অনলাইন বৈঠক ২রচয়িতার দায়িত্ব

admin
Published : 22 Oct 2011, 12:04 PM
Updated : 22 Oct 2011, 12:04 PM

অনলাইন বৈঠকে যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবেন। শুধু বাংলা ভাষায় লেখা প্রতিক্রিয়াই গ্রহণ করা হবে।


ছবি. কমলকুমার মজুমদার

‍‍অনলাইন বৈঠক ২ শুরু হয়েছে ২২/১০/২০১১ তারিখে। এর বিষয়:

পাঠক, শ্রোতা বা দর্শকের ব্যাপারে লেখক, গীতিকার বা চলচ্চিত্র রচয়িতার কোনো দায়-দায়িত্ব নাই।

লেখা পাঠানোর ঠিকানা: arts@bdnews24.com। লেখার সঙ্গে ছবি, ফেসবুক লিংক বা ওয়েব পেজ লিংক এবং ইমেইল অ্যাড্রেস দেওয়া যাবে। অনাগ্রহীরা এসব ছাড়াও আলোচনা চালাতে পারবেন। – বি. স.]

এ পর্যন্ত লিখেছেন

১. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
২. রিফাত হাসান
৩. সাইফুর রহমান
৪. লুনা রুশদী
৫. ফজলুল কবিরী
৬. তারেক আহমেদ
৭. ইউসুফ খান
৮. কাজী মাহবুব হাসান
৯. আমিনুল করিম মাসুম
১০. সালমান তারেক শাকিল
১১. আসমা সুলতানা
১২. ফাহাম আব্দুস সালাম
১৩. জাহিদ পাভেল
১৪. আশিক রূপম মাহমুদ


●●●

১. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

আমি অনেকবারই ভেবেছি, আমার লেখার ব্যাপারে পাঠকের কোনো দায়-দায়িত্ব থাকার প্রয়োজন কী? আমিই তো আমার লেখার একেবারে প্রাইমারি পাঠক। আমার নিজের পাঠের পরে আর পাঠ কী? এইটুকু ভাবি, ভাবতেই ভাবতেই নতুন ভাবনা আসে। আচ্ছা, লিখে যদি পাঠকের সাথে শেয়ারই না করলাম, তবে আর তা প্রকাশের বাসনা কেন? ছাই-ফাই যা লিখলাম, তা বালিশের তলায় বা ড্রয়ারে বা ডাস্টবিনে ফেলে দিলেই তো হয়! তবে তাতে শান্তি আসে না। অশান্তির তীক্ষ্ণস্রোত বার-বার আমারে খোঁচায়। পাঠকের সাথে মোলাকাত হতে চায়। সৃজনশীলতার সাথে পাঠ-সংযোগের একটা পথ করতে তখন বাসনা জাগে।

তা যখন প্রকাশই করি, তখনই শুরু হয় আমার আরেক লীলা, তখন আমিই আবার এর পাঠক হই, লেখার ভিতর নানান জাতের বিষয়, কথন, যুক্তি, প্রতিযুক্তি আবিষ্কার করতে থাকি। পাঠকও তাই করুক তাই ভাবতে চাই। আমি তখন লেখক হয়ে লেখা থেকে নিজেরে আলাদা করি; কিন্তু পাঠকসত্তা মরে না। নিত্য বোঝাপড়া করতে চায়। এইভাবে পাঠকের সাথে আমার একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়ই। এবং অবশেষে পাঠকের সৃজনশীলতায় নিজেরে সঁইপা দিয়া আরাম খুঁজি।

অক্টোবর ২২, ২০১১

২. রিফাত হাসান

রচয়িতা কী করে? যদ্দুর ভেবে উঠতে পেরেছি এ পর্যন্ত, লেখালেখি ও অন্যান্য যেসব অনুসঙ্গ রচয়িতার কাজ, সেসব প্রবলভাবে রাজনৈতিক এবং ইতিহাসসচেতনার বিষয়। স্রেফ কোন অনৈতিহাসিক সম্পর্ক এখানে ঘটে না। ইতিহাস সংশ্লিষ্ট থাকে। কারণ ঘটনাটি ইতিহাসেই ঘটে, বাস্তবে। যেমন, মানুষ তার ঐতিহাসিক অপর-এর সাথে যোগাযোগ এবং আলাপ ঘটানোর চেষ্টা করে লেখালেখিতে। জীবসত্তার এই যে ইতিহাসে প্রসার ও উত্তরণ ঘটে, আমি এইটারে সম্পর্ক বলি। আমি মনে করি, এই সম্পর্ক-জ্ঞান, সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের মুআমেলাত-ই হল রাজনীতি। রচয়িতা মূলত রাজনীতি করে।

তাই, 'দায়িত্ব' আরোপ করার থোড়াই কেয়ার করে রচয়িতা। তার আগেই 'দায়' সে নিজেই নিয়ে নেয়–যখন 'রচনা' করে এবং তার জনসমক্ষে 'প্রচার'-এর আস্পর্ধা ঘটায়। লেখার হরফে বা যে কোনো মাধ্যমেই হোক। এইটা কোনো আরোপের ঘটনা থেকে নয়, রাজনীতি সম্পর্কে রচয়িতার নিজের সম্বিৎ-জ্ঞান, একে ঠাহর ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ইচ্ছা এবং ক্ষমতা উদ্ভূত। রচয়িতা এ ক্ষেত্রে যেটুক দায় নিয়েছে–পাঠক বা ভোক্তা তার চুলচেরা বাছ-বিচার করবে, সেটাও পাঠকের দায়।

আন্ধারের ভিতরেই বিসমিল্লাহ করলাম।

২.
দেখা যাচ্ছে আন্ধারের ভিতর নয়, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর হাজির হয়েছেন আমার আগে। একটা কথা, লেখক লিখে ফেলার পর, তিনি আর লেখক থাকেন না। পাঠক হয়ে যান। আয়নায় মুখোমুখি বসার মতো হয়। এবং নিজেই একটু আগের লেখকটির দ্বারা প্রভাবিত হন। 'থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার' বনলতা নামের মেয়েটির দ্বারা মুগ্ধ হয়ে বসে থাকেন হাজার বছর।

অক্টোবর ২৩, ২০১১

৩. সাইফুর রহমান

দায়-দায়িত্ব নেই বলে মনে করি। দায় কেন হবে? দায় কখন হয়?

এটা ঠিক পাঠক না পড়লে কোনো টেক্সট ইটের বা কাঁঠের টুকরা বই কিছু নয় (রঁলা বার্থ) অথবা ফুকো লেখককে দেখেছেন বহু অর্থ তৈরির অন্তরায় হিসেবে (লেখক কী)। আর রিডার-রেস্পন্স থিওরি পাঠককে একটা অধিকার দিয়েছে টেক্সটের উপর।

তার মানে এই নয় লেখক তার সব হারিয়েছে। পাঠকের অধিকার শুধু বিবিধ পাঠ তৈরির ক্ষেত্রে যা লেখকের পাঠ হতে ভিন্ন হতে পারে। লেখকের নীতিগত কোনো দায় নেই পাঠকের প্রতি কারণ এমন কোনো সাধারণ আইন নেই যা লেখককে বাধ্য করবে। আর বই এই সময়ে পণ্য। তবে এই পণ্য বুদ্ধিনির্ভর। এটা ক্রেতার (পাঠকের) পছন্দ না হলে পরিবেশকের জন্য ফেরত নেয়া বাধ্যতামূলক নয় (পশ্চিমা দেশগুলোতে) যা প্রযোজ্য অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে। কারো যদি একটা বই 'পছন্দ' না হয় তার দায় লেখক কেন বহন করবে! তবে চাইলে করতে পারে যদি মনে করে পাঠক তার টিকে থাকার জন্য দরকার। এক্ষেত্রে সাধারণ নীতি নয় নির্দিষ্ট সেই লেখক তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা পূরণ করছে মাত্র।

একই কথা শ্রোতা ও দর্শকের জন্যও প্রযোজ্য।
অক্টোবর ২৩, ২০১১

৪. লুনা রুশদী

লেখক বা গীতিকারের চেয়ে চলচ্চিত্র রচয়িতার জায়গা একটু আলাদা বলে আমার মনে হয়। লেখক বা গীতিকারের কাজটা তাকে নিজস্ব একটা স্পেস দেয়। মানে এই কাজ অন্য কারো কথা না ভেবেও করা যায়। সব লেখক-গীতিকারের যে পাঠক-শ্রোতা থাকে তাও না। বা সবাই হয়তো চানও না কোনো অডিয়েন্স।

চলচ্চিত্র রচয়িতার কথা আলাদা। যখন বলা হয় চলচ্চিত্র, তখন সেই প্রসেস-এর শুরু থেকেই দর্শকের উপস্থিতি থাকে। চলচ্চিত্রের রচনা হয় কোনো নির্দিষ্ট অডিয়েন্স-এর জন্য।

তাতে করে কি 'দায়-দায়িত্ব' বিষয়টা আলাদা হয় এই দুই ক্ষেত্রে? হতে পারে।

দায়-দায়িত্ব মানে কী?

যদি এর অর্থ হয় কোনো কিছু লেখার শুরুতেই অডিয়েন্স-এর কথা ভাবতে থাকা অথবা আমি একজন রচয়িতা হিসাবে এই ব্যপারে সতর্ক থাকা যে আমার কোনো কথা আমার অডিয়েন্স-এর মনে কী রকম প্রভাব ফেললো, বা আমার অনুভূতি-চিন্তার প্রকাশে আমি কারো ক্ষতি করছি কিনা, আমার মনে হয় এইরকম দায় লেখক, গীতিকার বা চলচ্চিত্র রচয়িতার নাই। এই দায়িত্ব নেয়া মানে রচয়িতা হিসাবে নিজেকে শিক্ষক আর অডিয়েন্সকে ছাত্রের আসনে বসানো। শুরুতেই একটা হায়ারার্কির ব্যাপার চলে আসে তখন।

তবে দায়-দায়িত্ব আরো ব্যাপক অর্থেও বলা যায়। সেই ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন হলো–কেন লিখি?

এই কেনর কী উত্তর হয় তার উপরে দায়-দায়িত্ব নির্ভর করে লেখক-গীতিকারের ক্ষেত্রে।

চলচ্চিত্র রচয়িতা লেখেন তার লেখার চলচ্চিত্রায়নের জন্য। আর চলচ্চিত্র তো গণমাধ্যম। এখানে চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্যটাই রচয়িতার দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে।

যে কোনো প্রকাশিত বা প্রচারিত লেখা-গান বা চলচিত্র তো পণ্য আর পাঠক-শ্রোতা-দর্শকরা তার গ্রাহক। কাজেই শেষ পর্যন্ত ব্যপারটা ডিম্যান্ড আর সাপ্লাইয়ের। এইটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনে হচ্ছে যে দায়-দায়িত্ব শব্দটার ভেতর অডিয়েন্স-এর চাহিদা অনুযায়ী যোগান দেয়ার বিষয়টাও ঢুকে পড়ে কি?

অক্টোবর ২৩, ২০১১

[চলচ্চিত্র রচয়িতা বলতে চলচ্চিত্র নির্মাতা। চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট রচয়িতা নন। – বি. স.]

৫. ফজলুল কবিরী

আর্নস্ট ফিশার তার 'দি নেসেসিটি অব আর্ট' গ্রন্থে মানুষের বই পড়া, গান শোনা, নাটক-থিয়েটারের রস আস্বাদন কিংবা সিনেমাটিক কাহিনির পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এটি শিল্পের সার্বজনীন অস্তিত্বকে প্রমাণ করে এবং মানুষ যে তার স্বতন্ত্র অস্তিত্বের বাইরে গিয়ে আরো নতুন কিছু যোগ করতে চায় তার সাক্ষ্য বহন করে। পাঠকে তিনি দেখেছিলেন একজন স্বতন্ত্র মানুষকে অখণ্ড সমগ্র মানুষে পরিণত হওয়ার একটা প্রয়াস হিসাবে।

পাঠ কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়। এটি একটি অভ্যাসের ব্যাপার। অভ্যাসটা তৈরি করারও ব্যপার। পাঠকভেদে তাই পাঠও ভিন্ন। পাঠক যখন একটি পৃষ্ঠা পাঠ করেন তখন তিনি তাঁর নিজের জগতসহ পৃষ্ঠাটির মোকাবেলা করেন।

এত কিছুর পরও একজন পাঠক-যে গল্প, কবিতা কিংবা আখ্যানের কাল্পনিক জগতে প্রবেশ করতে উদ্বুদ্ধ হয়, তার পেছনে শুধুমাত্র অখণ্ড সমগ্র মানুষে পরিণত হবার বাসনাই দীপ্যমান থাকে তা নয়, একটা স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝাপড়া লেখার সাথে করতে হয়। পাঠকের নিষ্ক্রিয়তা লেখকের শ্রমসাধ্য কাজটিকে উন্মোচিত হবার সুযোগ বঞ্চিত করতে পারে। ক্রমবর্ধমান হারে লেখক ও বই বিক্রির পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি, পাল্লা দিয়ে 'নিষ্ক্রিয় পাঠক' বা 'ল্যাপসড্ রিডার'-এর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পেছনে পাঠকের অসচেতনতা কোনো অংশে কম দায়ি নয়।

পাঠক, শ্রোতা বা দর্শকের ব্যাপারে লেখক, গীতিকার বা চলচ্চিত্র রচয়িতার কোনো দায়-দায়িত্ব নেই এই অর্থে যে তারা শুধুমাত্র একটি পণ্যই উৎপাদন করার অভীষ্ঠ লক্ষ্য নিয়ে এই কাজে ব্রতী হয় না। কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় যে ঘটছে না তার কারণও অজানা নয়। পুঁজিবাদ যে সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করে এ ব্যাপারে ফিশারের দ্বিমত নেই। অর্থনীতির প্রাথমিক স্তরে একজন উৎপাদক বা কারিগর যেখানে তাদের ভোক্তার ফরমায়েস অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে অভ্যস্থ ছিল, সেখানে পুঁজিবাদ এই প্রত্যক্ষ যোগাযোগকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে উৎপাদিত পণ্যগুলো একটি অজানা বাজারে ঠেলে দেয়। অনির্দিষ্ট ও অপরিচিত ক্রেতার জন্য যে উৎপদন ব্যবস্থা তৈরি হয় তা শ্রমবিভাজনকে প্রসারিত করে এবং একটি কাজকে হাত, পা, মাথা ও পাছায় বিভক্ত করে উৎপাদককে ঐতিহ্যশূন্য করে ফেলে। একজন বনেদি কারিগর হয়ে ওঠেন অন্ধের বিররণে উঠে আসা হাতির মতো অভাগা 'অপর'। এই সামাজিক বাস্তবতা থেকে শিল্পও বাদ যায় না এবং শিল্পী পরিণত হয় পণ্য উৎপাদকে।

গুণবিচারি পাঠক-দর্শক-শ্রোতা সম্ভবত প্রকৃত শিল্পীর আরাধ্য ভোক্তা। শিল্পীর ধর্ম ও প্রকৃতিকে মৌলিক জ্ঞান ও বিবেচনাশক্তি দিয়ে আবিষ্কার করার যে দুর্লভ ক্ষমতা তারা ধারণ করেন, শিল্প সম্ভবত তার কল্যাণেই টিকে থাকে।

চান্দগাঁ আ/এ, চট্টগ্রাম

৬. তারেক আহমেদ

শিল্প সৃষ্টি মানেই কি কিছু দায় নয়? অনেকে বলতে পারেন, তা কেন হবে? শিল্পের মানে যেহেতু জীবনের প্রতিরূপ তৈরি–তবে সেই সৃষ্টি তো জীবনের কাছেই ফিরে যেতে চাইবে। সেই অর্থে প্রতিটা শিল্পকর্মে তার স্রষ্টা তো প্রথমতঃ নিজেকেই উপস্থাপন করেন। কাজেই প্রথম দায় তো শিল্পীর নিজের প্রতিই। তারপর সেখানে যুক্ত হন পাঠক, দর্শক বা শ্রোতা।

তবে, পারফরমিং আর্টস নির্ভর শিল্পমাধ্যম যেমন নাটক, সিনেমার নির্মাতাদের সৃষ্ট শিল্পকর্মগুলোর ক্ষেত্রে এই দায় নানাভাবে প্রতিফলিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে যখন শিল্পকর্মটি লিখিত আকারে থাকে যেমন চিত্রনাট্য বা নাটক ইত্যাদি ফর্মে–তখন লেখক বা রচয়িতার দায়টি কেবল তার সহশিল্পীদের প্রতি। সিনেমার বেলায় এ ক্ষেত্রে যুক্ত হন সিনেমাটির কলাকুশলী ও অভিনয়শিল্পীরা, যাদের সহযোগিতা ছাড়া যত মহৎ চিত্রনাট্যই হোক তা চলচ্চিত্রে রূপায়িত হতে পারবে না। সেই অর্থে এই শিল্পী ও কলাকুশলীরাই এর প্রাথমিক পাঠক, শ্রোতা ও সমালোচকও বটে। তাদের নিজ নিজ পারসেপশন থেকেই তারা প্রাথমিক এই টেক্সটিকে চূড়ান্ত একটি শিল্পে রূপায়িত হতে সহায়তা করেন। তাদেরও এক প্রকার দায়বোধ ও ইনভলবমেন্ট থাকে এই নির্মিতব্য চলচ্চিত্রটির প্রতি। তবে, শেষতঃ দায়টি কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতারই বটে। কারণ,সিনেমা চূড়ান্ত অর্থে, ডিরেকটরস মিডিয়াম। সেই অর্থে পরিচালক শুধু একজন স্রষ্টাই নন, যথাযথ ম্যানেজারের ভূমিকাটিও তাকে পালন করতে হয়। না হলে, এ জাতীয় একটি টিমওয়ার্ক ব্যর্থ হত বাধ্য। প্রামাণ্য ছবির বেলায় অবশ্য এটি ভিন্ন ভাবে ঘটে।

তবে গণমাধ্যম হিসেবে সিনেমা যখন দর্শকের কাছে যায়, তখন সিনেমাটির প্রতি দর্শকেরও একধরনের দায়বোধ থেকেই যায়। কাজেই চলচ্চিত্রস্রষ্টা তার ছবি নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানারকম দায়বোধের মাঝ দিয়েই যান। সেটি তিনি কত সফল ভাবে অন্যদের মাঝে জারিত করতে সক্ষম হন–তার উপরই তার চলচ্চিত্রটির সাফল্য নির্ভর করে। কারণ, চলচ্চিত্র তো মূলতঃ পূঁজিনির্ভর একটি শিল্পমাধ্যম।

তবে 'পাবলিক খায়'–এ জাতীয় একটা কথা আমাদের গণমাধ্যম বিশেষতঃ সিনেমা ও টেলিভিশনে অনেক কাল থেকেই চালু আছে। হাল আমলে, টেলিভিশনের 'ভীষণ' যুগে এই মাধ্যমটির পরিকল্পনা বা অনুষ্ঠান নির্মাণে যারা জড়িত আছেন, তাদের অনেকে 'পাবলিক খায়' জাতীয় কথা বলে নিজেদের রুচিকেই দর্শকের বিনোদন চাহিদা বলে চালিয়ে দেন। কারণ,দর্শক আসলেই ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এ জাতীয় বিশেষ পরিকল্পিত বিনোদন দেখতে আগ্রহী কি না তা জানার সুযোগ দর্শকদের আসলেই কিন্তু নেই।

তবে, 'পাবলিক খায়'–কী খায়! এটি হয়তো আমাদের এফডিসি কেন্দ্রিক সিনেমা জগতের মানুষেরা ঠিকই টের পাচ্ছেন এখন। কারণ,পাবলিক খাবে–এই জন্য ৩-৪টি সেমি পর্নো কাটপিস সিকোয়েন্স, সঙ্গে গোটা কতক ভয়াবহ ভায়োলেন্সের দৃশ্য তিন ঘণ্টার ছবিতে কাট অ্যান্ড পেস্ট করেও এখন পাবলিককে খাওয়াতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের এই ফর্মুলা এখন মধ্যবিত্ত তো দূরের কথা, নিম্নবর্গের পাবলিকও খায় না আর। পালিয়ে গেছে সিনেমা হল ছেড়ে। এখন এই জগতের মানুষেরা তাই নিজেদের সিনেমায় নিজেরাই পাবলিক বনে গেছেন। শেষে সিনেমা নামের প্রডাক্টগুলো নিজেরাই গিলে ফেলবেন কি না কে জানে?

অক্টোবর ২৪, ২০১১

৭. ইউসুফ খান

এটা এমন এক ধরনের দায়িত্ব যা, অনেকে প্রকাশ করে আবার অনেকে করতে চায় না। আমার তাই মনে হয়। একজন লেখক কোনো একটা গল্প লেখার সময় প্রথমেই চিন্তা করে, কী করে এটাকে গ্রহণযোগ্য করে দাঁড়া করানো যায়। তখন তার মাথায় এটাই বেশি কাজ করে। কোনো কিছু চিন্তা না করে প্রথমে সে গল্পটাকে নিজের মতো করে দাঁড়া করায়। সব শেষ হলে তখন সে চিন্তা করে, পাঠক গল্পের কোন জিনিসটা পছন্দ করবে, কোনটা করবে না। তখন সে পাঠকদের খাতিরেই কিছুটা কাট-ছাট করে থাকে। এটা হচ্ছে, মানসিক বাধ্যকতা। প্রত্যেকটা মানুষই তার নিজের সৃষ্টিকে বড় করে দেখে এবং সেখানে ছোটখাটো ভ্রান্তি থাকলে সাথে সাথে সেটা ঠিক করার চেষ্টা করে। এটাই হচ্ছে সেই বাধ্যকতা। আর এখানেই হচ্ছে লেখক, গীতিকার বা একজন চলচ্চিত্রকারের বাধ্যকতা। তবে কথা হলো, অনেকে এটা স্বীকার করে, অনেকে করে না।

অক্টোবর ২৫, ২০১১

৮. কাজী মাহবুব হাসান

যাদের জন্য শিল্পটি তৈরি করছেন একজন শিল্পী, সেটা যে মাধ্যমেই হোক না কেন, অবশ্যই তাদের প্রতি শিল্পীর ন্যূনতম হলে কিছু দায়িত্ব আছে বলেই আমি মনে করি। আর এই দায়িত্বটি আসলে শিল্পের প্রতি শিল্পীর সততার দায়িত্ব। কিন্তু এই দায়িত্বটির সীমানা নির্ধারণ করে শিল্পের সমঝদার এবং শিল্পী, দুই পক্ষই। তবে এই সীমানা নির্ধারণের ব্যাপারটায় একটা সূক্ষ্ম ভারসাম্য থাকে, যা সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে শিল্পীর স্বাধীনতার টানাপোড়েন, শিল্প সৃষ্টির প্রতি তার সততা, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বেশ কিছু পরিবর্তনশীল নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তাই দায়-দায়িত্বর ব্যাপারটা যে দ্বিপার্শ্বিক এটা বুঝতে হবে। শিল্পীর স্বাধীনতাকে যেমন বুঝতে হবে, তেমন শিল্পীকে তার ইন্টেগ্রিটিটাকেও বোঝাতে হবে তার শিল্পের মধ্য দিয়ে। যে কোনো মাধ্যমে কালজয়ী সৃষ্টি কেবল তখনই সম্ভব।

অক্টোবর ২৫, ২০১১

৯. আমিনুল করিম মাসুম

প্রথমে যে ব্যাপারটা নিয়ে খটকায় পড়লাম, এখানে আসলে কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। "খাইছি তোরে", "মারছি তোরে" ধরনের শিল্প নাকি এঞ্জেলোর সিস্টিন চ্যাপেলের ফ্রেস্কো যেখানে দর্শকের সাথে শিল্পের পরিষ্কার যোগাযোগ বড় একটা সিদ্ধান্ত, নাকি surreal "Un Chien Andalou" অথবা পোলকের পেইন্টিংগুলো?

টপিকটা শুরু করার পর কিছু ভূমিকা দরকার ছিলো বলেই আমার ধারণা।

যদি সচরাচর মানহীন বাংলা সিনেমা ধরনের টপিক নিয়ে আলোচনা হয় সেক্ষেত্রে আলোচক নিজের দায়িত্বে আলোচনা চালিয়ে যাবেন হয়ত।

শিল্পীকে যদি আমি বলেই দিই তুমি এটা করো, তাহলে তার নিজস্বতা কই যাবে? নতুন কিছুই বা কীভাবে সৃষ্টি হবে? আর শিল্পীর যদি বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা না থাকে, তিনিই বা কেমন শিল্পী হলেন আমি নিশ্চিত নই। কিছু দায়বদ্ধতা নিয়েই তো জন্মাই সবাই। তবে এটা তর্কের পর্যায়ে নিয়ে যাবার মানে দেখি না। ব্যাপারটা দুদিক থেকেই আসে। বলে কয়ে নির্দেশনা দিয়ে যেমন শিল্পমনকে ধরা যায় না, তেমনি শিল্পী নিজেও তাঁর কাজ মানুষের কাছে পৌঁছে গেলে খুশি হন।

শিল্পী করতে চাইলেন একটা ফুল, তাকে দিয়ে জোর করে করানো হল একটা পাথর, তারপর সেটা সকল পত্রিকায় ছাপানো হল। সবাই বাহবা দিলো, কিন্তু শিল্পী যে মন নিয়ে একটা ফুল আঁকতে চেয়েছিলেন সেটার সতেজ স্পর্শটা কেউ পেলো না। শিল্পী কতটুকু খুশি হবেন?

শুধু দর্শককেন্দ্রিক বা পাঠককেন্দ্রিক হলে নতুন কিছু কীভাবে আসবে? সৃজনশীলতার পথটাই অনেকটা বন্ধ হয়ে যেত তখন।

আর দর্শকের বা পাঠকের প্রতি দায়টা যদি নিজ থেকে শিল্পীর ভিতর জন্ম নেয় তবেই তো সবচেয়ে ভালো। বাইরে থেকে বলে অসাধারণ ব্যাপারটা আসবে না।

ব্যাপারগুলো এতটা আলাদা আলাদা করে দেখার কিছু আছে বলে মনে হয় না। শিল্প শিল্পী ও দর্শকের ব্যাপারে এতো রিজিড সিদ্ধান্ত দিলে শিল্প আর শিল্প থাকে না। রোবট হয়ে যায়।

অক্টোবর ২৬, ২০১১

১০. সালমান তারেক শাকিল

দায় ছাড়া লেখার কী দরকার। মানুষ তো আর মাগনা লেখকের লেখা কিংবা গান শোনে না। নিজের শিল্পবোধ চাপিয়ে দেয়া যায় না। একটা দেশের মানুষদের মনন চর্চার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সে দেশের সাহিত্য-শিল্প মাধ্যম। ফলে জনগণের কাছে দায়বোধ ছাড়া লেখা কিংবা শিল্প পরিপূর্ণ হয় না।
মানুষের প্রতি দায়বোধ না থাকলে লেখক কাকে কার জন্যে কীসের জন্যে লিখবেন। বয়সের মোটা অংশ মানুষের টাকা, মানুষের প্রতি দায়বোধের সাহিত্য পড়ে বড় হয়ে একসময় ইন্টেলেকচুয়াল সেজে মানুষ থেকে দূরে থেকে ঘরে বসে শিল্প ফলান। মানুষের জন্য শিল্প না হলে কি গরুর জন্য?
ভবিষ্যতে লিখব। আজ যাই।

অক্টোবর ২৬, ২০১১

১১. আসমা সুলতানা

আমি ছবি আঁকি ‍এবং কবিতা ও প্রবন্ধ লিখি, কিন্তু নিজেকে শিল্পী বা কবি/লেখক বলা দুঃসাহস দেখানো হবে। তবে আমি যে একজন সৎ পাঠক, দর্শক এবং শ্রোতা; সে ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী। সে ক্ষেত্রে আমি দ্বিপার্শ্বিক ভূমিকার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারি, এই আলোচনায়। আমি যেমন নিজের পছন্দ মত বই, চলচ্চিত্র বা গান বেছে নেই তেমন নিজের পছন্দ মত আমার কাজের বিষয়বস্তু খুঁজে নেই। তারপর, সেগুলোকে যখন উপস্থাপন করি, তখন দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের প্রতিক্রিয়া আমাকে আন্দোলিত করে, অনুপ্রাণিত করে বা আশাহত করে। এভাবে ধীরে ধীরে আমার ও আমার দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। আর আমার কাজ আমাদের মাঝে সেতু বন্ধনের মত হয়ে যায়…।

প্রকৃতিতে যখন বসন্ত আসে, বৃক্ষ এসে কারো দরজায় কড়া নেড়ে জানতে চায় না, কারো ফুল, পাতা, প্রজাপতির প্রয়োজন আছে কিনা! নিজের নিয়ম মতই আসে বসন্ত; সহজাত, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। ঠিক তেমন কবি কবিতা লেখে তার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে। কোনো দায়িত্ববোধ থেকে না। যখন শিল্পীর সৃষ্ট শিল্পকর্মের সঙ্গে দর্শক-শ্রোতা-পাঠক নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে ঠিক তখনি দ্বিপাক্ষিক দায়িত্ববোধ প্রকৃতিগত ভাবেই চলে আসে। সমগ্র ব্যাপারটাই এতটাই সহজাত যে আলাদা করে ভাববার অবকাশ নেই। এর কোনো নামও দেয়া যায় না। দায়-দায়িত্ব থাকা বা না থাকার কোনো প্রসঙ্গই অপ্রাসঙ্গিক।

শিল্পী বা কবি সমাজসেবক নন বা রাজনীতিবিদ যে তাদের দায়িত্ববোধ থেকে তাদের কাজ করতে হবে! শিল্পী কাজ করেন স্বপ্ন থেকে, ভালোবাসা নিয়ে! শিল্পী শুধুই একজন সংবেদনশীল মানুষ যে তার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে নিজের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করেন এবং এভাবেই পরোক্ষভাবে নিজের দায়িত্বগুলো পালন করে যান নিভৃতে।

অক্টোবর ২৭, ২০১১

১২. ফাহাম আব্দুস সালাম

লেখকের একটাই দায়িত্ব: পাঠকের মাথা চিবিয়ে খাওয়া। যে লেখক এই দায় রক্ষা করতে পারে না সে অনেক ওজনদার ভাবনার কথা বলে। কিন্তু বলে এজন্যেই যে লেখকের একটি মাত্র যে দায় সেটিই সে রক্ষা করতে পারে নি।

অক্টোবর ২৮, ২০১১

১৩. জাহিদ পাভেল

পরিচয়ে আমি পাঠক। আলোচনার সুবিধা হেতু আমার পাঠক বিবেচনায় ধরে নিচ্ছি লেখকের (এই পর্বে চলচ্চিত্র রচয়িতা বাদ) দায়-দায়িত্ব আছে।

তাহলে একদিকে পাঠক। অন্যদিকে লেখক। মাঝখানে দায়-দায়িত্ব। দায়-দায়িত্ব বলতে সহজ বুদ্ধিতে ভাবা যায়, কিছু একটা করতে বা না করতে বাধ্য থাকার অবস্থা। এখানে কিছু করতে বা না করতে বাধ্য থাকার ইঙ্গিতটা পুরোপুরি লেখকের দিকে। অর্থাৎ লেখক প্রথমে তার পাঠকের প্রতি তার দায়-এর কথা ভাববেন। তারপর তিনি লিখবেন। এই দায়টির স্বরূপ বিশ্লেষণে আবার নানান চেহারা নিতে পারে। যেমন কেউ বলতে পারেন —

এক। পাঠকের রুচি তৈরিতে লেখকের দায় আছে। অর্থাৎ লেখক তার অতি মার্জিত দিকনির্দেশক সুপাঠ্য লেখনী দিয়ে পাঠকের রুচি একটি বিশেষ আদলে গড়ে তুলবেন। এটিকে ব্যক্তিক দায় বলা যেতে পারে। (এইখানে প্রশ্ন আসবে–রুচি জিনিসটা কী? রুচির ভালো-মন্দ আছে কিনা! থাকলে তা বিচারের মাপকাঠি কী ইত্যাদি। এই বিষয়ে এই বৈঠকে আলোকপাত বাহুল্য বিধায় বর্জনীয়।)

দুই। সমাজ গঠনের জন্য অর্থাৎ সমাজের দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মাধ্যমে একে বাসযোগ্যরূপে উপস্থাপনে লেখকের দায় আছে। অর্থাৎ কোনো একটা সমস্যা, সম্ভাবনা, ক্ষয়, রোগ চিহ্নিত করে অথবা সমাধান হাজির করে লেখক তার লেখায় পাঠকের প্রতি দায় মেটাতে পারেন। এটিকে সামাজিক দায় ভাবা যেতে পারে। আরও অন্যান্য দায় নিয়ে আপাতত আলোচনা থাক।

এবার একজন লেখকের দিক থেকে ভেবে দেখা যাক। যারা লিখে থাকেন, কমবেশি সবারই একটা নিজস্ব চিন্তা, ভাব ও প্রকাশভঙ্গি থাকে, যা অন্যের থেকে সুনির্দিষ্টরূপে আলাদা। কোনো কিছু লেখার প্রথম পাঠক তার লেখক নিজেই। লেখক নিজেই প্রথম তার লেখাটির স্তুতি অথবা ব্যবচ্ছেদ করেন। এইভাবে তার লেখাটি প্রকাশ উপযোগী হয়ে ওঠে। তাই যদি হয়, তবে লেখক তার নিজের কাছে প্রথম দায়বদ্ধ, তার ইচ্ছা, রুচি, ভাবনা প্রকাশের জন্য। এর বাইরে তিনি আর কার কথা মাথায় রেখে লিখবেন? তিনি কি বইমেলায় কোনো বিশেষ বয়স/শ্রেণী বা পেশার পাঠকের দিকে তাকিয়ে ফরমায়েসি কলম চালনা করবেন? নাকি দেশে একটা বিপ্লব আসন্ন (হতে পারে কৃষি বিপ্লব), সেই বাতাসে পাল তুলে তিনি নিজেও কিছু মহৎ (!) সাহিত্য রচনা করবেন? আমি বলব, এর কোনোটিই নয়। লুই পা যেদিন লিখেছিলেন সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।/সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই॥–সেদিন তার খুব ভেতরের অনুভূতির প্রকাশ ছিল এটি। তিনি নিশ্চয়ই হাজার বছর ধরে তার এই পঙ্‌ক্তি উচ্চারিত হবে–পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণার দায় মেটাবে–এই দায় থেকে লিখেন নি। তারাশঙ্করের কথা মনে পড়ে গেল। লেখালেখির জন্য নিজের পড়াশোনার পাঠ অকালে চুকিয়ে দিয়েছিলেন। প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি লিখে গেছেন অবিরাম। আজ তার লেখার মুদ্রণের পর মুদ্রণ আসছে। অথচ সেই সময় তার লেখা কেউ ছাপতে চাইত না। তার অবিমিশ্র ভক্ত পাঠককূলের সেদিন ঠিকুজী মেলেনি। পাঠকের সাথে তার খুব যোগাযোগ ছিল এই কথাটি জোর দিয়ে বলা যাবে না। কীসের প্রণোদনায় তবে তিনি লিখে গেছেন? সে কি নিজের ভেতরের তাগিদ নাকি পাঠকের প্রতি, সমাজের উপর তাঁর দায়?

অতএব, আমি বলব, লেখকের নিজের বাইরে অন্যর (পাঠকের) প্রতি দায় নেই।

এবার সামাজিক দায়-এর কথা ভাবা যাক। লেখক, আগেই বলেছি, তার নিজের চিন্তা ভাব ভাষা সহযোগে লিখে থাকেন। সেই লেখনিতে ব্যক্তির/সমাজের একটা সমস্যা, সম্ভাবনার ছবি ফুটে উঠতে পারে। আবার নাও পারে। তাকে দায়বদ্ধ হয়ে ব্যক্তির ভাবনা, কষ্ট, সমাজের ক্ষত তুলে ধরতে হবে–এরূপ ভাবার কোনো কারণ নেই। লেখক কোনো ঠিকাদার নন। ফরমায়েসি আসবাবপত্র হয়, চাইলে ফরমায়েসি চিকিৎসাও করা যায়। তবে লেখকের থেকে ফরমায়েসি কিছু নিতে গেলে সেটি বনসাই লেখা হবার সম্ভাবনা প্রবল, যা কোনোমতেই সুস্থ লেখা হবে না। আর একজন লেখক নিশ্চয়ই চিকিৎসক, সমাজসংস্কারক, বা রাজনীতিক নন যে তার লেখায় সামাজিক দায়বদ্ধতা ''মেটাতেই'' হবে। তবে কারো লেখায় এই বিষয়গুলো উঠে আসা অস্বাভাবিক নয় মোটেও। পাঠক যেমন সমাজের রোদ-হাওয়ায় বেড়ে ওঠেন, সেই একই আবহে লেখকেরও পদচারণা। কাজেই রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের মত বুর্জোয়া দায়িত্ব কাঁধে না তুলেও একজন টমাস পেইনের 'রাইটস অফ ম্যান' আমেরিকার মানুষকে মুক্তির স্বাদ দিতে পারে। সমাজ সংস্কারক না হয়েও শরৎবাবু সমাজের দুষ্টক্ষতগুলো দেখিয়ে যেতে পারেন।

লেখকগণ সর্বদাই সমাজের অন্য সকল গোষ্ঠির থেকে ভাব প্রকাশে প্রাগ্রসর। এখন লেখক যদি তার সামসাময়িক পাঠকের দায় মেটাতে দিকরাশি ধরে হাঁটতে থাকেন, তবে এই সমাজ যে এক খানাখন্দে পড়েই রইবে, এবং সেই খন্দে একজন রুশো, টমাস পেইন, মার্ক্স বা ডারউইনের জন্ম হবে না–সে কথা বলাই বাহুল্য। এই মানুষগুলো পাঠকের কথা ভাবেননি। বরং তারা নিজের চেতনার স্বর শুনেছেন। তাকে ভাষায় রূপ দিয়ে আমাদের কৃতার্থ করেছেন। ভুলে গেলে চলবে না, তাদের সময়ে তাদের অনেক কথা মেনে নেবার মতো পাঠকের অভাব অত্যন্ত প্রবল ছিল। তারা অনেকটা বিদ্রোহের পথে হেঁটেছেন লেখনি নিয়ে। দীর্ঘ যুগ মাস বছর পর আমরা তাদের চিন্তার অনুগামী হয়েছি নিজেদের দায়ে, সময়ের দায়ে।

পরিশেষে বলি, লেখকের দায় কেবল তার নিজের কাছে। অন্যের কাছে নয়।

অক্টোবর ২৮, ২০১১

১৪. আশিক রূপম মাহমুদ

লেখককে নিয়েই বলি। সবটা গীতিকার আর চলচ্চিত্র রচয়িতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

ভাবছি, এখানে পাঠকের প্রতি একজন লেখকের সর্বজনীন দায়দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। আইনের বাইরে সর্বজনীন কোনো প্রকার দায়দায়িত্ব বলে কিছু আছে বা থাকার দরকার আছে বলে মনে হয় না। আর পাঠকের প্রতি লেখকের আইনগত দায়বদ্ধতা বলতে বুঝি লেখা পাঠকের (সরকারি পাঠকসমেত) মনঃপূত না হলে তার জন্য লেখকের জেল জরিমানা হওয়া, বিচারিকভাবে পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা, আইনিভাবে লেখাকে আংশিক বা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা, কোনো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের প্রেরণাদায়ী হিসেবে লেখাকে দায়বদ্ধ করা, ইত্যাদি। এইসব দায় কি লেখকের কলমের ঘাঁড়ে বর্তায়?

পাঠক লেখকের সম্পূরক অস্তিত্ব বলে মনে করি না। পাঠকের অবর্তমানেও লেখক বিরাজ করে। এমন কি লেখার জন্যে স্বয়ং লেখককেও পাঠক হতে হয় তেমনটা মনে হয় না। কারো জন্যে না, এমন কি নিজের পাঠের জন্যে না হলেও তো লেখা যায়। পাঠ লেখার অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। লেখা নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কর্ম। অন্তত সেটার অবারিত সুযোগ আছে। সেখানে চাইলে কেউ পাঠককে মাথায় রেখেই লিখতে পারেন। নিজের জন্যেও লিখতে পারেন। কিন্তু নিয়ম করে লেখকের কলমের স্কন্ধে পাঠকের ব্যাপারে দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়ার কথা ভাবা যায় না। অর্থাৎ পাঠকের প্রতি যেকোনো রকমভাবে সহানুভূতিশীল হতে অস্বীকার করতে পারার সুযোগ একজন লেখকের থাকা চাই। ফলত, সর্বজনীনভাবে লেখককে তার পাঠকের প্রতি কোনোভাবে দায়বদ্ধ করা চলে না। আইন তো লেখকের কলমকে সীমাবদ্ধ করবেই না, বরং আইন স্পষ্ট করে বলে দিতে পারে যে লেখকের কলমের যথেচ্ছ স্বাধীনতা রয়েছে।

এর বাইরে আর যতো অ-সর্বজনীন বা অ-আইনি দায়দায়িত্ব, সেগুলোকে নাকচ করে দেয়ার আর কিছু নেই। কিন্তু সেইসব দায়-দায়িত্ব বিরাজ করে কেবলই ভাবুকের মনে। সেইসব দায় বাস্তবায়নে কোনো জোরাজুরি নেই। সেইসব দায় নিয়ে জবাবদিহিতার বা স্বীকারেরও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যেমন অনেক লেখক পাঠকের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, অনুভূতির প্রতি নিজেকে সমর্পিত স্বীকার করে নিয়েই লিখেন। কিন্তু চাইলে যে কোনোদিন সেই দায়কে অস্বীকারও করতে পারেন। সেখানে তিনি তার চিন্তার সঙ্গতি নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন, কিন্তু দায়দায়িত্ব নিয়ে নয়।

আবার তেমনি পাঠকও ভাবতে চাইতে পারে যে লেখক তার প্রতি দায়টা পূর্ণ করে নি। এর জন্যে সেই লেখা বর্জন করার কি অন্যকে সেই লেখা বর্জন করানোর জন্যে রাজনীতি করার সুযোগ যে পাঠকের বা এমন কি অপাঠকেরও নাই তা না। বা এলাকাবাসী তাদের এলাকার বইব্যবসায়ীকে সেই বই না রাখার জন্যে দাবি দাওয়াও পেশ করতে পারে। বইব্যবসায়ী সেই অনুরোধ উপেক্ষাও করতে পারে। যদিও বইব্যবসায়ীর সাথে লেখকেরও আর্থিক লাভক্ষতির অনেক অংক পাঠকের চাহিদার সাথে জড়িত। তবে, পাঠকের ব্যাপারে কোনো প্রকারের দায়-দায়িত্ব না গ্রহণের স্বাধীনতার বিনিময়ে এই ব্যবসায়িক ঝুঁকিকে গ্রহণ করতে নিশ্চয়ই লেখকের আপত্তি নেই।

লেখার সাথে পাঠের, প্রচার প্রসারের কিংবা ব্যবসার সম্পর্ক অবধারিত নয়, কিন্তু সার্বিক-স্বাধীনতার অর্থাৎ দায়দায়িত্বহীনতার ও স্বেচ্ছাচারিতার সম্পর্ক অপরিহার্য।

অক্টোবর ২৮, ২০১১

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts