অধুনা যে দু'একজন মুসলিম সাহিত্যিককে দিগন্তে 'উদিত' হতে দেখা যাচ্ছে তাঁদেরকে বিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী আবদুর রাকিবের পদাঙ্ক অনুসরণকারী বলা যায় না।
Published : 27 Nov 2023, 01:45 PM
কেউ যখন কিছু লেখেন তখন তার একটা 'দায়' থাকে । দায়টা কার প্রতি, কিসের প্রতি? নিজের প্রতি নিজের । নিজের 'বিবেক'-এর প্রতি দায় । সমাজের প্রতি দায়, মানুষের প্রতি দায় এসব তো আছেই। কিন্তু, নিজের বিবেকের প্রতি দায়-এর অনুভূতি ছাড়া এই দায়গুলির ঠিক স্বরূপে স্ফুরণ হয় না। কারণ, দেখা যায়, বিবেকের প্রতি দায়শূন্যতা থেকে যে লেখা তা সমাজকে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে চিন্তার বহুস্তরকে ছুঁতে পারে না। তা হয়ে পড়ে একমুখী। মানুষের প্রতি দায়ের ক্ষেত্রেও একই কথা। নিজের প্রতি সৎ থাকার যে কথা বলা হয় তা আসলে নিজের বিবেকের প্রতি সৎ থাকা। বিবেক মানেই ব্যাপ্ত নৈতিকতা, ঔচিত্যবোধের আলো। যদি বিবেকের আলো ভাবনার কেন্দ্র ছুঁয়ে যায় তাহলে চিন্তার জগৎটা একপেশে হয় না। যা লিখছি তা সমাজের প্রতি দায় থেকে--এই ভাবনা ভুল নয়, কিন্তু এই দায়ে যদি বিবেকের প্রণোদনা না থাকে তাহলে সামাজিক ভাবনায় যতটা বাস্তবতার ধ্বনি থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে সমাজ সম্পর্কে নিজস্ব কল্পনার নির্মাণপ্রয়াস। এটা যথার্থ দায়বোধ-এর উৎসার নয়। খণ্ডিত, একপেশে, কৃত্রিম।
একজন লেখককে 'সাধক' হতে হয়। তিরিশের দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কিছুতেই 'তৃপ্ত' হতে পারতেন না। অজস্রবার তাঁর লেখায় সংশোধন করতেন। কাটাকুটি বা সংশোধনে রবীন্দ্রনাথ ও দস্তয়ভেস্কি তো রীতিমতো শিল্পী। সুধীন্দ্রনাথ লিখতেনও খুবই কম। আবদুর রাকিব একবার শুনিয়েছিলেন এক আশ্চর্য ঘটনা। একটি 'মনের মতো শব্দ' কোনও একটি লেখায় ব্যবহার করতে গিয়ে তিনি দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করেছিলেন। একেই বলে 'সাধনা'। আর, এখন কী দেখছি? একটি লেখা লিখে ফেলার পর তার দিকে আর ঘুরেও তাকানোর প্রয়োজন অনুভূত হয় না! তার ফলে কত অজস্র ভুলভ্রান্তি যে থেকে যায়! প্রতি নিয়ত এই 'দুর্ঘটনা' দেখতে হয়! নিজের ভাষার প্রতি একজন 'লেখকের' এত অমনোযোগ, এত অযত্ন, এত অবহেলা অভাবনীয়!
অপ্রিয় সত্য হ'ল, সকলেই লেখক কিন্তু সকলেই সাহিত্যিক নন। লিখলেই লেখক হওয়া যায়, কিন্তু 'সাহিত্যিক' পদবাচ্য হতে গেলে 'আরও কিছু মহিমা'র প্রয়োজন হয়, যা অনেকেরই নেই। অথচ বাজারে জনপ্রিয় অনেক লেখককেই আমরা 'সাহিত্যিক' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি। কবিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কে না জানে জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত উক্তি, 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।' কালে কালে বহু কূট প্রশ্ন জড়ো হয়েছে এই মর্মে যে, আদতে 'সাহিত্যিক' আমরা কাকে বলব? তিনি কি আদর্শবাদী হবেন, সংস্কারক হবেন, দ্রোহবাদী হবেন ইত্যাদি নানা প্রশ্ন ওঠে। দেখা যায়, সাহিত্যিকদের মধ্যেও এ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে । কিন্তু, যে কেন্দ্রীয় বিষয়টি নিয়ে সম্ভবত কোনও মতভেদ নেই সেটি হ'ল, সাহিত্যিক হচ্ছেন জীবনবাদী এক শিল্পী। জীবনের ধূসরতা, জীর্ণতা, পাঁক তিনি শব্দে শব্দে গাঁথলেও তার গহন অভিপ্রায়টি প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে সুন্দরতম জীবনের গভীর অন্বেষায়! 'আরও কিছু মহিমা'র গূঢ়ার্থটি হাতে নগদ প্রাপ্ত জীবন থেকে আকাঙ্ক্ষিত মহাজীবনের অন্বেষায় নিহিত! 'মহাজীবন' মানে কিন্তু মহাপুরুষের অলীক মহিমাঘন জীবন নয়! বরং যা ক্ষুদ্র, যা তুচ্ছ, তার ভেতরে কোন আলোর প্রবাহ আছে, সেই অন্বেষায় সমস্ত ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতাকে অতিক্রম করার 'গল্প' বলেন একজন সাহিত্যিক; যে গল্প আটপৌরে, সাধারণ মানুষের জীবনকেও মহাজীবনের মহিমা দিতে পারে! আবদুর রাকিবের গল্পে এই 'মহিমা' শিল্পোত্তীর্ণ হয়েছে!
সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত একবার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, খবরের কাগজের 'খবর' থেকে তিনি তাঁর অনেক ছোটগল্পের 'প্লট' তৈরি করেছিলেন। কথাটি ভাবার আছে। বহু বিখ্যাত সাহিত্যিক মানুষ ও মানুষের জীবনকে কাছ থেকে দেখে সাহিত্য-সাধনা করেছেন। তাই তাঁদের সাহিত্যে মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতা জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। সেইসব সাহিত্যকর্ম কালের কষ্টিপাথরে 'চিরায়ত সাহিত্য' হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বাঙালি সাহিত্যিকের কথা বাদ দিয়ে যদি দেখা যায় তাহলে তেমন দুই সাহিত্যিক হলেন--প্রেমচন্দ ও কৃষণ চন্দর। তুমুল বাস্তবতাই তাঁদের সাহিত্যের প্রাণভোমরা, যার আবেদন আজও অম্লান। দিব্যেন্দু পালিতের কথাটি সেই বাস্তবধর্মী সাহিত্যের দিকেই ইঙ্গিত করে। আজ হয়তো অনেক উপন্যাস-ছোটগল্প প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু পাঠকনন্দিত হচ্ছে না কেন? শুধুই কি বইপড়ার অভ্যাসে ছন্দপতন? নাকি, আরও 'অনেক কারণ' আছে? ভাবতে হবে। লেখার জন্য পড়তে হয়, এই কথাটি নতুন নয়। যাঁরা আধুনিক বাংলা ছোটগল্প লিখতে চান, তাঁদের অতীতের বিখ্যাত লেখকদের ছোটগল্প তো পড়তে হবেই, তার সঙ্গে এই সময়ের কয়েকজন লেখকের ছোটগল্পও পড়তে হবে--মণিরত্ন মুখোপাধ্যায়, শুভমানস ঘোষ, বীরেন শাসমল, মুর্শিদ এ এম, আবদুর রাকিব প্রমুখ। এঁদের ছোটগল্প শৈলী এবং বিষয়বস্তুর বৈচিত্র ও অভিনবত্বের নিরিখে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অধুনা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলেও সেগুলিকে ঠিক 'ছোটগল্প' আখ্যা দেওয়াই মুশকিল!
কথাশিল্পী আবদুর রাকিব-এর একটি চমৎকার ছোটগল্প--'খবরের পরমায়ু'। কীভাবে একটি 'খবর' নানা অভিঘাত তৈরি করে, তীব্র আলোড়ন ওঠে, সমাজমানসকে করে তোলে ভীষণ চঞ্চল, আবার সব উত্তাল ঢেউ একসময় তটরেখায় মিলিয়ে যায়, অপেক্ষা শুরু হয় আরেকটি নতুন 'খবর'-এর, তারই নিপুণ এক ছবি এঁকেছিলেন তিনি সেই ছোটগল্পটিতে। আবার, যে 'খবরটি' সামনে এল যে 'ব্যঞ্জনাটি' নিয়ে, তার যে ভিন্নতর কোনও 'ব্যঞ্জনা' অথবা 'অভিঘাত'ও থাকতে পারে, সেটা নিয়ে সচরাচর পাঠকের মস্তিষ্ক থাকে চিন্তাশূন্য--তার যত মাথাব্যথা দৃশ্যপটে অঙ্কিত ও সৃষ্ট ছবিটির 'অভিঘাত' নিয়ে! এই দিকটিও জীবন্ত হয়েছিল তাঁর অনবদ্য কলমের আঁচড়ে। জমে থাকা পুরনো কাগজ যখন বিক্রি হয়, বস্তায় ভরে নিয়ে চলে যায় আগত লোকটি, তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি কম্পিত করে! মনে হয়, প্রচুর কাগজ তো নয়, আসলে চোখের সামনে কত হাজার হাজার 'খবর' যেন 'বিক্রি' হয়ে গেল! একসময় খবরগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কত তাপ-উত্তাপ, আবেগের ঘরে রীতিমতো বসত করত 'যারা', পরে সেসব নেহাত 'অদরকারী' বলেই 'বিক্রিযোগ্য' হয়ে যায়! অভাবনীয়! মনে পড়ে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের অসামান্য একটি কবিতা--'কাগজ বিক্রি'। যে 'খবর' একসময় উদ্বেল করে, বিচলিত করে, বিষণ্ন করে, ক্ষুব্ধ করে, ভাবিত করে, তার 'আয়ুষ্কাল' আসলেই পরের 'খবরটি' আসা পর্যন্ত। আবদুর রাকিবের ছোটগল্প কিংবা প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা আমাদের এই মর্মে ভাবিত করে যে, 'খবরের' সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমাদের সমূহ তাৎক্ষণিক অনুভূতিগুলিকে কি আমরা আদৌ 'মহার্ঘ' বলে দাবি করতে পারি?
মানুষের একটি অভ্যাস হ'ল, নিজেকে 'সঠিক' প্রমাণ করার জন্য 'পরিবর্তিত সময়'-এর অজুহাত দেওয়া। লেখকরাও তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু, কিছু শাশ্বত সত্য আছে যাকে 'সময়ের খাঁচায়' বন্দি করা যায় না, কিংবা সময়ের নিক্তিতে মাপাও যায় না। দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক জে এম কুটসিয়া একবার একটি অনুষ্ঠানে বক্তা হয়ে কেবল বলেছিলেন, 'আমি লিখি। বলতে অভ্যস্ত নই।' বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ, আবদুর রাকিব কিংবা কুটসিয়ার মতো লেখকরা নিজেকে 'প্রচারের আলোয়' থাকার বহু মাধ্যম থেকে বঞ্চিত ছিলেন বলেই কি শুধু 'অমন' ছিলেন? একদমই নয়। এই যুক্তিবিন্যাস আসলে নিজেকে 'সঠিক' প্রমাণ করার অক্ষম চেষ্টা। 'একান্ত নিভৃতি' নামক বৃত্তে লেখক 'আত্মমগ্ন' থাকবেন। লেখকের দুটি প্রিয় শব্দ হবে--নিভৃতি ও নৈঃশব্দ্য। একান্ত বিজনে নৈঃশব্দ্যনিবিড় 'আত্মমগ্নতা'ই তার 'সৃষ্টির আনন্দে' মেতে ওঠার প্রেরণা। কিন্তু, দিনে দিনে 'নিভৃতি ও নৈঃশব্দ্য' শব্দগুলি বোধহয় লুপ্ত হয়ে যাবে! প্রকৃতপক্ষে একজন কি লেখেন পাঠকের জন্য? না। তিনি তো লেখেন আসলে নিজের জন্যে। পাঠক 'সৌভাগ্যক্রমে' পড়ে মাত্র। লেখক ভিড়ে মিশতে চান না, বরং ভিড় থেকে পালাতে পছন্দ করেন। কিন্তু, এখন চলছে সবই উল্টো পুরাণ। লেখক 'মঞ্চ' পছন্দ করছেন। যেকোনও মঞ্চ। বিজ্ঞাপন ভালবাসছেন। তা-ও নিজেরই প্রদত্ত বিজ্ঞাপন। প্রবল ও সোচ্চার সেই বিজ্ঞাপন। ভিড়ে, শব্দের জঙ্গলে, আলোর বন্যায় তিনি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন। অথচ, সেই পাওয়া আসলে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। গভীর নির্জনতা লেখকের যেন আর প্রিয় অনুষঙ্গ নয়। আরও অনেক কিছুই। জীবনানন্দ, শঙ্খ ঘোষ, বিভূতিভূষণ, আশাপূর্ণা দেবী, আবদুর রাকিব প্রমুখ বিরল আজকের লেখকদের চর্যায়!
''আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনও কালে সঞ্চয় করিনি !" লিখেছিলেন 'লোকায়ত বাংলা'র কবি আল মাহমুদ। 'যা আমার সবার হেলাফেলা যাচ্ছে ছড়াছড়ি...'। রবীন্দ্রনাথের এই গীতিদ্যোতনায় 'কবি' শব্দটিকে যদি দেখতে হয় তাহলে তা রীতিমতো ভাবিত করার মতো। বস্তুত, 'কবি' পরিচয়টি অযথা বহু ব্যবহারে জীর্ণ ও দীর্ণ হওয়া 'বড় বেদনার মতো' বাজে! 'কবি' বলতে যদি আপন হৃদয়ে কাব্যমঞ্জুষায় পূর্ণ পুরাকালের ধ্যানস্থ ঋষিকল্পটি প্রতিভাত হয়ে না-ও ওঠে, অন্তত প্রবল গৃহী রবীন্দ্রনাথের যাপনশৈলীটি মানসমুকুরে উদ্ভাসিত হতে কোনও অসুবিধা থাকার কথা নয়। কিংবা, ধরা যাক নজরুলের কথা ; যিনি 'রূপ' ও 'রুপার' মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করে কবিকে বলেছিলেন 'রূপের উপাসক'। আল মাহমুদও কিন্তু পরোক্ষে সেই কথাটিই বললেন। যদিও সোনালী কাবিন-এর দয়িতার উদ্দেশে কবির বলা কথা, কিন্তু কবির হৃদয়ের গভীর উচ্চারণকে তো 'সঙ্কুচিত' করা যায় না। প্রশ্ন উঠবে, কবি কি আলো ও বাতাস খেয়ে বেঁচে থাকবেন? কবি 'আলো' ও 'বাতাস'-এর 'স্তব' লিখলেও সেসব যে 'দেহের খাদ্য' নয় তা তো সকলেই জানে। কিন্তু, পাশাপাশি এ-ও সত্য যে, 'আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ' সঞ্চয়ের পথে ধাবিত হয়ে কবি 'আলো ও বাতাসের স্তব'কে কলুষিত করবেন না। দয়িতাকে কুসুমিত, মহার্ঘ 'প্রেম' দিতে চান ঠিকই, কিন্তু 'আত্মবিক্রীত' না হয়ে--কবির এই ঘোষণাটির মধ্যে রয়েছে আসলে পৃথিবীর সব 'যথার্থ কবি'র অন্তরাত্মার ছবি। প্রথম জীবনে কবিতা লিখলেও পরে গদ্যকেই প্রধান অবলম্বন করেন আবদুর রাকিব। এবং, তিনিও লেখক হিসেবে ছিলেন আল মাহমুদের কথিত পংক্তির অটল অনুসারী। তথাকথিত বৃহৎ মিডিয়া তাঁর প্রতি চিরকাল 'অবজ্ঞা' দেখিয়েছে। কিন্তু, সেজন্য তিনি 'আত্মবিসর্জন' দেননি এবং নিজের স্বতন্ত্র সাহিত্য-সাধনার পথ থেকে সরেও আসেননি। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অমিয়ভূষণ মজুমদারের পদাঙ্ক অনুসরণকারী।
রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ উত্তর-যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শঙ্খ ঘোষ। একজন কবি যে নিছক 'নিজের ভিতরেই' বাস করেন না, তারও যে রীতিমতো একটি 'সামাজিক সত্তা' আছে, সমাজের সঙ্গে যার নিবিড় যোগসূত্রতা রচনা করা জরুরি, শঙ্খ ঘোষ তাঁর যাপিত জীবনে তা প্রমাণ করেছেন। তিনি যে বাংলার শেষ 'বিবেকী কণ্ঠ', অভিভাবকের মমত্বে যার ধ্রুপদী নির্মাণ, সেখান থেকে নির্গত 'আলো'টি ছিল অপরূপ ও শুদ্ধ। গভীর দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তাঁর জীবনবোধ ও জীবনচর্যা এবং সৃজিত কবিতার জগৎ--সবকিছু থেকেই বহু যোজন দূরে অবস্থান সমাজবিচ্যুত, সমাজের আর্তনাদে অ-কম্পিত 'হিসেবী', 'প্রতিষ্ঠানের দোলনায়' দুলতে থাকা আজকের অনেক কবির! তিনি যত বড় কবি, তার চেয়েও বড় একজন মানুষ। এবং, দিনের শেষে দুটোই তো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত, অবিচ্ছেদ্যও বলা যায়। কবির 'সামাজিক সত্তা'-কে তিনি কবিতায় ও যাপনে মূর্ত করে তুলতে পেরেছিলেন। কবি সমাজবিচ্ছিন্ন জীব নন। সমাজের সঙ্গে কবির নিবিড় যোগসূত্র থাকা বাঞ্ছনীয়। কবিতা হোক, অথবা গদ্য, আসলে সমূহ লেখালেখির মূল কথাটি বহু প্রতিষ্ঠিত লেখকও বুঝতে ব্যর্থ। সত্যকে উচ্চকিত করা, সত্যের অনুরণন, মানুষ ও সমাজকে সংবেদনশীল অন্তর উৎসারিত গভীর কল্যাণকামনায় পথ বা পথের দিশা দেখানোই 'লেখালেখির' উদ্দেশ্য। অনুচ্চ অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন : 'সত্য' বলা ছাড়া কবিতার আর কোনও কাজ নেই' । 'তর্কে' কেউ জেতে না, বরং 'সত্য' জিতে যায়। আসলে মূল সমস্যার ভূত লুকিয়ে আছে বৃহত্তর সামাজিক 'আমরা'র সত্য অনুধাবনে। যতক্ষণ পর্যন্ত তা না হচ্ছে এবং তার সঙ্গে 'আমি'-কে সংযুক্ত করতে পারা না যাচ্ছে ততক্ষণ 'সত্য' যে কবিদের আরাধ্য হবে না, হবে কেবল অসামাজিক 'আমি'র কর্কশ উদযাপন তা তো আমরা নিদারুণ বাস্তবেই দেখতে পাচ্ছি! আবদুর রাকিব বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগসূত্র আজীবন বজায় রেখেছেন এবং 'সত্য' উচ্চারণ করেছেন। উল্লেখ্য, তাঁর সমূহ গদ্যে শব্দচয়নে পরিমিতিবোধ ও নির্মলতার প্রতি অভিনিবিষ্ট ছিলেন তিনি।
গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সবক্ষেত্রেই 'ভাষা' একটি প্রধান বিষয়। 'ভাষা' যদি ভাবের বাহন হয় তাহলে 'ভাব' স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাষাকে আশ্রয় করে নেবে সেটাই স্বাভাবিক । অর্থাৎ, 'ভাব' অনুযায়ী 'ভাষার ছাঁদ' ঠিক হবে। প্রবন্ধ জিনিসটাই এমন যে, সেখানে চিন্তার স্তরটাই তার ভাষাকে নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত করে। কেবল 'প্রাঞ্জল' করে তোলার শর্তের প্রতি প্রাবন্ধিক নিবিষ্ট থাকতে পারেন না।প্রবন্ধের ভাষাকে যারা 'কঠিন' বলেন এবং তাকে 'প্রাঞ্জল' করতে বলেন, প্রবন্ধ পাঠের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুব নিবিড় নয়। ভাষার 'কাঠিন্য' অনেকের কাছেই 'দেখনদারিতা' হিসেবে প্রতিভাত হয়। সেটা কোনও ক্ষেত্রেই কাম্য নয় তা ঠিক। তবে, যাঁদের প্রবন্ধের ভাষা তথাকথিত অর্থে অনেকের কাছে 'কঠিন' মনে হয় তাঁরা যে 'দেখনদারিতা'র জন্যেই সেই 'কাঠিন্যের পথ' বেছে নেন সেটা আবার ভাবা ঠিক হবে না। কারণ, তাহলে তাঁদের প্রবন্ধ এতটা 'সমাদৃত'ও হ'ত না। আসলে এই 'দেখনদারিতা' বস্তুটা সনাক্ত করাই খুব মুশকিল। অনেকে কোনও কোনও লেখকের উদাহরণ দিয়েও প্রবন্ধের ভাষার 'সহজিয়া সুর' প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু, আদতে 'কঠিন ও সহজ'-এর মীমাংসা মূলত পাঠকের শিক্ষা বা মেধানির্ভর। সেক্ষেত্রে একজন লেখকেরও জ্ঞান, মেধা, পছন্দ বা অনুরাগ অনুযায়ী ভাষাশৈলী নির্বাচনের স্বাধীনতা স্বীকার্য। পাঠকের কথাই একমাত্র বিবেচ্য হলে সেক্ষেত্রে লেখকের স্বচ্ছন্দ অভিব্যক্তি প্রকাশ ব্যাহত হয়ে সবকিছু 'তরল' হয়ে যেতে পারে, যা কাম্য নয়। গল্প, উপন্যাস, এমনকি কবিতার ক্ষেত্রেও উপরিউক্ত কথাগুলি সত্য। 'রাকিবীয় গদ্য' উপরিউক্ত ভাষ্যের মূর্ত উদাহরণ।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম এদরাকপুরে আমৃত্যু বসবাস করেছেন প্রান্তিক মানুষের সুখদুঃখের কথাকার, গদ্যশিল্পী আবদুর রাকিব, যিনি তাঁর বাড়িটির নাম রেখেছিলেন--'ছায়ানট'। তিনি ২০১৮'র ২১ নভেম্বর প্রয়াত হন । জন্ম : ১৬ মার্চ ১৯৩৯ । পেশায় ছিলেন একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। গল্পকার, জীবনচরিত রচয়িতা, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক নানা ক্ষেত্রেই তাঁর অনন্য প্রতিভা হিরণ্ময় বিভা ছড়িয়েছে। প্রথম জীবনে তিনি লিখেছিলেন বহুল সমাদৃত 'চারণকবি গুমানী দেওয়ান', যা কেবল মুর্শিদাবাদের প্রখ্যাত কবিয়াল গুমানী দেওয়ানের জীবনী নয়, বরং একদা তুমুল জনপ্রিয় কবিগানের বিষয়বস্তুর চমৎকার বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছেন 'সংগ্রামী নায়ক মওলানা আবুল কালাম আজাদ', 'একত্ববাদের মশাল দৌড়', 'আল কুরআনের উপমা ব্যঞ্জনা', 'ইসলামে নারীর অবস্থান ও অধিকার' নামক মৌলিক প্রবন্ধগ্রন্থ। তাঁর অনূদিত গ্রন্থগুলি হ'ল--'ইসলাম প্রসারের ইতিহাস', 'স্পেনের মুসলিম ইতিহাস'। তাঁর আসল কৃতিত্ব ও খ্যাতি যে ছোটগল্পে সেই কালোত্তীর্ণ গল্পগ্রন্থগুলি হ'ল--'বাদশাহ ও বাবুই বৃত্তান্ত', 'প্রতিকূলে একজন', 'আবদুর রাকিবের নির্বাচিত গল্প'। আত্মজীবনীমূলক গদ্য 'বেড়ে ওঠার দিনগুলি' এবং 'পথ-পসারীর পত্রোত্তর' সম্ভবত তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা ইত্যাদি। নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ, সত্যনিষ্ঠ, ভাষা নির্বাচনে ও নিজস্ব শৈলী নির্মাণে সফল 'সাধক' কথাশিল্পী আবদুর রাকিব আমাদের স্মরণে, মননে ও চর্চায় অমরত্বের অধিকারী!
'সাহিত্যে মুসলিম সমাজের প্রতিধ্বনি' এইসব শব্দবন্ধ ইদানীং অল্পস্বল্প চর্চিত হলেও বহুকাল যাবৎ সেই শূন্যতা বিষাদের আবর্তই রচনা করেছে। সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ কিংবা আবুল বাশার সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিমান হলেও তাঁরা মূলত বহমান সৃজনপ্রবাহেরই অনুসরণ করেছেন। যে দু'একটি সাহিত্যকীর্তি তাঁদের কলম থেকে উৎসারিত হয়েছে তা যেমন পূর্ণাঙ্গ মুসলিম সমাজের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং সংক্ষিপ্ত ; তেমনই সম্পূর্ণ যথার্থও নয়। তাদের সৃজনশীলতায় মুসলিম সমাজের দৃশ্যমান বাস্তবতা যতটা প্রতিফলিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁরা মুসলিম সমাজকে কীভাবে দেখতে চান তার ছায়া। অর্থাৎ, সেখানে তাঁদের নিজস্ব চিন্তা বা দর্শনের একটি আরোপ-প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দিনান্তে আফসার আমেদ বা কিছুটা সোহারাব হোসেনও তাদের সহযাত্রীই ছিলেন। আবদুল জব্বার বরং এদের থেকে 'পৃথক' ছিলেন। সবচেয়ে যে সাহিত্যিক যথার্থ মুসলিম সমাজচিত্র অঙ্কনে শুদ্ধতম ভূমিকা পালন করেছেন তিনি আবদুর রাকিব। তাঁর সাহিত্য মুসলিম সমাজকে হাইব্রিড গাছের মতো মাটির প্রতি দ্বান্দ্বিক অবস্থানে প্রতিস্থাপন করেনি। বরং যে মাটিতে যে গাছ জন্মায় ও বিবর্ধিত হয় সেই মাটি ও সেই গাছটিকে পরম মমত্বে চেনানোর কাজটি তিনি করেছিলেন। কৃত্রিম আরোপ-প্রবণতা বর্জিত হওয়ায় তাঁর সাহিত্য প্রতিবাদী নয়, বরং নিবিড় সংবেদনায় অনুভবী। ছোট ছোট দুঃখ-ব্যথাগুলি, যা সমাজের দেয়ালে গুমরে গুমরে কাঁদে, তিনি ছিলেন তার ভাষ্যকার। এক্ষেত্রে তিনি তাঁরই প্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের অনুসারী। 'সাহিত্যে প্রতিবাদ' জানানোরও উপযুক্ত 'ক্ষণ' থাকে। প্রেক্ষিত বা পটভূমি থাকে। শিশুর কান্না মোছানোর সময়টা শিশুর দুরন্তপনার বিচার করার কালপর্ব নয়। এই মৌলিক সত্য বিস্মৃত হলে 'শৌখিন প্রতিবাদী' হয়তো জন্ম নিতে পারে, কিন্তু তাকে 'জীবনবাদী কথাশিল্পী' বলা যায় না। কারণ, সেটা আসলে জীবনবিমুখতা।
অধুনা যে দু'একজন মুসলিম সাহিত্যিককে দিগন্তে 'উদিত' হতে দেখা যাচ্ছে তাঁদেরকে বিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী আবদুর রাকিবের পদাঙ্ক অনুসরণকারী বলা যায় না। অত্যন্ত সুভদ্র, প্রচারবিমুখ, ফুলের সৌরভ ছড়ানো জীবনচর্যায় অভ্যস্ত এই মানুষটির প্রতি জ্ঞাপন করি অনিঃশেষ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা!