জীবনে ফেরার দণ্ড

প্রিসিলা রাজপ্রিসিলা রাজ
Published : 11 Sept 2021, 11:39 AM
Updated : 11 Sept 2021, 11:39 AM


পদার্থবিদ ইগর টেপির শিক্ষকতা করেন এবং বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখেন। বর্তমানে স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে বাস করছেন। "সিক্রেট নাম্বার" তাঁর প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। এরপর "এ সেনটেন্স টু লাইফ"সহ আরো বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লিখেছেন।

মূল: ইগর টেপির
অনুবাদ: প্রিসিলা রাজ

এর চেয়ে মৃত্যু ভাল।
পার্কের বেঞ্চিতে বসেছিল সে। সামনের কৃত্রিম হ্রদে রাজহাঁসের দল ভেসে বেড়াচ্ছে। জলের ওপর তাদের পথরেখার স্পন্দন মুহূর্তে মিলিয়ে গিয়ে অন্য রূপে দেখা দিচ্ছে। চারপাশে স্বাস্থ্যোদ্ধারকারীদের জগিং, কুকুরপ্রেমীদের চতুষ্পদটি সহকারে হেঁটে চলা, প্যারাম্বুলেটরে বাচ্চা ঠেলতে ঠেলতে চলা বাপ-মায়েদের ভীড়। চতুর্দিকে এত প্রাণ, তবু জুলিয়াসের ভীষণ একা লাগে। এত একা কখনও ছিল না সে। এর চেয়ে মরণও যে অনেক ভাল।

তাবিথার ওপর দোষ চাপাতে পারবে না, জুলিয়াস তা ভাল করেই জানে। সবকিছুর জন্য সে নিজে দায়ী, সব দোষ তার নিজের। কিন্তু তারপরও, পুরো ব্যাপারটা এত খারাপ, এত অন্যায় যে জুলিয়াস নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি। ক্রোধে, ক্ষোভে, দুঃখে আকামটা সে করেই ফেলেছে। তাবিথা তার মনটাকেই শুধু ভাঙেনি, তার হৃদয়টাকে ভেঙেচুরে মÐ পাকিয়ে দুই পায়ে সেই মÐ পিষেছে। প্রতারণা, অপমান আর লাঞ্ছনার জ্বালায় জুলিয়াসের ভেতরটা পুড়ে খাক হয়ে গেছে।

আর তারই ফল তাবিথার খাওয়ার বøগে সেদ্ধ, ঝলসানো, ভাপানো, বেক করা, গ্রিল করা, কাঁটায় বিক্ষত, তেলে সাঁতলানো, ঝোলে ডোবা আস্ত কাকের ছবি, সঙ্গে বিশদ রন্ধন প্রণালী। ঐসব ছবি আর রন্ধনপ্রণালী জুলিয়াসের হৃদয়ের বর্তমান অবস্থাকেই প্রকাশ করে। যদি তা না হতো, জুলিয়াসকে দিয়ে কখনও এ কাজ সম্ভব ছিল না। তা যদি না হতো, জীবন্মৃত ভ্যাম্পায়ারের ভালবাসা নামের সিনেমা সিরিজের প্রত্যেকটার ওপর সিনে-পর্যালোচনার নামে বীভৎস সব বিবরণ প্রাক্তন প্রেমিকার মিডিয়া-বিষয়ক সাইটে কেনই বা পোস্ট করতে যাবে সে? আরো আছে। "আমারচেহারাকেমন" নামের সাইট থেকে কুৎসিততম ২০টি ছবি তাবিথার নিজের সাইটের প্রোফাইল ছবির জায়গায় বসে গেছে; "রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস"-এর জায়গায় "পচিতেছে" লেখা হয়েছে। কে করেছে জানতে বাকি নেই কারো।
এসব কীর্তির পর জুলিয়াসের মনটা সাংঘাতিক ফুর্তিতে ভরে গিয়েছিল। আত্মতৃপ্তি, রমরমা আনন্দ সব মিলিয়ে একটা দারুণ ব্যাপার হচ্ছিল তার মধ্যে। কিন্তু বেশিক্ষণ সেই অবস্থা টেকেনি। তার কিছু পরই আগের চেয়েও খারাপ লাগায় মনটা ছেয়ে গেছিল। হতে পারে, এর জন্য কী মূল্য দিতে হবে সেটার আগাম চিন্তা মনে ভর করেছিল। যে মূল্য সে এই মুহূর্তে দিচ্ছে।

বিশ্বে সাইবার অপরাধ শারীরিক আক্রমণকেন্দ্রিক অপরাধকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন এমন সব প্রোগ্রাম বেরিয়েছে যা দিয়ে একই লোককে একই সময় বহু জায়গায় দেখানো সম্ভব হয়। এটাকে বলা হচ্ছে স্বগুণন প্রোগ্রাম। জেলগুলোতে সাইবার অপরাধীদের সঙ্কুলান হচ্ছে না। সাইবার অপরাধ আইন ২০৩২ দিন দিন আরো কঠোরভাবে প্রয়োগ হচ্ছে। মানুষের জীবনের ডিজিটালকরণের ফলে একদিকে সাইবারনির্বাসন কার্যকর শাস্তি হিসাবে আবিভর্‚ত হয়েছে, কিন্তু একইসঙ্গে সাইবার অপরাধকেও অনিবার্য করে তুলেছে।

সাইবারনির্বাসন: এটা এমন শাস্তি যার প্রয়োগে সাইবার স্পেসে সব অ্যাকাউন্ট মুছে দেওয়া হয়। তার থেকেও খারাপ – আসামীর আরফিড ও আরফিডার দু'টোই অকেজো করে দেওয়া হয়। সেই শাস্তি জুলিয়াস হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এই মুহূর্তে।
পার্কে তার চারপাশে অগণিত মানুষ কিন্তু তাদের কারো সম্পর্কে একটি তথ্যও পাচ্ছে না সে – কারণ তার আরফিড অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। চারপাশের মানুষের মুখগুলো যেন একেকটা অচেনা-অজানা চিহ্ন যাকে সে পড়তে পারছে না। এই মানুষগুলোর নাম, তাদের আগ্রহ, তাদের সম্পর্ক, ব্যক্তিগত কোনো তথ্যের ছিটেফোঁটার হদিশ তার কাছে নেই। শরীরে আরফিড প্রোগ্রাম কার্যকর থাকলে তাদের রেটিনায় চোখ রেখেই সে জেনে যেত প্রত্যেকের হালহদিশ। অন্যদিকে, তার নিজের আরফিডারও অকার্যকর ফলে তার রেটিনাও পথচারীদের কাছে তাকে সম্পূর্ণ আগন্তুক করে তুলেছে। জুলিয়াস এখন তাদের কাছে একটা জালি লোক, যার কোনো তথ্য কারো কাছে নেই। এমনকি কুকুরগুলোর শরীরেও আরফিড আছে। তার দ্বারা কোনটা কার কুকুর, জাত, নাম, ঠিকানা সব খুঁটিনাটি সবার জানা হয়ে যায়। হতাশায় ডুবে গিয়ে জুলিয়াস ভাবে এমন কী কুকুরগুলোও তার চেয়ে বেশি মনুষ্যসমাজের সদস্য।
গত কয়েক ঘণ্টা যাবত জুলিয়াস কোনো মানুষের সঙ্গে চোখাচুখি করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল ক্রমাগত। কিন্তু মানুষগুলো যেন তাকে দেখতেই পাচ্ছে না। সে যত না অদৃশ্য তার চেয়ে বেশি যেন চারপাশের জড়নিসর্গের অংশ। যেন দেখতেই পায়নি এভাবে পথচারীরা পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তার কপালে কেবল জুটল বিস্মিত, কিছুটা যেন ভীত, কয়েকজনের একাধিক দৃষ্টিনিক্ষেপ। যেহেতু ওর রেটিনা কোনো তথ্য দিচ্ছিল না, কয়েকজন তাই কয়েকবার তাকাল। চোখ পিট পিট করে বুঝতে চাইল ব্যাপারটা কী। নিজেদের আরফিডে সমস্যা হয়েছে ভেবে আরেকজনের রেটিনায় তাকিয়ে যখন বুঝল সব ঠিক আছে, সামনের লোকটিতেই যত গÐগোল, তখন দ্রæত পাশ কাটিয়ে চলে গেল, একবারও আর দৃকপাত না করে। কুকুরছানা আর ছোট ছোট বাচ্চা যাদের আরফিড দেওয়া হয় না তারা তার দিকে তাকাল ঠিকই, কিন্তু অভিভাবকরা দ্রæত তাদের সরিয়ে নিয়ে গেল।

"কিন্তু আমার তো বারো বছর বয়সের আগে কোনো আরফিডই ছিল না," জুলিয়াস নিজেকে সান্ত¦না দিতে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিতের বারিধিবিপুলের সংস্পর্শে কখনও না আসা এক অভিজ্ঞতা, আর আসার পরে তা হারিয়ে ফেলা সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা এক।
"মাত্র এক বছরের জন্য এই শাস্তি," আবারও স্বান্ত¦না খোঁজে সে।
"পুরো একটা বছর!" হতাশায় মুহ্যমান হয় ওরই আরেক সত্তা।
এই এক বছরে ওর বন্ধুরা ওকে দ্বিগুণ বিস্মৃত হবে, ওর শব্দভাÐারের অর্ধেক মেয়াদ হারাবে, পুরো সংস্কৃতি তাকে পাশ কাটিয়ে ধাবিত হবে আরো অনেকটা দূর।
চোখ বন্ধ করে ফেলে, ক্ষোভে, আক্রোশে মুঠি পাকায় জুলিয়াস। মনের পর্দায় হারানো বিশ্বকে ভাসিয়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। আর তখনই বাম কবজির ডগায় ভিজে ভাবটা টের পেল। চমকে গিয়ে চোখ খুলে দেখে একটা কুকুর। গোল্ডেন রিট্রিভার জাতের রোমশ কুকুরটা গোল গোল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে ওর হাত চাটছিল। একটা জীবন্ত প্রাণী তার অস্তিত্বকে স্বীকার করছে ভেবে কৃতজ্ঞ বোধ করে জুলিয়াস। কিন্তু পরক্ষণেই অচেনা-অজানা জন্তুটা তার হাত চাটছে, এই ভেবে ভয়ে ঠাÐা হয়ে যায় সে।

"ভয় নেই, ও কেবল পছন্দের লোকদেরই হাত চাটে," নারীকণ্ঠে কথাগুলো পেছন থেকে এল।
বেঁটেখাটো, গাঢ় শ্যামলা বর্ণের, কালো চুলের মহিলাটি এগিয়ে এসে হাসি হাসি মুখে ওর চোখের দিকে তাকাল। ভারতীয় মনে হয়…আগন্তুক সম্পর্কে জুলিয়াস এটুকুই কেবল মনে করতে পারে। এইটুকু আবার নিশ্চিতভাবে জানা নয়, নিছক অনুমান। এ বাদে সামনের মানুষটি সম্পর্কে তার আর কিছুই জানার যো নেই! এরকম একশ' ভাগ আগন্তুকের সঙ্গে শেষ কবে কথা হয়েছিল মনে পড়ে না তার।
জুলিয়াসের পেটের মধ্যে অশান্তি গুড়গুড়িয়ে ওঠে। কিন্তু সে জোর করে স্বাভাবিক থাকে। পরিহাস বটে, সে নিজেও তো মহিলার কাছে সম্পূর্ণ আগন্তুক। এক হাত দূরে দাঁড়ানো তরুণীর দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে চেষ্টা করে। চোখের এখন কেবলই প্রকৃতিদত্ত দেখার ক্ষমতা। তাই দিয়ে ঠাহর করে মেয়েটির মুখ মেচেতায় ভরা কিন্তু দেখতে ভারী মিষ্টি।
"আমি রোমিতা," করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে বলে আগন্তুক।
"আমি জুলিয়াস," সেও হাত বাড়ায়। হাতদু'টো ঘামে চুপচুপে হয়ে আছে বলে বিরক্ত লাগে।
হাত মেলানোর সময় জুলিয়াসের মাথায় মৃদু সতর্কসঙ্কেত বাজে – মহিলাটির টীকা দেওয়া আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু কুকুরটা তো এরই মধ্যে তার হাত চেটে দিয়েছে। বিপদ হলে সেখান থেকেও হতে পারে। "আপনি নিশ্চয়ই কুকুর খুব ভালবাসেন," রোমিতা বলে।
"এ কথা বলছেন কেন?"
"ও যখন আপনার হাত চাটল আপনি হাত সরিয়ে নেননি…" বলতে বলতে সে চারদিকে তাকিয়ে নেয়, তারপর ফিসফিস করে বলে, "বেআইনি।" জুলিয়াসের চেহারায় বিভ্রান্তি ফুটে উঠতে দেখে ভ্রƒভঙ্গী করে সে। বলে, "আরফিড নাই।"
হেসে ওঠে জুলিয়াস। তেতো হাসি।
"হুঁ। তাহলে দু'জন হলাম আমরা"
এবার মেয়েটির বিভ্রান্ত হওয়ার পালা।
"ইয়ে, আমার সাইবার নির্বাসন হয়েছে," জুলিয়াস বলে, "কেন, আপনি বুঝতে পারেননি?"
"অধিকাংশ সময় আরফিডার বন্ধ করে রাখি আমি," রোমিতা বলে। "সাইবার নির্বাসন? বেশ একটা গল্প আছে মনে হচ্ছে?"
"বন্ধ করে রাখেন? নিজে ইচ্ছা করে?"
"আপনার কাছে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ইচ্ছা করে জেলে ঢোকার মতন?" বলে মেয়েটা।
"মানুষের সঙ্গে তাহলে আপনি কী করে মেশেন?"
"কথা বলি, মনোযোগ দেই। কারো সম্পর্কে কিছু জানতে হলে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করি। সহজ বিষয়।"
"কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করা যায় কিনা কীভাবে বোঝেন?"
"এ কথাটা আমি বুঝতে পেরেছি যে সাধারণত একটা মানুষকে বিশ্বাস করতেই পারেন আপনি। তাছাড়া এ বিষয়ে যেকোনো আরফিডারের থেকে শেক্সপিয়ারের ক্ষমতা অনেক বেশি। আরফিডার কখনোই ঐ জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না। শেক্সপিয়ার, সোনা আমার, ঠিক বলেছি না?"
নীচু হয়ে কুকুরের পিঠে সস্নেহে হাত বোলায় রোমিতা। গলা আর থুতনিতে সুড়সুড়ি দেয়। কুকুরটাও খুশিতে হেসে উঠে ওর হাত চেটে দেয়।
"বিশ্বাসই করতে পারছি না আমার সামনে এসব ঘটছে," মাথা নেড়ে বলে জুলিয়াস।
"আমাদের সঙ্গে আসুন," জুলিয়াসকে ডাকে মেয়েটা। "সত্যিকারের জীবন নামের জেলখানা সম্পর্কে দু'য়েকটা বিষয় আমার কাছে শিখতে পারবেন।"
ওর পেছন পেছন জগিং শুরু করে সে। বিশাল রহস্যময় এক জগতে প্রবেশ করে। একটা বিশেষ অনুভ‚তির দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় জুলিয়াস। সেই অনুভ‚তি শেষ কবে হয়েছে তার কিছুতেই মনে করতে পারে না সে। সেই অনুভ‚তির নাম – পূর্বানুমান।

"A Sentence to Life" by Igor Teper
Published in Nature; Vol 477; 1 September 2011