গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস:নিঃসঙ্গতার একশ বছর

আনিসুজ্জামান
Published : 25 Jan 2016, 07:36 AM
Updated : 25 Jan 2016, 07:36 AM

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর মতো আর কোনো উপন্যাস প্রকাশের পরপরই এতটা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে কিনা সন্দেহ। জনপ্রিয়তার বিচারে যেমন, তেমনি শিল্পকুশলতা আর শিল্পমুক্তির ক্ষেত্রেও এটি হয়ে উঠেছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কেবল স্প্যানিশ সাহিত্যেই নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেই একটি মাত্র উপন্যাসে ইতিহাস, আখ্যান, সংস্কার, কুসংস্কার, জনশ্রুতি, বাস্তব, অবাস্তব, কল্পনা, ফ্যান্টাসি, যৌন-অযাচার ও স্বপ্ন– সবকিছুর এমন স্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য সহাবস্থান আগে কখনও দেখা যায়নি।
ঠিক এই কারণে মারিও বার্গাস যোসা এটিকে বলেছিলেন এক সামগ্রিক উপন্যাস (Novela Total), আর পাবলো নেরুদা একে বলেছিলেন, "সের্বান্তেসের ডন কিহোতের পর স্প্যানিশ ভাষায় সম্ভবত মহত্তম উন্মোচন ("perhaps the greatest revelation in the Spanish language since Don Quixote of Cervantes.")
বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কিংবদন্তিতুল্য এই উপন্যাসটি মূলভাষা থেকে অনূদিত হয়নি। এই প্রথম এটি আনিসুজ্জামানের অনুবাদে মূল থেকে ধারাবাহিক অনূদিত হচ্ছে। বি. স.

অনুবাদ: আনিসুজ্জামান

———————————————————————————
ধারাবাহিক উপন্যাস । কিস্তি ৩২

মেমের শেষের দিকের ছুটিগুলো পরে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মৃত্যুতে শোকপর্বের সময় । অবরুদ্ধ বাড়িতে পার্টি করার মত অবস্থা ছিল না । সবাই কথা বলত ফিসফিসিয়ে, খাওয়া দাওয়া সারত নীরবে, জপমালা জপত দিনে তিনবার, এমনকি সিয়েস্তার গরমের সময়েও ক্লাভিকর্ডে বাজত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সুর । গোপনে বিদ্বেষ পোষন করলেও শোকপালনের কঠোরতা ফের্নান্দাই আরোপ করে কারণ সরকার কর্তৃক মৃত শত্রুর শোক পালনের আড়ম্বর তাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিল । আগের অভ্যেস মতই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো মেয়ের ছুটির দিনগুলোতে বাড়ি ঘুমুতে আসলে ফের্নান্দা, আইনানুগ স্ত্রীর অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য কিছু করে থাকবে কারণ পরের বছর মেমে তার এক সদ্যজাত বোন পায় ফের্নান্দার অমতেই যাকে ব্যাপটাইজ করা হয় আমারান্তা উরসুলা নাম দিয়ে ।

মেমের লেখাপড়ার পর্যায় শেষ হয়ে গিয়েছিল । কনসার্ট বাজিয়ে হিসেবে পাওয়া ডিপ্লোমাটা সঠিক অনুমোদন পায় যখন সে তার পাঠ সমাপ্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অসাধারণ নৈপুন্যের সাথে সমাপ্তি ঘটে শোকপর্বের । আমন্ত্রিতরা তার শিল্পকলার দক্ষতার চাইতেও বেশী তারিফ করে তার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী চরিত্রের জন্য । তার শিশুসুলভ প্রগলভতার জন্য কোন ভারিক্কি কাজের জন্য তার কথা চিন্তা করা যেত না কিন্তু যখন সে ক্লাভিকর্ডের সামনে বসত তখন রূপান্তরিত হত সম্পূর্ণ অন্য এক মেয়েতে যাকে মনে হতা পরিণতবয়ষ্কা । সবসময়ই সে এরকম ছিল, সত্যি বলতে ওর সুনির্দিষ্ট কোন ঝোঁক ছিল না কিন্তু মায়ের মতের বিরুদ্ধে কিছু না করার ইচ্ছেয় অনমনীয় নিয়মানুবর্তিতা দিয়ে সে অর্জন করে স্কুলে সবচেয়ে ভাল ফলাফল, ওকে যেকোন অন্য বিষয়ে পড়ালেখা করতে দিলেও সে একই রকমের ফলাফলই অর্জন করত আর শুধুমাত্র মায়ের একরোখা চরিত্রকে না মাড়ানোর জন্যই সে ক্লাভিকর্ডের অনুশীলনের চাইতেও আরও বেশী কিছু ত্যাগ স্বীকার করার ক্ষমতা ছিল তার ।

——————————-

আর্হেন্তিনার বুয়েনোস আইরেস-এর
এদিতোরিয়াল সুদামেরিকানা প্রকাশনী থেকে
প্রকাশিত 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' উপন্যাসের
প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ

——————————-


গ্রাজুয়েশনের দিনে সে অনুভব করে পথিক, অক্ষরে লিখা পার্চমেন্ট কাগজের বড়হাতের বর্ণগুলো থেকে এক আপোষ যেটা সে যতটা না করেছে বাধ্যতার তার চেয়েও বেশী করেছে স্বাচ্ছন্দের কারণে আর সে ভাবে সেই সময় থেকে যে বাদ্যযন্ত্রটাকে নানারা যাদুঘরের ফসিল বলে গন্য করে সেটা নিয়ে এমনকি একরোখা ফের্নান্দা পর্যন্ত মাথা ঘামাবে না । প্রথম কয়েক বছর তার মনে হয় যে হিসেবে কোথায়ও গোলমাল হয়েছে কারণ বৈঠকখানাতে, শহরের অর্ধেক লোক ঘুমোনোর পর তার বাজনা শোনার জন্য লোক ডেকে আনাই নয় দাতব্য অনুষ্ঠানে,স্কুলের অনুষ্ঠানে, এমনকি মাকন্দোর জনহিতকর অনুষ্ঠানেও তার মা সদ্যআগত যাকেই মনে হয় যে তার মেয়ের গুণের সমঝদার হতে পারে, তাকেই সে আমন্ত্রণ করে । শুধুমাত্র আমারান্তার মৃত্যুর পর পরিবারের সকলে, যখন আবার এক শোকপর্বে প্রবেশ করে তখনই মেমে ওর ক্লাভিকর্ডিওকে তালাবদ্ধ করে চাবিটা পোশাকের ড্রয়ারে রেখে সেটার কথা ভুলে যায় আর ফের্নান্দাও কার দোষে কখন সেটা হারিয়েছে এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বিরক্ত হয় না । যেরকমের নিস্পৃহতা নিয়ে সে তার শিক্ষা শেষ করেছিল একই ধরনের নিস্পৃহতা নিয়ে মেমে বাজায় ঐ অনুষ্ঠানগুলোতে । ওটা ছিল তার মুক্তিমূল্য । ফের্নান্দা ওর বাধ্যবাধকযতায় এতই আপ্লুত হয় ও তার শিল্পের প্রশংসায় এতই গর্ববোধ করে যে বাড়িভর্তি বান্ধবী নিয়ে এলে বা প্লান্টেশনে সমস্ত বিকেল কাটালে অথবা আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বা কোন বিশ্বাসী মহিলার সঙ্গে সিনেমায় গেলে তাতে বাঁধা দেয় না । একমাত্র শর্ত ছিল যে সিনেমাটি ফাদার আন্তোনিও ইসাবেল দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে । ঐ চিত্তবিনোদনের মুহুর্তগুলোতেই মেমের সত্যিকারের ভাললাগা প্রকাশ পেত । ওর আনন্দ ছিল নিয়মশৃংখলার অপরপ্রান্তে, কোলাহলপূর্ণ পার্টিতে, প্রেমিকদের সঙ্গে প্যাঁচালে, বান্ধবীদের সঙ্গে লম্বা সময় ঘড়ে আবদ্ধ থাকায় যেখানে ওরা ধূমপান করতে শিখত ও পুরুষদের সম্বন্ধে আলাপ করত; যেখানে একবার তিন বোতল রাম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলায় মধ্যরাতে সবাই নগ্না হয়ে নিজেদের অঙ্গ মেপে একে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে । সেদিনের কথা মেমে কখনই ভুলতে পারবে না যেদিন সে নিজেদের মানসিক কষ্ট ওদেরকে বুঝতে না দিয়ে, যষ্টিমধু চিবুতে চিবুতে বাড়ি ঢুকে ফের্নান্দা ও আমারান্তাবাগ বিনিময় না করে খেতে থাকা টেবিলে বসে । তার আগে সে এক বান্ধবীর শোবার ঘড়ে দুই ঘন্টা দারুন সময় কাটিয়েছে যেখানে ভয়েও হাসতে হাসতে সে কেঁদে ফেলে । আর যেখানে কষ্টের অন্যদিকে খুঁজে পায় এক বিরল অনুভূতি, সে অনুভব করে তার দুঃসাহসের অভাব যেটাও প্রয়োজন ছিল স্কুল পালিয়ে মাকে এই কথাগুলো অথবা অন্য কথা দিয়ে বলা যে ক্লাভিকর্ডটা তার জন্য কোন অর্থবহন করে না । টেবিলের মাথায় চেয়ারে বসে পান করছিল মুরগীর স্যুপ যেটা তার পেটে পরছিল সর্বরোগের সিরাপের মত, যেটা তাকে দিচ্ছিল পুনর্জীবন, আর তখন মেমে দেখতে পায় ফের্নান্দা ও আমারান্তাকে ঘেরা বাস্তবতার এক অভিযোগপুর্ণ দীপ্তি । প্রচন্ড কষ্ট করতে হয়, এই শালীনতার অভিনয়, আত্মিক দৈন্য, মহত্বের প্রলাপ ওদের মুখের উপর ছুড়ে না মারার জন্য । দ্বিতীয়বার ছুটির সময়ই সে জেনে গিয়েছিল যে ওর বাবা বাড়িতে বাস করে শুধুমাত্র বাহ্যরূপ রক্ষার খাতিরে, আর ফের্নান্দা চেনার পর যেমন ওকে চিনত আর পরে পেত্রা কতেসকে জানার জন্য এক সাক্ষাতের ব্যবস্থার পর সে বাবার এই কাজে সায় দেয় ।এমনকি তার মনে হয় সে উপপত্নীর মেয়ে হলেই বরঞ্চ ভাল হতো । সুরার ঘোরের মধ্যে মেমে ভাবে কি কেলেংকারীই না হতো যদি সে সেই মুহূর্তে প্রকাশ করতে পারত নিজের চিন্তাকে, ভেবে মজা পায় আর তার এই দুষ্টুমীপনার পরিতৃপ্তি এতইও গভীর ছিল যে ফের্নান্দার চোখে ধরা পরে যায় ।

"কি হয়েছে"- জিজ্ঞেস করে ।
"কিছুই না"- উত্তর দেয় মেমে- "কেবলমাত্র আবিষ্কার করছি তোমাদের দুজনকে কি ভালবাসাই না বাসি" ।
আমারান্তা ভয় পেয়ে যায় বুঝতে পেরে যে, এই কথার পেছনে কতটা ঘৃণা লুকিয়ে আছে । কিন্তু ফের্নান্দা এতই অভিভূত হয়ে পরে যে যখন মেমে মধ্যরাতে প্রচন্ড ব্যথায় মাথা টুকরো টুকরো হয়ে যাবার অবস্থা নিয়ে জেগে ওঠে আর প্রচন্ড পিত্তবমি তখন তার পাগল হবার অবস্থা হয় । ওকে এক বোতল রেড়ির তেল খাওয়ায়,পেটে পুলটিশ দিয়ে সেঁক আর মাথায় দেয় বরফের ব্যাগ আর বাধ্য করে ফ্রান্স থেকে নবাগত এক উদ্ভট ডাক্তার দুই ঘন্টারও বেশী সময় নিয়ে পরীক্ষা করে দেয়া খাবার খেতে ও পাঁচদিন ঘরে আবদ্ধ থাকতে । কারন ডাক্তারের ধোঁয়াটে ধারণা অনুযায়ী তার মেয়েলী রোগ হয়েছে । সাহস দ্বারা তাড়িত, মনোবলহীন,করুন দশায় পরা মেমের এ অবস্থাকে সহ্য করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না । সম্পূর্ণ অন্ধ কিন্তু স্থির মস্তিষ্ক ও তখন পর্যন্ত কর্মক্ষম উরসুলাই হচ্ছে একমাত্র ব্যক্তি যে নাকি সঠিকভাবে অনুমানে রোগটা ধরতে পারে । "আমার মতে মাতালদেরই এ ধরনের উপসর্গ দেখা দেয় " কিন্তু সে চিন্তাটা শুধুমাত্র বাতিল করে দেয় তাই নয়, এ ধরনের হাল্কা চিন্তাভাবনার জন্য নিজেকে ভর্তসনাও করে । মেমের এই অসহায় অবস্থার জন্য আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বিবেকদংশন অনুভব করে ও প্রতিজ্ঞা করে ভবিষ্যতে মেয়েটার দিকে আরও ভাল করে নজর দেবার । আর এভাবেই বাপ মেয়ের গড়ে ওঠে এক আনন্দঘন বন্ধুত্বের সম্পর্ক যা নাকি ওকে কিছুদিনের জন্য রেহাই দেয় পার্টির তিক্ততাপূর্ণ নিঃসঙ্গতা থেকে আর মেমেকে মুক্তি দেয় ফের্নান্দার সর্বক্ষণের পাহাড়াদারী থেকে । অবশ্যম্ভাবী পারিবারিক সংকটকে তরান্বিত না করেই মেমের সঙ্গে থাকার জন্য । ওকে সিনেমায় বা সার্কাসে নেয়ার জন্য অন্য সবকিছুকে একপাশে সরিয়ে রাখত আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ও অবসরের বেশীরভাগ সময়ই কাটাতো ওর সঙ্গে । শেষের দিনগুলোতে তার অস্বাভাবিক স্থূলত্বের কারনে নিজের জুতার ফিতে বাঁধাও অসম্ভব হয়ে পরে তার পক্ষে আর সব ধরনের খাবারের প্রতি তার প্রচন্ড বাড়াবাড়ি তার মেজাজকেও করে তুলেছিল তিক্ত । নিজের মেয়েকে নতুন করে আবিষ্কারের পর আগের দিনের আমুদেভাব ফিরে আসে আর তার সঙ্গে থাকার আনন্দ ধীরে ধীরে তাকে অবক্ষয় থেকে সরিয়ে দেয়। মেমে তখন বয়সের দিক থেকে পরিপূর্। সে সুন্দরী ছিল না যেমনটি আমারান্তাও কখনই ছিল না ‍ুন্দরী, কিন্তু তার বদলে সে ছিল হাসিখুশি,সরল এক মেয়ে।

(চলবে)