সাইদা খানমের ক্যামেরায় তোলা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রহাতে প্রশিক্ষণের ছবি বাংলাদেশের ইতিহাস।
Published : 10 May 2024, 11:03 PM
পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে দেশ যখন পিষ্ট, তখন সময়কে ফেম্রে বন্দি করে আলোকচিত্রী সাইদা খানম ‘এক অনন্য বিদ্রোহ’ করেছিলেন বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ ও গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।
তিনি বলেছেন, “সেই সময় আলোকচিত্র শিল্পের যে বিকাশ ঘটিয়েছিলেন সাইদা খানম, তা আমরা প্রচারের অভাবে জানতে পারিনি। সাইদা খানমের এই কাজ তো সমাজের বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের বিদ্রোহ।”
শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সাইদা খানমের উপর রচিত ও সম্পাদিত দুটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে বক্তব্য দিচ্ছিলেন মুনতাসীর মামুন।
অনুষ্ঠানে আলোকচিত্রী সাহাদাত পারভেজ রচিত ‘একজন সাইদা খানম’ ও ডা. সারা ফাতিমা সম্পাদিত ‘সাইদা খানমের রচনা সংগ্রহ’ বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
সাইদা খানমের ক্যামেরায় তোলা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রহাতে প্রশিক্ষণের ছবি বাংলাদেশের ইতিহাস। ২০২০ সালের ১৮ অগাস্ট ৮৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, সাইদা খানম শুধু ছবিই তুলতেন না, লেখালেখিও করতেন। সাইদা খানম ও তার সময়ের পরিক্রমটা বুঝতে পারলে তার রচনার সঙ্গে ছবি তোলার বিষয়টির সম্পর্ক নির্ধারণ করা যেতে পারে।
“সাইদা খানম যে কতটা সৃজনশীল ছিলেন এবং বিষয়ের দিক থেকে বৈচিত্রময় চিন্তা করতেন। জীবন চর্চার ব্যতিক্রমী ধারা তিনি বেছে নিয়েছিলেন। এই সবগুলোর প্রমাণ পাওয়া যাবে এই দুটি বইয়ে।”
আলোকচিত্রী পাভেল রহমান বলেন, “১৯৭১ সালে আমার বয়স ১৪ বছর। তখন আমরা জয় বাংলা বাহিনীর সদস্য। সাইদা আপা তখন ক্যামেরা হাতে নারীদের রোড মার্চের ছবি তুলছেন, বিক্ষুব্ধ বাংলার ছবি তুলছেন। কী তার কম্পোজিশন, তাতে আলোর কী দারুণ ব্যবহার। আমরা কেবল ভাবি সেই ছবি যদি আমরা তুলতে পারতাম। তবে সাইদা আপা শিখিয়ে গেছেন, সেই ছবি তুলতে হবে যে ছবি কথা বলে।’
পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত ১৯৩ পৃষ্ঠার ‘একজন সাইদা খানম’ বইটিতে সাহাদাত পারভেজ ৬৪টি আলোকচিত্র, পাঁচটি চিঠি, দুটি স্কেচ, ছয়টি প্রচ্ছদ, ১৫টি পেপার কাটিং, সাইদা খানমের হাতে লেখা একটি পাণ্ডুলিপি যুক্ত করেছেন। ৪৩টি অধ্যায়ে আলোকচিত্রী সাইদা খানমের জীবনকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস রয়েছে বইটিতে। বইটির মূল্য ৬৯৫ টাকা।
সারা ফাতিমা সম্পাদিত ‘সাইদা খানমের রচনা সংগ্রহ’ বইয়ে ১৯টি অধ্যায়ে সাইদা খানমের নানা রচনা সন্নিবেশিত হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখাগুলো পারিবারিকভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে জানান সাইদা খানমের ভাগ্নি সারা। ২০২০ সালে সাইদা খানমের মৃত্যুর পরে ২০২২ সালে তিনি লেখাগুলো সংকলনের উদ্যোগ নেন।
অন্যদের মধ্যে চিত্র শিল্পী অধ্যাপক মতলুব আলী, অভিনেত্রী ও ক্রীড়া সংগঠক আলেয়া ফেরদৌসী প্রকাশনা উৎসবে বক্তব্য দেন।
সাইদা খানমের এক জীবন
১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাবনায় জন্ম নেওয়া সাইদা খানমের সঙ্গে ক্যামেরার সখ্য সেই ১২ বছর বয়সে। আর ফটো সাংবাদিকতার শুরু গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে, তখনকার বেগম পত্রিকায় কাজের মধ্য দিয়ে।
পেশাদার আলোকচিত্রী হয়ে ওঠার পথে সাইদা উৎসাহ পেয়েছেন বড় বোন হামিদা খানমের কাছ থেকে, যিনি অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের স্ত্রী।
হামিদা খানম ছিলেন ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বোনের জন্য তিনি নিয়ে আসেন একটি রোলিকর্ড ক্যামেরা, যা তখনকার পেশাদাররা ব্যবহার করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে দুটো মাস্টার্স ডিগ্রি নেওয়ার পথেই সাইদা খানম তার ক্যামেরায় ধারণ করতে থাকেন সময় আর মানুষের মুখ, ইতিহাস আর জীবনের আখ্যান।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রহাতে প্রশিক্ষণের যে ছবি ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়, সাইদা খানমই তা ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবি তুলতে তখনকার রেসকোর্স ময়দানের দিকে রওনা হয়েছিলেন, কিন্তু ঘটনাচক্রে তা আর হয়ে ওঠেনি।
১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করেছেন সাইদা খানম।
তার ছবি ছাপা হয় অবজারভার, মর্নিং নিউজ, ইত্তেফাক, সংবাদসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। বাংলাদেশ থেকে সাইদাই প্রথম সত্যজিত রায়ের সাক্ষাৎকার নিয়ে আসেন, যেটি চিত্রালীতে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে।
১৯৫৬ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেন সাইদা খানম। ওই বছরই জার্মানিতে তার ছবি পায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ভারত, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, পাকিস্তান, সাইপ্রাস ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে তার ছবির প্রদর্শনী হয়।
বাংলাদেশের ছবি নিয়ে সাইদা খানম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন, পেয়েছেন বহু পুরস্কার। সত্যজিৎ রায় আর মাদার তেরেসার ছবি নিয়ে একক প্রদর্শনীও তিনি করেছেন।
ফটো সাংবাদিক হিসাবে দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সাইদা খানমের তোলা প্রায় ৩ হাজার ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ক্যামেরার পাশাপাশি কাজ করেছেন কলম হাতেও। তার লেখা ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও সাক্ষাতকার ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়।
আলোকচিত্রে অনন্য অবদানের জন্য সরকার ২০১৯ সালে শিল্পকলা শাখায় সাইদা খানমকে একুশে পদকে ভূষিত করে।