একজন তাঁর রাইফেল আকাশের দিকে তাক করে ‘টাস টাস টাস’ শব্দে কয়েকটা গুলি করলেন! গুলির সঙ্গে সঙ্গে সবাই চিৎকার করে উঠলেন, ‘জয় বাংলা!’
Published : 16 Dec 2024, 03:55 AM
একাত্তর সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে তখন আমি চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। আট বছর বয়স। মোটামুটি বুঝবার সামর্থ্য হয়েছে। ২৫ মার্চের কয়েক মাস আগে থেকেই আমরা থাকতাম পল্লবীতে। তখনকার পল্লবীর যে মানচিত্রটি আমার স্মৃতিতে এখনো স্পষ্ট হয়ে আছে তা হলো, আমাদের বাসার সামনের যে রাস্তাটা প্রধান সড়কে গিয়ে মিলেছে সেটার দূরত্ব মাত্র কয়েকশো গজ! রাস্তাটা যেখানে যুক্ত হয়েছে সেখানে পৌঁছে বামে তাকালে ডিপোতে পল্লবী টু গুলিস্তানের দোতলা বাসগুলো দেখা যেত। কতক্ষণ পরপর বাস ছাড়ত তা আজ আর মনে না থাকলেও মনে আছে ওখান থেকে যাত্রা শুরু করে সব স্টপেজে থেমে থেমে গুলিস্তান পৌঁছতে একঘণ্টা লাগত। মোটকথা পল্লবী বাস ডিপোর কাছের একটা একতলা দালানে ছোটমামার পরিবারের সঙ্গে আমরা থাকতাম। ছোটমামার পরিবার মানে মামা-মামি আর তাঁর দুই কন্যা! ছোট কন্যাটির তখনো জন্ম হয়নি। মামির এক ভাই, আমরা তাঁকে বড়মিয়া মামা বলতাম, তিনিও থাকতেন। সেসময় তিনি জগন্নাথ কলেজে পড়তেন বলে মনে পড়ে। রাজনীতিতে সক্রিয়। মনে পড়ছে তিনি পল্লবীর ঐ বাসায় থেকেও অনেক পোস্টার লিখেছেন। আমার দুই মামাতো বোন ঝর্না আপা ও বন্যা আপা এবং আমিও তাঁকে পোস্টার লেখায় সহযোগিতা করতাম কিনা স্পষ্ট মনে পড়ছে না!
আব্বা তখন চাকরি করতেন সরকারের হিসাব বিভাগে। থাকতেন আব্বার ছোটচাচা আবদুল কবিরের পুরোনো ঢাকার জোরপুল লেনের বাসায়। সে সময় আব্বা সারা সপ্তাহ আমাদের সঙ্গে থাকতেন না। শনিবার বিকেলে অফিস থেকে সোজা পল্লবীতে যেতেন। রোববারের ছুটি কাটিয়ে সোমবার অনেক ভোরে চলে যেতেন কাজে।
আমরা পড়তাম পল্লবীরই একটা স্কুলে। আজ আর সে স্কুলের নাম মনে পড়ে না। আদৌ সেই স্কুলটা মুক্তিযুদ্ধের পরেও টিকে ছিল কিনা সেটাও জানি না। কারণ যুদ্ধের পরে আমরা আর পল্লবীতে ফিরে যাইনি। মোটামুটি এই ছিল একাত্তরের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আমাদের জীবন যাত্রা!
ছোটমামা মিরপুর থেকে তেজগাঁও টেলিকম সেন্টারে অফিস করতে যেতেন একটা ভেসপা চালিয়ে। মনে পড়ছে ২৫শে মার্চ সকালে ভেসপা চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন! চারিদিক থমথমে। মামা তো গেলেন অফিসে, বিকেলে ফিরতে পারলেন না। যতদূর মনে পড়ে সন্ধ্যার আগেই বড়মিয়া মামা বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন রাজনৈতিক কাজে। সুতরাং তিনিও নেই! মামির দায়িত্বে ছিলাম, আম্মা, আমরা দুই ভাই আর দুই মামাতো বোন। নেতৃত্ব মামিরই ওপর, কারণ তিনিই সময়ের তুলনায় অগ্রসর বুদ্ধির মানুষ। আম্মার হম্বিতম্বি আব্বার আর আমাদের ওপর পর্যন্ত ছিল সীমিত।
সন্ধার পর থেকে আমরা সবাই ভীত সন্ত্রস্ত। কথাটা ঠিক হলো না বোধ হয়। আমরা ছোটরা কিছুটা অ্যাডভেঞ্চার করার মুডেও ছিলাম; মামি আর আম্মাই ছিলেন আসলে উৎকণ্ঠায়! সেই ভীতির মধ্যে পরের কারফিউ তুলে নেয়া পর্যন্ত মামার সঙ্গে আমরা বিচ্ছিন্ন। আব্বার কোনো খবর জানতাম না! তখন তো মোবাইলের কথা কারো কল্পনায়ও ছিল না! টেলিফোনই ছিল খুবই বিরল সুবিধা। মামা টেলিফোন বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন বলে তাঁদের ঘরে ফোন ছিল। কিন্তু লাইন ছিল ডেড। প্রতিবেশী একটি পরিবারের সঙ্গ আমরা সেই রাত আর কারফিউ শিথিল করার পর ভেসপা চালিয়ে মামার ফিরে আসার সময় পর্যন্ত রইলাম। মিরপুর ছিল বিহারী প্রধান এলাকা। আমাদের মতো আরো কয়েকটি বাঙালি পরিবারের সময় ভীষণ ভয়ের মধ্যে কাটল। এটুকু বুঝবার মতো বয়স ছিল যে ঐ আতঙ্কের মধ্যেই বিহারীদের একটা তরুণ দল আমাদের রক্ষা করেছিল এবং সহযোগিতা করেছিল ঐ এলাকা থেকে বেরিয়ে আসতে। সেসব কথা জানাতে অনেক কথা বলতে হবে। তা তোলা রইল অন্য সময়ের জন্য। এখানে আমি বলব ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের দিনের কথা!
২৭ মার্চ সম্ভবত ২ ঘণ্টার জন্য শিথিল করা হয়েছিল। ধ্বস্ত বিধ্বস্ত মামা তাঁর ভেসপা নিয়ে ফিরে এলেন! ধূসরতার ভেতর থেকে মনে পড়ছে বেশি সময়ের জন্য কারফিউ শিথিল করা হয় আরো ৪ দিন পরে। সেদিনই বিহারী তরুণদের দলটি আমাদের সেখান থেকে সরে যাবার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছিল! আমরা কয়েকদিন তেজগাঁওয়ে মামার কর্মস্থলের মেসে অবরুদ্ধ রইলাম! এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ডেমরা হয়ে নানাবাড়ি যাই গাজিপুর জেলার কাপাসিয়া থানার তরগাঁও গ্রামে! আব্বা সেখানে গিয়ে আমাদের খুঁজে পান আরো কয়েকদিন পরে। তিনি আমাদের নিয়ে যান আমাদের পৈত্রিক বাড়ি এখনকার নরসিংদী জেলার অন্তর্ভুক্ত মনোহরদী থানার গণ্ডারদিয়া গ্রামে। সেখানে আমাদের রেখে তিনি ফিরে যান তাঁর পেশাগত কর্মস্থলে! গণ্ডারদিয়ায় আমাদের কাটে ১৯৭২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত! সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করতেও অনেক পাতা লিখতে হবে। তাও হয়তো লিখতে পারব বেঁচে থাকলে!
২.
এখানে লিখছি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মুহূর্তের কথা! প্রসঙ্গ আমার এক দাদা, আব্বার এক চাচার মৃত্যু! তিনি দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিলেন! রোগশয্যায় তাঁর একটাই আকুতি ছিল, ‘আমি মরার আগে দেশ স্বাধীন হইব? আমি স্বাধীন দেইখা মরতে পারমু?’
দাদা অসুখে ঘোরে থাকতেন। একটু সুস্থ বোধ করলে বালিশ থেকে মাথা উঁচু করে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘দ্যাশ স্বাধীন হইছে?’
আমি তখন আমাদের বাড়ির মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে পেছনে দৌড়াই! তাঁদের সকলের মনেও অনেক আশাবাদ, যে-কোনোদিনই শুনবার প্রত্যাশা: পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ না করে উপায় নেই, আত্মসমর্পণ করবে তারা। আমিও দাদাকে দেখতে যেতাম মাঝে মাঝে। একবার তাঁর কাছে গেলে আমাকেও তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বাইয়ে, দ্যাশ স্বাধীন হইছে?’
দাদার মনে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয়ের খবর শোনার আকুতি তীব্র হয়ে উঠেছিল, কারণ ততদিনে মনোহরদী থানা যে মুক্তিযোদ্ধারা দখলে নিয়েছে সে খবর জানতেন! যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার মতো খবর আসছিল একের পর এক! আমার মুক্তিযোদ্ধা কাকাদের একজন ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাঁকে বললেন, ‘হ, কাহা, দ্যাশ স্বাধীন অইল বইলা! আপনে স্বাধীন দেখতে পারবেন।’
সকলেই সেই আশাবাদের কথা তাঁকে বলতেন!
ষোলোই ডিসেম্বর সকালে ঘুম ভাঙতেই শুনলাম কে যেন বলছে, দাদা অনেক ভোরে মারা গেছেন। আমি বিছানা ছেড়ে গেলাম দাদার মৃতদেহ দেখতে। আমার মনে তাঁর স্বাধীন দেশ দেখবার ব্যাকুলতাটুকু যেন স্থির হয়ে গেল! তক্ষুণি আমার মনে এলো, ‘আহা, আর কয়েকটা দিন বাঁচলে দাদায় স্বাধীন দ্যাশ দেইখা যাইতে পারত!’
তার কিছুক্ষণ পরেই খবর রটে গেল জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! আমি ডাক্তার দাদার বাংলাঘরের দিকে গেলাম! ঘর আর ক্ষেতের মাঝামাঝি খোলা জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা কাকাদের জটলা! একজন তাঁর রাইফেল আকাশের দিকে তাক করে ‘টাস টাস টাস’ শব্দে কয়েকটা গুলি করলেন! গুলির সঙ্গে সঙ্গে সবাই চিৎকার করে উঠলেন, ‘জয় বাংলা!’
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বাঙালির বিজয়ের আনন্দ দাদার মৃত্যুর দুঃখকে অতিক্রম করে গেল! কিন্তু কিশোর বেলায় দাদার চোখে স্বাধীন দেশ দেখার ব্যাকুলতা আমার মন থেকে কখনো যায় নি!
মৃত্যুর আগে দাদার আকাঙ্ক্ষা ছিল বাংলাদেশের বিজয়কে উদযাপন করার। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তা না করতে পারায় তাঁর যে অতৃপ্তি আমি অনুভব করেছিলাম তা এতদিন আমার কাছে ছিল কেবলই স্মৃতির ব্যাপার। কিন্তু এখন এই অনুভব পাল্টে গেছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে যে ইতিবাচকতার আশা ছিল তা যে বিজয়ের বিপরীত উদযাপন হয়ে উঠবে তা কখনো ভাবিনি! আজ আমার মনে হচ্ছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় আমার কিশোর মনকে যেভাবে জীবনের দিকে আশাবাদী করে তুলেছিল ২০২৪ সালের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রবীণ বয়সে তাকেই অবনমন করিয়ে দিয়েছে। হয়তো আমারও মৃত্যু হবে দাদার মতোই বিজয়ের মর্মকে অবনত দেখতে দেখতে!
বিজয় দিবসের লগ্নে আশা করি, আজকে যে অনুসন্ধিৎসু কিশোর নিজের স্বপ্নকল্পনায় বিকশিত হয়ে চলেছে সে নিশ্চয়ই একদিন বিজয়ের মর্মকেই বিজয়ী করে তুলবে!