যৌবনে মীনাক্ষী দেখতে যেমন রূপসী ও আকর্ষণীয়া ছিলেন তেমনি ছিলেন ব্যক্তিত্বে আভিজাত্যপূর্ণ। একটি সিনেমায় রোমান্টিক নায়িকার ভূমিকায়ও অভিনয় করেছিলেন তিনি।
Published : 25 Jan 2024, 05:18 PM
মীনাক্ষী দত্ত সম্পর্কে আমি প্রথম জানতে পারি আশির দশকের প্রথম দিকে তাঁর অনূদিত ডাক্তার জিভাগো বইটি পড়ার সময়! মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে ঐ বৃহদায়তন উপন্যাসটি তিনি অনুবাদ করেছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে ডা. জিভাগোর কবিতাও তাতে সংযুক্ত ছিল! সে সময়ই আমি একের পর এক বুদ্ধদেব বসুর বই পড়ে চলছিলাম। বলা যায়, আমাকে তখন অধিকার করে রেখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। যদ্দূর মনে পড়ে, মীনাক্ষী দত্ত সম্পর্কে আমার প্রাথমিক ধারণা হয়েছিল সেই সূত্রেই। কাছাকাছি সময়েই দেখেছিলাম শান্তিনিকেতনে বুদ্ধদেব বসুর সপরিবার রবীন্দ্র-সাক্ষাতের ফটোগ্রাফ। সেখানে শিশু মীনাক্ষীও ছিলেন।
বয়সের দিক থেকে মীনাক্ষী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের লেখকদের সমসাময়িক। তাঁদের অনেকেরই তিনি ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশের শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী কিংবা বেলাল চৌধুরীর তিনি ছিলেন বন্ধু। তাঁর স্বামী জ্যোতির্ময় দত্তও তাঁরই সমবয়সী। জ্যোতির্ময় দত্তের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নানা সময় আমার কিছু শোনা হয়ে থাকলেও মীনাক্ষীর সক্রিয়তা সম্পর্কে বেশি জানার সুযোগ হয়নি আমার। যদিও নব্বইয়ের দশকে সহপাঠী মাহফুজা শীলুর সূত্রে মীনাক্ষী-জ্যোতির্ময় দম্পতির কথা কিছু জানা হয়েছিল। মনে পড়ছে নব্বইয়ের দশকেই তাঁর অনূদিত ও সম্পাদিত বিদেশী প্রেমের গল্প-সংকলন ‘বিদেশিনী’ সংগ্রহ করেছিলাম। এখনো আমার ঢাকার বুকসেল্ফে আছে বইটি। অনেক পরে তাঁর সম্পাদিত বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা-সংকলন খণ্ডগুলো সংগ্রহ করি। ততদিনে এ কথা জানা হয়ে গিয়েছিল যে, বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা' পত্রিকা ও মীনাক্ষী দত্তের জন্ম একই তারিখে। ১৯৩৫ সালের ১ অক্টোবর তাঁর জন্ম। অনেক পরে, খুব সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত তাঁর বইয়ের ব্লার্ব সূত্রে জেনেছি প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষার্থী থাকাকালীন তিনি নিজেও ‘শ্রীহর্ষ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তাঁর কৃতবিদ্য স্বামী জ্যোতির্ময় দত্ত বুদ্ধদেবের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন; তিনিও কবি, অনুবাদক এবং সাংবাদিক; সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মননশীল পত্রিকা ‘কলকাতা'-র সম্পাদক হিসেবে তাঁর পরিচয়ও বেশ গুরুত্ব পায়! পত্রিকাটির বুদ্ধদেব বসুর ওপর বের হওয়া সংখ্যা দুটি তো খুব প্রিয় আমাদের অনেকের কাছে। পিতার ‘কবিতা’-সংকলনের মতো মীনাক্ষী স্বামীর ‘কলকাতা’ পত্রিকার সংকলনও সম্পাদনা করেছিলেন।
মীনাক্ষী দত্তের ৮৮ বছরের জীবনকে মোটামুটি দীর্ঘই বলা যায়। কিন্তু সে হিসেবে তাঁর রচিত বইয়ের প্রকাশনা সংখ্যায় খুব বেশি নয়! ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের ‘কল্কি', বরিস পাস্তারনাকের ‘ড. জিভাগো', ‘বেডসাইড মিনি ডিটেকটিভ’, লি কুনশিনের ‘মাও-এর শেষ নর্তক’, ফ্যানি পার্কসের ‘সাহেব বিবি বণিক হারেম’, ও হামদি বে-র ‘বে অব বেঙ্গল' –এসব বইয়ের সার্থক অনুবাদক তিনি।
নানা ধরনের গদ্য লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে স্মৃতিমূলক ও ব্যক্তিবিশেষের জীবন সম্পর্কিত রচনা! ‘ম্যাজিক লণ্ঠনে কয়েকটি মুখ’, ‘স্মৃতিতে চিঠিতে বুদ্ধদেব বসু ও তাঁর সারস্বত গোষ্ঠী’, ‘অ্যালবাম থেকে কয়েকজন’--এই বইগুলোকে এই ধারায় ফেলা যায়! বুদ্ধদেব বসুর কন্যা বলে যেমন তেমনই নিজের কর্মবৃত্ত সূত্রেও সাহিত্য অঙ্গনের বহু খ্যাতিমানের সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য ও অবহিতি! এরই পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর এ ধরনের রচনায়! মননশীলতা, পরিমিতি, ব্যক্তিস্বভাব শনাক্তির বিশিষ্টতা সূক্ষ্মদর্শী সাহিত্য রসিকের মনোযোগে আসবে তাঁর এ ধরনের লেখা। ছোট ছোট জার্নালধর্মী রচনা ‘অন্য নোটবই’ও বেশ পাঠস্বাদু। আমি প্রায়শই পড়ি সেটা।
তাঁর প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর কথা প্রাসঙ্গিকতাসূত্রে যতটা ওঠে ততটা মা প্রতিভা বসুর কথা ওঠে না। প্রতিভা বসুর বই বেশ জনপ্রিয় ছিল। সিনেমা হয়েছে তাঁর রচিত কয়েকটি উপন্যাস নিয়ে। যৌবনে মীনাক্ষী দেখতে যেমন রূপসী ও আকর্ষণীয়া ছিলেন তেমনি ছিলেন ব্যক্তিত্বে আভিজাত্যপূর্ণ। একটি সিনেমায় রোমান্টিক নায়িকার ভূমিকায়ও অভিনয় করেছিলেন তিনি।
মীনাক্ষী দত্তের পেশা ছিল মূলত শিক্ষকতা; পড়িয়েছেন দেশে ও বিদেশে। নিউইয়র্কের একটি সমাজসেবী সংস্থা, গ্র্যান্ড স্ট্রিট সেট্লমেন্টে কাজ করেছেন কর্মজীবনের শেষের দিকে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্ক ও কলকাতায় সময় ভাগ করে থাকতেন। ২০১৮ সালের পরে আর আমেরিকায় আসেননি। আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে দুইবার। দুবারই তা সম্ভব হয়েছিল নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি সাংবাদিক-লেখক হাসান ফেরদৌসের সৌজন্যে। ২০১৮ সালের একদিন নিউ জার্সিতে তাঁদের বাড়িতে প্রায় সারাদিনের আড্ডায় ছিলাম। তার কয়েকদিন পরে এক সন্ধ্যায় ছিলাম নিউ ইয়র্কে হাসান ফেরদৌসের বেলরোজের বাড়ির আড্ডায়! সে সময়ই তাঁরা বলছিলেন তাঁদের পক্ষে আর হয়তো আমেরিকায় আসা হয়ে উঠবে না! অবশিষ্ট জীবন কলকাতাতেই কাটাবেন।
কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যের নানা বিষয়ে কথা শুনেছিলাম দুজনের। আমার মনে বিশেষ করে দাগ কেটেছে জীবনানন্দ সম্পর্কে তাঁর টুকরো স্মৃতি শুনে। কবি অজিত দত্ত সম্পর্কেও জানতে চাইলে বলেছিলেন দুচার কথা। আবেগের পরিমিতি ও বাকসংযম যেমন তাঁর লেখায় দেখেছি তেমনি লক্ষ্য করেছি তাঁর মুখের কথায়ও। সামান্য সময়ের পরিচয়ে তাঁকে প্রসন্ন ব্যক্তিত্বের মানুষ মনে হয়েছে আমার।
মীনাক্ষী দত্তের সাহিত্যিক সত্তার তিন মাত্রার মধ্যে সম্ভবত অনুবাদক সত্তাই বইসংখ্যার বিবেচনায় এগিয়ে থাকবে। কেবল সংখ্যা বিবেচনাতেই নয়, অনুবাদের বই নির্বাচনেও যেমন রয়েছে স্বাতন্ত্র্য ও রুচিবৈচিত্র্য তেমনি রয়েছে উদার মানবিক বোধের পরিচয়!
সম্পাদনায় গুরুত্বপূর্ণ কাজকে পরিবারকেন্দ্রিকতার স্থূল দৃষ্টিতে বিবেচনা করা ঠিক হবে না! বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার রচনারাজি সন্ধানে তৃষ্ণার্ত পাঠককে সন্তুষ্ট করা সহজ নয়! একই ভাবে ‘কলকাতা’ পত্রিকাও গুরুত্বপূর্ণ। এই কাজগুলোর জন্য তাঁর প্রকৃত অন্তঃশীল পরিশ্রমী সত্তাকে স্মরণ করতে হবে আমাদের।
সংখ্যায় কম মনে হলেও তাঁর স্মৃতিমূলক গদ্য বিশেষ তাৎপর্যবহ! যেমন বুদ্ধদেব বসুকে বুঝতে তাঁর এই কাজগুলোর খোঁজ করতে হবে তেমনি বুদ্ধদেবের সমকালীন কতিপয়কে জানতেও আমাদের তাঁর এই সংক্রান্ত বইয়ের শরণ নিতে হবে!
মীনাক্ষী দত্তের নিউ জার্সির বাড়িতে আড্ডার ফাঁকে শিরীন বকুল বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রথম পার্থ’ নাটকের কুন্তী অংশ পাঠ করে শুনিয়েছিল। তাঁরা দুজনেই ছিলেন এর মনোযোগী শ্রোতা! আমি মোবাইল ক্যামেরায় ঐ অংশটুকুর ভিডিও করে রেখেছিলাম। বেশ কিছু ছবিও তুলেছিলাম দুই দিনের আড্ডাতেই। ২২ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখ থেকে তিনি আর তাঁকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো স্মৃতি সৃষ্টি করতে পারবেন না! তার প্রয়াণে গভীর শোক জানাই।