আবুল ফজলের অগ্রন্থিত আত্মজৈবনিক রচনা

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 10 April 2015, 07:02 AM
Updated : 10 April 2015, 07:02 AM

ছবি: নাসীর আলী মামুন/ফটোজিয়াম।

অতি সম্প্রতি দিল্লী সফর করতে গিয়ে দৈবের বশে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের আদিপর্বের প্রধান লেখকদের একজন কথাসাহিত্যিক আবুল ফজলের অগ্রন্থিত এই লেখাটি নজরে আসে। হাফিংটন পোস্ট (ভারত)-এর বার্তা সম্পাদক ইন্দ্রানি বসু, তার বাবা লেখক অধ্যাপক দিলীপ কুমার বসু এবং লেখিকা ও শিক্ষিকা নন্দিতা বসুর ব্যক্তিগত পাঠাগার দেখার সুযোগ করে না দিলে এই আবিষ্কার আদৌ সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ। তাদের উদার আতিথেয়তার সুযোগ নিয়ে ফাঁকে ফাঁকে চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলাম লোভনীয় পাঠাগারের ঘুমিয়ে পড়া বইগুলোর দিকে। নিতান্ত কৌতূহলবশত–পুরোনো বইয়ের প্রতি যা আমার সদাজাগ্রত–শ্রীশৌরীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং শ্রীপরেশ সাহার সম্পাদনায় কথাশিল্পী শীর্ষক ঘুমের অভিশাপে নিথর রাজকুমারীর গায়ে সোনারকাঠি ও রূপোরকাঠিসদৃশ প্রেমপ্রবণ আমার আঙুলের স্পর্শ মাত্র সে চোখ মেলে তাকালো। আমিও চোখ রাখলাম বইটির বারান্দায় (সূচীপত্রে)। দেখলাম সেখানে বসে অাছেন পশ্চিমবঙ্গের খ্যতিমান লেখকদের পাশাপাশি বাংলাদেশের লেখক আবুল ফজল, আবু ইসহাক, মহীউদ্দীন চৌধুরী, মবিন উদদিন আহমদ এবং শামসুদদীন আবুল কালাম। এই গ্রন্থের জন্য লিখিত আত্মজৈবনিক এই লেখাগুলো এখনও পর্যন্ত তাদের কোনো গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে জানা যায় না। আমরা এই পর্বে লেখক আবুল ফজলের লেখাটি প্রকাশ করছি।

শ্রীশৌরীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং শ্রীপরেশ সাহা সম্পাদিত কথাশিল্পী গ্রন্থ সম্পর্কে জ্ঞাতব্য তথ্য হচ্ছে এই যে এটি প্রকাশ করেছিল কলকাতার ভারতী লাইব্রেরী, প্রকাশক ছিলেন জে. সি. সাহা রায়। কলকাতার লোয়ার সাকুর্লার রোডস্থ শতাব্দী প্রেস প্রাইভেট লি:-এর পক্ষে শ্রীমুরারিমোহন কুমারের তত্ত্বাবধানে মুদ্রিত হয়েছিল। এর প্রথম প্রকাশকাল ছিল পৌষ ১৩৬৪, আজ থেকে প্রায় সাতান্ন বছর আগে। ১৭০ পৃষ্ঠার সুমুদ্রিত এই বইটির দাম ছিল পাঁচ টাকা।

কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল সম্পর্কে আজকের পাঠকদের জানাবার বিষয় এই যে তিনি কর্মজীবনে একসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং রাষ্ট্রপতির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি মূলত একজন চিন্তাশীল ও সমাজমনস্ক প্রবন্ধকার। তাঁর প্রবন্ধে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।

বাবা মৌলবি ফজলর রহমান এবং পিতামহ মৌলবি হায়দর আলীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আবুল ফজল আলেম হোক এমনটিই চেয়েছিলেন বাবা মৌলবি ফজলর রহমান। কিন্তু আবুল ফজলকে সাহিত্যই বেশি আকর্ষণ করেছিল। পিতার ইচ্ছায় পরবর্তীকালে শিক্ষক হওয়ার সংকল্প করেন আবুল ফজল। আর এ জন্য ১৯২৯ সালে বি.টি. পড়ার জন্য ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন। বি. টি. পাস করার পর ১৯৩১ সালে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। চট্টগ্রাম আসার পর সেখানকার কলেজিয়েট স্কুলে দ্বিতীয় মৌলবী হিসেবে কিছুদিন চাকরি করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম সরকারী মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে দুই মাস চাকরি করেন। এরপর চট্টগ্রাম কাজেম আলী বেসরকারী হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে অস্থায়ীভাবে যোগ দেন। ১৯৩৩ সালে তিনি খুলনা জেলা স্কুলে দ্বিতীয় পণ্ডিতের পদে স্থায়ীভাবে যোগ দেন। ১৯৩৭ সালে খুলনা ছেড়ে এসে তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে সহকারী ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীকালে ১৯৪১ সালে কৃষ্ণনগর কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে যোগ দেন চট্টগ্রাম কলেজে। এই কলেজের কলেজ গভর্নিং বডির নির্বাচনে তিনি দাঁড়ান এবং জয়ী হন। ১৯৫৯ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে এবং বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন:

স্বাধীনতা পদক, ২০১২
বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৬২
প্রেসিডেন্ট সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৩
আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬০
নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, ১৯৮০
মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮১
আব্দুল হাই সাহিত্য পদক, ১৯৮২
আবুল ফজল ১৯৮৩ সালের ৪ মে মৃত্যুবরণ করেন।

আবুল ফজল

"আমার জন্ম ১৯০৩ সালের পয়লা জুলাই চট্টগ্রাম জেলার কেওচিরা গ্রামে। বাবা ছিলেন আরবী শিক্ষিত মৌলবী। পিতামহও তাই। তবে মাতুল বংশে নতুন যুগের হাওয়া লেগেছিল। মামারা ছিলেন ইংরেজী-নবিস। কিন্তু তা হ'লে কি হবে। মাতুল বংশের চিন্তার ঢেউ তখনও আমাদের চৌহদ্দীতে এসে পৌঁছায়নি। কাজেই শিক্ষা সুরু হয় মাদ্রাসায়। মাদ্রাসা (নিউ স্কিম মতে) থেকেই ম্যাট্টিক পাস করি। সেটা হলো ১৯২৩ সালের কথা। এর পরে ১৯২৫ সালে আই এ ও ১৯২৮ সালে বি এ পাস করি।

'আইন' পড়বো মনে করে একদিন রওয়ানা দিলাম কলকাতার পথে। আমার সংকল্পের কথা বাবাকে জানালাম না। কলকাতায় এসে রিপন কলেজের আইন ক্লাসে (সান্ধ্য) ভর্তি হলাম। দিনে কাজ করতাম 'সওগাত' অফিসে– সন্ধ্যায় আমি আইনের ছাত্র। দিনগুলো কাটছিল মন্দ নয়। কিন্তু আমার আইন পড়ার খবর পেয়ে বাবা বসলেন বেঁকে। তিনি বললেন, লেখা-পড়া শিখে শেষ পর্যন্ত তুই কি মিথ্যেবাদী হবি?

ওকালতি মানেই তো মিথ্যা কথায় পসার জমানো। না, আমি বেঁচে থাকতে কিছুতেই তোকে ও পথে যেতে দেবো না।
বললাম: কোন পথে যাই তা হলে?
বাবার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠলো। উচ্ছসিত হয়ে তিনি বললেন, সকল পেশার সেরা পেশা শিক্ষকতা। হ্যাঁ, কিছু একটা যদি করতেই হয় তাহলে শিক্ষকতাই কর– দশজনের কাছে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াতে পারবো।

বাবার কথায় যুক্তি তুলিনি। তর্ক করিনি। রিপন কলেজ থেকে নাম কাটালাম। পাট উঠালাম কলকাতার। ঢাকায় এসে ভর্তি হলাম 'ঢাকা ট্রেনিং কলেজে'। বি-টি পাস করলাম।
আমার শিক্ষক জীবনের শুরু ১৯৩৯ সাল থেকে। সরকারী স্কুল মাদ্রাসায় কাজ করেছি। ঘুরতে হয়েছে আমায় অনেক জেলায়। জেলায় জেলায় ছাত্র পড়াতে পড়াতে নিজেই আর একবার ছাত্র হয়ে পড়লাম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পরীক্ষা দিলাম। পাসও করলাম। দ্বিতীয় শ্রেণীতে । ১৯৪০ সালে।

এবারে উপরের দিকে টান পড়লো। স্কুল ছেড়ে কলেজে। ১৯৪১ সালে কৃঞ্চনগর কলেজে বাঙলার লেকচারারের পদ পাই। ১৯৪৩ সালে চলে আসি চট্টগ্রাম কলেজে। সেই থেকে এখানেই আছি। ১৯৫৪ সাল থেকে চট্টগ্রাম কলেজের বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের প্রধান অধ্যাপকের কাজ করছি। বাবা বলেছিলেন শিক্ষক হতে, বাবার অভিলাষকে আমি ব্যর্থ হতে দিইনি।

যতদূর মনে পড়ে আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'চৌচির' (১৯৪০)। এই গ্রন্থখানি পড়ে রবীন্দ্রনাথ রোগশয্যা থেকেও আমায় চিঠি দিয়ে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন: 'আপনার চৌচির গল্পটি আমার দৃষ্টিকে ক্লিষ্ট করেও পড়েছি। আমার পক্ষে এ গল্প ঔৎসুক্যজনক। আধুনিক মুসলমান সমাজের সমস্যা ঐ সমাজের অন্তরের দিক থেকে জানতে হলে সাহিত্যের পথ দিয়েই জানতে হবে–এই প্রয়োজন আমি বিশেষ করেই অনুভব করি। আপনাদের মতো লেখকদের হাত থেকে এই অভাব যথেষ্টভাবে পূর্ণ হ'তে থাকবে এই আশা করে রইলুম।'

জানি না রবীন্দ্রনাথ আমার উপর যে বিশ্বাস রেখেছেন আমি তা রক্ষা করতে পেরেছি কিনা। আর এখনও যদি তা না পেরে থাকি তা হ'লে ভবিষ্যতে তা পারবো কিনা। কারণ আমার শক্তির দারিদ্র্য সম্পর্কে আমি নিজেই বেশ সচেতন। সব ব্যাপারেই আমি মাঝারি। পরীক্ষায়, লেখায় এমন কি চাকুরীতেও। আমাদের সমাজের ও দেশের শ্রীহীন চেহারাটা একদিন আমার যৌবনকে কাঁদিয়ে দিয়েছিল। তাই হয়তো সেদিন কলম নিয়ে বসে পড়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল, খোঁচায় খোঁচায় সমাজ-মনকে জাগ্রত করে তুলবো, জীবনবোধকে উদ্বুদ্ধ করে তুলবো। সে-ক্ষেত্রে আমি কতটুকু পেরেছি আর কতটুকু পারিনি আজ আর তার হিসেব দিতে বসবো না। তবে এই দিক থেকেই সাহিত্যের অঙ্গনে আজ অনেক নতুন পথিকের পদসঞ্চারণ লক্ষ্য করছি–সেখানেই আমার সান্ত্বনা। পঞ্চাশ তো পার হয়ে গেছি– আজ আমি উত্তরকাল, আমার লেখার মাধ্যমে যদি এ কালকে কোন কথা বলতে পেরে থাকি তা হলেই আমার তৃপ্তি।

মানুষের অগ্রগতি ও সামাজিক পরিবর্তনে আমি বিশ্বাস করি। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামো এই অগ্রগতি ও পরিবর্তনের এক বিশেষ অন্তরায়। ধর্মের গোঁড়ামি আজ অনেকাংশে শিখিল হয়ে পড়েছে, কিন্তু মধ্যযুগীয় অর্থনৈতিক বিধি-ব্যববস্থার তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করছিনে। কিন্তু নিশ্চিত পথে ওর কোন রূপান্তর না হলে সামাজিক অগ্রগতি অসম্ভব। আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের দায়িত্ব আছে। উপন্যাস জীবন-শিল্প। সমাজের–জীবনের এই মূল সমস্যাটিকে আজ তুলে ধরাই ঔপন্যাসিকের কাজ। ঔপন্যাসিক যদি এ দায়িত্ব পালন করতে পারেন তাহলে বাঙলা উপন্যাসের ভবিস্যৎ সম্বন্ধে শঙ্কা প্রকাশ করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।"
প্রকাশিত গ্রন্থ: চৌচির, জীবন পথের যাত্রী, সাহসিকা, প্রদীপ ও পতঙ্গ রাঙ্গাপ্রভাত, মাটির পৃথিবী, আয়েষা, প্রগতি, আলোকলতা প্রভৃতি।

(লেখকের বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।)