ইলিয়াস সংখ্যটি খুবই যত্ন আর মমতা নিয়ে সম্পাদক এন জুলফিকার বহুদিনের পরিশ্রমে তৈরি করেছেন। তার নিষ্ঠা আর শিল্পরুচি অতুলনীয়।
Published : 04 Jan 2024, 01:14 PM
বাংলা ভাষার প্রথম সারির কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস ও ছোটগল্পের ভাষা, শৈলী আর বুননকৌশলের প্রথাবিরোধী চরিত্র সাহিত্যরসিকদের নজরে পড়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে একাধিক সাহিত্যপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘ইলিয়াস সংখ্যা’। ক্যান্সারে তাঁর আকস্মিক অকালপ্রয়াণের পর এ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে এপার ও ওপার বাংলায় এত বেশি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে যে তা এখন অগণন বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। সম্ভবত এত অল্পসংখ্যক রচনার অন্য কোনো সাহিত্যরথীকে নিয়ে এত বেশি মনোযোগ আগে খুব একটা দেখা যায়নি। আসলে সংখ্যায় অল্প হলেও তাঁর প্রতিটি গল্প আর উপন্যাস ছিল শৈল্পিক দক্ষতায় উচ্চতম, শৈলী গুণে শিখরছোঁয়া। এসবই তাকে জীবদ্দশায় যেমন, তেমনি মরণোত্তরকালেও মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। এই মনোযোগের সর্বশেষ উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত আত্মদীপের প্রজ্বলনভূমি `দীপন' নামক সাহিত্যসাময়িকীর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা। এটি পত্রিকার রজত জয়ন্তী বর্ষপূর্তি সংখ্যা হিসেবেও পরিচিত। তার মানে পত্রিকাটি ২৫ বছরে পরেছে। তাদের এই দীর্ঘ যাত্রার সর্বসাম্প্রতিক চিহ্ন ইলিয়াসকে নিয়ে প্রায় ৯শ পৃষ্ঠার বৈচিত্রপূর্ণ প্রকাশ। যারা এর আগের সংখ্যাগুলো দেখেছেন তারা এর সম্পাদক সম্পর্কে নিশ্চয়ই অবগত। সম্পাদক এন জুলফিকার এই সংখ্যাটি কয়েক বছরের গভীর নিষ্ঠায় ও পরিশ্রমে তৈরি করেছেন যেখানে ইলিয়াসের ব্যক্তি ও সাহিত্যিক সত্তার নানা দিকে আলো ফেলা হয়েছে। সংখ্যাটিকে তিনি ‘স্বজন কথা’, ‘ছবির ডায়েরি’, ‘অপ্রকাশিত ও নির্বাচিত চিঠিপত্র’, ‘অগ্রন্থিত গল্প’, ‘ইলিয়াসের জীবনবীক্ষা ও সাহিত্যদর্শন’, ‘ইলিয়াসের উপন্যাসভুবন’, ‘ইলিয়াসের গল্পভুবন’, ‘ইলিয়াসের শিশুসাহিত্য’, ‘ইলিয়াসের কবিতা’, ‘ভিন্ন মাধ্যমে ইলিয়াস’,‘কথোপকথন’, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: বংশলতিকা’, ‘আলোকচিত্র’, ‘জীবনঞ্জি’ ও ‘গ্রন্থপঞ্জি’। শুধু যে বিষয়ের এই বৈচিত্রই এ সংখ্যার বৈশিষ্ট্য-- তা কিন্তু নয়, প্রতিটি বিভাগও একাধিক লেখকের নানান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ও মূল্যায়নের এক আন্তরিক চেষ্টা এই সংখ্যাটিকে দিয়েছে অতিরিক্ত মহিমা। এ সংখ্যায় প্রায় চল্লিশজন লেখক কিংবদন্তীতুল্য আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে লিখেছেন তার ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্যের অলিগলি নিয়ে।
এসব লেখার কিছু কিছু আগেই অন্য কোনো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত, কিন্তু তারপরও যে দীপন-এর এই বিশেষ সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত হলো তা কেবল পশ্চিমবঙ্গের বা দীপন-এর পাঠকদেরকে ইলিয়াস সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেয়ার উদ্দেশ্যে। উভয় বাংলার নবীন প্রবীণ লেখক শিল্পীদের পাশাপাশি ইলিয়াস-পরিবারের দুজন অর্থাৎ তার ছোট ভাই খালিকুজ্জামান ইলিয়াস ও স্ত্রী সুরাইয়া ইলিয়াসের স্মৃতিকথাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই সংখ্যাটির প্রধান ও ব্যতিক্রমী আয়োজন হচ্ছে ছবির ডায়েরি বিভাগে সর্বজিৎ সেন-এর একগুচ্ছ রেখাচিত্র যেখানে ইলিয়াসের আদল ও নানান ধরনের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। সর্বজিৎ সেনের এই কাজগুলো খুবই সুন্দর। ‘অপ্রকাশিত ও নির্বাচিত চিঠিপত্র’ বিভাগে যুক্ত হয়েছে ইতোপূর্বে অপ্রকাশিত ইলিয়াসের কিছু চিঠিপত্র, যেমন সাধন চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু বসু আর তরুণ পাইনকে লেখা। ‘ভিন্ন মাধ্যমে ইলিয়াস’ বিভাগে এই প্রথম প্রকাশিত হলো চিলেকোঠার সেপাই ও খোয়াবনাম উপন্যাস দুটোর চিত্রনাট্যের প্রকাশ। সবাই জানেন যে এই উপন্যাস অবলম্বনে দুটো নাটক হয়েছিল সমীর দাশগুপ্তের নাট্যরূপে এবং প্রথমটি গৌতম হালদার এবং দ্বিতীয়টি কিশোর সেনগুপ্তের নির্দেশনায়। সেগুলো খুবই মঞ্চসফল ছিল। এছাড়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রেইন কোট গল্প অবলম্বনে জাহিদুর রহিম অঞ্জন-এর পরিচালনায় যে সিনেমাটি হয়েছিল সেটি নিয়ে লিখেছেন প্রসূন মাঝি।
ইলিয়াস সংখ্যটি খুবই যত্ন আর মমতা নিয়ে সম্পাদক এন জুলফিকার বহুদিনের পরিশ্রমে তৈরি করেছেন। তার নিষ্ঠা আর শিল্পরুচি অতুলনীয়। প্রতিটি বিভাগে লেটারিং আর অলংকরণ দিয়ে সাজিয়েছেন তিনি অনন্য এই সংখ্যাটি। এমনকি সূচীপত্রও বাদ যায়নি সচিত্র বিন্যাসের অভিনবত্বে। এই সংখ্যায় ইলিয়াস ও তার পরিবারের দুর্লভ কিছু আলোকচিত্র সংখ্যাটির আকর্ষণ আরও বাড়িয়েছে। প্রচ্ছদ ও গ্রন্থসজ্জায় সৌম্যদীপ তার শিল্পিত স্বভাবের চমৎকার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। আর সবশেষে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে পত্রিকাটির শুরুর লেখাটি যাকে সম্পাদকীয় নামে চিনি। এ জুলফিকারের লেখা ১১ পৃষ্ঠার দীর্ঘ সম্পাদকীয় ভূমিকায় লেখক ইলিয়াসের বৈশিষ্ট্যের নানাদিক অত্যন্ত গভীরতায় বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। এটি যত না সম্পাদকীয় তার চেয়ে বেশি এক স্বতন্ত্র প্রবন্ধ বলেই মনে হবে পাঠকদের কাছে। ইলিয়াসপ্রেমীদের জন্য এই সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে এক লোভনীয় সংগ্রহ তাতে কোনই সন্দেহ নেই। সম্পাদক এন জুলফিকারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই এরকম একটি রুচিশীল ও গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা উপহার দেয়ার জন্য। একই সাথে বাংলা ভাষার প্রধান লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রয়াণদিবস উপলক্ষে তাকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।