সম্প্রতি ভারতের Outlook পত্রিকায় প্রাবন্ধিক ও নজরুল-গবেষক অর্ক দেব-এর একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে কোলকাতায় এক সময় নজরুলের বাসস্থান ও কর্মস্থল সংরক্ষণে অনীহা ও অবজ্ঞা নিয়ে। bdnews24.com-এর আহবানে লেখক সেটি বাংলা সংস্করণ তৈরি করেছেন।
Published : 27 May 2023, 02:32 PM
সম্প্রতি আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জর্জিয়ায় রুশ কবি মায়াকোভস্কির বাল্যকাল যে বাড়িটায় কেটেছে তা দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁর পাঠানো ছবিতেই দেখছিলাম ঢালু ঘাসজমিতে বসানো মায়াকোভস্কির মূর্তি। দোতালা বাড়িটা ঠিক যেমন ছিল তেমন রাখা। মায়াকোভস্কির বেশ কিছু বইয়ের প্রথম সংস্করণ, নোটখাতা, ছবি পরম যত্নে তুলে রাখা। আয়ু চলে গেলেও থাকবে অক্ষরের পরমায়ু, মনে করিয়ে দিচ্ছিল এই যত্ন। একজন ক্রান্তদর্শী কবির যেমন যত্ন প্রাপ্য, ঠিক তেমন, মাপা, নিখুঁত। সে সময়ে আমি নজরুল ইসলাম বিষয়ক গবেষণার কাজের মধ্যে ছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রথম প্রশ্ন জাগে, আমার শহর কলকাতায় নজরুলের বাসস্থানগুলির কী অবস্থা? বাসস্থানগুলি বলছি কারণ একজায়গায় থিতু হওয়ার মানুষ ছিলেন না নজরুল। কখনও ভাগ্য, কখনও স্বভাব, কখনও আবার পরিস্থিতি তাঁকে নানা জায়গায় ঘুরিয়েছে৷ মনে মনে ঠিক করি জায়গাগুলি ঘুরে দেখব।
আমার প্রথম গন্তব্য ছিল ৭, প্রতাপ চ্যাটার্জী লেন। গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছিল কলেজ স্ট্রিট লাগোয়া গলি। কলকাতা মেডিকেল কলেজের উল্টোদিকে। হাতের তালুর মতো চেনা কলেজ স্ট্রিট, কিন্তু এই রাস্তাটা যেন ঠিক ঠাওর করতে পারছিলাম না। সামনে দু'একটা কানাগলি (উত্তর কলকাতায় যা সাপের মতো ছড়িয়ে আছে) দেখলেও বুঝতে পারছিলাম না গন্তব্যে পৌঁছতে সেখানেই ঢুকব কিনা। আশেপাশে ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়া বাড়ি, নীচের তলায় ওষুধের দোকান। দু'একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, "এখানে নজরুল ইসলামের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?" অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ওঁরা। বোঝা গেল এ বিষয়ে কোনো তথ্যই তাদের কাছে নেই। ফুটপাথের উপর মন দিয়ে রোল ভাজছেন এক ব্যক্তি, নাম সুবল দাস। সামনে অপেক্ষা করছেন মেডিকেল কলেজে ভর্তি রোগীদের বিষণ্ন ক্লান্ত আত্মীয়রা। অতিব্যস্ত সুবল দাসকে একটু বিরক্তই করা হলো। এবার আর নজরুল নয়, বললাম দাদা প্রতাপ চ্যাটার্জী লেনটা কোন দিকে বলতে পারেন? একটা শিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিনি পরোটা ভাজছিলেন। সেই শিকটাই শূন্যে তুলে কম্পাসের মতো ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিলেন দু'দশ কদম সোজা হেঁটে ডানদিকে ঢুকতে হবে৷ তাঁর কথা মতোই ঢুকে পড়লাম গলিটায়। মিনিট খানেক হাঁটতেই চলে এল গন্তব্য। ৭, প্রতাপ চ্যাটার্জী লেন। সবার আগে চোখে পড়ল পুরসভা হলুদ সাইনবোর্ড বসিয়েছ বাড়ির গায়ে। তাতে লেখা বিপজ্জনক বাড়ি! এমন আক্ষরিক উপমা দেখতে পাব কল্পনাও করিনি।
বাড়িটি বিপজ্জনকই বটে। ইতিহাসের দিকনির্দেশ তেমনই। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে গেলে নজরুল ইসলাম কলকাতায় আসেন। কলকাতায় এসে প্রথমে অবশ্য নজরুল শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের রমাকান্ত স্ট্রিটের বোর্ডিং হাউসে উঠেছিলেন। দিন তিনেক সেখানে থাকার পর তাঁর মুসলমান আত্মপরিচয় জেনে ওই বোর্ডিংয়ের ভৃত্য তাঁর বাসন ধুতে অস্বীকার করে। অস্বস্তিতে পড়ে শৈলজানন্দ নজরুলকে ২০ বাদুরবাগান রো-তে তাঁর মাতামহের খালি বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেও নজরুল রাজি হননি। তিনি ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে মুজাফফর আহমেদ-এর সঙ্গে থাকতে চলে আসেন সেই সময়ে। সে বছর ৬ টার্নার স্ট্রিট, ৩/৪ সি তালতলা লেন, ৭ নম্বর প্রতাপ চ্যাটার্জী লেনে-পালা করে থেকেছেন নজরুল। নজরুল জীবনীকাররা মনে করেন নজরুল সম্পাদিত পত্রিকা ধূমকেতুর অফিস হিসেবে ৩২ কলেজ স্ট্রিটের ঠিকানা এত বেশি জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল যে পুলিশের দৃষ্টি এড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এমনকী সহযোগী আফজালুল হক গ্রেফতারও হন। গ্রেফতারি এড়াতেই নজরুল প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনের ঠিকানা বেছে নেন। সেখানে তিনি থাকতেন, আবার ধূমকেতুর কাজকর্মও চলত। ১৯২২ সালের ৮ নভেম্বর নজরুলের গ্রেফতারির পরোয়ানা হাতে যখন পুলিশ এই অফিসে হানা দিল তখনও পুরদস্তুর কাজ চলছে। বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত পুলিশের জুতোর শব্দ পেয়েই পালিয়ে যান। মুজাফফর আহমেদের স্মৃতিকথায় সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে এই ঘটনা। তাঁকে নজরুলের গ্রেফতারির পরোয়ানা দেখানো হলে তিনি বলেন, নজরুল কলকাতার বাইরে, সমস্তিপুরে রয়েছেন। পুলিশ তাঁকে সরকারি অর্ডার দেখান যেখানে স্পষ্টই জানান দেওয়া ছিল- ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ধূমকেতুতে প্রকাশিত নজরুলের লেখা কবিতা তথা সম্পাদকীয় 'আনন্দময়ীর আগমনে' এবং লীলা মিত্রর লেখা ছোট রচনা 'বিদ্রোহীর কৈফয়ত'-এর জন্য সংখ্যাটিকে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং সম্পাদক নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে গ্রেফতারির পরোয়ানা জারি হয়।
নজরুল গ্রেফতার হন ২৩ নভেম্বর,১৯২২। কিন্তু তিনি গ্রেফতার হলেই যাতে ধূমকেতু বন্ধ না হয়, অন্তত কয়েকটি সংখ্যা যাতে প্রকাশ করা যায় সে ব্যবস্থা করেই ধরা দিয়েছিলেন নজরুল।গ্রেফতারির আগের দিন পত্রিকার স্বত্ব তিনি লিখে দেন বীরজাসুন্দরী দেবীকে। ফলে নজরুলের গ্রেফতারির খবর কিন্তু নজরুলের গ্রেফতারির পরে ধূমকেতুতেই বেরিয়েছিল। আইন ফাঁকি দেওয়া প্রসঙ্গে পাঠকের মনে পড়তে পারে অমৃতবাজার পত্রিকার কথা। ১৮৭৮ সালের ১৪ মার্চ দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন জারি হতেই অমৃতবাজারের সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ কাগজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে রাতারাতি ভাষা বদলে ইংরেজি করে ফেলেন।
বিচারাধীন বন্দি হিসেবে নজরুল চার পাতার যে বক্তব্য আদালতে পেশ করেন তা-ই ২৭ জানুয়ারি ধূমকেতুর শেষ সংখ্যায় ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ নামে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি বলছেন-
"আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে কিন্তু ন্যায় বিচারে সেই বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু ধর্মের আলোকে , ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরাপরাধ, নিস্কলুষ, অম্লান, অনির্বান সত্য স্বরূপ।"
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই কাগজের সম্পাদকীয়তেই ‘ধূমকেতুর পথ’ প্রবন্ধে প্রথম প্রকাশ্যে পরিষ্কারভাবেস্বাধীনতার দাবি তোলেন। সেখানে লেখা হচ্ছে-
"সর্ব্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজটরাজ বুঝি না। কেননা, ও কথাটার মানে একেকরকম মহারথী এক একরকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীদের অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসন ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে।"
যে সময়ে দাঁড়িয়ে স্বরাজের প্রবক্তারা ডোমিনিয়ন স্টেটাস বা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দাবি করছেন, গান্ধীর অসহযোগ মুখ থুবড়ে পড়ছে, শাসনযন্ত্রের রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে এই দলিল তৈরি করা খুব সহজ কথা নয়।যেমন সহজ নয় সহবন্দিদের নিপীড়নের প্রতিবাদে জেলখানায় টানা ৩৯ দিন অনশন।
৭, প্রতাপ চ্যাটার্জী লেনের বাড়িটার সঙ্গে যে শুধু ধূমকেতুর স্মৃতিই জড়িয়ে আছে তাই-ই নয়। ধূমকেতুর আগে নজরুল-মুজফফর জুটি ‘নবযুগ’ বলে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সেই কাগজে নজরুল যে সম্পাদকীয়গুলি লেখেন সেগুলি যুগবাণী নামক বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। বইটি ব্রিটিশ সরকার তৎক্ষণাৎ বাজেয়াপ্ত করে। বইটিতে মুদ্রক হিসেবে আর্য পাবলিশিং-এর কর্ণধার শরৎচন্দ্র গুহর নাম থাকলেও প্রকাশক হিসেব দেওয়া ছিল নজরুলের নাম আর প্রকাশ ঠিকানা দেওয়া ছিল ৭, প্রতাপ চ্যাটার্জী লেন। এই সূত্রেই ব্রিটিশ পুলিশ এই বাড়িটিতে হানা দেয়। নজরুল বারুদসংকুল পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হননি, দ্বিধাবোধ করেননি। নিজেকে বাঁচিয়ে মহৎ সৃষ্টি করতে চাননি। বাজি রেখেছেন জীবন।
এমন গৌরবময় ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে বাড়ি তা সযত্নে রক্ষিত হবে, এমনটা চাইবেন সকলেই। কিন্তু আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখি, এই বাড়ির সঙ্গে জড়িত কেউ আজ নজরুল সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না। বাড়িটির একতলায় কাজ করছিলেন কিছু কাঠমিস্ত্রি। দোতলার ভাঙাচোরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতেই চোখে পড়ল তিনটি ঘর। পরিত্যক্ত। তালাবন্ধ, ধুলোমলিন। সামনে জমে আছে শতাব্দীর জঞ্জাল। সেসব সরিয়ে এগিয়ে যাই। মনে পড়ে মুজাফফর আহমেদের স্মৃতিকথায় পড়েছি এই বাড়ির তিনটি প্রশস্ত ঘরের কথা, যে ঘরগুলিতে ‘ধূমকেতু’র অফিস চলছে আবার নজরুল থাকছেনও। কল্পনা করি সেই আগুনরঙা দিন। হলুদ পাঞ্জাবি পরা কবি বিপ্লবীদের শোনাচ্ছেন রাত জেগে লেখা- ‘বিদ্রোহী’। দেখতে পাই নিউজরুমের ব্যস্ততা, দেশ দশের জন্য ভাবনায় মত্ত একদল তরুণকে।
সহসা ধ্যান ভাঙে ক্লিশে প্রশ্নে। দোহারা চেহারার এক ব্যক্তি পিছন থেকে ডেকে বলেন, কী চাই। এ বাড়ির অন্য অংশের ভাড়াটে। কৌশিক পাল। আমার অভিপ্রায় জেনে বলেন, নজরুলের কথা দু'একবার শুনেছেন কিন্তু পাড়ার কাউন্সিলর-বিধায়ক-মন্ত্রী কারও কোনো হেলদোল নেই এ নিয়ে। কাজেই তিনিও আর মাথা ঘামান না। বাড়ির মালিক আবু সৈয়দকে ফোনে ধরার চেষ্টা করি। পরিচয় জেনে তিনি কথা বলতে আগ্রহী হন না।
সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে আমি ভাবতে থাকি, স্বাধীনতা মানে কি বিস্মরণের স্বাধীনতা? দু'দেশের প্রশাসনের কি একজনও নেই যিনি কর্তৃপক্ষের কানে বিষয়টা তুলতে পারে? নজরুলের সমসাময়িক কবি লোরকার বাড়ির কথা মাথায় আসে। ভালদেরাবিওতে কত বড় মিউজিয়াম সেই বাড়ি ঘিরে! নজরুলের নামে যেসব অকাদেমি, যেসব কমিটিগুলি গঠিত হয়েছে তাদের কি কোনো দায় নেই? ফুলেল গানবাজনার আড়ালে চাপাপড়া ইতিহাসকে রক্ষা করবে কে? যারা নিজেদের নজরুল ভক্ত বলে জাহির করেন, তারা কি খোঁজ রাখেন এই বাড়ির? প্রশ্ন ঘিরে ধরে আমায়।
ফিরে আসব, ভাবি পুরো বাড়িটার একটা ছবি তুলে নিই, আর যদি কখনও আসা না হয়। একটু দূর থেকে তুলতে হবে ছবিটা। এই কারণেই পাশের ফাঁকা প্লটটায় ঢুকে যাই। ৮, প্রতাপ চ্যাটার্জী লেন। ঢুকতেই রে রে করে তেড়ে এল নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি। তাঁকে বললাম, আমার অন্য কোনো অভিসন্ধি নেই। একটা ছবি তুলব পাশের বাড়িটার কারণ ওই বাড়িতে নজরুল থাকতেন। তিনি ঝড়ের বেগে ফোন করলেন এক প্রোমোটারকে, যিনি এই ৮ প্রতাপ চ্যাটার্জী লেন প্লটটা কিনে অ্যাপার্টমেন্ট হাঁকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি তাঁকে সবটা বুঝিয়ে বললাম। সব শুনে তিনি ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, 'ইয়ে নজরুল কউন হ্যায় ভাই!' এরপর বোবা হয়ে বাড়ি ফিরে আসা ছাড়া আমার আর কী বা করার ছিল!