রামনাথ বিশ্বাস: বিশ্বজোড়া পাঠশালা তাঁর

তাঁর ভ্রমণ সাহিত্যে আশীর্বাদ করে শুভকামনা জানিয়েছেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আহসানুল কবীরআহসানুল কবীর
Published : 31 Oct 2022, 05:14 PM
Updated : 31 Oct 2022, 05:14 PM

উনিশ শতকের তিরিশের দশকে বাইসাইকেল নিয়ে বিশ্ব পরিভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বিদ্যাভূষণ পাড়ার ছেলে রামনাথ বিশ্বাস। বাইসাইকেলে তিনবার পৃথিবীর তিন প্রান্তে ভ্রমণ করেছিলেন যে মানুষটি, লিখেছেন ৩০টির মতো ভ্রমণ কাহিনি, দুর্বৃত্তরা দখল করে নিয়েছে তারই পৈত্রিক বসতভিটা; যে ভিটাতে ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি তাঁর জন্ম হয়েছিল, ১৯৪৭ দেশভাগের পরও যেখানে বাস করতে চেয়েছিলেন তিনি। দেশভাগের রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে বাধ্য হয়ে কলকাতায় চলে যান রামনাথ বিশ্বাস। সেখানেই ১৯৫৫ সালের পহেলা নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। কলকাতায় তার নামে রয়েছে ‘রামনাথ বিশ্বাস সড়ক’, অথচ নিজভূমে তিনি হয়ে গেছেন পরবাসী। বি. স.

রামনাথ বিশ্বাস নামটির সঙ্গে আমজনতার পরিচয় খুব বেশি নয় বলেই আমার ধারণা। আমাদের দেশে যে কজন মানুষ ইবনে বতুতা কিংবা আরব্য রজনীর দাতা হাতেম তাঈয়ের নাম জানেন, ততজন লোক রামনাথ বিশ্বাসের নাম জানেন না, এটি আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। অথচ সর্বকালের সেরা বিশ্ব ভূপর্যটকদের নাম লিখলে রামনাথ বিশ্বাসের নাম আসবে এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বাঙালি জাতি ঘরকুনো, তারা ভ্রমণ করতে জানে না--বিশ্বদরবারে এ অপবাদ ঘুচিয়েছেন রামনাথ। আমরা আমাদের আইডলদের তুলে ধরি না, এটি আমাদের জাতিগত সমস্যা। আমরা তাই ভিনদেশী ইবনে বতুতাকে চিনি, স্বদেশী রামনাথকে জানি না, ভিনদেশী সিরাজউদ্দৌলার জন্য অশ্রুপাত করি, ভূমিপুত্র সমশের গাজীকে ডাকাত বলি, রবার্ট ব্রুসের অধ্যবসায় সম্পর্কে জানি, এই মাটির সন্তান ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের সংগ্রামমুখর সাধনার কথা বলি না, হাজী মুহম্মদ মহসীনের দানশীলতার কথা বলি, মহেশ ভট্টচার্য্যরে নামও উচ্চারণ করি না। এই দায় কার? রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থা, আপনি, আমি, আমরা সবাই কমবেশি এর জন্য দায়ী।

রামনাথ বিশ্বাসের জন্ম হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ের বিদ্যাভূষণ পাড়ায়, যে বানিয়াচংকে তিনি পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বলে দাবি করেছিলেন। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন আসলেই বানিয়াচং একটা গ্রাম ছিল। সেই গ্রামটিই সম্প্রসারিত হয়ে এখন একটি উপজেলায় পরিণত হয়েছে, সরকারি তথ্য বাতায়ন অনুযায়ী, এর আয়তন ৪৮২.২৫ বর্গ কিলোমিটার, এখানে ১৫টি ইউনিয়ন এবং অনেকগুলো গ্রাম আছে। তবু বানিয়াচংয়ের মানুষ পুরো উপজেলাটিকে গ্রাম বলে ভাবতে ভালোবাসেন, কে এটিকে বৃহত্তম গ্রামের অভিধা দিয়েছিল তা জেনে এবং না জেনে। সে আমলে গ্রামে জন্ম তারিখ মনে রাখার বা লিপিবদ্ধ করে রাখার প্রবণতা ছিল কম। তাই অনেকের মতে রামনাথ বিশ্বাসের জন্মতারিখ নিয়েও একটি বিভ্রান্তি আছে। কারো মতে ১৮৮৫, কারো মতে আবার ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জন্ম। কেউ বলছেন বাংলা ১৩০০ সনের ২৩ চৈত্র রামনাথ বিশ্বাসের জন্ম। বিভিন্ন দিক বিবেচনায় আমরা ধরে নিতে পারি মোটামুটি ১৮৯৩ অথবা ৯৪ সালেই তাঁর জন্ম। জন্ম তারিখ হিসেবে ১৩ জানুয়ারির কথা বলা হয়। রামনাথ বিশ্বাস জন্মের দুবছরের মাথায় মা গুণময়ী দেবীকে হারান। পিতা বিরজানাথ বিশ্বাস গত হন রামনাথ বিশ্বাসের ৭ম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত অবস্থায়। ফলে একমাত্র ভাই কৃপানাথ এবং রামনাথকে অনাথ অবস্থাতেই বড় হতে হয়। একে বানিয়াচংয়ের মত একটি অবহেলিত জনপদে রামনাথ বিশ্বাসের জন্ম, তার ওপর ছোট বেলায় কলেরা ও টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর শরীর ছিল বেশ দুর্বল। ফলে একটু দেরিতেই তাঁর লেখাপড়া শুরু হয় এবং তা-ও অষ্টম শ্রেণির পর আর এগোয়নি। তখন দেশজুড়ে চলছে বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলন। যা রামনাথের মনেও আলোড়ন তৈরি করে। তিনি যোগ দিলেন বিপ্লবীদের গুপ্ত সংগঠন অনুশীলন দলে। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বাঙালি পল্টনে যোগ দিলেও কিছুদিন পর অসুস্থতার জন্য তা ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। ১৯১৭ সনে তিনি আবার চাকুরি জীবন শুরু করেন। চাকুরিসূত্রে বেলুচিস্থান, আফগানিস্তান এবং পারস্য দেশে যেতে হয় তাঁকে। ১৯২৪ সালে তিনি মালয় গমন করেন এবং সেখানে ১৯৩১ সন পর্যন্ত কাজ করেন। এই সময়েই রামনাথ বিশ্বাসের মাঝে ভ্রমণস্পৃহা জাগ্রত হয়। ১৯৩১ সনের জুলাই মাসে বাইসাইকেলে চেপে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন তিনি। আর এই ভ্রমণই তাঁর জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়। একদিকে তিনি যেমন জগৎ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন, অপরদিকে অভিজ্ঞতার ঝুলি বাড়তে থাকে, যা রামনাথ বিশ্বাসের চিন্তাধারার খোলনলচে পাল্টে তাঁকে পরিণত করে সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ রূপে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন মানবিক এক মানুষ।

বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছেন “ভ্রমণ প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে, তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে।” রামনাথ বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। তিনি শুধু ভ্রমণই করেননি তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ৩০টির অধিক বই যা সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর ভ্রমণ সাহিত্যে আশীর্বাদ করে শুভকামনা জানিয়েছেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শুধু নামমাত্র পরিচয় নয়, রামনাথের একটি মধুর সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘নাবিক’, ‘অন্ধকারের আফ্রিকা’, ‘আজকের আমেরিকা’, ‘বেদুইনের দেশে’, ‘পৃথিবীর পথে’, ‘ভিয়েতনামের বিদ্রোহী বীর’, ‘লাল চীন’, ‘বিদ্রোহী বলকান’, ‘আফগানিস্তান ভ্রমণ’, ‘সর্বস্বাধীন শ্যাম’ ইত্যাদি। এমনকি ‘হলিউডের আত্মকথা’, ‘আমেরিকার নিগ্রো’, ‘আগুনের আলো’, ‘সাগর পারের ওপারে’ নামে চারটি উপন্যাসও তিনি লিখেছেন। বইগুলো তাঁর জীবদ্দশাতেই বেস্ট সেলারের স্বীকৃতি পেয়েছিলো। বাংলার বিখ্যাত লেখক এবং ভ্রমণ সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর চেয়ে বছর দশেকের বড় ছিলেন রামনাথ বিশ্বাস। প্রকৃত ভ্রমণকারী কেবল চোখেই দেখেন না তিনি দেখেন, শোনেন এবং লিখে যান তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি।

রামনাথ বিশ্বাস ১৯৩১ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত তিন দফায় সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন। আজ থেকে ৯১ বছর আগে শুধু  একটি সাইকেল, একজোড়া চটি আর দুটি চাদর নিয়ে অসীম সাহসী এই মানুষটি পৃথিবী পরিভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। প্রতিটি ভ্রমণ তাঁকে ঋদ্ধ করেছিল। তাঁর জীবনবোধ আর জীবনদর্শনই পাল্টে গেছে একসময়। সাইকেলের গায়ে লেখাছিল “রাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড, হিন্দু ট্রাভেলার”  যদিও শেষাবধি ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে মানবীয় পরিচিতিটিই তাঁর কাছে মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছিল। এই সাইকেলে চড়ে তিনি পাড়ি দিয়েছেন ৫৩ হাজার মাইল, পায়ে হেঁটেছেন ৭ হাজার মাইল, ২৭ হাজার মাইল তিনি অতিক্রম করেছেন রেলগাড়ি এবং জাহাজে। সব মিলিয়ে তিনি ১০ বছরে প্রায় ৮৭ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছেন। যদিও এনিয়ে মতদ্বৈততা রয়েছে। এসময় তিনি অর্জন করেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, দেখেছেন ভিন্নভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা, পরিচিত হয়েছেন বিপরীত সব রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে। রামনাথ বিশ্বাস দুচোখ ভরে উপভোগ করেছেন পৃথিবীর নানা রং, রূপ, রস। নবীন শিক্ষার্থীর মতোই আগ্রহ ভরে শিক্ষার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেছেন। সঞ্চয় করেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার ঝুলি। ফলে গোটা জগৎ জুড়েই সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর পাঠশালা। আর এই পাঠশালার একনিষ্ঠ ছাত্র রামনাথ বিশ্বাস।

আমরা যদি রামনাথ বিশ্বাসের জীবনকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখবো জীবনের বিভিন্ন বাঁকে তাঁর চিন্তা, চেতনা ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। রামনাথ সিঙ্গাপুর থেকে বিশ্বভ্রমণের যাত্রা শুরু করেন। যাত্রায় থাইল্যান্ড থেকে শুরু করে ইন্দোচীন, চীন থেকে কোরিয়া হয়ে জাপান পৌঁছালেন রামনাথ। চীনের রাষ্ট্র বিপ্লবের অগ্নিগর্ভা দিনগুলোর সাক্ষী তিনি। রামনাথ সাইকেলে চড়েই জাপানের কোবে, ওসাকা, নারা শহর ভ্রমণ করেন। জাপানে তখন দুটো বিদ্রোহী দল রিপাবলিকান এবং রিফরমিস্ট। তাদের কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। নারা থেকে কিয়েটো আসেন, সেখান থেকে জাপানের আরও কয়েকটি ছোট ছোট শহর ভ্রমণ শেষে জাহাজযোগে কানাডায় আসেন রামনাথ। কিন্তু তৎকালীন কানাডা সরকার তাঁকে ভালোভাবে গ্রহণ করলেন না বরং ২৯ দিন বন্দি রেখে আবার জাপানেই ফেরত পাঠানো হয়। জাপান সরকার আবার চারদিন পর তাঁকে পাঠালেন সাংহাইয়ে। এখান থেকে তিনি ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণ শেষে বালিতে পদার্পণ করেন, এর একমাস পর আসলেন জাভায় কিন্তু তখনকার সরকার তাঁকে জাভায় গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং কয়েদ করে সিঙ্গাপুর পাঠিয়ে দেয় অর্থাৎ যেখান থেকে শুরু সেখানেই তাঁকে ফেরত আসতে হলো। সিঙ্গাপুরে দুমাসের বিশ্রাম শেষে তিনি আবার বের হয়ে যান তাঁর ভ্রমণ যাত্রায়। সিঙ্গাপুর থেকে রেলে চেপে তিনি পেনাং পৌঁছান সেখান থেকে বার্সায় আসলেন। বার্সা থেকে তিনি ভারতবর্ষে পা রাখেন। সমস্ত ভারতবর্ষ ভ্রমণ শেষে আফগানিস্তান, পারস্য (ইরান), ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং তুরস্ক ভ্রমণ করেন। ইরান এবং আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পদব্রজে কিংবা সাইকেলে ভ্রমণ করেন। দুর্গম পার্বত্য পথে হামাদান এবং কেরামন সা ভ্রমণেও বাইসাইকেল ব্যবহার করেন তিনি। পথের অপরিসীম কষ্ট,  জীবনের ঝুঁকি কোনো কিছুই দমাতে পারেনি তাঁকে।

এখান থেকে চলে আসলেন তিনি ইউরোপে। ইউরোপীয়দের বর্ণবাদী মানসিকতাকে উপেক্ষা করে রামনাথ বুলগেরিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, হাঙ্গেরী, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানী এই সকল সমাজবাদী রাষ্ট্র ভ্রমণ শেষে পশ্চিম জার্মানী, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ভ্রমণ করে ইংল্যান্ডে পদার্পন করলেন। এসকল দেশের অর্থনীতি, সামাজিক আচার, ঐতিহ্য, মানবিক মূল্যবোধকে তিনি গভীরভাবে আত্মস্থ করেছেন এসময়। যতই আমরা বলি শরীরের নাম মহাশয় যা সওয়াবেন তাহাই সয় কিন্তু তারও তো একটি সীমা আছে! কখানো পায়ে হেঁটে কখনও সাইকেলে চেপে দীর্ঘ ভ্রমণে রামনাথের শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ল। ফলে তিনি ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ যোগে বোম্বে হালের মুম্বাই চলে আসেন। ওখানে তিনি শারীরিক অসুস্থতার জন্য ছয় মাস বিশ্রাম গ্রহণ করতে বাধ্য হন। কিঞ্চিৎ স্বাস্থ্য উদ্ধারের পরই ভ্রমণের নেশা তাঁকে আবার টানতে থাকে। এসময় তিনি ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করে তৃতীয় দফা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। এবার তাঁর গন্তব্য আফ্রিকা। জাহাজে চেপে তিনি প্রথমে আফ্রিকার মোম্বাসাতে আসেন। মোম্বাসা ভারত মহাসাগরের উপকূলে দক্ষিণ-পূর্ব কেনিয়ার একটি শহর। সেখান থেকে কেনিয়ার বিভিন্ন এলাকা হয়ে উগান্ডা, টাঙ্গানিকা, নাগাল্যান্ড, উত্তর ও দক্ষিণ রোডেসিয়া পরিভ্রমণ শেষে দক্ষিণ আফ্রিকাতে পৌঁছান। দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সভাল, ডারবান, পোর্ট এলিজাবেথ হয়ে মূল দক্ষিণ আফ্রিকার ভূখণ্ডে যান তিনি। ১৯৪০ সালে আফ্রিকা ভ্রমণ শেষে আমেরিকার পথে পা বাড়ান। সমগ্র আমেরিকা ভ্রমণ করে আবার ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছিলো ক্রমশ। ফলে তিনি আমেরিকা ভ্রমণ সমাপ্ত না করেই জাহাজে করে কানাডা হয়ে কলকাতায় চলে আসেন। এরপর তিনি আর ভ্রমণে বের হতে পারেননি। দীর্ঘ ভ্রমণজনিত ক্লান্তিতে তাঁর শরীর ভেঙে যায়। এখানেই তিনি ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর মারা যান। এই পনের বছর তিনি ভ্রমণ করতে না পারলেও বসে ছিলেন না। এই দীর্ঘ সময় তিনি বিরামহীনভাবে লিখে গেছেন। লিখেছেন অসংখ্য ভ্রমণ কাহিনী, গল্প, উপন্যাস। এসময় তিনি ভূপর্যটকদের জন্য গড়ে তোলেন ‘সারা ভারত পর্যটক সমিতি’। পর্যটক নামে নিয়মিত একটি প্রকাশনাও বের হতো তাঁর সম্পাদনায়।

কিশোর বয়সে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের গুপ্ত সংগঠন অনুশীলন দলে যোগদানের মধ্যে দিয়ে তাঁর মধ্যে যে দেশপ্রেমের পরিচয় ফুটে উঠে তা রামনাথের মাঝে বিদ্যমান ছিলো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। সারা পৃথিবী ভ্রমণ শেষেও রামনাথের কাছে স্বীয় জন্মভূমি বানিয়াচংই ছিল ধ্যানজ্ঞান। ১৯৩৪ সালে বানিয়াচংয়ের ঐতিহাসিক এড়ালিয়া মাঠে গ্রামবাসী এক বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করলে রামনাথ সেখানে বলেছিলেন “বাইন্যাচুং (বানিয়াচং) আমার দুইন্যাই”। এমনকি ৪৭-এ দেশভাগের পরেও তিনি এখানেই থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর চিকিৎসা, গ্রন্থ প্রকাশনা এবং নানাবিধ কারণে তাকে কলকাতা যেতে হয়েছিল, তথাপিও বানিয়াচং থেকে মানসিকভাবে কখনোই বিছিন্ন হননি। ভ্রমণ করতে যেয়ে গোটা দুনিয়াকে তিনি পাঠশালা বানিয়েছেন। যতবেশি ভ্রমণ করেছেন, ততবেশি তাঁর দিব্যজ্যোতি প্রস্ফুটিত হয়েছে। প্রতিটি অভিযাত্রায় অংশ নিয়ে আবিষ্কার করেছেন বহু নতুন জায়গা, জনপদ ও সভ্যতার অমূল্য সম্পদ। ডুব দিয়েছেন সেসব দেশের সমাজ ব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি, জনপদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ভেতর। তুলে এনেছেন অমূল্য সব জ্ঞানের ভাণ্ডার। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছেন “নতুন কোন দেশে ভ্রমণে গেলে সে জাতি সম্পর্কে যদি খুব তাড়াতাড়ি জানতে হয় তাহলে বাজারে যাও এবং বইয়ের দোকানে যাও। তারা কি খাচ্ছে? তার দাম কেমন? তারা কি ধরনের বই পড়ছে? তা দেখেই তুমি সে জাতি সম্পর্কে একটি ধারণা করতে পারবে।” রামনাথের ভ্রমণগুলোকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবো তিনি ঠিক সে কাজটিই করেছেন। এতে তিনি নিজে যেমন ঋদ্ধ হয়েছেন, তেমনিভাবে সেই জাতির অতীত বর্তমান সম্পর্কে পাঠককেও জানাতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, এই বিশ্ব ভ্রমণের মাধ্যমে রামনাথের মনোজগতেও পরিবর্তন এসেছে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি। আফ্রিকাতে গিয়ে তিনি বর্ণবাদের নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন নিগ্রোদের কেউ মানুষ বলেই মনে করে না। আবার পশ্চাদপদ আফ্রিকায় নারী স্বাধীনতা দেখে তিনি চমকিত হয়েছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের দাসী হিসেবে দেখা হয়, সখেদে একথা লিখতেও দ্বিধা করেননি রামনাথ।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ঘ্রাণেই অর্ধভোজন। তেমনিভাবে রামনাথের ভ্রমণ বিষয়ক লেখাগুলো যদি আমরা মনোযোগ দিয়ে পড়ি, তাহলে সেই দেশ সম্পর্কে আমাদের মোটামুটি ধারণা এমনিতেই হয়ে যাবে। তিনি তাঁর লেখনীতে সে সব জনপদের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়গুলো তুলে এনেছেন সুনিপুণভাবে। এমনকি তাদের স্থাপত্য রীতি, গৃহনির্মাণ পদ্ধতিও বাদ যায়নি তাঁর লেখা থেকে। ‘আফগানিস্তান ভ্রমণ’ গ্রন্থে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন “এদের গৃহনির্মাণ পদ্ধতি পাঠানদের মতো নয়। এখনো ওরা আদিম মোঙ্গল জাতির মতই ঘর তৈরী করে।” এতে করে সে সময় আফগানদের গৃহনির্মাণ রীতি সম্পর্কে আমরা একটি ধারণা পেতে পারি। তিনি যখন আফগানিস্তান ভ্রমণ করেন, সেখানে তখন সদ্যই বাদশাহ্ আমানুল্লাহ যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সেখানকার রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার যে চালচিত্র রামনাথের লেখায় বিধৃত হয়েছে তা পাঠ করলে বোদ্ধা পাঠক এক নিমিষেই বুঝে ফেলার কখা দেশটি যে অন্ধকারের পথে ধাবিত হচ্ছে। যার প্রতিফলন আমরা আজকের আফগানিস্তানে দেখতে পাই। এতোটাই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন রামনাথ বিশ্বাস। আমাদের প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জগৎ জোড়া পাঠশালা তাঁর’ যে কত বড় সত্য তা রামনাথ বিশ্বাসের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনটিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে। রামনাথ বিশ্বাস তাঁর কিশোর বেলায় দীক্ষা নিয়েছিলেন অনুশীলন দলের ‘বন্দে মাতরম’ এই বিশ্বাসকে ধারণ করে। বলাই বাহুল্য যে একদিকে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, হাজী শরীয়ত উল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন, অন্যদিকে যুগান্তর আর অনুশীলন দলের কার্যক্রম কোনটিই পরিপূর্ণভাবে সম্প্রদায়গত বিশ্বাসের উর্ধ্বে ছিলো না। এমনকি রামনাথ বিশ্বাস তাঁর ভ্রমণকাল শুরু করেছিলেন বাইসাইকেলের গায়ে হিন্দু ট্রাভেলার্স লিখে। সেই রামনাথ বিশ্বাস দিন দিন পরিশীলিত হয়েছেন। তাঁর মনোজগতে পরিবর্তন হয়েছে। রামনাথ আফগানিস্তানের মুসলমানদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন “পরাধীন ভারতের মুসলমানরা বর্ণ হিন্দুদের গোঁড়ামী বেশ ভালো করেই নকল করেছিল। তারা স্বাধীন মুসলমান দেশগুলোর পদাঙ্ক অনুসরণ করা দূরের কথা নিজেদের আদর্শ ভুলে গিয়ে সর্বনাশের পথেই এগিয়ে চলেছিল।” আফগানিস্তানে সদ্য গজিয়ে ওঠা মোল্লাতন্ত্র কিভাবে দেশটিকে পিছিয়ে দিচ্ছিল তা তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা দিয়ে। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন “মোল্লা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ফিরিঙ্গী দাওয়াই বিশ্বাস করেন? বললাম নিশ্চয়ই। মোল্লা একটা হাই তুলে বললেন এটা কাফেরের লক্ষণ। পরে গ্রামের লোক প্রতিবাদ করে বলল ফিরিঙ্গী দাওয়াই না হলে আমাদের চলে না। ইংলিশদের সঙ্গে যখন লড়াই হয়েছিলো তখন ফিরিঙ্গী দাওয়াই না পেলে অনেক আহত সেপাই মরে যেতো।” এ থেকে আমরা বুঝতে পারি আফগানিস্তান তখন একটি ক্রান্তিকালীন সময় অতিক্রম করছে। একদিকে মোল্লাতন্ত্র তার থাবা বিস্তার করতে চাইছে, অন্যদিকে শুভবোধ সম্পন্ন মানুষও যুক্তি দিয়ে তা রোধ করার চেষ্টা করছে। প্রসঙ্গক্রমে আমরা উদাহরণ টানতে পারি সাম্প্রতিক কালেও বাংলাদেশে করোনার টিকা ইহুদীদের তৈরি বলে তা গ্রহণ করতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছিলো একদল লোক। তাহলে কি আমরাও সে পথে হাঁটছি? কি ভয়ঙ্কর কথা! ভাবার বিষয়। আরেক জায়গায় আত্মপোলব্ধির জায়গা থেকে তিনি লিখেছেন “লোকে দেবতার পূজা করে না। পুজা করে দেবতারূপী ভয়কে। ভক্তি হলো ভয়ের একটা অঙ্গ। ভক্তিভরে দেবতার সেবা করি কেন? অন্তিমে সুখ শান্তি পাবো বলেই। পেছনে রয়েছে নরকের সেই চিত্র যা দেখিয়ে দেয় স্বর্গের সুখ শান্তি। কল্পিত নরক যদি সৃষ্টি না করা হতো তা হলে কল্পনায় স্বর্গের সৃষ্টিও মানুষের দ্বারা হতো না।”

প্রতিটি ভ্রমণ রামনাথের মানবতাবাদী রূপটিকেই বিকশিত করছিলো। এর চূড়ান্ত প্রমাণ পাই আমরা রামনাথের নিম্নোক্ত লেখায়। তিনি লিখেছেন “ভাবছিলাম আসামাই মন্দিরের ভেতর দিয়ে যে নালা বয়ে যায় তাতে হিন্দু এবং মুসলমান বসন্ত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ঘোল ঢালে। এই দেশের লোকই গজনীর সুলতান ছিলেন। তারপর ভাবছিলাম আফগানিস্তানের যে দরিদ্র লোক না খেয়ে মরছে তারা হিন্দু না মুসলমান? আগে বাঁচতে হবে তারপর ধর্মের প্রশ্ন।” আজ থেকে শতবর্ষ আগে রামনাথ বিশ্বাস আমাদের মাঝে জ্ঞানের যে স্পৃহা তৈরি করে দিয়ে গেছেন, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এ প্রজন্মের। তিনি যে মানবতার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন, তা ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সমাজের। রামনাথ বিশ্বাসের স্মৃতিকে জাগরুক করে রাখার জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে তার জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বাঙালিও যে বীরের কদর করতে জানে তা রাষ্ট্রকেই প্রমাণ করতে হবে, তবেই না নতুন বীরের জন্ম হবে।