সে ভাবত, মালিক ও তার জীবন স্বাভাবিক এবং সঠিকভাবে বাঁচার বিষয়টিকে অনুধাবন করেই এগিয়ে চলছে আর এটাই বাঁচার একমাত্র উপায়।
Published : 03 Dec 2023, 12:33 PM
অলস মন, অবশ দেহ, স্থবির কাল। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘বিরস দিন বিরল কাজ’’; কিন্তু পরক্ষণে ‘‘মহাসমারোহে’’ প্রেম আসার কথাও তিনি বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের নীরব ভবনকোণে অলসমনে একলা থাকার মধ্যেই ‘‘অপরাজিত’’ এসে দ্বার ভেঙে ফেলে। এখন তা আর হয় না আমাদের জীবনে; আমাদের জীবন প্রত্যাহারেরই জীবন, তথাগতের নয়।
এখন মন কি অলসগামী? তবে তো তার চিন্তাহীন হয়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু অলস মনই যেন চিন্তার উৎস; আলস্যই যেন নতুন চিন্তার সূত্রধর! আর এই আলস্যের সেরা উদ্যাপন হলো শুয়ে থাকা। তা অবশ্যই জেগে থেকে থেকে। শোয়া-মানুষের চিন্তা স্বতশ্চল থাকে, সে-চিন্তা আকাশ-পাতাল ছুঁয়ে স্বর্গ-নরকের পথ করে নেয়।
সটান চিত হয়ে শুয়ে থাকি, আমিও; চিত হয়ে চিদানন্দ নিয়ে। চোখ থাকে আকাশের দিকে। ভাবি, ‘‘যে পারে সে আপনি পারে, পারে সে ফুল ফোটাতে।’’ ভাবি, ‘‘আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেব রে লুট ক’রে’’। অক্ষমের হম্বিতম্বি, মনে মনে সাগরসেঁচা। শোয়া-মানুষ যেন পাতালে বিছানা পাতে আর আকাশে রাখে দৃষ্টি। শুধু শুয়ে পড়াই শখ, ইচ্ছা, আর পরিণতি তার। আপন পাপড়িভারে নিজের সমাকুলতা, আচ্ছন্নতা; নিজ গন্ধভারে নিজেই বিভোর হয়ে থাকা। কখনও ছাদের দিকে কখনও-বা শার্শি দিয়ে বাইরের দিকে উদ্দেশ্যহীন তাকানো। এই যে চুপ করে বসে থাকা, তা কি আসলেই নির্জীব হয়ে থাকা? রবীন্দ্রনাথ তো একবার বলেছিলেন, চুপ করে যখন তিনি বসে থাকেন তখনই তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেন!
শোয়া-মানুষের চিন্তারা কিন্তু শুয়ে থাকে না, তার উড়তে থাকে, ডানা মেলে, ডানা ভেঙে। কত যে স্মৃতি, কত যে সময়ের সুতা উড়তে থাকে চোখের সামনে। শুয়ে-শুয়েই জীবনের ও জগতের সমাধান-খোঁজা। এ অবস্থাটি বাহ্যিকতায় ‘‘অবলোমভীয়’’। অবলোমভীয়? কে এই অবলোমভ, কাকে বলে অবলোমভিজম?
‘‘অবলোমভিজম’’ বা ‘‘অবলোমভাশ্চিনা’’-- এক শ্লথতার নিয়তি। মন্থরতার অনতিক্রান্ত অবস্থা। ডুবে-যাওয়া মানুষটি উদাসীন, জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অর্থহীন। কিন্তু এই অর্থহীনতারও অর্থ আছে, দর্শন আছে; আছে আশ্চর্যতা; আছে বিষাদকে প্রসাদ করার ক্ষমতা।
১৮৫৯ সালে ইভান আলেকসান্দ্রোভিচ গনচারোভ নামের একজন রুশ ঔপন্যাসিকের দ্বিতীয় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়, একটি সাহিত্যপত্রিকায়, যার নাম অবলোমভ। প্রথাগত কোনো প্লটে আবদ্ধ নয় উপন্যাসটি, বরং এমন-এক গাঠনিকতা আছে তাতে, যা পাঠককে দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে অন্তর্মুখী করে তোলে। বলা যায়, অন্তর্দর্শনই রচনাটির মূল ভিত্তি। প্রধান চরিত্রের নামেই রচনার নামকরণ। উপন্যাসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘‘অবলোমভিজম’’ বা রুশ শব্দবন্ধে ‘‘অবলোমভাশ্চিনা’’।
উপন্যাসটির শুরুতেই দেখা যায়, প্রাদেশিক এক শহরের গোরোখোভায়া স্ট্রিটের এক অ্যাপার্টমেন্টে এক সকালে বিছানায় শুয়ে আছে একজন, যার নাম: ইলিয়া ইলিচ অবলোমভ-- সম্ভ্রান্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত, ভূস্বামী। তার চোখ আসক্তিহীনভাবে দেয়াল ও ছাদের দিকে দৃষ্টিবিভঙ্গিত, যেন কিছুতেই-কিছু যায়-আসে না তার; এতই নির্বাক আর নিশ্চিন্ত, এবং অচিন্ত্যও। ঘরেই থাকে সে প্রায় সবসময়, যেটি তার শোবার-পড়ার-বসার ঘর। উপন্যাসটির প্রথম পঞ্চাশ পৃষ্ঠায় তাকে একবার-মাত্র শয্যা থেকে উঠে চেয়ারে যেতে দেখা যায়। জীবনের প্রতি উদাসীন ফলে কুঁড়েমিপনার এক আশ্চর্য আচরণে নতুন এক জীবনবৈশিষ্ট্যেই সে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। সে ভাবে, গ্লেডিয়েটর হয়ে সে জন্মায়নি, বরং যুদ্ধের নীরব-এক দর্শকমাত্র। একদিন সকালে একটি চিঠি পায় সে: তার দেশীয় পরগনা অবলোমোভকা-র ম্যানেজার জানায়, যে, এস্টেটের আর্থিক অবস্থা খারাপ; এ থেকে উত্তরণের জন্য পদক্ষেপ নিতে তার (অবলোমভ) পরগনা পরিদর্শনে আসা প্রয়োজন। কিন্তু এক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ওখানে যাওয়ার পরিবর্তে শয়নঘরে থাকাই শ্রেয় মনে করে না-যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল অবলোমভ। তার পর ঘুমিয়ে পড়লে সে স্বপ্নে দেখতে পেল বাল্যকালে অবলোমভিকায় তার বেড়ে-ওঠা-সময়ের নানা স্মৃতি। ঘরের কোনো কাজই করত না সে, ইস্কুল বন্ধ হলে পিতামাতা তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাত কিন্তু তাদের পীড়াপীড়ি কোনো কাজে আসত না। বিপরীতে তার বন্ধু স্টোল্ৎস ছিল সুশৃঙ্খল। এই বন্ধুই পরে এসে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। এবং সে-ই তাকে ওলগা নামের সুন্দরী তরুণীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় যা অবশেষে প্রেমে রূপ পায়। কিন্তু অবলোমভের উদাসীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় তা পরিণতি না পাওয়ায় ওলগা চলে যায়। অবলোমভের ছদ্মবেশী বন্ধু তারানতিয়েভ এবং ইভান মাতভেয়েভিচ তাকে ক্রমাগত ঠকাতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ব্লাকমেইলও করে বসে। এভাবেই গভীর স্বপ্নচারিতার ভেতর চলতে থাকে অবলোমভের জীবন। একসময় সে তার বিধবা বাড়িওয়ালি আগাফিয়াকে বিয়েও করে এবং তার সেবায় জীবন কাটাতে থাকে। আগাফিয়া অবলোমভবের শৈশবের স্বর্গ অবলোমভকা-কে পুনঃসৃষ্টি করে। একসময় বৃদ্ধ ও অসুস্থ অবলোমভ মারা যায় আর বলে যায় যে তার মৃত্যুর কারণ ‘‘অবলোমভিতিস’’, আর সে নিজেই লিখেছিল তার ললাটলিখন। নিজ দর্শনের মতোই তার মৃত্যুও হয়েছে ঘুমের গভীরে।
অবলোমভের গৃহে-অবস্থানের যে মানসতা, তাকে বলা যায় তার সুপ্তিচৈতন্যতাড়না। ঘরকাতুরে মন সমূহ নিরাসক্তি আর নৈর্ব্যক্তিকতায় দৃষ্টি দিয়ে স্পর্শ করতে চায় অজানাকে। দৃষ্টি বাসনারহিত ব্যাকুলতায় স্থির হতে চায়। কিন্তু ঘরে সে কী করে? ঔপন্যাসিকও এই প্রশ্ন উঠিয়েছেন উপন্যাসে: ‘‘কিন্তু ঘরে সে কী করে? পড়ে? লিখে? পড়াশোনা করে?’’ হ্যাঁ, এটা ঠিক, হাতে একটা খবরে-কাগজ বা বই থাকলে সে তা পড়ে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা শুনলে সে তা জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর বইয়ে তা খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু তা জানার আগেই সে নিরুদ্বেগচিত্তে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, না-পড়া-না-বোঝা বইটি তখন তার পাশে পড়ে থাকে অবহেলায়। যে শীতলতা তাকে পেয়ে বসে তার থেকে বের হতে পারে না সে, ফলে বইয়েও ফিরে যেতে পারে না। বন্ধু স্টোলৎস কোনো বই আনলে সে নীরবে তার দিকে এক-নাগাড়ে চেয়ে থাকত, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলত, ‘‘ ব্রুটাস তুমিও, আমার বিরুদ্ধে’’, মানে আমি তো পড়তে চাই না, তবে কেন তুমি বাধ্য করতে চাও হে! তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দার্শনিকতাময়: ‘‘ কেউ-একজন কখন বাঁচে? সে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিত। শেষমেশ কখন একজন মানুষ জ্ঞানের ধনকে ব্যবহার করতে চায় যার বেশিরভাগই জীবনের জন্য অনুত্তম? উদাহরণত, রাজনৈতিক অর্থনীতি, বীজগণিত, জ্যামিতি-- অবলোমভকাতে এসব দিয়ে কী হবে?’’ গুরুত্বপূর্ণ পড়াশোনা তাকে নিঃশেষ করে দিত। অনুমিত সত্যের কারণে শ্রেষ্ঠ চিন্তকরাও তাকে কোনো জ্ঞানের তৃষ্ণা জাগাতে পারত না। অন্যদিকে কবিরাও তাকে হতাশ করত। তবে জীবনের সুখকর মুহূর্ত, যা কাউকে প্রতারিত করে না, তা-ই তাকে আন্দোলিত করত। জীবন তাঁর কাছে দুটি ভাগে বিভক্ত: একদিকে কাজ আর একঘেয়েমি, যা তার কাছে সমার্থবোধক; অন্যটি হলো, প্রশান্তি আর নির্ঝঞ্ঝাট আমোদ-আহ্লাদ। এই কারণেই তার প্রধান রঙ্গভূমি সবচেয়ে অস্বচ্ছন্দভাবে প্রথমেই তার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলে।
এই একাকী মানুষটিকে শুধু তার ভৃত্য জাকার একাই দেখভাল করে রাখত। সে-ই শুধু জানত মালিকের অন্তর্গত জীবনের রহস্যকে। সে ভাবত, মালিক ও তার জীবন স্বাভাবিক এবং সঠিকভাবে বাঁচার বিষয়টিকে অনুধাবন করেই এগিয়ে চলছে আর এটাই বাঁচার একমাত্র উপায়। এই উপলব্ধি শুধু ভৃত্য জাকারের নয়, অবলোমভেরও। এভাবেই একদিন রোগে ভোগে পরিণত বয়সে অবলোমভ নিষ্ক্রান্ত হয়। কিন্তু কী হলো তার মন্থরতার জীবনদর্শনের? কোথায় এখন সে? ঔপন্যাসিক জানাচ্ছেন:
‘‘অবলোমভের কী হলো? কোথায় সে? নিকটস্থ সমাধিক্ষেত্রে এক প্রশান্তিময় কবরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে নিশ্চুপ তার দেহ বিশ্রাম করছে এখন। লাইলাক শাখা তার কবরের ওপর বাড়িয়ে দিয়েছে তার সহৃদয় হাতখানি, সেখানে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় ভেষজ লতাগুল্মের সুগন্ধময়তা। স্তব্ধতার দেবদূত পাহাড়া দিচ্ছে তার ঘুমকে।’’
‘‘কীভাবে স্ত্রীর তীক্ষ্ণ প্রেমময় দৃষ্টি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাকে পাহারা দিত, তার চিরন্তন বিশ্রাম, চিরন্তন নীরবতা, আর দিনানুদৈনিক অলসগমন একেবারেই তার জীবনযন্ত্রকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল কি না, তাতে আর কিছুই যায়-আসে না। এখন এটাই সত্য, যে, ইলিয়া ইলিচ কোনো ব্যথাবেদনা বা যন্ত্রণাভোগ ছাড়াই মরে গেছে, যেন স্তব্ধ-হয়ে-পড়া কোনো ঘড়ির মতো যাকে দম দিতে ভুলে গিয়েছিল কেউ-একজন।’’
একদিন সকালে আগাফিয়া মাতভেইয়েভনা প্রতিদিনকার মতো হাতে কফি নিয়ে এসে দ্যাখে, মৃত্যুশয্যায় অবলোমভ চিরবিশ্রাম নিচ্ছে। যেন এক স্বপ্নবিছানায় রয়েছে সে, শুধু মাথাটা বালিশ থেকে কাত হয়ে পড়ে আছে, হাতদুটি বুকে চেপে ধরা, সেখানে রক্তপ্রবাহ স্থির। অবলোমভ যেন কোনো কারণ ছাড়াই মোটের ওপর মরে রয়েছে।
ইভান আলেকসান্দ্রোভিচ গরনাচোভ এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অবলোমভকে পরিগ্রহণ করেছেন রুশ রূপকথার নায়ক ইলিয়া মুরোমেতস-এর আদলে যে তার জীবনের প্রথম তেত্রিশ বছর, রুশ-শত্রুর আক্রমণ ব্যতীত, কিছুই না-করেই শুধু স্টোভ-বেঞ্চে বসে কাটিয়ে দেয়। জীবনের অর্থময়তা-বিষয়ে উচ্চবিত্ত জমিদারদের রুশীয় প্রতীতিটি ছিল: এগিয়ে যাও আর ঘুমাও যতক্ষণ-না কোনো উচ্চাভিলাসী উদ্দেশ্য পাও। অবলোমভ চাকরির চিন্তা বাদ দেয় কেননা সে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হতে চায় না, ব্যবসায়ী হতে চায় না বিকিকিনির নোংরামির কারণে। সে গ্রহণ করে এক স্বতন্ত্র জীবন, বহিরাগতর জীবন যা মনে করিয়ে দেয় সেই রুশ কূটাভাসকে-- মূল্যবান জীবনযাপন করতে চাইলে পারতপক্ষে সোফা থেকে ওঠা যাবে না। অবলোমভ যদি রুশীয় ফাউস্ট হয় তবে বন্ধু স্টোল্ৎস হলো মেফিস্টো, যে জাগাতে চেয়েছিল ফাউস্ট অবলোমভকে। কিন্তু অবলোমভ আত্মা বিক্রি করতে অনিচ্ছুক। আর এ কারণেই সে আকর্ষণীয় এবং অনুগ্রহপ্রাপ্ত। অবলোমভ চরিত্রটি তৎকালীন রাশিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎকে ব্যঙ্গ করে তার প্রতীকী রূপায়ণ হলেও সমান্তরালে তা এক গভীর জীবনদর্শনে উদ্ভাসিত। স্টোল্ৎস অবলোমভকে বাস্তববাদী করতে চায়, বিষয়ী করতে চায়, কিন্তু সে পরাজিত হয় অবলোমভের সুষুপ্তির শক্তির কাছে, মনের কাছে। মানসজগৎই জীবনের বেঁচে থাকার প্রধান আধার ও অবলম্বন, এটাই যেন অবলোমভ চরিত্রটি জানাতে চায়। অবলোমভ নিদ্রাকে পছন্দ করে, এবং গ্রহণ করে, আর অবশেষে বসে-থাকাকে নিয়েই অন্তিমে চলে যায়। স্টোল্ৎসের ধারণা হলো: শ্রম আর জীবন একসঙ্গে জীবনের উদ্দেশ্যকে ঠিক করে নেয়, কিন্তু অবলোমভের ধারণা ভিন্ন: জীবন আসলে স্বপ্নবৎ এক অভিযাত্রা। উপন্যাসটির গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ‘‘অবলোমভের খোয়াব’’-এ তার শৈশবের গ্রাম অবলোমভা, যা নিদ্রাময় রাশিয়ার প্রতীক হয়ে ওঠে। এখানে সকলেই দৈনন্দিন কাজ করে কিন্তু সকলেই আবার যেন ঘুমগ্রস্ত। কেউ সিদ্ধান্ত নেয় না, উদ্যোগ নেয় না, ঠিক স্বপ্নে যেমনটা ঘটে।
শেষ অধ্যায়ে স্টোল্ৎস ও তার সাহিত্যপ্রেমী বন্ধু যখন এক গির্জায় ভিক্ষুকদের মাঝে অবলোমভের গৃহভৃত্য জাকারকে দেখতে পায় এবং এই দুরবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তাকে নিয়ে গিয়ে দেশে পুনর্বাসন করতে চায়, তখন জাকার যেতে অস্বীকার করে। কারণ হিসেবে বলে যে, এখানে থেকে গিয়ে সে অবলোমভের কবর পাহারা দিয়ে যাবে। কেননা, অবলোমভ তার প্রভু, যিনি সকলকে সুখী করার জন্য বেঁচে ছিলেন। সকলকে সুখী করার জন্য নিজেকে অচকিত এবং নিরুদ্বেগ এবং অপ্রয়াসিত রাখার কথাই বলে অবলোমভ। এ এক অবধূতীয় বোধ। এখানে দেখা দেয়, এক হিতবাদী সত্তার দার্শনিক উদ্ভাসন, পৃথিবীকে রক্ষার এক মানবিক অভিচারণা।
মানুষের ভিতরে যে নির্জ্ঞানধাম রয়েছে, সেখানে সুখী হওয়ার বাসনা নানা ভাবনা ও ভঙ্গিতে বিন্যস্ত, বা অবিন্যস্ত, অথবা বিস্রস্ত। অবলোমভের নির্জ্ঞান নিজেকেই নিজে বাসনাব্যক্ত করতে চাইছে একা একা , এক ঘরে, একই ভঙ্গিতে, যেখানে সুখের মতো একটা কিছু রয়ে যেতে চায় হারিয়ে যাওয়ার মধুর দূরত্বে। বাসনা ব্যক্ত হতে চায়, ফেটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে, রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন:
বাসনা সব বাঁধন যেন কুঁড়ির গায়ে
ফেটে যাবে, ঝরে যাবে দখিন বায়ে
একটি চাওয়া ভিতর হতে
ফুটবে তোমার ভোর আলোতে
প্রাণের স্রোতে।