Published : 10 Oct 2024, 12:22 PM
এস এম সুলতান (১৯২৩-১৯৯৪) ছিলেন একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিভাবান এক শিল্পী। এ বছর তাঁর জন্মের শতবর্ষ। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ১০ই অক্টোবর তারিখে তিনি পরলোকগমন করেন। জীবন, রাজনীতি এবং শিল্প সম্পর্কে একটি ভিন্ন দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি । তাঁর জীবন ছিল সুখে দুঃখে ভরা, বর্ণিল আর ঘটনাবহুল। শিল্পচর্চায় প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য ভেঙে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তার শিল্পকর্মকে বাংলাদেশের কৃষক এবং শ্রমিক শ্রেণীর যাপিত জীবনের চিত্র এবং গল্প দ্বারা চিহ্নিত করা যায়।
এস এম সুলতান বা শেখ মুহাম্মদ সুলতান, যিনি লাল মিয়া নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত নড়াইল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪০-এর দশকে কলকাতার আর্ট স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সব এলাকা ঘুরে দেখেন।
তিনি নিয়মিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ থেকে শিল্প প্রতিযোগিতা এবং শিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পেতেন। ১৯৫০ এর দশকে সুলতান বিলেতে একটি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন যেখানে পিকাসো, সালভাদর ডালি এবং অন্যান্যদের মতো বিশ্ববিখ্যাত নির্মাতাদের শিল্পকর্ম উপস্থাপন করা হয়েছিল। সুলতান ছিলেন এশিয়ার প্রথম শিল্পী যিনি এমন মর্যাদাপূর্ণ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। পরে ১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে "দ্য ম্যান অফ এশিয়া" হিসাবে সম্মানিত করে।
ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে শৈল্পিক কারুকাজ শিখেছিলেন এসএম সুলতান। বাবা ছিলেন নির্মাণ শ্রমিক, নড়াইলের এক জমিদার পরিবারে কাজ করতেন। জমিদার পরিবারের সমবয়সী ছেলের কাছে থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে সুলতান কলকাতার আর্ট স্কুলে পড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর্ট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হলে একজনকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হতে হয়। দারিদ্র্যের কারণে সুলতানের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার সুযোগ পাননি।
সুলতান নাছোড় বান্দা। তিনি আর্ট স্কুলে ভর্তি হবেনই। নড়াইলের জমিদারের পরিচিতির সূত্রে বালক সুলতান প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, কবি, অনুবাদক, শিল্প সমালোচক এবং কূটনীতিক হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করেন। যিনি বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বড় ভাই ছিলেন। হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশের পর আর্টস্কুলের অধ্যক্ষ এস এম সুলতানকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবার সুযোগ দেন। আর্ট স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মোট চার শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে এস এম সুলতান সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন। এরপর কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলেন।
সুলতানের আর্থিক অসঙ্গতির কথা বুঝতে পেরে হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছেলেটিকে তার বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। হাসান সোহরাওয়ার্দী সুলতানকে তার পারিবারিক গ্রন্থাগার ব্যবহারের অবাধ সুযোগ দিয়েছিলেন। লাইব্রেরিটি ভারত ও অন্যান্য দেশের বইয়ে ঠাসা ছিল, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় লেখা সেসব বই। শিল্প থেকে শুরু করে ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, প্রকৃতি, বিজ্ঞান ও রাজনীতি সবকিছুই পড়ার সুযোগ ছিল গ্রন্থাগারটিতে। সুলতান যতটা সম্ভব সব গোগ্রাসে পড়েছিলেন।
আর্টস্কুলে যাওয়া আসার জন্যে জন্য হাসান সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের অধিকার পেয়েছিলেন। তিনি রাজপুত্রের মতো জীবনযাপন করতেন। আর্টস্কুলের প্রথম বছরে সুলতান সমাপনী পরীক্ষায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। আর্টস্কুলে চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময়ে তিনি পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল আর্ট স্কুলে যা তার শেখার ছিল তা তাঁর শেখা হয়ে গেছে। তার চিন্তাভাবনা এবং মনোযোগ ভারতীয় উপমহাদেশের চারপাশে ভ্রমণ এবং মানুষের পাশে দাঁড়াবার দিকে ঝুঁকেছিল। তিনি হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে তার পরিকল্পনা তুলে ধরেন করেন এবং ব্যাখ্যা করেন যে আর্ট স্কুলের ছয় বছরের পড়াশোনা কার্যক্রম তাঁর জন্যে অহেতুক দীর্ঘ। আর্ট স্কুলের বাকি পড়াশোনা তিনি আর চালিয়ে যেতে চান না।
সুলতানের ইচ্ছাকে হাসান সোহরাওয়ার্দী সম্মান করেছিলেন। তিনি সুলতানের হাতে বেশকিছু টাকাও দিয়ে দিলেন। এরপর সুলতান এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যে, এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। তিনি ছবি এঁকেছেন, মানুষের প্রতিকৃতি তৈরি করেছেন। এভাবে তিনি অর্থ উপার্জন করেছেন। তিনি হয়ে উঠলেন বাউল, পথে পথে চলা গীতিকবি।
শিল্পচর্চার পাশাপাশি তিনি বাঁশিও বাজাতে পারতেন। এই উভয় দক্ষতাই তাকে অর্থ উপার্জন এবং জনসাধারণের সম্মান অর্জনের সুযোগ এনে দিয়েছিল। এই যোগ্যতা তাঁর জীবিকা চালিয়ে নিতে কাজে দিয়েছিল।
সবাই সুলতানকে সমীহ করে স্বাগত জানাত। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে ব্রিটিশ সৈন্যদের ছবি আঁকতেন আর তাদের কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করতেন। তিনি ভারতের সিমলা শহরে প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী করেছিলেন।
সুলতান ভারতবর্ষের নগরে নগরে পথে পথে ঘুরে ছবি আঁকেন। যেখানে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সেখানেই রাত্রিযাপন করেন। এর মধ্যে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। এসবের কোনো দিকেই সুলতানের খেয়াল ছিল না। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত আর পাকিস্তান নাম আলাদা দুটি দেশ হয়ে গেছে। ভারতের একটি স্টেশনে হঠাৎ একটি ঘোষণা শুনতে পেলেন। ঘোষণাটি ছিল এরকম, আসন্ন বাসটি পাকিস্তানের লাহোরে যাওয়ার শেষ বাস। এরপর আর কোনো বাস যাবে না।
সুলতান বাসে উঠে পাকিস্তানের উদ্দেশ যাত্রা শুরু করেন। পেছনে ভারতবর্ষের নানা জায়গায় রয়ে গেল তার আঁকা শত শত ছবি। সঙ্গে তিনি কিছুই নিতে পারলেন না। পাকিস্তান পৌঁছে ছবি আঁকা চালিয়ে গেলেন। লাহোর’সহ পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে ছবির প্রদর্শনীর মাধ্যমে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেন।
১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে পূর্ববঙ্গে (বর্তমানে বাংলাদেশ) তার নিজ গ্রামে ফিরে আসেন সুলতান। সেখানে তিনি বনের একটি খালি বাড়িতে লোকচক্ষুর আড়ালে, অনেকটা নামপরিচয়হীন আগন্তুক হিসেবে থাকতেন। কেউ জানতো না তিনি একজন শিল্পী। গ্রামের দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের সঙ্গে তার আন্তরিক যোগাযোগ গড়ে উঠে।
কয়েক বছর পরে, একটি আন্তর্জাতিক সংস্কৃত বিনিময় কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমেরিকার মাটিতে অনুষ্টিতব্য একটি আয়োজনের জন্যে পাকিস্তান থেকে শিল্পী বাছাই করতে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দল । পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এস এম সুলতানকে মনোনয়ন দিতে চায়নি কিন্তু আমেরিকান প্রতিনিধি দল তাকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছিল। মার্কিন প্রতিনিধিদল এর মধ্যে সুলতানের শিল্পকর্ম সম্পর্কে আগাম ধারণা লাভ করেছিলেন।
পরে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ নড়াইলের স্থানীয় প্রশাসনকে সুলতানের বিষয়ে বার্তা পাঠায়। সরকার স্থানীয় প্রশাসনকে এস এম সুলতানের তৎকালীন পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে এবং তারপর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে। এই নির্দেশনা পেয়ে নড়াইলের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ শিল্পীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু এসএম সুলতান নামের শিল্পীকে কেউ চিনত না। তারা এসএম সুলতান নামে একজনকে চিনত যিনি জঙ্গলের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকেন। তারা শুধু জানত তিনি একজন বোহেমিয়ান। বোহেমিয়ান মানুষ কি আসলেই একজন শিল্পী তা মানুষের বোধগম্য ছিল না।
অবশেষে স্থানীয় প্রশাসন যখন সুলতানকে খুঁজে পেল, তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন তিনি আসলেই একজন শিল্পী কিনা। এস এম সুলতান হ্যাঁ সূচক জবাব দেন।
সরকারি কর্মকর্তা বললেন: আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না। আপনি যদি সত্যিকারের শিল্পী হন, তবে আপনি অবশ্যই আমার সামনে কিছু আঁকবেন।
তারপর সুলতান ছবি এঁকেছেন। সরকারি আমলা সন্তুষ্ট হবার মত প্রমাণ পেয়ে গেলেন। এরপর সুলতান করাচি যান এবং তারপর যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সুলতান একটি প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রতিযোগিতার মধ্যে ছিল একজন নর্তকী প্রতি মিনিটে একটি করে 'ভঙ্গি' প্রকাশ করবেন, এক ঘন্টার মধ্যে, নর্তকী এভাবে ষাটটি ভঙ্গি করেছিলেন। আর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সারাদুনিয়া থেকে আগত শিল্পীরা একটি করে ষাটটি ছবি আঁকবেন। সারা বিশ্বের শিল্পীরা প্রতিটি পোজ অনুযায়ী ছবি এঁকেছেন। প্রতিযোগিতায় সুলতান তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।
তিনি অনেক সম্মান পেয়েছেন, মানুষ তাকে পছন্দ করেছে। তিনি ছবি আঁকতেন, বাঁশি বাজাতেন এবং বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। বাড়ি ফেরার পথে তিনি ইউরোপ সফর করেন; ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন এবং নেদারল্যান্ড ভ্রমণ করেন। আমেরিকা আর ইউরোপের নানা শহরে ছবির প্রদর্শনী, ছবি আঁকা এবং বাঁশি বাঁজানোর জন্যে অসংখ্য আমন্ত্রণ পান।
সুলতানের শিল্পকর্ম ১৯৪৬ সালে ভারতের সিমলা শহরে এবং ১৯৪৮-৪৯ সালে পাকিস্তানের লাহোর ও করাচিতে প্রদর্শিত হয়েছিল। ১৯৫০-এর দশকে নিউইয়র্ক, বোস্টন, লন্ডন এবং মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শিত হয়েছিল। বিদেশের অইসব প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৭৬ সালে দেশের জাতীয় চিত্রগ্যালারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে প্রদর্শনী আয়োজনের অনেক আগেই।
উড়িষ্যার একটি হিন্দু মন্দিরে কয়েক বছরকাজ করেছিলেন সুলতান। ওখানে তিনি বৈষ্ণব বা বাউলের মতো বেশ কিছু আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তিনি মুসলিম ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে নিজ জীবনে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, প্রকৃতি ও প্রাণীদের প্রতি অনুরাগী ছিলেন।
তিনি রাজপুত্রের মতো বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু একজন সাধারণ, দরিদ্র ব্যক্তির মতো জীবনযাপনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি প্রতিকূলতা, বাধা এবং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অনুভব করেছিলেন তার যাপিত জীবনে। ক্ষুধার্ত জীবন আর নিপীড়িত জীবনের অভিজ্ঞতা তিনি লাভ করতে পেরেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামবাসীদের সংস্পর্শে তিনি সম্মানিত বোধ করতেন। যেই জনপদে তিনি জন্মেছিলেন, বেড়ে উঠেছিলেন সেই জনসমাজে তিনি ফিরে ফিরে এসেছেন।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাকে রাজধানী ঢাকায় সরকারি আবাসিক শিল্পী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনি এই প্রস্তাব গ্রহণ করে কিছুকাল ঢাকায় বসবাস করেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে তিনি আগ্রহ হারিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন। সরকার তার জন্য গ্রামে একটি নতুন বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছিল এবং আজীবন বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিল। তিনি শিল্পী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সব রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
একবার বাংলাদেশের এক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া সুলতানের কাছে ছবি আঁকা শিখতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সুলতানকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণ পেয়ে সুলতান গ্রাম থেকে রাজধানীতে আসেন। 'সোনারগাঁও প্যান প্যাসিফিক' পাঁচ তারকা হোটেলে সুলতানের জন্যে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং একটি সরকারি গাড়ি বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রতি সন্ধ্যায় সেনা সদস্যরা সুলতানকে ক্যান্টনমেন্টের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাসায় নিয়ে যেতেন। এসবের কিছুই সুলতানকে ধরে রাখতে পারল না। বিত্তবৈভবের বনেদি জীবনযাপন তাকে টানল না। এসব ছেড়ে দুই সপ্তাহ পর সুলতান গ্রামে ফিরে গেলেন। এসএম সুলতান দক্ষিন পশিচমাঞ্চলের জনপদে বামপন্থী সর্বহারা রাজনীতির মানুষদের সঙ্গেও সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। তিনি মিশেছেন গ্রামের খেটে খাওয়া গরিব মানুষদের সঙ্গে। গ্রহণ করেছেন তাদের আতিথ্য। তাদের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়েছেন আপন আত্মীয়ের মত।
একবার তিনি সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের চায়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। চা পর্বের একপর্যায়ে শিল্পী এসএম সুলতান রাষ্ট্রপতির পত্নীকে জিজ্ঞেস করেছেন, আপনি কি জানেন বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ভোরের দিকে শিশুরা কাঁদে কেন।
রাষ্ট্রপতির পত্নী অপরাগ হয়ে সুলতানকেই এর উত্তর দিতে বলেছেন। সুলতান জানিয়েছেন, ভোরের দিকে শিশুরা ক্ষুধার্ত থাকে। দরিদ্রপীড়িত গ্রামের মায়েদের কাছে ভোরবেলায় শিশুর মুখে দেবার মত কোনো খাবার প্রায়শই থাকে না। তাই শিশুরা কাঁদে। এরকম ছিল শিল্পী সুলতানের পর্যবেক্ষণ শক্তি।
তিনি শিশুদের জন্যে শিশুস্বর্গ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এখানে একটি চিড়িয়াখানা, শিশুদের জন্য একটি স্কুল এবং একটি বড় নৌকায় অবস্থিত আরো একটি স্কুল রয়েছে। ওখানে শিশুরা উচ্ছ্বাসপূর্ণ অভিজ্ঞতায় ভরা কল্পনার জগতে সময় কাটায় । তিনি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আরো কয়েকটি স্কুল এবং আর্ট স্কুলও প্রতিষ্ঠা করে যান।
ছবিতে তিনি বিত্তবানদের যাপিত জীবনকে চিত্রিত করতে চাননি। তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল দরিদ্র মানুষের জীবন আর তাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সত্য ও সুন্দরের প্রচার করা। এটাই ছিল তাঁর দর্শন। তিনি তাঁর মাতৃভাষা বাংলাকেই তাঁর ধর্ম বলে মনে করতেন। ভারতীয় উপমহাদেশের অগ্রগণ্য শিল্পী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও তিনি বরাবরই বাঙালি ছিলেন।