পায় যে তার এ বাড়ি ও বাড়ি করা তোরঙ্গগুলো আবার স্ত্রীর বাড়ির রাস্তায় রয়েছে। অবশ্য সেরকমটি ঘটে না। কেউই পেত্রা কতেসের চাইতে ভাল করে তার প্রেমিককে চিনত না, আর ভাল করেই জানত একবার তোরঙ্গগুলো পাঠানো হলে সেগুলো সেখানেই থেকে যাবে কারন আউরেলিয়ানো সেগুন্দো যদি কোনকিছুকে অপছন্দ করে তা হচ্ছে বাড়ি বদল বা পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবনটাকে জটিল করে তলা। ফলে তোরঙ্গগুলো থেকে যায় যেখানে ছিল সেখানেই আর পেত্রা কতেস নিজেকে নিয়োগ করে একমাত্র সেই অস্ত্রগুলো ধার দিয়ে স্বামীকে পুনরায় জয়ে যে অস্ত্রগুলো দিয়ে মেয়ে তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। সেটাও ছিল এক অপ্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা কারন বাবার নিজস্ব ব্যাপারগুলোতে হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছে মেমের কখনই ছিল না, আর সে ইচ্ছে যদি থাকতও, তাহলে সেটা যেত উপপত্নীর পক্ষে। কাউকে বিরক্ত করার মত সময় তার বেঁচে থাকত না। সে নিজেই শোবার ঘর ঝাড়ু দিত, বিছানা ঠিক করত যেভাবে নানরা ওকে শিখিয়েছিল, সকালে সে তার পোশাকের পরিচর্যা করত বারান্দায় এমব্রয়ডারি করে বা হাত কলে সেলাই করে। অন্যেরা যখন দুপুরে ঘুমুত সে তখন দুঘণ্টা ধরে ক্লাভিকর্ড অনুশীলন করত; জানত যে প্রতিদিনের দুঘণ্টার এই স্বার্থত্যাগ ফেরনান্দাকে শান্ত রাখবে। একই কারণে ধর্মীয় মেলায় ও স্কুলের অনুষ্ঠানগুলোর কনসার্টগুলোতে নিজের সব কিছু উজাড় করে দিত যদিও আস্তে আস্তে তার ডাক কমতে থাকে। সন্ধ্যে হলে প্রসাধন সেরে সাদাসিদে পোশাক গায়ে চড়িয়ে উঁচু জুতা পায়ে গলিয়ে যদি বাবার সঙ্গে কিছু করার না থাকত তবে বান্ধবীদের বাড়ি যেত যেখানে থাকত রাতের খাবারের সময় হওয়া পর্যন্ত। আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর সঙ্গে সিনেমায় যাওয়াটাই ছিল তার একমাত্র বাতিক্রম।
——————————-

আর্হেন্তিনার বুয়েনোস আইরেস-এর
এদিতোরিয়াল সুদামেরিকানা প্রকাশনী থেকে
প্রকাশিত 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' উপন্যাসের
প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ

——————————-


বান্ধবীদের মধ্যে আমেরিকার তিনটি মেয়েই বিদ্যুতায়িত মুরগীর জালের বেড়া ভেঙে মাকন্দের মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে । ওদের একজন ছিল পাত্রিসিয়া ব্রাউন। আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর আতিথেয়তায় কৃতজ্ঞ ব্রাউন সাহেব মেমের জন্য তার দুয়ার খুলে দেয়, আর শনিবারের নাচের আমন্ত্রন করে ওকে, যে নাকি গ্রিংগো-দের ( সাদা চামড়ার লোক) মাঝে ছিল একমাত্র স্থানীয়। ফেরনান্দা যখন ব্যাপারটা জানতে পারে তখন আমারান্তা উরসুলা ও অদৃশ্য ডাক্তারদের কথা ভুলে গিয়ে বিশাল এক নাটকীয়তার সৃষ্টি করে। "ভেবে দেখ"- বলে মেমেকে –" কবর থেকে করনেল কি ভাববে"। অবশ্যই উরসুলার সমর্থন সে আশা করছিল। কিন্তু সেই প্রচীন মহিলা, সকলে যা আশা করছিল তার সম্পূর্ণ উল্টো; তার মতে নাচের আসরে যোগ দিয়ে ওর একই বয়সের দক্ষিণ আমেরিকার মেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার মধ্যে রাগ হবার মতো কিছু নেই, যদি সে নিজের নীতিতে অটল থাকে ও নিজেকে প্রটেস্টান্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত না করতে দেয়। মেমে তার পর দাদীর চিন্তাধারা ভাল করেই বুঝতে পারে, এবং নাচের পরেরদিন খুব ভোরে ওঠে মাস-এ যাবার জন্য। যতদিন পর্যন্ত না দক্ষিণ আমারিকানরা তার ক্লাভিকরড বাজানো শুনতে চেয়েছে এই খবর দিয়ে মেমে তোলপাড় শুরু করে , ততদিন পর্যন্ত ফেরনান্দার বিরোধিতা অনড় থাকে। যন্ত্রটা আর একবার বাড়ি থেকে বের হয় ও ওটাকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রাউন সাহেবের বারি, যেখানে তরুনী বাদিকা আন্তরিক বাহবা পায় ও পায় উষ্ণতম অভিনন্দন। সেই থকে শুধুমাত্র সে নাচেরই নিমন্ত্রণ পায় না, পায় রোববারে সুইমিং পুলে যোগ দেবার ও সপ্তাহে একবার দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রন। মেমে পেশাদারদের মত সাঁতার শেখে, খেলতে শেখে টেনিস, আর শেখে আনারসের ফালি দিয়ে ভার্জিনিয়া হ্যাম খেতে। নাচ, সুইমিং পুল ও মধ্য দিয়ে দ্রুত তার ইংরেজির জড়তা কাটতে থাকে। মেয়ের উন্নতিতে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো এতই উৎসাহী হয় যে এক ভ্রাম্যমান বিক্রেতার কাছ থেকে রঙিন ছবিওয়ালা ছয় খণ্ডের বিশ্বকোষ কেনে যেগুল মেমে তার অবসরে পড়তো। আগে সে যে সময় ব্যয় করত প্রেমিক প্রেমিকাদের নিয়ে গল্পের মধ্যে বা বান্ধবীদের নিয়ে পরীক্ষামূলক ঘরে আবদ্ধ হবার পেছনে, তা এখন লাগায় পড়ার পেছনে, তার কারন এই নয় যে তার উপর নিয়ম করে এটা চাপানো হয়েছে বরঞ্চ এর কারন হচ্ছে সর্বসাধারণের গুপ্তরহস্যের ব্যাপার নিয়ে আলাপের উৎসাহ সে এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। তার মনে পরে যায় শৈশবের মাতাল হবার দুঃসাহসিক ঘটনাটাকে, আর ব্যাপারটাকে এতই মজাদার মনে হয় যে সে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে সে তা জানায় আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো মজা পায় ওর থেকেও বেশী, " যদি তোর মা জানতে পারত" – বলে ওকে হাসতে হাসতে খাবি খেতে খেতে; যেমনটি সে সব সময়ই বলত মেয়ের কাছে গোপন কিছু বলার সময়। সে একই বিশ্বাসের ভিত্তিতে মেয়ের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছে যে মেয়ের প্রেম সম্পর্কিত যে কোন ব্যাপারই সে বাবাকে জানাবে আর বাবা মার সঙ্গে ছুটি কাটাতে আসা লালচুলো এক দক্ষিণ আমেরিকান যুবককে ভাল লাগার কথা মেমে জানায় ওকে। " কি কান্ড" – হাসে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো –" যদি তোর মা জানতে পারত"। কিন্তু মেমে এও বলে যে যুবক তার দেশে ফিরে গিয়েছে আর কখনই তার দেখা পাওয়া যায় নি। মেমের পরিণত বিচারবুদ্ধি বাড়িতে শান্তি বজায় রাখে। তখন আউরেলিয়ানো সেগুন্দো পেত্রা কতেসকে আরও বেশী সময় দিত। যদিও তার দেহমনে আগের মত পার্টি করার সামর্থ্য থাকে না তারপরও জুতোর ফিতে দিয়ে বিড বাঁধা আর্কাডিইয়ানটা বের করে সর্বসমক্ষে বাজানোর সুযোগ সে হাতছাড়া করত না। বাড়িতে আমারান্তা বুনে চলে ওর অন্তহীন শবাচ্ছাদন বস্ত্র আর বার্ধক্য দ্বারা অন্ধকারের গভীর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া উরসুলার কাছে একমাত্র যা দৃশ্যমান তা হল চেষ্টনাটের নীচে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার প্রেতাত্মা । ফের্নান্দা তার কর্তৃত্ব পাকা করে ফেলে । ছেলে হোসে আর্কাদিওর কাছে তার লিখা মাসিক চিঠিতে আর এক লাইনও মিথ্যে থাকে না, শুধুমাত্র গোপন রাখে অদৃশ্য চিকিৎসকদের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগের ব্যাপারটা, যারা তার বৃহদান্ত্রের মধ্যে এক অক্ষতিকারক টিউমার পেয়েছে আর তারা প্রস্ততি নিচ্ছে এক টেলিপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য ।
(চলবে)