ভাষাতাত্ত্বিক অনাথ আশ্রম: বলকান ভাষাসমূহ

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 10 Sept 2011, 05:34 AM
Updated : 24 April 2022, 05:26 AM

{গাস্তান দোরেন একজন ভাষাতাত্ত্বিক, সাংবাদিক এবং বহুভাষাবিদ। তিনি ওলন্দাজ, লিম্বার্গিশ, ইংরেজি, জর্মন, ফরাসী, এবং হিস্পানী ভাষায় কথা বলতে পারেন, পড়তে পারেন আফ্রিকানস, ফ্রিসীয়, পর্তুগীজ, ইতালীয়, কাতালান, ডেনিশ, নরওয়েজীয়, সুইডিশ এবং লুক্সেমবুর্গিশ। ওলন্দাজ ভাষায় তিনি দুটো গ্রন্থ রচনা করেছেন — অভিবাসীদের ভাষা নিয়ে রচিত Nieuwe tongen (New Tongues), এবং Taaltoerisme (Language Tourism), যে-বইয়ের ওপর ভিত্তি ক'রে Lingo: A Language Spotter's Guide to Europe ইংরেজিতে রচিত হয়েছে, এবং তৈরি হয়েছে Language Lover's Guide to Europe নামের একটি অ্যাপ (বক্ষ্যমাণ রচনাটি Lingo বইটির-ই একটি নাতিদীর্ঘ অধ্যায়ের অনুবাদ)। অবসরে গাস্তান দোরেন গান গাইতে পছন্দ করেন, এবং অবশ্যই তা বহু ভাষায়। নেদারল্যান্ডের আমার্সফুর্ট-এ তিনি সস্ত্রীক বাস করেন।}

মূল: গাস্তান দোরেন
অনুবাদ: জি এইচ হাবীব


আমাদের পরিবারই আমাদের তৈরি করে। কথাটা এভাবেও বলা যেতে পারে যে, আমরা যা তা আমাদের পরিবারের-ই তৈরি। আমাদের মা-বাবার কাছ থেকে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু জিন-ক্রোমোজম লাভ করি; ওদিকে, আমাদের মা-বাবার জিনও আবার তাঁদের মা-বাবার কাছ থেকে পাওয়া। একইভাবে, বেশিরভাগ ভাষাই একটি পরিবারের অংশ। এবং সেসব পরিবারের সদস্যরা উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। অবশ্য একথা বলতেই হচ্ছে যে ভাষাতাত্ত্বিক রিপ্রোডাকশন বা পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে, দুই পিতা-মাতাসদৃশ ভাষার মিলনে নতুন নতুন ভাষার সৃষ্টি হয় না। ভাষা সাধারণত অ্যামিবার মতো বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়ে যায়; কিংবা বলা যেতে পারে, ভাষার শাখা-প্রশাখা গজায়, স্ট্রবেরি গাছের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রোমান্স ভাষাগুলো (রুমানীয়, হিস্পানী, ফরাসী, ইতালীয়, এবং আরো কিছু) লাতিন থেকে উদ্ভূত হয়েছে; এবং টক পিসিন (পাপুয়া নিউগিনির ক্রেয়ল ভাষা) ইংরেজির একটি ছোট্ট শাখা।

তবে, মানুষ হিসেবে আমরা যেভাবে আচরণ করি, নিজেদের ব্যক্ত করি, তা কেবল আমাদের বংশানুক্রম দ্বারাই নির্ধারিত নয়। আমাদের জীবনের নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা, অর্থাৎ আমাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, এবং সেই অভিজ্ঞতার সূত্রে যাদের সঙ্গে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ ও চেনা-জানা হয় তারাও আমাদের সৃষ্টি করে। আর তারই ফলে, পরিবারের কোনো কোনো সদস্য অন্যদের চাইতে বেশি বিশিষ্টতা অর্জন করে – প্রবাদ অনুযায়ী যাকে বলে পরিবারের 'সাদা দাঁড়কাক', বা কখনো কখনো 'কুলাঙ্গার'। ভাষাতাত্ত্বিক বিষয়েও এই প্যাটার্নটা বেশ কাজ করে। ভাষাগুলোর ওপর পারস্পরিক প্রবল প্রভাব থাকতে পারে, বিশেষ ক'রে যখন বিভিন্ন ভাষা পরিবার শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিবিড় সংসর্গে বাস করে। আর ইউরোপের বলকান অঞ্চলে এই বিষয়টি যতটা সুতীব্র ও জটিলভাবে – আর সেই সঙ্গে এত স্থায়ীভাবে — ঘটেছে তা অন্য কোথাও ঘটেনি।

ইউরোপের দক্ষিণ পূর্ব কোণে অবস্থিত বলকান অঞ্চলটিকে বিভিন্ন ভাষার একটি তালগোল পাকানো মিশ্রণ বলা যেতে পারে – আলবেনীয়, বুলগেরীয়, গ্রীক, এবং মেসিদোনীয় থেকে রুমানীয়, রুমানী, সার্বো-ক্রোয়েশীয় এবং তুর্কী – যেগুলো এখন আর তাদের পরিবারে সঙ্গে বাস করে না। সত্যি বলতে কী, আলবেনীয় এবং গ্রীক ভাষার কোনো পরিবার এখন আর অবশিষ্ট নেই। রুমানীয় তার সবচাইতে কাছের রোমান্স প্রতিবেশী ইতালীয় থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে বাস করে। রুমানী নামের এক ভারতীয় ভাষা দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত তার পরিবার থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের বাসিন্দা; অন্যদিকে তুর্কী ভাষার বেশিরভাগ ভাই-বেরাদরের বাস বেশ খানিকটা দূরে, পুব দিকে। আর, সবশেষে, স্লাভিক-বলকান ভাষাগুলো (বুলগেরীয়, মেসিদোনীয় এবং সাব ক্রোয়েশীয়) মিলে স্লোভেনীয় ভাষার সঙ্গে একটি পরস্পর সন্নিহিত ভাষাদল তৈরি করেছে, কিন্তু তারাও সবাই তাদের আত্মীয়-পরিজনদের (যেমন রুশী, ইউক্রেনীয় এবং পোলিশ) প্রধান ভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন। সংক্ষেপে বললে, বলকান অঞ্চলটি একটি ভাষাতাত্ত্বিক অনাথ আশ্রম বা এতিমখানা।
তুর্কী ভাষাটিকে খানিকটা অন্তর্মুখী বা ইন্ট্রোভার্ট বলা যেতে পারে। অন্য ভাষার সঙ্গে সংসর্গের ক্ষেত্রে সেটা ধার নেয়া এবং, বিশেষ ক'রে, ধার দেয়া ছাড়া তেমন কিছু করেনি। তার বিপরীতে বাকি সাতটি ভাষা একে অন্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আর তাতে অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই, কারণ ভাষাগুলো দীর্ঘদিন একই প্রাঙ্গণে বাস করেছে ।

শত শত বছরে ধরে এসব ভাষা ব্যবহারকারীরা পরস্পরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আব্দ্ধ হয়েছে, এক সঙ্গে অভিবাসী হয়েছে, থেকেছে, সফর করেছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে, সহযোগী এবং শত্রু হিসেবে যুদ্ধ করেছে, একে অন্যের ধর্মে হস্তক্ষেপ করেছে। এখনো, এই একবিংশ শতকেও, বলকান অঞ্চলটি সংখ্যালঘু জনগণে গিজগিজ করছে। আলবেনীয়-ভাষী অঞ্চলে সার্বীয় ভাষী ছিটমহল (enclave) আছে; গ্রীক এলাকায় আছে মেসিদোনীয় আর রুমানীয় ছিটমহল; এবং এরকম আরো অনেক। আর অতীতে তো এখানকার লোকজন আজকের চাইতেও আরো অনেক বেশি জগাখিচুড়ি দশায় ছিল – প্রত্যেক্যেই দুই বা ততোধিক ভাষায় কথা বলতে জানতো; সব ক্ষেত্রেই যে খুব তরতর ক'রে তা নয়, তবে লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করার মতো যথেষ্ট ভালোভাবেই।

আর এই বহুভাষিতার কারণেই, যেসব ভাষার মধ্যে ফারাক ছিল রাত আর দিন, সেগুলো ধীরে ধীরে এক অন্যের মতো হয়ে গেল, বিশেষ ক'রে রুমানীয়, আলবেনীয়, মেসিদোনীয় আর বুলগেরীয়। হাল আমলে ভাষাগুলোর মধ্যে এত মিল চোখে পড়বে যে তাদের সবগুলোকে পরস্পরের আত্মীয় বলে লোকে ভুল করতে পারে (মেসিদোনীয় আর বুলগেরীয় আসলেই অতি নিকট সম্বন্ধীয়, কিন্তু অন্য দুটো তা নয়)। এই ভাষাতাত্ত্বিক কোয়ার্টেট বা চতুষ্টয়ের সঙ্গে সার্বো-ক্রোয়েশীয়, গ্রীক এবং রুমানী ভাষারও নানান বৈশিষ্ট্যগত মিল রয়েছে। একসঙ্গে এই আঁসেম্বলটি (ensemble) তথাকথিত বলকান স্প্রাখবান্দ (sprachbund) বা এক ধরনের বলকান লীগ বা গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে।
তা, এদের মধ্যে মিল কোথায়? একটা মিল, আর্টিকেল-এ। এই গোষ্ঠীর সদস্যদের বেশিরভাগই ডেফিনিট আর্টিকেল (দ্য) বিশেষ্যর পরে বা শেষে বসায়, আগে নয়। যেমন, রুমানীয় ভাষায় 'dog' হচ্ছে câine, 'the dog' câinele। বুলগেরীয়তে এ-দুটো হবে kuche এবং kuchete, (শেষের বাড়তি হরফগুলো আর্টিকেল বোঝায়), আর আলবেনীয়তে qen ও qeni। ব্যাপারটি উল্লেখ্যযোগ্য, যেহেতু এই ভাষাগুলোর সবচাইতে ঘনিষ্ঠ আত্মীদের মধ্যে, যেমন ইতালীয় এবং পোলিশ, এমনটা দেখা যায় না। ভাষাতাত্ত্বিক জোয়াকিম ম্যাটযিংগার এবং স্টেফান শুমাখার কয়েক বছর আগে আবিষ্কার করেন যে, বিশেষ এই রীতিটির উৎস সম্ভবত আলবেনীয়।

আরেকটি খাস বলকান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইনফিনিটিভ-এর বিরল ব্যবহার বা সেটার সম্পূর্ণ পরিহার। বেশিরভাগ ইউরোপীয় ভাষায় 'he ought to go'–র মতো বাক্যে ইনফিনিটিভ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। রুমানীয় এবং অন্যান্য বেশিরভাগ বলকান ভাষা অবশ্য কনজুগেটেট ভার্ব ফর্ম ব্যবহার করতে পছন্দ করে। আর তার ফলে, এমন সব বাক্যের সৃষ্টি হয় যার ইংরেজি অনুবাদে এমনটা দাঁড়াবে: 'it ought that he goes.' এই বৈশিষ্ট্যটিও বলকান অঞ্চলের বাইরের কাছাকাছি সম্পর্কযুক্ত ভাষাগুলোতে দেখা যায় না।


তৃতীয় উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো ভবিষ্যত কালের গঠন, ইংরেজিতে যা 'will' দিয়ে চেনা যায়। এই টেন্সটি ইউরোপীয় ভাষাগুলো নানান উপায়ে ব্যক্ত করে। কিন্তু এক্ষেত্রে বলকান গোষ্ঠী সদস্যদের প্রায় সবাই একটিই মাত্র ব্যতিক্রমহীন শব্দ ব্যবহার করে। এই শব্দটির আদি অর্থ ছিল অনেকটা '(it) wants'; কিন্তু তারপর থেকে এটা একটি পুরোপুরি ব্যাকরণগত হাতিয়ার বা উপকরণে পরিণত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, 'they will sing' রুমানীয়তে হবে et voirr cânte যার মানে একসময় ছিল '(it) wants that they sing'। (এদিক থেকে ইংরেজি ভাষা ঘটনাক্রমে একটি বলকান ভাষা হতে পারতো, যেহেতু 'they will' একসময় 'they want' বা 'they wish'- এর সমার্থক ছিল)

সাদৃশ্য আরো আছে। বলকান গোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যই ডিগ্রিয অভ কম্প্যারিযন বা তুলনার মাত্রা সাফিক্স দিয়ে তৈরি করে না ('prettier', 'prettiest', ইত্যাদি); করে অকযিলিয়ারি শব্দ দিয়ে। ('more pretty' 'most pretty')। বেশিরভাগ সদস্যের রয়েছে মাত্র দুই বা তিনটি কারক বা গ্র্যামাটিকাল কেস।, যার একটি অবশ্যই ভোকেটিভ বা সম্বোধন সূচক। আর বেশিরভাগ সদস্যই একটি ভোঁতা 'আহ (uh)' আওয়াজের অধিকারী, যা schwa নামে পরিচিত, এবং ইংরেজি শব্দ 'sofa'-র 'a' বা 'pencil'-এর 'i', বা 'spoken'-এর 'e'-র ধ্বনি বা উচ্চারণ এই schwa- ই। মানে, সেই ভোঁতা 'আহ (uh)'। রুমানীয় ă, আলবেনীয় ë, এবং বুলগেরীয় (সিরিলিক) ъ, এগুলো সবই একইভাবে উচ্চারিত হয়।

এসবকে মোটের ওপর সুসংসবাদ বলেই মনে হতে পারে। ভাষায় ভাষায় যত বেশি মিল থাকবে লোকে ততই আরো ভালোভাবে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। এমনটাই মনে হতে পারে আমাদের কাছে। কিন্তু বলকান ভাষাগুলোর মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পার্থক্য রয়েছে: আরে সেটা হলো, তাদের শব্দভাণ্ডার। অবশ্যই সেগুলোর মধ্যে খানিকটা মিল বা সাদৃশ্য রয়েছে। এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে 'dog' শব্দটি রুমানীয় আর আলবেনীয় ভাষায় কাছাকাছি — যথাক্রমে câine এবং qen, যেহেতু এই দুটোই লাতিন থেকে এসেছে। সেরকমই, 'paint' বোঝাতে আলবেনীয়, রুমানীয়, এবং রুমানী ভাষায় যে-শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়, যথাক্রমে, bojë, boja, আর bojava, এবং সেই সাথে বুলগেরীয়, মেসিদোনীয় আর সার্বো-ক্রোয়েশীয় ভাষায় boja — এই সবগুলোরই উৎস তুর্কী শব্দ boya। কিন্তু তিনটি স্লাভিক ভাষা বাদ দিলে, শব্দ ভাণ্ডারের ক্ষেত্রে মিলের চাইতে অমিলই নজরে বেশি পড়বে।

কাজেই, এই অনাথ আশ্রমের শত শত বছরে বিভিন্ন বলকান ভাষার ব্যাকরণগত আচরণ দিন দিন কাছাকাছি এসেছে। কিন্তু তাদের বাইরের চেহারার কথা বিচার করলে – মানে, তাদের শব্দভাণ্ডার– তারা বেশ কঠোরভাবে তাদের পরিবারের প্রতিই বিশ্বস্ত থেকেছে। আর তার ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, এই ভাষাগুলোর ব্যবহারকারীরা এক অন্যের কথা বুঝতে পারে না।

পাদটীকা:
১. ইংরেজি ভাষা ঈদ্দিশ থেকে 'pastrami'শব্দটি ধার নিয়েছে। ঈদ্দিশ সেটা পেয়েছিল রুমানীয়র কাছ থেকে, আর রুমানীয় সেটা ধার নিয়েছিল হয় গ্রীক নয়ত তুর্কী থেকে। উল্লেখ্য, রুমানীয়তে 'ড্রাকুলা' মানে শয়তান।
২. পরিপূর্ণ মানুষ মানে, নম্র, শোভন, সম্মানীয়, সেবাপরায়ণ, সভ্য, ভদ্র বোঝাতে রুমানীয়তে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে Omenie । এটি ইংরেজিতে অনায়াসে ঢুকে পড়তেই পারে।