দেশ স্বাধীন হবার পরে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কোনো ভাতা বা সুবিধার নেননি। মৃত্যুর পরে গার্ড অফ অনারটুকুও নিলেন না।
Published : 07 Aug 2023, 04:12 PM
বাংলাদেশের লেখক-কবিদের বড় ঘাটতির জায়গা রাজনৈতিক শিক্ষা। তাদের চিন্তাজগৎ এবং আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে উপরিকাঠামো এবং পপুলিস্ট রাজনীতির মধ্যে। সেই ঘাটতির চিহ্ন তাদের রচনায় সুস্পষ্ট। অন্ধকারে পথ খোঁজা নয়, তাদের রচনা অন্ধকারেই ঘুরপাক খাওয়া। আওয়ামী লীগ না বিএনপি-- এটি কোনো সাহিত্যিকের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে না। কিন্তু আর সব সেক্টরের মানুষের মতো সাহিত্যিকরাও এই দুই বর্গেই নিজেদের আবদ্ধ করে রাখেন। আসলে দুইটি মনে হলেও বর্গ যে একটাই তা বোঝার মতো গভীরতাসম্পন্ন রাজনীতির পাঠ এবং ধারণা তাদের নেই। এই জায়গাতে মোহাম্মদ রফিক বাংলাদেশের অল্প কয়েকজন সাহিত্যিকের মধ্যে একজন যিনি রাজনীতি ও সমাজের উপরিকাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে ভেতরকাঠামোর চেহারাটি চিনতে পেরেছিলেন। তিনি জানতেন ভেতরকাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া উপরিকাঠামোর স্থায়ী পুনর্বিন্যাস সম্ভব নয়। তিনি সদ্য তারুণ্যে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন। হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে থেকেছেন। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছেন। ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। সর্বোপরি একাত্তরের ১ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিক হিসাবে তাঁর ভূমিকা ছিল। দেশ স্বাধীন হবার পরে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কোনো ভাতা বা সুবিধার নেননি। মৃত্যুর পরে গার্ড অফ অনারটুকুও নিলেন না। এমনকি তাঁর মৃতদেহ বাংলা একাডেমি বা শহীদ মিনারে এনে প্রথাগত শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগটুকুও দিলেন না। এইসবই তাঁর ব্যতিক্রমী চিন্তার পরিচয়। আর এই ব্যতিক্রমী চিন্তা এবং কার্যক্রমের কারণেই তাঁকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অন্যদের তুলনায় বেশি।
কবি মোহাম্মদ রফিকের সাথে সর্বশেষ ফোনালাপে অনুযোগ করেছিলাম-- আপনি আমাদের অভিভাকত্বের দায়িত্ব পালন করেননি। করছেন না। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর জাতীয় কবিতা পরিষদ আওয়ামী কবিদের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে এলেন। কবিতা পরিষদ তার স্পিরিট হারাল। তা নাহয় ছাড়লেন। কিন্তু নিজেকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করলেন কেন? সংগ্রামী কৈশোর, তারুণ্য, যৌবনের পর আপনি যখন প্রাজ্ঞ, পরিণত, কবি হিসাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের সাহিত্যের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম আপনার পাঠের অধিগত, যখন আপনাকে দেশের সব প্রান্তের সাহিত্যকর্মীরা কাছে পেতে চায়, তখনই আপনি নিজেকে সরিয়ে নিলেন কেন? সংগঠন না-ই বা করলেন, পাঠচক্র চালাতে পারতেন। আপনাকে সামনে রেখে আমরা ভালো একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে পারতাম। তিনি উত্তর দেননি। তবে জানতে চেয়েছিলেন-- কী করতে চাও তোমরা? বলেছিলাম-- তা নির্ধারণ করতে হলে একসাথে বসতে হবে, একবার নয় বারবার বসতে হবে, দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে, দেশের সাহিত্য অঙ্গনের অসুস্থতাগুলো চিহ্নিত করতে হবে, বিদেশি সাহিত্যের সাথে আমাদের সাহিত্যপ্রক্রিয়ার তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে হবে। এগুলোই তো কাজের অগ্রাধিকার বেছে নেয়ার ভিত্তি। তিনি অরাজি হননি। কী কারণে যেন বেশি উত্তেজিত ছিলাম সেদিন। বলেছিলাম-- আপনার এবং আপনাদের স্বেচ্ছা গৃহবন্দিত্বের কারণে দেশে এখন সাহিত্য এবং চিন্তার পয়গম্বর হয়ে গেছেন ফরহাদ মজহার। আপনি তো জানেন আওয়ামী কবি-চিন্তকদের চিন্তার দৌড়। তারা তাত্ত্বিক মোকাবেলা করার সামর্থ্য রাখে না। সাহিত্যের উৎকর্ষ নিয়ে ভাবে না। সেক্ষেত্রে আমরা যদি চিন্তার প্রতিরোধ গড়ে না তুলি তাহলে আমাদের সাহিত্যজগৎ চলে যাবে ছদ্মমৌলবাদীদের হাতে। তিনি বলেছিলেন-- শরীরটা খারাপ। একটু সেরে উঠি। তারপর কাজ শুরু করা যাবে। সেই সুযোগ আর হলো না রফিক ভাই!