মরুর দেশে গভীর প্রণয়

ফারুক মঈনউদ্দীনফারুক মঈনউদ্দীন
Published : 28 Sept 2021, 06:02 PM
Updated : 28 Sept 2021, 06:02 PM


লেখক পরিচিতি: তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ও সমাজের বাস্তবতা চিত্রায়নে অবিমিশ্র দক্ষতার জন্য ফরাসি ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার অনরে দে বালজাক (১৭৯৯-১৮৫০) ছিলেন ইউরোপীয় সাহিত্যে বাস্তবতাবাদের জনকদের অন্যতম একজন। একারণে তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন এমিল জোলা, চার্লস ডিকেন্স, গুস্তভ ফ্লবের প্রমুখ লেখক এবং কার্ল মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মতো দার্শনিককে।
তখনকার প্রথা অনুযায়ী তাঁর শৈশব কেটেছে দাই মার কাছে। শিশুবয়সে স্কুলের মুখস্তবিদ্যার মতো বিষয়গুলো তিনি কখনোই আত্মস্থ করতে পারেননি বলে তিনি চিহ্নিত ছিলেন অবাধ্য ছাত্র হিসেবে। ফলে নির্জনবাসের মতো শাস্তি পেতে হতো তাঁকে। এসময় তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন প্রচুর বই পড়ার। এভাবেই লেখকজীবনের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল তাঁর। তবে লেখকবৃত্তির আগে তিনি প্রকাশনা, মুদ্রণব্যবসা, ব্যবসায়ী, সমালোচক ও রাজনীতিবিদ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনোটাতেই সফলতা পাননি। তাঁর উপন্যাস ও ঔপন্যাসিকার সংখ্যা ৪৯ আর নাটক ডজনখানেক।

অনুবাদকের পরিচিতি:
আর্নেস্ট ডাউসন (১৮৬৭Ñ১৯০০) ছিলেন ইংরেজ কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার। মাত্র বত্রিশ বয়সে মারা যাওয়ার আগে তাঁর আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে এক প্রকাশক তাঁকে কিছু অনুবাদের কাজ করতে দিয়েছিলেন। সেই কাজের মধ্যে বালজাকের "ইউন প্যাসসিওন দন লে ডিজার" গল্পটির ইংরেজি অনুবাদ "প্যাশন ইন দ্য ডেজার্ট" নামের এই অনুবাদটিও ছিল।
গল্পটির রচনাকাল ১৯৩২, আর এটির ওপর ভিত্তি করে হলিউডে চলচিত্র নির্মিত হয় ১৯৯৭ সালে।

মূল: অনরে দে বালজাক
ফরাসি থেকে ইংরেজি ভাষান্তর: আর্নেস্ট ডাউসন
বাংলা তর্জমা: ফারুক মঈনউদ্দীন

এম মার্টিনের পশুশালা থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে মহিলা চিৎকার করে বলে, 'পুরো ব্যাপারটাই ভয়ঙ্কর।' কিছুক্ষণ আগে অনুষ্ঠানটার কায়দায় বলতে গেলে দুঃসাহসী খেলোয়াড়টির "হায়নার সাথে খেলা" দেখছিল সে।
'কীভাবে এসব প্রাণীকে ওদের ভালোবাসা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এমনভাবে পোষ মানাতে পারলেন তিনি', মহিলা বলে চলে।
ওর কথা থামিয়ে আমি বললাম, 'তুমি যেটাকে সমস্যা বলে মনে করছ, সেটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা।'
ঠোঁটে একচিলতে অবিশ্বাসের হাসি দিয়ে সে বলে, 'ও তাই!'
আমি জিজ্ঞেস করি, 'তাহলে তুমি মনে কর, জন্তু-জানোয়ারেরা একেবারে আবেগহীন? বরং ঠিক উল্টো, আমাদের সভ্য জীবনের যা কিছু দোষগুন, সবই ওদের শেখানো যায়।
অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে ও।
আমি বলে চলি, 'যখন প্রথম মার্টিনের এই খেলা দেখি, স্বীকার করছি, আমিও তোমার মতো অবাক হয়েছিলাম।'

ঠিক এই সময় দেখি আমার পাশে দাঁড়িয়ে ডান পা কেটে ফেলা এক বুড়ো সৈনিক। লোকটার চেহারা দেখে চমকে উঠলাম। যুদ্ধের ছাপ মারা সাহসী পুরুষদের একজন, ওঁর চেহারায় লেখা রয়েছে নেপোলিয়নের যুদ্ধের যাবতীয় ইতিহাস। তাছাড়া, লোকটির মধ্যে ছিল প্রাণখোলা সরল একটা হাসিখুশির ভাব, ব্যাপারটা সবসময়ই মুগ্ধ করে আমাকে। নিঃসন্দেহে তিনি সেই সব সৈনিকদের একজন, যারা কোনো কিছুতেই অবাক হয় না, মৃত্যুপথযাত্রী সঙ্গীর মরণযন্ত্রণার দৃশ্যের মধ্যেও খুঁজে পায় হাসির খোরাক, খুশিমনে সঙ্গীকে কবর দিতে পারে, কিংবা লুঠ করতে পারে তার সর্বস্ব। বুলেটের সামনে অটল দাঁড়িয়ে থাকতে পারে যেসব মানুষ, তিনিও তাদের একজন। এরা বিচার বিবেচনায় সময় নষ্ট করে না, দ্বিধা করে না শয়তানের সাথে বন্ধুত্ব করতে। পশুশালাটির মালিক যখন খাঁচা থেকে বের হয়ে আসছিলেন, আমার সঙ্গিনী তাঁকে বেশ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতে থাকে। উঁচুমহলের লোকেরা যেরকম সহজে ভুলছে না, এমন এক অদ্ভুত অভিব্যক্তিতে ঠোঁট বাঁকায়, ওর কোঁচকানো ঠোঁটে ফুটে ওঠে সেরকম একটা উপহাস আর অবজ্ঞার ভাব। আমি যখন মার্টিনের সাহসের বিস্তারিত তারিফ করছিলাম, বৃদ্ধ সৈনিকটি হেসে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলেন, 'এসব ভালোই জানা আছে আমার।'
আমি বললাম, 'কীভাবে "ভালোভাবে জানা"? রহস্যটা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন, বাধিত হবো।'
পরবর্তী কয়েক মিনিটে পরিচয় পর্ব সারার পর সামনে যে রেস্তোরাঁটা চোখে পড়ে, সেটাতে খেতে ঢুকলাম আমরা। খাওয়া শেষে এক বোতল শ্যাম্পেন বৃদ্ধ সৈনিকটির স্মৃতিকে পুরোপুরি নতুন করে জাগিয়ে তোলে। গল্পটা যখন বললেন, তখন বুঝতে পারলাম, তিনি যে "ভালোভাবে জানা" বলেছিলেন, সেটা ঠিকই।

বাড়ি ফেরার পর আমার সঙ্গিনীটি এমনভাবে জ্বালাতন শুরু করে, সেটা এমন মধুর আর এমন সব প্রতিজ্ঞা করে সে, আমি বৃদ্ধ সৈনিকটির সাহসিকতার গল্পটা ওকে বলতে রাজি হয়ে যাই। পরদিন কোনো এক মহাকাব্যের একটা অধ্যায়ের মতো যে আখ্যানটি ও জানতে পারে, সেটার নাম দেওয়া যেতে পারে, "মিসরে ফরাসি মানুষটি।"
মিসরের উত্তরাঞ্চলে জেনারেল দুসের অভিযান চলার সময় প্রাদেশিক এক সৈনিক মুঘাবা (উত্তর মিসরের এক আরব উপজাতি: অনুবাদক) বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। দলটির আরব যোদ্ধারা তাকে নীল নদের ভাটি পেরিয়ে মরুভূমিতে নিয়ে যায়।
ফরাসি বাহিনীর সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বাধ্য হয়ে জোরকদমে ছুটছিল ওরা, তবু রাত নেমে এলে একজায়গায় থামতে হয় ওদের। সেখানে খেজুরগাছে ছাওয়া একটা কুয়োর চারপাশে তাবু ফেলা হয়। কিছুদিন আগে এখানে কিছু রসদ লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল ওরা। বন্দীটি যে পালাবার মতলব করতে পারে, সেটা অনুমান করতে পারেনি বলে কেবল ওর হাতজোড়া বেঁধেই সন্তুষ্ট হয়ে নিজেরা কয়েকটা খেজুর খেয়ে নেয়, তারপর ঘোড়াগুলোকে জাবনা দিয়ে শুতে চলে যায়।
সাহসী সৈনিকটি যখন বুঝতে পারে যে শত্রুপক্ষ ওর ওপর আর নজর রাখছে না, তখন দাঁত দিয়ে একটা ধারালো অস্ত্র চুরি করে সে। ওটার ফলাটা দুই হাঁটুর মধ্যে রেখে দড়ির বাঁধন কেটে দুহাত মুক্ত করে ফেলতে মুহূর্তমাত্র সময় লাগে। দ্রুত একটা রাইফেল আর একটা ছোরা তুলে নিয়ে এক বস্তা শুকনো খেজুর, বার্লি, বারুদ আর গুলিও খুঁজে নেয়। তারপর তলোয়ারটা কোমরে ঝুলিয়ে ঘোড়ার ওপর লাফ দিয়ে চড়ে বসে। সময় নষ্ট না করে যেদিকে ফরাসি সেনাদলকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয়, সেদিকে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় ও। ফরাসিদের কোনো একটা অস্থায়ী শিবিরে পৌঁছার জন্য অধৈর্য্য হয়ে ইতিমধ্যে ক্লান্ত ঘোড়াটাকে এমনভাবে ছোটায় যে ওটার দুপাশ ওর জুতোর নালের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। ওটার অবস্থার কথা মাথায় ছিল না, ফলে এক সময় ওকে মরুভূমির মধ্যে একা ফেলে রেখে বেচারা ঘোড়াটি মরে যায়। অগত্যা জেলপালানো বন্দীর দুঃসাহস নিয়ে বালির ওপর কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর দিনের আলো শেষ হয়ে এলে থামতে হয় ওকে।

প্রাচ্যের রাতের আকাশের সৌন্দর্যের মধ্যেও সে বুঝতে পারে এগিয়ে চলার মতো আর শক্তি নেই ওর। সৌভাগ্যক্রমে একটা ছোট টিলা খুঁজে পাওয়া যায়, চূড়োয় কয়েকটা খেজুর গাছ শূন্যে মাথা তুলে দাঁড়ানো। দূর থেকে দেখা ওগুলোর সতেজ শ্যামলিমা ওর বুকের মধ্যে আশা ও সান্তনা জাগিয়ে তোলে। প্রচ- ক্লান্তিতে প্রকৃতির খামখেয়ালিতে ক্যাম্পখাটের মতো আকৃতি নেওয়া একখ- গ্রানাইট পাথরের ওপর শুয়ে পড়ে ও। তারপর ঘুমন্ত অবস্থায় আত্মরক্ষার কোনো ব্যবস্থা না করেই ঘুমিয়ে পড়ে। নিজের জীবনকে যেন উৎসর্গই করে দিয়েছে সে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে ওর শেষ ভাবনাটা ছিল অনুতাপের। মুঘবাদের ছেড়ে আসার জন্য প্রচ- অনুশোচনা হচ্ছিল, যাযাবর লোকগুলো এখন ওকে নিয়ে নিশ্চয়ই হাসাহাসি করছে, এমন অসহায় অবস্থায় ওদের কাছ থেকে এখন অনেক দূরে ও।
সকাল বেলায় সূর্যের আলোয় জেগে ওঠে সে, রোদের নির্মম রশ্মি প্রবল শক্তি নিয়ে গ্রানাইট পাথরটার ওপর ঢেলে দিচ্ছিল অসহ্য গরম। খেজুর গাছগুলোর সবুজ রাজকীয় মাথার ছায়া যেদিকে পড়েছে, বোকার মতো তার উল্টোদিকে শুয়েছিল ও। নিঃসঙ্গ গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে ও শিউরে ওঠে, ওগুলোকে দেখে আহল গির্জার বেদুইন স্তম্ভের খিলানে উৎকীর্ণ পাতার চমৎকার মুকুটের কথা মনে পড়ে যায়।

খেজুর গাছগুলো এক এক করে গুনে চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে তাকায় ও, সামনে সীমাহীন সমুদ্র দেখে ঘোর হতাশায় ছেয়ে যায় মনটা। চারদিকে দৃষ্টিসীমা পেরিয়ে ছড়িয়ে থাকা মরুভূমির বিষণœ বালি খর রোদে ইস্পাতের ফলার মতো ঝকঝক করছে। মনে হচ্ছিল যেন আতস কাচের একটা সমুদ্র, হ্রদগুলো গলে গিয়ে পরিণত হয়েছে একটা আয়নায়। আগুনের বাষ্প উঠে এসে যেন কম্প্রমান ভূমির ওপর তৈরি করেছে ঢেউয়ের একটা অবিরাম ঘূর্ণি। আকাশ উদ্ভাসিত করা প্রাচ্যের অসহ্য অবিমিশ্র রোশনাইতে কল্পনার অভিলাষ শুন্য পড়ে থাকে। স্বর্গ-মর্ত্যজুড়ে জ্বলছে আগুন।
বন্য ভয়াল মহিমায় ভয়ানক নিরবতা চারপাশে। সবদিক থেকে বুকের ওপর চেপে বসেছে যেন অনন্ত বিশালতা। নির্মেঘ আকাশ, বাতাস নিথর, সদা সচল ছোট ছোট ঢেউয়ের বালির বুকে নেই একতিল খুঁত, পরিষ্কার দিনে সমুদ্রের দিগন্তরেখার মতো দিকচক্রবালে তলোয়ারের স্পষ্ট ফলার মতো একসার আলোর রেখা।
সৈনিকটি একটা গাছকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে, এ-যেন কোনো বন্ধুর শরীর, তারপর গ্রানাইট পাথরটার ওপর পড়া একটা গাছের পাতলা সোজা একফালি ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদে। একসময় নিশ্চল বসে থেকে গভীর বিষাদে একমাত্র দৃশ্যমান নির্মম মরুর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে। নৈঃশব্দের মাত্রা মাপার জন্য চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ও। ওর গলার স্বর কোনো প্রতিধ্বনি না তুলে ক্ষীণ শব্দে পাহাড়ের খোঁদলের মধ্যে হারিয়ে যায়– প্রতিধ্বনি ওঠে কেবল নিজের বুকের মধ্যে।

সৈনিকটির বয়স বাইশ, বন্দুকটায় গুলি ভরে রাখে ও। তারপর উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র সহায় অস্ত্রটাকে মাটিতে শুইয়ে রেখে আপন মনে বলে, 'এটা ব্যবহারের যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে পরে।'
মরুভূমির গাঢ় আর আকাশের নীল বিস্তারের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সের কথা কল্পনা করে ও– প্যারিসের নালাগুলোর গন্ধের কথা মনে পড়লেও আনন্দে বুক ভরে যায়, পেরিয়ে আসা শহরগুলোর কথা, সহযোদ্ধাদের চেহারা, জীবনের প্রায় সব বিশেষ ঘটনার বিস্তারিত স্মৃতি মনে পড়ে। মরুভূমির তপ্ত ঢেউখেলানো বিশাল বিস্তারের মধ্যে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে ওর প্রিয় প্রদেশের নুড়িগুলোও কল্পনায় দেখতে পায় ও। নিষ্ঠুর মরীচিকার বিপদের কথা মাথায় রেখেই আগের দিন যে পথ দিয়ে উঠে এসেছিল, একসময় সেই রাস্তা ধরে পাহাড়ের উল্টোপাশে নেমে যায়। এখানে একটা ছেঁড়া মাদুরের টুকরো পড়ে থাকতে দেখে ও বুঝতে পারে, জায়গাটা কোনো একসময় মানুষের আশ্রয় ছিল। অল্প দূরে ফলেভরা কয়েকটা খেজুর গাছ দেখতে পায়।
যে প্রবৃত্তি জীবনের সাথে বেঁধে রাখে আমাদের, সেটাই আবার জেগে ওঠে বুকের ভেতর। ওর আশা, কোনো মুঘবা দল এপথ দিয়ে যাওয়ার সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবে ও, কিংবা শুনতে পাবে কামানের গর্জন, কারণ, সেসময় নেপোলিয়নের বাহিনী মিসরের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল।
ভাবনাটা ওকে নতুন জীবন দান করে। পাকা ফলের ভারে খেজুর গাছগুলো যেন নুয়ে পড়েছে। গাছ ঝাঁকিয়ে তার কয়েকটা পেড়ে নেয় ও। অকল্পনীয় স্বাদের এই অমৃত খেয়ে ও নিশ্চিত হয় যে আগের কোনো এক বাসিন্দা লাগিয়েছে গাছগুলো– ফলটার সুস্বাদু তাজা শাঁস থেকেই বোঝা যায় গাছের প্রতি কত যতœ ছিল লোকটির। তার গভীর হতাশা আচমকা প্রায় উন্মত্ত আনন্দে পরিনত হয়। আবার পাহাড়ের মাথায় উঠে আসে ও, তারপর গতরাতে যে নিস্ফলা গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছিল, সারাদিন ধরে সেটি কাটে। একটা অস্পষ্ট স্মৃতি থেকে মরুভূমির পশুগুলোর কথা মনে পড়ে ওর। পাথরের ভেতর থেকে বের হয়ে নিচে নেমে মিলিয়ে যাওয়া ঝরনাটায় পানি খেতে আসতে পারে ওগুলো, তাই ঠিক করে, ওর আশ্রয়ের জায়গাটার মুখে একটা বেড়া দিয়ে নিজেকে নিরাপদ করতে হবে।
ঘুমের মধ্যে জানোয়ারের পেটে যাওয়ার আতঙ্কে প্রাণপন পরিশ্রম করেও গাছটাকে টুকরো করতে পারে না ও, তবে গুঁড়িটা কেটে নামানো যায়। মরু রাজ বৃক্ষটি পড়তে পড়তে সন্ধ্যা নেমে আসে, স্তব্ধতার ভেতর বহুদূর বিস্তৃত আর্তস্বরের মতো প্রতিধ্বনি তোলে ওটার পতনের শব্দ। যেন কোনো আসন্ন দুর্ভাগ্যের পূর্বাভাষ, ভয়ে শিউরে ওঠে সৈনিকটি।
মৃত আত্মীয়ের জন্য লম্বা সময় ধরে শোক না করা উত্তরাধিকারীর মতো গাছটার চমৎকার নান্দনিক সাজের দীর্ঘ চওড়া সবুজ পাতাগুলো ছিঁড়ে নিয়ে ছেঁড়া মাদুরটা মেরামত করে ফেলে ও, ওটার ওপরই শুতে হবে ওকে।
তারপর গরমে ও পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে একসময় ভেজা গুহাটার লাল ছাদের নিচে ঘুমিয়ে পড়ে।
মাঝরাতে একটা অস্বাভাবিক শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে বসে ও। শ্বাস-প্রশ্বাসের যে শব্দ সে শুনতে পায়, চারপাশের গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে সেই শব্দের স্বরাঘাতে বুঝতে পারে এই জান্তব শক্তি কোনো মানুষের হতে পারে না।
অন্ধকার, নিস্তব্ধতা আর হঠাৎ জেগে ওঠার বিস্ময়– সবকিছু মিলিয়ে গভীর আতঙ্কে ওর বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। টের পায় চুলের ডগা খাড়া হয়ে উঠছে, চোখের সবটুকু ক্ষমতা জড়ো করে আবছায়া অন্ধকারের ভেতর দিয়ে দুটো অস্পষ্ট হলুদ আলো দেখতে পায় ও। প্রথমে ভাবে, ওগুলো বুঝি ওর নিজের চোখের দুই তারার প্রতিবিম্ব। কিন্তু দ্রুতই রাতের স্বচ্ছ আলোর আভায় গুহার ভেতরের সবকিছুকে ধীরে ধীরে চিনে উঠতে পারে ও, আর তখনই দেখতে পায় কয়েক পা দূরে শুয়ে আছে বিশাল এক জানোয়ার। কী ওটা? সিংহ, বাঘ নাকি কুমির?
শত্রুটি কোন জাতের, সেটি জানার মতো যথেষ্ট জ্ঞান সৈনিকটির ছিল না, এই অজ্ঞানতা ভয়ের কল্পনাকে খুঁচিয়ে তুললে আতঙ্ক আরো বেড়ে যায় ওর। বিন্দুমাত্র নড়াচড়া না করে খুব কাছাকাছি শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠানামা লক্ষ করতে করতে এক নিষ্ঠুর পীড়ন সয়ে যাচ্ছিল সে। শেয়ালের গায়ের গন্ধের চেয়ে বলতে গেলে আরো তীব্র ও গাঢ় একটা বোঁটকা কটু গন্ধে গুহাটা ভরে ছিল। বিপদ বুঝতে পেরে সৈনিকটির আতঙ্ক চরমে ওঠে, কারণ, যার রাজকীয় আবাসে সে আশ্রয় নিয়েছে, সেই ভয়ংকর সঙ্গীর নৈকট্য সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ ছিল না ওর।
এসময় দিগন্তের ওপর নেমে যাওয়া চাঁদের আলোর প্রতিবিম্বে গুহার ভেতরটা আলোকিত হয়ে উঠলে একটা চিতাবাঘের ছোপ ছোপ চামড়া ধীরে ধীরে দৃশ্যমান ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
মিসরের পশুরাজটি বিশাল একটা কুকুরের মতো কু-লী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল, কোনো হোটেলের গেটে মহার্ঘ্য একটা উপযুক্ত জায়গার শান্তিপূর্ণ দখলদার যেন। ওর মুখ সৈনিকটির দিকে ফেরানো। একসময় চোখদুটো মুহূর্তের জন্য খুলে আবার বন্ধ হয়ে যায়। ফরাসি লোকটির মনের ভেতর দিয়ে হাজারটা সংশয়ী ভাবনা বয়ে যায়, একবার ভাবে বন্দুকের এক গুলিতে মেরে ফেলবে ওটাকে, কিন্তু দেখা গেল বন্দুক তাক করার মতো যথেষ্ট ব্যবধান নেই দুজনের মধ্যে– গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে। তখন যদি ওটা জেগে ওঠে!– এই দুশ্চিন্তায় ওর শরীর জমে যায়। নিরবতার মধ্যে নিজের বুকের ধুকধুকানি শুনতে শুনতে রক্ত স্রোতের বেগের সাথে বেড়ে যাওয়া বুকের প্রবল স্পন্দনকে গালি দেয় ও, এই শব্দেই যদি ওটার ঘুমের ব্যাঘাত হয়? জন্তুটা ঘুমাচ্ছে বলেই পালাবার বিভিন্ন উপায় ভাবতে পারছে সে।
শত্রুটার মাথা কেটে নেওয়ার কথা ভেবে দুবার সে তলোয়ারের ওপর হাত রাখে, কিন্তু ছোট ছোট শক্ত পশমের ভেতর দিয়ে অস্ত্র চালানোর কাজটা কঠিন হবে ভেবে এই দুঃসাহসী পরিকল্পনাটা বাদ দিতে বাধ্য হয় ও। বুঝতে পারে, ব্যর্থ হওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। তাই ন্যায্য লড়াইয়ের সুযোগ নেওয়াটাকেই শ্রেয়তর মনে হয় ওর। তাই সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সকাল হওয়ার জন্য বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না।
এবারে সহজে চিতাটাকে খুঁটিয়ে দেখতে পারে ও। ওটার নাকে-মুখে রক্ত লেগে ছিল। ও ভাবে, 'খাওয়াটা ভালোই হয়েছে বোঝা যায়', তবে ভোজটা নরমাংসের কিনা সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না, 'ঘুম থেকে উঠে আপাতত খিদে পাবেনা ওর।'
ওটা ছিল এক বাঘিনী। পেট আর কোমরের ভেতরদিকে তলপেটের পশম ঝলমলে সাদা, পায়ের নিচের অংশ ঘিরে ছোট ছোট মখমলী ছোপের কাঁকন, পাকানো সাদা লেজটার শেষমাথা পর্যন্ত বালার মতো কালো গোল গোল ছোপ, পোশাকের ওপরের অংশ পালিশ করা সোনার মতো হলদে রঙের, তার ওপর খুব কোমল আর মসৃণ গোলাপের ছাপমারা। এই সৌন্দর্যই চিতাবাঘকে বিড়াল প্রজাতির অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা করেছে।
ভয়ংকর এই গৃহকর্ত্রীটি এমন শান্ত ও মার্জিতভাবে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল যেন মনে হয় গদির ওপর ঘুমিয়ে থাকা কোনো বিড়াল। সামনে ছড়ানো জোরালো নখরসহ রক্তমাখা থাবার ওপর মুখটা রাখা, সেখান থেকে বেরিয়ে আছে রুপোর তারের মতো সরু খাড়া বড় বড় গোঁফ।
বাঘিনীটাকে এই ভঙ্গীতে খাঁচার মধ্যে দেখলে সৈনিকটি নিঃসন্দেহে ওর শরীরের জমকালো রাজকীয় সাজের বলিষ্ঠ তীব্র উজ্জ্বল বর্ণবৈচিত্র্যের প্রশংসা করত। কিন্তু এই পরিবেশে ওটার অলক্ষুণে উপস্থিতিতে ওর ভেতরটা অস্থির হয়ে ওঠে।
সাপের চৌম্বকীয় দৃষ্টি পাপিয়াকে যেমন সম্মোহিত করে ফেলে বলে মানুষের ধারণা, ঘুমন্ত অবস্থাতে বাঘিনীটার উপস্থিতিও সেরকম অবস্থার সৃষ্টি করে।
এই বিপদের সামনে মুহূর্তের মধ্যে সৈনিকটার সাহস যেভাবে ভেঙে পড়ে, কামানের গোলার মুখেও সেভাবে পড়ত না। তবু একটা বেপরোয়া ভাবনা ওর ভেতরে দিনের আলো নিয়ে আসে, কপাল গড়িয়ে পড়া ঠা-া ঘামের স্রোতের মুখটা বন্ধ হয়ে যায়। কোণঠাসা মানুষ যেমন মৃত্যুকে উপেক্ষা করে আঘাতকারীর হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়, সে-ও এটার মধ্যে একটা করুণ কাহিনি দেখতে পেয়ে সম্মানের সাথে শেষ অবধি নিজের ভূমিকা পালন করার সংকল্প নিয়ে ফেলে।
আপনমনেই সে বলে, 'সেদিন হয়তো আরবরা আমাকে মেরেই ফেলত,' তাই নিজেকে ইতিমধ্যে মৃত কল্পনা করে উত্তেজিত ঔৎসুক্যে শত্রুটির জেগে ওঠার জন্য সাহস নিয়ে অপেক্ষা করে।
সূর্য উঠে এলে বাঘিনীটা হঠাৎ চোখ মেলে, তারপর শরীরের আড়ষ্টতা কাটানোর জন্য বেশ জোরের সাথে থাবাগুলো সামনে মেলে দেয়। সবশেষে ভয়াল দাঁতের পাটি আর উখার মতো খসখসে তীক্ষè জিব দেখিয়ে হাই তোলে।
ওটাকে খুব নরম ছেনালী ভঙ্গীতে গড়াগড়ি খেতে দেখে ফরাসিটা ভাবে, 'এ যে দেখছি রীতিমতো সুন্দরী।' রক্ত লেগে থাকা থাবা আর নাকমুখ চেটে পরিস্কার করে ওটা, তারপর চমৎকার ভঙ্গীতে বারবার মাথা ঘষতে থাকে। 'ঠিক আছে, এবার সাফসুতরো হয়ে এসো,' যেন নিজেকেই বলে সৈনিক, সাহসের সাথে ওর ভেতরে রসিকতার ভাবটা ফিরে আসতে থাকে। 'এখন আমরা সুপ্রভাত বলব,' বলে মুঘাবাদের কাছ থেকে নিয়ে আসা ছোট ছোরাটা হাতে তুলে নেয়।


এসময় বাঘিনীটা ওর দিকে মাথা ঘুরিয়ে একদৃষ্টে নিশ্চল তাকিয়ে থাকে। তারপর উঠে এগিয়ে আসতে থাকলে ওটার ধাতব চোখের কাঠিন্য এবং অসহ্য দীপ্তিতে শিউরে ওঠে ও। তবু সম্মোহিত করার জন্য ওটার চোখের দিকে আদুরে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে খুব কাছে আসতে দেয়। তারপর খুব ধীরে ও রোমান্টিক ভঙ্গীতে হলুদ পিঠের মাঝ বরাবর নরম মেরুদ- নখ দিয়ে আঁচড়ে দিতে দিতে মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দেয়, যেন খুব সুন্দরী কোনো রমণীকে আদর করছে। ইন্দ্রিয়সুখে ওটার লেজ নড়তে থাকে, আরামে চোখ মুদে আসে। তৃতীয়বারের মতো এই মজার খোশামোদির পর তৃপ্ত বিড়ালের মতো গলা দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ করতে থাকে ওটা। কণ্ঠনিসৃত সেই শব্দ এতই জোরালো আর গম্ভীর যে গির্জার অর্গানের শেষ কম্পনের মতো গুহার ভেতর প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। ওর আদর কাজ করছে বুঝতে পেরে এই জাঁদরেল প্রণয়িনীটিকে বিস্মিত ও হতচেতন করার জন্য দ্বিগুন উৎসাহে কাজটি একইভাবে চালিয়ে যেতে থাকে ও। যখন নিশ্চিত হয় যে ভাগ্যক্রমে আগের দিন খিদে নিবৃত্ত করা ওর খেয়ালি সঙ্গিনীটির হিংস্রভাব দূর হয়েছে, তখন গুহার বাইরে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে ও। ওকে বাইরে যেতে বাধা দেয় না বাঘিনী। ও পাহাড়ের মাথায় উঠে এলে ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে বেড়ানো চড়–ই পাখির মতো হালকা লাফে বাঘিনীও উঠে আসে, তারপর বিড়াল প্রজাতির সব প্রাণীর মতো পিঠ উঁচু করে সৈনিকটির পায়ে গা ঘষতে থাকে। তারপর দীপ্তির তীব্রতা কোমল হয়ে আসা দৃষ্টিতে তার অতিথিটির দিকে শ্রদ্ধাভরে তাকিয়ে একটা বন্য গর্জন করে ওঠে, প্রকৃতিবিদেরা যেটিকে করাতের কর্কশ শব্দের সাথে তুলনা করেন।
সৈনিকটি মৃদু হেসে ভাবে, 'এ দেখছি পাওনাগ-া আদায়ে পটিয়সী।'
ওর কান নিয়ে খেলা, পেটে আদর করা, যথাসম্ভব জোরে মাথা আঁচড়ে দেওয়ার মতো কাজগুলো করার জন্য যথেষ্ট সাহসী হয়ে ওঠে ও। এসব ব্যাপার সফল হয়েছে দেখে ছোরার ডগা দিয়ে ওটার মাথার খুলিতে সুড়সুড়ি দিতে থাকে, আর লক্ষ রাখে কোন সময়টাতে খুন করার যায় ওটাকে, তবে ওটার হাড় এত শক্ত যে ব্যর্থ হওয়ার পরিণতির কথা ভেবে কেঁপে ওঠে ও ।
মরুভূমির সুলতানা তার ক্রিতদাসটির কাছে নিজের ভদ্রতা দেখানোর জন্য মাথাটা ওপরে তুলে গলাটাকে লম্বা করে প্রশান্ত আচরণে সন্তোষ প্রকাশ করে। আচমকা সৈনিকটির মাথায় আসে যে এই বর্বর রাজকুমারীকে এক আঘাতে খুন করার জন্য ওর গলায় ছুরি চালাতে হবে।
ও ছোরাটা যখন তুলে ধরে তখন নিঃসন্দেহে তৃপ্ত বাঘিনীটা মোহিনী ভঙ্গীতে ওর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে ওর দিকে চোখ তুলে তাকায়। সে দৃষ্টিতে ওদের সহজাত হিংস্রতা সত্ত্বেও মেশানো ছিল একধরনের সংশয়ী শুভেচ্ছা। বেচারা সৈনিকটি একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে খেজুর খেতে খেতে পালাক্রমে একবার সম্ভাব্য উদ্ধারকারীর সন্ধানে মরুভূমির দিকে, আরেকবার অনিশ্চিত অনুকম্পা বোঝার জন্য তার ভয়ংকরী সঙ্গিনীর দিকে তাকায়। ওর ফেলে দেওয়া খেজুরের বিচি যেখানে গিয়ে পড়ছিল সেদিকে তাকাচ্ছিল বাঘিনীটা। যখনই একেকটা বিচি ছুড়ে ফেলছিল, প্রতিবারই ওর চোখে ফুটে উঠছিল একটা অচিন্তনীয় অবিশ্বাস।
ব্যবসায়ীর মতো বিচক্ষণতা নিয়ে মানুষটাকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে বাঘিনী। যা-ই হোক, এই পরীক্ষাতে উৎরে যায় ও, কারণ ও যখন যৎসামান্য খাওয়া শেষ করে, বাঘিনী কর্কশ জিহ্বা দিয়ে ওর জুতোজোড়া চেটে চেটে চমৎকার দক্ষতায় ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করে ফেলে।
ফরাসি সৈনিকটি ভাবে, 'হায়, ওর যখন সত্যি ক্ষিদে পাবে, তখন কী হবে?' এই চিন্তায় শিউরে উঠলেও সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাঘিনীটার শরীরের অনুপাত মাপতে থাকে, এই প্রজাতির মধ্যে জমকালো সুন্দরীর নিশ্চিত এক নমুনা এটা। তিন ফুট উঁচু, আর লেজ বাদ দিয়ে চার ফুট লম্বা। গদার মতো গোল শক্তিশালী অস্ত্রটা দৈর্ঘ্যে তিন ফুট। সিংহীর মাথার মতো বড় মাথাটা বিরল পরিশীলিত এক অভিব্যক্তিতে বৈশিষ্ট্যময়। এটা ঠিক যে বাঘের ক্রুর নিষ্ঠুরতা এর মধ্যে স্পষ্ট, তবে আবেদনময়ী রমণীর চেহারার সাথেও রয়েছে অস্পষ্ট একটা মিল। আসলে এই নিঃসঙ্গ স¤্রাজ্ঞীর চেহারায় পানোন্মত্ত স¤্রাট নিরোর ফূর্তিবাজ ভাবের মতো কিছু একটা আছে: রক্তের পিপাসা মিটিয়ে এসেছে ও, এখন খেলতে চাইছে।
সৈনিকটি নিজের অবস্থান পরীক্ষা করার জন্য পাহাড়টাতে অবাধে ওঠানামার কসরৎ করে, বাঘিনী বাধা দেয় না, কেবল দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করেই সন্তুষ্ট থাকে। বিশ্বস্ত কুকুরের চেয়ে বেশি তুর্কি বিড়ালের বিশ্বাস নিয়ে সে তার প্রভুর প্রতিটি পদক্ষেপ এবং সব কর্মকা- লক্ষ করছিল।
চারপাশ ঘুরে দেখার সময় কুয়োর ধারে পড়ে থাকা ঘোড়াটার দেহের অবশিষ্টাংশ চোখে পড়ে ওর। বাঘিনীটা এতদূর পথ ওটাকে হেঁচড়ে নিয়ে গেছে, তিন ভাগের দুই ভাগ খাওয়া শেষ। দৃশ্যটা দেখে ভরসা পায় ও।
গত রাতে গুহায় বাঘিনীটার অনুপস্থিতি এবং ঘুমন্ত অবস্থায় ওর প্রতি খাতিরের কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। সৌভাগ্যের এই প্রথম নজিরটি ওকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে লোভী হতে সাহসী করে তোলে। পুরো দিনটাই বাঘিনীটার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, ওকে পোষ মানানোর কোনো উপায়কে ফেলনা মনে না করা এবং ওর সুনজরে থাকার একটা বেপরোয়া আশা মনের মধ্যে পুষে রাখে ও।
বাঘিনীর কাছে ও ফিরে আসে আবার। ওকে আসতে দেখে প্রায় বোঝা যায় না এমনভাবে ওটার লেজ নাড়ানো দেখে এক অবর্ণনীয় আনন্দ অনুভব করে সে। তারপর নির্ভয়ে পাশে বসে ওকে নিয়ে খেলতে শুরু করে। থাবা আর মুখটা হাতে তুলে নেয়, কান ধরে টানে, চিৎ করে শুইয়ে দেয়, তারপর উষ্ণ সুন্দর তলপেটে আদর করতে থাকে। ও যা করতে চায় কোনো বাধা দেয় না বাঘিনী। তবে পায়ের পশমের ওপর আদর করার সময় নখগুলো সাবধানে থাবার পেছনে ঢুকিয়ে রাখে।
সৈনিক ছোরাটা এক হাতে ধরে ভাবে, অতিবিশ্বস্ত বাঘিনীটার পেটে ঢুকিয়ে দেবে কি না, কিন্তু ভয় হয় অন্তিম ছটফটানির সময় জড়িয়ে ধরে ওকে দম বন্ধ করে মারবে। তাছাড়া যে ওর কোনো ক্ষতি করেনি, তাকে সম্মান জানানো উচিত বলে ওর মনের মধ্যে এক ধরনের অনুশোচনা জেগে ওঠে। অসীম এক মরুভূমিতে একজন বন্ধু তো পাওয়া গেছে। এসময় মনে পড়ে ওর প্রথম প্রেমিকার কথা। ওর একটা নাম দিয়েছিল সে, যেটা ওর স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত, 'মিনিওন' [মিষ্টি]। মেয়েটি এত ভয়ংকররকম হিংসুটে ছিল যে ছোরা দেখিয়ে যখন-তখন হুমকি দিত, তাই যতদিন ওদের সম্পর্ক ছিল, সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো ওকে।
এখন যখন ভয় কমে গিয়ে ওটার, ক্ষিপ্র চঞ্চলতা ও কমনীয়তা উপভোগ করতে শুরু করেছে, প্রথম জীবনের স্মৃতি থেকে তরুণী বাঘিনীটাকে সেই নামে ডাকার বিষয়টা ওর মাথায় আসে। দিনের শেষে এই বিপদজনক অবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে ও, পরিস্থিতির এই যন্ত্রণাটা যেন বরং পছন্দই করছে। শেষপর্যন্ত চড়া গলায় 'মিনিওন' ডাক শুনলে সঙ্গিনীটি ওর দিকে মুখ তুলে তাকানোর অভ্যাস রপ্ত করে ফেলে।
সূর্য ডোবার সময় মিনিওন গভীর বিষণœ গলায় কয়েকবার ডাক দিয়ে ওঠে। হালকা গলায় ও আপনমনে বলে, 'ভালো শিক্ষা-দীক্ষাই পেয়েছে দেখছি, সন্ধ্যারতিও করে।' সঙ্গিনীটির মধ্যে বিরাজ করা খুব প্রশান্ত একটা মনোভাব লক্ষ করেই এই মজার কথাটা মনে আসে ওর। আজ ওটা ঘুমিয়ে পড়ার পর যত দ্রুত সম্ভব পালিয়ে যেতে হবে দুপায়ের ওপর ভরসা করেই। তাই সে ডাক দেয়, 'চলে এসো, আমার ছোট সুন্দরী, তোমাকে আগে ঘুম পাড়িয়ে দিই।' তারপর রাতের জন্য আরেকটা ডেরা খুঁজে নিতে হবে।
পালাবার জন্য অধৈর্য্য হয়ে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে সৈনিকটা। তারপর সময় বুঝে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে জোর কদমে নীলনদের দিকে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু বালির মধ্য দিয়ে মাইলখানেক যেতে না যেতেই শুনতে পায় করাত চেরার কর্কশ শব্দে চিৎকার করে লাফাতে লাফাতে ওর দিকে ছুটে আসছে বাঘিনীটা। সেই আওয়াজ ওর ছুটে আসার শব্দের চেয়ে আরো ভয়ংকর।
সে বলে, 'আহ্! বুঝতে পারছি আমার প্রেমে পড়ে গিয়েছে ও। আগে কখনোই কোনো মানুষের সাথে বেচারির পরিচয় ঘটেনি, সে হিসেবে প্রথম প্রেমিক হওয়া যথেষ্ট সম্মানের।' ঠিক সেই মুহূর্তে মরুযাত্রীদের ভয়ানক এক বিপদ চোরাবালির মধ্যে পড়ে যায় সে, এখান থেকে রক্ষা পাওয়া রীতিমত অসম্ভব। বালির মধ্যে ডুবে যেতে যেতে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে ও। ঠিক তখন বাঘিনীটা দাঁত দিয়ে ওর কলার কামড়ে ধরে, তারপর বিপুল শক্তিতে পেছন দিকে টেনে প্রায় জাদুমন্ত্রবলে ঘুর্ণায়মান বালির ভেতর থেকে তুলে আনে ওকে।
'আঃ মিনিওন!' চিৎকার করে ওঠে ও। তারপর প্রবল উদ্যমে ওকে আদর করতে করতে বলে, 'আমরা জীবন মরণের জন্য একসাথে বাঁধা, ঠাট্টা নয়, কথাটা মনে রেখো।' তারপর ফিরতি পথে হাঁটতে শুরু করে।
তখন থেকে মরুভূমিকে আর জনশূন্য মনে হয় না ওর। এখানে অন্তত একজন আছে, যার সাথে কথা বলতে পারে, যার হিংস্রতাকে নমনীয় করে এনেছে সে। ওদের ভেতরের অদ্ভুত বন্ধুত্বের কারণ ওর নিজের কাছেও জানা নেই। আত্মরক্ষার জন্য জেগে থাকার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও সেদিন ঘুমিয়ে পড়ে সে।
সকালে ঘুম থকে উঠে মিনিওনকে কোথাও দেখা যায় না। ওকে খুঁজতে পাহাড়ের ওপর উঠে এলে দেখা যায় দূর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে আসছে বাঘিনীটা। এই প্রজাতির মেরুদ- বেশ নমনীয় বলে না লাফিয়ে দৌড়াতে পারে না ওরা। মিনিওন কাছে পৌঁছালে দেখা যায় ওর চোয়াল রক্তমাখা। সঙ্গীর কাছ থেকে অভ্যস্ত আদর আদায় করে বেশ জোরালো ঘড়ঘড় শব্দে বোঝাতে চায় কতখানি আনন্দ পেয়েছে সে। সৈনিকটি পোষ মানানোর মতো করে ওর সাথে কথা বললে অবসাদে ভরা চোখ দুটো আগের চেয়ে আরো ধীরে ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়।
'আঃ! মাদমোয়াজেল, তুমি যে কী চমৎকার একটি মেয়ে, তাই না? একবার ভেবে দেখ! আমরা কেউ কাউকে হেলা করব না, ঠিক আছে? আচ্ছা, তোমার লজ্জা লাগে না? তুমি আরবদের খেয়ে ফেলছ, অন্যদেরও খাচ্ছ, ঠিক? তাতে কিছু আসে যায় না। ওরাও তো ঠিক তোমার মতোই প্রাণী, কিন্তু দেখো অভ্যাসবশত কোনো ফরাসিকে খেয়ে ফেলো না যেন, তাহলে তোমাকে আর ভালোবাসব না আমি।
কুকুর যেমন মনিবের সাথে খেলে, বাঘিনীটাও ওর সাথে খেলা করে, নিজের শরীরটাকে গড়িয়ে নিতে দেয়, কখনো চাপড়, কখনো আদর উপভোগ করে, কখনো দুই থাবা তুলে অনুনয় করার ভঙ্গীতে সৈনিকটাকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে।
এভাবে কয়েকদিন কেটে যায়। একজন সঙ্গিনীর কারণে মরুভূমির মহান সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে সৈনিকটি, এখন ভাববার মতো জীবন্ত একটা কিছু আছে সাথে, ভয় আর নৈঃশব্দের মধ্যে আনাগোনা থাকলেও রয়েছে যথেষ্ট খাবার, বৈপরীত্যে ভরা ভাবনা নিয়ে এক বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন শুরু হয় ওর।
নিঃসঙ্গতার মাঝে ওর কাছে উদঘাটিত হয় বাঘিনীর সকল গোপন সৌন্দর্য্য, ওটার পুলকের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে যায় সে। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের ভেতর আবিষ্কার করতে পারে পৃথিবীর অচেনা রূপ। মাথার ওপর দিয়ে কদাচিৎ উড়ে যাওয়া পাখির ডানার শোঁ শোঁ শব্দ শুনে, কিংবা রঙ বদলানো বহুবর্ণ পথিক-মেঘের দলের একের মধ্যে অন্যের বিলীন হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে শরীরে কাঁপন ধরলে কেমন লাগে এখন বুঝতে পারে ও। রাতের বেলায় বালির সমুদ্রের ওপর চাঁদের আলোর খেলা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে, দেখে কীভাবে দ্রুত বালির তরঙ্গ সৃষ্টি করে আবার সহসাই বদলে ফেলে মরুঝড়। প্রাচ্যের দিনরাত্রির অসাধারণ আড়ম্বরে হতবাক হয়ে পড়ে ও। উপভোগ করে পাক খাওয়া শুষ্ক কুয়াশা আর মৃত্যুবাহী লাল মেঘ সৃষ্টি করে ধেয়ে আসা ঘুর্ণিঝড়ের দৃশ্য। আনন্দের সাথে সে তখন আহ্বান করে রাত্রিকে, তারা থেকে ঝরে পড়তে দেখে একধরনের স্বাস্থ্যকর সজীবতা, শোনা যায় আকাশের অশ্রুত সংগীত। নির্জন নিস্তব্ধতার মধ্যে স্বপ্নের ঐশ্বর্য ছড়িয়ে দিতে শেখে ও। স্মৃতিতে থাকা মামুলী বিষয়গুলোর কথা ভেবে আর নিজের বর্তমানের সাথে অতীত জীবনের তুলনা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে কাটিয়ে দিতে পারে এখন।
একধরনের ভালোবাসার খুব দরকার ছিল বলে শেষপর্যন্ত বাঘিনীটার প্রতি প্রবল আকর্ষণ জন্মে যায় ওর মধ্যে।
সঙ্গিনীর চরিত্রের এই পরিবর্তন সৈনিকটির প্রবল ইচ্ছাশক্তির কারণে, না কি মরুভূমিতে শিকার অভিযানে গিয়ে পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছিল বলে, সেটা জানা না গেলেও মানুষটির জীবনকে সম্মান করছিল বাঘিনীটা। তাই এত ভালোভাবে পোষ মেনে যায় যে সৈনিকটি এখন ওকে আর ভয় পায় না।
এখন দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায় সে, বাকি সময় জালের মাঝখানে বসা মাকড়সার মতো চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখে, যাতে দিগন্তরেখা ধরে কেউ যাওয়ার সময় ওর মুক্তির কোনো সুযোগ অসাবধানতায় হাতছাড়া হয়ে না যায়। নিজের গায়ের জামাটা কেটে পতাকা বানিয়ে একটা খেজুর গাছের ডাল-পাতা কেটে ফেলে ওটার মাথায় বেঁধে দিয়েছিল সে। গরজ থেকে শিক্ষা নিয়ে ছোট ছোট কাঠি বেঁধে ওটাকে মেলে রাখার ব্যবস্থা করে। জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়ার সময় ওটাকে ওড়ানোর মতো যথেষ্ট বাতাস না থাকলে যাতে কারো চোখ না এড়ায়।
কাটতে চায় না এমন দীর্ঘ সময়গুলোতে সে যখন সব আশা হারিয়ে ফেলে, বাঘিনীটার সাথে খেলাধুলা করে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করত ও। ততদিনে সে ওটার আওয়াজের স্বরভেদ আর চোখের চাউনির ভাষা শিখে নিতে পেরেছে। এখন বসে বসে ওটার গায়ের সোনালী পশমের ওপর ফুলের খেয়ালি ছাপের নকশাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করে। রোদ ঝলমল করা অলংকারের মতো বৃত্তগুলো গুনে দেখার জন্য লেজের মাথার চুলের গোছাটা হাতে তুলে নিলেও রাগ করত না মিনিওন। ওর মাথা নাড়ার মার্জিত ভঙ্গীমা, পেটের শুভ্রতা, চমৎকার কোমল দেহরেখা অখ- মনোযোগে লক্ষ করে গভীর পুলকে আচ্ছন্ন হয়ে যেত ওর মন। বিশেষ করে ও যখন খেলা করত, ওর চপলতা, যৌবনপূর্ণ গতিশীল লঘিমা ছিল এক নিরবিচ্ছিন্ন বিস্ময়। নমনীয় ভঙ্গীতে ওর লাফিয়ে ওঠা, গাছে চড়া, গা ঘষে পশমগুলো ঠিকঠাক করে নেওয়া, লাফ দেওয়ার আগে গুঁড়ি মেরে বসা– এসব ভঙ্গী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করত ও। লাফ যতই দ্রুত হোকনা কেন, পাথর যতই পিছল থাকুকÑ 'মিনিওন' ডাক শোনার সাথে সাথেই থমকে দাঁড়িয়ে যেত ও।
এক মধ্যদিনের প্রখর রোদে বিশাল একটা পাখি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে পাক খাচ্ছিল। লোকটা নতুন অতিথিকে দেখার জন্য সঙ্গিনীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দৃশ্যটা দেখে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করার পর গম্ভীর গর্জন করে ওঠে পরিত্যাক্তা সুলতানা।
'হা ঈশ্বর! নিশ্চয়ই ওর হিংসে হচ্ছে।' ওটার চোখের দৃষ্টি আবার কঠিন হয়ে উঠতে দেখে ও চিৎকার করে বলে, 'ওর শরীরের মধ্যে মেয়ে মানুষের আত্মা ঢুকে পড়েছে নিশ্চয়ই।'
একসময় ঈগলটা দূর আকাশে অদৃশ্য হয়ে যায়, বাঘিনীর দেহরেখার বাঁকের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে সৈনিক।
ওর শরীরের এমন যৌবন আর সৌষ্ঠব! কোনো রমণীর মতোই সুন্দরী সে! গায়ের সোনালী পশম ধীরে ধীরে রঙ বদলে নিখুঁতভাবে মিলে গেছে উরু ও তলপেটের সূক্ষ্ম সাদাটে রঙের সাথে। সূর্যের ঢেলে দেওয়া অকৃপণ আলোয় এই জীবন্ত স্বর্ণ, তার পিঙ্গল ছোপ ছোপ শরীর যেন এক অবর্ণনীয় রূপে ঝলসে ওঠে।
মানুষটি আর বাঘিনী অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকায়। এসময় মাথায় বন্ধুর আঙুলের নখের আদর পেয়ে কেঁপে ওঠে ছেনালটি, চোখদুটোতে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়– তারপর আঁট করে চোখ বুঁজে ফেলে।
মরু রাণীর শান্তশ্রী রূপ মরুর বালির মতোই স্বর্ণাভ, শ্বেতশুভ্র, অগ্নীময়ী ও নিঃসঙ্গ, সেদিকে চেয়ে সৈনিকটি ভাবে, 'ওর মধ্যে একটা সত্তা আছে।'
এটুকুর পর আমার সঙ্গিনীটি বলে, 'আচ্ছা বেশ। জন্তু-জানোয়ারদের নিয়ে তোমার আকুতিভরা লেখা আমি পড়েছি, কিন্তু এত ভালো বোঝাপড়া হওয়া দুজনের শেষ পরিণতি কী হলো।'
'ইশ! সব বড় ভালোবাসায় যা হয়, সেভাবেই শেষ হয়েছে– ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে। যে কোনো কারণে একজনের প্রতি আরেকজনের সন্দেহ, অহংকার, ঝগড়াবিবাদ, কখনো নিছক একগুঁয়েমির কোনো ব্যাখ্যা হয় না এসব ক্ষেত্রে।'
'তবু কখনো কখনো সবচেয়ে সুখের মুহূর্তে একটি মাত্র শব্দ কিংবা একটা চাউনিই যথেষ্ট। যা-ই হোক, তোমার গল্পটা শেষ কর।'
'ব্যাপারটা ভয়ানক কঠিন। তবে সেই বুড়ো খলনায়কটি শ্যাম্পেন খেতে খেতে আমাকে যা বলেছিলেন, তুমি হয়তো কিছূ বুঝতে পারবে। তিনি বলেছিলেন, "জানি না আমি ওটাকে ব্যথা দিয়েছিলাম কি না, কিন্তু রাগ করেছে এমনভাবে আমার দিকে ফিরে ওর ধারালো দাঁত দিয়ে আমার পা কামড়ে ধরে, অনুমান করি হালকাভাবেই ধরেছিল সে। কিন্তু আমাকে খেয়ে ফেলবে মনে করে ভয়ে ছোরাটা ওর গলায় চালিয়ে দিই। রক্ত হিম করা একটা ডাক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে সে, চোখের সামনে ওকে মরে যেতে দেখলাম, আমার দিকে তাকিয়ে ছিল তখনো, চোখে কোনো রাগ নেই। তখন ওকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য দুনিয়ার সব কিছু দিয়ে দিতে পারতাম, এমনকি আমার পদকও, যদিও সেটা পাইনি তখনো। মনে হচ্ছিল আসলে একজন মানুষকে খুন করেছি আমি। যে সেনাদল দূর থেকে পতাকাটা দেখতে পেয়ে আমার সাহায্যে এগিয়ে আসে, ওরা এসে দেখে আমি বসে বসে কাঁদছি।"
'কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বলেন, "তবে কি জানেন? তারপর থেকে যুদ্ধ করতে নানান দেশে গিয়েছি আমি– এই দেহখানা বয়ে জার্মানি, স্পেন, রাশিয়া, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে প্রচুর ঘুরেছি, কিন্তু মরুদেশের মতো এমন কিছু আর কখনো দেখিনি। আহা, কি চমৎকার!"
তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'কেমন লেগেছিল সেখানে?'
"ওহ! সেটা আমি বর্ণনা করতে পারব না হে যুবক! তাছাড়া, আমি যে সবসময় সেই খেজুর গাছ আর আমার বাঘিনীটার কথা ভেবে আক্ষেপ করছি তা নয়। ঘটনাটার জন্য আমার খুব মনোঃকষ্ট হওয়ার কথা। জেনে রাখুন, মরুদেশে সবই আছে আবার নেইও।"
'হ্যাঁ, জানি, কিন্তু যদি একটু ব্যাখ্যা করতেন।'
একটা অসহিষ্ণু ভঙ্গীতে তিনি বলেছিলেন, "তাহলে বলি, এটা জনমানবহীন ঈশ্বর।"