ব্লানচে সাকারিয়ে : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার প্রথম স্প্যানিশ অনুবাদক

কামরুল হাসানকামরুল হাসান
Published : 10 May 2020, 07:36 PM
Updated : 10 May 2020, 07:36 PM


স্প্যানিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম অনুবাদক হিসেবে নোবেলজয়ী স্পেনের কবি হুয়ান রামোন হিমেনেস ও তার স্ত্রী সেনোবিয়া কাম্প্রুবি হিমেনেস আর রবীন্দ্র সম্পর্কে প্রথম আলোচক হিসেবে রামোন পেরেস দে আইয়ালা স্বীকৃত হয়ে আছেন। কিন্তু একুয়াদরের প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গবেষক ও ভারতীয় সাহিত্যবিশারদ মারিয়া এলেনা বাররেরা-আগারওয়াল সম্প্রতি তার অনুসন্ধানে হাজির করেছেন চমকে দেয়ার মতো নতুন তথ্য যা রবীন্দ্র-গবেষণায় নতুন এক মাত্রা যুক্ত হয়েছে। নতুন এই অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে হিমেনেস-দম্পতির আগেই রবীন্দ্র-অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল বিদুষী ও বহুভাষী লেখিকা ব্লানচে সাকারিয়ে নামক এক লেখিকার হাতে। মারিয়ার এই লেখাটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা ট্রিবিউন-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায়। কবি ও অনুবাদক কামরুল হাসান বিডিআর্টসের পাঠকদের জন্য তা বাংলায় তর্জমা করেছেন। বি.স.

মুল: মারিয়া এলেনা বাররেরা-আগারওয়াল
ইংরেজি থেকে বাংলা তর্জমা: কামরুল হাসান


নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা বাংলার বাইরে কৌতূহল সৃষ্টি করেছিল। কবির নিজের করা গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের পরপরই অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় এর অনুবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। সাধারণ ধারণা হলো হুয়ান রামোন হিমেনেস ও সেনোবিয়া কাম্পরুবি স্প্যানিশ ভাষায় ঠাকুরের কবিতা প্রথম অনুবাদ করেছেন। এই ধারণা ভুল : নোবেল পুরস্কারের মাস কয়েক আগে রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রথম স্প্যানিশ অনুবাদ প্রকাশিত হয় কিউবায়, স্পেনে নয়। এই নিবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের কবিতা স্প্যানিশ ভাষায় প্রথম অনুবাদ করা ও ঠাকুরকে লাতিন আমেরিকার পাঠকদের কাছে সর্বপ্রথম তুলে ধরেছেন যিনি সেই ব্লানচে সাকারিয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রথমবারের মতো তুলে ধরলো।

অনুবাদক

জেন ব্লানচে সাকারিয়ে হাচিং ১৮৬৫ সালে নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা এলি সাকারিয়ে এসেছিলেন দক্ষিণ ক্যারোলিনা রাজ্য থেকে, তিনি ম্যানহাটনের উপকণ্ঠে একটি সুগন্ধির কারখানা খোলেন, এই সমৃদ্ধ ব্যবসাটি অনেক কাল ধরেই চালু ছিল। এলি নিজে একটি অভিবাসী পরিবারের সন্তান যার বাবা ছিল পোলিশ আর মা ছিল ইংরেজ। তার স্ত্রী আনা হাচিংস নিউ জার্সির স্থানীয় মেয়ে।

১৮৮৬ সালের ডিসেম্বরে ব্লানচে সাকারিয়ে লুইস আলেহান্দ্রো বারাল্ট ই পেওলি নামের বহু প্রতিভার অধিকারী এক কিউবান অভিবাসীকে বিয়ে করেন। পেশাগত জীবনে চিকিৎসক হলেও তিনি ছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক, কূটনীতিক ও ভাষা বিশেষজ্ঞ- যিনি ইংরেজি ভাষাভাষীদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্প্যানিশ পুস্তক রচনা করেছিলেন।

স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য

প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্লানচেকে ফ্রান্সে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে তনি আমেরিকায় পড়াশোনা করেন। ১৯০২ সালে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে; তিনি হলেন প্রথম আমেরিকান নারী যিনি কিউবা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। জীবনের এইসব কীর্তি এরূপ ধারণা দেয় যে তিনি বেশ কয়েকটি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তার মাতৃভাষা ছিল ইংরেজি, এটাও অনুমান করা অসম্ভব নয় যে তিনি পোলিশ ভাষা ভালো জানতেন। প্যারিসে থাকাকালে তিনি ফরাসী ভাষা শেখেন, আর বারাল্টকে বিয়ে করে স্প্যানিশ ভাষাটিও রপ্ত করে ফেলেন। একজন বক্তা হিসেবে তার দক্ষতা জন ফিটজেরাল্ড ব্যক্ত করেন নিম্নোক্তভাবে:

"কিউবার ড. লুইস ই বারাল্টের স্ত্রী মিসেস ব্লানচে সাকারিয়ে দে বারাল্ট বর্তমানকালে জীবিত নারীদের মাঝে সবচেয়ে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিনী, যিনি ফ্রান্স ও আমেরিকায় স্প্যানিশ ও স্প্যানিশ-আমেরিকান সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে বক্তৃতা দেন এবং শ্রোতাদের স্প্যানিশ, ফরাসি ও ইংরেজিতে সমান বাগ্মিতা ও দক্ষতার সাথে মুগ্ধ করে রাখেন।"

বহুভাষার উপর ব্লানচের এতটাই দখল ছিল যে লাতিন আমেরিকায় প্রকাশিত তার বহু পুস্তকের কোনটিই তাকে বিদেশি বলে প্রতিপন্ন করবে না। এর সাথে যুক্ত ছিল তার নামের কিছুটা রহস্যময় প্রকৃতি- যা এমন একটি ধারণা সৃষ্টির জন্য সহায়ক যে, সে অর্ধেক কিউবান, অর্ধেক উত্তর আমেরিকান। EcuRed তালিকায় তার অন্তর্ভুক্তির প্রতি ইতিহাসবিদ লিলিয়ান গেররা ইঙ্গিত দেন যে ব্লানচে সাকারিয়ে " অত্যন্ত মননশীল এক অভিবাসী।"

১৯০০ সাল পর্যন্ত বারাল্ট-সাকারিয়ে পরিবার নিউইয়র্কে বাস করেন; পরে তারা হাভানা চলে আসেন। এই ভূখণ্ড বদলের পর ব্লানচে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই কিউবার নাগরিক হয়ে যান, অন্তত আমেরিকায় তার আগমনের রেকর্ডগুলো তাই সাক্ষ্য দেয়। এ সকল আনুষ্ঠানিক অভিবাসন প্রক্রিয়ার বাইরে তিনি গভীরতম অর্থেই একজন কিউবান হয়ে ওঠেন; এর কারণ দ্বীপ রাষ্ট্রটির প্রকৃতি ও এর আবেগের প্রতি তার অনুরাগ।

এই অনুরাগের সর্বোচ্চ উদাহরণ হোসে মার্তির সাথে বন্ধুত্ব ও তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন। মার্তির বিশ্বাসভাজন কারমেন মিরায়েস ই পেওলি ছিলেন ব্লানচের স্বামীর কাজিন। কিউবার স্বাধীনতার প্রতি আমেরিকার যে অভিবাসী সম্প্রদায় নৈতিক ও আর্থিক সমর্থন জানিয়েছিল তারা ছিলেন সেই সম্প্রদায়ের সদস্য। ব্লানচে ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত তার গ্রন্থ El Marti que yo conociতে ওই আন্দোলনের ইতিহাসের একটি অসামান্য আলেখ্য তুলে ধরেন; এ গ্রন্থে তাদের নিউইয়র্কবাসের জীবনের অনেক মূল্যবান তথ্য সন্নিবেশিত।

অনুবাদ


লাতিন আমেরিকায় গীতাঞ্জলির প্রথম আলোচনা প্রকাশিত হয় কারাকাসের `এল ইউনিভার্সাল' সাময়িকীতে ১৯১৩ সালে। এই নিবন্ধের মূল লেখাটি প্রথমে অবশ্য স্প্যানিশ ভাষায় লিখিত হয়নি। এটি ছিল প্যারিসের `লা রিভিউ' পত্রিকায় প্রকাশিত জন হ্যানরিক দ্য রোসেন-এর লেখা ফরাসি প্রবন্ধের অনুবাদ। রোসেন-এর আলোচনার স্প্যানিশ ভার্সনটি ওই আগস্টেই প্রকাশিত হয় এল সালভাদরের পত্রিকা 'এল ডিয়ারিও'তে। ওই সময়ে লাতিন আমেরিকায় ফরাসি সাময়িকীগুলোর প্রবল প্রভাব থাকায় ওরকম অনুবাদ ও পুনর্মুদ্রণ ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্লানচে
সাকারিয়ে ছিলেন ব্যতিক্রমী। তার অনুবাদের উৎস অবশ্য ফরাসিই ছিল, একই সঙ্গে তা ছিল অ্যাংলো-স্যাক্সন। বহুভাষার উপর ব্লানচের দক্ষতা মূল উৎস থেকে উদ্ধৃত করতে সহায়ক হয়েছে, যে সুযোগ অন্য অনুবাদকদের ছিল না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনার প্রতি সাকারিয়ের আগ্রহের শেকড় ছিল লাভজনক। ১৯১৩ সালে তার এক বন্ধু ইউরোপ থেকে হাভানা আসেন, সঙ্গে করে নিয়ে আসেন গীতাঞ্জলির এক কপি, যা ছিল খুবই চিন্তাপ্রসূত উপহার। তার কথা থেকে এটা অবশ্য বোঝা যায়নি বইটি ১৯১২ সালে ইন্ডিয়ান সোসাইটির জন্য চিসউইক প্রেস থেকে প্রকাশিত গীতাঞ্জলির প্রথম ইংরেজি মুদ্রণ নাকি তা ১৯১৩ সালের এপ্রিলে ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত অধিকতর পরিচিত সংস্করণ, যা একই বছরে বেশ কয়েকবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। সাকারিয়ে গীতাঞ্জলি পাঠ করে বিমোহিত হন। পরবর্তীতে তিনি ওই প্রথম পাঠের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন এভাবে:

"এটা যে একজন শিল্পীর কাজ, তার চিন্তা, ছবি, অনুভূতি, এমনকি ভাষা যদিও তা ছিল বাংলায় প্রকাশিত ডানাময় কবিতার গদ্য অনুবাদ, তবু একে অনুধাবন করতে খুব বেশিদূর পাঠের প্রয়োজন হয় না; এ কবিতার সবকিছুই ছিল এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ।"

ততদিনে লাতিন আমেরিকার বোদ্ধা মহলে সাকারিয়ে একজন খ্যাতিমান লেখক ও সমালোচক হিসেবে সুপরিচিত, যিনি কিউবার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা 'এল দিয়ারিও দে লা মারিনা'র লেখক ও সম্পাদক হিসেবে জড়িত।

তার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল গীতাঞ্জলির একটি পর্যালোচনা লিখে ফেলা। তিনি নিবন্ধটির শিরোনাম দেন – 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- ভারতের এক কবি'। কবিতার প্রশংসার সাথে গীতাঞ্জলির ১৭, ১৯, ৩৫, ৩৬ ও ৫২ শীর্ষক পাঁচটি গীতিকবিতার অনুবাদ যুক্ত করেন। এই অনুবাদ সম্বলিত আলোচনাটি হাভানার 'এল দিয়ারিও দে লা মারিনা' পত্রিকার আগস্ট ৬, ১৯১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, যা ছিল রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দেবার ঘোষণার মোটামুটি তিন মাস আগে। মাদ্রিদের 'লা ত্রিবিনা' পত্রিকায় রামোন পেরেস দে আইয়ালার লেখা প্রথম স্প্যানিশ ভার্সনটি প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালের ২৩ ও ২৯ শে আগস্ট।

এর পরে সাকারিয়ে রবীন্দ্রনাথের আর কোনো অনুবাদের কাজ হাতে নিয়েছিলেন কি না তার কোনো প্রমাণ নেই। তা সত্বেও এটা ধারণা করা সম্ভব তিনি কখনোই এই কবির প্রতি তার অনুরাগ থেকে সরে আসেননি। ব্লানচের কন্যা আদেলেইদা কিউবান কূটনীতিক ও বুদ্ধিজীবী মারিয়ানো ব্রুল কাবাইয়্যেরোকে বিবাহ করেন। ১৯২৭ সালে, সন্তানদের প্রতি উৎসর্গীত "Leyenda"( রূপকথা) শীর্ষক আপাত সঙ্গতিহীন এক সংক্ষিপ্ত আনন্দময় গীতিকবিতায় ব্রুল "jitanjáfora" শব্দবন্ধটি তৈরি করেন। পরবর্তীতে আলফানসো রেইয়েস এই শব্দবন্ধটিকে 'যে সকল সৃষ্টি যুক্তির দিকে ধাবিত না হয়ে, বরং অনুভূতি ও স্বপ্নকল্পনাকে উসকে দেয়' বলে ব্যাখ্যা করেন। পরবর্তীকালে 'সুর' পত্রিকায় লেখার সময় বোর্হেস মন্তব্য করেন নতুন শব্দটি "গীতাঞ্জলির বিচারবুদ্ধিকে" ধারণ করে। ব্রুলোর শাশুড়ি ব্লানচে সাকারিয়ে যে ঠাকুরের কবিতার প্রথম স্প্যানিশ অনুবাদ করেছিলেন তা হলো ওই নতুন শব্দের একটি আশ্চর্যকর যোগসূত্র!