নোবেলজয়ী লুইস গ্লাক-এর তিনটি কবিতা

লায়লা ফারজানা
Published : 20 April 2022, 05:49 AM
Updated : 20 April 2022, 05:49 AM


লুইস গ্লাকের জন্ম ১৯৪৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে। বেড়ে ওঠেন নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডে। তিনি ১৯৬১ সালে জর্জ ডব্লিউ হাই স্কুল, হিউলেট, নিউ ইয়র্ক থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। পরবর্তীতে তিনি সারাহ লরেন্সে কলেজ ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। বর্তমানে তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। লুইস গ্লাক তাঁর 'ওয়াইল্ড আইরিস' কবিতা-গ্রন্থের জন্য ১৯৯৩ সালে পুলিৎজার প্রাইজ পান। পুলিৎজার প্রাইজ'র পাশাপাশি তিনি ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড, দ্য একাডেমি অব অ্যামেরিকান পোয়েট'স প্রাইজসহ বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হন।

২০২০ সালে লুইস গ্লাক সাহিত্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। নোবেল-কমিটি তাদের বক্তব্যে বলেন,
"Her unmistakable poetic voice that with austere beauty makes individual existence universal"

লুইস গ্লাকের কবিতা মূলত আত্মজৈবনিক। ব্যক্তিগত হতাশা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাফল্য-ব্যর্থতা, নিঃসঙ্গতা ধ্রুপদী মিথের সাথে মাখামাখি হয়ে ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়। লুইস গ্লাকের কবিতার বইয়ের সংখ্যা মোট এগারটি। তন্মধ্যে 'দ্য সেভেন এইজ', 'ভিটা নোভা' ও 'এভেরনো' উল্লেখযোগ্য। কবিতার পাশাপাশি 'প্রুফস এন্ড থিওরিস', 'এসেস অন পোয়েট্রি' তাঁর বহুল আলোচিত গদ্যসংগ্রহ। কবিতাগুলো ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন লায়লা ফারজানা। বি.স.

লুইস গ্লাক'র কবিতা
অনুবাদ: লায়লা ফারজানা

কুহকিনী (Siren)

প্রেমে পড়ে আমি দুর্বৃত্ত, পাপী।
আগে ছিলাম বেয়ারা।

আমি তোমার সাথে শিকাগো যেতে চাইনি।
তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম,
তোমার স্ত্রীকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলাম।
চেয়েছিলাম তার জীবনটা ট্র্যাজেডি নাটক হয়ে যাক —
যার প্রতিটি অংশই দুঃখের অংশ।

কোনো ভালো মানুষ কি এভাবে ভাবতে পারে?
আমার প্রাপ্য—
আমার সাহসের কৃতিত্ব —

আমি তোমার বাড়ির সামনের বারান্দায়
অন্ধকারে বসেছিলাম।
সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার ছিল:
তোমার স্ত্রী যদি তোমাকে যেতে না দেয়,
তাহলে কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে
সে তোমাকে ভালোবাসে না?
যদি সে তোমাকে ভালবাসতো,
সে কি চাইতো না তুমি সুখী হও?

এখন আমার মনে হয় আমার অনুভূতি যদি
এতো গাঢ় না হতো —
হয়তো আমি একজন ভালো মানুষ হতে পারতাম।
আমি তো ভালো বেয়ারা ছিলাম।
আটটি পানীয় অনায়াসে বহন করতে পারতাম।

কতবার বলেছি তোমাকে, আমার স্বপ্নের কথা!
কাল রাতে একটি মেয়ে কাঁদছিল—
অন্ধকার একটি বাসে — স্বপ্নে,
বাসটি দূরে সরে যাচ্ছিলো।
এক হাতে বিদায় জানাচ্ছিলো সে;
অন্য হাতে খামচে ধরা একটি বাচ্চা-ভর্তি ডিমের খাঁচা।
স্বপ্নেও মেয়েটির নিষ্কৃতি নেই।

জিম্মিদের দৃষ্টান্ত (Parable of the Hostages)

গ্রীকরা বসে আছে সমুদ্রতটে,
যুদ্ধ শেষে কী করবে সেই ভাবনায়।

ঘরে ফিরতে চায় না কেউ,
সেই অস্থিসার দ্বীপে;
চায় আরো একটু ট্রয়,
ট্রয়ের বল্গাহীন জীবন—
প্রতিটি দিন যেখানে বিস্ময়ের
মোড়কবন্দী নতুন চমক।

কিন্তু অপেক্ষায় থাকা ঘরের মানুষদের
কিভাবে বোঝানো যায়!
অনুপস্থিতির জন্য যুদ্ধ একটি যুক্তিসঙ্গত অজুহাত,
কিন্তু প্রমোদভ্রমণ নয়।
আবার ভাবে, 'আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে'—

কর্মক্ষম পুরুষ এরা,
নারী ও শিশুদের অন্তর্দৃষ্টি আর
অন্ধকারে রেখে যেতে এরা প্রস্তুত।
প্রখর রোদে নিজেদের মজবুত কব্জির দিকে তাকিয়ে
আবার ভাবনায় তলিয়ে যায় —
কব্জিগুলো ঘর ছাড়ার আগে যেমন ছিলো
তার চেয়েও এখন আরও বেশি দৃঢ় আর সোনালি।

কেউ কেউ আবার
পরিবারের জন্য স্মৃতি-আক্রান্ত,
ঘরের বউটিকে কতদিন দেখে না!
—"যুদ্ধ কি বুড়িয়ে দিয়েছে তাকে?"

কেউ কেউ ভোগে অস্বস্তিতে:
যুদ্ধ যদি হয় পোশাকি সাজের একটি নিছক পুরুষালি সংস্করণ?
আধ্যাত্মিক প্রশ্ন এড়াতে উদ্ভাবিত একটি গভীর পরিকল্পিত খেলা?

আহ্!
কিন্তু এতো কেবল যুদ্ধ নয়!
সমগ্র পৃথিবী যেন শুরু হয়
যুদ্ধের ধ্বনিত কণ্ঠের একটি সমবেত সঙ্গীত দিয়ে
আর শেষ হয় ভাসমান সাইরেনের একক সঙ্গীতে।

সেখানে, সেই সমুদ্রসৈকতে,
ঘরে ফেরার সময়সূচীর বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে করতে —
কেউ কেউ অবাক হয় এই জেনে যে
ইথাকাতে ফিরে যেতে
দশ বছর সময় লাগতে পারে;
কিন্তু কেউ পায় না
হাজার দশকের অদ্রবণীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পূর্বাভাস —
উত্তরহীন হৃদয়ের কষ্ট:
কীভাবে বিভক্ত হয় পৃথিবী, বিশ্বের সৌন্দর্য —
গ্রহণযোগ্য আর অগ্রহণযোগ্য
ভালবাসায়!

ট্রয়ের সেই সমুদ্র তীরে,
গ্রীকরা কিভাবেই বা জানবে —
তারা ইতিমধ্যেই জিম্মি:
যারা যেতে চায় না তারা আটকা পড়ে যায়,
যারা যাত্রা শুরু করেনি তারা বিমোহিত;
কিভাবেই বা জানবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ
চিরকালের জন্য ধরা পড়ে গেছে:
কেউ সুখের স্বপ্নে,
কেউ কেউ ঘুমে,
আর কেউ গানে!

স্বর্গীয় সংগীত (Celestial Music)

আমার একটি বন্ধু আছে।
সে স্বর্গে বিশ্বাস করে।
না, বোকার স্বর্গের কথা বলছি না।
সে বোকা নয়।

তবুও সে যাই জানে তাই দিয়ে —
ঈশ্বরের সাথে কথা বলে এই বিশ্বাসে যে
ঐ স্বর্গ থেকে কেউ তাকে শুনছে।

পার্থিব জীবনে সে অস্বাভাবিকরকম দক্ষ। সাহসীও,
যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে অনায়াসে।

আমরা একদিন একটি শুঁয়োপোকাকে
আবর্জনার মধ্যে মরতে দেখেছি,
লোভী পিঁপড়ার দলের হামাগুড়ি যার উপর।
জীবনীশক্তি-বিরোধী বিপর্যয় আমাকে আন্দোলিত করে চিরকাল।
কিন্তু আমি ভীরু —খুব সহজেই চোখ
বন্ধ করে ফেলি।

অথচ আমার সাহসী বন্ধু
পুরো ঘটনাটি ঘটতে দেখছিল,
প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে নিয়ে।
শুধু আমার জন্য পিঁপড়াগুলো ঝেড়ে ফেলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন শরীরটিকে
তুলে নিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলো পথের পাশে।

বন্ধু বলে, আমি ঈশ্বরের প্রতি আমার চোখ বন্ধ রেখেছি;
এ আমার বাস্তবতার প্রতি মুখ ফেরানো ছাড়া আর কিছুই নয়।
মাতৃসুলভ স্নেহ নিয়ে সে আমাকে বলে
আমি যেন বালিশে মুখ লুকানো সেই শিশুর মত—
যে সত্যকে মেনে নিতে ভয় পায়,
যে মনে করে আলো বুঝি সব জ্বালিয়ে দিবে।

এমন কি স্বপ্নেও বন্ধুটি আমাকে তিরস্কার করে।
ধৈর্য নিয়ে আমাকে তাগিদ দেয় যেন আমি
তার মতো একজন পরিণত মানুষ হয়ে জেগে উঠতে পারি,
একজন সাহসী মানুষ —

একই পথ ধরে আমরা আজও হাঁটছি,
পার্থক্য শুধু এটুকুই যে এখন শীতকাল।
সে আমাকে বলে — উপরে তাকাও,
এই পৃথিবীকে ভালবাসলে তুমিও স্বর্গীয় সঙ্গীত শুনতে পাবে —
আমি উপরে তাকাই— কিচ্ছু দেখি না।
কেবল মেঘ, আর তুষার,
সাদা হয়ে যাওয়া গাছ যেন কোনো নববধূ —
অতিক্রম করতে চায় কোনো অপার্থিব উচ্চতা।
আমার ভয় হয়, তার জন্য;
ভাবি, সে কি ইচ্ছাকৃতভাবে
পৃথিবীর উপর ফেলা জালে ধরা পড়ে যাচ্ছে!

বাস্তবে ফিরে আসি আবার,
এখন আমরা পথের ধারে, সূর্যাস্তের দিকে চোখ,
বসে আছি পাশাপাশি,
কখনো কখনো পাখির ডাক নীরবতা ভেদ করে যায়।
এখনই সময় —
আমাদের বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করার,
মৃত্যু এখন আমাদের কাছে
নির্জনতার মত সহজ।

বন্ধুটি পথের ধুলায় একটি বৃত্ত আঁকে;
স্থির শুঁয়োপোকাটি এখনও তার পরিধিতে,
নড়াচড়া নেই।
বরাবরের মতো সে চেষ্টা করে একটি পরিপূর্ণ, সুন্দর, কিছু সৃষ্টি করতে,
স্রষ্টার থেকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে যে সক্ষম।

আমরা এখন ভীষণ শান্ত, চুপচাপ,
এই নির্জনতা, এই বসে থাকা শান্তিময়,
কথাহীন, স্থির,
পথটি হঠাৎ অন্ধকার হয়, বাতাস শীতল,
এখানে ওখানে প্রস্তরখণ্ডগুলো চকচক করে জ্বলে —
নীরবতার এই ধীর রূপ আমরা দুজনেই ভালবাসি।

এই রূপের প্রতি ভালবাসা —
সমাপ্তির প্রতি ভালবাসা।