এখানেই আর্জেন্টাইন জাদুকরের অনন্যতা। যেজন্য প্রবল প্রতিপক্ষও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে মুহূর্তের জন্য হলেও থমকে দাঁড়ায়।
Published : 20 Dec 2022, 08:09 AM
সদ্যসমাপ্ত বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে স্নায়ুক্ষয়ী সেমিফাইনাল ম্যাচের পর আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসির মুখোমুখি হয়েছিলেন আর্জেন্টাইন টিভি সাংবাদিক সোফিয়া মার্তিনেস। কয়েক মুহূর্তের জন্য সাংবাদিকের ভূমিকা ছেড়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাড়ে চার কোটি আর্জেন্টাইনের মুখপাত্র। বিশ্বকাপ জিতুন বা না জিতুন, আর্জেন্টিনার জনগণের হৃদয়ের কোথায় তিনি অবস্থান করছেন সেটি অকপটে জানিয়েছিলেন মেসিকে। তিনি বলেছিলেন, ‘সবার শেষে আপনাকে যা বলতে চাই, এটা কোনো প্রশ্ন নয়, আমি শুধু বলতে চাই, পরের ম্যাচটাই বিশ্বকাপ ফাইনাল এবং আমরা আর্জেন্টাইনরা সবাই এটা জিততে চাই। আমি কেবল বলব, ফাইনালের ফল যা-ই হোক না কেন একটা জিনিস কেউ আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। সেটা হচ্ছে, প্রতিটি আর্জেন্টাইনের আবেগের সঙ্গে আপনার নামটি যুক্ত। আর্জেন্টিনায় এমন কোনো কিশোর নেই যার কাছে আপনার জার্সি নেই, হোক না সেটি নকল, আসল বা নিজেদের বানানো। আমাদের সবার জীবনে ছাপ ফেলেছেন আপনি। আমার কাছে এটি বিশ্বকাপের চেয়েও বড়। কেউ এটা নিয়ে নিতে পারবে না আপনার কাছ থেকে। যে আনন্দ আপনি শত শত মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছেন সেজন্য আমার কৃতজ্ঞতা জানবেন। আমি চাই এ কথাগুলো আপনি হৃদয়ঙ্গম করুন কারণ আমি বিশ্বাস করি বিশ্বকাপ জেতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে এবং এরই মধ্যে সেটি আপনার। আপনাকে ধন্যবাদ, অধিনায়ক।’
পারানা থেকে ভিসেন্তে লোপেস, মার দেল প্লাতা থেকে মেন্দোসা--আর্জেন্টিনার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত একজন মানুষও সোফিয়া মার্টিনেসের সঙ্গে দ্বিমত করবেন না। ১৯৮৭-তে রোসারিওতে জন্ম নেয়া পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির ক্ষীণকায় মানুষটি যতই বিনয় দেখান, দিয়েগো মারাদোনার পাশাপাশি আর্জেন্টিনার মানুষের হৃদয়ের সিংহাসনে তাঁর একচ্ছত্র অধিষ্ঠান। সেখানে তিনি কিং লিও।
অবশেষে সহস্র নির্ঘুম রাত পার হয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নটাও তিনি পূরণ করেছেন। সেই ২০০৬ থেকে যে অধরা শিরোপাটা বারবার হাতছানি দিয়েও এড়িয়ে যাচ্ছিল তাঁকে, সেটি করায়ত্ত করতে পেরেছেন। সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলংকার! বিশ্বকাপের শিরোপা হাতে নিয়ে মেসি ধন্য হলেন নাকি মেসির স্পর্শেই ধন্য হলো কাপ, এটা তর্কসাপেক্ষ। তবে বিশ্বের তাবৎ ফুটবলপ্রেমী আপাতত ১৮ ডিসেম্বর রাতে মরুরাজ্য কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের শিরোপা হাতে ফুটবলের রাজার হাস্যময় ছবিটাই হৃদয়ের ফ্রেমে ধরে রাখায় ব্যস্ত। দীর্ঘদিন ধরে ফুটবলপ্রেমীদের মনের মধ্যে গুঞ্জরিত একটি প্রশ্ন, ফুটবলের নিখাদ ভক্তদের হৃদয়ে গুমরে মরা একটি দীর্ঘশ্বাস অবশেষে প্রাপ্তির পূর্ণতায় মীমাংসিত হলো।
নাছোড়বান্দার মতো ঘাড়ে বসে থাকা সিন্দাবাদের ভূতটাকে অবশেষে নামাতে পারলেন মেসি। আট বছর আগে যে প্রাপ্তি হাতের নাগালে এসেও হারিয়ে গিয়েছিল মারাকানার প্রান্তরে, সেটিকে মুঠোবন্দি করতে পারলেন। বার্সেলোনাকে চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা আর আর্জেন্টিনাকে একটি কোপা আমেরিকা এনে দিয়েছেন, নিজের জন্য জিতেছেন সাত-সাতটি ব্যালন ডি’অর, কিন্তু বিশ্বকাপ জেতা অব্দি চারপাশে গুমরে মরা গুঞ্জনটাকে যেন কিছুতেই হার মানাতে পারছিলেন না। তবে কি ক্লাবের মেসিই রয়ে গেলেন তিনি? দেশের হয়ে বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত শিরোপাটা কি আর জেতা হবে না?
১৮ ডিসেম্বর রাতে কী অসাধারণভাবেই না প্রশ্নটাকে চিরদিনের জন্য মাটিচাপা দিলেন মহামতি মেসি। লুসাইলে এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। নতুন করে লিখলেন বিশ্বকাপের ইতিহাস। দু’ দুটো বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার, আর্জেন্টিনার পক্ষে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল, বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে খেলা, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে মাঠে থাকা, গোল করা ও করানোয় বাকি সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া--এর কোনোকিছুই আসলে মেসি জাদুর মাহাত্ম্য বোঝাতে পারবে না। সেটি বুঝতে হলে বল পায়ে মেসিকে দেখতে হবে। এমনকি তিনি যখন মাঠের কোনো কোণায় একা দাঁড়িয়ে আছেন তখনও দেখতে হবে তাঁকে। কারণ যেকোনো মুহূর্তে হ্রস্বকায় সেই শরীরে খেলে যেতে পারে বজ্রবিদ্যুৎ, পায়ের অতুল প্রতিভা নিয়ে তিনি ঝলসে উঠতে পারেন, এমন একটা পাস দিতে পারেন, অথবা দেখাতে পারেন এমন একটা কারসাজি, যা ম্যাচের চেহারাই আমূল বদলে যাবে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল জেতা ইংলিশ স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার যেমনটা বলেছেন, ‘যখনই সে খেলে, কেউ চোখ সরাতে পারে না তার ওপর থেকে। যখনই বল পায়, গ্যালারিতে বসা সবার দম একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। তারা দাঁড়িয়ে যায়, অপেক্ষা করে তার জাদুর জন্য এবং সে জাদু দেখায়। বহু বছর ধরেই সত্যিকারের অসাধারণ এক খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে আসছে সে। কেবল এ বিশ্বকাপের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন সে সত্যিই বিশেষ কেউ এবং আধুনিক জমানায় এ খেলাটা যারা খেলেছে তাদের সবার থেকে সেরা।’ লিনেকার আরো বলেছেন, ‘মেসি এমন কিছু পারে যা আর কেউ পারে না। ছোট্ট একটা জায়গার মধ্যে চার পাঁচজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে পাঁচ গজ দূরের একজনকে নিখুঁত পাস দিতে পারে সে, বা এমন একটি পাসের কথা কল্পনা করতে পারে যেটি আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এবারের বিশ্বকাপেই সে বারবার করে দেখিয়েছে এটা, যেমন করেছে গোটা ক্যারিয়ার জুড়ে।’
এখানেই আর্জেন্টাইন জাদুকরের অনন্যতা। যেজন্য প্রবল প্রতিপক্ষও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে মুহূর্তের জন্য হলেও থমকে দাঁড়ায়। বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে তাকায় বল পায়ে মানুষটার দিকে। মনে মনে ভাবে, আসলেই রক্তমাংসের মানুষতো সে? নাকি ভিনগ্রহের কেউ? ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে এ বিশ্বকাপের অন্যতম আবিষ্কার, ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরী জস্কো ভার্ডিয়ল মেসির কয়েক মুহূর্তের জাদুমন্ত্রে আবিষ্ট হতে হতে বুঝেছেন, এক অতিমানবের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন তিনি। বয়সে তার বছর পনেরর বড় বটে, তবে গতি ও কৌশলের লড়াইয়ে এই জাদুমানবের সমতুল্য হতে বহুদূর পথ পাড়ি দিতে হবে তাঁকে।
তবে কি সেই প্রশ্নটার চূড়ান্ত মীমাংসা হয়ে গেছে? মেসিই সর্বকালের সেরা? বলা দুষ্কর। আসলে এক যুগের খেলোয়াড়ের সঙ্গে আরেক যুগের খেলোয়াড়ের তুলনা করা সহজ নয়, সম্ভবত উচিতও নয়। তাছাড়া হাজার তর্ক করলেও এ প্রশ্নের মীমাংসা কোনোদিন হবে না। আপাতত বোধহয় ১৯৮৬-তে দিয়েগো মারাদোনার বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনার দলের সদস্য হোর্হে বুররুচাগার অভিমতটাকেই মেনে নেয়া যাক। তিনি বলেছিলেন, সর্বকালের নয়, মেসি তাঁর সময়ের খেলোয়াড়দের মধ্যে সেরা। পাঁচজন ফুটবলারের নাম বলেছিলেন তিনি, যাঁদের সর্বকালের সেরা বলে মানেন। এঁরা হলেন আলফ্রেদো দি স্তেফানো, জোহান ক্রুইফ, পেলে, মারাদোনা ও মেসি। সংক্ষিপ্ত এ তালিকায় তিন-তিনজন স্বদেশীর নাম রাখায় কেউ কেউ হয়তো পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলবে তাঁর বিরুদ্ধে।
তাহলে বরং কে প্রথম আর কে দ্বিতীয় সে বিতর্কে না গিয়ে আপাতত লিওনেল আন্দ্রেস মেসি নামের ফুটবল জাদুকরের বন্দনাতেই মেতে ওঠা যাক।