তিনি বলেছিলেন, জীবনানন্দের কবিতা বড় জাতের রচনা যদিও তাতে শান্তির অভাব রয়েছে।
Published : 19 Feb 2025, 01:32 AM
আজ তারা কই সব ? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক —পুকুরের জলে
বহু দিন মুখ দেখে গেছে তার ; — তারপর কি যে তার মনে হ’ল কবে
কখন সে ঝ’রে গেল, কখন ফুরাল, আহা — চ’লে গেল কবে যে নীরবে
তাও আর জানি না ক’ ; ঠোঁটভাঙা দাঁড়কাক ঐ বেলগাছটির তলে
রোজ ভোরে দেখা দিত — অন্য সব কাক আর শালিখের হৃষ্ট কোলাহলে
তারে আর দেখি না ক’ — কত দিন দেখি নাই ; সে আমার ছেলেবেলা হবে
জানালার কাছে এক বোলতার চাক ছিল — হৃদয়ের গভীর উৎসবে
খেলা ক’রে গেছে তারা বহু দিন — ফড়িং কীটের দিন যত দিন চলে’’
— ওখানে হিজল গাছ ছিল এক --জীবনানন্দ দাশ
‘রূপসী বাংলা’র কবি খ্যাত জীবনানন্দ দাশ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান বাঙালি আধুনিক কবি, লেখক, ও প্রাবন্ধিক। তিনি যে শুধু ‘রূপসী বাংলা’র কবি হিসেবে পরিচিত তা নয়; বুদ্ধদেব বসু তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন ‘নির্জনতম কবি’ হিসেবে। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে জীবনানন্দ ছিলেন ‘শুদ্ধতম কবি’। ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বরিশালে তাঁর জন্ম। নিজের জীবদ্দশায় তিনি প্রায় ২৬৯ টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। সেগুলোর মধ্য থেকে মোট ১৬২ টি কবিতা তাঁর ৬ টি কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল। কবিতার পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাস। বেকার অবস্থায় তিনি যখন সস্ত্রীক বরিশালে পিতৃগৃহে অবস্থান করেন, তখন তাঁর হাতে অনেক সময় ছিল। সেই অবসর সময়ে তিনি প্রচুর লিখতেন। ১৯৩১ সালে তিনি গল্প লিখতে শুরু করেন; প্রথম বছরেই গল্প লেখেন ১৪ টি। ১২৩২ সালে ‘প্রেতিনীর রূপকথা’ ও ‘নিরুপম যাত্রা’ শিরোনামে দুটি উপন্যাস লেখেন।
কবি, লেখক, ও প্রাবন্ধিক হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন পত্রলেখক। পত্র লেখা নিয়ে তিনি তাঁর ‘লেখার কথা’ নিবন্ধে বলেছেন, ‘’কেউ অনেক মাথা ঘামিয়ে কাটাকুটি করে তবে চিঠির খসড়া দাঁড় করাতে সক্ষম হন, আবার কেউ কেউ তরতর করে লিখে ফেলেন; তার কিছু সাহিত্য হিসেবে গৃহীত হওয়ার যোগ্য।‘’ জীবনানন্দ খুব যত্ন নিয়ে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। তাঁর লেখার খাতায় পাওয়া গিয়েছে বহু চিঠির খসড়া এবং সেই সাথে পাওয়া গিয়েছে যাদেরকে চিঠি লিখবেন বলে মনস্থির করেছেন তাদেরও একটি তালিকা। সেই তালিকা দেখে বোঝা যায় যে, চিঠির মাধ্যমে আত্নীয়স্বজনের পাশাপাশি তিনি যোগাযোগ করতেন বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদকদের সাথে।
কবি জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলির বিষয়বস্তু কি ছিলো? বলা হয়ে থাকে, তাঁর চিঠি-পত্রে কবিতা ও সাহিত্যের কথাই বেশি এসেছে। সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘’চিঠিপত্রে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ কবি ছিলেন তিনি। তাঁর চিঠি পেলে মনে হত, সব সময় তিনি কবিতার কথা ভাবেন। এমন তো কেউ ভাবেন না, রবীন্দ্রনাথেরও অন্যান্য ভাবনা আছে, কিন্তু কবিতার দুর্ভাবনা ছাড়া কি এই ব্যক্তিটির ভাবনার মত আর কিছু নেই।‘’
জীবনানন্দের চিঠি থেকে জানা যায় তাঁর সাহিত্যিক মতাদর্শ, কবিতার নির্ভুল ও যথাযথ মুদ্রণ নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা, আর্থিক দুরবস্থা ও অন্যের প্রতিভার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা। তাঁর লেখা চিঠি-পত্রের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই একজন সৌজন্যসুন্দর ব্যক্তিত্বকে; যিনি আত্নবিশ্বাসী, বিনয়ী, সংযমী, শ্রদ্ধাশীল ও আত্নমর্যাদা সচেতন।
রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে জীবনানন্দের কবিত্বশক্তির স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জীবনানন্দের কবিতা বড় জাতের রচনা যদিও তাতে শান্তির অভাব রয়েছে। সেই চিঠির প্রত্যুত্তরে জীবনানন্দের লেখা চিঠিটিও যেন একটি শিল্পকর্ম। চিঠিটি ছিল দীর্ঘ। এর একটি অংশে তিনি লেখেন,
‘’পত্রে আপনি যে কথা উল্লেখ করেছেন সেই সম্পর্কে দুএকটি প্রশ্ন মনে আসচে। অনেক উঁচু জাতের রচনার ভেতর দুঃখ বা আনন্দের একটা তুমুল তাড়না দেখতে পাই। কবি কখনও আকাশের সপ্তর্ষিকে আলিঙ্গন করবার জন্য উৎসাহে উন্মুখ হ’য়ে ওঠেন—পাতালের অন্ধকারে বিষজর্জর হ’য়ে কখনও তিনি ঘুরতে থাকেন। কিন্তু এই বিষ বা অন্ধকারের মধ্যে কিম্বা এই জ্যোতির্লোকের উৎসের ভেতরেও প্রশান্তি যে খুব পরিস্ফুট হ’য়ে উঠেছে তা তো মনে হয় না। প্রাচীন গ্রীকরা serenity জিনিসটার খুব পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁদের কাব্যের মধ্যেও এই সুর অনেক জায়গায় বেশ ফুটে উঠেছে। কিন্তু যে জায়গায় অন্য ধরনের সুর আছে, সে কাব্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে ব’লে মনে হয় না। দান্তের Divine Comedyর ভেতর কিম্বা শেলীর ভেতর serenity বিশেষ নেই। কিন্তু স্থায়ী কাব্যের অভাব এঁদের রচনার ভেতর আছে ব’লে মনে হয় না।‘’
চিঠিটিতে তিনি আরোও লেখেন,
‘’সকল বৈচিত্র্যের মতো সুরবৈচিত্র্যও আছে সৃষ্টির ভেতর। কোনো একটা বিশেষ ছন্দ বা সুর অন্য সমস্ত সুর বা ছন্দের চেয়ে বেশি করে স্থায়ী স্থান কি করে দাবি করতে পারে? আকাশের নীল রং, পৃথিবীর সবুজ রং, আলোর শ্বেত রং কিম্বা অন্ধকারের কালো রং—সমস্ত রংগুলিরই একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ আছে। একটিকে অন্যটির চেয়ে বেশি সুন্দর বা সুচির বলা চলে ব’লে মনে হচ্ছে না। এই অন্ধকার, এই আলো, আকাশের নীল, পৃথিবীর শ্যামলিমা—সবই তো সুচির, সুন্দর। সৌন্দর্য ও চিরত্বের বিচার তাই একটু অন্য রকমের ব’লে মনে হয়। ঘুড়ির কাগজের সবুজ, নীল, শাদা বা কালো রং যখন পৃথিবী, আকাশ, প্রভাত বা রাত্রির বর্ণের সৌন্দর্য ও স্থায়িত্বের দাবি ক’রে বসে তখন আর কোনো প্রসঙ্গের প্রয়োজন থাকে না। আমার তাই মনে হয়, রচনার ভেতর যদি সত্যিকার সৃষ্টির মর্যাদা থাকে তা হলে তার ভেতরকার বিশিষ্ট সুরের প্রশ্নটি হয়তো অবহেলাও করা যেতে পারে। শান্তি বা serenityর সুরে কবিতা বেঁধেও সত্যিকারের সৃষ্টির প্রেরণার অভাব থাকলে হয়তো তাও নিষ্ফল হ’য়ে যায়।‘’
জীবনানন্দ ছিলেন ইর্ষাহীন একজন মানুষ। অন্যের প্রতিভার প্রতি তাঁর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। অন্যের কীর্তিকে তিনি সম্মান করতেন। রবি ঠাকুরকে লেখা অন্য একটি পত্রে তিনি তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার প্রশংসা ও তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে লেখেন,
‘’শ্রীচরণেষু,
আপনি আধুনিক পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও মনীষী। আপনি মহামানব।
আপনার সাহিত্যসৃষ্টি ও জীবন পৃথিবীর ইতিহাসে এক গভীর বিস্ময় ও গরিমার জিনিস। জার্মান সাহিত্যে Goethe, ইংরেজি সাহিত্যে Shakespeareএর যে স্থান আমাদের দেশের সাহিত্যের ইতিহাসে আপনার সেই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা।”
এবং এই চিঠিটিতেই তিনি উল্লেখ করেন যে, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পাওয়া পূর্বোক্ত চিঠিটি তাঁর কাছে একটি মূল্যবান সম্পদ।
তাঁর লেখা চিঠি-পত্রের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠি বিখ্যাত। তবে রবি ঠাকুর ছাড়াও তিনি চিঠি লিখেছেন আরোও অনেককে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দেবীপ্রাসাদ চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সাগরময় ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অশোক মিত্র, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখ।
তিনি যে শুধু কবি-সাহিত্যিক বা সম্পাদকদের চিঠি লিখেছেন তা নয়। নিজের পাঠক ও অনুরাগীকেও তিনি চিঠি লিখেছেন। এমনই একজন জীবনানন্দ পাঠক ও অনুরাগী ছিলেন প্রভাকর সেন। সেই চিঠিতে কবি তাঁর রচনা পদ্ধতি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন,
‘’যখনই ‘ভাবাক্রান্ত’ হই, সমস্ত ভাবটা বিভিন্ন আঙ্গিকের পোষাকে ততটা ভেবে নিতে পারি না, যতটা অনুভব করি,—একই এবং বিভিন্ন সময়ে। অন্তঃপ্রেরণা আমি স্বীকার করি। কাব্য সম্পর্কে ইংরেজিতে imagination শব্দটি প্রচলিত আছে, এর বাংলা কি?—যে কবির কল্পনাপ্রতিভা আছে সে ছাড়া আর কেউ কাব্যসৃষ্টি করবার মত অন্তঃপ্রেরণার দাবি করতে পারে কি? এবং এ প্রেরণা ছাড়া শ্রেষ্ঠ কবিতা লেখা কি করে সম্ভব হতে পারে? যদিও কোনো কোনো কবি এর তাগিদ সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে চান, তবুও তাঁদের ভালো কবিতা প’ড়ে বোঝা যায় যে তাদের আত্নালোচনায় অসম্পূর্ণতা রয়েছে। বুদ্ধিমান এমনকি জ্ঞানী-বিজ্ঞানী মানুষের পক্ষেও নিছক বিজ্ঞান বা জ্ঞানসম্ভার বলে প্রায় mechanically মহৎ কবিতা লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু ভাব-প্রতিভাজাত এই অনুপ্রেরণাও সব নয়, তাকে সংস্কারমুক্ত শুদ্ধ তর্কের ইঙ্গিত শুনতে হবে, এ জিনিস ইতিহাসচেতনায় সুগঠিত হওয়া চাই।
এই সব কারণেই—আমার পক্ষে অন্তত—ভালো কবিতা লেখা কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার নয়, কবিতাটিকে প্রকৃতিস্থ ক’রে তুলতে সময় লাগে। কোনো কোনো সময় কাঠামোটি, এমনকি প্রায় সম্পূর্ণ কবিতাটিও খুব তাড়াতাড়ি সৃষ্টিলোকী হয়ে ওঠে। কিন্তু তারপর—প্রথম লিখবার সময় যেমন ছিল তার চেয়ে বেশি স্পষ্টভাবে—চারিদিককার প্রতিবেশচেতনা নিয়ে শুদ্ধ প্রতর্কের আবির্ভাবে কবিতাটি আরো সত্য হয়ে উঠতে চায় : পুনরায় ভাবপ্রতিভার আশ্রয়ে। এরকম অঙ্গাঙ্গি-যোগে কবিতাটি পরিণতি লাভ করে।‘’
একই চিঠিতে তিনি তাঁর কাব্যপ্রেরণার উৎস নিয়ে বলেন,
‘’আমার কাব্যপ্রেরণার উৎস নিরবধি কাল ও ধূসর প্রকৃতির চেতনার ভিতর রয়েছে বলেই তো মনে করি। তবে সে প্রকৃতি সব সময়ই যে ‘ধূসর’ তা হয়তো নয়।‘’
এসবকিছুর পাশাপাশি, নিজের কবিতা কিংবা বই পাঠানো, কবিতার নাম ঠিক করা ,অথবা প্রুফ দেখা ও তা ফেরত দেওয়া—বিষয়গুলো নিয়েও তিনি চিঠি লিখতেন। ঘুরে ফিরে দেখা যায়, তার চিঠিপত্রে মূল বিষয় ছিল কবিতা। তিনি ভাবতেন, লিখতেন। তার ভাবনা জুড়ে ছিল কবিতা, শব্দ ও বিভিন্ন চরণ কিংবা কবিতার শিরোনাম। তিনি নিজের কবিতা ভালোবাসতেন, কবিতার বই অন্যদের পাঠিয়ে তা নিয়ে মতামত বা মূল্যায়ন জানতে চাইতেন। তাঁর পাঠক ও অনুরাগীদের চিঠির উত্তর দিতেন। তিনি জীবনানন্দ দাশ যিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন ধূসর পাণ্ডুলিপি, রূপসী বাংলা, ও বনলতা সেনের মতো সব কাব্যগ্রন্থ এবং ভালোবেসেছেন এ বাংলার মাঠ-ঘাট, প্রকৃতি, পাখির ডাক ও আকাশের নীলিমা।
তথ্যের উৎস: ফয়জুল লতিফ চৌধুরী সম্পাদিত ও পাঠক সমাবেশ প্রকাশিত দুটি বই: 'জীবনানন্দ পত্রাবলি' ও 'বাংলার ত্রস্ত নীলিমা'