“এ ধরনের মেলায় এলে বুঝতে পারি আমরা কতটা সমৃদ্ধ। আমাদের কত ঐতিহ্যবাহী নান্দনিক পণ্য আছে। কিন্তু সঠিক প্রচার, বিপণন নেই,” বলেন এক দর্শনার্থী।
Published : 29 Dec 2023, 07:23 PM
‘কলিকাতা টাউন আছে/ বড় লাটের বাড়ি আছে/ দার্জিলিংয়ে শহর আছে...’ সুরে সুরে বর্ণনা করে চলেছেন জলিল মণ্ডল। আর তার বায়োস্কোপে চোখ রেখে বসেছে জনা ছয়েক শিশুর দল। সেই দলটির একজন রাইসা।
প্রথমবার বায়োস্কোপ দেখে ‘ভীষণ ভালো’ লেগেছে বলে জানাল সে। রাইসার বাবা রফিক সিকদার মেয়েকে গল্প করে শোনাচ্ছিলেন বায়োস্কোপের সোনালি ঐতিহ্যের কথা।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় বাড়ি জলিল মণ্ডলের। তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে বায়োস্কোপ ফেরি করেন বেড়ান তিনি। তবে এখন আর গ্রামে গ্রামে নয়, বিভিন্ন উৎসব-পার্বণেই বায়োস্কোপ ফেরি করেন বলে জানালেন জলিল।
ভিড়ের ফাঁকেই জলিল মণ্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পারিবারিকভাবেই বায়োস্কোপওয়ালা হয়েছেন তিনি। তবে ধীরে ধীরে এই পেশাটি এখন বিলুপ্ত প্রায়। তবে তিনি এখনও ধরে রেখেছেন পারিবারিক এ পেশা।
জলিলের ভাষ্য, “এখন তো কেউ বায়োস্কোপ দেখতে চায় না। মোবাইল ফোনে ভিডিও দেখে।”
জলিলের বায়োস্কোপে কলকাতা থেকে শুরু করে নানা শহরের চিত্র রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গল্পও শোনান সুরে সুরে। আছে পবিত্র মক্কা ও মদিনা শহরের ছবি।
জলিল বলেন, “চারুকলা, বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠান হইলে তারা ডাকে। সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও বায়োস্কোপের প্রদর্শনী হয়। পথে পথে ঘুরে ঘুরে আর বায়োস্কোপ দেখানো হয় না।”
রাইসার মতো অনেকের জন্য রাজধানীতে বায়োস্কোপ দেখার এই সুযোগ তৈরি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল উৎসবে।
বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ১০৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ উৎসব শুরু হয়েছে শুক্রবার, যা চলবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
মেলায় কেবল বায়োস্কোপ নয়, দেশের ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্যের পসরাও সাজিয়েছেন বিক্রেতারা। তাদের স্টলে এসব পণ্য প্রদর্শনের পাশাপাশি বিক্রি করা হচ্ছে। মেলায় রয়েছে শোলা ও বেতের শিল্পকর্ম, শীতল পাটি, মাটির টেপা পুতুল, আঁকা ছবিসহ অনেক কিছু।
মৌলভীবাজারের অরুণ চন্দ্র দাস এসেছেন শীতলপাটি নিয়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রুনা বেগম আর সোনারগাঁর হোসনে আরা বেগম এসেছেন নকশিকাঁথা নিয়ে। মেলায় রয়েছে রাজশাহীর রতন কুমার পালের পট শিল্প, সুবোধ কুমার পালের মুখোশ শিল্প। রংপুর থেকে শতরঞ্জি নিয়ে এসেছেন আনোয়ার হোসেন।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জের বাসন্তী সূত্রধর এসেছেন পাখা শিল্প নিয়ে। এসেছে শাঁখারীবাজারের অনুপ নাগের শঙ্খ শিল্প, বান্দরবানের জয়শ্রী মারমার কোমর তাঁত শিল্প; কিশোরগঞ্জের সুনীল পাল ও খোকন পালের মাটির পুতুল শিল্পী।
সোনারগাঁর আশুতোষ সূত্রধরের কাঠের পুতুল শিল্প মেলায় দৃষ্টি কেড়েছে। রয়েছে রুবেল রিয়াদের বাঁশি শিল্পও। চারুকলা অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের স্টলও রয়েছে।
মেলার প্রথম দিন শুক্রবার বিকালে দেখা যায় দর্শনার্থীদের ভিড়। কেউ কেউ স্টলে ঘুরে এসব ঐতিহ্যবাহী পণ্য দেখছেন, তার মাঝে পছন্দের পণ্যটি কিনছেনও কেউ।
তিন বন্ধু শাহনাজ, নাঈম, পিংকি এসেছেন মেলায় ঘুরতে। কিন্তু ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকেই একটি গলার হাড় পছন্দ হয় শাহনাজের। সেটি কিনে নেন তিনি।
শাহনাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেলায় তো ঘুরতেই এসেছি। এত সুন্দর সব পণ্য, অনেক কিছুই কিনতে ইচ্ছা করছে। এ ধরনের মেলায় এলে বুঝতে পারি আমরা কতটা সমৃদ্ধ। আমাদের কত ঐতিহ্যবাহী নান্দনিক পণ্য আছে। কিন্তু সঠিক প্রচার, বিপণন নেই।”
উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা
শুক্রবার সকালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই উৎসব। এরপর চারুকলার বকুলতলায় উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল।
উৎসবে জয়নুল মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সম্মাননা প্রদান, শিল্পীদের পুনর্মিলনী ও সাংস্কৃতিক উৎসব।
এ বছর জয়নুল সম্মাননা পেয়েছেন শিল্পী কাজী গিয়াস উদ্দীন ও শিল্পী আবদুস সাত্তার। স্বর্ণপদক পেয়েছেন চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুপ্রিয় কুমার ঘোষ।
এমিরেটাস অধ্যাপক শিল্পী হাশেম খান ও ইমেরিটাস অধ্যাপক শিল্পী রফিকুন নবী তাদের হাতে সম্মাননা তুলে দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, “এ উৎসবটি আরও বিস্মৃত পরিসরে করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সার্বিক পরিস্থিতির কারণে আয়োজনটি ৩ দিনের করা হয়েছে।”
পর্দা নামবে রোববার
চারুকলা অনুষদে জয়নুল মেলা চলবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এ মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
শনিবার সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিত হবে জয়নুল স্মারক বক্তৃতা। এ বক্তৃতা দেবেন কলাতাত্ত্বিক অধ্যাপক আবুল মনসুর।
এদিন বেলা আড়াইটায় অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলার ৭৫ বছর পূর্তির বিশেষ সেমিনার। এ সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন গবেষক সম্পূর্ণা চক্রবর্তী। আলোচক থাকবেন অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক।