গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস: নীল কুকুরের চোখ

মোস্তাক শরীফমোস্তাক শরীফ
Published : 5 Feb 2022, 01:06 PM
Updated : 5 Feb 2022, 01:06 PM


মার্কেসের বিখ্যাত গল্প 'আইস অব আ ব্লু ডগ' (ওহোস দে পেররো আসুল)-এর মূল উপজীব্য এক পুরুষ ও এক নারীর সম্পর্ক, তবে এই সম্পর্ক পুরোপুরিভাবেই ঘটে স্বপ্নে। প্রথাগত বিচারে প্লট বলে তেমন কিছুই নেই গল্পটিতে, তবে মার্কেসিয় জাদুবাস্তবতার এক অনন্য উদাহরণ এটি। মার্কেস গল্পটি লিখেছিলেন ১৯৫০ সালে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত 'ওহোস দে পেররো আসুল' গল্পসংগ্রহের নামগল্প এটি।

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
ইংরেজি অনুবাদ: গ্রেগরি রাবাসা
বাংলা ভাষান্তর: মোস্তাক শরীফ

তারপর আমার দিকে তাকাল সে। ভেবেছিলাম সে-ই প্রথম তাকিয়েছে, কিন্তু বাতির পেছনে ঘুরে দাঁড়ানোর পরও যখন তার পিচ্ছিল, তেলতেলে দৃষ্টি শরীরে, ঘাড়ের পেছনে টের পেলাম, বুঝলাম সে নয়, আমিই তাকাচ্ছি প্রথমবারের মতো। সিগারেট ধরালাম। কড়া, কটু ধোঁয়ায় লম্বা টান দিয়ে ঘুরলাম চেয়ারসহ, চেয়ারের পেছনের পায়ে ভর রেখে স্থির হলাম। ঠায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে সে আমার দিকে, দীর্ঘ আর অনড় একটা হাত বাতির ওপর রাখা। প্রতি রাতে যেমন হয়, আলোকিত হতে দেখলাম তার চোখের পাতা। আর তখনই মনে পড়ল বরাবরই যা মনে পড়ে, তার উদ্দেশে যখন বলেছিলাম: নীল কুকুরের চোখ।
'ওটা,' বাতি থেকে হাত না সরিয়ে সে বলল, 'কখনোই ভুলব না।' দৃষ্টিসীমা থেকে সরে গেল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল: 'নীল কুকুরের চোখ, কথাটা লিখে রেখেছি সব জায়গায়।'
হেঁটে যেতে দেখলাম তাকে ড্রেসিং টেবিলের দিকে। গাণিতিক আলোর আগুপিছুর শেষ প্রান্তে দেখলাম তাকে, আয়নার গোল কাচ থেকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কয়লার মতো উত্তপ্ত বিশাল দুই চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম তাকে, আমার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই গোলাপি মুক্তো খচিত ছোট বাক্সটি খুলল। পাউডার বোলাতে দেখলাম নাকের পাশটায়। কাজ শেষে বাক্স বন্ধ করল, উঠে দাঁড়াল, ফিরে গেল বাতির কাছে। 'ভয় হচ্ছে কেউ বোধহয় এ ঘরটাকে স্বপ্ন দেখছে আর আমার গোপন রহস্যগুলো ফাঁস করে দিচ্ছে,' বলল সে। আয়নার সামনে বসার আগে যে হাতটি গরম করছিল, দীর্ঘ আর কাঁপা কাঁপা সে হাত রাখল বাতির শিখার ওপর। 'ঠান্ডাটা টের পাচ্ছ না তুমি,' বলল আমার উদ্দেশে।
'মাঝেসাঝে টের পাই,' আমি বললাম।
'এখন পাচ্ছ নিশ্চয়ই,' বলল সে, আর তখনই বুঝলাম চেয়ারে কেন আমি একা নই। সঙ্গে ছিল সেই হিম ঠান্ডাও যা নিশ্চয়তা দিচ্ছিল নিঃসঙ্গতার। 'বুঝতে পারছি এখন,' বললাম, 'ব্যাপারটি অদ্ভুত কারণ রাতটি বেশ চুপচাপ। হতে পারে চাদরটা পড়ে গেছে।'
জবাব দিল না সে। ফের পা বাড়াল আয়নার দিকে, তার দিকে পেছন ফিরে ঘুরে বসলাম চেয়ারে। না তাকিয়েই বুঝতে পারলাম কী করছে সে। টের পেলাম, আয়নার সামনে বসেছে আবার, আমার পেছন দিকটা দেখছে এখন-আয়নার গভীরে গিয়ে তার দৃষ্টিতে ধরা পড়ার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছে যা, ওদিকে তার দৃষ্টিও সময় পেয়েছে গভীরে পৌঁছে আবার ফিরে আসার-তার হাত আয়নার সামনে প্রথম বার নড়ে উঠে দুই ঠোঁটকে তীব্র লাল রঙে মাখামাখি করে দ্বিতীয় দফা শুরু করার আগেই।
আমার উল্টোদিকে মসৃণ দেয়ালটা দেখলাম, আরেকটি অন্ধ আয়নার মতো, তার প্রতিবিম্ব চোখে পড়ে না যাতে। সে বসে আছে আমার পেছনে, অথচ কল্পনায় ঠিকই দেখতে পেলাম তাকে, যেন দেয়াল নয়, একটা আয়নাই ঝোলানো আছে পেছনে।
'দেখতে পাচ্ছি তোমাকে,' বললাম তাকে। এবং দেয়ালের মধ্যে দেখলাম চোখ তুলে সেও যেন তাকিয়েছে আর আয়নার গভীরে দেখছে আমার পেছনটাকে, যদিও চেয়ারে বসা আমার মুখটা ঘুরানো দেয়ালের দিকে। ফের চোখ নামাতে দেখলাম তাকে, দৃষ্টি নিবদ্ধ নিজের বক্ষবন্ধনীর ওপর, মুখে কথা নেই। 'দেখতে পাচ্ছি তোমাকে,' আবার বললাম। 'অসম্ভব,' বক্ষবন্ধনী থেকে চোখ তুলে বলল সে। কেন অসম্ভব জিজ্ঞেস করলাম। দৃষ্টি শান্ত এবং ফের বক্ষবন্ধনীতে নিবদ্ধ, সে বলল, 'কারণ দেয়ালের দিকে ফেরানো তোমার মুখ।'
চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিলাম, দাঁতে কামড়ে আছি সিগারেট। আয়নার দিকে আমার মুখ ফেরানো অবস্থাতেই বাতির কাছে ফিরে গেছে সে। মুরগির দুই ডানার মতো দু'হাত শিখার ওপর বিছানো, আগুনে সেদ্ধ করছে নিজেকে, আঙ্গুলে ঢেকে রেখেছে মুখ। 'মনে হচ্ছে ঠান্ডা লাগবে,' বলল সে, 'এ নিশ্চয়ই বরফের শহর।'
মুখ পুরোপুরি ফেরাল আমার দিকে, তামারঙ থেকে এখন লাল তার ত্বক, কেমন বিষন্ন। 'কিছু একটা করো এ ব্যাপারে,' বলল সে, তারপর পোশাক ছাড়তে লাগল এক এক করে, শুরু করল উপরে, বক্ষবন্ধনী থেকে।
'দেয়ালের দিকে ফিরছি আমি,' বললাম।
'না। তবে যাই করো, পেছনে ফেরা অবস্থায় যেমন দেখেছ এখনও তেমনই দেখবে আমাকে,' বলল সে।
বলতে না বলতেই প্রায় পুরোই বিবস্ত্র হয়ে গেল, আগুনের শিখা লেহন করছে তার তামারঙের ত্বক। 'এমনভাবেই দেখতে চেয়েছি তোমাকে সবসময়, পেটের চামড়াটা ছোট ছোট গর্তে ভরা, যেন কেউ ভীষণ মেরেছে তোমাকে।' তার নগ্ন শরীরের দৃশ্য আমার কথাগুলোকে এলোমেলো করে দেয়ার আগেই স্থির হয়ে গেল সে, বাতির ঢাকনায় গরম করে নিচ্ছে শরীর। 'কখনো কখনো মনে হয় আমার শরীরটা ধাতু দিয়ে তৈরি,' বলল সে। কিছুক্ষণ চুপচাপ, বাতির শিখার ওপর ধরা হাতটি একটু নড়ল।
'মাঝে মাঝে অন্য কোনো স্বপ্নে তোমাকে মনে হয়েছে জাদুঘরের কোনায় রাখা ছোট ব্রোঞ্জমূর্তির মতো। হতে পারে এজন্যই এত ঠান্ডা তুমি,' বললাম আমি।
'কখনো কখনো,' সে বলল, 'যখন হৃদয়ের উপর ঘুমাই, টের পাই শরীরটা ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে আর চামড়া হয়ে যাচ্ছে যেন একটা পাত। তারপর, রক্ত যখন শরীরের ভেতর উথালপাথাল করে, মনে হয় কেউ যেন আমার পাকস্থলীতে ঘা দিচ্ছে, আর আমার নিজের তামার টুংটাং শুনতে পাই বিছানায়। যেন স্তরে স্তরে ঢাকা ধাতু।' বাতির আরো কাছে গেল সে।
'খুশি হতাম তোমাকে শুনতে পেলে,' আমি বললাম।
'কখনও একজন আরেকজনকে খুঁজে পেলে, আমি বাম কাত হয়ে শুয়ে থাকার সময় পাঁজরে তোমার কান রেখ, আমার প্রতিধ্বনি শুনবে। আমি চাই একদিন এটি করবে তুমি।'
কথা বলার সময় জোরে শ্বাস টানতে শুনলাম তাকে। অন্যরকম কিছুই করেনি বহু বছর ধরে, জানাল সে। জীবন কেটেছে তার বাস্তবে আমাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায়, চেনার জন্য ছিল একটিমাত্র শব্দ: নীল কুকুরের চোখ। সশব্দে একথা বলতে বলতে রাস্তায় হেঁটে বেড়ায় সে, দুনিয়ায় একমাত্র যে লোকটি তাকে বুঝতে পারবে কেবল তার উদ্দেশেই।
আমায় সে এ-ও জানাল যে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবারের ফরমাশ দেয়ার আগে পরিচারকদের বলে: নীল কুকুরের চোখ। পরিচারকেরা সসম্মানে মাথা ঝোঁকায়, নিজেদের স্বপ্নে কখনও একথা বলেছে বলে মনে পড়ে না তাদের। সে ন্যাপকিনে লেখে, ছুরি দিয়ে টেবিলের বার্নিশের গায়ে আঁচড় কেটেও লেখে: নীল কুকুরের চোখ। এবং ধোঁয়ায় ভেজা হোটেল, স্টেশন, সরকারি দরদালানের জানালায় তর্জনী দিয়ে লেখে: নীল কুকুরের চোখ। জানাল, একদিন এক ওষুধের দোকানে গিয়ে একটা গন্ধ পেয়েছিল, কোনো একরাতে আমাকে স্বপ্নে দেখার পর নিজের কক্ষেও ঠিক সে গন্ধটিই পেয়েছিল। 'কাছেপিঠে কোথাও অবশ্যই আছে সে,' দোকানের পরিষ্কার, নতুন টাইলসগুলো দেখে তার মনে হয়েছিল। বিক্রয়কর্মীর কাছে গিয়ে বলেছিল, 'সবসময় একজনকে স্বপ্নে দেখি আমি যে আমাকে বলে: নীল কুকুরের চোখ।' লোকটা নাকি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, 'সত্যি বলতে কি, আপনার চোখ আদতেও সে রকম।'
'যে আমাকে স্বপ্নে একথা বলে তাকে খুঁজে বের করতে চাই,' লোকটাকে বলল সে। হাসতে শুরু করে লোকটা, চলে যায় কাউন্টারের অন্য প্রান্তে। ঝকঝকে টাইলসগুলো দেখতে থাকে মেয়েটা, নিতে থাকে সেই গন্ধটা। তারপর হাতব্যাগ খুলে টকটকে লাল লিপস্টিকে লাল রঙে টাইলসের ওপর লেখে: 'নীল কুকুরের চোখ'। বিক্রয়কর্মী ফিরে আসে অন্য প্রান্ত থেকে। 'ম্যাডাম, টাইলস নোংরা করেছেন আপনি,' এই বলে ভেজা একটুকরো কাপড় হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, 'পরিষ্কার করুন ওটা।'
এখন, বাতির পাশে দাঁড়িয়ে সে জানায়, গোটা একটা বিকেল হামাগুড়ি দিয়ে টাইলস মুছতে মুছতে সে বলেছিল: 'নীল কুকুরের চোখ' – যতক্ষণ না দরজার কাছে ভিড় জমিয়ে তাকে পাগল বলতে শুরু করেছিল মানুষজন।
তার কথা বলা শেষ হওয়া অব্দি ঘরের কোনাতেই থাকলাম, বসে আছি চেয়ারে, দুলছি। 'প্রতিদিন সে কথাটিই মনে করার চেষ্টা করি যা দিয়ে খুঁজে পাব তোমাকে,' বললাম আমি। 'এখন আর ভাবি না কালই ভুলে যাব শব্দগুলো। যদিও বরাবরই বলি একথাটা এবং ঘুম থেকে জাগার পরই ভুল যাই তোমাকে খুঁজে বের করব কোন কথাটি দিয়ে।'
'শব্দগুলো তুমিই তৈরি করেছিলে সেই প্রথম দিন,' সে বলল।
'তৈরি করেছিলাম, কারণ তোমার পাংশুটে দুই চোখ দেখেছিলাম। কিন্তু পরদিন সকালেই আর স্মরণ ছিল না,' বললাম আমি।
হাত মুষ্টিবদ্ধ, নিঃশ্বাস গভীর, বাতির পাশে দাড়িয়ে সে বলল, 'কেবল যদি এটিও মনে করতে পারতে, কোন শহরে লিখেছিলাম সেটি!'
বাতির আভার ওপর ঝিকিয়ে উঠল তার চেপে রাখা দাঁত। 'তোমাকে ছুঁতে চাই এখন,' বললাম আমি। আলোর দিকে উঁচিয়ে রাখা মুখটি আরেকটু উঁচু করল সে। উপরে তুলল দৃষ্টিকেও, ঠিক তার মতো, তার হাতের মতো যা জ্বলছে এখন, সেদ্ধ হচ্ছে। টের পেলাম, কোনায় বসে চেয়ারে দুলতে থাকা আমাকে দেখছে সে।
'এটাতো কখনও বলোনি আমাকে,' সে বলল।
'এখন বললাম এবং এটাই সত্যি,' বললাম আমি।
বাতির ওপাশ থেকে সিগারেট চাইল সে আমার কাছে। সিগারেটের গোড়ালিটা অদৃশ্য হয়ে গেছে আমার দু'আঙ্গুলের ফাঁক থেকে, ধোঁয়া যে টানছি ভুলেই গিয়েছিলাম।
'বুঝতে পারছি না কেন ভুলে গেছি কোথায় লিখেছিলাম ওটা,' সে বলল।
'ঠিক যে কারণে আমিও কাল মনে করতে পারব না শব্দগুলো,' বললাম আমি।
'উঁহু,' বিষন্ন গলায় বলল সে, 'ব্যাপার হলো, কখনও কখনও মনে হয় ওটাও স্বপ্নেই দেখা আমার।'
চেয়ার ছেড়ে বাতির দিকে পা বাড়ালাম, বাতির একটু পেছনে সে। সিগারেট আর দেশলাই হাতে হাঁটতেই থাকলাম, দুটোর কোনোটাই যাবে না বাতির পেছনে। তার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম সিগারেট। ঠোঁটের ফাঁকে গুজল ওটা, আমি দেশলাই জ্বালার ফুরসৎ পাওয়ার আগেই ঝুঁকল বাতির ওপর দিয়ে।
'দুনিয়ার কোনো এক শহরে, সমস্ত দেয়ালে এ শব্দগুলো লেখা থাকা দরকার: নীল কুকুরের চোখ,' আমি বললাম, 'কাল সকালে এটা মনে থাকলে খুঁজে পাব তোমাকে।'
ফের মাথা তুলল সে, জ্বলন্ত কয়লা এখন তার দু' ঠোঁটের ফাঁকে। 'নীল কুকুরের চোখ,' দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, স্মরণ করলো, থুতনির কাছে ঝুলছে সিগারেট, এক চোখ আধবোঁজা। দু' আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট ধরে ধোঁয়া টানল, বলল, 'হ্যাঁ, এটা অন্যরকম, গরম হয়ে উঠছি আমি।' নিস্তেজ আর ক্ষীণ শোনাল তার গলা, যেন আসলেই বলেনি কথাটা, এক টুকরো কাগজে লিখে আগুনের শিখার কাছে নিয়ে এসেছে এবং আমি পড়ছি: 'গরম হয়ে উঠছি', এবং বুড়ো আঙ্গুল ও তর্জনীর মাঝখানে কাগজটি ধরে আছে সে, নাড়ছে এদিক ওদিক আর আগুন গ্রাস করে নিচ্ছে কাগজটিকে, আমি সবে পড়েছি: '… উঠেছি', ততক্ষণে কাগজটি পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে আর বাঁকাচোরা হয়ে খসে পড়েছে মাটিতে, তারপর দ্রুত ক্ষয়ে গিয়ে পলকা ছাইয়ের ধুলোয় রূপ নিয়েছে।
'এটিই ভালো হয়েছে,' বললাম আমি, 'তোমাকে ওভাবে, বাতির পাশে কাঁপতে দেখলে ভয় লাগে মাঝেমধ্যে।'
আমাদের দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। কখনো কখনো, দুজন একসঙ্গে থাকার সময়, হয়তো বাইরে কেউ চামচ ফেলল একটা, ঘুম ভেঙে জেগে উঠি। ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছি, আমাদের বন্ধুত্বটা অন্য অনেক জিনিস, তুচ্ছ সব ঘটনার অধীন। সবসময়ই এভাবে শেষ হয় আমাদের সাক্ষাৎ, খুব ভোরে মেঝেতে চামচ পড়ার মাধ্যমে।
এখন, বাতির পাশে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে। মনে পড়ল, আগেও এভাবেই তাকিয়েছে, দূরবর্তী সেই স্বপ্নের ভেতর থেকে, যেখানে চেয়ারের পেছনের পায়ে ভর রেখে ওটাকে ঘুরাই আর তাকিয়ে থাকি পাংশুটে চোখের অদ্ভুত এক নারীর দিকে। এবং সে স্বপ্নেই তাকে প্রথমবারের মতো জিজ্ঞেস করলাম: 'কে তুমি?' সে বলল, 'মনে পড়ে না আমি কে।' 'কিন্তু আমার মনে হয় আগে কোথাও দেখা হয়েছে দুজনের,' আমি বললাম। সে নিরাসক্ত গলায় বলে, 'মনে হচ্ছে একবার স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে নিয়ে, এই ঘরটাকে নিয়েও।' আমি বললাম, 'তাই তো, আমারও মনে পড়তে শুরু করেছে এখন।' সে বলল, 'তাজ্জব ব্যাপার! হলফ করে বলতে পারি, অন্য স্বপ্নেও দেখা হয়েছে আমাদের।'
সিগারেটে দুটো টান দিল সে। তখনও দাঁড়িয়ে আমি, মুখ বাতির দিকে ফেরানো, তারপর হঠাৎ তাকাতে থাকলাম তার দিকে, চোখ বুলালাম মাথা থেকে পা অব্দি, তখনও সে তামা, তবে সে তামা শক্ত আর ঠান্ডা নয়-হলদেটে, মোলায়েম আর নমনীয়।
'তোমাকে ছুঁতে ইচ্ছে করছে,' বললাম আমি।
'সব বরবাদ হয়ে যাবে তাহলে,' সে বলল।
'কিছু আসে যায় এখন?' বললাম আমি, 'বালিশটা ঘুরিয়ে নিলেই তো দেখা করতে পারব আবার।'
বাতির ওপর হাত রাখলাম। নড়ল না সে, তবে তাকে ছুঁতে পারার আগেই কথাটা আবার বলল, 'বরবাদ করে দেবে সবকিছু। ঘুরে যদি বাতির পেছনে চলে আসো, কে জানে দুনিয়ার কোন প্রান্তে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জেগে উঠব দুজন!'
'কিছু আসে যায় না তাতে,' বলতেই থাকলাম আমি। 'বালিশ ঘুরিয়ে নিলে ফের দেখা হবে ঠিকই, কিন্তু জেগে উঠেই সব ভুলে যাবে তুমি,' সে বলল।
কোনার দিকে এগোতে শুরু করলাম। সে রয়ে গেল পেছনে, বাতির আঁচে গরম করছে হাত। তখনও চেয়ারের কাছে পৌঁছাইনি, পেছন থেকে বলতে শুনলাম তাকে, 'মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকি, বালিশের পাড় হাঁটুদুটো জ্বালিয়ে দেয়, ভোর হওয়া অব্দি একটা কথাই কেবল বলতে থাকি: নীল কুকুরের চোখ।'
তখনও দেয়ালে আমার চোখ। 'ভোর হচ্ছে,' তার দিকে না তাকিয়েই বললাম, 'ঘুম ভেঙেছিল ঘড়িতে যখন দুটো বাজে, সে অনেক আগের কথা।'
দরজার কাছে গেলাম, হাতলে হাত রাখতেই ফের কানে এল তার গলা, সেই আগের মতোই, পরিবর্তন নেই কোনো। 'খুলো না। বাইরে হলঘরভর্তি জটিল সব স্বপ্ন।'
'তুমি কীভাবে জানো?' জিজ্ঞেস করলাম।
'কারণ খানিক আগে ওখানে ছিলাম। যখন দেখলাম হৃদয়ের ওপর শুয়ে আছি, ফিরে আসতে হলো।'
দরজা অর্ধেক খুলে ফেলেছি ততক্ষণে। আরেকটু ঘোরালাম হাতল। ঠান্ডা, পাতলা একটু বাতাস বৃক্ষগন্ধা মাটি আর ভেজা মাঠের তাজা ঘ্রাণ বয়ে নিয়ে এল। ফের কথা বলে উঠল সে। হাতল ঘোরালাম, শব্দহীন কব্জার ওপর বসানো দরজাটাকে খুলতে খুলতেই বললাম, 'মনে হয় না বাইরে কোনো হলঘর আছে। গ্রামের গন্ধ পাচ্ছি।'
খানিক শীতল শোনাল তার গলা, 'আমার চেয়ে বেশি জানো না তুমি। ঘটনা হচ্ছে, বাইরে একটা মহিলা আছে, যে গ্রামের স্বপ্ন দেখছে।' শিখার ওপর আড়াআড়িভাবে দু'হাত রাখল সে। কথা বলে যাচ্ছে তখনও, 'এ সেই মহিলা, গ্রামে একটা বাড়ি করার খায়েশ অথচ শহর ছাড়তে পারল না কখনও।'
অতীতের অন্য কোনো স্বপ্নে মহিলাটিকে দেখার কথা মনে পড়ল আমার, যদিও আধখোলা দরজাকে সামনে রেখে এও বুঝলাম, আধঘণ্টার মধ্যেই নাস্তা খেতে নিচে যেতে হবে। বললাম, 'ঘটনা হচ্ছে, জেগে ওঠার জন্য বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।'
মুহূর্তের জন্য বাইরে ধড়ফড় করে উঠল বাতাস, তারপর থম মেরে দাঁড়াল। এইমাত্র বিছানায় পাশ ফিরে শোয়া ঘুমন্ত কারো শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। শস্যক্ষেত থেকে ছুটে আসা বাতাস নেই এখন, কোনো গন্ধও নেই আর। 'এ থেকেই কাল চিনে নেব তোমাকে,' বললাম আমি, 'রাস্তায় কোনো মহিলাকে 'নীল কুকুরের চোখ' লিখতে দেখলেই চিনব তোমাকে।'
বিষন্ন একটুকরো হাসি তার মুখে, এরই মধ্যে যা রূপ নিয়েছে অসম্ভব আর অনধিগম্যের কাছে হার মেনে নেয়া হাসিতে। 'দিনের বেলা কিছুই মনে রাখতে পারবে না তুমি,' বলে ফের বাতির ওপর হাত রাখল, তেতো এক মেঘে ছেয়ে আছে মুখ। 'দুনিয়ায় তুমিই একমাত্র লোক, ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর যে মনে করতে পারে না স্বপ্নে কী দেখেছিল।'