সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ: ‘চেরনোবিলের কণ্ঠস্বর’ থেকে

বিনয় বর্মনবিনয় বর্মন
Published : 10 Oct 2015, 05:05 PM
Updated : 10 Oct 2015, 05:05 PM

সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ ২০১৫ সালে সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী। ১৯৪৮ সালের ৩১ মে ইউক্রেনে জন্মগ্রহণকারী বেলারুশের এই লেখিকা সাক্ষাৎকারমূলক গদ্য রচনায় সিদ্ধহস্ত। তাঁর গদ্য নিছক সাংবাদিকীয় সাক্ষাৎকার নয়, বরং তা অনবদ্যরূপে সাহিত্যগুণসম্পন্ন, যা বেদনাদায়ক মানবীয় অভিজ্ঞতার করুণ রসে সিক্ত। বর্তমান রচনাটি ('On Why We Remember') কীথ গেসেন অনূদিত তাঁর চেরনোবিলের কণ্ঠস্বর (Voices from Chernobyl) গ্রন্থ থেকে গৃহীত। এটি উক্ত বইয়ের Part One: 'The Land of the Dead'-এর প্রথম অধ্যায়, যেখানে লিপিবদ্ধ পিওতর এস. (Pyotr S.) নামে এক মনোবিদের স্মৃতিচারণ। অনুবাদ করেছেন বিনয় বর্মন। বি. স.

তুমি এ ব্যাপারে লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছো? কিন্তু আমি চাই না লোকজন আমার সম্পর্কে এটা জানুক। সেই অভিজ্ঞতা আমি জানাতে চাই না। আমার মধ্যে কাজ করে একদিকে সবকিছু খুলে বলার বাসনা, অন্যদিকে নিজেকে মেলে ধরার কুণ্ঠা।

তোমার কি তলস্তয়ের ঘটনা মনে পড়ে? পিয়েরে বেজুখভ যুদ্ধ দেখে কতোই না বেদনাহত! তার মনে হয়েছে সে এবং সমস্ত পৃথিবী চিরকালের জন্য বদলে গেছে। কিছুটা সময় অতিবাহিত হয় এবং সে নিজেকে বলে: 'আমি আগের মতোই কোচ-চালকের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলবো। আমি আগের মতো হুঙ্কার দেবো।' মানুষ তাহলে স্মরণ করে কেনো? যাতে তারা সত্য নির্ধারণ করতে পারে? সততার জন্য? যাতে তারা নিজেদেরকে মুক্ত করে দিয়ে ভুলে যেতে পারে? এর কারণ কী এটা যে তারা মনে করে তারা কোনো বৃহৎ ঘটনার অংশ? নাকি তারা লুকানোর জন্য অতীতপানে তাকায়? স্মৃতি ভঙ্গুর, ক্ষণস্থায়ী—এটা সঠিক জ্ঞানের ধারক নয়, বরং নিজের সম্পর্কে এক ধরনের অনুমান। এটা জ্ঞানের কোনো পর্যায়েই পড়ে না, এটা কিছু আবেগের সমষ্টিমাত্র।

আমার আবেগ … আমি চেষ্টা করি স্মৃতির গভীরে ঢুকতে। আর আমার মনে পড়ে যায়।

আমার শৈশবের সবচেয়ে ভীতিকর জিনিস হলো যুদ্ধ।

আমার মনে পড়ে, আমরা ছেলেরা কিভাবে 'মা মা বাবা বাবা' খেলতাম। আমরা বাচ্চাদের পোশাক খুলে একজনের ওপর আরেকজনকে তুলে দিতাম। এরা যুদ্ধের পরে জন্ম নেওয়া শিশু। যুদ্ধের সময় বাচ্চাদের কথা সবাই ভুলেই গিয়েছিলো। আমরা জীবনের আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করেছি। আমরা 'মা মা বাবা বাবা' খেলেছি। আমরা জীবনের আবির্ভাব দেখতে চেয়েছি। আমাদের বয়স তখন আর কতো হবে, আট-দশ বছর!


আমি এক মহিলাকে দেখেছি আত্মহত্যার চেষ্টা করতে। নদীর পাশে ঝোপের আড়ালে। সে হাতে ইট নিয়ে নিজের মাথায় দমাদম আঘাত করছিলো। সে ছিলো অন্তসত্ত্বা, যা ঘটেছে এক ঘৃণ্য দখলদার সৈনিকের বদৌলতে। বাচ্চা বয়সে আমি গাদা গাদা বিড়ালছানাও জন্ম নিতে দেখেছি। আমি মাকে গাভীর পেট থেকে বাছুর টেনে বের করতে সাহায্য করেছি। আমি আমাদের শূকরীকে নিয়ে গেছি বন্য শূকরের কাছে। আমার মনে পড়ে, তারা বাবার মৃতদেহ কিভাবে নিয়ে এলো। তার গায়ে ছিলো সোয়েটার, যেটা আমার মা বুনে দিয়েছিলো। ম্যাশিন গানের গুলিতে তার শরীর ঝাঁঝরা। সোয়েটারের ভেতর থেকে বেরিয়েছে রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড। খাটের ওপর তাকে রাখা হয়েছিলো। অন্য কোথাও রাখার জায়গা ছিলো না। বাড়ির সামনেই তাকে কবর দেওয়া হয়। থকথকে কাদার নিচে। কাদায় মিশে ছিলো বিটমূল। চারদিকে তখন যুদ্ধ চলছিলো। রাস্তায় ছড়ানোছিটানো মানুষ ও ঘোড়ার মৃতদেহ।

আমার কাছে স্মৃতি অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়। আমি তা অন্যের কাছে চাউর করতে পছন্দ করি না।

সে-সময় আমি জন্মের কথা যেমন ভেবেছি, তেমনি ভেবেছি মৃত্যুর কথা। বাছুর কিংবা বিড়ালছানার জন্ম আর মানুষের আত্মহত্যা আমার কাছে একই অনুভূতি নিয়ে আসে। যে কারণেই হোক, জন্ম ও মৃত্যু আমার কাছে একই বিষয় বলে মনে হয়।

শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে। শূকর জবাই করার সময় বাড়িতে কেমন বোঁটকা গন্ধ। তুমি কেবল আমাকে স্পর্শ করেছো, আর আমি গড়িয়ে পড়ছি। গড়িয়ে পড়ছি দুঃস্বপ্নের গহীনে। আতঙ্ক। আর আমি তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি। মনে পড়ে, যখন ছোট ছিলাম, মহিলারা আমাদের বাষ্পঘরে নিয়ে যেতো। আমরা দেখতাম, তাদের জরায়ু (সেই বয়সেও আমরা এটা বুঝতাম) বেরিয়ে আসছে আর তারা তা ন্যাকড়া নিয়ে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

আমি দেখেছি অতিরিক্ত পরিশ্রমে পড়ে যাওয়া মানুষ। বাড়িঘরে পুরুষ নেই। আস্তাবলে ঘোড়া নেই। মহিলারা বোঝা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তারা ক্ষেতে লাঙল দিচ্ছে। বড় হওয়ার পরে আমার যখন কোনো মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়, তখন দেখেছি বাষ্পঘরে কী ঘটে। আজ সব মনে পড়ছে।

কিন্তু আমি ভুলতে চেয়েছি। সবকিছু ভুলতে চেয়েছি। সবকিছু ভুলেও গেছি। আমার মনে হয় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। যুদ্ধ। আমি এখন সুরক্ষিত। সুরক্ষিত বটে!

তারপর আমি চেরনোবিল এলাকায় গেলাম। সেখানে অনেকবার গিয়েছি। বুঝেছি আমি কতোটা শক্তিহীন। আমি ভেঙে পড়ছি। আমার অতীত আমাকে আর রক্ষা করে না। কোনো উত্তর নেই। সেখানে যারা ছিলো, এখন তারা নেই। অতীত নয়, ভবিষ্যৎ আমাকে ধ্বংস করছে।