পুনঃপাঠ: আলালের ঘরের দুলাল

‘আলালের ঘরের দুলাল’ নিজের জন্য ইতিহাসে তো বটেই, বর্তমানেও জায়গা করে নিয়েছে।

জাকির তালুকদারজাকির তালুকদার
Published : 12 Jan 2023, 05:40 PM
Updated : 12 Jan 2023, 05:40 PM

বাংলা চলিত ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস প্যারীচাঁদ মিত্র-র ‘আলালের ঘরের দুলাল’।

প্রথম প্রকাশের সময় লেখকের নাম ছাপা হয়েছিল টেকচাঁদ ঠাকুর। পরে জানা যায়, প্যারীচাঁদ মিত্রই ছদ্মনামে এই উপন্যাসটির লেখক। গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে ‘মাসিক পত্রিকা’ নামক একটি সাহিত্যের কাগজে উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানেও লেখক ছদ্মনাম ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ই ব্যবহার করেছিলেন। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলা ১২৬৪ সনে, কলিকাতা রোজারিও কোম্পানির যন্ত্রালয় থেকে মুদ্রিত হয়ে।

‘আলাল’ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন-- ‘উহার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট গ্রন্থ তৎপরে কেহ প্রণীত করিয়া থাকিতে পারেন, অথবা ভবিষ্যতে কেহ করিতে পারেন, কিন্তু “আলালের ঘরের দুলাল” দ্বারা বাঙ্গালা সাহিত্যের যে উপকার হইয়াছে, আর কোন বাঙ্গালা গ্রন্থের দ্বারা সেরূপ হয় নাই এবং ভবিষ্যতে হইবে কি না সন্দেহ।’

কী সেই উপকার?

বঙ্কিমই জবাব দিচ্ছেন-- ‘উহাতেই প্রথম এ বাঙ্গালা দেশে প্রচারিত হইল যে, যে বাঙ্গালা সর্ব্বজনমধ্যে কথিত এবং প্রচলিত, তাহাতে গ্রন্থ রচনা করা যায়, সে রচনা সুন্দরও হয়, এবং সর্ব্বজন-হৃদয়-গ্রাহিতা সংস্কৃতানুযায়িনী ভাষার পক্ষে দুর্লভ, এ ভাষার তাহা সহজ গুণ।’

বোঝা যাচ্ছে, ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর আগে এমন কোনো বাংলা বই প্রকাশিত হয়নি, যার ভাষা সাধারণ মানুষের কথ্যভাষার সাথে মিল রেখে লেখা। এর আগে যেসব বই লেখা হয়েছে সেগুলা পড়ার জন্য সংস্কৃত অভিধান বই পাশে নিয়ে বসতে হয়েছে পাঠককে। এখানেই এই উপন্যাসের অনন্যতা।

প্যারীচাঁদ মিত্র ছিলেন বাঙালির নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ডিরোজিও-র শিষ্য। ডিরোজিও-র আরেক শিষ্য ছিলেন রাধানাথ শিকদার। তিনি এভারেস্টের উচ্চতা নির্ণয় করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। রাধানাথ শিকদার তার বন্ধুদের উৎসাহিত করলেন এমনসব লেখাসমৃদ্ধ একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে যার ভাষা ‘স্ত্রীলোকগণ বুঝিতে পারিবে’। এর আগে বাংলায় যতগুলি পত্রিকা ছিল, সংস্কৃত ভাষা না জানলে সেগুলো বোঝার সাধ্য কারো ছিল না। প্যারীচাঁদ দায়িত্ব নিলেন। পত্রিকা বের হলো। লেখকের সংখ্যা তখন দেশে নিতান্তই কম। অপণ্ডিত পাঠকের জন্য সহজ বাংলায় লিখতে পারেন, এমন লেখকের সংখ্যা আরো কম। তাই বাধ্য হয়ে সম্পাদককে একাই বিভিন্ন নামে বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে হতো। সেই কারণেই ‘আলালের ঘরের দুলাল’ লেখার জন্য তাঁকে টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনাম গ্রহণ করতে হয়।

উপন্যাসের বিষয় আমাদের পরিচিত। অতিরিক্ত আদরে এবং প্রশ্রয়ে ধনীপুত্রের বখে যাওয়ার ঘটনা। উপন্যাসে আলালের ঘরের দুলাল বা বখে যাওয়া সন্তান হচ্ছে মতিলাল। পিতা বাবুরাম। জমিদারি এবং ব্যবসা করে বাবুরাম বিস্তর অর্থবিত্ত অর্জন করেছেন। তার একমাত্র পুত্র মতিলাল। স্বভাবকৃপণ বাবুরাম একমাত্র মতিলালের ব্যাপারে উদারহস্ত। মতিলালকে প্রথমে সংস্কৃত পণ্ডিতের কাছে পাঠানো হলো। মতিলালের অত্যাচারে পণ্ডিত পালিয়ে বাঁচলেন। এরপরে মৌলানা সাহেবকে নিযুক্ত করা হলো ফারসি শেখানোর জন্য। ফলাফল একই। তারপরে মতিলালকে কলিকাতায় পাঠানো হলো ইংরেজি স্কুলে পড়ার জন্য। বৌবাজারে আত্মীয় বেচারামবাবুর বাড়িতে থেকে মতিলাল ইংরেজি স্কুলে পড়বে। লেখক জানাচ্ছেন, প্রথম যখন ইংরেজরা কলিকাতায় বাণিজ্য করতে এল তখন বসাকরা সেখানকার প্রধান ব্যবসায়ী। কিন্তু কেউ কোনো ইংরেজি শব্দ জানে না। তাই ইশারার মাধ্যমেই ব্যবসা শুরু হলো। কিছুদিন পরে দুই-চারটি ইংরেজি শব্দ শিখে নিয়ে কেউ কেউ দোভাষী হয়ে বিস্তর উপার্জন করতে শুরু করল। কলিকাতায় আদালত স্থাপিত হলে ইংরেজি শেখার প্রয়োজন আরো বেড়ে যায়। ঐ সময় রামরাম মিশ্র এবং আনন্দিরাম দাস বেশ কয়েকটি ইংরেজি শব্দ শিখেছিলেন। রামরামের কাছ থেকে শব্দগুলো শিখেছিলেন তার শিষ্য রামনারায়ণ মিশ্র। তিনি ইংরেজি শেখার স্কুল খুললেন। প্রত্যেক ছাত্রের কাছ থেকে বেতন নিতেন মাসে ১৪/১৫ টাকা। বাঙালিদের এমন ব্যবসা দেখে কয়েকজন ইংরেজ সাহেব নিজেরাই স্কুল খুললেন। উপন্যাসে কথিত সরবোর্ন সাহেব এবং কালুজ সাহেব তাদের অন্যতম। মতিলাম প্রথমে সরবোর্ন সাহেব, পরে কালুজ সাহেবের স্কুলে ইংরেজি শিখতে ভর্তি হলো।

স্কুলে মাসে মাসে বেতন দেওয়াই যথেষ্ট ছিল। কোনো ছাত্র পড়ছে কি না, শিখছে কি না, তা নিয়ে সাহেবদের মাথাব্যথা ছিল না। মতিলালের জন্য একেবারে উপযুক্ত পরিবেশ। সে দুই সঙ্গী হলধর এবং গদাধরকে নিয়ে ষাঁড়ের মতো ঘুরে বেড়ায়। টাকার অভাব নেই। পিতাকে বিভিন্ন খাত দেখিয়ে টাকা পাঠাতে বলে। আবার সপ্তাহান্তে বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছ থেকে টাকা নেয়। পুত্রস্নেহে অন্ধ মা তার স্বামীকে না জানিয়ে বাড়তি টাকা তুলে দেয় মতিলালের হাতে। মতিলাল সেই টাকায় ফুর্তি করে ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে। পায়রা ওড়ায়, বুলবুলির লড়াইতে টাকা ঢালে, ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা করে, তাস-পাশা খেলে সময় কাটায়। বাঈজীবাড়িতে খেমটা নাচ দেখে টাকা ওড়ায়। মতিলাল ও তার সঙ্গীদের পোশাকের খরচও অনেক। ’সর্ব্বদাই ফিটফাট-- মাথায় ঝাঁকড়া চুল, দাঁতে মিসি-- সিপাই পেড়ে ঢাকাই ধূতি পরা-- বুটোদার একলাই ও গাজের মেরজাই গায়-- মাথায় জড়ির তাজ-- তাহে আতরে ভুরভুরে রেসমের রুমাল ও ছড়ি-- পায়ে রূপার বকলসওয়ালা ইংরাজী জুতা। ভাত খাইবার অবকাশ নাই কিন্তু খাস্তার কচুরি, খাসা গোল্লা, বরফি, নিখুতি, মনোহরা ও গোলাবি খিলি সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে।’ পাড়ার লোকেরা তাদের জ্বালায় অস্থির। পাড়ার যত বখাটে সবাই জুটে যায় মতিলালের সঙ্গে। বৈঠকখানা ঘরে রোজ বসে গাঁজা-চরস-তামাকের আড্ডা। দুর্গন্ধ আর ধোঁয়ায় পাড়ার লোকের তিষ্টানো দায়।

একদিন রাস্তায় মতিলালাকে পাকড়াও করে পুলিশ। লোকে অভিযোগ করেছে তার বিরুদ্ধে। পুলিশের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে জোরাজুরি করায় বেশ কয়েক ঘা খেতে হয় মতিলালকে। তারপর তাকে থানার মেঝেতে ফেলে রাখা হয়।

খবর পাওয়ামাত্র মা জ্ঞান হারালেন। আর পিতা বাবুরাম কী করবেন তা স্থির করতে পারেন না। পুলিশ, আদালত, মামলা-- এগুলি সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা নেই। তখন খোঁজ পরে ঠক চাচার।

এই উপন্যাসে ঠক চাচা একটি আশ্চর্য জীবন্ত চরিত্র। নাম মোকাজান মিয়া। কিন্তু আসল নাম ভুলে গেছে লোকে। এই নামেই তাকে ডাকা হয়, এবং সে বিনাদ্বিধায় সাড়া দেয়। মামলার জাল কাগজ তৈরিতে সে পটু, মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে দক্ষ, অন্য সাক্ষীদেরও শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে কোনো সমস্যা নেই তার। সেইসাথে আছে সবার কাছে তদবিরে ছুটে যাওয়ার দক্ষতা। এত এত খারাপ কাজ করে বলে তার কোনো অনুশোচনা নেই। যুক্তি হিসাবে বলে-- ‘দুনিয়া সাচ্চা নয় মুই একা সাচ্চা হয়ে কি করবো?’

মতিলালের মামলার তো সুরাহা হলো অনেক টাকা খরচ করে। কিন্তু ঠকচাচা আর কাছছাড়া হলো না বাবুরামের। তার পরামর্শ ছাড়া চলেই না বাবুরামের। এবং সেই পরামর্শে একের পর এক বিষয়ে লালবাতি জ্বলতে থাকে আর পয়সা ওঠে ঠকচাচার পকেটে।

সেকালে লোকের পরমায়ু বেশি ছিল না। মতিলালের বয়স কুড়ি বছর হবার আগেই মৃত্যু ঘটল বাবুরামের। তারপরে তো মতিলালের রাজত্ব। বাবার এত কষ্টে অর্জিত টাকা-পয়সা, বিষয়-সম্পত্তি উড়িয়ে দিতে মতিলালের বেশি সময় লাগল না।

এই হচ্ছে সংক্ষেপে ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর বিষয়বস্তু।

বিশেষত্বের কথা বলা হয়েছে শুরুতেই। বলা হয়েছে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস এটি।

তাছাড়াও এই উপন্যাসের আরেকটি বিশেষত্ব রয়েছে। তা হচ্ছে-- ভাষাটি তথা উপন্যাসটি চিত্ররূপময়। প্যারীচাঁদ মিত্র এমনভাবে লিখেছেন উপন্যাসটি, পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে হবে তার চোখের সামনে একের পর এক ছবি ফুটে উঠছে। যেমন কোলকাতার একটি বর্ণনায় আমরা পাচ্ছি-- ‘রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে-- কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে-- বল্দেরা গরু লইয়া চলিয়াছে-- ধোবার গাধা থপাস থপাস করিয়া যাইতেছে-- মাছের ও তরকারির বজরা হু হু করিয়া আসিতেছে-- ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিতেছেন-- মেয়েরা ঘাটে সারি সারি হইয়া পরস্পর মনের কথাবার্তা কহিতেছে।’

সেইসাথে উপন্যাসের অনন্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য। মতিলাল, বাবুরাম যদিও সেই সময়ের উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি, তবু তাদের পাশাপাশি সমাজের সবশ্রেণীর মানুষের কথাই উঠে এসেছে উপন্যাসে। নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ এর আগে কখনো উঠে আসেনি আমাদের ভদ্রশ্রেণীর সাহিত্যে। প্যারীচাঁদ মিত্র এই কারণেই আখ্যায়িত হয়েছেন ‘বাংলার ডিকেন্স’ নামে। যদিও কাউকে পাশ্চাত্যের কারো সাথে তুলনীয় করে প্রতিভার বিচার করাটা ঔপনিবেশিক মানসিকতারই ফসল।

‘আলালের ঘরের দুলাল’ নিজের জন্য ইতিহাসে তো বটেই, বর্তমানেও জায়গা করে নিয়েছে। সেই সময় বঙ্কিমের ভাষাই উপন্যাসের ভাষা হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এসে বাংলা গল্প-উপন্যাস ‘হুতোমী’ ভাষা ও ভঙ্গির পাশাপাশি ‘আলালী’ ভাষাকেই গ্রহণ করেছে।