গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস:নিঃসঙ্গতার একশ বছর

আনিসুজ্জামান
Published : 3 Jan 2016, 03:07 PM
Updated : 3 Jan 2016, 03:07 PM

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর মতো আর কোনো উপন্যাস প্রকাশের পরপরই এতটা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে কিনা সন্দেহ। জনপ্রিয়তার বিচারে যেমন, তেমনি শিল্পকুশলতা আর শিল্পমুক্তির ক্ষেত্রেও এটি হয়ে উঠেছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কেবল স্প্যানিশ সাহিত্যেই নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেই একটি মাত্র উপন্যাসে ইতিহাস, আখ্যান, সংস্কার, কুসংস্কার, জনশ্রুতি, বাস্তব, অবাস্তব, কল্পনা, ফ্যান্টাসি, যৌন-অযাচার ও স্বপ্ন– সবকিছুর এমন স্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য সহাবস্থান আগে কখনও দেখা যায়নি।
ঠিক এই কারণে মারিও বার্গাস যোসা এটিকে বলেছিলেন এক সামগ্রিক উপন্যাস (Novela Total), আর পাবলো নেরুদা একে বলেছিলেন, "সের্বান্তেসের ডন কিহোতের পর স্প্যানিশ ভাষায় সম্ভবত মহত্তম উন্মোচন ("perhaps the greatest revelation in the Spanish language since Don Quixote of Cervantes.")
বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কিংবদন্তিতুল্য এই উপন্যাসটি মূলভাষা থেকে অনূদিত হয়নি। এই প্রথম এটি আনিসুজ্জামানের অনুবাদে মূল থেকে ধারাবাহিক অনূদিত হচ্ছে। বি. স.

অনুবাদ: আনিসুজ্জামান

———————————————————————————
ধারাবাহিক উপন্যাস । কিস্তি ৩১

শেষের ক'বছর মানসিক মন্থরতার কারনে উরসুলা হোসে আর্কাদিওর পোপ হওয়া সম্পর্কিত পড়াশোনা আর দেখাশোনার সুযোগ খুব কম পেত, যখন হোসে আর্কাদিওকে ধর্মীয় স্কুলে দেবার জন্য তার প্রস্তত করার সময়। ওর বোন মেমে পূর্বনির্ধারিত বয়সে সন্যাসিনীদের স্কুলে ভর্তি হয় ফের্নান্দার কঠোরতা আর আমারান্তার তিক্ততার মধ্যে বড় হয়ে, আর সে স্কুলে ক্লাভিকর্ড বাজানোয় হয়ে ওঠে পটু। যেসব উপায় অবলম্বন করে উরসুলা শিক্ষানবীশ ভবিষ্যত পোপের দুর্বল সত্তাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে, তার কার্যকারিতা সম্বন্ধে ঘোর সন্দেহ বোধ করে মনোকষ্টে ভোগে নিজেই, কিন্তু এর জন্য নিজের প্রচন্ড বার্ধক্যকে বা জিনিষপত্রের চারপাশে ঢেকে রাখা কালো মেঘ, যেটা তাকে কোনরকমে দেখতে দেয়, সেগুলোকে দোষী না করে দোষে এমনকিছুকে যা কিনা সে নিজেই চেনে না, যাকে সে মনে করে ক্রমবর্ধমান সময়ের আগ্রাসন বলে । "এখন আর বছরগুলো আগের মত আসে না"- বলত মাঝেমধ্যে, যখন দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা তার হাত থেকে ফসকে যেত । আগে তার মনে হত শিশুদের বড় হতে অনেক সময় লাগে । অত সময় ব্যয় করে চিন্তাভাবনা না করে শুধুমাত্র, সবচেয়ে বড়, হোসে আর্কাদিওর জিপসিদের সঙ্গে চলে যাবার কথা, সাপের মত উল্কি গায়ে ফিরে এসে জোতির্বিদদের মত কথা বলার পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কথা, আমারান্তা ও আর্কাদিওর আদিবাসীদের ভাষা ভুলে কাস্তেয়্যানো (স্প্যানিশ ভাষা) শেখার পূর্বে যতসব ঘটেছে বাড়িতে সেগুলোর কথা মনে করলেই তা ভালভাবে বোঝা যায়। বোঝা যায় যখন মনে আসে চেষ্টনাটের নীচে কত রোদ বৃষ্টি সহ্য করতে হয়েছে অভাগা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে, এতসব যুদ্ধের পর মূমূর্ষু কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসার আগে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার মৃত্যুতে কত শোক পালন করতে হয়েছে, আর তখনও কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়নি । অন্য সময়ে সারাদিন মিসরির জীবজন্ত বানাবার পরও সময় বেঁচে থাকত বাচ্চাদের দেখাশুনা করার, ওদের চোখের সাদা অংশ দেখে রেড়ির তেল খাওয়ানো দরকার কিনা তা বোঝার। আর অন্যদিকে এখন, যখন কিছুই করার নাই, শুধুমাত্র সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হোসে আর্কাদিওকে পিঠে চড়িয়ে ঘোড়ায় চড়ার খেলা ছাড়া, তার পরও, এই দুঃসময়টা কাজ অর্ধসমাপ্ত করে ফেলে রাখতে বাধ্য করে তাকে। সত্যি বলতে উরসুলা নিজের বয়সের হিসেব হারিয়ে ফেললেও বার্ধক্যে বুড়িয়ে যাওয়াকে প্রতিরোধ করে চলত, আর বিরক্ত করত সবাইকে সব দিক থেকেই, সবকিছুতেই নাক গলানোর চেষ্টা চালাতো, আর যুদ্ধের সময় বৃষ্টি ধরে আসার অপেক্ষায় প্লাস্টার দিয়ে বানানো এক সেন্ট জোসেফের মূর্তি জামানত রেখে গিয়েছিল কিনা এই প্রশ্ন করে বহিরাগতদের উত্যক্ত করত। কখন থেকে যে সে দৃষ্টিশক্তি হারাতে শুরু করেছে তা কেউই জানে না। এমনকি জীবনের শেষের কবছরে যখন সে বিছানা থেকে উঠতে পারতো না তখনও মনে হত যে সে শুধুমাত্র জরার কাছেই হার মেনেছে, কিন্তু কেউই বুঝতে পারেনি যে সে দেখতে পেত না । হোসে আর্কাদিওর জন্মের আগে নিজেই সে খেয়াল করেছিল ব্যাপারটা। প্রথমদিকে তাঁর মনে হত এটা হচ্ছে সাময়িক দুর্বলতা আর গোপনে মজ্জার সিরাপ খেত ও চোখে মধু লাগাতো, কিন্তু খুব শগগিরই সে হার মানে অদম্য অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে অন্ধত্বের কাছে। এমনকি বৈদ্যুতিক আলোর আবিস্কার সম্পর্কেও পরিষ্কার কোনো ধারণা পায়নি সে, কারন যখন প্রথম বাল্বগুলো লাগানো হয় সে শুধু অনুভব করেছিল এক আলোর দ্যুতি। কাউকেই বলেনি কথাটা, কারন সেটা হত তাঁর অকর্মন্যতার এক প্রকাশ্য স্বীকৃতি। সে নিঃশব্দে নিজেকে সপে দেয় বস্তুদের মধ্যের দূরত্ব, মানুষের গলার স্বর শেখায়, যাতে করে স্মৃতির দ্বারা সে দেখতে সক্ষম হয় যখন চোখের ছানির ছায়ারা তাকে দেখতে দেবে না। আরও পরে সে জানতে পারবে ঘ্রানশক্তির সাহায্যের কথা যা কিনা আধারের মাঝে বস্তুর কলেবর ও রঙয়ের চাইতেও অনেক কার্যকর আর যেটা তাকে সবকিছু থেকে পদত্যাগের হাত থেকে রক্ষা করে। ঘরের অন্ধকারের মাঝেও সে সূচে সুতো পরিয়ে বোতাম লাগাতে পারত, জানত কখন দুধ প্রায় বলগ দেবার উপক্রম । প্রতিটি জিনিসের অবস্থান এমন নির্দিষ্ট করে জানত যে মাঝে মাঝে সে নিজেই ভুলে যেত তার অন্ধত্ব। একবার ফের্নান্দা বিয়ের আংটি হারিয়ে ফেলায় বাড়ি তোলপাড় করে ফেলে আর উরসুলা খুঁজে দেয় সেটা, বাচ্চাদের শোবার ঘরের এক তাক থেকে। মোদ্দা কথা অন্যরা যখন চলাফেরা করত অসতর্কতার সাথে সে তখন তাঁর চার ইন্দ্রিয় দিয়ে, সবাইকে অনুসরণ করত যাতে করে তাকে কেউই অসতর্কতার সুযোগে বিব্রত করতে না পারে, আর কিছুদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করে বাড়ির প্রতিটি সদস্য নিজের অজান্তেই প্রতিদিন একই জায়গা দিয়ে চলাফেরা করে, একই কাজ করে, এমনকি প্রায় একই সময় একই কথার পুনরাবৃত্তি করে। আর শুধুমাত্র তখনই যখন এই সুচারু নিয়মের বাইরে বেরোয়, কোনকিছু হারাবার ঝুঁকি থাকে। কাজেই যখন সে শোনে ফের্নান্দার আংটি হারিয়ে দিশেহারা অবস্থার কথা, তখন তার মনে পরে যে একমাত্র ব্যতিক্রমী যে কাজটা ফের্নান্দা করেছিল তা হচ্ছে মেমের মাদুরে এক ছাড়পোকা পাওয়া যাওয়ায় মাদুরটা রোদে শুকাতে দেওয়া, যেহেতু বাচ্চারা পরিষ্কার করায় সাহায্যের হাত লাগিয়েছিল, উরসুলা ভাবে একমাত্র যেখানে বাচ্চাদের নাগালের বাইরে ফের্নান্দা আংটিটা রাখতে পারে তাহলো ঐ তাক। অন্যদিকে ফের্নান্দার দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসই হারিয়ে যাওয়া জিনিস খোঁজার পথে বাঁধা সৃষ্টি করে, আর সে তা না জেনেই একমাত্র খুঁজে বেড়ায় ওর দৈনন্দিন চলাচলের জায়গাগুলোতে, আর একই কারনে জিনিষপত্র হারিয়ে গেলে তা খুঁজে পেতে সকলেরই এত কষ্ট হয় ।

হোসে আর্কাদিওর লালনপালনের কাজই বাড়ির সামান্যতম পরিবর্তনগুলোর খবর রাখার মত প্রাণান্তকর ব্যাপারে খুব সাহায্য করে। যখন সে বুঝতে পারত আমারান্তা শোবার ঘরের সেন্টদেরকে কাপড় পরাচ্ছে সে তখন ভান করত হোসে আর্কাদিওকে বিভিন্ন রঙয়ের পার্থক্য শেখাবার ।

"বল তো"- বলত ছেলেটাকে-"সেন্ট রাফায়েল আরকানহেলের(দেবদুত শ্রেষ্ঠ) পোশাকটা কি রঙয়ের?"

এভাবেই ছেলেটা ওকে তথ্য দিত যে তথ্যগুলো দিতে তাঁর চোখ অস্বীকার করে, আর এভাবেই ছেলেটা ধর্মীয় স্কুলে যাবার অনেক আগেই সে সেন্টদের কাপড়ের বুনুনী থেকেই রঙয়ের পার্থক্য বুঝতে পারত। মাঝে মাঝে ঘটে যেত অভাবনীয় দুর্ঘটনা। এক বিকেলে আমারান্তা যখন বেগনিয়ার বারান্দায় এমব্রয়ডারী করছে সে হোঁচট খায় আমারান্তার সঙ্গে । -"ঈশ্বরের দোহাই"-প্রতিবাদ করে আমারান্তা-"দেখে পথ চলুন" ।
-"তোরই দোষ" বলে উরসুলা " তুই বসে আছিস, যেখানে তোর বসার কথা নয়"।

ওর জন্য ব্যাপারটা ছিল সত্য । কিন্তু সে সেদিনই এমন একটা কিছু বুঝতে শুরু করে যা কিনা এর আগে কেউই আবিষ্কার করেনি। সেটা হচ্ছে বর্ষপরিক্রমার সাথে সাথে সূক্ষ্মভাবে সূর্য তাঁর স্থান পরিবর্তন করে, আর যারা বারান্দায় বসে তাদেরও স্থান পরিবর্তন করতে হয় ধীরে ধীরে, আগাম কোন আভাস না দিয়েই । তখন থেকেই উরসুলাকে তারিখ খেয়াল রাখতে হত আমারান্তা ঠিক কোথায় বসেছে তা জানাবার জন্য। যদিও তাঁর হাতের কাঁপুনি প্রতিদিনই বেশী করে নজরে পরে, আর পায়ের ভরও সে আর সইতে পারছিল না তবুও তাঁর ছোটখাট শরীরটা এত জায়গায় একই সময়ে আগে কখনই দেখা যায়নি । সারা বাড়ির দায়িত্ব যখন তাঁর উপর ছিল সেই একই রকমের পরিশ্রমী সে এই বয়সেও। কিন্তু বার্ধক্যের অভেদ্য নিঃসঙ্গতা তাকে পরিবারের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখার এমনই এক দিব্যদৃষ্টি দিয়েছে যে প্রথমবারের মত সে সত্যগুলো এত পরিষ্কারভাবে দেখে যে তাঁর অন্য সময়ের ব্যস্ততা তাকে এমনভাবে দেখতে বাঁধার সৃষ্টি করত। ঐ সময় যখন হোসে আর্কাদিওকে তৈরী করছিল সেমিনারী-তে (ধর্মস্কুল) পাঠানোর । মাকন্দো পত্তনের পর থেকে তখন পর্যন্ত জীবনের সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনাগুলো স্মরণ করে সে আর তাতে করে উত্তরসুরীদের সম্বন্ধে তাঁর ধারণা আমূল বদলে যায়। সে বুঝতে পারে কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যুদ্ধের কারণে মন শক্ত হয়ে যাওয়ায় পরিবারের প্রতি ভালবাসা হারিয়ে ফেলেনি, বরঞ্চ সে কখনই কাউকে ভালবাসেনি, এমনকি তাঁর স্ত্রী রেমেদিওসকে, বা একরাতের জন্য তাঁর জীবনে আসা অগুনতি রমনীদেরকেও নয়, আর তাঁর ছেলেদেরকে তো নয়ই। বুঝতে পারে যে এতসব যুদ্ধ সে আদর্শের জন্য করেনি, যেমনটি দুনিয়ার সবাই ভেবেছিল। পায়ে দলেনি অবসাদের কারনে আসন্ন বিজয়, বরঞ্চ তাঁর বিজয় এবং পরাজয় এসেছে একই কারণে, নিখাদ পাপে ভরা অহংবোধের কারণে। সার কথা হচ্ছে সে ভাবে, যে সন্তানের জন্য সে নিজের প্রাণও দিতে পারত সে শুধুমাত্রই ভালবাসতে অক্ষম এক মানুষ। একরাতে ও যখন পেটে তখন উরসুলা ওর কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় । কান্নার শব্দ এতই স্পষ্ট ছিল যে পাশে থেকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া জেগে উঠে আনন্দিত হয় এই ভেবে যে শিশুটি হারবোলা হবে। অন্যেরা বলে যে ও ভবিষ্যৎ বক্তা হবে। অন্যদিকে উরসুলা এটাকে নিশ্চিতভাবে শুয়োরের লেজসহ ভয়ংকর বাচ্চার প্রথম ঈঙ্গিত ধরে নিয়ে শিহরিত হয় আর ঈশ্বরের কাছে অনুনয় করে বাচ্চাটা যেন পেটে থাকতেই মারা যায়। কিন্তু বার্ধক্যের কারণে প্রাপ্ত স্বচ্ছতা তাকে বুঝতে সাহায্য করে যে যে-ছেলে পেটে থাকতে কাঁদে সে হরবোলা বা ভবিষ্যৎবক্তার কোন ঘোষণা নয়, সেটা হচ্ছে ভালবাসতে না পারার এক নির্ভুল ইঙ্গিত আর কথাটা সে অনেকবারই বলে বেড়ায়। নিজের ছেলের এই অবমুল্যায়িত প্রতিমূর্তি এক ধাক্কায় ভরে দেয় ছেলের প্রতি উরসুলার সমস্ত অনুকম্পার ভান্ডার। অন্যদিকে আমারান্তা, যার হৃদয়ের কঠোরতা চমকে দেয়, যার পুঞ্জিভূত তিক্ততা, মনকে তিতিবিরক্ত করে তোলে, শেষ পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হয়, এ পর্যন্ত আবির্ভূত মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে দয়শীল হিসেবে, এক করুনাঘন স্বচ্ছতা নিয়ে বুঝতে পারে যে পিয়েত্র ক্রেসপিকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দিয়েছে সেটা কোন প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছে দ্বারা চালিত নয়, এমনকি কর্ণেল হেরিনালদো মার্কেজ, যে জীবনের প্রলম্বিত আঘাতে ভোগে তাঁর তিক্ততা ভরা বিদ্বেষের কারণে, যেমনটি সকলে ভেবেছিল তা নয়, বরঞ্চ দুটো ঘটনাই ছিল অসীম ভালবাসা ও এক অজেয় কাপুরুষতার মধ্যে আমরণ সংঘর্ষ, আর শেষ পর্যন্ত তাতে জয়ী হয় অযৌক্তিক ভয়টাই, যেটাকে আমারান্তা নিজের বিক্ষুব্ধ হৃদয়ে সর্বক্ষণ ধারণ করেছিল । ঐ সময়ই, যখন উরসুলা রেবেকার নাম উচ্চারণ করতে আরম্ভ করে, এবং দেরীতে আসা অনুতাপের ফলে পুরোন ভালবাসা উথলে ওঠে, মাঝে মাঝে সম্ভ্রমের সঙ্গে, যা শুধু একমাত্র সেই বুঝতে পারে। রেবেকা, যে নাকি কখনই তাঁর বুকের দুধ থেকে আহার গ্রহণ করেনি, করেছে মাটি থেকে, দেয়ালের চুন থেকে, যে উরসুলার শিরা থেকে রক্ত নেয়নি, যার শিরায় বইছে অজ্ঞাত পরিচয় মানুষের রক্ত, যাদের হাড়গোড় এখনও কবরে ক্লক ক্লক শব্দ করে, রেবেকা, সেই অস্থির মেয়েটিই, সেই কামুক মেয়েটিই, একমাত্র তারই ছিল অদম্য সাহস আর উরসুলার কাছে তখন সেই ছিল নিজের বংশে আকাঙ্ক্ষিত জন ।

-"রেবেকা" – দেয়াল হাতরাতে হাতরাতে বলত- "কি অবিচারই না আমরা করেছি আমরা তোর সঙ্গে" ।

বাড়িতে সবাই তাকে ভাবত বুঝিবা আবোল-তাবোল বকছেন, যখন থেকে দেবদূত শ্রেষ্ঠ জীব্রাইলের মত ডান হাতটা উঁচু করে হাটতে শুরু করে তখন থেকে এই ভাবনাটার শুরু হয়। অবশ্য ফের্নান্দা বুঝতে পারে, এই আবোল-তাবোলের ছায়ার ভিতরেই লুকিয়ে আছে সূর্যের আলোর মত স্বচ্ছতা, কারণ কোন রকমের ইতস্ত না করেই উরসুলা বলে দিতে পারত গত বছরে বাড়িতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে । একদিন আমারান্তারও একই রকমের ধারণা হয়, যখন ওর মা রান্নাঘরে এক স্যুপের পাত্রে নাড়া দিচ্ছিল, ওর কথা কেউ শুনছে কি না শুনছে তা না জেনেই হঠাৎ বলে ওঠে যে প্রথম আসা জিপসিদের কাছ থেকে যে ভুট্টা পেষার যন্ত্রটা কিনেছিল, যেটা হোসে আর্কাদিওর পয়ষট্টিবার পৃথিবী প্রদক্ষিণের আগেই বাড়ি থেকে উধাও হয়, সেটা পিলার তেরনেরার বাড়িতেই আছে। পিলার তেরনেরা,বয়স যার প্রায় একশত, কিন্তু এখনও শক্ত সমর্থ, যার অস্বাভাবিক মোটা দেহ দেখে শিশুরা ভয় পায়, আগে হাসির শব্দে যে রকম ভয়ে কবুতরগুলো ভয় পেত, যে এইরকম স্থুল দেহ নিয়েও চটপটে, সে কিন্তু উরসুলার এই কথায় অবাক হয় না, কারণ তার নিজের অভিজ্ঞতাই তাকে শেখাতে শুরু করেছে যে সজাগ সচেতন বার্ধক্য, তাসের গণনার চাইতে অধিককতর সঠিকভাবে ভবিষ্যৎ গণনা করতে পারে ।

অবশ্য উরসুলা যখন বুঝতে পারে যে, হোসে আর্কাদিওকে পোপ বানানোর জন্য যথেষ্ট সময় সে হাতে পাবে না, তখন আতংকে অস্থির হয়ে পরে । ভুল করতে শুরু করে সে, চোখ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে যা কিনা সে স্বজ্ঞা দিয়ে আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখতে পেত। এক সকালে বাচ্চাটার মাথায় ফুলের সুগন্ধী জল মনে করে এক দোয়াত কালি ঢেলে দেয়। সব কিছুতে নাক গলাতে গিয়ে সে বারবার হোঁচট খায়, ফলে বারবার মন খারাপ হয়ে অস্থির হয়ে পরে, আর চেষ্টা চালায় অন্ধকারের মাকরশার জালটাকে খুলে ফেলতে যেটা তাকে আলখাল্লার মত জড়িয়ে ধরেছিল । ঐ সময়ই তাঁর মনে হয় যে তাঁর এই ভুল করা, বার্ধক্যের ও অন্ধত্বের প্রথম বিজয় নয়, এটা হচ্ছে সময়ের এক গলদ । সে ভাবতো যখন ঈশ্বর, তুর্করা এক গজ কাপড় মাপতে যেমন ফাঁকি দেয় তেমনি ফাঁকিভরা মাস আর বছর বানাতো না, আর সবকিছুই তখন ছিল অন্যরকম । এই যে রেমেদিওস লা বেয়্যা সশরীরে স্বর্গে উঠে গিয়েছে তাঁর রেশ না কাটতেই অবিবেচক ফের্নান্দা বাড়ির কোনায় কোনায় গজগজ করছে । আউরেলিয়ানোদের শরীর কবরে শীতল হওয়ার আগেই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো আবার বাড়িটাকে জ্বালিয়ে রেখেছে মাতালদের বাজানো একর্ডিয়ানোর শব্দ দিয়ে, শ্যাম্পেন দিয়ে গোসল করে, যেন কোন খ্রীস্টান মারা যায়নি, মরেছে কিছু কুকুর আর যেন এই উন্মত্ত বাড়িটা যেটার জন্য এত মাথাব্যথা সহ্য করতে হয়েছে, যেটাকে বানাতে এত মিশ্রির জানোয়ার খরচ হয়েছে, সেটা যেন আগে থেকেই ঠিক করা ছিল ময়লার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবার জন্য । হোসে আর্কাদিওর তোরঙ্গ গোছাতে গোছাতে এগুলোই মনে পরে উরসুলার; নিজেকে প্রশ্ন করে সে, একবারে সটান কফিনে গিয়ে শুয়ে পরাই কি ভাল নয় যাতে তার উপর মাটিচাপা দেয়। আর কোন ভয়ডর ছাড়াই প্রশ্ন করে ঈশরকে যে সত্যিই ঈশ্বর বিশ্বাস করে কিনা যে মানুষকে লোহা দিয়ে বানানো হয়েছে এতসব লজ্জা, যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য; আর জিজ্ঞেস করতে করতে নিজেই খুচিয়ে তুলছিল নিজের অজ্ঞতাকে, অনুভব করছিল শেষতক বিদ্রোহের সাথে যা মনে আসে তাই নিজের ইচ্ছেমত গলাফাটিয়ে বলার দুর্দমনীয় ইচ্ছে, যা করার জন্য এতবার তার প্রবল ইচ্ছে জেগেছে আর প্রতিবারেই সে ইচ্ছেটা দমিয়ে রেখেছে নীতি-আদর্শ ইত্যাদি চিন্তা করে, ইচ্ছে করে এসব নীতির উপর বিষ্ঠা ঢেলে দিয়ে হৃদপিণ্ডের ভিতর থেকে অকথ্য শব্দের অসীম পাহাড়গুলোকে বের করে আনতে, যেগুলোকে শতাব্দী জুড়ে গলাধঃকরণ করতে হয়েছিল আপস রক্ষার জন্য ।

-"জাহান্নামে যাক" চীৎকার করে ।
আমারান্তা তোরঙ্গে কাপড় ঢুকাচ্ছিল, মনে করে কাঁকড়াবিছে কামড়েছে ।
"কোথায় ওটা" ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করে ।
"কী"
"কীটটা"- পরিষ্কার করে আমারান্তা । উরসুলা হৃদপিণ্ডের উপর এক আঙ্গুল রাখে "এখানে" বলে ।

এক বৃহস্পতিবার বেলা দুটোর সময় হোসে আর্কাদিও সেমিনারিতে যায়। তার বিদায়ের দৃশ্যটা কখনই ভুলতে পারবে না উরসুলা, তামার বোতামসহ সবুজ কাপড়ের কোট পরে, মাড় দেয়া টাই গলায় পরে, গরমে সিদ্ধ হতে হতে, উরসুলার শিক্ষামাফিক এক ফোটাও অশ্রু বিসর্জন না করে, ছিপছিপে গম্ভীর ছেলেটা বিদায় নেয়। খাবার ঘরটাকে ফুলের সুগন্ধী জলের সুবাস দিয়ে ভরপুর করে যায়, যা নাকি উরসুলা ওর মাথায় দিয়েছিল যাতে করে বাড়িতে তার পদচারনা অনুসরন করা যায় । যতক্ষণ পর্যন্ত দুপুরে বিদায়ের ভোজ চলছিল, আনন্দের মধ্য দিয়ে তারা ঢেকে রাখে নিজেদের অস্বস্তি আর ফাদার ইসাবেল আন্তনিওর ভাবনা চিন্তাগুলো নিয়ে অসম্ভব রকমের বাড়াবাড়ি করে । কিন্তু যখন কোণাগুলো রূপার পাত দিয়ে ও মখমলের কাপড়ে মোড়া তোরঙ্গটা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন মনে হচ্ছিল যেন বের করছে এক কফিন । এই বিদায় উৎসবে একমাত্র যে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে সে হচ্ছে কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ।

-"শেষতক একমাত্র ওটারই দরকার আমাদের"- গজগজায় সে –"এক পোপ" ।

তিনমাস পর যখন আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ও ফের্নান্দা মেমেকে স্কুলে নিয়ে যায় আর ফিরে আসে এক ক্লাভিকর্ড নিয়ে, যেটা পিয়ানোলার জায়গা দখল করে। এই সময়ই আমারান্তা নিজের লাশে পরানোর কাপড়টা সেলাই করতে শুরু করে ।

কলা নিয়ে মাতামাতির ঝড় ঠান্ডা হয়ে যায় এরই মধ্যে । আগন্তকেরা মাকন্দোর আদিবাসীদের কোনঠাসা করে ফেলে কারন তারা নিজেদের আদিকালের জীবিকাগুলোকেই আকড়ে ধরে রেখে, এক ভরাডুবি থেকে রক্ষা পেয়েছে ভেবে সন্তুষ্ট হয় । বাড়িতে দুপুরের খাবারে অতিথি আপ্যায়নের প্রথা চালু থাকলেও কয়েক বছর পর কলা কোম্পানী চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে আগেকার নিয়ম আর চালু হয় না । অবশ্য আতিথেয়তার প্রাচীন ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে কারণ তখন ফের্নান্দাই প্রবর্তন করত আইনের । উরসুলা অন্ধকারে আশ্রয় নেয়ায়, আমারান্তা শবাচ্ছাদন বস্ত্র সেলাইয়ে ব্যস্ত থাকায় অতীতের শিক্ষানবীশ রানী স্বাধীনতা পায় অতিথি বাছাই করার ও বাবা-মার থেকে পাওয়া কঠোর রীতিনীতি আরোপ করার । বহিরাগতদের সহজে কামানো, অশ্লীল কাজে উড়ানো টাকাপয়সায় যে গ্রামের উত্থান হচ্ছে সেই গ্রামে ফের্নান্দার কঠোরতা বাড়িটাকে বানিয়ে ফেলে জড়াজীর্ণ রীতিনীতির শক্ত ঘাটি । কোন রকমের ব্যতিক্রম ছাড়া, ওর কাছে ভাল লোক হচ্ছে যাদের সঙ্গে কলা কোম্পানীর কোন সম্পর্ক নেই । এমনকি ওর দেবর হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো পর্যন্ত তার এই হিংসাত্মক পক্ষপাতের শিকার হয় কারন সে এই উত্তেজনাপূর্ণ দিনগুলোতে তাঁর ভাল ভাল লড়াইয়ের মোরগগুলো নিলামে বিক্রি করে, কলা কোম্পানীর ফোরম্যানের চাকরী নেয় ।

-"এই বাড়িতে ও আর পা ফেলতে পারবে না"- বলে ফের্নান্দা-"যতদিন পর্যন্ত ওর গায়ে বিদেশী পাঁচড়া থাকবে" ।

বাড়ির কড়াকড়ি এমন পর্যায়ে পৌছায় যে সুনিশ্চিতভাবেই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো পেত্রা কতেসের বাড়িতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে । প্রথমে স্ত্রীর উপর থেকে ভার কমানোর ছুতোয় পার্টিগুলোকে পেত্রার বাড়িতে সরায়। পরে জন্তগুলোর উর্বরতা কমে যাওয়ার ছুতোয় খামার ও আস্তাবলও স্থানান্তরিত করে। শেষে রক্ষিতার বাড়ি অপেক্ষাকৃত শীতল এই ছুতোয় ছোট্ট অফিসটি স্থানান্তরিত করে যেখান থেকে সে ব্যাবসা চালাতো । যখন ফের্নান্দা বুঝতে পারে যে স্বামী মারা না গেলেও সে বিধবা হয়ে গেছে, ততদিনে অবস্থা আগের জায়গায় ফেরানোর জন্য অনেক দেরী হয়ে গেছে । আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বাড়িতে প্রায় খেত না বললেই চলে আর একমাত্র যেসব কারনে সে বাড়িতে আসত, যেমন স্ত্রীর সঙ্গে শোবার জন্য, তাতে কাউকে বোঝানো অসম্ভব হয় যে কোন পরিবর্তন হয়নি । এক রাতে অসাবধনতার ফলে পেত্রা কতেসের বিছানাতেই রাত ভোর হলে ধরা পরে যায় আউরেলিয়ানো সেগুন্দো । যা আশা করেছিল তার উল্টো, ফের্নান্দা কোন রাগ করে না, এমনকি সামান্য অপমানকর দীর্ঘশ্বাসও ফেলে না সে, কিন্তু ঐ একই দিনে তার কাপড়সহ দুটি তোরঙ্গ পাঠিয়ে দেয় রক্ষিতার বাড়িতে । প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তার মধ্য দিয়ে ওগুলো বয়ে নেবার নির্দেশ দেয় যাতে সকলেই দেখতে পারে তার বিপথগামী স্বামী এই লজ্জা সহ্য না করতে পেরে মাথা নীচু করে বাড়িতে ফেরে । কিন্তু এই বিরোচিত কাজটা আর একবার প্রমাণ করে ফের্নান্দা শুধু যে তার স্বামীর চরিত্রই নয়, বরঞ্চ এই সমাজের চরিত্র সম্বন্ধেও কি পরিমান অজ্ঞ, যে সমাজ তার বাপমায়ের সমাজ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারন যারা তোরঙ্গগুলো নিয়ে যেতে দেখে তারা সকলেই মন্তব্য করে যে শেষ পর্যন্ত এটাই হচ্ছে এই ধরনের ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতি যে ঘটনার আদ্যপান্ত সকলেরই জানা, আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো তার উপহার স্বরূপ পাওয়া মুক্তি উদযাপন করে তিনদিনব্যাপী পার্টি দিয়ে । তার স্ত্রীর জন্য আরও প্রতিকূল অবস্থা হচ্ছে যখন সে শুরু করেছে লম্বা পোশাক, তার সাবেক কালের পদক ও অসময়োচিত গর্ব নিয়ে এক করুন প্রাধান্য তখন তার রক্ষিতা ফেটে পরছে যেন তার দ্বিতীয় যৌবন নিয়ে, প্রাকৃতিক রেশমের কাপড় জামা ও স্বীকৃতি পাওয়ার ফলে চোখে ডোরাকাটা ঝিকমিক দীপ্তি নিয়ে । আউরেলিয়ানো সেগুন্দো নিজেকে সমর্পন করে তার কাছে বয়ঃসন্ধির যৌনকামনা নিয়ে । আগের মত যখন পেত্রা কতেস ওকে চাইত না বরং আসত ওর যমজ ভাই বলে ভুল করে, যখন পেত্রা কতেস দুজনের সঙ্গেই বিছানায় যেত আর ভাবত ঈশ্বর ওকে কি সৌভাগ্যই না দিয়েছে, সে বিছানায় যাচ্ছে এমন একজনের সঙ্গে যে সহবাস করে ভিন্ন ভিন্ন দুজনের মত । ওদের পূনরায় আসা কামনা এতই তীব্র ছিল যে একবার খেতে বসে একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ কাউকে কোন কথা না বলে ঢাকনা নিয়ে খাবার ঢেকে শোবার ঘরে যায় প্রণয় করতে খিদেয় মরার জন্য । ফ্রান্সের রমনীদের কাছে গোপনে বিভিন্নবার যাবার অভিজ্ঞতায় আউরেলিয়ানো সেগুন্দো কেনে এক যাজকীয় চাঁদোয়াসহ বিছানা পেত্রা কতেসের জন্য, জানালায় লাগায় মখমলের পর্দা, আর সিলিং ও দেয়াল মুড়ে দেয় ক্রিস্টাল পাথরের আয়না দিয়ে। এই সময় সে ছিল সবচেয়ে বেশী পার্টি ও পানাহারে মত্ত । প্রতিদিন বেলা এগারোটায় আসা ট্রেন থেকে সে বুঝে নিত কেসের পর কেস শ্যাম্পেন ও ব্রান্ডি । ট্রেন স্টেশন থেকে ফেরার পথে কুম্বিয়া নাচের আসরে টেনে আনে পথে দেখা হওয়া সব মানুষদের, স্থানীয় বা বহিরাগতদের, পরিচিত বা অপরিচিতদের, কোন রকমের ভেদাভেদ না করেই, এমনকি মিস্টার ব্রাউন যে নাকি অন্য ভাষার সঙ্গে নিজেকে খুব একটা জড়াতো না সেও আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর আকার ইঙ্গিতে প্রলুব্ধ হয়ে অনেকবারই পেত্রা কতেসের বাড়িতে বেদম মাতাল হত, এমনকি তার সর্বক্ষণের সঙ্গী হিংস্র জার্মান শেফার্ড কুকুরগুলোকে পর্যন্ত একর্ডিয়ানের সুরে যেনতেনভাবে গাওয়া টেক্সাসের সঙ্গীতের সঙ্গে নাচাতো ।

-"দূর হও গরুর পাল"- পার্টি তুঙ্গে উঠলে চীৎকার করত আউরেলিয়ানো সেগুন্দো- "ভাগো, কারন জীবন বড়ই ছোট" ।

এত ভালো মেজাজে ওকে কখনই দেখা যায়নি, ওকে কেউ এত ভাল কখনই বাসেনি, আর জন্তুগুলোও সৃষ্টিছাড়াভাবে কখনই এত বিয়োয়নি । তখন এত গরু শুয়োর, মুরগী জবাই করা হয়, যে অন্তহীন পার্টিগুলোর জন্য যে রক্ত জমে পচে, তাতে উঠানের মাটি কালো কাঁদায় পরিণত হয় । উঠানটা হয়ে ওঠে ছড়ানো ছিটানো উচ্ছিষ্ট হাড়গোড় ও নাড়িভুড়ির ভাগার, যেখানে সবসময়ই পোড়াতে হত ডিনামাইট যাতে শকুনের দল অতিথিদের চোখ খুবলে না নেয় । আউরেলিয়ানো সেগুন্দো হয়ে পরে মোটা, পায়ের রং হয় লালচে বেগুনী, আকৃতি হয় কচ্ছপের মত, হোসে আর্কাদিও সারা পৃথিবী ঘুরে যে ক্ষুধা নিয়ে এসেছিল সেইরকম ক্ষুধা নিয়ে খাবার খেল। তার অসীম ক্ষিধের অপরিমিত খরচের ক্ষমতা, অভূতপূর্ব আতিথেয়তার খ্যাতি ছড়িয়ে পরে জলাভূমি ছাড়িয়ে আর আকৃষ্ট করে উপকূলের সেরা ভোজন রসিকদের । সব জায়গা থেকে এসে হাজির হত দুর্দান্ত সব পেটুকের দল কান্ডজ্ঞানহীন খাবারের ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য, যেগুলো আয়োজিত হত পেত্রা কতেসের বাড়িতে । আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ছিল অপরাজিত ভোজনরসিক, যতদিন পর্যন্ত না এক দুর্ভাগ্যজনক শনিবারে এসে হাজির হয় সারা দেশজুড়ে হস্তিনী নামে ভালভাবে পরিচিত কামিলা সাগাস্তুমে নাম্নী এক টোটেম (আদিবাসী) মহিলা । মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত চলে সেই প্রতিযোগিতা । প্রথম চব্বিশ ঘন্টায় পরিবেশন করা হয় এক কচি গরুর সঙ্গে ইউকা, (এক ধরনের আলুর মত খাদ্য) রোস্ট করা কাঁচা কলা, আর তার সাথে দেড় বাক্স শ্যাম্পেন, আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর জয়ের ব্যাপারটায় ছিল নিশ্চিত । প্রতিদ্বন্দ্বীর নির্বিকার হুমকির মুখে তাকে দেখা যায় বেশী উৎসাহী ও প্রাণশক্তিসম্পন্ন যেখানে অপর পক্ষ ছিল শান্ত আর অবশ্যই অনেক পেশাদারী ভাব, আর এই কারনেই বাড়ি উপচে পরা দর্শকদের কাছে ছিল কম আকর্ষণীয় । যখন আউরেলিয়ানো প্রতিযোগিতায় জেতার উৎকণ্ঠায় বড় বড় কামড়ে ও গোগ্রাসে খেয়ে চলছে, হস্তিনী তখন একজন সার্জনের নিপুনতা নিয়ে মাংশ কেটে কোন তাড়া ছাড়াই খেয়ে চলে এমনকি এক ধরনের আনন্দের সাথেই ।

দানবসম শক্তপোক্ত ছিল সেই মহিলা কিন্তু তা সত্ত্বেও তার সেই বিশালায়তনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল এক নারীত্বের কমনীয়তা, তার মুখটা ছিল এতই সুন্দর আর হাত দুটো ছিল এতই চমৎকার ও যত্ন করা, যে তার সঙ্গে যোগকৃত অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিগত আকর্ষণে উদ্বেলিত আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বাড়িতে ঢুকতে দেখে নীচু গলায় মন্তব্য করে যে দ্বৈরথটা খাবার টেবিলে না হয়ে বিছানায় হওয়াটাই সে বেশী পছন্দ করত। আরও পরে যখন দেখে ভোজের কেতাকানুনের একটিও না ভেঙে কচি বাছুরের পিছনের সম্পূর্ণ অংশ খেয়ে ফেলে তখন আন্তরিকভাবেই মন্তব্য করে যে, রুচিবান, আকর্ষণীয়, অতিলোভী শুড়ওয়ালা মানুষটা একদিক থেকে একজন আদর্শ নারী, আর কথাটা সে ভুল বলেনি । হস্তিনি নামের পূর্বে হাড়ভাঙ্গানী নামে তাঁর যে খ্যাতি ছিল তার ভিত্তির অভাব ছিল । লোকে যেমন বলত তেমন সে বলদ খেয়ে শেষ করত না অথবা গ্রীক সার্কাসের কোন দাড়িওয়ালা রমনীও ছিল না, সে ছিল এক সঙ্গীত স্কুলের নির্দেশিকা । পরিবারের সম্মানশীল মা হয়েও বাচ্চাদেরকে ভালভাবে খাওয়ানোর পন্থা খুঁজতে খুঁজতে সে আয়ত্ব করে খাবার বিদ্যেটা, যেটা ছিল কোন কৃত্রিম ক্ষুধা বর্ধকের সাহায্যে নয়, বরঞ্চ আত্মার পরম প্রশান্তির মাধ্যমে । এ সম্পর্কে তার প্রমাণিত তত্ত্ব যে, যে-লোকের সমস্ত নীতিবোধ নিখুঁত সে ক্লান্তিবোধ করা পর্যন্ত কোন বাঁধা ছাড়াই খেয়ে যেতে পারবে । এভাবেই খেলোয়াড়ি মনোভাব থেকে নয়, বরঞ্চ নৈতিক কারণে স্কুলের দেখাশোনায় ক্ষান্ত দিয়ে সারা দেশজুড়ে প্রবল ভোজনরসিক নামে খ্যাত নীতিবিহীন লোকটির বাড়ি আসে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য । প্রথমবারের সাক্ষাতেই সে বুঝতে পারে যে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো পাকস্থলীটা খোয়াবে না, খোয়াবে তার চরিত্র। প্রথম রাত শেষে যখন হস্তিনী খেয়ে চলছে বিরতিহীনভাবে, আউরেলিয়ানো সেগুন্দো তখন ক্লান্ত হয়ে পরে প্রচুর কথা বলে আর হাসে। চারঘন্টা ঘুমায় ওরা, জেগে উঠে পান করে পঞ্চাশটি কমলালেবুর রস,আট লিটার কফি আর ত্রিশটি কাঁচা ডিম । দ্বিতীয় সকালে অনেক ঘন্টা নির্ঘুম কাটিয়ে, দুটি শুকর, এক ছড়া কলা ও চার বাক্স শ্যাম্পেন পেটে চালিয়ে হস্থিনী সন্দেহ করে যে নিজের অজান্তেই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ওর ফরমুলাটা আবিষ্কার করে ফেলেছে চরম দায়িত্বহীনতার উদ্ভট উপায়ে। সে আসলে অনেক বেশী বিপজ্জনক, যতটা সে ভেবেছিল তার চেয়েও । কিন্তু যখন পেত্রা কতেস দুটো রোস্ট করা তিতির টেবিলে নিয়ে যায় আউরেলিয়ানো সেগুন্দো সম্পূর্ণভাবে ভরপেট হবার এক পা দূরে ।

-"যদি না পারো আর খেয়ো না"- বলে হস্তিনী –"আমরা ড্র করলাম" ।

কথাটা সে বলে মন থেকেই, প্রতিদ্বন্দ্বীকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাড় করানোর অনুশোচনায় নিজে আর এক গ্রাসও মুখে তুলতে পারবে না জেনে । কিন্তু আউরেলিয়ানো সেগুন্দো সেটাকে ধরে নেয় নতুন এক শক্তি পরীক্ষার আহবান হিসেবে আর তার অবিশ্বাস্য ক্ষমতার বাইরে গিয়ে গিলে ফেলে তিতিরের রোস্টটাকে, অজ্ঞান হয়ে পরে সঙ্গে সঙ্গে। কুকুরের মত মুখে ফেনা তুলতে তুলতে মুখ থুবরে পরে হাড়সহ থালার উপর আর যন্ত্রনায় গোঙ্গাতে থাকে। নিজেকে অনুভব করে অন্ধকারের মাঝে, কেউ যেন তাকে ছুড়ে ফেলছে সুউচ্চ চূড়া থেকে তলহীন পাতালে আর চেতনার সর্বশেষ আলোয় সে বুঝতে পারে অশেষ পতনের প্রান্তে মৃত্যু অপেক্ষা করছে তার জন্যে ।

-"আমাকে ফের্নান্দার কাছে নিয়ে যাও"- কোনরকমে বলতে পারে ।

যে বন্ধুরা ওকে বাড়িতে নিয়ে আসে, তারা মনে করে এর মাধ্যমে সে রক্ষিতার বাড়িতে না মরার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারল । পেত্রা কতেস সে বুটজোড়া পরে কফিনে ঢুকতে চেয়েছিল সেগুলোকে পালিশ করে আর যখন লোক খুঁজতে থাকে পাঠাবার জন্য তখন লোকে বলতে যায় তাকে যে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বিপদ কাটিয়ে উঠেছে । এক সপ্তা পার হবার আগেই সত্যি সে সেরে ওঠে আর এই রক্ষা পাওয়াটাকে উদযাপন করে এক অভূতপূর্ব পার্টির মধ্য দিয়ে । পেত্রা কতেসের বাড়িতেই বাস করতে থাকে সে কিন্তু প্রতিদিন দেখতে যেত ফের্নান্দাকে আর মাঝে মাঝে থেকে যেত, পরিবারের সকলের সঙ্গে খেত যেন নিয়তির ফেরে অবস্থা উল্টে গিয়ে সে রক্ষিতার স্বামী হয়ে গিয়েছে আর স্ত্রীর প্রেমিকে পরিণত হয়েছে ।

ফের্নান্দার জন্য এটা হয় এক বিশ্রাম । পরিত্যক্ত হবার সেই একঘেয়ে দিনগুলোতে তার একমাত্র সময় কাটানোর উপায় ছিল সিয়েস্তার সময়ে ক্লাভিকর্ডের অনুশীলন ও ছেলেমেয়েদের কাছে চিঠি লিখা । চিঠিগুলোতে পনের দিন পরপর বিস্তারিত যা কিছু সে ওদের কাছে লিখে তার একটি লাইনেও সত্য কথা থাকে না । সে তার লজ্জা গোপন রাখত । আলোকিত বেগনিয়া থাকা সত্ত্বেও, বেলা দুটোর দমবন্ধ করা অবস্থা সত্ত্বেও, রাস্তা থেকে অনবরত আনন্দোৎসবের ঢেউ আসা সত্ত্বেও যে বাড়িটা ক্রমশই তার বাবা মার বাড়ির মত এক ঔপনিবেশিক ম্যানশন হয়ে উঠছে সে বাড়ির বিষন্নতা সে গোপন রাখে ওদের কাছে। ফের্নান্দা বসবাস করত তিন জ্যান্ত প্রেতাত্মা ও মৃত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার প্রেতাত্মার সাথে যে নাকি মাঝে মাঝে বৈঠকখানার আলোআঁধারির মধ্যে কৌতূহলী মনোযোগ নিয়ে ক্লাভিকর্ডের সামনে গিয়ে বসত তার বাজানোর সময় । কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ছিল এক ছায়ামাত্র। সে শেষবারের মত বাড়ির বের হয়েছিল কর্ণেল হেরিনেলদো মার্কেজকে সম্ভাবনাহীন এক যুদ্ধের প্রস্তাব দেবার জন্য, আর এখন শুধুমাত্র কর্মশালা থেকে বের হয় চেস্টনাটের নীচে প্রস্রাব করার জন্য । প্রতি তিন সপ্তাহে একবার ছাড়া আর কারও সঙ্গে দেখা করত না সে । দিনে একবার উরসুলা যা নিয়ে যেত তাই দিয়ে আহার সারত আর যদিও সোনার ছোট্ট ছোট্ট মাছগুলোকে সে বানিয়ে চলছিল তবুও বিক্রি বর্জন করে যেদিন থেকে লোকেরা সেগুলোকে আর অলংকার হিসেবে না কিনে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে কেনা শুরু করে। বিয়ের দিন থেকে শোবার ঘরে সাজানো রেমেদিওসের পুতুলগুলো একবার উঠোনে জ্বালিয়ে দেয় । চোখে চোখে রাখার ফলে উরসুলা ব্যাপারটা টের পেলেও ওকে নিবৃত করতে পারে না । -"তোর মনটা পাথরের তৈরী" ওকে বলে ।
-"ব্যাপারটা মনের নয়"- কর্ণেল বলে- "ঘরটা পোকায় ভরে যাচ্ছে ।"

——————————-

আর্হেন্তিনার বুয়েনোস আইরেস-এর
এদিতোরিয়াল সুদামেরিকানা প্রকাশনী থেকে
প্রকাশিত 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' উপন্যাসের
প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ

——————————-


আমারান্তা সেলাই করে চলে ওর শবাচ্ছাদন। ফের্নান্দা বুঝতে পারে না কেন আমারান্তা মাঝে মাঝে মেমেকে চিঠি লিখে, এমনকি উপহারও পাঠায়, অথচ হোসে আর্কাদিওর নাম পর্যন্ত শুনতে পারে না । "কারণটা না জেনেই মারা যাবে ও"- উত্তর দেয় আমারান্তা যখন উরসুলার মাধ্যমে প্রশ্ন করে ফের্নান্দা, আর এই উত্তর ওর মনে এমন এক রহস্যের সৃষ্টি করে যা তার কাছে কখনই খোলসা হয় না। লম্বা, চওড়া কাঁধবিশিষ্ট সবসময়ই অনেকগুলো লেসের পেটিকোট পরিহিত অহংকারী আমারান্তার এক স্বাতন্ত্র্য ছিল ওরর বয়স ও খারাপ স্মৃতিগুলোকে ঠেকিয়ে রাখার, আর মনে হত যেন কপালে ধারন করে আছে এক কুমারীত্বের ছাই আঁকা ক্রস । সত্যিকার অর্থে ক্রসটা ছিল তার হাতে কালো ব্যান্ডেজটাতে যেটাকে সে রাতে ঘুমোনোর সময়ও খুলতো না, যেটাকে নিজ হাতে ধুয়ে ইস্ত্রি করত। শবাচ্ছাদন বস্ত্রটি এম্ব্রয়ডারি করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছিল তার । এভাবেও বলা যায় যে দিনে যা বুনত রাতে সে তা খুলে ফেলত, নিঃসঙ্গতাকে পরাজিত করার আশায় নয় বরং তার উল্টো, নিঃসঙ্গতাকে জিইয়ে রাখতে ।

পরিত্যক্তার দিনগুলোতে ফের্নান্দার সবচেয়ে বড় উৎকণ্ঠার ব্যাপার ছিল প্রথমবারের মত বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসে মেমে, আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে বাড়িতে পাবে না । উৎকণ্ঠাটাকে দূর করে দেয় আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর এই পেটভর খেয়ে মৃত্যুদশার অবস্থা । বাবা, মা দুজনেই মেমে ফিরে আসার আগেই এই চুক্তিতে পৌঁছায় যে ফিরে এসে যেন দেখে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো শুধু যে ভাল একজন গৃহকর্তা তাই নয়, তার কাছে যেন বাড়ির বিষন্নতাটাও ধরা না পরে । প্রতিবারই দুমাসের জন্য আউরেলিয়ানো সেগুন্দো আদর্শ স্বামীর ভূমিকা পালন করে আইসক্রিম ও ছোট বিস্কুটের উৎসবের আয়োজন করে, যেগুলোকে সেই আনন্দোচ্ছল মেয়েটা ক্লাভিকর্ডটার সাহায্যে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। ঐ সময় থেকেই বোঝা যায় সে মায়ের চরিত্রের খুব কমই পেয়েছে উত্তরাধিকারসূত্রে। তার চেয়ে বরঞ্চ সে ছিল আমারান্তার দ্বিতীয় সংস্করণ, যখন আমারান্তা তিক্ততার সাথে পরিচিত ছিল না আর সারা বাড়ি মাতাতো তার নাচের পদতালে, যখন বয়স ছিল তার বারো চৌদ্দ, পিয়েত্রর প্রতি গোপন আসক্তি তার মনের গতিবিধি চিরকালের জন্য বদলে দেবারও আগে। কিন্তু আমারান্তার উল্টো এমনকি বাড়ির সবার উল্টো মেমে নিঃসঙ্গতার কোন নিদর্শনই তুলে ধরে না, এমনকি যখন বেলা দুটোর সময় অলংঘনীয় নিয়মের মধ্যে ক্লাভিকর্ডের অনুশীলনের জন্য বৈঠকখানার দরজা বন্ধ করত তখনও না, স্পষ্ট বোঝা যায় যে বাড়িটাকে ওর ভাল লাগে ও সারা বছর স্বপ্ন দেখে তার আগমনে বয়ঃসন্ধির ছেলে মেয়েদের মধ্যে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয় সেগুলোর। আর বাপের পার্টি দেয়া ও আতিথেয়তার স্বভাব থেকেও সে খুব একটা পিছিয়ে নেই । এই উত্তরাধিকারের প্রথম নিদর্শন হচ্ছে যখন সে তৃতীয় ছুটির সময় নিজের উদ্যোগে কাউকে কিছু না জানিয়ে চারজন নান ও আটষট্টি জন সহপাঠিনী নিয়ে বাড়িতে হাজির হয় ।

-"কি কান্ড"- বিলাপ করে ফের্নান্দা-"এ দেখছি বাপের মতই বর্বর" ।

প্রতিবেশীদের কাছে বিছানা, হ্যামক ধার করতে হয়, নয়টি পালা নির্দিষ্ট করতে হয় । বেঁধে দিতে হয় গোসলের সময় ও ধার করে যোগাড় করতে হয় চল্লিশটি টুল যাতে করে নীল উনিফরম ও ছেলেদের মত লম্বা বুট পরিহিত মেয়েরা বাড়ির এক মাথা থেকে অন্য মাথা দৌড়ে না বেড়ায় । আমন্ত্রণটা মাঠে মারা যায় কারন হৈ চৈ করা ছাত্রীরা সকালের নাস্তা শেষ করতে না করতেই দুপুরের খাবারের সময় হয়ে পরে আর দুপুরেরটা শেষের পর রাতের, আর সারা সপ্তাহে শুধু একবার প্লান্টেশনে বেড়ানোর সুযোগ পায় ওরা । রাত হওয়ার সাথে নানরা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে পরে, নড়াচড়া করতে ব্যর্থ হয় আর যখন তাদের এমনকি একটা হুকুম দেবারও ক্ষমতা থাকে না তখনও ক্লান্তিহীন উঠানে গেয়ে চলছে ওরা স্কুলের বেসুরো সঙ্গীত । উরসুলা, যে নাকি কাজ করতে গিয়ে সবসময় অকাজ করে ফেলে তাকে একদিন ওরা প্রায় মাড়িয়েই ফেলছিল । অন্যদিন নানেরা এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে কারন উঠানে ছাত্রীদের উপস্থিতিকে পাত্তা না দিয়ে কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া চেষ্টনাটের নীচে প্রশ্রাব করে । আরেকবার আমারান্তা প্রায় আতংকের সৃষ্টি করে যখন সে স্যুপে লবন দেবার সময় এক নান ঢুকে পরে আর একমাত্র যে-প্রশ্ন তার মনে উদয় হয় তা হচ্ছে ঐ মুঠিভড়া সাদা গুড়োগুলো কি ।
-"আর্সেনিক"- বলে আমারান্তা ।

ছাত্রীদের আসার রাতে বিছানায় যাবার আগে পায়খানায় যাবার চেষ্টায় ওরা এমন গোলযোগের সৃষ্টি করে যে ভোর একটার সময়, তখনও শেষের ক'জন পায়খানায় ঢুকছে। ফলে ফের্নান্দা বাষট্টিটি মলমূত্র ত্যাগ পাত্র কেনে কিন্তু এতে শুধুমাত্র রাতের সমস্যাটা বদলে গিয়ে দিনের সমস্যার রূপ নেয় কারন ভোর হতেই পাত্র হাতে ছাত্রীদের লম্বা লাইন লেগে যায় ওগুলো ধোঁয়ার জন্য। যদিও কেউ কেউ জ্বরে ভোগে ও মশার কামড়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তবুও অধিকাংশই প্রচন্ড সমস্যার মুখে অনমনীয় প্রতিরোধের পরিচয় দেয় আর দিনের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়ও দৌড়াদৌড়ি করে বাগানে । অবশেষে ওরা যখন বিদেয় হয় বাগানের ফুল পায়ে দলে শেষ করে দিয়ে, তখন আসবাবপত্রগুলো সব ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, দেয়ালজুড়ে করা হয়েছে বিভিন্ন আঁকিঝুকি ও লেখালেখি। তবুও ফের্নান্দা ওদের ক্ষমা করে দেয় শুধুমাত্র ওদের বিদায়ের স্বস্তিতে। সে ধার করা বিছানা ও টুলগুলো ফেরত দিয়ে বাষট্টিটি মলত্যাগ পাত্র মেলকিয়াদেসের ঘরে ঢুকিয়ে রাখে । সেই নিষিদ্ধ ঘরটা যাকে কেন্দ্র করে বাড়ির আধ্যাত্মিক জীবন আবর্তিত হত তখন থেকে সেই ঘরকেই সকলে চেনে মলত্যাগ পাত্রের ঘর হিসেবে। কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার জন্য ওটাই ছিল মোক্ষম নামকরন, কারন পরিবারের অন্য সকলেই মেলকিয়াদেসের জিনিসপত্রগুলো ধুলাবালি ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে মনে করে আশ্চর্য হলেও সে মনে করত ওটা পরিণত হয়েছে এক শুয়োরের খোঁয়াড়ে । যাই হোক, কার কথায় যুক্তি আছে তার কোন গুরুত্বই ছিল না কর্ণেলের কাছে, সে ব্যাপারটা জানতে পারে কারন ফের্নান্দা মলত্যাগপাত্রগুলো রাখবার জন্য সারাটা বিকেলজুড়ে বারবার ওর কর্মশালার সামনে দিয়ে গিয়ে ওকে বিরক্ত করছিল ।

ঐদিনগুলোতে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর পুনরাবির্ভাব ঘটে বাড়িতে। সে বারান্দা দিয়ে চলে যেত কাউকে কোন অভিবাদন না জানিয়ে, আর কর্নেলের সঙ্গে আলোচনার জন্য কর্মশালায় ঢুকে দরজা বন্ধ করত । যদিও চোখে দেখতে পেত না তবুও উরসুলা বিশ্লেষণ করত সুপারভাইজারের বুটের শব্দ আর অবাক হয়ে যেত পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে ওর অমোচনীয় দূরত্ব দেখে যেটা ওকে অন্যান্যদের থেকে করে ফেলেছে আলাদা, এমনকি ওর যমজ ভাইর থেকেও, যে ভাইর সঙ্গে ছেলেবেলায় সে খেলত অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করার অসাধারণ সব খেলা, আর যার আজ তার সঙ্গে কোন মিলই নেই । ও ছিল ঋজু, গম্ভীর,সবসময় যেন কিছু চিন্তা করছে । সারাসিনদের (সিরিয়া, মিশর এলাকার বেদুঈন) মত বেদনাক্লিষ্ট শরৎরঙা মুখটাতে ছিল এক বিষাদের আলোর ছটা, চেহারার মিল সবচেয়ে তার বেশী ছিল মা সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের সঙ্গে । যদিও পরিবার প্রসঙ্গে কথা বলার সময় ওর অস্তিত্বের কথা ভুলে যাওয়ায় নিজের উপরই রাগ হত উরসুলার, তবুও পূনরায় ওর বাড়িতে আসা ও কর্মশালায় ঘন্টার পর ঘন্টা কর্নেলকে তার উপস্থিতি মেনে নিতে দেখে উরসুলা আবার পুরাতন স্মৃতি পরখ করে, আর তার মনে বদ্ধমূল ধারণা হয় যে শৈশবের কোন এক সময়ে ও যমজ ভাইয়ের সঙ্গে অদল বদল হয়ে গিয়েছে, আসলে ওরই নাম হওয়া উচিৎ ছিল আউরেলিয়ানো, অন্যজনের নয় । ওর জীবনের বিশদ ব্যাপারগুলো বাড়ির সকলেরই অজানা । এক সময় জানা গিয়েছিল, থাকবার নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই ওর, পিলার তেরনেরার বাড়িতে লড়াইয়ে মোরগ পালন করছে, মাঝে মাঝে রাতে সে ঘুমুতে থেকে যেত ওখানেই তবে বেশীরভাগ রাতই কাটাতো ফ্রান্সের মোহনীয় রমনীদের সাথে। সেই ভালবাসাহীন জীবনের প্রতি বেপরোয়া হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো যেন উরসুলার গ্রহমন্ডলে এক পথভ্রষ্ট নক্ষত্র ।

সত্যিকার অর্থে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো এ পরিবারের কোন সদস্য ছিল না, সেই সুদূর ভোরে যখন কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেজ ওকে নিয়ে গিয়েছিল ব্যারাকে, গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দৃশ্য দেখতে নয়, বরঞ্চ যেন সে দন্ডিতের বিষণ্ণ উপহাসপূর্ণ হাসিমুখ সারাজীবনের জন্য ভুলতে না পারে তার জন্য, তখন থেকেই সে আর কোন পরিবারেরই সদস্য হবে না । ওটা শুধু তার মনের সবচেয়ে প্রাচীন স্মৃতি নয়, একমাত্র স্মৃতি । আর এক স্মৃতি সেকেলে জ্যাকেট ও কাকের ডানার ন্যায় টুপি পড়া এক প্রৌঢ় যে আলোকিত জানালার সামনে বসে অবাক করা সব গল্প বলে যেত আর তা যে কোন যুগের সেটা সে ঠিক করতে পারে না । সেটা ছিল এক অনিশ্চিত স্মৃতি, সম্পূর্ণরূপেই অভিজ্ঞতা বা স্মৃতিকাতরতা-বহির্ভূত মৃত্যুদন্ড কার্যকরের স্মৃতি থেকে উল্টো, কারণ মৃত্যুদন্ডের স্মৃতিটা তার জীবনের দিক নির্ধারন করে দিয়েছিল যেটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতিক্ষণেই আরও উজ্জ্বল হতে থাকে, যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা আরও কাছে চলে আসছে । হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর এই আগমনকে কাজে লাগিয়ে উরসুলা চেষ্টা করে কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে এই আবদ্ধ অবস্থা থেকে বের করে আনতে । "ওকে সম্মত করার চেষ্টা কর যাতে সিনেমায় যায়"- বলে । "সিনেমা ভাল না লাগলেও অন্তত একবারের জন্য হলেও বিশুদ্ধ বাতাস নিতে পারবে ফুসফুসে" কিন্তু তার বুঝে উঠতে বেশী সময় লাগে না যে কর্ণেলের মত আর্কাদিও সেগুন্দোও কোন অনুরোধ বা ভালবাসার প্রতি অনুভূতিহীন। যদিও অন্য সকলের মতই উরসুলা কখনই জানতে পারে না কর্মশালায় আবদ্ধ হয়ে এত লম্বা সময় ধরে কি আলাপ করে, কিন্তু বুঝতে পারে পরিবারে ওরা দুজনই শুধু যেন রক্তের টানে একত্রিত হয় ।

সত্যিকথা হচ্ছে এমনকি হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোও কর্ণেলকে আবদ্ধ অবস্থা থেকে বের করে আনতে পারত না । স্কুলের ছাত্রীদের জবর দখল তার ধৈর্যের সীমাকে অতিক্রম করে গিয়েছে । রেমেদিওসের মোহনীয় পুতুলগুলো ধ্বংস করে ফেলার পরও তাদের বৈবাহিক ঘরটা মথদের দখলে চলে গিয়েছে, এই ছুতোয় সে কর্মশালায় এক হ্যামক টাঙ্গায় আর এর পর থেকে শুধুমাত্র পায়খানা প্রশ্রাব করার প্রয়োজন ছাড়া উঠানেও পা দেয় না । উরসুলা, এমনকি মামুলি কোন আলাপও করতে পারে না ওর সঙ্গে। সে জানত যে কর্ণেল খাবারের পাত্রের দিকে তাকায় না, তার বদলে ছোট একটি মাছ তৈরী শেষ না করা পর্যন্ত বেঞ্চের এক কোণায় রেখে দিত সেটা, আর স্যুপ ঠান্ডা হয়ে সর পরলেও বা মাংস ঠান্ডা হয়ে গেলেও তার কিছু এসে যেত না । যেদিন কর্ণেল হেরিনেলদো মার্কেজ ভীমরতিপ্রসূত এক যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে সেদিন থেকেই সে আরও কঠোর হয়ে পরে । নিজেকে সে বদ্ধ করে নিজের মধ্যেই আর পরিবারের সকলেই তাকে মৃত বলে ধরে নেয়। তার ভিতরে মানবিক কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না, যতদিন পর্যন্ত না এক অক্টোবরের এগারো তারিখে রাস্তার দরজায় বের হয় সার্কাসের লোকদের মিছিল দেখার জন্য। শেষের অন্যান্য বছরগুলোর অভ্যেস মতই এই দিনেও দরজায় বেরোয় সে মিছিল দেখতে। ভোর পাঁচটার সময় দেয়ালের অপর দিকের ব্যাঙের ও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক তাকে জাগিয়ে তোলে। শনিবার থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঝরে চলছিল আর বাগানের পাতাগুলোর ভেতর থেকে মৃদু ফিসফিসানি শোনার কোন প্রয়োজন ওর ছিল না, কারন মজ্জায় বাসা বাঁধা শীতের মধ্যেই সে সেটা অনুভব করছিল । বরাবরের মতই ওর গায়ে ছিল পশমের চাদর আর সুতির লম্বা জাঙ্গিয়া পরা ছিল আরামদায়ক বলে; যদিও ধুলোবালি মাখা অন্তর্বাসটা মান্ধাতা আমলের বলে সে সেটাকে বলত গথিক জাঙ্গিয়া, টাইট প্যান্ট পরেছিল সে, কিন্তু জিপার বন্ধ না করে , এমনকি সবসময়ের মত শার্টের কলারে সোনার বোতামও লাগায় না গোসল করবে বলে। পরে মাথায় চাদরটা দিয়ে মাথা ঢাকে হুডের মত করে, পরে তেল চোয়ানো গোঁফ আঙ্গুল দিয়ে ঠিক করে উঠানে যায় প্রশ্রাব করতে। রোদ বের হতে এত সময় নিচ্ছিল যে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তখনও বৃষ্টিতে পচে যাওয়া তালাপাতার ছাউনির নীচে ঘুমুচ্ছিল । সে তা দেখতে পায় না, কখনই যেমন দেখেনি, এমনকি শুনতেও পায় না যখন ওর বাবার অপচ্ছায়ার জুতোয় গরম মুতের ছিটা লেগে লাফ দিয়ে হেসে উঠে অবোধ্য ভাষায় ওকে কিছু বলে । গোসলটাকে আপাতত স্থগিত করে, শীত ও স্যাতস্যাতে ভাবের জন্য নয়, অক্টোবরের ঘন কুয়াশার কারণে। কামারশালায় ফেরার পথে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের জ্বালানো তুলোর পলতের গন্ধ পায় আর রান্নাঘরে অপেক্ষা করে বলগ দেয়া কফি ভরা কাপ চিনি ছাড়া নিয়ে যাবার জন্য। অন্য সব দিনের মতই সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ প্রশ্ন করে সেদিন সপ্তাহের কি বার আর সে জবাব দেয় মঙ্গলবার, এগারই অক্টোবর । আগুনের আভায় সোনালী মেয়েটাকে দেখতে দেখতে সে ভাবে, যে মেয়েটার অস্তিত্ব তখন কেন জীবনের অন্য কোন সময়েই তার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব ছিল না আর ভাবতে ভাবতে তার মনে পরে যায় যে ঘোর যুদ্ধের সময় এক এগারোই অক্টোবরে, সে এক নির্দয় নিশ্চয়তা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, যে মেয়েটার সঙ্গে ঘুমিয়েছিল সে মারা গেছে। সত্যিই মারা গিয়েছিল মেয়েটা, আর দিনটির কথা কখনই সে ভোলেনি কারন তার এক ঘন্টা আগে মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছিল সেদিন কয় তারিখ ছিল। এই স্মৃতি জেগে ওঠার পরও তার পূর্ববোধগুলো তাকে কতটা ত্যাগ করেছে তা বিশ্লেষণ করার ইচ্ছে তার হয় না, আর যতক্ষণ কফি গরম হচ্ছিল ততক্ষণ সে ভাবছিল শুধুমাত্র কৌতুহলবশত কোন রকম স্মৃতিকাতরতার সূক্ষ্মতম ঝুঁকি ছাড়াই, ভাবছিল সে সেই রমনীর কথা, যার নাম সে কখনই জানেনি, আর যার মুখও জীবিতাবস্থায় সে কখনই দেখেনি কারণ অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে সে তার হ্যামকের কাছে পৌঁছেছিল। তা সত্ত্বেও তার জীবনে একইভাবে আসা অসংখ্য রমনীর শূন্যতার মাঝে তার মনে পরে না যে এই মেয়েটিই প্রথম সান্নিধ্যের উন্মত্ততার মাঝে যখন নিজের চোখের জলে ডুবে খাবি খাচ্ছিল তখন, মৃত্যুর এক ঘন্টা আগে, দিব্যি দেয় তাকে আমরণ ভালবাসার। সে আর ওর কথা ভাবে না, এমনকি অন্য কোন মেয়ের কথাও নয় যখন ধূমায়িত কাপ নিয়ে কামারশালায় ঢোকে, বাতি জ্বালায় টিনের পাত্রের মধ্যে রাখা ছোট ছোট সোনার মাছগুলি গোনার জন্য। সতেরটি ছিল, যখন থেকে বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন থেকেই দিনে দুটি করে মাছ বানাতে থাকে আর পঁচিশটি হয়ে গেলে গলন পাত্রে ঢুকিয়ে ওগুলোকে গলিয়ে ফের বানাতে শুরু করে । সারা সকাল কাজ করে নিমগ্ন হয়ে, কোন কিছুই চিন্তা না করে, টের না পেয়ে যে বেলা দশটার সময় বৃষ্টির তোড় বেড়ে যায় আর কেউ তার কামারশালার সামনে দিয়ে যেতে যেতে চীৎকার করে দরজাগুলো বন্ধ করতে বলে যাতে বৃষ্টির পানি ঢুকে বাড়ি না ডুবিয়ে দেয়; এমনকি টেরও পায় না কখন উরসুলা দুপুরের খাবার ঘরে ঢুকে আলো নিভিয়ে দেয় ।
-"কি বৃষ্টি"- বলে উরসুলা ।
-"অক্টোবর"- বলে সে ।

বলার সময় দিনের প্রথম মাছটি থেকে দৃষ্টি সরায় না, কারন সে মাছের চোখগুলোতে রুবি বসাচ্ছিল । শেষ করার পরই শুধু মাছটাকে পাত্রের অন্যগুলোর সঙ্গে রেখে স্যুপ পান করতে আরম্ভ করে । পরে সে খাবার খায়, খুবই ধীরে ধীরে, খাবারটা ছিল পেয়াজ দিয়ে রান্না করা মাংসের টুকরো, সাথে সাদা ভাত ও কলাভাজি সবই পরিবেশন করা ছিল একই পাত্রে । সুসময় বা দুঃসময় কখনই ওর ক্ষুধার কোন পরিবর্তন ঘটত না । খাবার শেষ করার পর সে আলস্যজনিত উদ্বেগ অনুভব করে । কোন এক ধরনের বৈজ্ঞানিক কুসংস্কার বশত হজম করার প্রথম দুঘন্টা সে কোন কাজ করত না, কোন বই পড়ত না বা গোসল করত না এমনকি সহবাসও করত না, আর এটা এমনই এক গভীর বিশ্বাস ছিল যে অনেকবারই সৈন্যরা যাতে বদহজমের শিকার না হয় তার জন্য সামরিক অপারেশন পিছিয়ে দিয়েছে । কাজেই সে হ্যামকে শুয়ে ছোট ছুড়ি দিয়ে কানের ময়লা বের করতে থাকে আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পরে। স্বপ্ন দেখে এক সাদা দেয়ালের খালি বাড়িতে ঢুকছে সে আর সেখানে প্রথম মানব হিসাবে ঢোকার কারনে সে বিষন্ন বোধ করে । স্বপ্নের মধ্যেই তার মনে পরে যে একই স্বপ্ন সে আগের রাতেও দেখেছে । বিগত বছরগুলোর অনেক রাতের মতই আর জানতে পারে যে জেগে ওঠার সাথে সাথেই এই স্বপ্ন তার স্মৃতি থেকে মুছে যাবে কারন এই পূনঃপৌণিক স্বপ্নের বৈশিষ্ট হচ্ছে স্বপ্নের মধ্যে ছাড়া সেটাকে অন্য কোন সময় মনে করতে পারা যাবে না । সত্যিই কিছুক্ষণ পরে যখন নাপিত এসে কামারশালার দরজা থেকে ডাক দেয় তখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া অনিচ্ছা স্বত্বেও অল্প কয়েক মুহূর্ত ঘুমিয়ে পরার অনুভূতি নিয়ে জেগে ওঠে আর মনে হয় স্বপ্ন দেখার মত কোন সময় পায়নি ঘুমের সময় । -"আজকে নয়"- বলে নাপিতকে-"শুক্রবার-এ দেখা হচ্ছে" ।

গালে তখন তার তিনদিনের দাড়ি ছিল, সাদা দাড়ির ছোপ ছিল তাতে, কিন্তু চুলকাটার সময় একই সঙ্গে দাড়ি কামানোর প্রয়োজন মনে করে না সে । বগল তলায় গলদ্রিনার ক্ষতগুলোতে অনাকাঙ্ক্ষিত সিয়েস্তার(দুপুরের ঘুম) চটচটে ঘাম জেগে ওঠে। বৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এলেও সূর্য দেখা যায় না । কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া টাকরায় স্যুপ খাওয়ার টক স্বাদ নিয়ে সশব্দ ঢেকুর তোলে । আর সেটা তার দেহে হুকুমের মত কাজ করায় কাঁধে চাদর ফেলে পায়খানায় যায় সে। প্রয়োজনের চেয়েও বেশী সময় কাটায় সে ওখানে, যেখানে কাঠের বাক্সটাতে ঘন গাজানোর কাজ চলছিল আর বেরিয়ে আসছিল গাজলা। তার উপর আসনপিঁড়ি অবস্থায় বসে থাকে যতক্ষণ না অভ্যেস তাকে আবার কাজ শুরু করার সময় বলে দেয় । অপেক্ষার সময়টাতে মনে পরে সেদিন ছিল মঙ্গলবার, আর হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো কর্মশালায় আসেনি কারন মঙ্গলবার হচ্ছে কলা কোম্পানীর বেতন দেবার দিন । বিগত কয়েক বছরের মতই এই স্মৃতি তাকে নিয়ে যায় যুদ্ধের স্মৃতিতে নিজের অজান্তেই । মনে পরে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেজ কথা দিয়েছিল কপালে সাদা তারাওয়ালা এক ঘোড়া জোগাড় করে দেবার কিন্তু এ সম্বন্ধে দ্বিতীয়বার আর কিছু বলেনি সে, পরে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনার দিকে নিয়ে যায় তার স্মৃতি । কিন্তু সেগুলো সে স্মরণ করে কোন রকমের কোন বিশ্লেষণ ছাড়াই, কারন অন্য কিছু চিন্তা করার অপারগতার ফলে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে শিখেছে সে, যাতে করে অনিবার্য স্মৃতিগুলো যেন তার অনুভূতির কোন ক্ষতি না করতে পারে । কর্মশালায় ফিরে আসার পর আবহাওয়া শুকিয়ে আসছে দেখে মনে হয় এটাই গোসল করার উত্তম সময়; কিন্তু তার আগেই আমারান্তা গোসল আরম্ভ করে দিয়েছে। ফলে আরম্ভ করে দেয় দিনের দ্বিতীয় সোনার মাছ তৈরীর । লেজটা বসানোর সময় রৌদ্র ওঠে এমন তেজ নিয়ে যে ইয়টের মত কাচকেচিয়ে ওঠে আলো। তিনদিনের গুড়ি বৃষ্টিতে ধোয়া বাতাস ভরে যায় উড়ন্ত পিপীলিকায়। তখনই টের পায় পেশাবের বেগ, আর যেটাকে সে আটকে রাখছিল দ্বিতীয় মাছটা বানানোর জন্য । বেলা চারটে দশে উঠানের দিকে যাচ্ছিল যখন কানে আসে দূর থেকে ভেসে আসা কাঁসা আর ড্রামের শব্দ, শিশুর দলের কোলাহল, আর যৌবনের পর এই প্রথমবারের মত জেনেশুনে পা দেয় স্মৃতিকাতরতার ফাঁদে আর জাগিয়ে তোলে জিপসীদের সেই বিস্ময়কর বিকেলটিকে যেদিন ওর বাবা ওকে বরফ চেনাতে নিয়ে গিয়েছিল । রান্নাঘর থেকে রান্না ফেলে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ দরজার দিকে দৌড় লাগায় ।
-"সার্কাস এসেছে"- চীৎকার করে ।

চেষ্টনাটের দিকে যাবার বদলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াও রাস্তার দরজার দিকে গিয়ে মিশে যায় শোভাযাত্রা দেখতে আসা কৌতূহলী লোকদের সাথে । দেখতে পায় হাতির পিঠে বসে থাকা সোনালী পোশাক পরা এক মেয়েকে, দেখে বিষন্ন এক উট। দেখে ওলন্দাজ মেয়ে পোশাক পড়া ভালুককে বড় এক চামচ ও কড়াই দিয়ে বাজনার তাল দিতে, শোভাযাত্রার লেজের দিকে ভাঁড়-কে ডিগবাজি খেতে আর সকলে চলে যাবার পর পুনরায় দেখতে পায় নিজের নিঃসঙ্গতার করুন চেহারা আর তখন রাস্তায় আলোকিত শূন্যতা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকে না । বাতাস ভরে ওঠে উড়ন্ত পিপীলিকায় আর শুধু থাকে গভীর অনিশ্চয়তার চূড়া থেকে উঁকি দেয়া কিছু কৌতুহলী লোক। তখন সার্কাসের কথা চিন্তা করতে করতে যায় চেষ্টনাটের নীচে, আর যতক্ষণ পেশাব করে চিন্তা করার চেষ্টা করে সার্কাসের, কিন্তু স্মৃতিটাকে সে আর খুঁজে পায় না । মুরগীর ছানার মত ঘাড়ের মধ্যে গুঁজে দেয় মাথাটাকে আর চেষ্টনাটের গুড়িতে কপাল ঠেস দিয়ে পরে থাকে নিশ্চল। পরদিন, সকাল এগারোটার সময়, বাড়ির পেছনে ময়লা ফেলার সময় সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের মনোযোগ কাড়ে শকুনের দল আর ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবারের কেউই খবরটা জানতে পারে নি ।
(চলবে)