আর্থার শোপেনহাওয়ার প্রবন্ধ : পঠন ও পুস্তক

shibobroto_barmon
Published : 16 Feb 2013, 10:22 AM
Updated : 16 Feb 2013, 10:22 AM

অজ্ঞতা তখনই অবমাননাকর, যখন অজ্ঞ ব্যক্তিটি ধনবান হইয়া থাকেন। অভাব নিঃস্বের হস্তপদ বাঁধিয়া ফেলে, চাকরিই তাহার জ্ঞান, চাকরিই ধ্যান। কিন্তু যে সকল ব্যক্তি ধনবান হইয়াও অজ্ঞ, তাহারা কেবল বাঁচিয়া থাকেন আনন্দ সম্ভোগের নিমিত্ত, শ্বাপদের ন্যায়; ইহার প্রমাণ সতত বিধৃত। তাহারা করুণার পাত্র, কেননা ধনসম্পদ আর অবসর তাহারা বিদ্যার্জনের নিমিত্ত ব্যয় করেন নাই।

আমরা যখন কোনো পুস্তক পাঠ করি, তখন ভিন্ন এক ব্যক্তি আমাদের হইয়া চিন্তা করিয়া দেন: আমরা কেবল তাহার মানসিক ক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি করি মাত্র। ইহা সেই অপরিণত শিক্ষার্থীর ন্যায়, লিখন শিখিবার জন্য যে শিক্ষকের আঁকিয়া দেওয়া অক্ষরের উপর দিয়া আপনকার কলম চালনা করে। পঠনকালে চিন্তাক্রিয়াটিও সেইরূপ অপর কর্তৃক সমাধা হইয়া থাকে। এই কারণেই গভীর চিন্তামগ্নাবস্থা অন্তে আমরা যখন কোনো বই পাঠ শুরু করি, তখন কেমন নির্ভার বোধ হয়। পাঠকালে আমাদের মস্তিষ্ক অন্যের চিন্তার ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই কারণে, যে ব্যক্তি বিস্তর পুস্তকাদি পাঠ করিয়া থাকেন –ধরা যাক, সারাদিন পাঠ করেন-এবং এক পাঠ হইতে অন্য পাঠের মধ্যবর্তী মুহূর্তগুলি জাবর কাটেন, তিনি নিজে চিন্তা করিবার সামর্থ্য হারান, ঠিক যেমন সর্বদা মোটরগাড়িতে চলাফেরা করা ব্যক্তি হারাইয়া ফেলেন হাঁটিবার ক্ষমতা। ইদৃশ পরিণতি বহু জ্ঞানী বিদ্বজনেরই হইয়াছে: তাহারা পড়িয়া পড়িয়া নির্বোধে পরিণত হইয়াছেন। কেননা প্রত্যেক অবসর মুহূর্তে পুস্তক পাঠ, অর্থাৎ অহর্নিশি পাঠক্রিয়া, নিরন্তর কায়িক শ্রম অপেক্ষা অত্যধিক ক্ষতিকর। বহিঃশক্তির নিরন্তর চাপে একখানি স্প্রিং যে-প্রকারে নিজের স্থিতিস্থাপকতা বিসর্জন দেয়, ভিন্ন ব্যক্তির চিন্তা অনবরত চাপিয়া বসিতে থাকিলে মনেরও তদ্রুপ পরিণতি ঘটে। অত্যধিক ভূড়িভোজ যদ্রুপ পাকস্থলীর জন্য পীড়াদায়ক এবং নিত্য করিলে শরীরের বারোটা বাজে, মানসাভ্যন্তরে অত্যধিক পুষ্টির অনুপ্রবেশও তদ্রুপ ইহার শ্বাসরোধ ঘটায়। কেননা কোনো ব্যক্তি যতোই পাঠ করে, ততই সে যাহা পড়িয়াছে, তাহার নিশানা মুছিয়া যাইতে থাকে; মন একখানি শ্লেটের ন্যায়, ক্রমাগত অপনয়ন করিয়া তাহার উপর নতুন লেখা চলে। ফলত, চিন্তা করা অসম্ভবপর হইয়া পড়ে। আর একমাত্র চিন্তার দ্বারাই যাহা-যাহা পঠিত হইয়াছে, তাহা-তাহার সংশ্লেষ সাধন সম্ভব। কেহ যদি একনাগাড়ে শুধু পাঠ করিয়া যায়, যাহা পড়িতেছে পরে সে বিষয়ের ওপর চিন্তাভাবনা না করে, তবে পঠিত বিষয় বদ্ধমূল হয় না, বৃহদংশই হারাইয়া যায়। দৈহিক ব্যঞ্জনের ক্ষেত্রে যাহা সত্য, তাহা মানসিক ভোগ্যাদির ক্ষেত্রে অসত্য নয়: মনুষ্য আহারের এক-পঞ্চমাংশ কদাচ আত্মসাৎ হয়, বাকি অংশ মূত্র, স্বেদ ইত্যাদি আকারে নিষ্ক্রান্ত হইয়া যায়।

এতদ্বিবেচনায়, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া চলে যে, কাগজে লিপিবদ্ধ চিন্তা বালুকাবেলায় পদচিহ্নের অতিরিক্ত কিছু নহে: ইহা দ্বারা কেবল পথিকের অনুসৃত পথের নিশানা পাওয়া চলে, পরন্তু পথিক পথিমধ্যে কী কী অবলোকন করিয়াছেন, সেই তথ্য পাওয়া চলে না, তাহা পাইতে পথিকের চক্ষু অধিকার করিতে হয়।

বই পাঠ করিয়া উহার লেখকের কোনো গুণাবলী আত্মস্থ করা সম্ভবপর নহে: সে তাহা বাকচাতুর্যই হউক, বা হউক কল্পনাশক্তি, উপমা-নির্মাণ-দক্ষতা, দৃঢ়তা বা তিক্ততা, বীরত্ব বা ঔদার্য্য, প্রকাশদক্ষতা বা বুদ্ধিপ্রাখর্য্য, সারল্য বা ইত্যাদি। কিন্তু আমরা যদি ইতঃপূর্বে এইসকল গুণাবলীর অধিকারী হইয়া থাকি – অর্থাৎ কিনা যদি এইসকল আমাদের জন্মগত হইয়া থাকে – পঠনমুহূর্তে আমরা সেইসকলকে জাগ্রত করিয়া মনের চেতন স্তরে তুলিয়া আনিতে পারি; আমরা স্থির করিতে পারি, গুণগুলিকে কোন প্রয়াসে ব্যবহার করিব; তুলনাকর্মের মাধ্যমে আমরা সেইগুলিকে আরো শাণিত করিতে পারি, সেগুলির যোগ্যতর প্রয়োগ চর্চ্চা করিতে পারি; আর এই কর্মগুলি সমাধা হইলে পরে আমরা বলিতে পারি যে, আমরা সত্যিকারভাবে ইহাদের অধিকারী হইয়াছি। কেবলমাত্র এই পথে আমরা বলিতে পারি যে, পঠনক্রিয়া লিখনক্রিয়ার রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে, কেননা ইহা আমাদের জন্মলদ্ধ গুণ সমুদয়ের সঠিক প্রয়োগ শিক্ষা দেয়। আর ইহা তখনই সম্ভব, যখন গুণগুলি আমাদের মধ্যে ভূতপূর্ব থাকে।

এতদ্ভিন্ন বইপাঠ হইতে কতকগুলি শীতল, মৃত অভ্যাস ব্যতীত আর কিছু আমাদের আয়ত্ত হয় না এবং আমরা নিছক অনুকরণকারীতে পর্যবসিত হই।

যে-প্রকারে বসুন্ধরার অভ্যন্তরভাগ অতীতের জীবসকলকে স্তরে স্তরে ধারণ করিয়া থাকে, একখানি গ্রন্থাগারের আলমারিসমুহও অতীতের সমুদয় ভুলভ্রান্তিকে তদ্রুপ সংরক্ষণ করিয়া চলে। অতীতকালের জীবের ন্যায় এই গ্রন্থগুলিও নিজ নিজ সময়ে প্রাণপ্রাচুর্যময় ছিল, বিস্তর কর্ণপীড়াদায়ক শোরগোল তুলিয়াছে; কিন্তু এক্ষণে তাহারা অনড় ও প্রস্তরিভূত। তাহাতে একমাত্র প্যালিঅন্টলজিস্টেরই আগ্রহ।

হেরোডোটাসের ভাষ্যমতে, জারেক্সেস তাহার অপরিমেয় সেনাবহর দর্শনে এই ভাবিয়া অশ্রু বিসর্জন দিয়াছিলেন যে, আহা! আজি হইতে শতবর্ষ পরে ইহাদের কে বা জীবিত থাকিবে! অমেয় গ্রন্থতালিকার দিকে চাহিয়া কাহাকে না অশ্রু সংবরণ করিয়া বলিতে হইবে, আহা! আর দশ বৎসর অন্তে ইহাদের অনেকগুলিরই অস্তিত্ব বিলীন হইয়া যাইবে!
মনুষ্যজীবনে যাহা সত্য, সাহিত্যভাণ্ডারের বেলাতেও তাহার ব্যতয় নাই। ধরাধামে যেইখানেই যাওয়া চলে, মনুষ্যের গিজগিজ ভিড়। সর্বত্র ঝাঁকে ঝাঁকে তাহারা বিচরণশীল; গ্রীষ্মদেশীয় মক্ষিকার ন্যায় উড়িতেছে, সবকিছু নোংরা করিতেছে। অপগ্রন্থও সংখ্যায় তদ্রুপ, সাহিত্যের এইসকল আগাছা শস্য হইতে পুষ্টি শুষিয়া তাহাকে ছোবরা বানাইতেছে।

এই কারণে, পাঠ না করিয়া থাকিবার কৌশল আয়ত্ব করা অত্যন্ত জরুরি।
(সংক্ষেপিত)