হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কবি হেলাল হাফিজকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন কবিবন্ধু শামীম আজাদ
Published : 07 Oct 2022, 12:38 AM
যখন তাহার একুশ বয়স ছিল আমি তখন অষ্টাদশী ছিলাম। কিন্তু তখন আমাদের হয়নি তো পরিচয়!
আমি বলছি আমার বন্ধু ও তুমুল জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজের কথা। তাকে প্রথম দেখেছি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হবার পর। না হেলালকে কোন শ্রেণীকক্ষ থেকে বেরুবার সময় কিংবা কোন শিক্ষকের কক্ষ থেকে টিউটোরিয়াল ক্লাশে যাবার পথে করিডোরে কিংবা বিভাগীয় কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়ায়ও দেখিনি। নিয়মিত ক্লাশ করলে তো দেখব নাকি!
দেখেছি আমাদের কলা ভবনের 'ময়না পাড়ার মাঠে'। মানে লাইব্রেরি চত্তরে। কবি নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান সহ আরো ক'জনের সংগে।শরীফের মিয়ার ক্যান্টিন থেকে একদম চোখে না পড়ার মত রোগা পাতলা, টেরি কাটা, তেল দেয়া চুলের হেলাল হাফিজ! কাঁধে ঝোলা। বুঝতে পারি, তার ভেতরে বই। দেখেছি হেঁটে এগিয়ে গেলো যেখানে বাকিরা বসা। তারপর সবাই কি নিয়ে যেন হো হো করে উঠলো।
আমার রুমমেট শ্রাবণী ও আমি রোকেয়া হল থেকে বেরিযে ত্রস্তপায়ে শাড়ি সামলে রাস্তা পেরিয়ে কলাভবনে যাচ্ছিলাম। ডান দিকের মাঠে নভেরার ভাস্কর্য ফেলে পা রাখতেই ফিসফিস করে শ্রাবণী বলে, ‘এই রে আবার সেই সব কবি!’ লক্ষ্য করেন ‘সেই সব’ শব্দটি। কারণ এরা এদের অনেকেই তখনো তরুণ কিংবা উঠতি কবি। আর আমি? আমি তখন শুধুই গল্প লিখি। কিন্তু কবি হবার ইচ্ছা অদম্য। সেদিন কারো সঙ্গেই চেনা জানা ছিল না তাই আমরা তাদের ‘লাফাঙ্গা’দের দলেই ফেলে ছিলাম।
অথচ পরে এরাই বয়স নির্বিশেষে আমার প্রাণের বান্ধব হয়ে যায়। তখন নির্মলেন্দু গুনকে কেবল নির্মলদা ডাকতাম। বয়সে বড় হলেও আবুল হাসান আর হেলাল হাফিজকে প্রথম নাম ধরেই সম্বোধন করেছি। কিন্তু আমরা আপনি বলেই করতাম। সে শরতে প্রথম চোখাচোখি হলে আমাদের মনে হলো ঐ হাসির বিষয় বুঝি আমরাই! আমরা আড়চোখে তাকিয়ে দ্রুত ওদের পেরিয়ে গেলাম, কিন্তু পিঠে গাঁথা রইলো ওদের চোখ! বিশেষ করে হেলালের ডাগর দুটো চোখ।
সে ছিলো ১৯৬৯ সাল। আমি নিয়মিত ছোটগল্প লিখছি। বন্ধু বাবলী হক লিখছে কবিতা ও গদ্য। প্রভোস্ট আখতার ইমাম আপার ভয়ে সাতটার আগে হলে ফিরি। লাইব্রেরির বারান্দা থেকে পিঠে গেঁথে থাকে ‘সেই সব’ তরুণ কবিদের চোখ।
পরিচয়টা হল সাহসী নির্মলেন্দু গুণের কারণেই। হ্যাঁ, তখন অপরিচিত মেয়েদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে সাহস লাগতো বৈকি। এক সংগে আড্ডায় বসতে শুরু করলে তিনিই পত্রিকা সম্পাদকদের চেনেন বলে আমার প্রথম কবিতা তাকে দিই। অবশ্যই! বলে সেই যে তিনি আমার কবিতাটি ভরে ছিলেন আজও তা আলোর মুখ দেখেনি! এ নিয়ে এখনো আমরা হাসাহাসি করলেও তাঁর মনেই নেই!
হলে ফিরে সহপাঠী লিলির সঙ্গে হেলালের ভাসা ভাসা চোখজোড়া, মাথায় মাঝখানে সিঁথি করা তেল দেয়া বাবরি চুল আর মধু কবির মত দাড়ি এসবই আলোচনা হল। মনে হল এরা থাকে কোথায়? হ’লে, মেসে না বাড়িতে? ওরা কি শরীফ আর মধু দা’র ক্যান্টিনেই খেয়ে বাঁচে নাকি কিছু রান্না করে হাঁড়িতে।
আমাদের বন্ধুত্ব ও আড্ডাগুলো যখন জম্পেশ হয়ে উঠছে তখনই হালুম করে আমাদের উপর লাফিয়ে পড়লো যুদ্ধ। তারপর সে ভয়াবহ যুদ্ধ আমাদের সবাইকে কঠোর বাস্তবের খোঁচা খোঁচা বাগানের উপর ছুঁড়ে দিল। তখন আমিও কবিতা লিখতে শুরু করেছি। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিকতাও। আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয় তখন। হেলাল তখন তরুণ জনপ্রিয় কবি। আমার অফিস বিচিত্রায় দৈনিক বাংলা ভবনে। একতলা উপরেই দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক চির তরুণ অবয়বের প্রিয় কবি আহসান হাবীবের কক্ষ। ভিরু পায়ে সেখানে কবিতা দিতে গেলে কিংবা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমার টেবিলেই অথবা বাংলা একাডেমির বইমেলায় জমেছে সে সব আড্ডা। হেলালের কবিতার চরণ এসে গেছে মানুষের মুখে মুখে কিন্তু একখানা বই বেরিয়েছে! ভাবা যায়! আমি অবাক হয়ে যাই তার কবিতার মাজেজা ভেবে। কখনো গল্প করতে করতেই বলে ফেলতো এক লাইন। কিছু কিছু পুরুষ আছেন না নারী বান্ধব? হেলালের টাইপটা সে রকম। এই টাইপটা পুরুষের এক বিশেষ গুণ বিধায় আমি একটু খুলেই বলি। এদের সঙ্গে বসে এক ঘন্টা গল্প করলেও আপনি যে নারী এবং তাদের থেকে আলাদা সেটার চল্টা উঠে আসবে না। আপনি যে কেবল স্তন, নিতম্ব-সর্বস্ব নন সেটাও বুঝতে পারবেন। জানবেন ওরা ঠিকই চটপটির প্লেটে আপনার জন্য টক বেশি চাইবে। হাঁটার সময় পাশাপাশি থাকার জন্য ঘোষনা বা অনুযোগ ছাড়াই নিজেদের হাঁটার গতি কমিয়ে দেবে। এ হল সেই টাইপ। হেলালকে আমি কখনো জোরে ছুটে যেতে দেখিনি। অব্যাহত অট্টহাস্য করতেও শুনিনি। এমন কি টেবিল চাপড়াতেও। সে কথা বলে নরম নরম। তাই শুনে অন্যরা করে টেবিল গরম। হেলাল বিচিত্রায় এলে তার কথা শুনে দীর্ঘদেহী কবি মাহমুদ শফিক টেবিলে কিল মেরে লাল লেবু চা ছলকে ফেলে দিতো যে দিতোই! ২০১২ তে প্রায় ছাব্বিশ বছর পর দ্বিতীয় কবিতা গ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’ বেরোয়। ততদিনে আমার বিলেতে থাকার প্রায় এক দশক হয়েছে। প্রতি বছর দেশে গেলে দেখা হয়, কোনোবার হয় না। কিন্তু লন্ডন থেকে টেলিফোনে কথা হয়, হয় হাসাহাসিও। বেশি সময়ই টেক্সট করা হয়। যার প্রথম লাইন সব সময় একই রকম- শামীম কেমন আছো গো? ভাল বুঝলে ফোনেই আমার শেষ কবিতাটি পড়তে চাইতো। ইতিবাচক মন্তব্য দেখলে আমি কুলু কুলু এনে ফোনে বলতাম,--দোস্ত আমি কবি হয়ে গেছি! - তুমি তো কবিই গো! মনে পড়ছে, সেবার বাংলা একাডেমি মেলায় হেলালের প্রথম কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ এসে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বইটি বের করেছেন অনিন্দ্য প্রকাশনীর নাজমুল হক।
আলেকজান্ডার প্রেস থেকে লাইনো প্রিন্টে ছাপা হয়েছে। সেই আশির দশকে ঢাকা শহরে দু’জায়গায় লাইনো মেশিন ছিল। এক আমাদের দৈনিক বাংলা ও বিচিত্রায়। দুই আলেকজেন্ডার প্রেস। বইটি মেলায় হাতে হাতে ঘুরছে। তাকে নিয়ে চলছে আলোচনা ও কথাবার্তা। সেবার আমার ও তসলিমার বোধ করি প্রথম এবং দ্বিতীয় বই এসেছে। কিন্তু কোন আওয়াজ তুলছে না। আমরা দু’জন নিজেদের ক’টি চেনা স্টলে ক’খানা করে বই দিয়ে আসি এবং মাঝে মাঝে তার খোঁজ নিই আর নিয়মিত আড্ডা দিই হেলালের সঙ্গে। হেলালকে দেখলেই হাসতে হাসতে বলি, কষ্ট নেবে কষ্ট। সিঙ্গারা গরম কষ্ট। চরম গরম কষ্ট! আমাদের বাঁধা টেবিলে কখনো আসেন রফিক আজাদ, সায়ীদ আতিকুল্লাহ, হাবিবুল্লাহ সিরাজী, তারিক সুজাত, মাকিদ হায়দার সহ অগ্রজ অনুজসম কবি ও সাহিত্যিকগণ। হেলালের বইই বিষয়। তার বই কিনে যুবক যুবতীরা সেখান থেকেই নিয়ে গেল অটোগ্রাফ। হেলাল আমাদের দিকে প্রীত ও হাস্য মুখে তাকিয়ে অটোগ্রাফ দেয়, ‘নিউট্রোন বোমা বোঝ মানুষ বোঝো না!’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর সামরিক পটপরিবর্তনের প্রতিবাদী সময়ে যে তরুণ কবিগণ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন আমার বন্ধু হেলাল হাফিজ তার অন্যতম। আপাত আবছা স্বরে কথা বললেও তার কবিতায় কঠোর গালি দেখে বিস্মিত হয়েছি। সে নিজেও সরকার, সরকার প্রধান এদের গালি দিয়ে তোপের মুখে পড়ে যখন পালিয়েছে সে সময়েই এদিকে তার ভক্তরা প্রেমে, অবসাদে, আনন্দে, বিদ্রোহে হেলা্ল হাফিজের কবিতা ফেরী করে ফিরছে। বিশ্ব মানবতা ধ্বংসের মুখোমুখি বলে তার কবিতা গর্জে উঠেছে। হেলালের কবিতায় তাঁর আত্মাটা কেমন করে কাঁপে তা বোঝা যায় তার বন্ধুত্বেও।
আমার ফোন না ধরায় কবি ইরাজ আহমদের কাছ থেকে জেনেছি সে এখন ভাল নেই। পিজিতে একটি কক্ষে আছেন। পরিবারবিহীন আমার বন্ধুকে এখন কে দেখে, তার কি ঠিকমত দেখভাল হয়, তার শরীর আরো খারাপ হলে কী হবে? একজন রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্ত, অসম্ভব জনপ্রিয় কবির গোধূলি লগ্নটিতে আমরা তাকে কতটা স্বস্তিতে রেখেছি আমি তা জানি না। জানতে গেলেও প্রাণটা কাঁপে। অপেক্ষায় আছি কবে হেলাল সুস্থ হয়ে আমার ফোনটা ধরবে। কবে সে বলবে,
কেমন আছো গো শামীম?
‘ভালো থেকো বন্ধু। সেরে ওঠো। শুভ জন্মদিন’।